উপনিষদগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কোনটি তা নিয়ে সমস্যা রয়েছে; কেউ বলেছেন-ছান্দোগ্য; কারও মতে, বৃহদারণ্যক৷ ছান্দোগ্যকে যাঁরা প্রাচীনতম বলেন তাঁরা দলে ভারী৷ আমরা তাই তাঁদের কথা মেনেই ছান্দোগ্য দিয়েই আলোচনা শুরু করব৷
ছান্দোগ্য
ছান্দোগ্য উপনিষদ শুধু প্রাচীনতমই নয়, গৌরবেও যেমন বিশিষ্ট, আয়তনেও বিশাল৷ এর আটটি অধ্যায়ে ছয়শো সাতাশটি মন্ত্র রয়েছে৷ এই আটটি অধ্যায় একশো চুয়ান্নটি খণ্ডে বিভক্ত; খণ্ডে খণ্ডে সমসংখ্যক মন্ত্র নেই-কোনো খণ্ডে কম, কোনো খণ্ডে বেশি৷
ছান্দোগ্য সামবেদের অঙ্গ, তাই মন্ত্রগুলিও গেয়৷ যে গান দিয়ে উপনিষদটি শুরু করা হয়েছে তাকে বলা হয় ‘উদ্গীথ’৷ উদ্গীথ যজ্ঞবিশেষের প্রস্তাবনার প্রার্থনা-সংগীত৷
যজ্ঞ নানা প্রকারের, তাদের প্রার্থনা-মন্ত্রও বিভিন্ন৷ উদ্গীথ সংগীত হত সোম-যজ্ঞে৷ এই প্রথম শব্দটি ওঁ, এ শব্দটিকে বলা হত প্রণব-প্রণবই প্রার্থনার বাহন৷
প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে যজ্ঞ ও উপাসনার কথা; একে বলা হয় উদ্গীথবিদ্যা৷ চতুর্থ অধ্যায়ে জবালা-নন্দন সত্যকামের উপাখ্যান রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ভর করে বহু প্রসিদ্ধি লাভ করেছে৷ এ নিয়ে বাদানুবাদও হয়েছে যথেষ্ট৷ ‘অহং বহু-চরন্তী’ এই কথা-কয়টি নিয়েই তর্ক৷ শংকর যাঁকে পতিগৃহে পরিচর্যারত বলে ব্যাখ্যা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এঁকেছেন বারনারীরূপে৷ তাতে কাব্যের গৌরব বেড়েছে, কিন্তু সত্যের মর্যাদা হয়তো রক্ষা করা হয়নি৷ সত্যকামের আচার্য গৌতম বলেছেন, ব্রাহ্মণ-তনয় ছাড়া এমন সত্যবাক্য কেউ বলতে পারে না, অর্থাৎ সত্যকাম নিশ্চয় ব্রাহ্মণ-তনয়৷ ষষ্ঠ অধ্যায় থেকে শুরু হয়েছে ব্রহ্মবিদ্যা, যা প্রতিটি উপনিষদেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়৷ উদ্গীথ-বিদ্যার পরিণতি ব্রহ্মবিদ্যায়৷
ষষ্ঠ অধ্যায়ে ব্রহ্মবিদ্যার কথা শুরু করা হয়েছে আরুণি বনাম উদ্দালক, ও তাঁর পুত্রশ্বেতকেতুর উপাখ্যান দিয়ে৷ আরুণি লক্ষ করলেন, শ্বেতকেতু যেন বিদ্যা-গৌরবে কিছু উদ্ধত ও অবিনয়ী হয়ে উঠেছে৷ যদিও প্রচলিত নিয়মানুসারে সে বারো বৎসরই বেদাধ্যয়ন করেছে, তবু সে বেদ-বিদ্যার মর্ম গ্রহণ করতে পারেনি৷ তার বিদ্যা ভাসা-ভাসা৷ বেদাধ্যয়নের লক্ষ্য বিশ্বের পরম সত্তার পূর্ণোপলব্ধি-শ্বেতকেতু সে লক্ষ্যের কাছাকাছিও যেতে পারেনি৷ উদ্দালক তাই শ্বেতকেতুকে ব্রহ্মবিদ্যায় দীক্ষা দিতে শুরু করলেন নানারূপ অপূর্ব উপমা ও স্পষ্ট দৃষ্টান্ত সহযোগে৷ অর্থাৎ তিনি ব্রহ্মবিদ্যার আদিকাণ্ড থেকেই শুরু করলেন৷ এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হল কি করে? এর পূর্বে ব্রহ্মা বা বিশ্বের পরম সত্তা ছিলেন কোথায়? শূন্য থেকেই কি এর জন্ম? উদ্দালক ধাপের পর ধাপ সন্তর্পণে এগিয়ে চললেন চিন্তাজগতের এই সংকীর্ণ পিচ্ছিল পথে৷ তাঁর দীক্ষাদান শেষ করলেন পরমতত্ত্ব ও চরম সত্য ‘তত্ত্বমসি’ মন্ত্রে, যার অর্থ ‘মানুষ তুমি নিজেই সেই আত্মা বা ব্রহ্ম, যিনি বিশ্বের পরম সত্তা, আর যা দিয়ে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়েছে৷’
সপ্তম অধ্যায়ে নারদ ও সনৎকুমারের উপাখ্যান৷ নারদ তপস্বী, তাঁর পাণ্ডিত্যও অপরিসীম৷ বিদ্যার পরিধি তাঁর বহুবিস্তৃত; গণিতশাস্ত্র, নৈসর্গিকতত্ত্ব, ভূবিদ্যা, তর্কশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, বেদ, এমন কি প্রসাধনী ও নানা শিল্প ও কলা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান বিস্ময়কর৷ কিন্তু তথাপি তিনি মানসিক স্থৈর্য ও শান্তি পাননি৷ বিদ্যার এত প্রাচুর্য সত্ত্বেও মাঝে মাঝে তাঁর মন পরম অবসাদগ্রস্ত, বিচলিত ও বিষাদভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে৷ কী করে এই বিষাদ-যোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়? তিনি শুনেছেন যে আত্মজ্ঞান না হলে কেহ দুঃখ থেকে অব্যাহতি পায় না-মানসিক স্থৈর্য ও পরম আনন্দের আস্বাদ পায় না৷ কী করে সেই আত্মজ্ঞান লাভ হয়? মহর্ষি সনৎকুমার কি তাঁকে সে শিক্ষা দেবেন?
উদ্দালকের মতো সনৎকুমারও ব্রহ্মবিদ্যার আদিপর্ব থেকে তাঁর শিক্ষাদান শুরু করেন৷ প্রথমে বলেন নিষ্ফল বা নিরর্থক জ্ঞানের কথা৷ তারপর ক্রমে ক্রমে ব্যাখ্যা করেন অনেক-কিছু; বাগিন্দ্রিয়ের ক্রিয়া, মনের প্রকৃতি, সংকল্পের শক্তি, ধ্যানের সামর্থ্য প্রভৃতি৷ এসবের সঙ্গে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কি সম্পর্ক তাও স্পষ্ট করে বলেন৷ তাঁর শিক্ষার শেষ কথা, ‘নাল্পে সুখমস্তি, ভূমৈব সুখং’ অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও মহৎ বস্তু ছাড়া কারও পরমানন্দ লাভ ঘটে না৷ অল্পে বা সামান্যে তৃপ্তি কোথায়? ভূমা ব্রহ্মেরই নামান্তর৷ তিনি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ৷ ব্রহ্ম শব্দটি ‘বৃহ্’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন-বৃহ্ ধাতুর অর্থ বৃদ্ধি ও বৃহৎ৷
অষ্টম অধ্যায়ে আচার্য ও শিষ্যের নানা কল্পিত আলোচনার মধ্যে রয়েছে অনেক মূল্যবান তথ্য৷ এতে আলোচিত হয়েছে মৃত্যু, মৃত্যুর পরের অবস্থা, নিদ্রা, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি, আর ব্যাখ্যা রয়েছে সুষম্না নাড়ির, যা পরবর্তীকালে উদ্ধৃত হয়েছে কঠোপনিষদে৷ মানুষের হৃদয়ে যে একশো-একটি নাড়ি রয়েছে তার মধ্যে একটি সুষুম্না৷ এটি দিয়ে প্রাণ বহির্গত হলে আর তা মরজগতে ফিরে আসে না৷ আধুনিক জগৎ শারীরস্থানবিদ্যায় এ-নাড়িটিকে স্বীকার করে নিয়েছে৷ এটি ভেগাস (vagus) নামে খ্যাত, একে বলা হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যুর দ্বার৷
এসব আলোচনার মধ্যে একটি সুন্দর আখ্যায়িকাও স্থান পেয়েছে৷ দেবরাজ ইন্দ্র ও অসুররাজ বিরোচন এলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা প্রজাপতির কাছে আত্মজ্ঞান লাভের জন্য৷ বিশ্বস্রষ্টা তাঁদের উভয়কেই যথাযোগ্য শিক্ষাদান করলেন বটে, তবে এর মধ্যে শিক্ষাবিভ্রাট ঘটল; উভয়েই সে শিক্ষা থেকে ভুল তথ্য আহরণ করলেন৷ উভয়েরই ধারণা হল, দেহ ও দেহাশ্রিত আত্মার মধ্যে কোনো বিভেদ নেই৷ অসুররাজের মনেও হল না যে তিনি ভুল বুঝেছেন, কিন্তু দেবরাজ তাঁর সংশয় নিয়ে কিছুদিন পরেই ফিরে এলেন৷ প্রজাপতি তাঁকে পুনরায় শিক্ষা দিলেন; তাঁর তপস্যা চলল শত বৎসর৷ পরিশেষে তিনি আত্মার সন্ধান পেলেন৷ দেখলেন, দেহ ও আত্মা মূলত বিভিন্ন; দেহ আত্মার আধার মাত্র৷ চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয় কর্মের সহায় বা উপায় মাত্র৷ দেহাশ্রিত যে-শক্তি বোধ করেন যে এসব কর্ম আমি করব, তিনিই আত্মা৷ ‘যো বেদেদং স আত্মা’৷
ছান্দোগ্যে ‘দেবকীপুত্র কৃষ্ণের’ উল্লেখ রয়েছে (২৬৮/৩)৷ মন্ত্রটি প্রক্ষিপ্ত বলে কেউ বলেননি, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে মহাভারতের যুগ থেকে উপনিষদের যুগে ঠেলে দেবার চেষ্টা হয়নি৷ হয়তো উপনিষদের যুগে এই নামে কোনো ঋষি ছিলেন; বহুপরবর্তী যুগে আবার সন্তানের নামকরণে তার আবির্ভাব ঘটেছে৷ এ যুগেও কৃষ্ণ, গার্গী, মৈত্রেয়ী ও নচিকেতা প্রভৃতি খুবই জনপ্রিয় নাম৷
পূর্বেই বলা হয়েছে, উপনিষদ-গুচ্ছে ছান্দোগ্যের গুরু সবিশেষ৷ শংকর তাঁর বেদান্তদর্শন প্রতিষ্ঠার জন্য এ-গ্রন্থ থেকে আটশোরও বেশি উদ্ধৃতি প্রয়োগ করেছেন৷ ছান্দোগ্যের ভাষা অপেক্ষাকৃত সহজ, কিন্তু অত্যন্ত ভাবগভীর৷ এর মধ্যে যেসব উপাখ্যান, উপমা স্থান পেয়েছে তা সবই সুবিন্যস্ত ও সুষ্ঠু৷ জ্ঞানমার্গই অবশ্য এর উপজীব্য, কিন্তু তা বলে কর্মমার্গকে গ্রন্থের কোথাও হতাদর বা অশ্রদ্ধেয় করা হয়নি৷ প্রকৃত পক্ষে কর্মমার্গের পরিণতি যে জ্ঞানে, তাঁরই ইঙ্গিত রয়েছে ছান্দোগ্যের বহু স্থলে এবং সমগ্রভাবে বিচার করলে এর অন্তর্নিহিত কর্ম ও জ্ঞানের সামঞ্জস্য স্পষ্টতর হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই৷
বৃহদারণ্যক
পণ্ডিতদের মতে ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক সমসাময়িক৷ আয়তনের দিক থেকে ছান্দোগ্যের পরেই এর স্থান৷ এতে অধ্যায় রয়েছে ছয়টি৷ এই ছয়টি অধ্যায়ে খণ্ডের সংখ্যা চুয়াল্লিশটি৷ সর্বশুদ্ধ এর মন্ত্রসংখ্যা চারশো ঊনচল্লিশ৷
জাতিগতভাবে সবগুলি উপনিষদই অবশ্য “আরণ্যক’ বা অরণ্যজাত, কিন্তু প্রাচীনতম দলের এটিই মাত্র সমগ্র জাতির নাম বহন করছে৷ শুধু আকারের জন্যই এটি ‘বৃহৎ’ বলে খ্যাত৷ ছান্দোগ্য অবশ্য বৃহত্তর৷
বৃহদারণ্যক শুক্ল-যজুর্বেদীয়৷ এতে যেসব বিচার-বিতর্কের অবতারণা করা হয়েছে তার ক্রম-পরিণতি ঘটেছে কতগুলি দৃঢ় সিদ্ধান্তে৷ কোনো কোনো মন্ত্রের প্রকাশ-শৈলী ও শক্তি যে অতুলনীয় তা ক্রমে ক্রমে আমরা দেখতে পাব, আর দেখতে পাব এমন-সব মন্ত্র যার মধ্যে চিন্তার গভীরতা অতলস্পর্শী৷
অশ্বমেধ যজ্ঞ দিয়ে প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে৷ ক্রমে আলোচনা এসে ঠেকেছে সৃষ্টিবাদে৷ একই মূল থেকে জন্ম হল দেব ও অসুরদলের বটে, কিন্তু প্রথম থেকেই তারা একে অন্যের বিরোধী৷ এক দল অন্য দলকে পরাভূত করার জন্য বদ্ধপরিকর৷ ক্রমে আসে প্রাণের কথা৷ মানুষের ইন্দ্রিয়শক্তির তুলনায় প্রাণশক্তির গুরুত্ব যে কত বেশি তা স্পষ্ট করে বলা হয়৷ প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে বহুখ্যাত প্রার্থনা-মন্ত্র :
”অসতো মা সদ্গময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়,
মৃত্যোর্ম্মা]মৃতং গময়৷’’
বিশ্বদেবের কাছে আদিম মানুষের এই প্রার্থনার সারল্য ও শুচিতা আজও মনকে স্পর্শ করবে, সন্দেহ নেই৷ প্রার্থনাটির অর্থ, আমাকে ‘অসৎ’ থেকে ‘সৎ’-এ নিয়ে যাও, ‘অজ্ঞান’ থেকে ‘জ্ঞানে’ নিয়ে যাও, ‘মৃত্যু’ থেকে ‘অমৃতে’ নিয়ে যাও-আমাকে অমৃতত্ব দাও৷ ‘অসৎ’ ও ‘অজ্ঞানের’ অর্থও মৃত্যু৷
চতুর্থ খণ্ডে রয়েছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র-এই চার জাতিবিভাগের কথা৷
প্রকৃত ব্রাহ্মণের স্বরূপ কি? ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তাঁকেই ব্রাহ্মণ বলা যায় যিনি সকলের প্রতিই মৈত্রীভাবাপন্ন, সবারই হিতৈষী-কল্যাণব্রতী, আর সকলকেই আশা-ভরসা দেন৷ উপনিষদের মন্ত্রে সকলকেই ব্রাহ্মণ হতে আবাহন করা হয়েছে, কারণ ব্রাহ্মণত্ব-লাভ ব্রহ্মত্ব-লাভের প্রথম সোপান৷
পঞ্চম খণ্ডে বলা হয়েছে, ব্রহ্মাণ্ডের যেখানে যত অন্ন অর্থাৎ আহার্যদ্রব্য ছড়ানো রয়েছে সকলই সর্বজনীন বা সকলেরই জন্য৷ সেগুলি কারো নিজস্ব সম্পত্তি নয়৷ আরও বলা হয়েছে, পাপের মূলে রয়েছে স্বার্থপরতা৷ এ খণ্ডে ‘সম্প্রত্তি’র কথাও বলা হয়েছে; সম্প্রত্তি অর্থ সম্প্রদান, পুত্রের উপর আপন কর্তব্যের ভার সমর্পণ৷ আসন্ন মৃত্যুকালে মানুষ পুত্রকে সে ভার দেয়৷ পিতার সে অসম্পন্ন কর্তব্যের ভার গ্রহণ করে বলেই তাকে পুত্রবলা হয়৷ ‘পুৎ’ নামক নরকের কথা এখানে নেই৷
ষষ্ঠ খণ্ডে একটি পরম বৈতানিক তথ্যের কথা বলা হয়েছে৷ রূপের কথায় এসেছে বর্ণের কথা৷ শ্বেতবর্ণকে এখানে সর্ববর্ণের সমত্ব বা সাম্যাবস্থা বলে নির্দেশ করা হয়েছে৷
প্রথম অধ্যায়ে তাই শুধু ‘অপরা’ বিদ্যারই কথা৷ উপনিষদের মূলতত্ত্ব ‘পরাবিদ্যা’ বা ব্রহ্মবিদ্যার কথা এতে নেই৷
দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে বালাকি ও অজাতশত্রুর উপাখ্যান দিয়ে৷ বালাকি বাগ্মী ও তপস্বী; অজাতশত্রু কাশীর রাজা৷ বালাকি অজাতশত্রুকে ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা দিতে গিয়ে ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে পারলেন না৷ তাঁর মাথায় সবই তালগোল পাকিয়ে গেল; অজাতশত্রুর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতে পারলেন না, ব্রহ্ম সূর্য, চন্দ্র, বিদ্যুৎ, আকাশ, বায়ু, জল, দর্পণের মধ্যে প্রতিবিম্ব, ছায়া, না অন্য কিছু৷ ক্ষত্রিয় রাজা তখন ব্রাহ্মণ তপস্বীকে ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা দিতে শুরু করলেন; বালাকিও মাথা হেঁট করে বসে সশ্রদ্ধ মনে তা গ্রহণ করলেন৷ দেখা যায়, শিক্ষিত ব্রাহ্মণও সেকালে তাঁর থেকে নীচু শ্রেণির মানুষের কাছে বিদ্যালাভে অসম্মান বোধ করতেন না এবং এ-ব্যাপারকে হেয় বলে কেউ মনেও করত না৷ জাতিত্বের সঙ্গে ধর্মের কোনো সংস্পর্শ ছিল না, জাতিত্ব ছিল কর্মগত৷
এরপর তৃতীয় খণ্ডে ব্রহ্মের মূর্ত অর্থাৎ দৃশ্যমান বা ব্যক্ত ও অমূর্ত অর্থাৎ অদৃশ্য বা অব্যক্ত রূপের কথা বলা হয়েছে৷ বিশ্বসৃষ্টিতে তাঁর ব্যক্ত রূপের প্রকাশ পঞ্চভূতের তিনটিতে, যথা, ক্ষিতি বা মাটি, অপ্ বা জল, তেজ বা আগুনে৷ তাঁর অব্যক্ত রূপের স্বরূপ বাকি দুটিতে, যথা, মরুৎ বা বাতাস ও ব্যোম বা আকাশ অর্থাৎ শূন্যে৷
চতুর্থ খণ্ডে বিখ্যাত যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী সংবাদ৷ মুনিবর যাজ্ঞবল্ক্যের বিদ্যাবত্তা অসাধারণ, মৈত্রেয়ী তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী৷ বানপ্রস্থ গ্রহণ করে যাজ্ঞবল্ক্য সংসারত্যাগ করবেন, তাই তাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে চান৷ তিনি মৈত্রেয়ীকে তাঁর যথাযোগ্য অংশ দান করলেন কিন্তু মৈত্রেয়ী তা গ্রহণ করলেন না৷ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই পার্থিব ঐশ্বর্য দিয়ে কি আমার অমৃতত্ব লাভ ঘটবে? যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, তা কি ঘটে? মৈত্রেয়ী বললেন, তবে এসব দিয়ে আমি কী করব? ”যেনাহং নামৃতা স্যাং, কিমহং তেন কুর্য্যাম্?’’ যে বিত্ত বা বিত্তসাধ্য কর্ম দিয়ে আমি অমৃতত্ব লাভ করতে পারব না, তা দিয়ে আমি আর কী করব?
মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবল্ক্যকে অমৃতত্ব ত্ব-লাভের পথ নির্দেশ করতে অনুরোধ করলেন৷ তারপর চলল যাজ্ঞবল্ক্যের শিক্ষাদান৷ প্রথমেই যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, মানুষের অপরের প্রতি এই যে স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা, এ সবই কিন্তু তার আত্মপ্রীতি মাত্র৷ স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, মাতাপিতার সন্তান-স্নেহ, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর প্রীতি-এসবের কারণ এই নয় যে একজন অন্যজনের প্রতি আসক্ত; এর প্রকৃত কারণ এই যে মানুষ অন্যের মধ্যে নিজের প্রতিমূর্তি দেখে তাতে আকৃষ্ট হয়৷ সংসার-ভরা এই যে স্নেহ, প্রেম, ভক্তি ও প্রীতি তার মূলে রয়েছে আত্মপ্রীতি মাত্র৷
এই খণ্ডেই মৈত্রেয়ীকে উপলক্ষ্য করে যাজ্ঞবল্ক্য জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক সম্বন্ধে যে প্রশ্ন তুলেছেন, দার্শনিকদের মধ্যে তার মীমাংসা এখনও হয়নি৷ জীবাত্মা যখন পরমাত্মার বা ব্রহ্মের সান্নিধ্যে আসে তখন তার কি অবস্থা ঘটে? জীবাত্মার কি আত্মচেতনা ও নিজের বৈশিষ্ট্যের কথা মনে থাকে, না নদী যেমন সমুদ্রের মধ্যে লয় পেয়ে যায়, তার অবস্থা তেমনই হয়?
যাজ্ঞবল্ক্যকে আবার দেখা যায় তৃতীয় খণ্ডে৷ বিদেহ দেশের রাজা জনক বহুদক্ষিণ যজ্ঞ করছেন৷ বহু দেশ থেকে নানা বেদবিদ মুনি ও তপস্বীরা এসে সমবেত হয়েছেন৷ জনকের জানতে ইচ্ছে হল, এতগুলি বেদবিদ তপস্বীর দলে সর্বাপেক্ষা বেদজ্ঞ কোন জন৷ তিনি এক হাজার গোরু দানের জন্য মনোনীত করে তাদের প্রত্যেকের শৃঙ্গে এক-একটি থলে বেঁধে দিলেন, তাতে রইল স্বর্ণমুদ্রা৷ তারপর সমবেত তপস্বীদের সম্বোধন করে বললেন, আপনাদের মধ্যে যিনি সর্বাপেক্ষা বেদজ্ঞ ও ব্রহ্মিষ্ঠ, তিনি এসে এই এক হাজার গোরু দান হিসাবে গ্রহণ করুন৷
কথাটা শোনামাত্রই যাজ্ঞবল্ক্য এসে দাঁড়ালেন সেই হাজার গোরু দাবি করে৷ সঙ্গে সঙ্গেই এসে জুটলেন অশ্বল, আর্ত্তভাগ, চাক্রায়ণ, কহোল, উদ্দালক ও গার্গী প্রভৃতি বহু তপস্বী ও তপস্বিনী প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে৷ ক্রমে ব্রহ্মজ্ঞানের বিচার শুরু হল৷ প্রতিদ্বন্দ্বীরা একে একে প্রশ্ন করতে লাগলেন, যাজ্ঞবল্ক্য দিতে লাগলেন তার উত্তর৷ কেউ কি মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারে? মৃত্যুর পরে মানুষের কি অবশিষ্ট থাকে? বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের শেষ পরিণতি কী? ব্রহ্ম বলতে সত্যি কি বোঝা যায়-তাঁর স্বরূপ কী? মানুষের বিলাপ কি তার আকাঙ্ক্ষারই নামান্তর মাত্র? প্রাণের জন্ম হল কী করে?
ব্রহ্মবাদিনী গার্গীই যে তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই৷ তাঁর প্রশ্নই ছিল সর্বাপেক্ষা কঠিন৷ তবু যাজ্ঞবল্ক্য সে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সর্বাপেক্ষা ব্রহ্মিষ্ঠ বলে স্বীকৃত হলেন৷ সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুরস্কারও নিয়ে গেলেন৷
চতুর্থ অধ্যায়ে যাজ্ঞবল্ক্য আবার দেখা দিলেন জনক রাজার শিক্ষকরূপে৷ তিনি সেখানে তাঁকে ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা দিচ্ছেন৷ সুষ্ঠু উপমা দিয়ে ‘ইহলোক’, ‘পরলোক’ ও ‘সন্ধিলোকে’র কথা বললেন৷ ইহলোকের উপমা মানুষের জাগ্রদবস্থা, পরলোকের উপমা মানুষের স্বপ্নহীন নিদ্রিতাবস্থা, আর সন্ধিলোক স্বপ্নময় নিদ্রিতাবস্থার মতো৷ মানুষ মুমূর্ষু অবস্থায় থাকে সন্ধিলোকে৷ তারপর তিনি স্বপ্নের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলেন আর বোঝালেন জন্ম-মৃত্যুর চক্র৷ পরমানন্দ ও ব্রহ্মলোকের ব্যাখ্যাও করলেন৷
যাজ্ঞবল্ক্যের এ স্বপ্ন-ব্যাখ্যাই ফ্রয়েড প্রমুখ আধুনিক মনোবিদগণের স্বপ্ন-সিদ্ধান্তের মূলতত্ত্ব৷ কথাটার মধ্যে অতিশয়োক্তি কিছুই নেই, কিন্তু এ নিয়ে প্রাচীন ভারতের গৌরব-প্রকাশের উচ্ছ্বাসও অশোভন৷ কারণ, পাশ্চাত্যের সমস্ত বস্তুকেই আমরা অভিনব বলে গ্রহণ করতে শিখেছি৷ আমাদের দেশের পণ্ডিতেরা সুষ্ঠুভাবে এসব মূলতত্ত্বের কথা জগতের সামনে মেলে ধরার চেষ্টাও করেননি৷
বৃহদারণ্যক বলেছে,
”যত্র সুপ্তো ন কঞ্চন কামং কাময়তে, ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি’’ (২৭১/৪)
সোজা কথায়, যে কোনোরূপ ভোগ্যবিষয় কামনা করে না, সে কোনোরূপ স্বপ্নদর্শনও করে না৷
তারপর,
”আরামমস্য পশ্যন্তি ন তং পশ্যতি কশ্চনেতি৷
যানি হ্যেব জাগ্রৎ পশ্যতি, তানি সুপ্ত ইতি৷’’ (২৬৫/৪)
মানুষ বাসনা-সম্পাদিত ক্রীড়াই স্বপ্নে দেখে; আত্মাকে কেউ দেখে না (যদিও স্বপ্নকালে অর্থাৎ নিদ্রিতাবস্থায় সে আত্মার সন্নিধানেই যায়)৷ জাগ্রদবস্থায় মানুষ যা দেখে, স্বপ্নেও সে তা-ই দেখে, তার অতিরিক্ত কিছু দেখে না৷ অর্থাৎ, কখনও যা অনুভূত হয়নি তা স্বপ্নে দেখা যায় না৷
মানুষ-প্রজাতির আদিম চিন্তাধারাকে যে অনেক ক্ষেত্রে আজও মানুষ অতিক্রম করে যেতে পারেনি, শুধু এ তত্ত্বটি প্রমাণ করার জন্যই এ আলোচনাটি একটু বিস্তৃত করেছি৷ এমন প্রমাণ বহু রয়েছে৷
এই অধ্যায়েই আবার যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ীর কথোপকথনের পুনরুক্তি দেখা যায়৷ উপনিষদে এরূপ অনেক পুনরুক্তি রয়েছে৷
পঞ্চম অধ্যায়ে মানুষ, দেবতা ও অসুর সম্পর্কে একটি সুন্দর আখ্যায়িকা রয়েছে৷ একই পিতামাতা থেকে এ তিনটি বিভিন্ন জাতির সৃষ্টি হয়েছে৷ তিনটি দলই তাদের পিতা ও গুরু প্রজাপতির আশ্রমে তপস্যা করেছিল৷ তারা যার যার তপস্যা শেষ করে বিভিন্নভাবে ভাগে-ভাগে এসে গুরুর আশীর্বাদ ও উপদেশ ভিক্ষা করল৷ গুরু তিনটি দলকেই একটিমাত্র বাক্যে উপদেশ দিলেন; সে বাক্যটি ‘দ’৷ উপদেশ দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর উপদেশ তারা বুঝতে পেরেছে কিনা৷ উত্তরে সবাই বলল, হ্যাঁ, পেরেছি৷ এ বাক্যটি থেকে কি বুঝল তারা?
দেবতারা আর সর্বপ্রকারেই নির্দোষ শুধু তাদের কামের বা কামনার মাত্রা একটু বেশি৷ তাই তারা ‘দ’-এর অর্থ করল, ‘দাম্যত’ অর্থাৎ কামকে দমন কর৷ মানুষের মধ্যে লোভের মাত্রা বেশি৷ তারা ‘দ’-এর অর্থ বুঝল ‘দত্ত’ অর্থাৎ দান করে লোভ কমাও৷ আর, অসুরের প্রধান দোষ ক্রোধ৷ তারা ‘দ’-এর অর্থ করল, ‘দয়ধ্বম’ বা ক্রোধকে চেপে রাখ৷ বহুদিনের তপস্যার ফলে তারা যার যার চরিগত দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিল৷ আত্মবিচারে অভ্যস্ত মানুষের এ-শক্তি স্বাভাবিক৷ গূঢ় মন্ত্রের ব্যাখ্যাও হয় চিরদিনই আত্মমুখ বা subjective৷
পঞ্চম অধ্যায়ের অন্যান্য খণ্ডগুলি খুবই সংক্ষিপ্ত৷ এগুলিতে সাধারণত একটি বা দুটি মন্ত্র রয়েছে৷ এর মধ্যে নানা বিষয়বস্তুর সমাবেশ৷ তার মধ্যে রয়েছে হৃদয়, সত্য, মনোময় আত্মা, বাক্, প্রাণ, বিদ্যুৎ, বিশ্বের পরম সত্তা, গায়ত্রী বা ব্রাহ্মণের প্রার্থনামন্ত্র৷ গায়ত্রী ও সাবিত্রী সমার্থক৷ গায়ত্রী মানুষকে ভব-বন্ধন-মুক্ত করে৷
ষষ্ঠ অধ্যায়ের শুরুতেই প্রাণকে প্রাণীর সর্বেন্দ্রিয়ের জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে৷ প্রাণ যদি দেহ পরিত্যাগ করে তবে অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের কাজ সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়৷
দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে মুনিবর গৌতমের পুত্র শ্বেতকেতু ও পাঞ্চালরাজ প্রবহণের কাহিনি৷ শ্বেতকেতু বয়সে নবীন কিন্তু আত্মম্ভরিতা তাঁর আকাশস্পর্শী৷ পাঞ্চালরাজ প্রবহণ তাঁকে পরলোক সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু বিদ্যাগর্বী শ্বেতকেতু তার একটিরও জবাব দিতে পারলেন না৷ তাই তিনি ফিরে এলেন পিতা গৌতমের কাছে৷ গৌতম নিজেও প্রবহণের প্রশ্নের সুষ্ঠু জবাব দিতে অসমর্থ হলেন; তাই তিনি শিক্ষার জন্য গেলেন প্রবহণের কাছে৷ প্রবহণ গৌতমকে নিরস্ত করতে নানা চেষ্টা করলেন; এ-সকলের পরিবর্তে নানা ঐশ্বর্যদানও করতে চাইলেন৷ কিন্তু গৌতম কিছুতেই রাজি হলেন না৷ পরিশেষে প্রবহণ তাঁকে ‘পঞ্চাগ্নিবিদ্যা’ বা পরলোকতত্ত্ব শিক্ষা দিলেন৷ এ-কাহিনির সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে কঠোপনিষদের যম-নচিকেতা উপাখ্যানের৷ কঠোপনিষদ বৃহদারণ্যকের অনেক পরবর্তীকালের৷
এ-অধ্যায়ের শেষে, অর্থাৎ উপনিষদটিরই শেষাংশে উৎকৃষ্ট পুত্রলাভের উপায় বা সুপ্রজনন-বিদ্যা সম্বন্ধে অনেক কথা রয়েছে৷ এ কথা স্পষ্ট করে বারবার বলা হয়েছে যে মা ভালো হলেই তার পুত্রকন্যারা ভালো হয়৷
এ-উপনিষদ থেকে শংকরের উদ্ধৃতির সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচশো৷ ছান্দোগ্যের মতো বৃহদারণ্যকেও কর্ম ও জ্ঞান উভয় পন্থারই একত্র সমাবেশ রয়েছে, কিন্তু কর্মের পরিসমাপ্তি যে জ্ঞানে তার ইঙ্গিত যেন আরও স্পষ্ট, আরও সাবলীল হয়ে উঠেছে, আর এ দুয়ের সামঞ্জস্য স্ফুটতর হয়েছে৷
তৈত্তিরীয়
তৈত্তিরীয় উপনিষদ কৃষ্ণ-যজুর্বেদীয়৷ আয়তনে ছোটো হলেও এটি বহু গভীর দার্শনিকতত্ত্বের আকর৷ এর অধ্যায় তিনটি, খণ্ডসংখ্যা ত্রিশ৷ এই ত্রিশ খণ্ডে মোট মন্ত্রসংখ্যা মাত্র পঞ্চান্নটি, আকারে কেউ ছোটো, কেউ বড়ো৷
প্রথম অধ্যায়ের নাম শিক্ষাবল্লী৷ শিক্ষাবল্লীতে শব্দোচ্চারণ বা মন্ত্রোচ্চারণের কথার সঙ্গে উপাসনা, প্রার্থনা ও নানা বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে৷ দেহের মধ্যে হিরন্ময় মনোময় পুরুষের অবস্থানের স্থান নির্দেশ করে বলা হয়েছে, তালুদ্বয়ের মধ্যে যে স্তনের ন্যায় মাংসখণ্ড বর্তমান, অর্থাৎ আলজিব, যেখানে কেশমূল মাথার খুলি ভেদ করে উঠেছে তা-ই পরমাত্মার অভিব্যক্তিস্থান৷
কিন্তু উপনিষদের সঙ্গে শিক্ষা বা মন্ত্রোচ্চারণের কী সম্পর্ক?
ছয়টি বেদাঙ্গের মধ্যে শিক্ষা একটি৷ আর পাঁচটি যথাক্রমে ‘কল্প’ বা সংস্কার-বিধি-পদ্ধতি সংগ্রহ, ‘ব্যাকরণ’ বা শব্দের ব্যুৎপত্তি ও প্রয়োগের শাস্ত্র, ‘নিরুক্ত’ বা বৈদেশিক শব্দকোষ, ‘ছন্দ’ বা পদ্যের রচনা-প্রণালী এবং ‘জ্যোতিষ’ বা জ্যোতিঃশাস্ত্র৷ শিক্ষা বা মন্ত্রোচ্চারণকে বেদাঙ্গের দলে স্থান করে দিয়ে বেদপাঠে উচ্চারণের প্রভূত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ কারণ, মন্ত্র সঠিক উচ্চারিত না হলে, তার অন্তর্নিহিত শক্তি ও মূর্তি মানুষের মানসলোকে না-হয় স্থায়ী, না-হয় স্পষ্ট৷ মন্ত্রশক্তি যে অসাধারণ তা বোঝানোই এর উদ্দেশ্য৷
এসব ছাড়াও এ-অধ্যায়ে আরও একটি চিত্তাকর্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ রয়েছে৷ সেটিকে বিশ্বজগতের প্রথম সমাবর্তনের, অর্থাৎ ছাত্রগণকে উপাধি বিতরণের সভার ভাষণ বলা চলে৷ সভ্যজগতের আদি সমাবর্তন-ভাষণ হলেও, এটি এত সজীব, সাবলীল ও সর্বজনীন যে ভারতবর্ষের তো কথাই নেই, এমনকি পৃথিবীর সর্বত্রই, সমার্তন-ভাষণ হিসাবে এটি ব্যবহার করা চলে৷ পাঠক-সাধারণের বিচার-বিবেচনার জন্য আমরা তার কিছুটা উদ্ধৃত করছি৷
”সত্যং বদ৷ ধর্ম্মং চর৷ মাতৃদেবো ভব৷
পিতৃদেবো ভব৷ আচার্য্যদেবো ভব৷
যান্যনবদ্যানি কর্ম্মাণি তানি সেবিতব্যামি৷
নো ইতরাণি৷’’
”সত্য বলবে৷ ধর্মাচরণ করবে৷ মাতাকে দেবতারূপে পূজা করবে৷ পিতাকে দেবতারূপে পূজা করবে৷ আচার্যকে দেবতারূপে পূজা করবে৷ যে-সকল কর্ম অনিন্দিত বা অনবদ্য, শুধু তাই আচরণ করবে; যে-সকল কর্ম তা নয়, তা শিষ্ট বা পূজ্যজনের দ্বারা অনুষ্ঠিত হলেও, করবে না৷’’
দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ব্রহ্মানন্দবল্লী৷ এতে বলা হয়েছে যে আত্মজ্ঞান লাভ না হলে আমাদের দৃষ্টিবিভ্রম দূর হয় না৷ আমাদের দৃষ্টি বা চিন্তাজগৎকে স্বতই বিভ্রান্ত করে ইন্দ্রিয়শক্তি, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক৷
আত্মার অবস্থান পর পর পাঁচটি কোষের মধ্যে৷ এ পাঁচটিকে অতিক্রম না করে তার দর্শন পাওয়া যাওয়া যায় না অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ ঘটে না৷ পাঁচটি কী কী?
প্রথমটি অন্নময় কোষ, অর্থাৎ স্থূল বস্তু দ্বারা তৈরি কোষ;
দ্বিতীয়টি প্রাণময়, অর্থাৎ নির্জীব স্থূল দেহে প্রাণের সঞ্চার;
তৃতীয়টি মনোময়, অর্থাৎ প্রাণে সূক্ষ্মতাবোধের আবির্ভাব;
চতুর্থটি বিজ্ঞানময়, অর্থাৎ মনে বুদ্ধির সংযোগ এবং
পঞ্চমটি আনন্দময়, অর্থাৎ মনের তৃপ্তিময়, সুখময় অবস্থা৷
এ-অধ্যায়ে এমন কিছু কিছু মন্ত্র রয়েছে যার উদ্ধৃতি প্রায়শই চোখে পড়ে৷ যথা, ”রসো বৈ সঃ৷’’ এর অর্থ, আত্মা একটি এমন রস যা মনে তৃপ্তি ও আনন্দ দান করে৷ ”কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণাৎ৷ যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ’’ অর্থাৎ আমাদের হৃদয়াকাশে নিহিত আত্মা যদি আনন্দস্বরূপ না হত, তবে কে আর এ জীবন ধারণ করতে চাইত? এ আনন্দস্পর্শেই মানুষ বাঁচার জন্য উদ্গ্রীব, যদিও সে ক্ষণে ক্ষণে তার দুঃখের কাঁদুনি গায়৷
এ ছাড়াও এই অধ্যায়ে মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার একটি সম্পূর্ণ চিত্ররয়েছে৷ মানুষ এ পৃথিবীতে কি চায়? চায় আনন্দ, চায় পরিপূর্ণ সুখ৷ সে পরিপূর্ণ সুখ কী হলে ঘটে?
”যুবা স্যাৎ সাধুযুবাধ্যায়ক৷
আশিষ্ঠো দৃঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠঃ৷
তস্যেয়ং পৃথিবী সর্ব্বা বিত্তস্য পূর্ণা স্যাৎ৷
স একো মানুষ আনন্দঃ৷’’
পূর্ণ সুখ পেতে হলে চাই যৌবন; কিন্তু শুধু যুবা হলেই চলবে না, হতে হবে সুচরিত্র৷ হতে হবে বিদ্বান, শুধু বিদ্বান হলেই চলবে না, সে বিদ্যাবত্তা দেখাবার সুযোগ পেতে হবে৷ স্বাস্থ্য অটুট, আর পৃথিবীর যাবতীয় ধনরাশি থাকবে তার আয়ত্তে৷
মানুষের এই পরিপূর্ণ সুখচিত্রের কল্পনা করা হয়েছে অন্য কোনো কারণে নয়, ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে তার তুলনা করার জন্য৷ কিন্তু ব্রহ্মানন্দকে এ সামান্য কল্পনা দিয়ে মাপাই চলে না৷ ব্রহ্মানন্দ সাধারণ মানুষের পক্ষে অনির্বচনীয়, কল্পনাতীত৷
তৃতীয় অধ্যায়ের নাম ভৃগুবল্লী৷ এ অধ্যায়ে মুনিবর বরুণ ও তাঁর পুত্র ভৃগুর আখ্যায়িকা অবলম্বনে ব্রহ্মবিদ্যার সুষ্ঠু ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷
ভৃগু ব্রহ্মবিদ্যা-লাভে উৎসুক৷ পিতা বললেন, তুমি তপস্যা কর৷ অল্প কিছু কাল তপস্যা করেই পুত্র পিতাকে বলল যে, সে ব্রহ্মবিদ্যা বা আত্মজ্ঞান লাভ করেছে৷ পরম তপস্বী বরুণ বললেন, তুমি যে জ্ঞানলাভ করেছ তা ব্যাখ্যা কর৷ পুত্র যা বলে তাতে বরুণের ধারণা হয় যে সে কিছুই বোঝেনি৷ তাই তাকে আবার তপস্যায় মগ্ন হতে বলেন৷
তারপর বারবার ফিরে আসেন ভৃগু-বারবারই তাঁকে ফিরিয়ে দেন বরুণ৷ পরিশেষে অধ্যবসায়ী ভৃগু সাফল্যলাভ করলেন৷ এবার এসে বললেন,
”আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ’’ অর্থাৎ ”আনন্দই ব্রহ্ম’’৷
একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন৷ ব্রহ্মবিদ্যা উপনিষদের মূল উপপাদ্য বটে, তবে সেজন্য স্থূল মরজগৎকে, দেহের খাদ্য অন্নকে কোথাও অবহেলা করা হয়নি৷ বরং অন্নসংস্থানের গুরুত্বকে বারবার স্বীকার করে তার বহুল উৎপাদনকে ব্রত বলে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে৷ ভৃগুবল্লী থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি :
”অন্নং ন নিন্দ্যাৎ৷ অন্নং বহু কুর্ব্বীত৷ তদব্রতম্৷’’
”খাদ্যকে কখনও অবহেলা করো না৷ খাদ্যের উৎপাদন বাড়াও৷ একে ব্রত বলে গ্রহণ কর৷’’
এ অধ্যায়ে ব্রহ্মের স্বরূপ স্পষ্ট করে বোঝানো হয়েছে৷ প্রথমে ব্রহ্মের অমূর্তরূপের কথা-ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ৷ তারপর যে মূর্ত কাজের মধ্যে তাঁর অস্তিত্ব প্রতিফলিত হয়েছে তার কথা বলা হয়েছে৷ সেগুলি কী? সৃষ্টি, স্থিতি ও বিলয়৷
এই ছোটো উপনিষদখানা থেকেও শংকর একশো চল্লিশটিরও বেশি অংশ উদ্ধৃত করেছেন৷
ঐতরেয়
ঐতরেয় উপনিষদ ঋগ্বেদীয়৷ এতে তিনটি অধ্যায়ে মন্ত্র রয়েছে মাত্র তেত্রিশটি৷ প্রথম অধ্যায়ে খণ্ড তিনটি, বাকি দুটি অখণ্ড৷
বিশ্বজগতের জন্মবৃত্তান্ত দিয়ে উপনিষদটির শুরু৷ সৃষ্টির পূর্বে কী বর্তমান ছিল? ঐতরেয়ের মতে,
”আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীৎ৷
নান্যৎ কিঞ্চন মিষৎ৷’’
”বিশ্বসৃষ্টির পূর্বে একমাত্র বস্তু যা বর্তমান ছিল তা আত্মা৷’’
আত্মা শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কি? যে তিনটি ধাতু থেকে এ শব্দটি নিষ্পন্ন হতে পারে তার একটি ‘আপ’-যার অর্থ পাওয়া বা ব্যাপ্ত হওয়া, অন্য দুটি ‘অদ্’ ও ‘অৎ’ যার অর্থ যথাক্রমে খাওয়া ও ক্রমাগত চলা৷ উপনিষদে ব্যবহৃত আত্মা শব্দটি ব্রহ্মের সমার্থ৷ কাজেই ব্রহ্মের কল্পনা যত স্পষ্ট হবে আত্মার ধারণাও হবে ততই পরিস্ফুট৷ পরবর্তী পরিচ্ছেদে উপনিষদের ব্রহ্মকল্পনা-সম্পর্কে আলোচনা করা যাবে৷
প্রথম অধ্যায়ে বিশ্বজগতে ক্ষুধা ও পিপাসার জন্মকথা বলা হয়েছে৷ এর কিছু পূর্বেই সৃষ্ট হয়েছে মানুষ, সঙ্গে সঙ্গে তার দেহে সংযোজিত হয়েছে তার ইন্দ্রিয় এবং প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের বিভিন্ন অধিষ্ঠিত দেবতা৷ সর্বশেষ স্বয়ং বিধাতাও মানুষের দেহে প্রবেশ করলেন মূর্ধদেশ অর্থাৎ মস্তকের ঊর্ধ্বদেশ দিয়ে৷ কোথায় তাঁর বাসস্থান ঠিক হল? জাগরণকালে ডান চোখে, স্বপ্নকালে মনে, আর স্বপ্নহীন নিদ্রাকালে হৃদয়াকাশে৷
দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে যে মানুষের জন্ম হয় তিনবার৷ প্রথমবার সে ভূমিষ্ঠ হয় পৃথিবীতে৷ তার পুত্রকন্যার মধ্যে জন্মে সে দ্বিতীয়বার; তারপর এ বিশ্বজগৎ থেকে বিদায় নিয়ে পরলোকে জন্মে সে তৃতীয়বার৷
এ-জগতে মানুষের ঋণও তিন প্রকার৷ প্রথম, দেবঋণ অর্থাৎ দেবতার প্রতি কর্তব্য৷ এ-দেনা শোধ হয় সৎকার্যে৷ দ্বিতীয়, ঋষিগণ অর্থাৎ বিশ্বজগতের অন্যান্য মানুষের প্রতি কর্তব্য৷ এ-দেনা শোধ করা যায় বিত্ত ও ঐশ্বর্য দানে৷ তৃতীয় পিতৃঋণ অথবা নিজের পূর্বপুরুষের প্রতি কর্তব্য৷ এ-দেনা শোধ হয় সুপ্রজননের দ্বারা অর্থাৎ কৃতী সন্তানের পিতা হয়ে৷
তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে ব্রহ্মবিদ্যার কথা৷ এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, কে সেই ব্রহ্ম যিনি আমাদের চোখ দিয়ে দেখেন এবং আমাদের কান দিয়ে শোনেন?
এ-প্রশ্নের মীমাংসাও করা হয়েছে৷ এ-বিশ্বজগতে যা-কিছু বর্তমান তার সবারই মূলে রয়েছে প্রজ্ঞান বা চৈতন্য, উপলব্ধি৷
”সর্বং তৎ প্রজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিতং…প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম৷’’
দেখা যায়, এ-উপনিষদে উদ্ভিজ্জ অর্থাৎ বৃক্ষলতা ছাড়া, প্রাণীজগৎকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে; যথা, জরায়ুজ, অণ্ডজ ও স্বেদজ৷ স্বেদজদের দলে পড়ে ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ৷
স্বেদজ প্রাণীর কল্পনা সভ্য মানুষের অতি পুরাতন উদ্ভাবনা৷ হয়তো ভারতবর্ষ থেকে এ-ধারণা পৃথিবীর সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়েছিল৷ এই সেদিন মাত্র, ঊনবিংশ শতকে, লুই পাস্তুর এ ধারণা উলটে দেন৷
এই ছোটো উপনিষদখানা থেকে শংকর বিশ-বাইশটি উদ্ধৃত করেছেন৷
এবার আমরা প্রাচীনতম উপনিষদের দেশ ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নবীন জগতের সামনাসামনি এসে পড়েছি৷ পূর্বেই বলা হয়েছে, এই প্রবীণ ও নবীন জগতের সন্ধিস্থলে রয়েছে ‘কেন উপনিষদ’ যার কিছুটা লেখা পদ্যে, কিছুটা গদ্যে৷
এবার আমরা এ-সন্ধিলোকের কথা বলব৷
কেন
ছান্দোগ্যের মতো কেন উপনিষদ সামবেদীয়; এতে অধ্যায় চারটি এবং এর মন্ত্রসংখ্যা চৌত্রিশ৷
কতগুলি ‘কেন’ অর্থাৎ ‘কার দ্বারা’?-এই প্রশ্ন দিয়ে উপনিষদটির শুরু৷ এর প্রথম মন্ত্রটি :
”কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ
কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতি যুক্তঃ৷
কেনেষিতাং বাচমিমাং বদন্তি
চক্ষুঃ শ্রোত্রং ক উ দেবো যুনক্তি৷৷’’
মন কার দ্বারা প্রেরিত হয়ে কার্য করে? প্রাণের গমনাগমনের কর্তাই-বা কে? মানুষ কার ইচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে শব্দ উচ্চারণ করে? কোন দেবতার বা শক্তির নির্দেশে চোখ ও কান নিজ নিজ কাজ করে? অর্থাৎ, এ-সব ইন্দ্রিয় মানুষের দেহাঙ্গ বটে, তবে এদের অধিকর্তা যে মানুষ নয়-তা বোঝা যায়৷ তবে সে অধিকর্তা কে?
ক্রমে চিন্তাজগৎ আরও প্রসারিত হয়৷ দৃষ্টি পড়ে এই সৃষ্টির নিয়মবদ্ধ পরিচালনার দিকে৷ কার ইঙ্গিতে, কার পরিচালনায় এত বিধিবদ্ধ কাজ সম্ভবপর হয়? আমাদের চক্ষু তো তাঁকে দেখে না, আমাদের কথা তো তাঁর কানে যায় না৷ তিনি তো অনন্য৷ আমরা চারদিকে যা দেখি বা শুনি, তার সঙ্গে তো তাঁর সম্পর্কে খুঁজে পাওয়া যায় না৷ তিনিই ব্রহ্ম-আমাদের সর্বকর্মের শক্তিদাতা৷ কিন্তু আমাদের চোখ তাঁকে দেখে না কেন? আমাদের মন তাঁর খোঁজ পায় না কেন?
আগুন সকল জিনিস দহন করে বটে, কিন্তু নিজেকে কি দহন করতে পারে? তা পারে না৷ আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিও তেমনি তাদের অন্তঃস্থিত শক্তিকে না-পায় দেখতে, না-পায় শুনতে, না-পায় অনুভব করতে৷
দ্বিতীয় অধ্যায় জুড়েও ব্রহ্মবিদ্যারই কথা৷ যাঁরা ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝতে পেরেছেন বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন বা মনের কোণে সামান্য অহংকারেরও স্থান দেন, তাঁরা স্পষ্টত কিছুই বোঝেননি৷ যাঁরা সত্যি ব্রহ্মের বিন্দুমাত্র আস্বাদও পেয়েছেন, তাঁরা বলেন যে আমাদের এ সীমাবদ্ধ মনে সে অসীম শক্তির ধারণা অসম্ভব৷ সে শক্তি সমস্ত গুণ, রূপ, আকার, সংস্কার ও সীমার বাইরে৷
তবে কি কেন উপনিষদের এ চিন্তাধারা আধুনিক অজ্ঞেয়বাদের মূলসূত্র? আধুনিক অজ্ঞেয়বাদে একটি হতাশার সুর রয়েছে৷ ঈশ্বর আছেন কি নেই তা জানবার কোনো উপায় নেই, সে উপায় কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ অজ্ঞেয়বাদ আধুনিক জড়বাদী মেধাগর্বী মানুষের ক্রন্দন মাত্র; কিন্তু উপনিষদের কথায় সে হতাশার সুর নেই৷ এ আধুনিক সমস্যার মীমাংসা ওই উপনিষদেরই পাতায় পাওয়া যাবে৷
তৃতীয় অধ্যায়ে উপনিষদের মতে দেবতা ও পরম দেবতা বা ব্রহ্মের যে ধারণা তার কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷
দেবতাদের ও অসুরদের দ্বন্দ্ব চিরকালের৷ প্রাধান্যলাভের জন্য তারা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী৷ এজন্য তারা ক্রমাগত যুদ্ধ করত৷ এমনি একটি যুদ্ধে জয়লাভ করে, দেবতারা একটি বিজয়-স্মৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন৷ গর্বান্ধ হয়ে তাঁরা ভুলে গেলেন যে পরম দেবতা বা ব্রহ্মের শক্তিই তাঁদের শক্তি; তিনিই তাঁদের শক্তিদাতা৷
দেবতাদের এ অসার গর্ব দূর করতে চাইলেন ব্রহ্ম৷ যেখানে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছিল তারই অনতিদূরে তিনি দেখা দিলেন একটি জ্যোতিষ্কের মতো চোখ-ঝলসানো আলো নিয়ে৷
তাঁর আলোর জেল্লা দেখে দেবতারা স্তম্ভিত হলেন৷ তাঁরা অগ্নিদেবকে জানতে পাঠালেন জ্যোতিষ্কটি কী৷ অগ্নিদেব কাছে আসতেই জ্যোতিষ্ক জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে?
গর্ব-সহকারে অগ্নি বললেন, তিনি অগ্নিদেব, জগতের সমস্ত কিছুই তিনি পুড়িয়ে ছাই করতে পারেন৷ জ্যোতিষ্কটি অগ্নিদেবের সামনে একগাছি শুষ্ক তৃণ রেখে বললেন, এটি পুড়িয়ে ছাই কর তো! আশ্চর্য ব্যাপার হল৷ অগ্নিদেব প্রথমে হেলায়, পরে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে সে শুষ্ক তৃণটিকে দহন করতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই তা পেরে উঠলেন না৷ ফলে, মাথা নীচু করে তিনি ফিরে গেলেন৷
তারপর দেবতারা পাঠালেন বায়ুদেবকে৷ জ্যোতিষ্কটি বায়ুদেবকে সেই শুষ্ক তৃণটিকেই উড়িয়ে নিয়ে যেতে বললেন৷ তিনিও তা পারলেন না; তাই লজ্জায় ফিরে এলেন৷
এবার এলেন দেবরাজ ইন্দ্র৷ ইন্দ্র কাছে আসতেই জ্যোতিষ্কটি যেমন নিমেষে উদিত হয়েছিলেন তেমনি নিমেষেই অন্তর্হিত হলেন৷ সহসা জ্যোতিষ্কটির পরিবর্তে দেখা দিলেন একজন দেবী৷ এ দেবীর নাম হৈমবতী, তিনি হিমালয়ের কন্যা; তাঁর অপর নাম উমা৷
চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে উমা ও ইন্দ্রের চিত্তাকর্ষক কথোপকথন৷ উমা ইন্দ্রকে বুঝিয়ে বললেন, দেবতাদের যা-কিছু শক্তি সবই ব্রহ্মেরই শক্তি৷ প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মের সহায়তা ছাড়া বিশ্বজগতে কোনো জয়লাভের সম্ভাবনা নেই৷
কে সে জ্যোতিষ্কটি? ইন্দ্র বুঝলেন, তিনিই ব্রহ্ম৷ যদি সত্যি তিনি কারো চক্ষুগোচর হন তবে কিরূপে তিনি দেখা দেন? কেন উপনিষদের মতে,
”যদেতদ্বিদ্যুতো ব্যদ্যুতদা ইতীন্ন্যমীমিষদা’’-ব্রহ্মের আবির্ভাব ও প্রতীতি বিদ্যুতের স্ফুরণ ও চোখের নিমেষের মতো৷
এই সন্ধিলোকের উপনিষদটিতে আলোচনার সূত্রও ধারাটি মনোরম৷ বহু-পরিচিত পথ ধরে চলেছে রচনার ধারা এবং সর্বশেষ তর্কবিতর্কের মীমাংসা হয়েছে একটি কথায়৷ সে কথাটি এই যে, বিশ্বজগতে সমস্ত শক্তি ও কার্যের মূলে রয়েছেন ব্রহ্ম; তিনিই একমাত্র সত্যবস্তু৷ শংকর অবশ্য এ উপনিষদ থেকে মাত্র চার-পাঁচটি উদ্ধৃত করেছেন, কিন্তু পূর্বেই বলা হয়েছে, এই উদ্ধৃতির সংখ্যা গুনে এর মূল্য নিরূপণ করা যায় না৷
পরবর্তীকালের যে ছয়টি উপনিষদ, তার মধ্যে কঠ, ঈশ, মুণ্ডক ও শ্বেতাশ্বতর পদ্যে লেখা, বাকি দুটি অর্থাৎ প্রশ্ন ও মাণ্ডূক্য লেখা গদ্যে৷ প্রথমে আমরা এই পদ্যাত্মক উপনিষদ কয়টির পরিচয় দিতে চেষ্টা করব৷
কঠ
কঠোপনিষদ কৃষ্ণ-যজুর্বেদীয়৷ এতে দুটি অধ্যায়, কিন্তু এক অধ্যায়ের সঙ্গে অন্য অধ্যায়ের সম্পর্কটা মোটেই স্পষ্ট নয়৷ এতে সর্বশুদ্ধ মন্ত্রসংখ্যা একশো সাতাশ; এর মধ্যে একাত্তরটি রয়েছে প্রথম অধ্যায়ে৷ এর প্রতিটি অধ্যায় তিনটি খণ্ডে বিভক্ত৷
উপনিষদটির শুরু হয়েছে একটি যজ্ঞের দৃশ্য দিয়ে৷ যজ্ঞ করছেন ঋষি বাজশ্রবস৷ যজ্ঞে দানের জন্য যে গোরুগুলি আনা হয়েছে সেগুলি শুধু অস্থিচর্মসারই নয়, বৃদ্ধ ও অকেজো৷ সত্যকথা বলতে কি, তাদের মুমূর্ষু বললেও অত্যুক্তিও হয় না৷ বাজশ্রবসের পুত্র নচিকেতা পিতার এমন নিরর্থক ও অশোভন দানের জন্য পরম ক্ষুব্ধ৷ তিনি পিতাকে বারবার বলছেন, এ দান অগ্রাহ্য, কারণ যজ্ঞের রীতি অনুসারে যাজ্ঞিকের সবচেয়ে প্রিয়বস্তু দানই এ যজ্ঞের রীতি৷ নচিকেতা বাজশ্রবসের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু৷ তিনি কাকে এ বস্তু দান করতে চান? নচিকেতা বারবার তিনবার এই একই প্রশ্ন করলেন৷
ফলে পিতা হলেন রুষ্ট; মনে উত্তেজনার সীমা রইল না৷ বারবার একই বিরক্তিকর প্রশ্ন শুনে উত্তেজনার মুখে তিনি বলে বসলেন, আর কাকে দেব! দেব মৃত্যুর রাজা যমকে৷
নচিকেতা এর সোজা সরল অর্থ ধরে নিলেন৷ কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যে ভিন্ন, এ-কথা তাঁকে আর বোঝানো গেল না৷ ফলে, তিনি চললেন মৃত্যুরাজ যমের বাড়ি৷
নচিকেতা যখন যমের বাড়ি গিয়ে পৌঁছোলেন, তখন তিনি বাড়ি ছিলেন না৷ এলেন তিন দিন তিন রাত্রি পরে৷ এ সময়টা নচিকেতা তাঁর দ্বারে অন্ন, জল ও আশ্রয়হীন অবস্থায় কাটালেন৷ যম এসে দেখলেন যে একজন ব্রাহ্মণতনয় অতিথি হয়ে এসে তাঁর দ্বারে তিন দিন ও তিন রাত্রি কোনো আতিথ্যই পায়নি৷ গৃহস্থের পক্ষে এটা অমার্জনীয় অপরাধ৷ অতিথিকে তাই প্রসন্ন করতে হবে; তিনি সন্তুষ্ট না-হলে গৃহস্থের হবে অনিবার্য অকল্যাণ৷ কাজেই নচিকেতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি তাঁকে তিনটি বর প্রার্থনা করতে বললেন৷
নচিকেতা বর প্রার্থনা করলেন৷ প্রথম বরটি যা চাইলেন তা এই-তাঁর পিতা যেন তাঁর অভাবে বিষম ক্ষুব্ধ শোকার্ত না হন; তিনি যেন মনে শান্তি পান৷ তারপর নচিকেতা ফিরে গেলে যেন তিনি আবার তাঁকে আশীর্বাদ করে গ্রহণ করেন৷
মৃত্যুরাজ যম সাহ্লাদে এ বর দান করলেন৷
দ্বিতীয় বরে নচিকেতা চাইলেন পঞ্চাগ্নিবিদ্যা৷ এ-বিদ্যা জানলে, এ অগ্নিকে বরণ করে, অর্থাৎ এ-যজ্ঞের ফলে মানুষ স্বর্গে যেতে পারে৷
এখানে স্বর্গ সম্পর্কে তখন যে ধারণা ছিল তা বলা প্রয়োজন৷ স্বর্গে ভয় নেই, সেখানে দুঃখের লেশও নেই; তাই সকলেই আনন্দে কাল কাটাতে পারে৷
যম এ বরও দান করলেন৷
কিন্তু তৃতীয় বরটি নিয়েই সৃষ্টি হল সমস্যার৷ তৃতীয় বরটি প্রথম দুটির সমগোত্রীয় তো নয়ই, প্রকারেও নিতান্তই বিভিন্ন৷ এটি মানুষের চিরন্তন প্রশ্ন-চিরদিনের সমস্যা৷ এর জন্ম হয়েছে মানুষের চিন্তাশক্তির উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু আজও সে সমস্যা মেটেনি৷ নচিকেতা সেই চিরন্তন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন যমকে-
”যেয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে
অস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে৷
এতদ্ বিদ্যামনুশিষ্টয়াহং
বরাণামেষ বরস্তৃতীয়ঃ৷৷’’
কেউ কেউ বলেন, মৃত্যুর পরে মানুষের আত্মা পরলোকে গমন করে; কারও কারও মতে, আত্মারই কোনো অস্তিত্ব নেই৷ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ দেহত্যাগের পরেই, মানুষের পরিসমাপ্তি ঘটে৷ এর কোনটি সত্য? হে মৃত্যুরাজ! তুমি আমাকে স্পষ্ট করে বল, মৃত্যুর পরে কী ঘটে?
যম কিন্তু বেশ মুশকিলে পড়লেন৷ প্রথমত, তিনি জানেন না নচিকেতা পরলোকতত্ত্ব জানার উপযুক্ত পাত্রকিনা; দ্বিতীয়ত, এ তত্ত্ব এত দুরূহ যে দেবতারাও এর মর্মোদ্ঘাটন করতে অসমর্থ হন৷ তাই এ তত্ত্বজ্ঞানের পরিবর্তে নচিকেতাকে তিনি বিশ্বের যে-কোনো আকাঙ্ক্ষিত সম্পদ দিতে চাইলেন-শতবর্ষ পরমায়ু, বহু বিত্ত-ঐশ্বর্য, রাজ্য, রথ, সুন্দরী রমণী বা অপ্সরা ইত্যাদি৷ কিন্তু নচিকেতা নাছোড়বান্দা; তিনি তাঁর সংকল্পে অটল রইলেন৷ বললেন, এ-সব নিয়ে কি হবে? সবই ‘শ্বোভাবা’-আজ আছে কাল নেই৷ এ-সব কোনো জিনিসেই তাঁর লোভ নেই৷ তারপর মৃত্যুর অধিপতি যমের মতো আর পরলোকতত্ত্ব কে বলতে পারবে? তাই, স্বয়ং যমেরই সাক্ষাৎ ও আশীর্বাদ যখন লাভ করা গেছে, তখন শিক্ষার এ সুযোগ আর ছাড়া যাবে না৷ যম কি করুণা-পরবশ হয়ে তাঁকে সে শিক্ষা দেবেন না?
শেষটা যমকে হার মানতেই হল৷
প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় খণ্ডে যম নচিকেতাকে পরলোকতত্ত্ব উপলব্ধি করার যোগ্য পাত্রকরে গড়ে তুলবার চেষ্টা করছেন৷ প্রথমেই শিক্ষা দিলেন শ্রেয় ও প্রেয় সম্বন্ধে৷ শ্রেয় কি? শ্রেয় সেই বস্তু, যা দিয়ে মানুষের পরম কল্যাণ ঘটে৷ প্রেয় কী? এ বিশ্বজগতে মানুষ যা-কিছু কামনা করে তাই প্রেয়৷
শ্রেয় চরম শান্তি; সর্ববন্ধন ও কামনা থেকে মুক্তি৷ প্রেয় মানুষের যতসব কাম্যবস্তু, যা তাকে সুখ দেবে বলে মানুষ আশা করে৷ শ্রেয় ও প্রেয় কিন্তু বিভিন্নরূপে মানুষের কাছে দেখা দেয় না-তারা একত্রেই ঘোরাফেরা করে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ শ্রেয়কে বরণ না করে প্রেয়কেই বরণ করে৷ কেন?
কারণ, মানুষের মধ্যে যাদের মেধা অপরিপক্ব অথবা যারা অর্থ ও শক্তিগৌরবে মত্ত, তার ‘সাম্পরায়’ বা পরলোকের কথা একেবারেই ভুলে থাকে৷ যারা সে কথা কখনো-কখনো চিন্তা করে, তারাও ভাবে, এ জগতে সৎকর্ম-সাধনের ফলে তারা পরলোকে সুখে থাকে৷ কিন্তু সব সৎকার্যের ফলই ক্ষণস্থায়ী; তাতে ‘অমৃতত্ব’ লাভ ঘটে না৷ কারণ কোনো অনিত্য বস্তু দিয়ে কখনো নিত্যবস্তু লাভ করা অসম্ভব৷ ‘অমৃতত্ব’ নিত্যবস্তু৷
সঙ্গে সঙ্গে আসে ব্রহ্মের কথা ও প্রণব মন্ত্র ওঁ৷ ওঁ-এর অর্থ ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ, আমিই ব্রহ্ম৷ এ খণ্ডে ব্রহ্ম ও আত্মাকে সমার্থ ধরে তাদের স্বরূপ বোঝাতে যে বিশেষণাত্মক বর্ণনার প্রয়োগ করা হয়েছে তা যেমন সাবলীল, তেমনি প্রাণবন্ত৷ এর দু-একটি উদাহরণ দেওয়া যাক৷
”নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো
ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন৷’’
আত্মার বা ব্রহ্মের স্বরূপ ধর্মগ্রন্থপাঠে বা তার আবৃত্তি শুনে উপলব্ধি হয় না-অথবা মেধা বা বুদ্ধি দ্বারাও তা বোঝা যায় না৷ তবে? সে প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছে উপনিষদ৷
”অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্৷’’
ব্রহ্ম বা আত্মা অণু-পরমাণু থেকেও ক্ষুদ্র, আবার সর্বাপেক্ষা বৃহৎ বস্তু-যা মানুষের কল্পনাতীত তার চেয়েও বড়ো; অর্থাৎ মানুষের সীমাবদ্ধ মনে তাঁর ধারণা অসম্ভব৷
তৃতীয় খণ্ডেও ব্রহ্মের স্বরূপেরই কথা৷ তা বোঝানো হয়েছে কতকগুলি সাধারণ অথচ যথাযথ উপমা-প্রয়োগে৷ এটা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে মানুষের ইন্দ্রিয়ের চেয়ে যে-শক্তি তাদের চালনা করে তা বেশি শক্তিমান; মনের শক্তি তার চেয়েও বেশি৷ তার চেয়েও বেশি শক্তিমান তার বুদ্ধি বা বিশ্লেষণাত্মক জ্ঞান বা মেধা৷ কিন্তু ব্রহ্ম এ-সবেরও বাইরে-বুদ্ধির বহু ঊর্ধ্বে৷ ব্রহ্মকে এরূপ নানাভাবে বর্ণনা করে কঠোপনিষদ তূর্যকণ্ঠে মানুষকে আহ্বান করে বলেছে :
”উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত৷’’
”আত্মদর্শনে উদ্যোগী হও, জাগো, বরান্ বা শ্রেষ্ঠ আচার্যের কাছে গিয়ে সম্যক জ্ঞানলাভ কর৷’’
তৃতীয় খণ্ডে প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে৷ তারপর শুরু হয়েছে দ্বিতীয় অধ্যায়ের৷ কিন্তু প্রথম অধ্যায়ের সঙ্গে তার যোগসূত্র অস্পষ্ট৷
এর প্রথম খণ্ডে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তার মূল কোনোপরিষদে৷ আত্মা বা ব্রহ্ম তো মানুষের ইন্দ্রিয়গুলি সৃষ্টি করেছেন, তবে তারা তাদের স্রষ্টাকে দেখতে পায় না কেন? তার জবাবও দিয়েছে উপনিষদ৷ স্রষ্টাকে দেখতে হলে প্রবল ও অসাধারণ উদ্যমের প্রয়োজন৷ সে উদ্যম থাকে কজনের? যে মুষ্টিমেয় শ্রেষ্ঠজনের তা থাকে, তাঁরা বহির্মুখী ইন্দ্রিয়গুলিকে অন্তর্মুখী করে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেন৷ কিন্তু এ চেষ্টা প্রবল স্রোতোবহা নদীকে সংহত করার মতোই দুঃসাধ্য৷
দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে দেহস্থ আত্মার অবস্থানের কথা৷ আর, প্রাণের সঙ্গে আত্মার প্রভেদ কী৷ সাধারণজন প্রাণ ও আত্মাকে সমার্থ মনে করে৷ কিন্তু তাদের মৌলিক প্রভেদ এই যে আত্মা অন্য কোনো বস্তু, ভাব ও কারণ-নিরপেক্ষ, নিত্য ও স্বয়ংপূর্ণ; কিন্তু প্রাণের অস্তিত্ব নির্ভর করে বহু কর্ম ও কারণের উপর৷ এখানে জন্মান্তরবাদের কথাও বলা হয়েছে৷ মৃত্যুর পরে মানুষ পুনর্জন্ম গ্রহণ করে এবং তার পরবর্তী জীবন হয় ‘যথাকর্ম যথাশ্রুতম্’ অর্থাৎ পূর্ববর্তী জীবনের কৃতকর্ম ও সাধন অনুসারে৷
এ-খণ্ডে একটি নূতন ও অর্থপূর্ণ শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়৷ শব্দটি ‘সর্বভূতান্তরাত্মা’ অর্থাৎ বিশ্বজগতের আত্মা বা ব্রহ্ম৷ দ্যোতনায় শব্দটি অনবদ্য৷ নানাভাবে এর ব্যঞ্জনা প্রকাশ করা হয়েছে; বিশ্বসৃষ্টিকে ঘিরে রয়েছেন সেই বিশ্ব-আত্মা, যদিও তাঁর বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন৷ যা-কিছু এখানে বর্তমান, সবই সেই আত্মারই রূপ; সমস্ত বিশ্বই তাঁর রূপের প্রভায় সমুজ্জ্বল৷
তৃতীয় খণ্ডে বিশ্বসংসারকে একটি গাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে৷ স্পষ্ট করে এটাও বলা হয়েছে যে, পঞ্চভূতের সমষ্টিতে রচিত হয়েছে এই বিশ্ব, অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম, তা দিয়েই রচিত হয়েছে মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক৷ ব্যোম থেকে মানুষ পেয়েছে কান; ব্যোমে অজস্র শব্দের আনাগোনা, কান সে আওয়াজ শুনতে পায়৷ মরুৎ বা বায়ু থেকে এসেছে ত্বক বা চামড়া, যা দিয়ে মানুষ স্পর্শ অনুভব করে৷ তেজ বা আগুন থেকে চোখের জন্ম; আগুন আলো বিতরণ করে, মানুষ আলো না থাকলে দেখতে পারে না৷ অপ্ বা জল থেকে এসেছে জিহ্বা; জল দেয় স্বাদ৷ সর্বশেষ ক্ষিতি বা মাটি থেকে জন্মেছে মানুষের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের শক্তি৷
যোগ কাকে বলে তা পাওয়া যাবে এই তৃতীয় খণ্ডে এবং যোগী কি করে হওয়া যায়-তা-ও৷ যোগী তার মৃত্যুর পূর্বেই, অর্থাৎ এই জন্মেই, আত্মদর্শন করতে পারে৷ আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে মানুষের কি ঘটে? সে অমৃতত্ব লাভ করে; অর্থাৎ তার সমস্ত আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি ঘটে৷
উপনিষদগুচ্ছের মধ্যে কঠোপনিষদই সর্বাপেক্ষা বেশি পরিচিত ও জনপ্রিয়৷ বস্তুত এটি পরম জনপ্রিয় হবারই যোগ্য৷ এর প্রকাশ-রীতি অনবদ্য এবং ভাবপ্রবাহও চিত্তাকর্ষক৷
কঠোপনিষদে জ্ঞানপন্থার কথা ছাড়াও মানুষের নীতিধর্মের কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ ভগবদ্গীতায় এর বহু মন্ত্র হয়েছে এবং তার দর্শনতত্ত্বও কঠোপনিষদের দ্বারা প্রভাবান্বিত৷ হিন্দুর শ্রাদ্ধবাসরে কঠোপনিষদ পাঠ প্রশস্ত বলে কথিত৷
শংকর এ উপনিষদটি থেকে শতাধিক উদ্ধৃতি সংগ্রহ করেছেন৷
ঈশ
ঈশোপনিষদ শুক্ল-যজুর্বেদীয়৷ মুনিবর যাজ্ঞবল্ক্য এ উপনিষদটি পাঠ ও প্রচার করেন৷ যাজ্ঞবল্ক্যের অপর নাম বাজসন অর্থাৎ যার প্রচুর খাদ্যসংস্থান রয়েছে৷ কাজেই, এ উপনিষদটিকে ‘বাজসনেয়ী’ উপনিষদও বলা হয়৷
ঈশোপনিষদে রয়েছে মাত্র আঠারোটি মন্ত্র৷ এর প্রত্যেকটিই এক-একটি রত্নতুল্য৷ প্রথম মন্ত্রটি শুরু হয়েছে ‘ঈশ’ শব্দটি দিয়ে, যার অর্থ বিশ্বের চালক বা বিশ্বাধ্যক্ষ৷ এ শব্দটি থেকে উপনিষদটির নামকরণ হয়েছে৷
প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে, আমরা বিশ্বের চারদিকে যা দেখি তার কোনো যথার্থ সত্তা নেই-এগুলি যা বলে মনে হয়, তা সত্য নয়৷ প্রতিটি জিনিসই অন্তরে ও বাহিরে ব্রহ্মের দ্বারা আবৃত৷ প্রকৃতপক্ষে সবই ব্রহ্মেরই রূপ মাত্র৷ উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক নানা স্বর্ণালংকারের কথা৷ তাদের বহিরঙ্গ পরম বিভিন্ন বটে, কিন্তু মূলত সবই স্বর্ণ ছাড়া আর কিছুই নয়৷
এ-মন্ত্রটির একটি অংশ ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’ পরবর্তী কালে বহুস্থলে উদ্ধৃত হয়েছে৷ এটি অর্থবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ৷ এর তাৎপর্য এই যে এই দৃশ্যমান বিশ্বজগৎকে অসার ও অনিত্য জেনে, একমাত্র নিত্যবস্তু আত্মার সংরক্ষণে যত্নবান হবে৷ অন্যভাবে বললে এর অর্থ হবে, বিশ্বকে পরিত্যাগ করেই, অর্থাৎ সন্ন্যাস নিয়েই, তার প্রকৃত আস্বাদ গ্রহণ করতে পারা যায়৷ কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে এর অর্থ-ত্যাগের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে সাংসারিক ভোগও পরিপূর্ণরূপে আস্বাদ করতে পারা যায় না৷ ত্যাগের সংস্পর্শেই ভোগের আনন্দ-যেমন উপবাসে ক্ষুধার্ত না হলে ভোজের আনন্দ সম্পূর্ণ হয় না৷
এ-মন্ত্রটিতে জ্ঞানপন্থার উপর জোর দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু এর পরবর্তী মন্ত্রেই বলা হয়েছে কর্মের কথা; কর্মের পন্থা তাঁদের জন্যই যাঁরা জ্ঞানপন্থায় অগ্রসর হতে পারেন না৷
এখানে সন্ন্যাসী বলতে কী বোঝা যায়? তিনি জ্ঞানপন্থী, জীবনের প্রতিও তাঁর আসক্তি নেই, মরণেও তিনি নিরাসক্ত৷ কর্মপন্থীর সঙ্গে তাঁর প্রভেদ যথেষ্ট৷ এ দুটি পথের সামঞ্জস্য পাওয়া যাবে পরবর্তী মন্ত্রে৷
তৃতীয় মন্ত্রটিতে ‘আত্মহনো’ বলে একটি শব্দ রয়েছে৷ কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে এর মধ্যে নিহিত রয়েছে সেকালের বৈদিক সমাজের একটি চিত্র৷ চিত্রটি বিষাদের-সমাজের সর্বস্তরের একটা অবসন্নতার কাহিনি৷ এর ফলে সেকালে বহু লোক ‘আত্মাহা’ বা ‘আত্মঘাতী’ হত৷ এ মন্ত্রে তাই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে যারা আত্মহত্যা করে তারা মৃত্যুর পরে তমসাবৃত ‘অসূর্য্যা’ লোকে, যাকে পরে নরক নাম দেওয়া হয়েছে, গমন করে৷ অপর মতে, ‘আত্মহনো’ শব্দের অর্থ অজ্ঞান বা আত্মতত্ত্ববোধ-রহিত৷
চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্রে ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা৷ তাঁর শান্ত, সমাহিত, দুঃখ-সুখ-নিরপেক্ষ নিত্যভাবের কথা৷
ষষ্ঠ ও সপ্তম মন্ত্রে এমন মানুষের কথা রয়েছে, যিনি সর্বভূতে নিজের প্রতিমূর্তি দর্শন করেন৷ নিজেকে কে না ভালোবাসে? তাই, কাউকে তিনি হিংসা দ্বেষ করেন না, ঘৃণা বা অবিশ্বাসও করতে পারেন না৷ কাজেই তাঁর মোহও নেই, শোকও নেই-‘তত্র কো মোহঃ কঃ শোকঃ৷’
অষ্টম মন্ত্রে ব্রহ্মের ধ্যানমূর্তি৷ ভাবে উজ্জ্বল, চিন্তায় সাধারণ মানুষের মানসলোকের বহু ঊর্ধ্বে৷ যে-চিত্রটি এতে প্রতিফলিত হয়েছে তার উপলব্ধি হয় শুধু গভীর ধ্যানজগতে৷
নবম, দশম ও একাদশ মন্ত্রে বিদ্যা ও অবিদ্যার প্রভেদ বোঝানো হয়েছে৷ বিদ্যা, ব্রহ্মজ্ঞান বা ব্রহ্মবিদ্যা; অবিদ্যা, অন্য সকল জ্ঞান-সাংসারিক ও জাগতিক৷ তারপর রয়েছে তাদের অপূর্ব সামঞ্জস্য৷ অবিদ্যাকে বিদ্যার সোপানে পরিণত করা হয়েছে :
”অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়া]মৃতমশ্নুতে৷’’
অর্থাৎ, অবিদ্যা দ্বারা ‘মৃত্যুং’, অর্থাৎ কাম্যকর্মাদি যা মোক্ষলাভের প্রতিকূল, অতিক্রম করে বিদ্যার দ্বারা অমৃতত্ব লাভ করা যায়৷
দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ মন্ত্রে “সম্ভূতি’ ও ‘অসম্ভূতি’র কথা৷ ‘সম্ভূতি’ ও ‘অসম্ভূতি’ কী? যা-কিছুই জন্মগ্রহণ করেছে বা তৈরি হয়েছে, সবই ‘সম্ভূতি’; আর, ‘অসম্ভূতি’? যার জন্ম হয়নি, যে তৈরি হয়নি, যা সনাতন, শাশ্বত৷ বিদ্যা ও অবিদ্যার মতো এদেরও সামঞ্জস্য করা হয়েছে৷
দেখা যায়, উপনিষদের রাজ্য অধিবিদ্যার রাজ্য বটে, তবে কখনও বাস্তব বা বহির্জগৎ-বর্জিত নয়৷ উপনিষদের ঋষিগণ বাস্তবকে বর্জন করেননি; তার সামঞ্জস্য সাধন করেছেন৷ বাকি চারটি মন্ত্র মুমূর্ষুর শেষ প্রার্থনা৷ এগুলি, শুচি-শুভ্র প্রার্থনা মন্ত্র; প্রায়শই এর উদ্ধৃতি দেখা যায়৷ ”যৎ তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি৷’-তোমার যে মঙ্গলময় রূপ তা-ই আমি দেখি৷
ঈশোপনিষদে যে অঙ্কুর দেখা দিয়েছে তারই পরিণতি হয়েছে গীতায়-বহু পরবর্তী কালে৷
শংকর এ-উপনিষদটি থেকে আটটি উদ্ধৃতি সংগ্রহ করেছেন৷ এ-উপনিষদটির অনেক মন্ত্রই বেদ থেকে সংগৃহীত-হুবহু পুনরুক্তি মাত্র৷
শ্বেতাশ্বতর
তৈত্তিরীয় ও কঠোপনিষদের মতো শ্বেতাশ্বতর কৃষ্ণ-যজুর্বেদীয়৷ এটি ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত; মোট মন্ত্রসংখ্যা একশো তেরো৷ প্রতিটি অধ্যায়েই নূতন নূতন কথার অবতারণা করা হয়েছে; তাই একটি অধ্যায়ের সঙ্গে অন্যটির কোনো সম্পর্ক নেই৷ এটিকে একটি সুসম্বদ্ধ পুথি বলা চলে না৷
এই পরবর্তী কালের উপনিষদের দলেও এটি বয়সে নবীন; হয়তো সর্বাপেক্ষা নবীন৷ এর ভাষা আধুনিক সংস্কৃত-ঘেঁষা৷ এর চিন্তাধারাও, পূর্ববর্তী উপনিষদগুলির তুলনায় এত সাবলীল, প্রাণবন্ত ও সজীব নয়৷
কিছু কিছু মন্ত্র যে স্বতঃস্ফূর্ত নয় তা স্পষ্টই বোঝা যায়৷ লেখার উপর মকশো করা হয়েছে, সৌকর্যার্থে পরিবর্তনও ঘটেছে, কিন্তু তাতে মন্ত্রের প্রাণশক্তিই কমে গেছে৷ কিন্তু এ-সব বিকার সত্ত্বেও, এই ভস্মের মাঝে মাঝে স্ফুলিঙ্গও দেখতে পাওয়া যায়৷ সে স্ফুলিঙ্গের শক্তিস্পর্শে প্রাণ উচ্ছল ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে৷ কোনো কোনো মন্ত্রে মন্ত্রস্রষ্টার আত্মানুভূতির ছাপ স্পষ্ট যে তা সাধারণ পাঠকের কাছেও ধরা পড়ে৷
কতগুলি প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়েছে প্রথম অধ্যায়ের৷ ব্রহ্ম এ-বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন; তিনি ব্রহ্মাণ্ডের কারণ৷ কিন্তু কীরূপ কারণ তিনি? [এটা দার্শনিকদের কারণ-তত্ত্বের কথা] কোথা থেকে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি? জন্মের পরেই-বা আমরা কী করে জীবিত আছি? মৃত্যুর পরেই বা কোথায় যাব? জগতে সুখ সবাই চায় অথচ কেউ-ই দুঃখের পথ এড়াতে পারে না৷ এই সুখদুঃখের পথে কোন শক্তি আমাদের চালনা করে?
উপনিষদটির পাতায় এ-সব প্রশ্নের সুষ্ঠু জবাব পাওয়া যাবে৷
মানুষের দুঃখ তিন প্রকারের৷ প্রথম, আধ্যাত্মিক বা দৈহিক দুঃখ, যেমন, জ্বর বা চক্ষুরোগ৷ দ্বিতীয়, আধিভৌতিক দুঃখ, অর্থাৎ মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী যার কারণ; যেমন, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বা কোনো জন্তুর আক্রমণে আঘাত পাওয়া৷ তৃতীয়, আধিদৈবিক দুঃখ, অর্থাৎ ভূমিকম্প, ঝড়, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণে যে দুঃখ আসে৷
সকলেই এই তিন প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে চায়৷
দ্বিতীয় অধ্যায়ে যোগ ও যোগীর কথা৷ সঙ্গে সঙ্গে আনে ধ্যান ও প্রাণায়াম, যাকে বলা যায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ৷ এ দুয়ের সহযোগে ব্রহ্মলাভ ঘটে৷ এ-অধ্যায়ে যোগীর প্রাথমিক চিহ্ন বর্ণনা করা হয়েছে৷ যোগীর দেহ হয় লঘু, কোনো রোগ তার থাকে না৷ মন থেকে লোভ ধুয়ে-মুছে যায়, দেহের ঔজ্জল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ কথা হতে থাকে মিষ্টতর, দেহে আসে সুগন্ধ আর তার মলমূত্র কমে যায়৷
এর পরে তার শেষ অবস্থা, অর্থাৎ আত্মবোধের ঠিক পূর্বাবস্থার কথাও বলা হয়েছে৷ তার মানসিক জগতে কী কী পরিবর্তন ঘটে? তার চারদিকে বা দূরে আকাশে তিনি কী দেখেন?
তৃতীয় অধ্যায়ে আমাদের দেহস্থ পরমাত্মার কথা৷ যদিও অন্যান্য উপনিষদে বিশ্বদেবতা যে একক ও অনন্য, এ কথা বহুবার বলা হয়েছে, তবুও আবার এ-অধ্যায়ে সে কথা আরও স্পষ্ট, আরও তর্কাতীত ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে :
”একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থুঃ৷’’
অর্থাৎ বিশ্বাত্মা, পরমাত্মা, পরমদেবতা বা রুদ্র একজনই, তাঁর কোনো দ্বিতীয় নেই৷ তিনি অদ্বিতীয়৷
এ-অধ্যায়ে আরও একটি মন্ত্র রয়েছে যার সজীবতা ও স্বতঃস্ফূর্তি অতুলনীয়৷ ব্রহ্মবিদ ঋষি ছাড়া কারও মুখ থেকে এমন সহজ, সরল এবং ভাবাবেগপূর্ণ কথা বের হতে পারে না৷
”বেদহমেতং পুরুষং মহান্তম!
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ৷
তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি
নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে]য়নায়৷৷’’
আমি দেখেছি সেই পরমপুরুষকে, যিনি এই তমসাবৃত দেশের ওপারে সূর্যের মতো জাজ্বল্যমান৷ একমাত্র তাঁকে জেনেই মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে অব্যাহতি পেতে পারে; এ-ছাড়া অমৃতত্ব লাভের আর দ্বিতীয় পন্থা নেই৷
মন্ত্রটি অবশ্য ঋগ্বেদ থেকে সংগৃহীত হয়েছে৷
চতুর্থ অধ্যায়ে আত্মা বা ব্রহ্মের দ্বিবিধ রূপের কথা৷ পরমাত্মা বা বিশ্বাত্মা এবং জীবাত্মা অর্থাৎ যিনি আমাদের দেহে বাস করেন, তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক কী? এ-সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে ঋগ্বেদের প্রসিদ্ধ একটি মন্ত্র এখানে পুনরুক্ত হয়েছে :
”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া
সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে৷
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্য-
নশ্নন্নন্যো]ভিচাকশীতি৷’’
পরমাত্মা ও জীবাত্মা দুটি মানিকজোড় পাখি; দুটিই সুপক্ষ, একে অন্যের প্রতি অনুরক্ত৷ একটি থেকে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না৷ একই বৃক্ষে অর্থাৎ সংসার-বৃক্ষে তারা উভয়েই বসে আছে৷ একটি এ-বৃক্ষের ফলের আস্বাদ গ্রহণ করছে, অন্যটি তা করছে না, শুধু চেয়ে দেখছে৷
আলোচনা এসে পৌঁছেছে ব্রহ্মের ক্ষর ও অক্ষর স্বরূপের কথায়৷ ক্ষর স্বরূপ পরিবর্তনশীল, ধ্বংসশীল; অক্ষর স্বরূপ নিত্য, অপরিবর্তনীয়৷ ব্রহ্মকে এখানে মায়াবী বলা হয়েছে, কারণ সমগ্র বিশ্ব তিনি মায়া বা ভ্রান্তি দিয়ে ভরে রেখেছেন৷
এ-অধ্যায়ের শেষাশেষি যে প্রার্থনাটি রয়েছে তার উদ্ধৃতি প্রায়শই চোখে পড়ে:
”রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্৷’’
-হে রুদ্র, তোমার যে দক্ষিণ মুখ (যার ধ্যানে জন্মে আনন্দ ও উৎসাহ) তা দিয়ে আমাদের সর্বদা রক্ষা কর৷
পঞ্চম অধ্যায়ে ব্রহ্মভাবের কথা৷
মৃত্যুর পরে জীবাত্মা কেন সরাসরি পরমাত্মার সান্নিধ্যে চলে যায় না? জীবাত্মার পুনর্জন্ম কেন ঘটে এবং সে পুনর্জন্মের রীতি ও প্রকৃতি কী? এ-সবই কি পরমাত্মার অমোঘ বিধান, না, এতে জীবাত্মার কোনো হাত আছে?
ষষ্ঠ অধ্যায়ে ব্রহ্মের আবাহন ও তাঁর নিকট প্রার্থনা৷ সবই প্রায় গতানুগতিক, কঠোপনিষদের অনুসরণে রচিত৷ কিন্তু ভাবের গভীরত্বেবা ভাষায় কঠোপনিষদের সঙ্গে এর তুলনা হয় না৷ তবুও মাঝে মাঝে ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির দর্শন মেলে৷
”ন তত্র সূর্য্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং
নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতো]য়মগ্নিঃ৷
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্ব্বং
তস্য ভাসা সর্ব্বমিদং বিভাতি৷৷’’
”সূর্যের আলোকে ব্রহ্ম প্রকাশিত হন না, চন্দ্র বা তারকাও তাঁকে প্রকাশ করতে পারে না৷ বিদ্যুৎও তা পারে না, অগ্নির কথা বলে আর লাভ কী? তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে বলেই অন্য সব জিনিসেরও অস্তিত্ব রয়েছে; তিনিই সকল দীপ্তি ও মহিমার কারণ৷’’
শ্বেতাশ্বতরের সঙ্গে কিন্তু অন্যান্য উপনিষদের একটু প্রভেদ রয়েছে৷ অন্যান্য উপনিষদের অবলম্বন কর্ম ও জ্ঞানপন্থা৷ এটিতে এ-দুটি পথের কথা তো রয়েছেই, তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ভক্তিবাদের কথা৷ এটাও শ্বেতাশ্বতরের নবীনতার অন্যতম প্রমাণ৷
এ-পুথি থেকে শংকরের উদ্ধৃতির সংখ্যা পঞ্চাশেরও ঊর্ধ্বে৷ কিন্তু যদিও শ্বেতাশ্বতরের শংকর-ভাষ্য রয়েছে, তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় যেন এতে মেলে না, যেমন মেলে অন্য সকল উপনিষদের ভাষ্যে৷ সাধারণত শংকরভাষ্যে পুরাণের কথা থাকে না; বহু পরবর্তী কালের লেখা পুরাণের উপর তাঁর ভরসা কম, কিন্তু শ্বেতাশ্বতরের ক্ষেত্রে দেখা যায় এর নিদারুণ ব্যতিক্রম৷ এ ব্যতিক্রমের স্পষ্ট কারণও প্রায় মেলে না৷
শংকর-ব্যাখ্যাতা সুপ্রসিদ্ধ আনন্দগিরিরও অন্যান্য শংকর-ভাষ্যের ব্যাখ্যা বর্তমান, কিন্তু তাঁর শ্বেতাশ্বতর শংকর-ভাষ্যের ব্যাখ্যার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি৷ পণ্ডিতদের অনেকের মনেই তাই গভীর সন্দেহ জেগেছে যে শ্বেতাশ্বতরের ‘শংকর-ভাষ্য’ বলে যা বর্তমান, তা কি সত্যই শংকরের রচনা?
এ-সন্দেহের যথেষ্ট কারণও রয়েছে৷
মুণ্ডক
মুণ্ডকোপনিষদ অথর্ববেদীয়৷ তিনটি অধ্যায়ে এতে মোট মন্ত্রসংখ্যা পঁয়ষট্টি৷ প্রতিটি অধ্যায় দুটি খণ্ডে বিভক্ত৷ মন্ত্রগুলি বাহুল্যবর্জিত, তাই প্রত্যেকটি মন্ত্রই এক-একটি সুঠাম ও মার্জিত রত্নতুল্য৷
মুণ্ডক প্রশ্নােত্তর-ছলে রচিত৷ শৌনক মুনি এ-সবের প্রশ্নকর্তা আর তার জবাব দিয়েছেন ঋষিবর অঙ্গিরা৷
”এমন কী মহাবিদ্যা রয়েছে যা অধিগত হলে সর্বজ্ঞান লাভ হয়?’’
অঙ্গিরা জবাবে বললেন, ‘পরা; ও ‘অপরা’ বিদ্যার কথা৷ পরা ব্রহ্মবিদ্যা, অপরা অন্যসব জ্ঞান৷ পরাবিদ্যা অধিগত হলে অন্যবিধ জ্ঞান আপনিই জন্মে৷
প্রথম অধ্যায়ের প্রথম খণ্ডে পরাবিদ্যার কথা৷ এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে ব্রহ্ম কল্পনাতীতরূপে সূক্ষ্ম৷ তিনি নির্গুণ৷
এ-ক্ষেত্রে বক্তব্য যে গুণের সঙ্গে সঙ্গে আসে স্থূলতা৷ যেমন, আকাশের একটিমাত্র গুণ, সে শব্দময়৷ কাজেই, আমাদের কল্পনাজগতে আকাশই সর্বাপেক্ষা সূক্ষ্ম৷ সূক্ষ্মতার দিক থেকে পরবর্তী জিনিস বায়ু৷ এর গুণ দুটি; শব্দ ও স্পর্শ৷ এর পরবর্তী আগুন৷ এর গুণ তিনটি; শব্দ, স্পর্শ ও রূপ৷ চতুর্থ জল৷ এর গুণ চারটি; শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস৷ সর্বশেষ মাটি৷ এর গুণ পাঁচটি; শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ৷ এদের মধ্যে স্থূলতায় এর জুড়ি নেই৷
বেদ ও বেদাঙ্গও কিন্তু অপরা বিদ্যা৷ এ-সব মানুষকে অমৃতত্ব নিয়ে যেতে পারে না৷ পারে কিছুকালের জন্য আনন্দলোকে স্থান করে দিতে৷ অমৃতত্ব না পেলে সে স্থান-চ্যুতি অবশ্যম্ভাবী; হয় আজ, নয় কাল৷
দ্বিতীয় খণ্ডে অপরা বিদ্যার কথা৷ অপরা বিদ্যা নিয়েই যারা মত্ত তাদের কপালে কী ঘটে? অজ্ঞান তিমিরেই তাদের বাস, যদিও তারা নিজেদের দৃঢ়তায়, বুদ্ধিতে ও বিদ্যায় অসাধারণ মনে করে৷ কিন্তু দুঃখ, শোক, জরা, মরণ থেকে তাদের রেহাই নেই; তাদের অবস্থা ‘অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধা’র মতো অর্থাৎ এক অন্ধকে যেন অন্য অন্ধ পথ দেখিয়ে নেয়৷ এ-মন্ত্রটি অবশ্য কঠোপনিষদেও রয়েছে৷
কাজেই বারবার এটা উচ্চারিত হয়েছে যে মানুষের তৈরি কোনো জিনিস থেকেই অমৃতত্বের সন্ধান পাওয়া যাবে না৷ অপরা বিদ্যা ছেড়ে পরাবিদ্যার শরণ না-নিলে ‘নান্যঃ পন্থাঃ’৷ এ-বিদ্যা শিক্ষার জন্য প্রয়োজন ব্রহ্মবিদ আচার্যের৷
দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম কাণ্ডে বিশ্বসৃষ্টির কাহিনি৷ সঙ্গে সঙ্গে এসেছে ব্রহ্মের কথা৷ মাটি বা জলের মতো দৃশ্যমান; আবার প্রাণ, মন, বায়ুর মতো অদৃশ্য বস্তু দুই-ই তাঁর সৃষ্টি৷ তিনিই বিশ্বাত্মা; সমগ্র বিশ্বকে তিনি একীভূত করে রেখেছেন; তিনি সর্বভূতান্তরাত্মা৷ সর্বভূতান্তরাত্মা শব্দটি কঠোপনিষদেও ব্যবহৃত হয়েছে৷
দ্বিতীয় কাণ্ডে বলা হয়েছে, ব্রহ্ম রয়েছেন বিশ্বকেন্দ্রে; সবারই তিনি লক্ষ্য৷ সে লক্ষ্যভেদের জন্য সকলেই উৎসুক৷ কিন্তু কী করে তা করা যায়? তা করা যায় একমাত্র ধ্যানের তির দিয়ে; সে তির ছুঁড়তে হবে উপনিষদের জ্যা থেকে৷ ‘ওঁ’ বা ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ হচ্ছে ধনুক, জীবাত্মা বা মানুষের দেহে যে আত্মা বাস করে তা-ই তির, এবং পরমাত্মা বা ব্রহ্ম সে তিরের লক্ষ্য৷
আত্মার বাসস্থান কোথায়? অন্ন দিয়ে গড়া এই শরীরটাতেই তাঁর বাস, হৃদয়ের খুব সন্নিকটে৷ যদিও জড়ের মধ্যেই তাঁর বাস, তবুও তিনি নিজে ‘মনোময়’-জড় নন৷ তিনি আমাদের জীবনদেবতা৷
কেউ কি তাঁকে দেখতে পায়? পায় বই কি৷ যাঁদের ধ্যানশক্তি অসীম তাঁরা সে অমৃতের সন্ধান পান; তাঁদের কাছে তিনি আনন্দরূপে ধরা দেন৷
যখন সে আনন্দের আস্বাদ কেউ পায় তখন তাঁর কী হয়?
ব্রহ্মের সান্নিধ্যে অপরাবিদ্যাজাত সমস্ত বাসনা, সংস্কার ও ধারণার পরিসমাপ্তি ঘটে; এই আত্মকৃত কর্মচক্রের মায়াজাল নিমেষে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়৷ কর্মচক্রের মায়াজাল বলতে কী বোঝা যায় তা যথাস্থানে বলা যাবে৷
শ্বেতাশ্বতরে সূর্য, চন্দ্র, তারকা ইত্যাদি ব্রহ্মকে প্রকাশ করতে পারে না বলে যে মন্ত্রটি রয়েছে তা আবার মুণ্ডকের দ্বিতীয় অধ্যায়েও দেখা যায়৷ শ্বেতাশ্বতর এটি মুণ্ডক থেকেই সংগ্রহ করেছে বলে মনে হয়৷
ঋগ্বেদের বিখ্যাত মন্ত্র ‘দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া’ দিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ের শুরু৷ কঠ ও শ্বেতাশ্বতরেও এ-মন্ত্রটি পুনরুক্ত হয়েছে৷ যথাস্থানে এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করাও হয়েছে৷
এই খণ্ডে বলা হয়েছে যে যিনি জীবাত্মাকে পরমাত্মা বলে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনি নিজের মধ্যে ডুবে যান৷ তিনি হয়ে পড়েন ‘আত্মক্রীড়’ ও ‘আত্মরতি’ অর্থাৎ যিনি নিজের মনেই খেলা করেন, নিজের প্রেমে নিজেই বিভোর থাকেন৷ বিশ্বের অন্য কোনো জিনিসে তাঁর আর মন বসে না৷ না থাকে পুত্র-কলত্রের প্রতি মোহ, না থাকে অর্থের লিপ্সা৷
কিন্তু কি করে সে উপলব্ধি ঘটে?
উপনিষদ তার পন্থা নির্দেশ করেছে৷ সত্যের প্রতি অচল নিষ্ঠা তার প্রথম সোপান৷ তাই এ উপনিষদ বলে,
”সত্যমেব জয়তে নানৃতং
সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ৷’’
সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, অনিবার্য; অসত্য কখনো জয়ী হতে পারে না৷ ‘দেবযান’ নামক বিস্তৃত যে-পথ, তা শুধু সত্যের দ্বারাই লাভ করা যায়৷ এ-পথে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত দুরূহ, কিন্তু ‘আপ্তকাম’ অর্থাৎ মানুষের আশা পূরণের এই একটি মাত্রই পথ৷ সত্যাশ্রয়ী ছাড়া সে পথে কেউ যেতে পারে না৷
সত্যের স্বরূপ কী?
পরিপূর্ণ সত্যের ধারণা করতে হলে, অসত্য কী তা বিচার করতে হবে৷ অসত্যের রূপ ছয়টি৷ প্রথম রূপ ‘কুহক’ বা ছলনা; দ্বিতীয়, ‘মায়া’ অর্থাৎ যা ভাবা যায় তা প্রকাশ না-করে অন্য কিছু বলা; তৃতীয়, ‘শাঠ্য’ অর্থাৎ অর্থসংগতির অনুপাতে দান না-করা; চতুর্থ, ‘অহংকার’ অর্থাৎ মিথ্যাভিমান; পঞ্চম, ‘দম্ভ’ অর্থাৎ অযথা ধার্মিকের ভান করা; ষষ্ঠ, ‘অনৃত’ অর্থাৎ যা অনুভব করা যায়, তা না-বলে অন্য কিছু বলা৷
অসত্যের এ-ব্যাপক রূপকে পরিপূর্ণভাবে বর্জন করতে না-পারলে সত্যনিষ্ঠা জন্মে না৷
দ্বিতীয় খণ্ডে দেখানো হয়েছে যে বলহীন কখনো আত্মজ্ঞ বা ব্রহ্মবিদ হতে পারে না৷ ”নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ৷’’ এটি কঠোপনিষদেরই পুনরুক্তি৷ কিন্তু এ-বল শারীরিক শক্তি নয়-এ-বল আত্মসংযমের বা আত্মনিয়ন্ত্রণের৷ সাংসারিক ব্যাপারের মধ্যে জড়িত বা জীবনের প্রতি আসক্ত হলে আত্মসংযম অসম্ভব৷ সন্ন্যাসগ্রহণ ছাড়া আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ নেই; কিন্তু শুধু সন্ন্যাস নিলেই হবে না, সঙ্গে চাই তপস্যা৷ এই সন্ন্যাসভিত্তিক তপস্যার দ্বারাই ব্রহ্মলাভ ঘটে৷
তারপর ব্রহ্মলাভ ঘটলে মানুষের কী হয়, সে কথা অত্যন্ত মনোজ্ঞ উপমা দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে৷
বিশ্বসৃষ্টির প্রকৃতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা-ও নানা উপমার সাহায্যে৷ প্রকৃতপক্ষে এই মনোরম উপমাগুলি এ-উপনিষদটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণের বস্তু৷
এ-উপনিষদটি থেকে শংকরের উদ্ধৃতির সংখ্যা ন্যূনাধিক একশো ত্রিশ৷
মুণ্ডকের সঙ্গে সঙ্গে পদ্যে লেখা উপনিষদ-গুচ্ছের আলোচনা শেষ হল৷ বাকি রইল দুটি : প্রশ্ন ও মাণ্ডূক্য৷ দুটিই গদ্যে লেখা৷ এ-দুটির ভাষাও পরবর্তীকালের ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃত-ঘেঁষা-প্রাচীন সংস্কৃত থেকে বহুদূরে৷
প্রশ্ন
মুণ্ডকের মতো প্রশ্নােপনিষদও অথর্ববেদীয়৷ মোটের উপর এটি গদ্যে লেখা; পদ্য আছে বটে, তবে তার ভাগ বেশি নয়৷
এর অধ্যায় ছয়টি এবং মোট মন্ত্রসংখ্যা সাতষট্টিটি৷ এটিও প্রশ্নােত্তরের রীতিতে রচিত৷ সেদিক থেকে এটি অন্বর্থ৷ সব প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছেন মহর্ষি পিপ্পলাদ; প্রশ্ন করেছে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই৷
প্রকৃতপক্ষে মুণ্ডক ও প্রশ্নােপনিষদ একটি অন্যটির পরিপূরক মাত্র৷ যে প্রশ্নটি মাত্র ভ্রূণরূপে একটির মধ্যে দেখা যায়, তারই পরিণতি ঘটেছে অন্যটিতে৷ কাজেই এ-দুটি উপনিষদ মূলত বিভিন্ন নয়; বিষয়বস্তু দুটির একই, শুধু ব্যাখ্যার রীতিটি বিভিন্ন৷ একটিতে পাওয়া যাবে যে-সব বিষয়ের সংক্ষিপ্তসার, অন্যটিতে দেখা যাবে তারই বিশদ ব্যাখ্যা৷
যে প্রশ্ন কটির শাশ্বত মূল্য রয়েছে এখন সেগুলিরই আলোচনা করা যাক৷
মহর্ষি পিপ্পলাদ বিখ্যাত ব্রহ্মবিদ মুনি৷ তাঁর কাছে ব্রহ্মবিদ্যা শেখবার জন্য আসলেন কাত্যায়ন, ভার্গব, আশ্বলায়ন, সৌর্য্যায়ণী, সত্যকাম, সুকেশা প্রভৃতি মুনি৷ তাঁরা সবাই নিয়ে এলেন কিছু কিছু যজ্ঞকাষ্ঠ গুরুকে দেবার জন্য৷ এটা ভারতবর্ষের অতি পুরোনো রীতি৷ এ-রীতি অনুসারে কারওরই কোনো-কিছু উপহার না-নিয়ে কখনো রাজা, ভিষক বা গুরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা অবিধেয়৷
পিপ্পলাদ তাঁর আশ্রমের অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে তাঁদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিলেন৷ এক বছরেরও বেশি তাঁরা সে আশ্রমে তপস্যা করলেন৷ তারপর একদিন কাত্যায়ন গুরুকে প্রশ্ন করলেন, প্রাণীজগতের সৃষ্টি হল কী করে?
পিপ্পলাদ বিশ্বজগতের জন্মবৃত্তান্ত ব্যাখ্যা করলেন, আর তার সঙ্গে এল বিভিন্ন প্রাণীর জন্মের কাহিনি৷ উপনিষদটির প্রথম অধ্যায়ে তারই বর্ণনা৷
দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভার্গবের প্রশ্ন৷ প্রাণীদের দেহের কথা; তার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে প্রাণের কথাও৷ কী কী শক্তি এ-বিশ্বজগৎকে চালনা করে? তাদের মধ্যে কোন কোনটি দেহ চালনা করে? তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কে?
শেষবিচারে প্রাণই প্রাণীজগতে সর্বজয়ী শক্তি বলে স্থিরীকৃত হয়েছে৷ বিশ্বজগৎও প্রাণভিত্তিক৷ প্রাণের অভাবে ঘটে বিশ্বজগতের পরিসমাপ্তি৷ কাজেই, এ-অধ্যায়ে নানাভাবে প্রাণের জয় বিঘোষিত হয়েছে৷
প্রাণের স্বরূপ কী? প্রাণ প্রাণবায়ু ও পঞ্চেন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকের সমবায়ে রচিত শক্তি৷ এই পঞ্চেন্দ্রিয় প্রাণের সহযোগী৷ প্রাণবায়ু দেহের আভ্যন্তরস্থ সতত সঞ্চরমান বায়ু৷ দেহের সর্বত্রএটি বিদ্যমান, কিন্তু কার্যের বিভিন্নতার জন্য একে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে৷
মুখে ও নাকে যে বায়ু বহে, তার নাম ‘প্রাণ’৷ এর কাজ শ্বাসযন্ত্রের চালনা৷
পাকস্থলীর নিম্নদিকে যে বায়ু বহে ও মলদ্বার দিয়ে নিঃসৃত হয়, তার নাম ‘অপান’৷ এর কাজ আহার্য জীর্ণ করা ও মলমূত্রত্যাগে সহায়তা করা৷
‘ব্যান’ বায়ু কিন্তু দেহের সর্বত্রবিদ্যমান থেকে দেহকে ক্রমাগত প্রসারিত ও সংকুচিত করে৷ এর কাজ দেহের নার্ভ-যন্ত্রের চালনা৷
‘উদান’ বায়ু খাদ্যনালি বেয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়৷ ‘উদান’ বায়ুই হৃদয়স্থিত সুষুম্নানাড়ির সাহায্যে পাপ ও পুণ্যলোকে নিয়ে যেতে পারে৷
[অত্যাধুনিক ভিষক্শাস্ত্র এই সুষুম্নানাড়ির সন্ধান পেয়েছে৷ এ ক্ষুদ্র নাড়িটি মস্তিষ্কের সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের সংযোগ-সাধনকারী৷ যখন হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক ও ফুসফুসও অবিকৃত থাকে, তখনও মানুষের মৃত্যু হতে পারে এই নাড়িটি দিয়ে-প্রতিবর্তী বা reflex ক্রিয়ার ফলে৷ এর বৈজ্ঞানিক নাম ভেগাস্ (vagus)]
“সমান’ বায়ু দেহের ভিতরে সমতা রক্ষা করে সর্বত্র বিচরণ করে৷
প্রাণবায়ু তাই “প্রাণ, অপান, সমান, উদান ও ব্যান’ বায়ুর সমবায়৷
ব্যান বায়ুকে প্রাণ ও অপান বায়ুর সংযোগস্থলে অবস্থিত বলে বলা হয়৷ এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন মানুষ কোনো বিশেষ শ্রমসাধ্য কাজ করে৷ তখন প্রাণ ও অপান দুটি বায়ুরই কাজ বন্ধ থাকে, শুধু রাজত্ব করে ব্যান৷
এ-অধ্যায়ের শেষে প্রাণকে দেহ ছেড়ে না-যেতে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে৷
তৃতীয় অধ্যায়ে আশ্বলায়ন পিপ্পলাদকে প্রাণ সম্পর্কে পাঁচটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন৷ প্রাণের জন্ম হল কী করে? দেহের মধ্যে প্রাণের প্রবেশের দ্বার কী? প্রাণ কী করে দেহের মধ্যে নিজেকে সঞ্চারিত করছে? কী করে প্রাণ দেহত্যাগ করে? প্রাণ কী করে মহাপ্রাণে বা বিশ্বপ্রাণে পরিবর্তিত হয়?
প্রাণের জন্ম কি বিশ্বের পরম সত্তা থেকে ঘটেছে? তা হয়ে থাকলে এ-দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক কী?
এ-সম্পর্কে আলোচনা চলেছে বহু৷ প্রাণকে বলা হয়েছে বিশ্বের পরম সত্তা বা বিশ্বপ্রাণের ছায়া৷ একটির সঙ্গে অন্যটির অচ্ছেদ্য বন্ধন, আলো-ছায়ার মতো৷ কিন্তু আলো ও ছায়া যেমন এক নয়, এরাও তেমনি বিভিন্ন৷
সূর্য থেকে বিশ্ব পেয়েছে তার শক্তি, আলো ও তাপ; এই সূর্যই কি প্রাণের জন্মদাতা? বাইরের তাপের সঙ্গে দেহাভ্যন্তরের তাপের সংযোগ ও সমতা রয়েছে৷ আলোচনার শেষে পিপ্পলাদ বলেছেন, ”আদিত্যো হ বৈ বাহ্যঃ প্রাণঃ’’ অর্থাৎ সূর্যই পৃথিবীর বাহ্য বা বাইরের প্রাণ৷
আধুনিক জীববিদ্যার প্রথম সূত্রপাত যে এ-অধ্যায়ে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই৷
চতুর্থ অধ্যায়ে সৌর্য্যায়ণী পিপ্পলাদকে পাঁচটি প্রশ্ন করেছেন; পিপ্পলাদ তার জবাব দিয়েছেন৷
সৌর্য্যায়ণীর প্রশ্ন : দেহের মধ্যে কোন শক্তি নিদ্রিত থাকে? কে জাগ্রত থাকে? কোন শক্তি বা দেবতা স্বপ্ন দর্শন করে? সুখানুভূতি হয় কোন শক্তির? এ-সব শক্তির ভিত্তি কী?
নিদ্রাকালে দেহের অন্য সব কাজের অবসান ঘটে, কিন্তু প্রাণ থাকে জাগ্রত৷ অর্থাৎ প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান ও উদান বায়ুর কাজ থাকে অব্যাহত৷
স্বপ্ন দেখে মন৷ মনের ক্রিয়া চারটি৷ এই ক্রিয়া অনুসারে মনকে চার ভাগে বিশ্লেষণ করা চলে; মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত৷ মনের কাজ সন্দেহ জাগানো; বুদ্ধির কাজ কর্তব্য স্থির করা; অহংকার জাগায় আত্মম্ভরিতা; আর স্মৃতি বা পূর্বানুভূত বিষয়ের জ্ঞান রক্ষা করে চিত্ত৷
কিন্তু স্বপ্ন পুনরাবৃত্তি মাত্র৷ জাগ্রত অবস্থায় মানুষ যা কখনো চিন্তা করেনি বা দেখেনি, তা কখনো স্বপ্নে দেখা যায় না৷ যদি এমন কিছু দেখা যায় যা অসাধারণ, বা যা মনে পড়ে না, তবে তা পূর্বজন্মে দৃষ্ট৷
স্বপ্নহীন নিদ্রাকালে মানুষ আনন্দলোকে অবস্থান করে৷ উপমা দিয়ে প্রশ্নােপনিষদ বলেছে,
”স যথা সৌম্য বয়াংসি বাসোবৃক্ষং সম্প্রতিষ্ঠন্তে এবং হ বৈ তৎসর্ব্বংপর আত্মনি সম্প্রতিষ্ঠতে৷৷’’
অর্থাৎ সন্ধ্যাকালে পাখিরা যেমন তাদের কুলায়ে ফেরে, স্বপ্নহীন নিদ্রাকালে সবাই তেমন পরমাত্মার সকাশে গিয়ে তাঁর মধ্যে বিলীন হয়৷ কাজেই স্বপ্নহীন নিদ্রার পরে মানুষ আনন্দোচ্ছল হয়৷
প্রণব মন্ত্র বা ওঁ ধ্যান করলে মানুষের কি ফললাভ ঘটে?
প্রণব মন্ত্র বা ওঁ পরমাত্মার প্রতীক৷ আত্মোপলব্ধি হয় নানা প্রকারে-প্রার্থনায় ও ধ্যানে৷ প্রণব মন্ত্রের ধ্যানকে বলা হয় প্রতীকোপসনা৷
প্রতীক অর্থ কী৷ প্রতীক কোনো মহৎ বা বিরাট জিনিসের অংশবিশেষ অথবা এমন কোনো বস্তু যার মধ্য দিয়ে সে বিরাট পদার্থের কল্পনা করা যায়৷ সীমাবদ্ধ মনে কোনো বিরাটত্ব কল্পনা করা সহজসাধ্য নয়, প্রায় অসম্ভবই বলা চলে৷ কাজেই বিরাটের প্রতিকোপাসনাই বিরাটের উপাসনার প্রথম সোপান৷ এই প্রতীকোপাসনাই বিরাটের উপাসনার প্রথম সোপান৷ এই প্রতীকোপাসনাই মূর্তিপূজার জন্মদাতা৷
পিপ্পলাদ বললেন, সাপ যেমন তার খোলস বদলায়, মানুষও তেমনি ওঁ-এর ধ্যান করে পাপমুক্ত হতে পারে৷
ষষ্ঠ অধ্যায়ে ষষ্ঠ অর্থাৎ শেষ প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছেন সুকেশা৷
আত্মা ষোলোটি অংশের সমষ্টি বলে বলা হয়; এ-ষোলোটি অংশ কী কী৷
আত্মার কোনো আকৃতি নেই, কোনো দেহও নেই৷ মানুষ অপরাবিদ্যার চর্চা করে আত্মার মধ্যে নানা বৈশিষ্ট্যের আরোপ করে৷
আত্মা কি দেহের মধ্যে বাস করে না? যদি তা-ই করে, তবে মানুষের দেহের আকৃতির সঙ্গে কি তার সামঞ্জস্য বা সাদৃশ্য রয়েছে? না, ফলের মধ্যে বীজের মতো এর বাস? দেহস্থ আত্মাই কি দেহের স্রষ্টা বা কারণ?
পিপ্পলাদ অধিবিদ্যার রাজ্যে প্রবেশ করে এসব প্রশ্নের সবিশেষ উত্তর দেন৷ আর, সর্বশেষ এসব ব্যাখ্যার সংক্ষিপ্তসার করে বলেন,
”অরা ইব রথনাভৌ কলা যস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতাঃ৷
তং বেদ্যং পুরুষং বেদ যথা মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথা ইতি৷’’
অর্থাৎ রথচক্রের মধ্যস্থিত শলাগুলি যেমন চক্রের মধ্যবিন্দুতে এসে সংযুক্ত হয়, অপরাবিদ্যা-কথিত কলা বা অংশ বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যও এসে সর্বশেষ আত্মায় বিলীন হয়৷ আত্মোপলব্ধি ছাড়া মৃত্যুর দুঃখ ও ক্ষোভ এড়ানো যায় না৷
প্রশ্নােপনিষদে প্রশ্নের পর প্রশ্ন; অন্যান্য প্রধান উপনিষদগুলির মতো আলোচনাও সর্বত্র উচ্চস্তরের নয়৷ অনেকে তাই ওই উপনিষদটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন না৷
এ-উপনিষদটি থেকে শংকরের উদ্ধৃতির সংখ্যা ত্রিশটির কিছু বেশি৷
মাণ্ডুক্য
মাণ্ডূক্য দিয়ে আমরা আলেখ্য রচনা শেষ করব৷
মাণ্ডূক্যোপনিষদ অথর্ববেদীয়৷ এতে মন্ত্র মাত্র বারোটি৷ কিন্তু মাণ্ডূক্যোপনিষদ বুঝতে হলে পড়তে হবে গৌড়পাদের কারিকা বা শ্লোকোময় ব্যাখ্যার পুথি৷ এই কারিকার মধ্যে রয়েছে দু-শো পনেরোটি শ্লোক৷ এ শ্লোকগুলির সাহায্য ছাড়া মাণ্ডূক্যের অন্দরমহলে প্রবেশ করা যায় না৷
এমন যে পরম প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান কারিকা, তার রচয়িতা আচার্য গৌড়পাদ কে ছিলেন? গৌড়পাদ গৌড়দেশীয় মানুষ বা গৌড়বঙ্গের মানুষ-সোজা কথায় বাঙালি৷ শুধু তাঁর নামের সঙ্গে যোগ রেখে এ-কথা বলা হচ্ছে না, এর বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সাক্ষ্য রয়েছে৷ শংকরের সাক্ষাৎশিষ্য সুরেশ্বর তাঁর প্রসিদ্ধ “নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি’ গ্রন্থে গৌড়পাদকে বাঙালি বলে উল্লেখ করেছেন৷ আচার্য গৌড়পাদের শিষ্য গোবিন্দপাদ আর তাঁর শিষ্য শংকর৷ শংকর তাই এ-কারিকাটিকে পরম শ্রদ্ধা করতেন৷ সত্যি এটি সে শ্রদ্ধারই যোগ্য৷
অন্যান্য উপনিষদের সঙ্গে মাণ্ডূক্যের একটু প্রভেদ রয়েছে৷ অন্যান্য উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যা যেমন হয় প্রশ্নােত্তরচ্ছলে, নয় উপমা ও দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো হয়েছে, এখানে তা হয়নি৷ এ-উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে সরাসরি৷
এখানে ব্রহ্মকে “চতুষ্পাৎ’ অর্থাৎ চারটি অংশযুক্ত বলে কল্পনা করা হয়েছে৷ অন্যভাবে বলতে গেলে, ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার ঘটে তিনটি ধাপ পার হয়ে চতুর্থ ধাপে৷ এই চতুর্থ ধাপে জীবাত্মা পরমাত্মার মধ্যে বিলীন হয়৷
যে-তিনটি ধাপ পার হলে ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার ঘটে, তা মানুষ যে-তিনটি অবস্থার মধ্যে পৃথিবীতে বাস করে তারই অনুরূপ৷ এ-তিনটি অবস্থা কী কী? প্রথমত, জাগ্রতাবস্থা; দ্বিতীয়, স্বপ্নময় নিদ্রাবস্থা; তৃতীয় স্বপ্নহীন নিদ্রাবস্থা৷ এরই পরবর্তী ধাপকে বলা হয় তুরীয়াবস্থা, যা পরমানন্দময়৷
ব্রহ্মের সাক্ষাৎকারের পথে আমরা প্রথম পাই বিশ্বজগৎকে; এটি জাগ্রতাবস্থার তুল্য৷
প্রণব মন্ত্র “ওঁ’-এরও চারটি অংশ-অ, উ, ম; ওঁ-এর প্রথম ধাপ বা বিশ্বজগৎ ‘অ’-এর অনুরূপ৷
বিশ্বজগতের ভিত্তি কী? অর্থাৎ বিশ্বজগতের অবস্থিতি নির্ভর করে কিসের উপর? নানা স্থূল জিনিসের উপর৷ আমাদের জাগ্রতাবস্থা স্থূলতাময়৷ কাজেই বিশ্বজগতে শুধু জড়েরই খেলা-স্থূল জিনিসের মেলা নিয়েই এর কারবার৷ তাই একে বলা হয় ‘স্থূলভুক’ অর্থাৎ এমন একটি অবস্থা যার ভিত্তিই স্থূলতাময়৷
দ্বিতীয় ধাপকে বলা হয় ‘তৈজসম্’-এটি স্বপ্নময় নিদ্রিতাবস্থার তুল্য৷ এটি ওঁ-এর ‘উ’-এর অনুরূপ৷ এ-অবস্থায় মানুষের অন্য সকল ইন্দ্রিয়ের কাজের অবসান ঘটে, শুধু জাগ্রত থাকে মন৷ মানুষ স্বপ্নে যা দেখে তা তার কাছে বাস্তব বলেই মনে হয়-সে যে স্বপ্ন দেখেছে তা তার মনে পড়ে না৷ কারিকায় বলা হয়েছে যে স্বপ্নদৃষ্ট বিষয় মানুষের পূর্বস্মৃতির প্রকাশ মাত্র৷
এ-অবস্থাটি নির্ভর করে কীসের উপর? বহির্জগতের প্রভাব যে স্বপ্নময় নিদ্রিতাবস্থায় থাকে না তা তো স্পষ্ট৷ জাগ্রতাবস্থার মতো এটি স্থূলতাময় নয়; চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বকের কাজ তখন বন্ধ, কাজেই স্থূলতারও তখন অবসান ঘটে৷ তাই, এ-অবস্থাকে বলা হয় ‘সূক্ষ্মভুক’ অর্থাৎ যার ভিত্তি সূক্ষ্মতায়, সৌকুমার্যে, পেলবতায়৷
তৃতীয় ধাপকে বলা হয় ‘প্রাজ্ঞ’৷ এটি সুষুপ্তির অবস্থা অর্থাৎ স্বপ্নহীন নিদ্রাবস্থা; ওঁ-এর ‘ম’-এর অনুরূপ৷ এ-অবস্থায় মানুষের সকল ইন্দ্রিয় থাকে সুপ্ত, এমনকি মনও৷ সুষুপ্ত মানুষের কাছে বিশ্বজগতের সত্তা অবলুপ্ত হয়ে যায়; মানুষ এক আনন্দের রাজ্যে বিচরণ করে৷ এ-অবস্থাকে বলা হয় ‘আনন্দভুক’ অর্থাৎ যার বনিয়াদ আনন্দরসে৷
কিন্তু এটাই শেষ ধাপ নয়৷ চতুর্থ ধাপের অবস্থা সাধারণ মানুষের চিন্তা, ভাবনা ও অনুভূতির বাইরে৷ একে বলা হয় তুরীয়; জীবাত্মা তখন পরমাত্মার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়৷
এবার গৌড়পাদের কারিকার কথা বলা যাক৷
কারিকাটিও চারভাগে বিভক্ত৷ এর প্রথম অধ্যায়ের নাম আগমপ্রকরণ৷ এতে রয়েছে নানা শাস্ত্রব্যাখ্যা৷ দ্বিতীয়, বৈতথ্য-প্রকরণ; এর প্রতিপাদ্য জগতের অলীকত্ব, আলোচনাও সে সম্পর্কেই৷ তৃতীয়, অদ্বৈত-প্রকরণ; যে-শক্তি এ-বিশ্বজগৎকে পরিচালনা করছে তা যে এক ও অভিন্ন, এ-তথ্য প্রমাণ করাই এ-অধ্যায়ের উদ্দেশ্য৷ চতুর্থ, অলাতশান্তি-প্রকরণ; এতে বিশ্বের পরম সত্তার সম্পর্কে দ্বৈতবাদকে খণ্ডবিখণ্ড করা হয়েছে৷
বিশ্বনিয়ন্তার ইচ্ছানুসারেই কি বিশ্বসৃষ্টি হয়েছে? না আদিহীন, অন্তহীন কালই এর সৃষ্টিকর্তা? এটি কি সত্যি বিশ্বস্রষ্টার লীলানিকেতন? প্রথম অধ্যায়ে গৌড়পাদ এ-সকল প্রশ্নের বিচার করেছেন৷
বৈতথ্য শব্দের অর্থ অলীকত্ব৷ দ্বিতীয় অধ্যায়ে, আমরা যা দেখি বা অনুভব করি, সবই যে মিথ্যা তা প্রতিপন্ন করা হয়েছে৷ জগৎকে তুলনা করা হয়েছে স্বপ্নের সঙ্গে৷ স্বপ্ন যে দেখে, সে কি তখন বুঝতে পারে যে সে স্বপ্ন দেখছে অর্থাৎ যা দেখছে তা সত্য নয়? তেমনি বিশ্বের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থেকে কেউ এর অলীকত্ব বুঝতে পারে না৷ এটা মায়ার খেলা৷ এ-মায়া সৃষ্টি করেছেন পরমাত্মা বা বিশ্বের পরম সত্তা৷
মায়ার স্বরূপ কী?
মোটামুটিভাবে মায়া পরমাত্মার একটি বিশেষ ধর্ম, গুণ বা শক্তি৷ এ-শক্তির প্রভাবেই হয় বিশ্বজগতের উদ্ভব-তিনি এ-জগৎ ‘সৃষ্টি’ করেননি, জাদুকর ভেলকিতে যেমন কোনো জিনিসেরই সৃষ্টি হয় না, মাত্র সাময়িকভাবে অনুভূত হয়, এ-ও তাই৷ প্রকৃতপক্ষে পরমাত্মার অনুভূতি সাধারণের পক্ষে অসম্ভব-এই মায়ার প্রভাবেই তা সীমাবদ্ধ মনের গোচরে আসে৷ মানুষ যতক্ষণ নিজের অস্তিত্ব স্বীকার করে, অনুভব করে, ততক্ষণই সে তার অন্তরাত্মাকে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মেনে নেয়৷ নিজের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী আর ক-জন?
কিন্তু মানুষের অন্তরাত্মার স্বরূপ কী? আত্মা কি তার দেহ, না প্রাণ, না মন, না বুদ্ধি, না এ-ছাড়া কিছু?
তৃতীয় অধ্যায়ে গৌড়পাদ অদ্বৈতবাদের বিশেষ আলোচনা করেছেন৷ পরম সত্তা ও সে সত্তার মধ্যে বিলীন হওয়ার পথের বিশ্লেষণ করেছেন৷ অধ্যায়টির শেষে এর সংক্ষিপ্তসার দিয়েছেন এই শ্লোকে :
”ন কশ্চিজ্জায়তে জীবঃ সম্ভবোহস্য ন বিদ্যতে৷
এতত্তদুত্তমং সত্যং যত্রকিঞ্চিন্ন জায়তে৷৷’’
পরম সত্য কী? কোনো কিছুরই জন্ম হয় না; না-কোনো ভোজ্যের, না-কোনো ভোগীর৷ অর্থাৎ মানুষের এই যে সৃষ্টির ধারণা তা-ই অমূলক৷ কাজেই সঙ্গে সঙ্গে বিলয়ের কল্পনাও অমূলক, সবই মায়ার ভেলকি৷
চতুর্থ অধ্যায়েও অদ্বৈতবাদেরই কথা৷ অলাতের সুষ্ঠু উপমা দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে৷ অলাত কাকে বলে?
অলাত একখণ্ড কাঠ, যার মাত্র একদিকে আগুন জ্বালানো হয়েছে৷ কাঠটির অন্যদিক ধরে যদি কেউ তাড়াতাড়ি সেটিকে ঘোরায়, তবে একটি অবিচ্ছিন্ন আলোর রেখার সৃষ্টি হবে৷ এ-রেখাটির আকৃতি ইচ্ছামতো পরিবর্তন করা যেতে পারে-সোজা, গোল বা বাঁকা; সবই নির্ভর করবে যে-কাঠটি ঘোরাচ্ছে তার হাতের কারসাজির উপর অর্থাৎ হাত-ঘোরানোর গতির ও প্রকৃতির উপর৷
কিন্তু হাত-ঘোরানো বন্ধ করলেই এ-আলোর রেখার মায়াজালেরও সমাপ্তি হবে৷ কিন্তু এ-সমাপ্তির অর্থ কী? রেখাটি কি অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হবে, না অলাতের মধ্যেই বিলীন হবে. এর কোনো কিছুই ঘটবে না, কারণ এ-রেখার সৃষ্টিই কখনও ঘটেনি, তাই এর বিলয়ের কথাও ওঠে না৷
আমরা চারদিকে যা দেখি, সবই এই অলাতের রচা আলোর রেখার মতো৷ আমরা এগুলি দেখতে চাই বলেই দেখি; দেখতে যখন আর চাই না তখন দেখব না৷
কারিকার মতে,
”অলাতে স্পন্দমানে বৈ নাভাসা অন্যতোভুবঃ৷
ন ততোহন্যত্রনিস্পন্দান্নালাতং প্রবিশন্তি তে৷৷’’
অর্থাৎ অলাত যখন ঘোরে, তখন আলোর রেখার বিভিন্ন রূপগুলি অলাত ছাড়া আর অন্য কোনো কারণ থেকে উদ্ভূত হয় না, আর সেগুলি আবার নিস্পন্দ অলাতেও প্রবেশ করে না৷
কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে যে-অলাতটি ঘোরে, সেটি কী? ঘোরে মানুষের বুদ্ধি৷ ঘোরায় কে? অবিদ্যা৷ তার ফলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডরূপ মায়ার খেলার উদ্ভব ঘটে৷
আমরা এবার শংকরের একাদশ উপনিষদগুচ্ছের আখ্যান মোটামুটি শেষ করেছি৷ তাদের বিভাগও করেছি মোটামুটি কালানুসারে৷
পুনরুক্তি হলেও আরও একবার স্মরণ করা প্রয়োজন যে উপনিষদের আশ্রয় বা অবলম্বন বেদ৷ বেদের অনেক মন্ত্র নানা উপনিষদে হুবহু উদ্ধৃতও হয়েছে৷ তবে বেদে যা নিতান্ত ইতস্তত ছড়ানো, উপনিষদে তা শুধু মোটামুটি সুবিন্যস্তই হয়নি, দানাও বেঁধেছে৷
আরও একটি কথা৷ উপনিষদের ভাবধারা এত সর্বজনীন ও সনাতন যে পাঠকের কাছে এগুলি যে এত প্রাচীন তা মনেও হবে না৷
তবু আবার স্মরণ করা প্রয়োজন যে এই ভাবধারাই মানুষ-প্রজাতির বিশ্বজগৎ ও তার পরম সত্তার আদি বিশ্লেষণ৷ এগুলি শুধু ভারতের মানুষের চিত্ত, ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্য নয়, সমস্ত মানুষ-প্রজাতিরও৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন