জ্ঞান ও বাঙলা ও ইংরেজি

হুমায়ুন আজাদ

উনিশশতকের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালির জ্ঞানচর্চার প্রধান ভাষা ইংরেজি। সাহিত্য ও সাহিত্যসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ছাড়া অন্যদের মনে খুব কম সময়ই বাঙলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার উৎসাহ জেগেছে। বাঙালির জ্ঞানও পরাধীন, জ্ঞানের এলাকায় অসাধারণ ও মৌলিক কিছু করতে বাঙালি বিশেষ সক্ষম হয় নি, যদিও কারো কারো ভৃত্যসুলভ শ্রমের উৎপাদন বিদেশিদের কাছে কখনো কখনো প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু তাতে বাঙালির নিজস্ব জ্ঞানের জগত গ’ড়ে উঠতে পারে নি। গত দেড়শো বছরে অজস্র ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেছেন বাঙলার পণ্ডিত ব্যক্তিরা, ওই গ্রন্থরাজির অধিকাংশই অপঠিত থেকে গেছে—বহু শ্রমে রচিত ওই সব বইয়ের বাণী বাঙালি সমাজে সঞ্চারিত হ’তে পারে নি। আমাদের জ্ঞান-জগত গ’ড়ে তুলেছে সে-সব প্রচেষ্টা, যা তথাকথিতভাবে ‘আন্তর্জাতিক’ হতে চায় নি, হ’তে চেয়েছে বাঙলার নিজস্ব, এবং রচিত হয়েছে বাঙলা ভাষায়। বাঙলার সাহিত্যিক ও সাহিত্যসংশ্লিষ্টরাই প্রধানত উদ্ভব ও বিকাশ ঘটিয়েছেন বাঙলার জ্ঞানজগতের; বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ, চিকিৎসাশাস্ত্রী, অর্থনীতিবিদ ও অন্যরা আমাদের জ্ঞানজগতের সৃষ্টি-ও বিকাশে মেধা নিয়োগ করেছেন সামান্য। বাঙালি মুসলমান জ্ঞানচর্চা শুরু করেছে অনেক পরে এবং নিয়েছে ইংরেজিকেই।

বাঙলাদেশের পণ্ডিতেরা ইংরেজিনিষ্ঠ। মানববিদ্যা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যখন তাঁরা গবেষণায় উদ্যত হন, তখন ইংরেজিকে অবলম্বন করেন। গত এক দশকে বাঙলাদেশের পণ্ডিতেরা ইংরেজিতে যে-সব পুস্তক লিখেছেন, তার অধিকাংশই নিম্নমানের। বরং যাঁরা বাঙলায় গবেষণা করেন, তাঁরা হয়ে ওঠেন অনেক বেশি মৌলিক ও গভীর। ইংরেজিতে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের লক্ষ্য পশ্চিমের কোনো প্রতিষ্ঠান বা শক্তিমানের দৃষ্টি আকর্ষণ; বাঙলায় যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের লক্ষ্য রচনাকে মূল্যবান করা। যখন কোনো সমাজ-বা রাষ্ট্র-বিজ্ঞানী বাঙলা ভাষায় সমাজ-রাষ্ট্রের নানা ক্রিয়াকলাপ প্রক্রিয়া ব্যাখ্যায় মন দেন, তখন তিনি উদ্ঘাটন করতে চান বিষয়ের আভ্যন্তর সূত্র; আর যখন ইংরেজিতে লেখেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন তথ্য-উপাত্ত সরবরাহকারী। ঢাকা শহরে এখন অনেক ইংরেজি গবেষণাপত্ৰিকা প্ৰকাশ পায়; ওগুলোতে যে-সব রচনা মুদ্রিত হয়, বাঙলায় রচিত হ’লে সেগুলো মুদ্রণযোগ্যও বিবেচিত হতো না। তাই এখন বাঙালির ইংরেজি ভাষায় গবেষণা আত্মস্বার্থে পণ্ডশ্রমমাত্র, তা বিশ্বের ও বাঙলার জ্ঞানজগতে কোনো কম্পন সৃষ্টি করে না।

সকল অধ্যায়

১. অবতরণিকা
২. শত্রুমিত্র শনাক্তকরণ
৩. শত্রুমিত্রতার ইতিকথা
৪. পাকিস্তানি শত্রুতা ও কয়েকজন কুখ্যাত শত্রু
৫. ঔপনিবেশিক ঘোর
৬. কানা নিতাই ও খোঁড়া অদ্বৈতের উত্তরাধিকারীরা
৭. বাঙলা প্রচলনের সমস্যাটি ভাষাতাত্ত্বিক নয়
৮. ইংরেজি ও বাঙলা : শ্ৰেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণী-উত্তরণ
৯. ইংরেজি : পশ্চিমের জানালা- কার জন্যে খোলা থাকা দরকার?
১০. কতো টাকা জমলে বাঙলাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয়?
১১. ইংরেজি : চক্রান্ত ও শোষণের ভাষা
১২. বাঙলা : তোষণ ও প্রতারণার ভাষা
১৩. ফেব্রুয়ারি : উৎসব ও স্নিগ্ধ ছলনার মাস
১৪. বাঙলা প্রচলনের বর্তমান অবস্থা
১৫. সরকার ও বাঙলা
১৬. রাজনীতিক ও বাঙলা
১৭. আমলা ও বাঙলা
১৮. বিচারালয় ও বাঙলা
১৯. বাঙলা একাডেমি ও বাঙলা
২০. বিশ্ববিদ্যালয় ও বাঙলা
২১. খেলোয়াড় ও বাঙলা
২২. নামকরণ ও বাঙলা
২৩. পণ্য ও বাঙলা
২৪. জ্ঞান ও বাঙলা ও ইংরেজি
২৫. ভাষা-পরিকল্পনার সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য
২৬. উপসংহার
২৭. পরিশিষ্ট : এক – ভাষা-আন্দোলন : নূরুল আমীনের দৃষ্টিতে
২৮. পরিশিষ্ট : দুই – ভাষা-আন্দোলন ১৯৮২
২৯. গ্রন্থপঞ্জি – ভাষা-বিতর্ক ও ভাষা-আন্দোলন বিষয়ক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন