বিশ্বরূপ মজুমদার
এমন বহু জিনিসই আছে, যা হঠাৎ করেই যে কোনও মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে দিতে পারে। যেমন কোনও প্রিয় বন্ধুর চরম বিশ্বাসঘাতকতা, বা কোনও দুরারোগ্য ব্যাধি, অথবা কোনও বদ এবং অপ্রতিরোধ্য নেশা। কিন্তু তাই বলে একটা পুরনো মোবাইল ফোন? একটা পুরনো রংচটা, ছালওঠা মুঠোফোন একজন মানুষের জীবনকে এতটা বদলে দিতে পারে? কিন্তু নম্রতা, তার স্বামী তথাগত’র পুরনো একটা মোবাইল খুঁজে পাওয়া ও তার পরবর্তী ঘটনাপরম্পরা প্রত্যক্ষ করতে করতে এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটাকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে। আর তার সঙ্গেই নিজের শাশুড়ির ক্রমাগত দোষারোপ শুনতে শুনতে মানতে শুরু করেছে যে তথাগত’র এই অবস্থার জন্য সে-ই দায়ী। আত্মরক্ষার জন্য সে শাশুড়ির সামনে নিজস্ব যুক্তিজাল খাড়া করার চেষ্টা করে বার বার। কিন্তু বোধহয় নিজের অপরাধবোধ এবং সেহেতু সৃষ্টি হওয়া আত্মবিশ্বাস এর অভাব থেকেই সেই যুক্তিজাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় প্রতিবার এবং সে মন থেকে মেনে নিতে বাধ্য হয় যে দোষটা শেষ পর্যন্ত তারই ছিল।
কিন্তু সবকিছুই সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল একসময়। শাশুড়ি গায়ত্রীর সঙ্গে নম্রতার সুসম্পর্ক তাদের পরিচিত অনেক শাশুড়ি বউমাদের বিস্ময় ও ঈর্ষার কারণ ছিল। অপরিচিত কেউ কেউ তাদের প্রথমবার একসঙ্গে দেখে মা-মেয়ে বলে ভুলও করত। সকালবেলায় গায়ত্রীর হাতের তৈরি কড়া মিঠে চা পেটে না পড়লে তার সাধের নমুর চোখ থেকে নিদ্রাদেবী যেন বিদায় নিতেই চাইতেন না। আবার রাতের বেলায় নম্রতা মাথা টিপে না দিলে গায়ত্রী দেবীর ঘুমই আসতে চাইত না যেন। তিনি বলতেন নম্রতার হাতের পাঁচটা আঙুল তাঁর শরীরের পঞ্চইন্দ্রিয়কে অলস করে দিয়ে তাঁকে নিদ্রাসমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্যই তৈরি হয়েছে। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল মহানন্দে।
কিন্তু সমস্ত সমস্যার সূত্রপাত শাশুড়ির উত্তর ভারতে তীর্থযাত্রা করতে যাওয়ার সময়। বিধবা গায়ত্রীদেবী এবং তাঁর দু’জন বান্ধবী একসঙ্গে হরিদ্বার, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন ইত্যাদি সমস্ত জায়গা মিলিয়ে প্রায় একমাসের জন্য বেশ বড়সড় একটা প্যাকেজ ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলেন। অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা চলছিল। অবশেষে একটি ট্র্যাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে এক দুপুরবেলা সবাই রওনা দিলেন দুর্গা দুর্গা বলে।
তার কিছুদিন পরেই এক রোববার তথাগত আর নম্রতা মিলে তাদের বাড়ি গোছগাছ করছিল। নম্রতা পরিষ্কার করছিল তার শাশুড়ির ঘরটা। গায়ত্রীর বিছানার তলা পরিষ্কার করতে গিয়ে সেখানে বহুকাল ধরে রাখা বেশ কিছু পুরনো কাগজের বাক্স ও কাপড়ের পুঁটলি বের করতে হল। গায়ত্রী নম্রতার সামনেই এইগুলো অনেকবার বের করেছেন ও ঢুকিয়ে রেখেছেন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে। কিন্তু কখনও খুলে দেখাননি। হয়তো দেখানোর মতো কিছু ছিল না বলে। কিন্তু আজ নম্রতার খেয়াল হল একবার ওগুলো খুলে দেখতে। ভিতরে যদি পোকামাকড় হয়ে থাকে, সেইগুলো তাড়িয়ে দেওয়াই ভালো। আর তা করতে গিয়েই একটা কাপড়ের পুঁটলির মধ্যে একটা প্যাকেটে মোড়া সেই মোবাইলটি সে পায়, যা ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে চলেছিল সব সমস্যার মূল। হায়! যদি সে ওই পুরনো মুঠোফোনটার ইতিহাস আগে থেকেই জানত, তাহলে তা আর তথাগতকে ডেকে দেখাতে যেত না।
তথাগতের প্রতিক্রিয়া বেশ একটু অন্যরকম ছিল সেটা প্রথম দেখে। সে মোবাইলটার দিকে কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল। তারপর প্রায় ছোঁ মেরে নম্রতার হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে একই সঙ্গে বিস্ময় ও আনন্দ মাখানো গলায় বলে উঠল, “এ কী! এটা কোথায় পেলে? এটা তো বহুদিন আগে হারিয়ে গিয়েছিল!”
“মায়ের একটা পুঁটলির মধ্যে।” উত্তর দিল নম্রতা।
তথাগত কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে নম্রতার দিকে চেয়ে থেকে আপন মনেই বলে উঠল, “ও! তা হলে কি মা-ই লুকিয়ে রেখেছিল?”
নম্রতা ব্যাপারটা নিয়ে বেশ আগ্রহ অনুভব করছিল। “এটা কি তোমার পুরনো মোবাইল?” সে জিজ্ঞাসা করল।
তথাগত একমনে মোবাইলটাকে দেখে চলেছে। নম্রতার প্রশ্নে কোনওরকম ভ্রূক্ষেপই নেই তার। মোবাইলটা দেখতে দেখতে কখনও তার মুখ গম্ভীর হচ্ছে, আবার কখনও বা আনন্দে ভরে উঠছে। নম্রতা আবার প্রশ্নটা করল, এইবার একটু গলা খাঁকারি দিয়ে, “এটা কি পুরনো মোবাইল তোমার?”
“অ্যাঁ… ও, হ্যাঁ।” তথাগতর এবার খেয়াল হল। নম্রতার প্রশ্নটা আর পাশ কাটিয়ে যেতে পারল না। “হ্যাঁ, প্রায় পনেরো বছর আগের। তখন সবে নতুন মোবাইল আসছে ভারতের বাজারে। বাবা দিয়েছিলেন এটা।” তারপর আবার মোবাইলটা দেখতে দেখতে বলল, “তখন আমি গ্র্যাজুয়েশন করছি বর্ধমান থেকে। ওখানেই কলেজের হস্টেলে থাকতাম। একটাই মাত্র ল্যান্ডলাইন সেখানে। কথা বলার জন্য প্রায় বুকিং করে রাখতে হত আগে থেকে। সবাই নিজের নিজের বাড়ির লোককে এক একটা নির্দিষ্ট সময়ে ফোন করতে বলে রাখত। তাতেই পাবলিকের লাইন লেগে থাকত। আমার বাবা-মা ফোন করত রাত্রি ন’টা নাগাদ। অন্য সময় করলে লাইন পেত না, বাকিরা তখন কথা বলত।”
একটু থেমে তথাগত আবার তার পুরনো স্মৃতিতে ডুব দিল, “যাই হোক, এইসব ঝামেলা দেখে বাবা আমাকে এই মোবাইলটা দিয়েছিল। তখন সবে এখানে মোবাইল সার্ভিস শুরু হচ্ছে। সেকালের মোবাইল এটা, ওজন দেখেছ জিনিসটার! তবে মোবাইল দিলেও বাবার অভ্যাস কিন্তু বদলাল না। সেই রাত্রি ন’টা নাগাদই ফোন করত রোজ।”
“ফোনটা কি খারাপ হয়ে গিয়েছিল?” নম্রতা জানতে চাইল।
“না এটা তো ঠিকই ছিল। তুমি তো জানোই, আমার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবার কিছুদিন পরেই বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় হঠাৎ। তার কিছুদিন পরে এই ফোনটাও হঠাৎই হারিয়ে যায়। ফোনটা দেখতে খারাপ হয়ে গেলেও আশা করি কাজ ঠিকই করবে। দাঁড়াও তো, দেখি একটু!” বলে তথাগত উঠে পড়ল। মায়ের ওই পুরনো পুঁটলিটা থেকে মোবাইলের চার্জারটাও পাওয়া গেল। তথাগত মুঠোফোনটাকে চার্জ দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করল প্রথমে। তারপর নিজের বর্তমান মোবাইলের সিমকার্ডটা পুরনোটাতে পুরে, সেখান থেকে নম্রতার নাম্বারে ফোন করল। নম্রতার মোবাইল রিং হল কোনও সমস্যা ছাড়াই। মোবাইলটা ঠিকঠাক কাজ করছে দেখে তথাগত’র খুশি আর ধরে না। তার চোখেমুখে এখন বাচ্চাদের উচ্ছ্বলতা। নতুন কোনও লেটেস্ট মডেলের মোবাইল হাতে পেলে যেমন হয়। পুরনো তথাগতও কি এমনই খুশি হয়েছিল বছর পনেরো আগে, এই যন্ত্রটা পেয়ে? নম্রতা কল্পনা করার চেষ্টা করল।
তথাগত তারপর থেকে পুরনো মোবাইলটা নিজের কাছেই রাখছে, কখনওই কাছছাড়া করছে না। তার নতুন মোবাইলের জন্যও একটা নতুন সিম কিনেছে। এখন ওর দুটো ফোন। পুরনোটাও বেশ ভালোই সার্ভিস দিচ্ছে। পুরনো জিনিসের সত্যিই দম আছে বলতে হবে, নম্রতা মনে মনে বলে।
কিন্তু আপদ শুরু হল কয়েকদিন পর থেকে। শাশুড়ি তখনও হরিদ্বারে। প্রতিদিন রাত্রে সময় করে কখনও নম্রতা গায়ত্রীকে, আবার কখনও গায়ত্রী দেবী নম্রতাকে ফোন করেন। সারাদিনের সব জমা কথা বেরিয়ে আসে। নম্রতা একদিন কথায় কথায় গায়ত্রীকে পুরনো মোবাইলের কথাটা জানাল। গায়ত্রীদেবী এতক্ষণ বেশ খোশমেজাজে ছিলেন, কিন্তু পুরানো মোবাইলের কথাটা শুনেই হঠাৎ চুপ করে গেলেন। একটু পরে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, তথাগত কি প্রতিদিন রাত ন’টা নাগাদ ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে?”
“সেটা তো খেয়াল করিনি মা। ও তো সবসময় ওটাই ব্যবহার করছে এখন। সব কথাবার্তা ওতেই বলে।” গায়ত্রীদেবী ওপার থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে, এখন থেকে একটু খেয়াল রেখো তো! আমাকে জানাবে।” বলে ফোনটা আচমকাই কেটে দিলেন।
সেদিনই নম্রতা খেয়াল করল যে রাত ঠিক ন’টায় তথাগত ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল, কারও সঙ্গে কথা বলার জন্য। অন্যান্য কল তো ঘরের মধ্যেই করে তথাগত। তাহলে এখন হঠাৎ বারান্দায় যাবার কারণ কী? আর মা-ই বা কেন রাতে তথাগতর ফোন করার কথা বললেন? মেয়েরা সাধারণত স্বভাব কৌতূহলী। নম্রতা কাজের অছিলায় বারান্দার কাছাকাছি গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ফোনে তথাগত কী কথা বলছে, আর কার সঙ্গেই বা বলছে।
কিন্তু অল্পস্বল্প যা শুনতে পেল, তাতেই তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। তার শুনতে পাওয়া কয়েকটা কথার টুকরো ছিল এরকম : ‘বাবা, ওখানে কেমন লাগছে? — ভাগ্য ভালো ফোনটা পাওয়া গেল, না হলে তোমার সঙ্গে আর যোগাযোগই হত না। — তুমি কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলে বাবা? — ফিরে এসো।”
শাশুড়িকে ফোনে নম্রতা জানাল সমস্ত কথা। শাশুড়ি সব শুনে গম্ভীর গলায় বললেন, “কাজটা তুমি ঠিক করোনি বউমা। আমার জিনিসে হাত দেওয়ার আগে অন্তত একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতে!”
“আমি তো শুধু ধুলো ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম মা,” নম্রতা আত্মরক্ষার চেষ্টা করল। “কিন্তু ব্যাপারটা কী একটু বলবেন?”
শাশুড়ির কাছ থেকেই নম্রতা জানতে পারল পুরো ঘটনাটা। ছেলেরা সাধারণত মা ন্যাওটা হয়। কিন্তু তথাগত ছিল বাবা অন্ত প্রাণ, যা ছেলেদের ক্ষেত্রে একটু বিরল। বাবা-ই ছিল তার বেস্ট ফ্রেন্ড। তাই বাবার হঠাৎ মারা যাওয়ার ধাক্কাটা সে খুব সহজে মেনে নিতে পারেনি। হোস্টেলে থাকাকালীন তার বাবা তাকে রোজ রাত্রি ন’টা নাগাদ ফোন করত। তখন প্রাণ খুলে বাবা আর ছেলের কথা হত। আর তাদের বন্ধন এতটাই গভীর ছিল যে বাবার মৃত্যুর পরও সেই নিয়মে ছেদ পড়েনি, তথাগতই ছেদ পড়তে দেয়নি। সে নাকি দেখতে পেত তার বাবা ওই সময় তাকে এখনও ফোন করছে। যদিও অন্য কারোর চোখে তা ধরা পড়ত না কোনওভাবেই। অথচ তথাগত ফোন রিসিভ করে বাবার সঙ্গে অনর্গল কথা বলত। কখনও কখনও সে নিজেও ফোন করত বাবাকে। অন্যরা তার বাবার নাম্বারে ফোন করে দেখেছিল, কিন্তু একই কথা সবাই যথারীতি শুনত, ‘দ্য নাম্বার ইজ সুইচ অফ’। কারণ বাবার সেই সেট অব্যবহৃত অবস্থায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল তখন বাড়িতে। কিন্তু তথাগত ওই নাম্বারে ফোন করেই বাবার সঙ্গে দিব্যি কথাবার্তা চালিয়ে যেত। বাকিরা সেইসময় তথাগত’র কাছাকাছি থেকে অপর দিকের আওয়াজ শোনার চেষ্টা করত বিভিন্নভাবে। কিন্তু বহু প্রয়াস সত্ত্বেও এপারে তথাগত’র কথা ছাড়া অপর প্রান্ত থেকে কোনও আওয়াজই শুনতে পায়নি কেউ কোনওদিন।
কিন্তু তথাগত তা মানতে নারাজ। তার দাবি, সে প্রতিদিনই তার বাবার সঙ্গে কথা বলে। বোঝা যাচ্ছিল যে, ব্যাপারটা তথাগতর ক্ষেত্রে একটা জটিল মানসিক রোগের রূপ নিচ্ছে। তাই একজন মনস্তত্ববিদের পরামর্শ নেওয়া হল। তার পরামর্শেই তথাগতর ওই মোবাইল লুকিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু তথাগত জানল তার মোবাইল হারিয়ে গেছে।
মোবাইল নিরুদ্দেশ হওয়ার প্রথমদিকে তার মনমেজাজ ভালো থাকত না একেবারেই। মেজাজ বিগড়ে যেত, যখন তখন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিত। লোকজনের সঙ্গে, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করতে চাইত না। বেশিরভাগ সময়েই গুম মেরে ঘরের মধ্যে বসে থাকত।
কিন্তু মনস্তত্ববিদের কথা মতোই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগল। দেখতে দেখতে তথাগত সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গেল একসময়, ভুলেই গেল পুরনো সেই মোবাইলটার কথা।
গায়ত্রীদেবী সমস্ত বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। শেষে হতাশার স্বরে যোগ করলেন, “তুমি জানো না বউমা তুমি কী সর্বনেশে কাণ্ড করেছ! আবার ফিরিয়ে এনেছ সেই অভিশাপকে তথাগত’র জীবনে।”
নম্রতা বোঝাতে গেল গায়ত্রীকে, “বিশ্বাস করুন মা, আমি এত কিছু ভেবে করিনি। আমি জানব কী করে যে ওই পুঁটলিটার মধ্যে—”, কিন্তু তার কথা শেষ হবার আগেই গায়ত্রীদেবী ফোন কেটে দিলেন।
নম্রতা এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে নিজের অজ্ঞাতসারেই সে একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু এই ভুল শোধরানোর কি কোনও উপায় নেই?
তারপর প্রায় একবছর কেটে গেছে। তথাগত এখনও রোজ রাত ন’টা নাগাদ পুরনো ফোনে তার বাবার সঙ্গে কথা বলে। নম্রতা প্রথমদিকে চেষ্টা করেছিল ফোনটা আবার লুকিয়ে ফেলার, কিন্তু তথাগত ওটাকে কখনওই কাছছাড়া করে না। এমনকি বাথরুম যাওয়ার সময়ও সঙ্গে রাখে, আবার হারিয়ে ফেলার ভয়ে। নম্রতাও এখন তাই চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে। তবে এর ফলে তার খুব যে একটা অসুবিধা হচ্ছে তা বলাটাও ঠিক হবে না। তথাগত’র বাকি সব কাজকর্মই অত্যন্ত স্বাভাবিক। তার ঘুম থেকে ওঠা, শরীরচর্চা, অফিস যাওয়া, অফিস ফেরত বাজার করে আনা, নম্রতাকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্তই রুটিনমাফিক, শুধু প্রতিদিন রাতে ওই একটা মাত্র ফোন কল ছাড়া। তবে এত স্বাভাবিকত্বের মাঝখানে এই সামান্য একটু অস্বাভাবিকতা বোধহয় মেনে নেওয়া যেতে পারে। বিশেষত যখন তা কারও কোন ক্ষতি করছে না। নম্রতার অন্তত তাই মত।
নম্রতার শাশুড়িও এখন অনেকটাই নরম হয়েছেন তার প্রতি। মাঝে মাঝে যদিও একটু আধটু বকাঝকা করেন নম্রতাকে এই নিয়ে, কিন্তু তার মধ্যে আর আগের সেই ঝাঁঝ নেই। বউমা না বলে আবার উনি নম্রতাকে মাঝেমধ্যে নমু বলে ডাকতে শুরু করেছেন, সেই আগের মতো। যদিও এখন তিনি প্রায় স্থায়ী কাশীবাসিনী, তবুও নম্রতার সঙ্গে ফোনে তাঁর প্রতিদিনই কথা হয়। নম্রতা বার বার তাঁকে বলে, “মা আর কতদিন থাকবেন ওখানে? সেই একবছর আগে তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছেন, এবার তো ফিরে আসুন। আপনাকে ছাড়া এই ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছুই তেমন ভালো লাগে না।”
ওপার থেকে গায়ত্রীদেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “ওরে নমু! ফেরার কী আমার আর উপায় আছে রে মা!”
সত্যিই গায়ত্রীদেবীর ফেরার কোনও উপায় নেই আর। বছর খানেক আগে তীর্থভ্রমণ চলাকালীনই, হঠাৎ এক রাতে হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তথাগত’র পুরনো মুঠোফোন খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটা নম্রতার কাছে জানার দিনকয়েক পরেই ঘটে এই দুর্ঘটনা। তখন তিনি কাশীতে। তথাগতরা সেখানে গিয়েই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে আসে।
তুচ্ছাতিতুচ্ছ, এমনকি একসময়ে বাতিল করে দেওয়া বহু জিনিসও অনেকের জীবনে সত্যিই অনেক বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। যেমন তথাগত’র জীবনের প্রথম মোবাইল নম্রতার জীবনে এনে দিয়েছে।
মৃণাল নন্দী
জন্মসূত্রে বাঁকুড়ার মানুষ, কর্মসূত্রে আপাতত কলকাতার বাসিন্দা। ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনার চাপে ও কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে খুব বেশি লেখালেখি করতে পারেননি। তবে সময় পেলে যথাসম্ভব লেখার চেষ্টা করেন। মূলত অলৌকিক, কল্পবিজ্ঞান, রোমাঞ্চ ও সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লিখতেই বেশি পছন্দ করেন, আর ভালোবাসেন রম্যরচনা লিখতে। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গল্প ও রচনা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন