ঔপনিবেশিক ঘোর

হুমায়ুন আজাদ

রাতভর পান করলে তার ঘোর লেগে থাকে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা পর্যন্ত; মত্ততায় বিবশ হয়ে থাকে সমস্ত স্নায়ু, পেশি, মস্তিষ্ক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালের সবচেয়ে কড়া মদের নাম ঔপনিবেশিক মদ, যা পান করেছি আমরা দু-শো বছর; এবং তার ‘হ্যাঙওভার’ বা ঘোর এখনো কাটে নি, দিন দিন বাড়ছে। শাদা সাহেবেরা চ’লে যাওয়ার সময় এ-দেশে রেখে যান কয়েক লাখ কালো সাহেব, যাঁরা প্রভুদের গুণগুলো আয়ত্ত করে নি, কিন্তু দোষগুলো যত্নের সাথে অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এ-দুর্দশাগ্রস্ত গ্রহের চতুদিকে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটতে থাকে। স্বাধীনতার উল্লাসে এসব দেশে তৈরি করা হয় মধ্যযুগীয় সম্রাটের চিত্তে ঈর্ষা জাগানো রাষ্ট্রপতিভবন, প্রধান মন্ত্রীর প্রাসাদ, নির্মাণ করা হয় এশিয়া-আফ্রিকার বৃহত্তম স্টেডিয়াম, উচ্চতম টাওয়ার; দেখা দেয় অলাভজনক বিমানসংস্থা, বাণিজ্যতরী, স্কুলোদর একমুখি রাজপথ, রোলসরয়েস মার্সিডিজ, এবং নির্ধারণ করা হয় একটি ‘রাষ্ট্রভাষা”। কিন্তু স্বাধীনতার এ-বাহ্য উল্লাস কাটিয়ে উঠতে পারে না ঔপনিবেশিক ঘোর; তাই এসব দেশে স্বাধীনতার অর্থ হয় বিদেশি ঔপনিবেশিকদের হাত থেকে দেশি ঔপনিবেশিকদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। ঔপনিবেশিক ঘোর খুব স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে ভাষার ক্ষেত্রে : দেখা যায় নির্ধারিত ‘রাষ্ট্রভাষা’টি থাকে নামেমাত্র, আর রাজনীতিক আমলা বিচারপতি আইনজীবী চিকিৎসক ব্যবসায়ী প্রকৌশলী শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরা’ অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ফলভোগীরা লিপ্ত থাকেন একদা প্রভুদের ভাষা চর্বণে-রোমখনে। যে-সব দেশে, যেমন আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে, মহান ঐতিহ্যমণ্ডিত’ কোনো ভাষা নেই, সেখানে ঔপনিবেশিক ভাষাটিই অবাধে হয়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা; কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সে-সব দেশে, যেখানে আছে ‘মহান ঐতিহ্যমণ্ডিত’ এক বা একাধিক ভাষা। পাকিস্তান ও ভারত এ-সমস্যা উপলদ্ধি করেছে অস্থিমজ্জায়।

ঔপনিবেশিক ঘোর বাঙলাদেশের বৃহত্তম সমস্যাগুলোর অন্যতম। ঘোর কাটানোর কোনো প্রয়াস নেই, বরং নব নব ঘোরে আচ্ছন্ন হওয়ার উদ্দীপনা চতুর্দিকে। যে-আইনে এদেশে বিচার হয় পকেটমারের, তা লিখিত ইংরেজিতে; উদ্বাস্তুকে উৎখাত করার বিধিও লিপিবদ্ধ ইংরেজিতে; চিকিৎসক ভিখিরিকেও ঔষুধের বিধান দেন ইংরেজিতে। আরো গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর কথা উল্লেখ করাই বাহুল্য। এ-ঘোর উপকারে আসে ক্ষমতাশালীদের, তাই এ-ঘোর থেকে তাঁরা মুক্তি চান না; বরং তাকে ঘোরতর ক’রে তোলেন। এ-ঘোরেই বাঙলাদেশের সংবিধান প্রথমে রচিত হয় ইংরেজিতে, পরে তাকে অনুবাদ করা হয় বাঙলাভাষায়।

সকল অধ্যায়

১. অবতরণিকা
২. শত্রুমিত্র শনাক্তকরণ
৩. শত্রুমিত্রতার ইতিকথা
৪. পাকিস্তানি শত্রুতা ও কয়েকজন কুখ্যাত শত্রু
৫. ঔপনিবেশিক ঘোর
৬. কানা নিতাই ও খোঁড়া অদ্বৈতের উত্তরাধিকারীরা
৭. বাঙলা প্রচলনের সমস্যাটি ভাষাতাত্ত্বিক নয়
৮. ইংরেজি ও বাঙলা : শ্ৰেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণী-উত্তরণ
৯. ইংরেজি : পশ্চিমের জানালা- কার জন্যে খোলা থাকা দরকার?
১০. কতো টাকা জমলে বাঙলাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয়?
১১. ইংরেজি : চক্রান্ত ও শোষণের ভাষা
১২. বাঙলা : তোষণ ও প্রতারণার ভাষা
১৩. ফেব্রুয়ারি : উৎসব ও স্নিগ্ধ ছলনার মাস
১৪. বাঙলা প্রচলনের বর্তমান অবস্থা
১৫. সরকার ও বাঙলা
১৬. রাজনীতিক ও বাঙলা
১৭. আমলা ও বাঙলা
১৮. বিচারালয় ও বাঙলা
১৯. বাঙলা একাডেমি ও বাঙলা
২০. বিশ্ববিদ্যালয় ও বাঙলা
২১. খেলোয়াড় ও বাঙলা
২২. নামকরণ ও বাঙলা
২৩. পণ্য ও বাঙলা
২৪. জ্ঞান ও বাঙলা ও ইংরেজি
২৫. ভাষা-পরিকল্পনার সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য
২৬. উপসংহার
২৭. পরিশিষ্ট : এক – ভাষা-আন্দোলন : নূরুল আমীনের দৃষ্টিতে
২৮. পরিশিষ্ট : দুই – ভাষা-আন্দোলন ১৯৮২
২৯. গ্রন্থপঞ্জি – ভাষা-বিতর্ক ও ভাষা-আন্দোলন বিষয়ক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন