বাঙলা একাডেমি ও বাঙলা

হুমায়ুন আজাদ

ভাষা-আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রতিষ্ঠানিক পরিণতির নাম ‘বাঙলা একাডেমি’। স্বাধীনতার পর বাঙলা একাডেমির আকার ও দায়িত্ব বৃদ্ধি পায়; এবং অনেকের ধারণা সর্বস্তরে বাঙলা বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব ন্যস্ত বাঙলা একাডেমির ওপর। এখন অবশ্য বাঙলা একাডেমি ও ব্যর্থতা একার্থবোধক। এটি আর জ্ঞনকেন্দ্র নয়, আর দশটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতোই একটি বিশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান এটি। বাঙলা একাডেমির মূল দায়িত্ব কী, বোঝা কঠিন; এর অজস্র বিশৃঙ্খল নিরর্থক নিষ্ঠাহীন কাজের স্রোতে মূল লক্ষ্য খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে। ইতালি, ফরাশি প্রভৃতি দেশে একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো দেশের বিশৃঙ্খল ভাষার মানরূপ প্রতিষ্ঠার জন্যে। ইতালীয় ও ফরাশি একাডেমি প্রথমেই প্রকাশ করেছিলো এমন ব্যাপক বিস্তৃত নির্ভরযোগ্য অভিধান, যা ইতালীয় ও ফরাশি ভাষার মানরূপ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। কয়েক দশকেও বাঙলা একাডেমি একটি ব্যাপক ও নির্ভরযোগ্য অভিধান প্রকাশ করতে পারে নি। বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (১৯৭৪) নামে যে-খণ্ডিত অভিধানটি (স্বরবর্ণ অংশ) একাডেমি প্রকাশ করেছে, তা কেউ ব্যবহার করে না; বাঙলা একাডেমিতেও ব্যবহৃত হয় না। অত্যন্ত বিশৃঙ্খল, ত্রুটিপূর্ণ, অবৈজ্ঞানিক এ-অভিধান খণ্ডটি। জ্ঞানসাধনায় বাঙলা একাডেমির শোচনীয় ব্যর্থতার নিদর্শন এটি।

বাঙলা একাডেমির এক বড়ো দায়িত্ব পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করা। ১৯৭২- ১৯৮১ সালের মধ্যে বাঙলা একাডেমি প্রকাশ করেছে ৫৯৯টি বই, যার মধ্যে অভিধান, পরিভাষা, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, শিশুসাহিত্য, রচনাবলি, পাঠ্যপুস্তক প্রভৃতি রয়েছে। অজস্র অত্যন্ত নিম্নমানের বই প্রকাশ করেছে বাঙলা একাডেমি, এবং ক’রে চলছে। বাঙলা একাডেমি পরিভাষা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলো এবং এ-ক্ষেত্রে সীমিত সার্থকতা অর্জন করেছে। বাঙলা বাস্তবায়নের জন্যে বাঙলা একাডেমি বাঙলা মুদ্রাক্ষর ও সাঁটলিপির প্রশিক্ষণ দেয়ারও ব্যবস্থা করেছিলো, এবং বিদেশিদের বাঙলা শেখানোরও উদ্যোগ নিয়েছিলো; কিন্তু অল্পকাল পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়।

বাঙলা একাডেমির ব্যর্থতা বেশ বিশাল ও মর্মস্পর্শী; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একাডেমিকে সফল করার কোনো আন্তরিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো কি না? সবার জন্য পরিভাষা, মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ, বাঙলা ভাষার মানরূপ স্থির করা ইত্যাদি বিশাল কাজ। এর জন্যে দরকার অনেক জ্ঞানীব্যক্তি, আর প্রচুর অর্থ। মনে করা যাক সর্বস্তরে বাঙলা বাস্তবায়নের জন্যে দরকার দশ হাজার বই; এবং প্রতিটি বই রচনা-প্রকাশনার জন্যে দরকার এক লক্ষ টাকা। তাহলে দশ হাজার বই প্রকাশের জন্যে প্রয়োজন একশো কোটি টাকা। দশ বছরে একশো কোটি- বছরে দশ কোটি— বেশি নয়; তবে বাঙলা একাডেমি দুঃস্বপ্নেও এতো টাকার কথা ভাবতে পারে না। ১৯৮০-৮৫-র পরিকল্পনায় পাঠ্যপুস্তকের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে এক কোটি তিরাশি লক্ষ, অ-পাঠ্যপুস্তকের জন্যে এক কোটি তেইশ লক্ষ টাকা। এতো কম টাকায় সর্বস্তরে বাঙলা বাস্তবায়ন অসম্ভব।

সকল অধ্যায়

১. অবতরণিকা
২. শত্রুমিত্র শনাক্তকরণ
৩. শত্রুমিত্রতার ইতিকথা
৪. পাকিস্তানি শত্রুতা ও কয়েকজন কুখ্যাত শত্রু
৫. ঔপনিবেশিক ঘোর
৬. কানা নিতাই ও খোঁড়া অদ্বৈতের উত্তরাধিকারীরা
৭. বাঙলা প্রচলনের সমস্যাটি ভাষাতাত্ত্বিক নয়
৮. ইংরেজি ও বাঙলা : শ্ৰেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণী-উত্তরণ
৯. ইংরেজি : পশ্চিমের জানালা- কার জন্যে খোলা থাকা দরকার?
১০. কতো টাকা জমলে বাঙলাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয়?
১১. ইংরেজি : চক্রান্ত ও শোষণের ভাষা
১২. বাঙলা : তোষণ ও প্রতারণার ভাষা
১৩. ফেব্রুয়ারি : উৎসব ও স্নিগ্ধ ছলনার মাস
১৪. বাঙলা প্রচলনের বর্তমান অবস্থা
১৫. সরকার ও বাঙলা
১৬. রাজনীতিক ও বাঙলা
১৭. আমলা ও বাঙলা
১৮. বিচারালয় ও বাঙলা
১৯. বাঙলা একাডেমি ও বাঙলা
২০. বিশ্ববিদ্যালয় ও বাঙলা
২১. খেলোয়াড় ও বাঙলা
২২. নামকরণ ও বাঙলা
২৩. পণ্য ও বাঙলা
২৪. জ্ঞান ও বাঙলা ও ইংরেজি
২৫. ভাষা-পরিকল্পনার সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য
২৬. উপসংহার
২৭. পরিশিষ্ট : এক – ভাষা-আন্দোলন : নূরুল আমীনের দৃষ্টিতে
২৮. পরিশিষ্ট : দুই – ভাষা-আন্দোলন ১৯৮২
২৯. গ্রন্থপঞ্জি – ভাষা-বিতর্ক ও ভাষা-আন্দোলন বিষয়ক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন