মশকপাহাড়ের অঘোরীবাবা – দেবদুলাল কুণ্ডু

বিশ্বরূপ মজুমদার

‘হ্যালো, প্রতাপ? আমি দয়াময় বলছি; তুমি এখন কোথায়?’

‘আমি তো ল্যাবে আছি; কোনও সমস্যা হয়েছে জামাইবাবু?’

‘হ্যাঁ, একটা ভীষণ জরুরি কাজে ফেঁসে গেছি। আমাকে একটু বিষ্ণুপুরে যেতে হচ্ছে।’

‘ঠিক আছে, দিদিকে বলে দেব।’

‘শোনো, দিদিকে নয়, তোমার হেল্প দরকার আমার।’

‘আমার হেল্প?’

‘হ্যাঁ, তোমাকে ভীষণ দরকার আমার।’

‘কোনও জটিল কেস আছে নাকি?’

‘একটা নয়, দু’-দুটো কেস একসঙ্গে ঘাড়ে চেপেছে ভাই, প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করো।’

‘ঠিক আছে, কী করতে হবে তাই বলুন।’

‘তুমি ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে বেরিয়ে দ্যাখো আমাদের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ইন্সপেক্টর শর্মা তোমাকে চেনে; তোমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেবে। প্যাকেটের ভেতরে হাজার দশেক টাকা, রিজার্ভেশন টিকিট আর কিছু ইনফরমেশন আছে। প্যাকেটটা নিয়ে তুমি বাড়ি চলে যাবে। রাত দশটায় রওনা দেবে হাওড়া স্টেশনের দিকে। এগারোটায় হাওড়া-চক্রধরপুর এক্সপ্রেস। বাকি কথা পরে হবে।’

ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে প্রতাপ দেখল রাস্তার ওপারে পার্কিংজোনে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা এক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এল।

“কেমন আছেন মি. জানা?”

“ভালো। আপনিই কি ইন্সপেক্টর শর্মা?”

“হ্যাঁ। দয়াময়বাবু এটা আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।” অফিসার প্রতাপের হাতে প্যাকেটটা তুলে দিল।

“থ্যাঙ্কিউ।”

“ওয়েলকাম। আচ্ছা আমি এখন আসছি। বেস্ট অফ লাক মি. জানা। টেক কেয়ার।”

|| ২ ||

ইন্সপেক্টর দয়াময় মান্নার নির্দেশমতো প্রতাপ হাওড়া-চক্রধরপুর মেলের এসি টু-টায়ার কামরায় ওর জন্য নির্দিষ্ট সীট দখল করল। প্রতাপের ভালো নাম প্রতাপাদিত্য জানা। সে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে বটানিতে মাস্টার্স করার পর পি.এইচ.ডি করেছে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক লাইনে থাকার ইচ্ছে ওর নেই। বরং অপরাধ বিজ্ঞানের উপর বিরাট ঝোঁক ওর। জামাইবাবু দয়াময় মান্না গোয়েন্দা বিভাগের পদস্থ অফিসার। এর আগে দু’-দুটো কেস সল্‌ভ করার ক্ষেত্রে সে জামাইবাবুকে হেল্প করেছে; হেল্প করেছে বললে ভুল হবে, সে নিজে রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে। এখন যে কোনও কাজেই দয়াময় প্রতাপের হেল্প নিয়ে থাকে।

কামরায় ঢুকেই সে দেখল আগে থেকেই তিনজন যাত্রী তাঁদের নির্দিষ্ট সীট অধিকার করে রয়েছে। বাঁদিকের উপরের সীটটা প্রতাপের। সে নম্বর মিলিয়ে নিজের লাগেজ তুলে দিল। বাকি তিনজন চাদর বিছিয়ে ঘুমতে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। প্রতাপ দেখল ওর নীচের সীটের ভদ্রলোক অবাঙালি, নীচের অপর সীটে রয়েছে রক্তাম্বর পরিহিত জটাজুটধারী এক সাধু। আর সাধুর উপরের সীটে এক বাঙালি ভদ্রলোক।   

প্রতাপ পোশাক চেঞ্জ করে একটা ট্রাউজার আর টিশার্ট চাপিয়ে নিল। তারপর চাদর বিছিয়ে ব্যাগটাকে মাথার নীচে রাখল বালিশের মতো করে। সে এখন রিলাক্সের মুডে আছে। রোজকারের অভ্যেসমতো ঘুমোতে যাওয়ার আগে একটা ম্যাগাজিন খুলে থ্রিলার গল্প পড়ার চেষ্টা করল। হঠাৎ ওর চোখ চলে গেল ওর উলটোদিকের বাঙালি ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক অভদ্রের মতো চেয়ে আছে প্রতাপের দিকে। এ কী! ভারি অস্বস্তি হচ্ছে। প্রতাপ সরাসরি লোকটার দিকে তাকাল। লোকটা তবুও পূর্ণদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তবে চোখ দুটো ভাবলেশহীন। কয়েক সেকেন্ড পর লোকটা চোখ সরিয়ে নিল। ইতিমধ্যে প্রতাপের নীচের অবাঙালি প্যাসেঞ্জার নাসিকাগর্জন শুরু করেছে। আর সেই সাধু চোখ বুজে বিড় বিড় করে কী যেন বলে চলেছে; যেন মন্ত্র পড়ছে। প্রতাপ আবারও তাকাল পাশের ভদ্রলোকের দিকে। লোকটা এবারেও প্রতাপের দিকে তাকিয়ে ছিল; প্রতাপের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল। প্রতাপ ভালো করে দেখল, লোক না বলে তাকে যুবক বলাই ভালো। মাথায় ঘন চুল, চৌকো মুখ, টিকাল নাক; গায়ের রং শ্যামলা। প্রতাপ বুঝতে পারল না, তাকে দেখার এত কী আছে! চোখ দুটোতে চালাকি না রহস্য খেলা করছে, তা সে কিছুতে ধরতে পারল না।  

প্রতাপ প্রকাশ্যে বলল, “আমি ঘুমোব; লাইট অফ করলে আপনার আপত্তি আছে?”

আকর্ণবিস্তৃত হেসে লোকটা জানাল, “হে হে, না না আমার কোনও আপত্তি নেই, হে হে…।”

প্রতাপ জানে সহজে তার ঘুম আসবে না, আসলে সে নিজের ভেতরে একটু ডুব দিতে চাইছিল। গাড়ি তখন ছুটতে আরম্ভ করেছে। ফেব্রুয়ারি মাস, তাই শীতটা রয়েছে। প্রতাপ কম্বলটা টেনে নিল গায়ে। ভোর চারটের সময় গাড়ি পৌঁছবে বাঁকুড়ায়।

|| ৩ ||

ঠিক পৌনে চারটের সময় প্রতাপের মোবাইলে আলার্ম বেজে উঠল। ঘুম ভেঙেই প্রতাপ শুনতে পেল সাধুটি বাজখাঁই গলায় কাকে যেন শাপ-শাপান্ত করছে। কিছুক্ষণ পরে বিষয়টি প্রতাপের কাছে পরিষ্কার হল। সাধুটি হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে যা বলল, তাতে বোঝা গেল তার ঝোলাটি হাওয়া হয়ে গিয়েছে। চট করে সে তাকাল তার নীচের সীটের দিকে; অবাঙালি লোকটা চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। এবারে সে নিজের বিপরীত সীটের দিকে তাকাল; যে লোকটি গতরাতে প্রতাপের দিকে খুব তাকিয়ে ছিল— তার সীটটাই ফাঁকা রয়েছে। লোকটি কখন নেমে গেছে কে জানে! তাহলে কি সাধুর ঝোলা হারানোর সঙ্গে লোকটার অন্তর্ধানের সম্পর্ক আছে? কিন্তু সাধুর ঝোলাতে আর কীই বা আছে? না সাধুকে আন্ডারেস্টিমেট করা ঠিক হবে না; যে সাধু টিকিট কেটে টু-টায়ার এসিতে উঠতে পারে, তার ঝোলায় বেশ কিছু টাকা-পয়সা ছিল, এ বিষয়ে কোনও বিস্ময়ের কিছু নেই। হয়তো সেই কারণেই লোকটা সাধুর ঝোলা নিয়ে নেমে গিয়েছে।

“স্বামীজি, আপ কাহা যায়েগা?’’ কৌতূহলী প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

“তুম কৌন হো জো তুমকো এ বাত কহু!” রক্তজবার মতো চোখ করে বলল সাধুটা।

“পুলিস মে জি.ডি. করাইয়ে…।’’

“রাখ দো তুমহারা পোলিশ…।’’ রাগে গর গর করতে করতে সাধু নেমে গেল বাঁকুড়া স্টেশনে।

হতভম্ব প্রতাপ এবারে অবাঙালি লোকটার দিকে তাকাল। লোকটা ততক্ষণে উঠে বসেছে। প্রতাপ তার দিকে চেয়ে বলল, “এইজন্যই কারও উপকার করতে নেই।”

“ছোড় দো বাবুজি…’’ ফ্যাল ফ্যাল করে ওর দিকে চেয়ে বলল লোকটা।

“আপ কাহা যায়েগা?’’

“পুরুলিয়া।”

লোকটার উত্তর শুনে প্রতাপ সাধুর প্রায় পেছন পেছন নেমে এল বাঁকুড়া স্টেশনে।

কলকাতার তুলনায় ঠান্ডাটা এখানে বেশি। তখনও ঠিকমতো ভোরের আলো ফোটেনি। প্রতাপ দেখল প্রচুর যাত্রী নামল এখানে। সে লাগেজ নিয়ে স্টেশন চত্বরে একটা চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ খেয়াল করল সাধুটা স্টেশনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অল্টোতে উঠল; গাড়িটা তাকে নিয়ে চলে গেল স্টেশনের বাইরে।

|| ৪ ||

ভোর পাঁচটা নাগাদ প্রতাপ রিক্সা করে বাসস্ট্যান্ডে এল। সেখান থেকে সিমলাপালগামী একটা বাসে চাপল সে। মোবাইল-ম্যাপে সে দেখে নিয়েছে এখান থেকে খাতরার দূরত্ব প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিমি। খাতরা নেমে আর সাত-আট কিমি দক্ষিণে গেলেই মুকুটমণিপুর, এশিয়ার বৃহত্তম ন্যাচারাল বাঁধ। এই সময়ে মুকুটমণিপুর তার কাছে একটা উপরি পাওনা। কলকাতার যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে অল্প সময়ের জন্য হলেও মুক্তি। অবশ্য এখানে সে এসেছে বিশেষ এক মিশনে। প্রতাপ খাতরায় নেমে একটা ট্রেকার ধরল। ট্রেকারের বেশিরভাগ যাত্রী কুলি-কামিন। তারা কাজে যাচ্ছে। মিনিট পনেরো লাগল তার মুকুটমণিপুরে পৌঁছতে। তখন বাজে সকাল সাড়ে আটটা। 

ট্রেকার থেকে নেমেই প্রতাপ ফোন করল অশোক নামে একটা ছেলেকে। সে এখানকার সরকারি গেস্টহাউসের কেয়ার টেকার। দয়াময়বাবু অশোকের নম্বরটা ওকে দিয়েছিল। গেস্ট হাউসের একটা রুম ওর নামে বুক করা আছে। মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই লম্বা ঢ্যাঙামতো কুড়ি-পঁচিশ বছরের একটা ছেলে উদয় হল তার সামনে।

“অশোক?”

“হ্যাঁ সার। আসুন আমার সঙ্গে।”

বাঁধের পাশে নতুন তৈরি সরকারি লজের একটা ঘর খুলে দিল প্রতাপকে। তারপর বলল, “আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আপনার জন্য ব্রেকফাস্ট আনছি।”

“শোনো ব্রেকফাস্ট সেরে আমি প্রোফেসর চ্যাটার্জি আর তাঁর স্টুডেন্টদের সঙ্গে দেখা করব।”

“ওঁরা আছেন বি ব্লকে। আপনি রেডি হলেই আমি নিয়ে যাব।”

|| ৫ ||

“নমস্কার, আমি প্রতাপাদিত্য জানা, সি.আই.ডি. লালবাজার। আপনিই কি প্রোফেসর চ্যাটার্জি?”

“হ্যাঁ, অর্ণব চ্যাটার্জি।” প্রোফেসর যেন মুহূর্তের জন্য ম্লান হয়ে গেলেন।

“কোন ইউনিভার্সিটি?”

“যাদবপুর।”

“আপনার সাবজেক্ট?”

“হিস্ট্রি।”

“কী ঘটেছে সংক্ষেপে বলুন।”

“গত তিরিশে জানুয়ারি আমার ডিপার্টমেন্টের বারোজন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বিষ্ণুপুরে আসি। ওখানে দু’দিন কাটিয়ে ২রা ফেব্রুয়ারি সকালে চলে আসি মুকুটমণিপুর। তিন তারিখ রাত থেকে অর্থাৎ পরশু রাত থেকে দিশাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“এগজ্যাক্ট কটার সময় আপনারা নোটিশ করলেন যে দিশা মিসিং?”

“রাতে খাবার টেবিলে।”

“আপনার দলে কতজন আছে?”

“ছ’জন ছেলে আর ছ’টা মেয়ে।’’

“দিশার কোনও ছবি আছে?’’ দিশার এক বন্ধু মোবাইল থেকে দিশার ছবি দেখাল। প্রতাপ আবার বলল, “ওর বাড়িতে জানানো হয়েছে?”

“হ্যাঁ, ওর বাবা-মা কাল এসেছেন।”

“আপনি প্রথম থেকেই যাদবপুরে আছেন?”

“না, প্রথমে ঢুকেছিলাম দুর্গাপুর কলেজে ১৯৯৭-এ; এখানে আছি দু’হাজার পাঁচ থেকে।”

কথাবার্তার মাঝে প্রতাপ ভালো করে লক্ষ করছিল প্রোফেসরকে। লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট হবে। পাতলা ছিমছাম চেহারা। মাথার সামনের দিকে চুল নেই বললেই চলে; দু’পাশে আর পেছনে কাঁচাপাকা চুল। চৌকো নিরীহ মুখ, চোখ দুটো উজ্জ্বল।

“স্থানীয় পুলিশ ইনভেস্টিগেশন হয়ে গেছে নিশ্চয়?” প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, এঁরাই আমাদের আপাতত কলকাতায় ফিরে যেতে বারণ করেছেন।”

“এখানে কোথায় কোথায় খোঁজা হয়েছে?”

“আশেপাশে খুঁজেছি; ড্যামে ডুবুরি নামানো হয়েছিল।”

“দিশার সেলফোনটা কোথায়?”

“ওটা ওর সাইডব্যাগেই রয়েছে।” একজন দিশার সাইড ব্যাগ এনে দিল। প্রতাপ ব্যাগটা চেক করল।

প্রতাপ একে একে দিশার বন্ধুদের বয়ান নিল। বন্ধুরা কেউ কেউ কেঁদে ফেলল। প্রতাপ মনে মনে বলল একটা মিসিং কেসে দয়াময়বাবু কেন যে আমাকে পাঠালেন কে জানে! “আচ্ছা, আমি এখন উঠছি। পরে দরকার পড়লে ডাকব।” প্রোফেসর চ্যাটার্জি ও স্টুডেন্টদের কাছ থেকে বিদায় নিল প্রতাপ। তারপর অশোককে বলল, “আমি একটু ড্যামটা ঘুরে দেখতে চাই। একাই বেরোব। তুমি দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করো।”

|| ৬ ||

বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে মুকুটমণিপুর বাঁধ। এটা নাকি মাটির বাঁধ। পরে সেটাকেই সুন্দরভাবে বাঁধানো হয়েছে। বাঁধের পাশ দিয়ে সাজানো গোছানো রাস্তা চলে গিয়েছে উঁচু টিলার উপরে। এই বাঁধটি কংসাবতী ও কুমারী নদীর মিলনস্থলে আবস্থিত। নদীর জল বেশ টল টলে। সরকার থেকে টিলার উপরে একটা পার্ক তৈরি করেছে। এই টিলার উপর দাঁড়ালে পুরো ড্যামটাকে দেখা যায়। বাঁধের ধারে বেশ কিছু ভটভটি-নৌকা বাঁধা রয়েছে। এই নৌকা করে নদীর গভীরে চলে যাওয়া যায়। এই সময়ে অনেক পিকনিক পার্টি এসেছে বাঁধের ধারে। তারা হই-হুল্লোড় করছে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গেস্টহাউসে ফিরে এল।

“স্যার, আপনার জন্য একটা চিঠি আছে।’’ অশোক বলল।

“মোবাইলের যুগে চিঠি? দেখি, কে দিল?”

“অপরিচিত একটা লোক; সে আপনাকে নাকি চেনে!’’ একটা মুখবন্ধ খাম অশোক প্রতাপের হাতে দিল।

প্রতাপ খামের মুখ ছিঁড়ে ভেতর থেকে একটা চিরকুট বের করল। চিরকুটের ভাঁজ খুলে দেখল তাতে নীলকালিতে লেখা রয়েছে— ‘কুয়াশাময় মশকপাহাড়’। এ আবার কী হেয়ালি! মশক পাহাড়! সেটা আবার কোথায়? যে এই কাগজটা দিয়ে গেল, সে সামনে এল না কেন? সে কি বন্ধু, না শত্রু? গভীর চিন্তায় প্রতাপ যখন ডুব দিয়েছে, তখন চমকে উঠল অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে— “স্যার, ভেতরে আসতে পারি?” প্রতাপ দেখল একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক ও এক ভদ্রমহিলা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।      

“আপনারা?’’ প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

“আমরা দিশার বাবা-মা।”

“ভেতরে আসুন।” প্রতাপ দেখল দুজনেই মেয়ের চিন্তায় ভেঙে পড়েছেন। ভদ্রমহিলা তো তার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

“আপনাদের বাড়ি কোথায়?”

“কলকাতায় সিঁথির মোড়ে। শুনলাম আপনি দিশার কেসটার তদন্ত করছেন, তাই দেখা করতে এলাম।” দিশার বাবা বলল।

“আমিও কেসটা নিয়ে বিভ্রান্ত। আচ্ছা বাড়িতে কোনও বিষয় নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কোনও রকম মনোমালিন্য…।”

“না, সেসব কিছু ঘটেনি।”

“৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেল, কোনও ফোন-টোন এসেছিল?”

“না, তাও আসেনি।”

“কাউকে আপনাদের সন্দেহ হয়?”

“না।”

“প্রতাপবাবু, দিশা আমাদের একমাত্র মেয়ে, দেখুন না খুঁজে দিতে পারেন কি না? যত টাকা লাগে দেব।” দিশার মা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

“এ কী করছেন? দেখুন কিছুই আমাদের হাতে নেই, তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনারা বিশ্রাম করুন, আমি আবার ডেকে নেব।”

দিশার বাবা-মা চলে যাওয়ার একটু পরে একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল গেস্ট হাউসের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে এল স্বয়ং দয়াময় মান্না। দয়াময়কে দেখে বুকে যেন বল ফিরে পেল প্রতাপ।

“জামাইবাবু, একটা গোলক ধাঁধার ভেতরে ফেলে দিয়েছে আমাকে। এমনটা করে আমি আর কোনও কেসের দায়িত্ব নেব না।”

“স্যরি ভাই, আমি কি কম ফ্যাসাদে পড়েছি? দুদিন ধরে আমি পড়ে আছি বিষ্ণুপুরে। একটা মন্দির থেকে দু-দুটো বিষ্ণুমূর্তি গায়েব হয়েছে। আনুমানিক দশম কি একাদশ শতাব্দীর মূর্তি। বুঝতে পারছ উপর মহলের চাপ আছে। এই নিয়ে বেশ কয়েকটা মূর্তি চুরি হল বিষ্ণুপুর থেকে। একই সঙ্গে আবার এই দিশার মিসিং; এবার বলো আমি কোন দিকে যাই? এইজন্য আমি তোমাকে এখানে পাঠিয়ে ছিলাম। আচ্ছা একটা নতুন ছেলেকে পাঠিয়ে ছিলাম তোমার ওই গাড়িতেই, ওর নাম অভিজিৎ। সে দেখা করেনি তোমার সঙ্গে?”

“না তো! ও কি আমাকে চেনে?”

“ও চেনে বলল। এর আগের দুটো কেসে তোমার সাফল্যের খবর চাপা আছে ভেবেছ?”

ইতিমধ্যে অশোক চা নিয়ে উপস্থিত। দয়াময় বলল, “এখন আর চা নয়, একবারে লাঞ্চ করব। আমার সঙ্গে গাড়ির ড্রাইভার আর একজন অফিসার খাবে।”

“আপনাদের খাবার তো তৈরি, স্নান করে খাবেন তো?” অশোক বলল।

“না স্নান করেছি। হাত ধোব শুধু।” দয়াময় বলল।

“ওদের সাইট সিইং করিয়েছিল যে ড্রাইভার দু’জন, তাদের দেখা করতে বলেছিলে?” প্রতাপ জিজ্ঞেস করল অশোককে।

“হ্যাঁ, ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে।” অশোক চলে গেল ওদের খাবার আনতে।

|| ৭ ||

প্রতাপ আর দয়াময় লাঞ্চ সেরে যখন বিশ্রাম করছিল, তখন ড্রাইভার দু’জন এল। এরাই প্রোফেসর আর তার স্টুডেন্টদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। প্রতাপ ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারল পরশুদিন দিশারা মশক পাহাড়ের দিকে গিয়েছিল।

“মশক পাহাড়? সেটা এখান থেকে কতদূর?’’ প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

“এখান থেকে খাতরা যেতে হবে, সেখান থেকে সিমলাপালের দিকে সাত-আট কিলোমিটার গেলেই বাঁদিকে পড়বে মশকপাহাড়।” ড্রাইভারদের একজন বলল।

“কী দেখার আছে ওখানে?”

“পাহাড়টা অনুচ্চ, দেখার তেমন কিছু নেই। কয়েকটা প্রাচীন গুহা আছে। গুহাসংলগ্ন স্থানে একটা প্রাচীন মন্দির আছে। সেখানে আগে কালি বা দুর্গাপুজো হত।”

“চলো, আমরা এখুনি বেরোব। চলুন জামাইবাবু।”

ড্রাইভার দুজনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতাপ আর দয়াময় আধঘণ্টার ভেতরে পৌঁছে গেল মশক পাহাড়ে। পাহাড় না বলে অনুচ্চ ঢিবি বলা যেতে পারে। তবে এখানে মানুষের যাতায়াত বড় কম। শুশুনিয়া পাহাড়ে যেমন ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে উঠেছে, এখানে তেমন কিছু দেখা গেল না। প্রতাপ আর দয়াময় ঘুরে ঘুরে দেখল। এখানে বেশ কয়েকটা গুহা আছে। গুহার ভেতর চামসে গন্ধ। ভাম আর বনবিড়াল থাকার উপযোগী। প্রতাপ গুহাগুলো পরীক্ষা করল। পাহাড়ের উত্তর দিকে একটা পাতকুয়ো আছে; আশ্চর্য লাগল এই দেখে যে কুয়োতে জল রয়েছে। হতে পারে পাহাড়ের গা বেয়ে লুকোনো কোনও ঝরনার জলে এই কুয়ো পুষ্ট।

“চলুন ফেরা যাক।” দয়াময়বাবুকে বলল প্রতাপ; ড্রাইভার দুজনকে জিজ্ঞেস করল, “এখান থেকে ফেরার পথে আর কোথাও নেমে ছিল তারা?”

“কিছুটা এগিয়েই একটা নলেন গুড় তৈরির ধাবা পড়বে। প্রোফেসর আর ছেলেমেয়েরা সেখানে গিয়েছিল।”

“ঠিক আছে, আমরাও যাব।” প্রতাপের নির্দেশ মতো সেদিকেই ঘোরানো হল গাড়ির মুখ। পাঁচ মিনিট যাওয়ার পর ছনের তৈরি একটা চালাঘর চোখে পড়ল প্রতাপদের। চালার নীচে দুটো উনুন। কয়েকজন আদিবাসী রস জ্বাল দিচ্ছিল। পুলিশের গাড়ি আসতে দেখে দৌড়ে পালাল মাঠের দিকে। প্রতাপ দৌড়ে গিয়ে একজনকে ধরল।

“পালাচ্ছিলে কেন?” প্রতাপ জিজ্ঞেস করল তাকে। লোকটা প্রথমে কিছুই বলতে চাইল না। শেষে সে অভয় দিল, “ভয় নেই, আমরা রস খেতে এসেছি। আছে?”

“আছে বাবু, খাবেন?” লোকটি বলল।

চারজনে খেজুর রস খেতে লাগল। এই অবসরে জিজ্ঞেস করল, “দু’দিন আগে এক বাবু কয়েকজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছিল?”

লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, “কতজনেই তো আসে। কাদের কথা বলছেন বাবু?”

প্রতাপ নিজের মোবাইল থেকে প্রোফেসর আর স্টুডেন্টদের গ্রুপছবি দেখাল। এটা সে নিয়েছিল একটা ছাত্রের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে। ছবি দেখে লোকটা বলল, “হ্যাঁ, এরা এসেছিল। এই বাবু আমার কাছ থেকে এক ভাঁড় গুড় কিনেছিল। আর সকলে রস খেল।”

প্রতাপ চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখল। চালাঘর থেকে কিছুটা দূরে মাটিতে ওষুধের একটা ছেঁড়া স্টিপ কুড়িয়ে পেল। ও সেটা তুলে নিল হাতে। দেখল গায়ে লেখা আছে নাইট্রেশন-২৫। মনে মনে ভাবল, “আরে এটা তো ঘুমের ওষুধ! এটা কী করছে এখানে?”

“তোমরা রসের সঙ্গে নেশার ওষুধ মেশাও?” প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

“না বাবু, আমরা ওসব কাজ করি না। আমরা গরিব মানুষ।” লোকটা হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল।

“এই কেঁদো না, তোমার নাম কী?’’ দয়াময় জিজ্ঞেস করল।

“বাবু, লছমন।’’

“কোথায় থাকো?”

“সিমলেপাল।”

“আমাদের সঙ্গে এখন তোমাকে যেতে হবে। ভয় নেই জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেব।” প্রতাপ বলল।

|| ৮ ||

লজে ফিরেই প্রতাপ দেখা করল প্রোফেসর চ্যাটার্জির সঙ্গে।

“মি. চ্যাটার্জি আপনি মশক পাহাড়ে গিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ, আমরা মোটামুটি সব জায়গাতে ঘুরেছি।”

“কলকাতা থেকে এখানে নলেন গুড় সস্তা— আপনি কী বলেন?” প্রতাপের কথায় প্রোফেসর যেন কিছুটা দমে গেল।

“না মানে হ্যাঁ, তাছাড়াও এখানে খাঁটি গুড় পাওয়া যায়।’’ প্রোফেসর আমতা আমতা করতে লাগল।

“আচ্ছা আপনি কি ঘুমের ওষুধ সেবন করেন?”

“না তো” প্রোফেসর যেন আকাশ থেকে পড়ল।

“আপনার কোনও স্টুডেন্ট?”

“আমার ছাত্রদের মধ্যে… হ্যাঁ মনে পড়েছে, সায়নকে দেখেছি ঘুমের ওষুধ সেবন করতে। ওর নার্ভের একটা প্রবলেম আছে— রাতে ঘুম আসে না”

প্রতাপের নির্দেশে সায়নকে ডাকা হল। সায়ন স্বীকার করল সে ঘুমের ওষুধ সেবন করে।

“তোমার ওষুধের স্টিপটা একটু দেখাতে পারবে?’’ প্রতাপ বলল।

সায়ন ওষুধের পাতাটা এনে দিল প্রতাপের হাতে। সায়নের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। প্রতাপ দেখল ওষুধের নাম ‘নাইট্রেশন-২৫’; পাতাতে আর মাত্র চারটে ওষুধ অবশিষ্ট আছে।

“যতদিন দিশা-হত্যার কিনারা না হচ্ছে, ততদিন আপনাদের সকলকে এখানেই থাকতে হবে মি. চ্যাটার্জি।”

ব্লক-বি থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ ফোনটা এল।

‘হ্যালো কে বলছেন?’ প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

‘আজ রাতে মশক পাহাড়ে আসুন।’ অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল অন্যপ্রান্তে।

‘কে—কে—’ প্রতাপ কিছু বোঝার আগেই কেটে গেল লাইনটা। পরে শত চেষ্টাতেও ফোনটা আর ধরতে পারল না। কেবল বার বার ‘নট রিচেবল’ বলছে।

|| ৯ ||

রাত তখন সাড়ে দশটা। প্রায় ঘণ্টা খানেক আগে প্রোফেসর ও স্টুডেন্টদের ডিনার শেষ হয়েছে। শীতের রাত, তারপরে দিশাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই প্রতি ঘরের আলো নিভে গেছে। লজের বাইরে কয়েকটা ল্যাম্পপোস্টে টিম টিম করে আলো জ্বলছে। কুয়াশার চাদর ঢেকে ফেলেছে চারপাশ। তারপরেও আজ অমাবস্যা। তাই কিছুটা দূরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। একটু দূরে একটা কুকুর কেঁদে উঠছে থেকে থেকে। বাঁধের কাছটায় একদল শেয়াল চেঁচিয়ে উঠল তারস্বরে।

হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল বি-ব্লক থেকে। ছায়ামূর্তিটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে গেল সামনের দিকে। তারপর অন্ধকারে একটা মোটর বাইক স্টার্ট নিয়ে ছুটে গেল সামনের দিকে। ঠিক এক মিনিট পরে অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল প্রতাপদের সুমো গাড়িটি। গাড়িতে প্রতাপ আর দয়াময় ছাড়াও আছে ছয়জন আর্মড পুলিশ। প্রতাপ আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

মশক পাহাড়ের কাছে এসে থেমে গেল বাইকটা। ঝোপের আড়ালে বাইকটাকে রেখে দুটো ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরে। একটু পরেই প্রতাপদের গাড়িটা এসে থামল। প্রতাপ আর দয়াময় সামনে, এবং দু’পাশে তিনজন করে দুটো দলে ভাগ হয়ে এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। জঙ্গল পেরিয়েই মশক পাহাড়। এ বছরই প্রতাপ একটা লাইসেন্সড পিস্তল পেয়েছে; ওর হাতে এখন সেই পিস্তল। সকলেই আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত।      

পাহাড়ের কাছে এসে ওরা মশাল জ্বলতে দেখল। সেইসঙ্গে শুনল গম্ভীর গলায় কে যেন মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে। কিন্তু কাছে এগোবার উপায় নেই। যমদূতের মতো একজন এদিকেই দাঁড়িয়ে আছে পাহারায়; তার হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র। প্রতাপ মাটিতে উবু হয়ে বসে হামাগুড়ি দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে গেল লোকটার পিছন দিকে; তারপর একটা ডাল দিয়ে লোকটার মাথার পেছন দিকে সজোরে আঘাত করল। লোকটা ‘আঁক’ শব্দ করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। এবারে বাকিদের ডাক দিল পাহাড়ের দিকে।

একটু কাছে আসতেই ছবিটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। গুহার সামনে করালবদনা এক কালিমূর্তি; তার সামনে হাঁড়িকাঠে মাথা দিয়ে রয়েছে এক যুবতী। তার সামনে ধারাল খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ছে এক অঘোরীবাবা। এই দৃশ্য দেখবার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। সকলের শিরদাঁড়া বেয়ে নামল ঠান্ডা স্রোত। অঘোরীবাবাকে প্রতাপের খুব চেনা চেনা লাগল। ওর মনে পড়ে গেল, আরে এর সঙ্গেই তো এক কামরায় এসেছে সে। ট্রেনের ভেতরে তার ঝোলাটি চুরি হয়ে গেল। সাধুটি তার খড়্গ তুলেছে মেয়েটির গলায় কোপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। অমনি প্রতাপ চাপা গলায় বলে উঠল, “জামাইবাবু শ্যুট নাউ।” কিন্তু দয়াময় কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেল মাটিতে। বাধ্য হয়ে প্রতাপ গুলি চালাল। এর আগে বেশ কিছুদিন শ্যুটিং প্র্যাক্টিস করেছে। অঘোরীবাবার হাত থেকে ছিটকে পড়ল খড়্গটি। অঘোরীবাবা হতভম্ব হয়ে বসে পড়ল মাটিতে।

“কে রে আমার সাধনায় ব্যাঘাত ঘটালি? আগে তাকে খাব… মা, মা তুই দেখলি তো তুই আয়… তুই খেয়ে নে এই পাষণ্ডদের’’ তারস্বরে আর্তনাদ করে উঠল অঘোরীবাবা।

কিছু বোঝার আগেই অঘোরীবাবার এক শিষ্য ত্রিশূল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতাপের উপর। প্রতাপের হাত থেকে খসে পড়ল পিস্তল। হঠাৎ সকলকে হতবাক করে দিয়ে একটা গুলি ছুটে এল সেই শিষ্যর দিকে; তার হাতে লাগল গুলিটা। হাত থেকে খসে পড়ল ত্রিশূল। প্রতাপ পিস্তলটা কুড়িয়ে নিল। ঠিক তখনই গুহার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন, ‘‘আমি অভিজিৎ বোস, আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আপনার কিছু হয়নি তো স্যার?”

এরই মধ্যে দয়াময় উঠে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সকলকে আদেশ দিল অঘোরীবাবা আর তার চেলাদের বেঁধে ফেলার জন্য। প্রোফেসর চ্যাটার্জিকে দেখা গেল কুয়োর ধার থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতাপ বলল, “পালাবেন না মি. চ্যাটার্জি, আপনার খেল খতম। ধন্যবাদ অভিজিৎ। তোমাকে আগে কোথায় দেখেছি বলো তো?”

“ট্রেনের মধ্যে, আপনার পাশের সিটে আমি ছিলাম। আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলে আপনি বিব্রত হচ্ছিলেন।”

“হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা তোমার পরিচয় দিলে না কেন?”

“তাতে মিশন কি সাকসেস হত?” অভিজিৎ বলল।

অঘোরীবাবা আর প্রোফেসরসহ দলে মোট বারোজন লোকের হাত-পা বেঁধে বসানো হল পাহাড়ের সামনে। হাঁড়িকাঠ থেকে বের করা হল দিশাকে; সে তখনও অজ্ঞান। দয়াময় তার চোখে-মুখে জলের ছিটে দিল, তারপর ওর জ্ঞান ফিরল। দয়াময় লোকাল থানায় খবর দিল আর এক গাড়ি ফোর্স আনার জন্য।

“আমার তো ঘোর কাটছে না প্রতাপ? একবিংশ শতকে কাপালিক? এ যে বঙ্কিম চ্যাটুজ্জের গল্পকেও হার মানিয়ে দিল। বিষয়টা একটু খুলে বলো না প্রতাপ” দয়াময় বলল।

“প্রথমে জিজ্ঞেস করি আপনি ওরকম ভাবে কেঁপে পড়ে গেলেন কেন?”

“ভয়ে। এ দৃশ্য এই প্রথম দেখলাম তো! তোমার দিদিকে আবার বোলো না। আচ্ছা সে কথা থাক, এবারে শুনি কীভাবে কী ঘটল?”

“সম্ভবত গত বছর অঘোরীবাবার সঙ্গে প্রোফেসর চ্যটার্জির পরিচয়; কীভাবে পরিচয়, সে কথায় পরে আসছি। অঘোরীবাবা তান্ত্রিক-কাপালিক; একটা যুবতী নারীকে কালী মায়ের পায়ে বলি দিতে পারলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করবে। তাই ছেলেমেয়েদের নিয়ে মুকুটমণিপুরে এলেন প্রোফেসর। তারপর খেজুর রসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিশাকে খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ পরে দিশা জ্ঞান হারাল; অজ্ঞান দিশাকে সকলে ফেলে রেখে গাড়িতে ওঠে। গাড়ি ছিল দুটি; দুই দলের ছেলেমেয়েরাই ভেবেছে দিশা হয়তো অন্য গাড়িটাতে আছে। দিশা যে ফেরেনি বা নেই সেটা বুঝতে পারল লজে খেতে বসে। আর দিশার দেহটাকে মশক পাহাড়ের গুহায় নিয়ে এসেছিল অঘোরীবাবার শিষ্যরা।’’ এই পর্যন্ত বলে প্রতাপ থামল।

“আমার দুটো প্রশ্ন আছে— প্রথম প্রশ্ন, ঘুমের বড়ি কি প্রোফেসর নিজে মিশিয়ে ছিল? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন— এই কাজে প্রোফেসরের স্বার্থ কী?” দয়াময় বলল।

“প্রথম প্রশ্নের উত্তর ঘুমের বড়ি সেবন করে ওঁর ছাত্র সায়ন, উনি ওর ঘর থেকে ওটা চুরি করেছিলেন। তারপর সুযোগ বুঝে গুড়ের ধাবায় রসের সঙ্গে ওটা মিশিয়ে দেন। কী মি. চ্যাটার্জি ঠিক বলেছি?’’ প্রতাপের কথা শুনে প্রোফেসর মাথা নিচু করল। 

“আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর?”

“এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আমি ধন্যবাদ জানাব অভিজিৎবাবুকে। উনি না থাকলে এই অভিযান সফল হত না।”       

“আপনি ওভাবে বলবেন না। আপনি ভীষণ সাহসী আর বুদ্ধিমান।” অভিজিৎ বোস বলল।

“দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ওই পুরোনো পাতকুয়োতে ঝুলন্ত দড়ি ধরে টান দিন।” প্রতাপ বলল।

দয়াময়ের নির্দেশে দুজন পুলিশ দড়ি ধরে টান দিল সজোরে। কিছুক্ষণ কসরত করার পরে কুয়ো থেকে বেরিয়ে এল প্রায় দু-ফুট লম্বা একফুট চওড়া বিশিষ্ট পর পর দুটো বিষ্ণুমূর্তি।

“আরে এই তো সেই বিষ্ণুমূর্তি!” লাফিয়ে উঠল দয়াময়, “কিন্তু এ দুটো এখানে এল কী করে?”

“এর উত্তর অভিজিৎ দেবে।’’ প্রতাপ বলল।

“বিষ্ণুপুরের একটা মন্দিরে এই অঘোরীবাবা দীর্ঘদিন ওঠা-বসা করেছে; সেই সুবাদে রাতারাতি মূর্তিদুটো সরিয়েছে। অবশ্য এ কাজে তার সাগরেদরা সাহায্য করেছে। কিন্তু সেটা কবে সরিয়েছে, কবে কলকাতা গেছে, কবে প্রোফেসরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, এসকল প্রশ্নের জবাব অঘোরীবাবা দেবে থানায় বসে।’’ অভিজিৎ বলল।

“প্রোফেসর এই মূর্তি নিয়ে কী করবে?” দয়াময় জিজ্ঞেস করল।

“হাসালেন জামাইবাবু, প্রোফেসর বাইরে পাচার করবে এই মূর্তি; বিরাট গ্যাংয়ের সঙ্গে ওর যোগাযোগ আছে। গাড়ি এসে গেছে, চলুন এবারে যাওয়া যাক।’’

সকলকে অ্যারেস্ট করে ওরা যখন ফিরছিল, তখন ভোরের আলো ফুটেছে মশক পাহাড়ে; কুয়াশা নেই বললেই চলে।

.

দেবদুলাল কুণ্ডু

জন্ম ১৯৭৪। শিক্ষাগত যোগ্যতা বাংলায় এম.এ, বি.এড। পেশায় শিক্ষক। আকৈশোর সাহিত্যপ্রেম। ছাত্রজীবনে কবিতা ও প্রবন্ধ দিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত। ২০০৯ সালে ছোটদের সাহিত্য পত্রিকা ‘দোলনা’র সম্পাদনা শুরু। ওই বছরেই “গণশক্তি” সংবাদপত্রে প্রথম গল্পের প্রকাশ। তারপর থেকে ছোট ও বড়দের জন্য সমানে গল্প-ছড়া-কবিতা লিখে চলেছেন। “দেশ”, “আনন্দবাজার পত্রিকা”, “আনন্দমেলা” “সন্দেশ”, “শুকতারা”, “কিশোর ভারতী”, “সাপ্তাহিক বর্তমান”, “চিরসবুজ লেখা” প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। ২০১৬ সালে শিশুসাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ছোটদের গল্পসংকলন ‘হাতু ও বাঘা’।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন