বিশ্বরূপ মজুমদার
কুয়াশার ভেতর থেকে ছায়ামূর্তি বেরিয়ে ফেলুদাকে ধাক্কা দিয়েছে খাদের দিকে। ‘দার্জিলিং জমজমাট’ গল্প পুরো জমে ক্ষীর। ঠিক সেই সময় কলিং বেল সশব্দে তার উপস্থিতি জানান দিল। বিরক্তই হল তীর্থ। এটাই হচ্ছে ওর প্রবলেম। গল্প একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। ব্যাজার মুখে দরজা খুলেই দেখতে পেল থমথমে মুখে সাদার ওপর ফুলফুল নকশার সিল্কের শাড়ি পরে বছর চল্লিশের এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তীর্থ কিছু বলার আগেই ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, “আপনিই কি গোয়েন্দা তীর্থ চট্টরাজ? ঋতমা আপনার ঠিকানা দিয়েছে।” নিজের নামের সঙ্গে গোয়েন্দা তকমাটা জুড়ে দেওয়ায় মনে মনে বেশ খুশি হয়ে উঠল তীর্থ। আর ঋতমার ওপরেও মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। গত মাসেই ঋতমার একটা সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিল সে।
একটু সৌজন্যমাখা হাসি হাসল তীর্থ। “ভেতরে আসুন। আমিই তীর্থ।”
ভেতরে এসেই সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন ভদ্রমহিলা। “একটু জল খাওয়াবেন ভাই?”
তীর্থ ফ্রিজ থেকে একটা বোতল বের করে ভদ্রমহিলার সামনের ছোট্ট সেন্টার টেবিলে রাখল। ভদ্রমহিলা ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে বলল, “নমস্কার। আমি মিসেস সুতপা মল্লিক। রয় অ্যান্ড রয় কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার অন্বয় মল্লিকের স্ত্রী।”
এইবার তীর্থ বুঝতে পারল কেন প্রথম থেকেই ভদ্রমহিলাকে চেনা চেনা লাগছিল। অন্বয় মল্লিকের স্ত্রী! ভদ্রলোক তো দিন পাঁচ-ছয়েক আগেই নিজের ঘরে সুইসাইড করেছেন! পেপারে ফলাও করে খবরটা বেরিয়েছিল।
তীর্থকে চিন্তান্বিত দেখে সুতপাই কথা বলল। “মাসখানেক আগে অন্বয় বেস্ট ওয়ার্কিং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল। পেপারে ছবি বেরিয়েছিল। দেখেছেন নিশ্চয়ই। সেটা পাওয়াই ওর কাল হয়েছিল। না পেলে হয়তো…” শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কান্নাকে সামলাল সুতপা।
তীর্থ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল সুতপার দিকে। “কেন? কেউ কি সহ্য করতে পারেনি অন্বয়বাবুর এই সাকসেস? আপনি জানেন সে কে?”
“না সে কে সেটা জানি না। আর সেই কারণেই আপনার কাছে এসেছি।”
“আপনার কেন মনে হল যে কেউ এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি… আর তাই…!”
“কারণ তারপর থেকেই ওর ফোনে আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসতে শুরু করে। কে বা কারা ওকে ফোন করত জানি না। আর কেনই বা করত সেটাও জানি না। তবে তাতে যে ও ভীষণ ভয় পেত সেটা বুঝতাম। সারারাত ভয়ে ছটফট করত।”
“আপনি ওঁকে জিজ্ঞেস করতেন না যে কেন উনি ভয় পান? বা কে ফোন করছে?”
“জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘তুমি এসব বুঝবে না।’”
“মৃত্যুর রাতে ঠিক কী কী ঘটেছিল পুরো ডিটেলসটা আমায় বলবেন প্লিজ! তাহলে আমার কাজ করতে সুবিধা হবে।”
“হ্যাঁ। হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।”
একটু দম নিয়ে সুতপা দেবী বলা শুরু করলেন, “রাত প্রায় এগারোটা। আমাদের ছোট্ট মেয়ে মিমিকে আগেই খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি ওর ঠাম্মার কাছে। আমি আর অন্বয় খাচ্ছি। অন্বয় খাচ্ছে আর কী যেন ভাবছে। চামচ দিয়ে অর্ধেক খাবার প্লেটেই পড়ে যাচ্ছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী গো। তোমার শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’ কোনও উত্তর দিল না ও। হঠাৎই অন্বয়ের ফোনটা বেজে উঠল। প্রথমবার রিং হয়ে গেল। ধরল না। দ্বিতীয়বার আমি ধরতে যেতেই ও আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে নিজেই রিসিভ করল।”
তীর্থ এবারে কথা বলল। “উনি কী বলছিলেন ফোনে?”
“নাহ! ও কিছুই বলেনি। শুধু শুনছিল চুপ করে। মিনিট দুই তিন পরে ফোনটা কেটে সুইচড অফ করে দেয়। তারপর আর খায়ও না। আমি জিজ্ঞেস করতেই বলে পেট ভরে গেছে। অফিসের কাজের অছিলায় আমাকে শুয়ে পড়তে বলে দোতলায় ও যে ঘরে বসে কাজ করে সেখানে ঢুকে যায়।”
“ওই ঘরে উনি কী করছিলেন দেখেছিলেন ম্যাডাম?”
“হুম। শোয়ার আগে দেখেছিলাম বইকি। ও কম্পিউটারে কীসব যেন দেখছিল। আমি ওকে বলেছিলাম যে, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। বেশি রাত কোরো না। বলে আমি শুয়ে পড়েছিলাম। আর সেদিন রাতে ঘুমিয়েও পড়েছিলাম তাড়াতাড়িই। তারপর যখন ঘুম ভাঙল তখন রাত দুটো বাজে বোধহয়। অন্বয়কে বিছানায় দেখতে না পেয়ে নীচে নেমে দেখি দোতলার ওই ঘরেই খাটে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। এমনিতেই কিছুদিন ধরে ছটফট করছিল। দেখতেও কেমন যেন সিক লাগছিল। তাই ভাবলাম ঘুমোচ্ছে যখন ঘুমাক। ঘুমটা হলে শরীরটা ভালো লাগবে। কিন্তু কে জানত যে সেই ঘুম আর কোনওদিনও ভাঙবে না! ভাবতে পারিনি। সত্যিই ভাবতে পারিনি।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সুতপা। তীর্থ কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের রিলেশান কেমন ছিল? আই মীন কঞ্জুগাল লাইফ? ওয়্যার ইউ হ্যাপি কাপল?”
সুতপা চোখ মুছতে মুছতে বলল, “আমাদের যারা খুব ক্লোজ তারা বলত উই আর মেড ফর ইচ আদার।”
“আপনাকে সব কথা শেয়ার করত অন্বয়বাবু?”
“সবই করত। শুধু এই ফোনটার ব্যাপারটা ছাড়া। ও কেন যে এই ব্যাপারটাতে আমাকে এড়িয়ে চলত সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আমাকে যদি বলত তাহলে হয়তো এই অঘটনটা ঘটত না!”
অন্বয়ের ব্যাপারে আরও কিছু খুঁটিনাটি জানার পরে তীর্থ বলল, “তা কী করতে পারি আপনার জন্যে ম্যাডাম?”
সুতপা সোজাসুজি তীর্থর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি চাই আপনি অপরাধীকে খুঁজে বার করুন।”
“কিন্তু সেক্ষেত্রে আমার অন্বয়বাবুর ফোনটা একবার দেখা দরকার। ফোনটা এখন কোথায় আছে?”
“ওটা রাতে ওর কাছে ছিল না। ও সুইচড অফ করে ডাইনিং-এই রেখে দিয়েছিল। তাই ওটা পুলিশ দেখে ফেরত দিয়ে দিয়েছে।”
তীর্থ সবিনয়ে বলল, “আমি আমার লেভেল বেস্ট চেষ্টা করব ম্যাডাম। কাল একবার আপনাদের বাড়ি আসতে পারি?”
“অবশ্যই আসুন।”
সুতপা ওদের বাড়ির ঠিকানাটা লিখে দিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল। সুতপা চলে যেতেই তীর্থ গালে হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা সাজাতে চাইল পরপর। কেউ একজন অন্বয়কে বিশেষ কিছু বলে ভয় দেখাচ্ছিল। তার মানে অন্বয়ের কিছু একটা দুর্বলতার জায়গা নিশ্চিত ছিল যেটা সুতপার অজানা। আর সেই কারণেই বিষয়টা ওর কাছে লুকিয়েছিল। কিন্তু কী সেই দুর্বলতা যা কিনা এত বড় পজিশানে থাকা সত্ত্বেও তাকে ভীত করেছিল!
* * * * *
তীর্থ পুরো দশটায় সুতপার লিখে আসা ঠিকানা ধরে পৌঁছে গিয়েছিল অন্বয় মল্লিকের বালিগঞ্জের বাড়িতে। বিরাট বড় তিনতলা বাড়ি। বেল টিপতেই একটা বছর কুড়ির মেয়ে দরজা খুলে দিল। “কাকে চাই?” জিজ্ঞেস করতে সুতপা মল্লিকের নাম করতেই মেয়েটি দোতলার ড্রয়িং রুমে তাকে নিয়ে গিয়ে বসাল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সুতপা এল। বাড়িটা বেশ শান্ত মনে হল তীর্থর। সুতপা মুখোমুখি সোফাতে বসতেই তীর্থ বলল, “বাড়িতে এখন কে কে আছেন?”
“আমি, অন্বয়ের মা, আমার মেয়ে আর দুজন পরিচারিকা।”
“আত্মীয়স্বজন সব…! সবাই চলে গেছে?”
“হ্যাঁ। চারদিনে কাজ হল। কাজের পরদিনই মোটামুটি যেতে আরম্ভ করেছিল। আর যে ক’জন ছিল তারাও আজ সকালে চলে গেছে। তাছাড়া সবাই আসেওনি। এইরকম ঘটনাতে কেই বা আসতে চায়!”
কথা বলার মধ্যেই যে মেয়েটি দরজা খুলে দিয়েছিল সেই মেয়েটিই একটা ট্রের মধ্যে কেক চা ইত্যাদি নিয়ে এল। তীর্থ সুতপার সঙ্গে গিয়ে অন্বয় যে ঘরে সুইসাইড করেছিল সেই ঘরটা ঘুরে এল। ঘরটা বেশ বড়সড়। একপাশে টেবিল, টেবিলে কম্পিউটার, পেনদানি, কিছু ফাইলপত্র। পাশে কিছু ড্রয়ার। ড্রয়ারেও ফাইল আর কাগজপত্র। একটা ড্রয়ারে ফাইলের ওপর একটা ডায়েরি দেখে সে হাতে তুলে নিয়ে বলল, “এটা আমি নিতে পারি দিন দুয়েকের জন্যে?”
“নিন না।”
ঘরটা দেখে তীর্থ বেশ বুঝতে পারল যে ঘরটা অন্বয় তার অফিসের কাজেই ব্যবহার করে।
তারপর তীর্থ তিনতলার সবকটা ঘর ঘুরে শেষে গেল অন্বয়ের মায়ের ঘরে। অন্বয়ের মা কাঁদতে কাঁদতে বারেবারেই বললেন, “পারলাম না ছেলেটাকে ধরে রাখতে। আমাকে ও ফাঁকি দিয়ে চলে গেল!” তবে তীর্থ ওঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারল অন্বয় মানুষটা শুধু তার অফিসের প্রতিই ডেডিকেটেড ছিল না। সে সেইসঙ্গে তার ফ্যামিলির প্রতিও ভীষণ রেসপন্সিবল ছিলেন। তবে সাংসারিক বিষয়টা সুতপাই দেখত। অফিসের পরে কিছু কিছু দিন ছোটবেলার কিছু বন্ধুরা যেমন সমর, দীপক, সাহেব এদের সঙ্গে ড্রিঙ্ক করত। তবে সাধারণত মাতাল হত না।
পুরো বাড়িটাই বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তীর্থ বুঝতে পারল যে নীচের তলায় পরিচারিকারা থাকে। তার সঙ্গে ভাঁড়ার ঘর এবং রান্নাঘর। দোতলায় ড্রয়িং, ডাইনিং আর অফিসের কাজের জায়গা আর গোটা তিনতলা জুড়ে বেডরুম।
সুতপার অনুমতি নিয়ে অন্বয়ের তিনটে ফোনই ঘেঁটে ঘেঁটে দেখে নিল। আননোন নাম্বার থেকে যে কলগুলো আসত সেই ফোনটার সেটিংস-এ গিয়ে দেখল এই ফোনের প্রত্যেকটা কল অটোমেটিক রেকর্ড হয়ে গেছে। এটা যে তার জন্য বিরাট সুখবর তা বলাই বাহুল্য। ব্লুটুথ অন করে মাসখানেক ধরে আসা আননোন কলের রেকর্ডগুলো তার নিজের ফোনে নিয়ে নিল। বাড়ি ফিরে ধীরে সুস্থে শুনতে হবে সবকটা রেকর্ড। কারণ এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে অন্বয় মল্লিকের মৃত্যু রহস্য। সুতপার কাছ থেকে অন্বয়ের বন্ধুদেরও নাম্বার নিয়ে নিল। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললে অন্বয় সম্পর্কে আরও অনেক বেশি তথ্য পাওয়া যাবে।
বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়েই ফোন নিয়ে বসে পড়ল। কয়েকটা ফোন কোম্পানির কলারটিউন সংক্রান্ত। আননোন নাম্বারের প্রথম ফোনটা আসে ২৬ মার্চ রাত দশটায়। কথা হয় মাত্র কুড়ি সেকেন্ড। সেদিন বিশেষ কিছুই কথা হয়নি। ফোনটা ধরে অন্বয় হ্যালো হ্যালো বলে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা ফিসফিসে কণ্ঠ বলে উঠল, “কেমন আছ অন্বয়? চিনতে পারছ আমায়?” ব্যস। এরপরেই কেটে গেল ফোনটা।
আবার নতুন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে দিন দুয়েক বাদে। এবারে আর আড়াল আবডাল নয়। ফিসফিসে কণ্ঠস্বর সরাসরি বলল, ‘হায়দেরাবাদের সেই কেসটা মনে আছে তো? সেই খুনটা? আমি কিন্তু সব জানি। আপনি কি চান আপনার স্ত্রীকে, আপনার অফিসে সব রটিয়ে দিই?’
এবার অন্বয়ের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ‘নাহ! প্লিজ। কাউকে কিছু বলবেন না। কী চান বলুন আপনি।’
‘টাকা চাই। টাকা।’
‘টাকা!’
‘হ্যাঁ। আপাতত লাখ দুই দাও।’
‘দু’ লাখ!’
‘কেন? খুব বেশি বলে ফেললাম নাকি? একটা অসহায় মেয়ের প্রেগন্যান্সি, তাকে খুন করা, তার দাম কি এর কম হয় মিস্টার মল্লিক?’
‘না মানে… ঠিক আছে।’
‘তাহলে কাল বিকেল চারটের সময় খাইখাই রেস্টুরেন্টে ১০২ নাম্বার কেবিনে টাকাটা রেখে বেরিয়ে আসবে। আর একটা কথা। পুলিশকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করলে আমি নিজেই পুলিশকে সব সত্যি জানিয়ে দেব। তখন জেল হাজত কে আটকাবে তোমার! তখন না থাকবে চাকরি আর না থাকবে সম্মান…’
‘না। আমি পুলিশকে জানাব না।’
তারপরের কল আবার দিন আষ্টেক পর। কনভারসেশন প্রায় একই রকম। টাকার অঙ্কটাও এক। মোট তিনবার টাকা চেয়েছে। অর্থাৎ ছয় লাখ টাকা অলরেডি অন্বয়ের কাছ থেকে নেওয়া হয়ে গিয়েছে। ২৪শে এপ্রিল অর্থাৎ যেদিন শেষ কল আসে সেদিন দশ লাখ টাকা ডিম্যান্ড করে লোকটা। অন্বয় বারেবারে বলছে, ‘এভাবে ব্ল্যাকমেল করছেন কেন? এত টাকা পাবই বা কোথায়? আমি আর একটা টাকাও দিতে পারব না আপনাকে। যা করার করে নিন আপনি।’
তারপরেই ফোনটা কেটে গেল। তীর্থ বুঝল যে ফোন করেছে সে কখনও আপনি আবার কখনও তুমি বলছে। তার মানে লোকটা অন্বয়ের খুব চেনা কেউ।
ব্যাঙ্কের বইসহ তীর্থ অন্বয়ের ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সঙ্গেও দেখা করল। সত্যি সত্যিই ছয় লাখ টাকা তুলেছিল অন্বয়। এর বেশি কিছুই ম্যানেজার বলতে পারল না। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের বিষয়ে বালিগঞ্জের ওসি সুপ্রকাশ সান্যালের সঙ্গেও কথা বলল। উনি বললেন পুলিশের ধারণা এমনই ডিপ্রেশান থেকেই এই সুইসাইড। “আর ফোন কলগুলো?” তেমন কোনও সদুত্তর দিতে পারল না অফিসার। তীর্থ বুঝতে পারল কেন সুতপা পুলিশের ওপর ভরসা না রেখে তীর্থর কাছে ছুটে গিয়েছিল। থানা থেকে ফেরার সময় তীর্থ সুপ্রকাশবাবুকে বলে এল, “এই কেসটা আমি নিয়েছি স্যার। যদি আপনার সাহায্য লাগে পাব তো?”
সুপ্রকাশবাবু লোক মন্দ নয়। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “যে কোনও প্রয়োজনে বলবেন মশাই। যথাসাধ্য সাহায্য করব।”
এরপর তীর্থ অন্বয়ের সব বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করল। সমরবাবু ট্যাক্স অফিসার। তার অফিসে গিয়েই দেখা করতে হল। যে কোনও সময় যে কোনও সাহায্য করতে সে প্রস্তুত, জানিয়ে দিল সে। তারপর গেল সাহেবের কাছে। লোকটা সত্যি সাহেবদের মতোই ফর্সা। সাহেব বাড়িতেই ছিল। অন্বয়ের সঙ্গে সে ক্লাস এইট থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে। এখন একটা কলেজের প্রফেসার। বেশ দিলখোলা মানুষ। বন্ধুদের ড্রিঙ্কসের আড্ডায় সেই বেশি কন্ট্রিবিউট করত। একেবারে শেষে গেল দীপকের কাছে। বছর বিয়াল্লিশের দীপক অনেক জায়গায় অনেক চাকরি করেছিল বটে। কিন্তু কোনও চাকরিতেই বিশেষ মন বসাতে পারেনি সে। তারপর তীর্থ তার বন্ধু শেখরের সঙ্গে দেখা করল। শেখর ভয়েস স্পেশালিস্ট। যে উত্তরটা তীর্থ এতদিন ধরে খুঁজছিল তা সে পেয়ে গেছে।
সুতপা তীর্থকে দায়িত্ব দেওয়ার ঠিক সাতদিনের মাথায় ফোন করে বলল, ‘কাল ঠিক সন্ধে সাতটায় অপরাধীকে ধরিয়ে দেব।’ ওসি সুপ্রকাশবাবুকেও বলে দিল ফোর্স পাঠাতে। অন্বয়ের সব বন্ধুদেরও আসার জন্য অনুরোধ করল।
ঠিক সন্ধে সাতটার সময় সুতপার বাড়ি পৌঁছে তীর্থ দেখল তার টোপে কাজ হয়েছে। আসল লোক অন্য সকলের সঙ্গে উপস্থিত রয়েছে সেখানে। তীর্থ কোনও ভণিতা ছাড়াই সমরের দিকে তাকিয়ে বলল, “অন্বয় মল্লিকের সঙ্গে লাস্ট কবে কথা হয়েছে আপনার?”
সমর যেন একটু ভয় পেলেন। “ওই যেদিন ও সুইসাইড করল সেদিনও কথা হয়েছে ওর সঙ্গে। ওর সঙ্গে বসারও কথা ছিল আটটার সময়। কিন্তু আমার একটা কাজ এসে পড়ায় আসতে পারব না জেনেই ওকে ফোন করে জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ওর মৃত্যুর জন্যে দায়ী নই। বিশ্বাস করুন। আমরা সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। না, ওর মতো অত উঁচু লেভেলে পৌঁছোতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে হিংসা করতাম না মোটেও।”
তীর্থ এবারে হেসে ফেলল। এবারে সে দীপক সামন্তর সামনে এসে তার ঘাড়ে হাতটা রেখে বলল, “তা দীপকবাবু, যদি আপনাকে না টোপ দিতাম, তবে নিশ্চিত আজ এখানে আসতেন না।”
সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে তীর্থর দিকে। “সরি সমরবাবু। আপনাকে আজ হাতকড়া পড়াব— এই টোপটা না দিলে আসল অপরাধীকে আজ আমাদের মধ্যে আনতে পারতাম না।”
দীপক লাফিয়ে উঠে বলল, “মানেটা কী? কী বলতে চাইছেন আপনি?”
“আপনি কখনও হায়দ্রাবাদ গিয়েছেন দীপকবাবু?”
“হায়দেরাবাদে? নাহ! কেন বলুন তো?”
“আপনার এই মিষ্টি ‘হায়দেরাবাদ’ উচ্চারণটাই আপনাকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করল। আপনার সঙ্গে আমার যে ওভার টেলিফোন কথা হয়েছে তা আমি স্পেশালিস্ট দিয়ে চেক করিয়েছি। আপনিই সেই লোক যে দিনের পর দিন অন্বয়বাবুকে ব্ল্যাকমেল করে ভয় দেখিয়ে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। সমস্ত প্রমাণ আমার হাতে রয়েছে। কেন করলেন এমন? কীসের এত রাগ ছিল ওঁর ওপর?”
“আপনার সাহস তো বড় কম নয়! আপনার বিরুদ্ধে আমি মানহানির মামলা করব।”
“সে না হয় করবেন। কিন্তু অন্বয়ের টাকা তোলার পর দিনই দু লাখ করে টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে গেল কী করে? আর যেসব দিন অন্বয়বাবু রেস্টুরেন্টের কেবিনে টাকা রেখে আসতেন, প্রত্যেকবারই আপনাকে ছদ্মবেশে সিসিটিভিতে দেখা গেছে। সেখানে আপনার পা টেনে হাঁটা ছবিই ধরিয়ে দিয়েছে আপনাকে।”
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে প্রথমে কান্নায় ভেঙে পড়ল দীপক। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “অন্বয় ভীষণ স্বার্থপর ছেলে। নিজে এত বড় পোস্টে ছিল। ও চাইলেই পারত আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে। কিন্তু…”
“সামান্য একটা চাকরির জন্যে এত বড় সর্বনাশ করলেন! ওঁর হায়দ্রাবাদের অতীত আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো ওর সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন না?”
“আমরা বন্ধুরা মাঝে মাঝেই ওর সঙ্গে ড্রিঙ্ক করতাম। জানুয়ারি মাসে এক রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন আমি ছাড়া আর কেউ আসেনি ওকে সঙ্গ দিতে। অফিসের একটা ঝামেলার কারণে এমনিতেই উত্তেজিত ছিল অন্বয়। তার মধ্যে কড়া ড্রিঙ্কস পান করার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো আউট হয়ে যায়। তখনই ও হায়দেরাবাদে পড়ার সময় রিয়ার সঙ্গে ওর প্রেমের, মেয়েটির প্রেগন্যান্ট হওয়ার এবং মেয়েটি বিয়ের জন্যে চাপ দিতে বালিশ মুখে চাপা দিয়ে তাকে খুন করে পালিয়ে আসার ঘটনা নিজের মুখে জানায়। তারপর ওসব পড়তে ভাল লাগছে না বলে হায়দেরাবাদ থেকে ফিরে আসে ও। কলকাতায় এসে বিসিএ, এমসিএ করে এই চাকরি পায় অন্বয়।”
“বাহ! বন্ধুর হিডেন অতীতের গন্ধ পেয়েই অমনি বন্ধুকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করলেন! একবারও মনে হল না এতে অন্বয়ের কত বড় ক্ষতি হতে পারে?”
সুতপা মুখ ঢেকে আছে। হয়তো লজ্জায়। তীর্থ পুলিশের হাতে পুরো ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়ে ধীর পায়ে বেড়িয়ে পড়ল অন্বয়দের বাড়ি থেকে।
মহুয়া সমাদ্দার
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক, রবীন্দ্র ভারতী থেকে মাস্টার্স এবং চাকরি করাকালীন বি.এড ডিগ্রি লাভ। বর্তমানে কলকাতা নিবাসী একটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষিকা। সেই ছোট্ট বেলা থেকে কবিতা লিখলেও বছর দুয়েক ধরে গল্প, উপন্যাস, গান, নাটক, ফিচার সবেতেই সিদ্ধহস্ত। “এই সময় দৈনিক”, “শুকতারা”, “কৃত্তিবাস”, “কিশোর ভারতী”, “সাহিত্য এখন” সহ বহু নামী পত্র-পত্রিকায় লেখিকার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন