বিশ্বরূপ মজুমদার
‘ক্রীড়নক’ শব্দের অর্থ খেলনা। জীবনের এই বিচিত্র খেলায় কে যে খেলোয়াড় আর কে খেলনা, তা জানতে গেলে খেলা শেষ হওয়া অবধি ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে হয়।
* * * * *
“টিটো! খেতে আয়…”
“উফ! এখনই দিতে তোমায় কে বলেছে? একটা ইম্পরট্যান্ট ম্যাচ খেলছি… টেক কভার! কুইক কুইক!”
এই গল্পে পাওয়া প্রথম খেলোয়াড় হচ্ছে টিটো। ক্লাস এইটের ছেলে, দুর্দান্ত অনলাইন গেমার। সারাদিন মোবাইল স্ক্রিনে আঙুল চালিয়ে একটার পর একটা যুদ্ধ জয় করে চলেছে। হাবজি-গাবজি-পাবজি কিছুই বাদ নেই আর। ইদানীং গেম খেলার নেশাটা আরও বেশি পেয়ে বসেছে, কারণ বহুদিন পর টিটো অনলাইন গেমের জগতে তার এক সমানে সমানে কম্পিটিটর খুঁজে পেয়েছে, নাম ‘Anonymouse’… হ্যাঁ, mouse-ই। বলাই বাহুল্য, এটা আসল নাম নয়। অনলাইন গেমে সবাই এরকম উদ্ভট নাম, যাকে বলে ‘ইউজারনেম’ ব্যবহার করে। টিটোও করে। যাতে আসল নাম, আসল পরিচয়, সবই থাকে অন্তরালে।
“টিটো… এলি?!”
“ওহ প্লিজ মম, জাস্ট গিভ মি ফাইভ মিনিটস!”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা অজানা নম্বর জ্বলজ্বল করে উঠল টিটোর মোবাইল স্ক্রিনে। এই গল্পের আর এক খেলোয়াড়। দেখেই টিটোর ভুরুদুটো মারাত্মক রকম কুঁচকে উঠল। ভুরুর খাঁজে বিরক্তি ছাপিয়েও একরাশ অবিশ্বাস ও বিস্ময়। আবার এই নম্বর থেকে ফোন আসছে কী করে? নম্বরটা তো ব্লক করে দিয়েছে টিটো! এর আগেও দু’বার ফোন এসেছিল এই একই নম্বর থেকে, দু’বারই ফোন ধরে হাজারবার হ্যালো হ্যালো করার পরেও অপরপক্ষের একটা শব্দও শুনতে পায়নি টিটো। তাই তো বাধ্য হয়ে… এক সেকেন্ড! টিটো তো ফোনটা এয়ারপ্লেন মোডে ফেলে রাখে গেম খেলার সময়, এখন তো কোনও ফোন আসা সম্ভব না! টিটো ঘাবড়ে গেল রীতিমতো। এ কী ভূতুড়ে ব্যাপার রে বাবা!
“টিটো-ও-ও-ও… এবার কিন্তু একটা চড় খাবি!”
মায়ের বকুনিটা আর আগের মতো বিরক্তিকর ঠেকল না ওর কানে।
“আসছি-ই-ই-ই!”
কলটা ডিক্লাইন করে গেম থেকে বেরিয়ে টিটো ডাইনিং রুমে দৌড়ে এল, পালিয়ে আসার মতো।
* * * * *
খাওয়া শেষ করে বাবা টেবিল ছেড়ে উঠে যেতেই টিটো দোনামনা করতে করতে মাকে রহস্যময় ফোন আসার গল্পটা বলেই ফেলল। গল্প শুনে টিটোর মায়ের প্রথম উক্তিটাই হল,
“কতবার বলেছি এই গেমটেমগুলো খেলা কমা, কী থেকে কী হচ্ছে কে জানে!”
“উফফ মা! এইজন্যই তোমাদের কিছু বলতে ইচ্ছে করে না জানো তো!”
“কী করব বল? যা দেখছি তা-ই তো বলছি! নিজেই তো বললি এক্ষুনি যে গেম খেলার সময়ই ফোনগুলো আসছে বারবার…”
“তাতে কী প্রমাণ হল? আজ গেম খেলার সময় আসছে, কাল হয়তো অনলাইনে ক্লাস করার সময় আসবে! একটা কিছু ব্যবস্থা তো করতে হবে নাকি?”
“তা আমি কী বলব বল? আমি কি এসবের কিছু বুঝি? তুই একবার তোর বাবাকে বলে দ্যাখ না… দাঁড়া ডাকি… হ্যাঁ গো শুনছ…”
“ওফ মা! প্লিজ! আমার লাগবে না কোনও হেল্প, নমস্কার!”
“আরে দাঁড়া দাঁড়া, উফফ যেমন বাপ তেমন ছেলে, সবেতেই মেজাজ টঙে! আচ্ছা আমায় কী করতে হবে বল!”
টিটো কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল, “একটা কাজ করা যায়। তোমার সিমকার্ডটা দু’দিনের জন্য আমায় দাও আর আমারটা তুমি নাও। তারপর দ্যাখো তোমার ফোনে ওই নম্বর থেকে ফোন আসছে কিনা, তাহলে হাতেনাতে প্রমাণ পাবে! আমি তো কিছুই দেখাতে পারছি না, ইনকামিং কললিস্টে পর্যন্ত নাম্বারটা থাকছে না, হাওয়া হয়ে যাচ্ছে!”
“এ কী অদ্ভুত ব্যাপার রে বাবা! তোর ফোন খারাপ হয়ে যায়নি তো?”
“সেইজন্যই তো বলছি, তোমার ফোনে সিমটা ঢুকিয়ে একবার টেস্ট করে দেখা যাক!”
“বেশ কর তাহলে! তবে আমার নাম্বারে তোর দিদা-মাসির যে ফোনগুলো আসবে ওগুলো কাটবি না খবরদার বলে দিচ্ছি! আমায় দিয়ে যাবি!”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেব, চিন্তা কোরো না!” টিটো লজ্জা পেয়ে হাসল। হাত-মুখ ধুয়ে দুটো মোবাইলের সিমকার্ড দুটো অদলবদল করে নিল দ্রুতহাতে। তরপরেই আয়েশ করে আবার গেম খেলতে বসল। যাক, দুটো দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। গেমে কনসেনট্রেট করতে পারবে এবার ভালো করে। Anonymouse-এর কাছে দুটো ম্যাচ হেরে মাথা গরম হয়ে গেছে, এবার মজা দেখিয়ে ছাড়বে! গেম খেলা শুরু করতে না করতেই আবার ঝংকার দিয়ে উঠল মোবাইল। টিটোর বুকটা ধড়াস করে উঠল! সেই এক নম্বর! লোকটা এর মধ্যেই জেনে গেল টিটো সিমকার্ড বদলেছে? কীভাবে সম্ভব? ফোন রিসিভ করে টিটো পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, “হু দ্য হেল আর ইউ? হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? আনসার মি!”
অপরপ্রান্তে অপার নৈঃশব্দ্য। ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মারল টিটো, অক্ষম রাগে।
“কী হল রে বাবু?” টিটোর মা হাতে একগাদা কাপড় নিয়ে ধড়মড় করে ঘরে ঢুকলেন।
“আবার ফোন আসছে!! আহ!” বিছানাতেই একটা ঘুঁসি মেরে বসল টিটো।
টিটোর মা চোখ গোলগোল করল, “এই নাম্বারেও! সে কী! নাম্বারগুলো পাচ্ছে কোথা থেকে বল তো!” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “জানিস, সারারাত কাপড়গুলো বারান্দায় পড়ে থাকবে ভেবে তুলে আনতে গিয়ে দেখলাম, আমাদের বাড়ির নীচেই, সামনের রাস্তাটায়, তোর বয়সী একটা ছেলে দাঁড়িয়ে কাকে যেন ফোন করছে… এ পাড়ায় কোনওদিন দেখিনি ছেলেটাকে… এত রাতে…”
মায়ের কথা শেষ হবার আগেই টিটো বারান্দায় ছুটল। হুমড়ি খেয়ে পড়ল রেলিংয়ে। কেউ নেই রাস্তায়। শুধু ল্যাম্পপোস্টের আলো, আর একটা কুকুর তারস্বরে কাঁদছে, কী একটা দেখে ভয় পেয়েছে যেন। হঠাৎ টিটোর কাঁধে একটা ভারী হাতের স্পর্শ। টিটো প্রায় আঁতকে উঠে পিছনে তাকাল। দেখল ওর বাবা। বাবার এত মায়াবী, কোমল মুখ শেষ কবে দেখেছে মনে পড়ে না। ভরাট গলায় বললেন, “চিন্তা করিস না, কাল আমার সঙ্গে একবার সার্ভিস সেন্টারে চল, সিমকার্ড প্রোভাইডারদের কাছে সব রেকর্ড থাকে, ওরা ঠিক বলতে পারবে।”
“বাবা!” প্রায় পাঁচ বছর পর এরকম শিশুর মতো বাবাকে জড়িয়ে ধরল টিটো।
* * * * *
“না স্যার, যে নাম্বারটা বললেন সেই নাম্বার থেকে তো কোনও কল আসেনি আপনাদের ফোনে!”
“আসেনি? একটু ভালো করে দেখুন না…”
“উঁহু…” সার্ভিস সেন্টারের অল্পবয়সী স্মার্ট ছেলেটা ঠোঁট উলটাল, “কিছুই তো দেখছি না!”
“কীরে টিটো, নাম্বারটা ঠিকঠাক মনে আছে তো তোর? ঠিক বলছিস তো?”
টিটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
“না স্যার, আমাদের কাছে তো কোনও রেকর্ড নেই! আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে! তাছাড়া এগুলো ডিসক্লোজ করা আমাদের রুলের মধ্যেই নেই, আপনারা এত রিকোয়েস্ট করলেন তাই…”
থমথমে মুখে বাবা ছেলে বাড়ি ফিরে এল। টিটো নিজেও ট্রু কলার সহ আরও কয়েকটা ট্র্যাকিং অ্যাপে নাম্বারটা ফেলে আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করল। ধুত্তেরি! সব ফালতু! গেম খেলাটাই এবার লাটে উঠল বোধহয়।
* * * * *
একসপ্তাহ কেটে গেছে তারপর। বন্ধুদেরকেও বিষয়টা বলেছে টিটো। কেউ হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, কেউ আবার দায়সারাভাবে দু’-একটা উপদেশ দিয়ে সরে পড়েছে। ব্যতিক্রম একমাত্র তার সেই অনলাইন ফ্রেন্ড, Anonymouse। সেই একমাত্র হাল ছাড়েনি এখনও, টিটোকে আশ্বাস দিয়েছে যে টেকনোলজির ব্যাপারে তাঁর জ্ঞান অনেক বেশি, এই রহস্যটাকে একবার যখন সে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে, তখন সমাধান করেই ছাড়বে। কী বিচিত্র এই মানবসম্পর্ক! যাঁদের সঙ্গে ছোট থেকে খেলাধুলো করে বড় হল, তারা দিব্যি কেটে পড়ল, আর যাকে কোনওদিন সামনে থেকে দেখেইনি, সে বিপদের দিনে এগিয়ে এল। টিটো রোজ আশায় আশায় থাকে, কখন Anonymouse মেসেজ করে বলবে ও ওই জঘন্য নাম্বারটাকে ট্র্যাক করতে পেরেছে, আর টিটো সবার কাছে প্রমাণ করতে পারবে যে ওর মাথায় কোনও গণ্ডগোল নেই, বা ও মিথ্যা কথা বলছে না।
* * * * *
একদিন দুপুরবেলা বিছানায় বসে একমনে অঙ্ক করছিল টিটো। টুং করে একটা নোটিফিকেশন আসতেই দেখল Anonymouse মেসেজ করেছে। বইখাতা সরিয়ে তড়িঘড়ি হোয়াটসঅ্যাপ খুলতেই দেখল একটা মডেড গেম অ্যাপের লিঙ্ক আর ইংলিশে লেখা — ‘নাম্বারটা ট্র্যাক করতে পেরেছি। সব খুলে বলব। কিন্তু তার আগে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। তোমার ফেভারিট গেমের যে লেটেস্ট ভার্সনটা চাইছিলে সেটা পেয়ে গেছি। এই লিঙ্কটায় ক্লিক করে ডাউনলোড করে নাও। আগে এক রাউন্ড খেলে সেলিব্রেট করে নিই।’
ডবল খুশিতে টিটোর মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা স্নায়ুকোষ চনমনে হয়ে উঠল, এতদিন সংকুচিত হয়ে থাকা হৃদয় লাবডুব শুরু করল নতুন উদ্যমে। লিঙ্কটায় যেই আঙ্গুল ছোঁয়াতে যাবে তখনই টিটোকে ছিটকে দিয়ে যেন স্বাভাবিকের চেয়েও অনেক বেশি জোরে চিৎকার করে উঠল ফোনটা। ফোনের স্ক্রিনে সাক্ষাৎ যমের মতো প্রকট হয়ে উঠল সেই চিরচেনা অভিশপ্ত নম্বর। টিটো পাগলের মতো লাল বাটনে আঙুল ঘষতে লাগল, কিন্তু ফোন কাটল না। এত জোরে ফোনটা বাজছে মনে হচ্ছে কানের পর্দা ফেটে যাবে। টিটোর মনে হল ওর শরীরটা কাঁপছে থরথর করে।
হঠাৎ সবুজ বাটনটা সোয়াইপ করে ও চুপ করে বসে থাকল। স্ক্রিনে সেকেন্ডের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, অপরপক্ষ ফোন কাটছে না। সাহস করে কানে নিল ফোনটা।
“এত দেরি হয়? এইতো আমি, তোমার পিছনে।”
কাঁপুনি থেমে গেছে, এবার মনে হচ্ছে শরীরটা বরফের তৈরি। অনেক কষ্টে জমে যাওয়া ঘাড় পিছনে ঘোরাল টিটো। কেউ নেই। আবার ঘাড়টা সামনে আনতেই দেখল ওর মুখের একদম সামনে, বিছানায় বসে লাল লাল দাঁত বার করে হাসছে ওরই বয়সী, সারা শরীরে রক্তমাখা একটা ছেলে!
“মা-আ-আ-আ-আ!”
মাথা ঘুরে বিছানায় পড়ে গেল টিটো। তারপর সব অন্ধকার…
* * * * *
মাত্র দু’দিন হল টিটোর জ্বরটা ছেড়েছে। এই এক সপ্তাহ যে কী ভয়ঙ্কর কেটেছে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। জ্বরের মধ্যে বিকারগ্রস্ত হয়ে ভুলভাল কথা বলছিল টিটো… মোবাইলের রিংটোন শুনলেই চিৎকার করে উঠছিল… কখনও বা কেন্নোর মতো গুটিয়ে যাচ্ছিল ভয়ে। দু’বার ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছেন, টিটোর মা তো প্রায় খাওয়াদাওয়া ছেড়ে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন কেঁদে কেঁদে। টিটোর ফোন একদম দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, সিম টিম খুলে। এই দু’দিন হল ও চোখ মেলে চেয়েছে। অনেক শান্ত হয়ে গেছে আগের থেকে। বড় একটা ধাক্কা খাওয়ার পর যেন নিজের মতো করে খেলাটা মাথায় সাজিয়ে নিচ্ছে টিটো, আগের থেকে অনেকটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এটুকু সে নিশ্চিত, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে যে ছেলেটাকে সে দেখেছিল, সে যত বীভৎসই হোক না কেন, তার ক্ষতি করতে আসেনি। কিন্তু আসলে সে কে, কেনই বা এসেছিল? রোজ মাঝরাত অবধি এসবই ভাবে টিটো শুয়ে শুয়ে। এভাবেই ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এক রাত্রে উঠে পড়ল যন্ত্রচালিতের মতো। আর কতদিন ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে থাকবে? এবার তার ফোন ফেরত চাই। সে অনলাইনে ক্লাস করবে, তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলবে! আর এই ভূতকেও একহাত নেবে। টিটোর ভেতর থেকে কে যেন ধাক্কা মারল, ও বিছানা থেকে নেমে গুটিগুটি পায়ে পৌঁছে গেল বাবার ঘরে, বাবা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ড্রয়ার টেনে বের করল মোবাইল আর সিমকার্ড। আবার গুটিগুটি পায়ে ঘরে ফিরে এসে ফোনটা অন করল। ঠক করে বন্ধ জানলায় শব্দ হল একটা। একবার জানলার দিকে তাকাল টিটো, তারপর হঠাৎ খুলে দিল জানলাটা। নাহ, রাস্তায় কেউ নেই… শুধু ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া আর ঝিঁঝির ডাক।
‘আমি এখানে।’
হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢুকল একটা, ইংরেজি হরফে বাংলা ভাষায় লেখা। সেই পরিচিত নাম্বার। টিটো তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে কিছুক্ষণ, তারপর দ্রুতহাতে নাম্বারটা সেভ করল প্রোফাইল পিকচার দেখার জন্য। ঠিক, সেই ছেলেটাই। কিন্তু ওইরকম রক্তমাখা অবস্থায় নয়… এখানে খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। টিটো যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে, ওর হাত কাঁপছে না… টাইপ করল, ‘কে তুমি?’
‘তোমার মতোই একজন গেমার।’
‘কী চাও?’
‘Anonymouse লোকটা শয়তান, ফ্রডস্টার। ওদের গ্যাং আছে। অ্যাভয়েড দ্য গাই।’
টিটো চমকে উঠল। আবার টাইপ করল, ‘তুমি জানলে কীকরে? ও তো আমায় হেল্প করছিল…’
‘সব মিথ্যে, জালে ফাঁসানোর ধান্দা। আমার নাগাল পাওয়ার ক্ষমতা কারওর নেই। তোমায় একটা মডেড লিঙ্ক পাঠিয়েছে তো?’
টিটো আবার চমকে উঠল। লিখল, ‘হ্যাঁ।’
‘আমাকেও পাঠিয়েছিল। ওটা ডাউনলোড করার পরেই অজান্তেই একটা স্পাইওয়্যার ইনস্টল হয়ে গিয়েছিল আমার ডিভাইসে। ওইখান থেকে স্পাইং করে আমাদের ডেবিট কার্ডের নাম্বার, সিভিভি সব হ্যাক করে নিয়েছিল। তারপর পুরো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খালি করে দেয়।’
টিটো টাইপ করতে পারল না বেশ কিছুক্ষণ। আঙুলগুলো ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে গেছে। কত বড় বিপদ থেকে যে একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সেটা আত্মস্থ করতেই ওর সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ওদিকে অপরপক্ষের জমে থাকা কথা যেন আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, টুকরো টুকরো মেসেজের আকারে।
‘আমরা খেলোয়াড়, কিন্তু Anonymouse-রা আমাদের চেয়েও বড় খেলোয়াড়। ওরা খেলার ভিতর অন্য খেলা খেলে। আমরা ওদের খেলার ঘুঁটি। জানো আমার বাবার হার্টের প্রবলেম ছিল, এই ধাক্কাটা সে নিতে পারেনি, হি ডায়েড।’
‘আর তুমি?’ খুব সাবধানে লিখল টিটো।
‘আমার মনে আছে… আমি কাঁদতে কাঁদতে ছুটছিলাম… আমার ভুলের জন্যই তো সব শেষ হয়ে গেল… তারপর… এক নম্বর রেল লাইন দিয়ে একটা থ্রু ট্রেন এসে…’
টিটো পাথরের মতো বসে আছে। বড় তাড়াতাড়ি খেলাঘর ভেঙে যায়। অন্ধকার ঘরে ওর মুখের উপর মোবাইলের নীলাভ আলো, বাইরে চতুর্দশীর চাঁদের চেয়েও বেশি মায়াবী লাগছে ওকে।
‘আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইনি, দেখাও দিতে চাইনি, শুধু হিন্ট দিতে চেয়েছিলাম, তুমি বুঝতে পারোনি।’
কী বিচিত্র এই মানবসম্পর্ক! যাঁদের সঙ্গে ছোট থেকে খেলাধুলো করে বড় হল, তারা দিব্যি কেটে পড়ল, আর যাকে কোনওদিন সামনে থেকে দেখেইনি, সে বিপদের দিনে এগিয়ে এল।
‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ টিটো লিখল অনেকক্ষণ পর।
‘ওয়েলকাম, অ্যান্ড গুডবাই।’
টিটো আরও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল চ্যাটটার দিকে। কারণ ও জানে, একবার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বেরিয়ে গেলে এই বিদেহী বন্ধুকে সে চিরজীবনের মতো হারিয়ে ফেলবে।
.
জন্ম কলকাতায়। হুগলি জেলার রিষড়ায় বেড়ে ওঠা। স্কুলজীবন কেটেছে মাখলার দেবীশ্বরী বিদ্যায়তনে। অঙ্কে অনার্সসহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্ৰি লাভ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকুরিরতা। লেখালেখির হাতেখড়ি মায়ের কাছে। অবসর সময়ের শখ বলতে গল্পের বই, সিনেমা, অভিনয় ও ভ্রমণ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন