ছয় – উপনিষদ ও ভারতীয় নয়টি দর্শনশাস্ত্র

ছয় – উপনিষদ ও ভারতীয় নয়টি দর্শনশাস্ত্র

প্রধান উপনিষদগুচ্ছের সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ হল৷ বলা বাহুল্য, একে দার্শনিক আলোচনা বলা চলে না, বস্তুত এ-গ্রন্থের উদ্দেশ্যও তা নয়৷

উপনিষদে মানুষ-প্রজাতির আদিম চিন্তাধারা ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে; তখনও সুবিন্যস্ত বিজ্ঞান ও দর্শনের সৃষ্টি হয়নি৷ সে-জগতের যাঁরা চিন্তাবীর, তাঁরা সবাই ছিলেন বিজ্ঞানী-দার্শনিক৷ উপনিষদে চিন্তার সূত্রজাল বহু; সেগুলি মানুষের নবোন্মেষিত মেধার সার্থক সৃষ্টি৷ তাই বলে এর মধ্যে বিজ্ঞান বা দর্শনের কোনো প্রতিষ্ঠিত মত খুঁজতে গেলে ব্যর্থ হতে হবে৷

উপনিষদে কোনো প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক মতবাদ নেই সত্য, আর তা থাকারও কথা নয়, কিন্তু এর সূত্রজাল থেকেই সৃষ্ট হয়েছে ভারতীয় নয়টি দর্শন৷ সে-দর্শনশাস্ত্র সৃষ্টি যাঁরা করেছেন, তাঁরা সবাই জগতের নমস্য ব্যক্তি৷ চার্বাক (যদি অবশ্য এটি একটি নাম হয়ে থাকে), বুদ্ধ, মহাবীর, কপিল, কণাদ প্রভৃতি সকলেই এই উপনিষদ থেকে যাঁর যাঁর চিন্তাধারার সূত্র সংগ্রহ করেছেন, আর সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠেছে নয়টি অপরূপ দর্শনশাস্ত্র৷

এই নয়টি দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে তিনটি বেদের সাক্ষ্য ও প্রমাণ মানে না, অন্য ছয়টি মানে৷ কাজেই এরা দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে৷ সাধারণভাবে প্রথম দলকে বলা হয় নাস্তিকধর্মী; দ্বিতীয়টিকে আস্তিকধর্মী৷ এ-আখ্যা-দুটিকে অবশ্য যথাযথ ও সুষ্ঠু বলা চলে না, কারণ যদিও প্রথম দলের মধ্যে সবকয়টিই, হয় ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না, নয় সে-সম্পর্কে নির্বাক৷ দ্বিতীয় দলেও এমন কয়টি রয়েছে যারা এ-ব্যাপারে প্রথম দলেরই অনুরূপ৷ আস্তিক ও নাস্তিক কথা-দুটির উদ্ভব ঈশ্বরকে নিয়ে, বেদের প্রমাণস্বীকার বা অস্বীকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই৷ কাজেই, এ-নাম-দুটিকে অন্বর্থ বলা চলে না৷ তারপর বেদ-মাননা কথাটির উপর জোর দিয়ে এদের বিভাগও যথাযথ হয় না; কারণ, ক্রমে দেখা যাবে, বেদ-মাননা যে-অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা এই যে অধ্যাত্মজ্ঞান, মেধাজাত যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানের চেয়ে অনেক বড়ো৷

আমাদের দেশের প্রাচীন ইতিহাস নেই, কাজেই এ-সব দর্শনশাস্ত্রের ইতিবৃত্তও নেই৷ তবুও যতদূর সম্ভবপর তার একটা হদিস দেওয়ার চেষ্টা করা যাক৷

পূর্বেই বলা হয়েছে যে প্রতিটি বেদেরই দুটি ভাগ৷ দ্বিতীয় ভাগের আরণ্যক অংশ অধিবিদ্যা ও অধ্যাত্ম জ্ঞানের রাজ্য; মূল বেদেরও বহু মন্ত্র এতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে৷ পণ্ডিতেরা মনে করেন যে কালক্রমে জনসাধারণ বৈদিক যজ্ঞ ও নানারূপ আচার-বিচারেই মত্ত হয়ে পড়ে, আর যুক্তিসিদ্ধ ও অধ্যাত্মজ্ঞান থেকে ক্রমশ অনেক দূর সরে যায়৷

কিন্তু প্রতি যুগেই সভ্য মানুষের মধ্যে বুদ্ধিজীবী, ধীমান ও অধ্যাত্মজ্ঞানলিপ্সু জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁরা কি আচার-বিচারকেই জীবনের পরম লক্ষ্য বলে মনে করতে পারেন? এই গতানুগতিক, চিন্তাহীন জীবন ও ধর্মের খোলস অবলম্বন করে তাঁদের মন ভরে না; তাই তাঁরা ক্রমশ হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী৷ এই ক্রমবিদ্রোহেরই মূর্ত প্রতীক চার্বাক, মহাবীর ও বুদ্ধ এবং এঁদের রচিত তিনটি দর্শনশাস্ত্রই এ-বিদ্রোহের মর্মবাণী৷

ইতিহাসের দিক থেকে সন তারিখ দিয়ে এ-বিদ্রোহের কাল চিহ্নিত করা দুষ্কর, তবে মনে হয়, এঁদের মধ্যে চার্বাক পূরোবর্তী৷ অপর দুজন যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মানুষ তার সাক্ষ্য রয়েছে ইতিহাসে৷ এঁরা দুজনেই সমসাময়িক৷ এ-তিনটি দর্শনশাস্ত্রেরই মোটামুটি পরিচয় ক্রমে ক্রমে দেওয়া যাবে৷

হয়তো যে-কারণে এ-বিদ্রোহের উদ্ভব ঘটেছিল সে-কারণেই, অথবা এ-বিদ্রোহের ফলে, দেশের অধিকাংশ চিন্তাশীল ও শিক্ষিত মানুষের মনে একটা ঘোর সন্দেহবাদ ব্যাপক হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ এ-সন্দেহ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে, পরলোকের বিদ্যমানতা নিয়ে৷ শুধু বিশ্বাসের বর্ম এঁটে এ-দারুণ সন্দেহের আঘাত থেকে ধীমান মানুষ তো বটেই, এমনকি অনেক সাধারণ লোকও রক্ষা পেল না৷ এ-সন্দেহের স্রোতকে রোধ করার জন্য বাঁধ তৈরি করতে হল৷ সে-বাঁধের উপকরণ বহু৷ একদিকে যুক্তিবাদ, সহজ বুদ্ধির বিচার ও তার্কিক মীমাংসা, অন্যদিকে সেকালের প্রচলিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের তথ্য৷ এর ফলে ক্রমে উদ্ভব হল ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা বা বেদান্তের৷ এদের কোনটি আগে, কোনটি পরে রচিত হয়েছিল তার বিচার সহজ নয়৷ তবে পণ্ডিতদের মতে বৈশেষিক ও সাংখ্য সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, পূর্ণ আকারে না-হোক অন্তত সূচনায়৷ এমনকি অনেকের মতে, এ-দুটি বৌদ্ধ-পূর্ব যুগের অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকেরও পূর্বের রচনা৷

ন্যায়ের রচয়িতা গৌতমমুনি; বৈশেষিকের রচয়িতা কণাদ৷ কপিল লিখেছেন সাংখ্য, পতঞ্জলি লিখেছেন যোগ; জৈমিনি লিখেছেন পূর্বমীমাংসা আর বেদান্ত রচনা করেছেন বাদরায়ণ৷ এগুলির মধ্যে বেদান্তের গৌরবই সর্বপেক্ষা বেশি; ভারতীয় চিন্তাধারার মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছে বেদান্তপন্থা৷ অদ্বৈত বেদান্ত এই বেদান্তপন্থার সজীব প্রাণধারা; এ-ধারাটির সৃষ্টি করেছেন বিশ্ববিশ্রুত শংকরাচার্য, অবশ্য বাদরায়ণের সূত্র থেকেই৷ এর মূলতত্ত্ব “একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থুঃ’৷ ব্রহ্ম অদ্বিতীয়৷

চার্বাক-পন্থাকে একটা পুরোপুরি দর্শনশাস্ত্র বলা চলে না; মোটামুটিভাবে এটি মানুষের মনের একটা সাময়িক ভাববিপ্লবের কথা৷ এ-ভাবের প্রবাহ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি৷ উপনিষদেরই কোনো কোনো ভাবধারাকে অভিব্যক্ত ও বিকশিত করে সৃষ্টি হয়েছে জৈন ও বৌদ্ধ চিন্তাধারার৷ এ-দুটি ধারার প্রচারও ঘটেছে বহু, বিশেষ করে বৌদ্ধধারায়৷ এরা ঠিক ক্ষণস্থায়ীও হয়নি-বরং যেকালে এদের উদ্ভব ঘটেছিল, সেকালে এদেশে ও বিদেশে এরা বহু মানুষের চিত্ত দখল করে বসেছিল৷ বস্তুত কোনো সময়ে বৌদ্ধধারাটি যুগধর্ম বলেই গৃহীত হয়েছিল৷

ন্যায়, বিশেষ করে ন্যায়ের নবভাষ্য নব্যন্যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে, প্রধানত বাংলাদেশেই প্রভূত জনপ্রিয়৷ বৈশেষিককে এখন আর সজীব বলা চলে না৷ সাংখ্য প্রবচনও এখন প্রায় পুস্তকস্থ বিদ্যা-বিশেষ কোনো কাজে লাগে না৷ যোগ নিয়ে চর্চা করেন অতি অল্পসংখ্যক মানুষই৷ পূর্বমীমাংসার স্থান দর্শনশাস্ত্র হিসাবে কোনোদিনই উচ্চে ছিল না, এখন তো নয়-ই৷ এবার এ-নয়টি দর্শনশাস্ত্রেরই চিন্তা-পদ্ধতির একটা মোটামুটি ধারণা দিতে চেষ্টা করব৷

১৷ চার্বাক

ঈশ্বর ও আত্মা সম্পর্কে পুরোপুরি সন্দেহবাদই এ-চিন্তাধারার মূলসূত্র৷ অবশ্য জগতে পুরোপুরি সন্দেহবাদী কেউ আছেন কিনা তা নিয়ে তর্ক করা চলে, তবে চার্বাকবাদের আদর্শ এটি৷ ঈশ্বর ও আত্মা নেই, কারণ এর কোনোটিই প্রত্যক্ষ করা যায় না৷ এদের মতে প্রত্যক্ষ করা ছাড়া অন্য কোনো প্রকারে আর জ্ঞান আহরণ করা চলে না৷ দেহের উপকরণ তো ভৌতিকই, অর্থাৎ বায়ু, জল, মাটি, আগুন প্রভৃতি; এমনকি প্রাণেরও৷ এ-সব জিনিসের একটা বিশেষ সংযোগের ফলে প্রাণের জন্ম হয়েছে; বাইরে থেকে কেউ প্রাণের সৃষ্টি করে দেহে তার সংযোগ করে দেয়নি৷

এখানে অবান্তর হলেও একটা কথা বলছি৷ আধুনিক বিজ্ঞানে প্রাণের জন্মরহস্য সম্পর্কে যে-কথা বলা হয়, তার সঙ্গে চার্বাকের এ-সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে৷ পৃথিবীর মধ্যে প্রথম প্রাণের জন্মের ইতিহাসের ব্যাখ্যা চার্বাকের কালেও যা ছিল, এখনও মূলত তাই রয়েছে৷

দেহপাতের সঙ্গে সঙ্গে হয় প্রাণেরও সমাপ্তি৷ কাজেই, মৃত্যুর পরে মানুষের আর কোনো অস্তিত্বই থাকে না; কোনো প্রকারেই নয়৷ যারা বলে অস্তিত্ব থাকে, তারা শুধু গল্পই রচনা করে৷ মৃত্যুর পরবর্তী অস্তিত্বের প্রমাণ কেউ দিতে পারে?

চার্বাকবাদীরা পুরোপুরি জড়বাদী অর্থাৎ যা দেখা যায়, শোনা যায় বা প্রত্যক্ষ অনুভব করা যায়, তা ছাড়া আর কিছুই মানে না৷ তাই তারা প্রেয়োবাদ, অর্থাৎ যা নিয়ে পৃথিবীতে মানুষ সুখী হয় বলে মনে করে, তারই প্রচার করে৷ কঠোপনিষদে কথিত শ্রেয়োবাদ বা সাম্পরায় বা পরলোকের কথায় তারা বিশ্বাস করে না৷ তাদের মতে, এ- জন্মে যত পারো সুখ ভোগ করে নাও, কারণ পুনর্জন্ম আছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে তাদের ঘোর সন্দেহ৷ “খাও দাও, স্ফূর্তি কর’-দরকার মতো, “ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’, অর্থাৎ ঋণ করেও ঘি খাবে-কাল কি হবে জানা নেই; হয়তো তোমার অস্তিত্বও থাকবে না৷ “ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ?’ তোমার দেহ ভস্মীভূত হলে তুমি আর কোনোক্রমেই ফিরে আসবে না৷

ভারতবর্ষের বহুযুগের পুরোবর্তী এ-চার্বাকপন্থার রূপই দেখা গিয়েছিল গ্রিসে-খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে৷ সিরেনিক (Cyrenaic) ও এপিকুরিয়ান (Epicurean)-দু-দলই ছিল এ-পথের পথিক৷ অবশ্য তাদের দলগত মতবাদে একটু প্রভেদ ছিল৷

বৈদিক সমাজ একদা পরলোকের তথ্যবিচারে ইহলোকের কথা একেবারেই বিস্মৃত হতে বসেছিল৷ মনে হয়, চার্বাক-বিদ্রোহের মূলে এই ইহলোকের প্রতি সেকালের মানুষের চরম অবহেলা৷ এই বিস্মৃতি ও আবেশ থেকে মুক্তি দেবার জন্য চার্বাক সমাজকে আঘাতও করলেন চরম৷ এর প্রয়োজন ছিল৷ মানুষ কি শুধু বেদের রীতি ও পদ্ধতি বিনাপ্রশ্নে ও বিনাবিচারে মেনে চলার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে? তার মধ্যে কি বিচারবুদ্ধি নেই? তার কি কর্মের স্বাধীনতা নেই? আত্মসম্মান-বোধ নেই?

চার্বাকের চিন্তাধারার মূলসূত্র রয়েছে উপনিষদের পাতায়৷ সেখানে বলা হয়েছে এ-সন্দেহবাদেরই কথা৷ বলা হয়েছে আত্মা বা ব্রহ্ম নেই, পরলোক নেই; মৃতের আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না বলে অনেকে বলেন৷ তাই নচিকেতা তার তৃতীয় বরে মৃত্যুরাজ যমকে এ-সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন৷ একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, চার্বাকের মূল চিন্তাধারার সূত্র এটিই৷ শুধু এ-বক্তব্যটিই তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন আর নানাভাবে পল্লবিত করেছিলেন৷

২৷ জৈন

জৈনপন্থায় আত্মাকে মানা হয়েছে৷ প্রকৃতপক্ষে এরা আত্মার বহুত্বেবিশ্বাসী অর্থাৎ পৃথিবীতে যত জীবিত প্রাণী রয়েছে আত্মার সংখ্যাও ততই৷ শুধু জীবিত প্রাণীর মধ্যেই আত্মা যে রয়েছে তা নয়, গাছপালারও আত্মা রয়েছে, এমনকি প্রতিটি ধূলিকণারও৷ এ-সকল আত্মার মধ্যে চেতনা কিন্তু সমভাবে পরিস্ফুট নয়; প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে স্তরভেদ৷ মানুষের চেতনা পঞ্চেন্দ্রিয়গত অর্থাৎ তার চেতনার দ্বার পাঁচটি-চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক৷ অন্যান্য ক্ষেত্রে কারও চারটি, কারও তিনটি, কারও দুটি ইত্যাদি৷

এই চিন্তাধারার সূত্র রয়েছে উপনিষদেরই পাতায়৷ কঠোপনিষদ বলেছে, হীনপ্রকৃতি নীচাশয় মানুষ পরজন্মে নীচযোনি প্রাপ্ত হয়৷ তারা বৃক্ষলতা, পাথর প্রভৃতি হয়ে জন্মায়৷ মৃতব্যক্তি তার নিজ কর্মফলেই এ-সব তির্যকযোনি পায়৷

কাজেই মানুষ, ইতরপ্রাণী, বৃক্ষলতা, পাথর, ধূলিকণা সমস্ত-কিছুর মধ্যেই আত্মা বর্তমান; অবশ্য সে-সব আত্মার চেতনার স্তরভেদ রয়েছে৷

কিন্তু প্রত্যেকটি আত্মার মধ্যে তার উন্নততর হওয়ার শক্তি বর্তমান, সে-শক্তি যতই ক্ষীণ হোক৷ চেষ্টা করলে সবাই ক্রমে ক্রমে উচ্চতর চেতনা লাভ করতে পারে৷ এই ধারণা বা চিন্তারও সূত্র রয়েছে উপনিষদের পাতায়৷ বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলে, মানুষ প্রতিটি জন্মেই নিজেকে উন্নততর করার চেষ্টা করছে; সে-চেষ্টা অবশ্য সবক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হয় না৷

এ-চিন্তাধারার প্রতিধ্বনি রয়েছে জৈনপন্থার মধ্যে৷ তাই, ইতর প্রাণী, এমনকি কীট-পতঙ্গের প্রতি করুণাও এতে স্থান পেয়েছে৷ আর শুধু স্থানই পায়নি, এ-পন্থার প্রধান অঙ্গ হয়ে জুড়ে বসেছে৷ এর ফলেই জন্মেছে এ-পন্থার পরমত-সহিষ্ণুতা; তারও স্থান এ-ধর্মে অতি উচ্চে৷

দর্শনের দিক থেকে জৈনরা বাস্তববাদী; তবে, চার্বাকদের মতো শুধু প্রত্যক্ষের মধ্য দিয়েই যে জ্ঞান আহরণ করা যায়, এ-বিশ্বাস এদের নেই; অনুমান ও সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়েও যে বহু বিষয় জ্ঞানগম্য হয়, এ-কথা এরা মানে৷ এ-সাক্ষ্যপ্রমাণ অবশ্য বেদের নয়; সে-সবই তাদের সিদ্ধপুরুষ বা তীর্থংকরদের৷ এই তীর্থংকরেরাই এদের দেবতার স্থান অধিকার করেছে৷

৩৷ বৌদ্ধ

বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্ব চারটি পরম সত্য৷ বুদ্ধ এই সত্য কয়টিই প্রচার করেছিলেন৷ এদের সব-কয়টিই উপনিষদের প্রতিধ্বনি মাত্র৷ দেখা যাক এদের মর্মার্থ কী৷

 ক. পৃথিবীতে দুঃখভোগ অবশ্যম্ভাবী; দুঃখের রকমফের রয়েছে৷

 খ. দুঃখের কারণও রয়েছে; সেগুলি কী কী?

জন্ম না হলে, দুঃখও থাকে না; কিন্তু ইহলোকের নানা বিষয়-ভোগের কামনা থেকেই মানুষ জন্মলাভ করে৷ এ-কামনার মূল কোথায়? মূল মানুষের অজ্ঞানতায়৷ একমাত্র জ্ঞান আহরণ করেই এ-অজ্ঞানতা দূর করা যায়৷

 গ. দুঃখের কারণকে দূর করতে পারলেই দুঃখের নিবৃত্তি হবে৷

ঘ. পুনর্জন্ম নিরোধ করার জন্য মানুষকে আটটি সোপান অতিক্রম করতে হবে৷ এই পথে যাত্রা করলে দুঃখের
 আত্যন্তিক নিবৃত্তি অনিবার্য৷

এবার এই পরম সত্যচতুষ্টয়ের চিন্তাধারার সঙ্গে উপনিষদের বাণী মিলিয়ে দেখা যায়৷

বৃহদারণ্যক বলে (পৃঃ ৭৬), এ-বিশ্বজগতে মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষার অন্ত নেই৷ এ-সব আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করেই হয় তার চিন্তাধারার সৃষ্টি, আর এ-চিন্তাধারাই তার কর্মের প্রেরণা জোগায়৷ তার পুনর্জন্মের একমাত্র নিয়ন্তাই তার কর্ম, যার মূলগত প্রেরণা তার নিজেরই আকাঙ্ক্ষা; অর্থাৎ, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার নিজের আকাঙ্ক্ষাই তার পুনর্জন্মের কারণ৷

বৌদ্ধধর্মে বিশ্বজগতের যাবতীয় ব্যাপারকেই কার্যকারণসম্ভূত বলে মানা হয়েছে, আর মানা হয়েছে যে, সমস্ত বস্তুই প্রতিক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে৷ কাজেই, বৌদ্ধরা কোনো নিত্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করে না; ফলে, আত্মা বা পরমাত্মার শাশ্বত সত্তার আলোচনার সম্পর্কে তারা উদাসীন৷

এবার উপনিষদ-ভিত্তিক দর্শনশাস্ত্র কয়টির, অর্থাৎ ষড়্দর্শনগুচ্ছের কিছু পরিচয় দেওয়া যাক৷ আলোচনায় দেখা যাবে যে অনেক মূল বিষয়ে এদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই৷ এই মূলগত বিভেদ-সত্ত্বেও তারা একই কুলজাত, একই মূলোদ্ভব বলে বলা হয় কেন? এর কারণ, উপনিষদের চিন্তাসূত্রগুলি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন-এতে কোনো সুবিন্যস্ত ও বিস্তৃত পন্থার চিত্র নেই৷ এর সূত্রগুলি নিয়ে তর্কবিতর্ক করা চলে, ব্যাখ্যারও ইতর-বিশেষ করা সম্ভবপর৷ তারপর, বেদ-মাননার সূত্রে যে তাদের মধ্যে একটা বাঁধাবাঁধি নিয়ম বা সীমাবদ্ধ চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে তা নয়৷ বরং বেদের বহুবিস্তৃত চিন্তাজগতের মধ্যে পরবর্তী যুগের মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷

ষড়্দর্শনের উদ্ভদের কারণ দুটি বলে মনে হয়৷ এর একটি, যে-চিন্তার বিদ্রোহ পূর্ববর্তী তিনটি পন্থার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে তার প্রতিরোধ৷ দ্বিতীয়টি, অন্ধবিশ্বাসের রাজ্য থেকে যুক্তির দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ৷ এ-কয়টি দর্শন-পন্থা সমৃদ্ধও হয়েছে দুটি কারণে৷ এক, একটির অন্যগুলির সম্পর্কে তীব্র সমালোচনা; দুই, একই পন্থার পথিকদের মধ্যে ঘোরতর তর্কবিতর্ক৷ তারপর, তথাকথিত নাস্তিকপন্থীদের কঠোর সমালোচনা ও বিরুদ্ধ-মন্তব্য তো রয়েছেই৷

এ-ছয়টি দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে কিছু কিছু মূলগত সাদৃশ্যকে উপলক্ষ্য করে তাদের জোড়া-মেলানো হয়েছে; ছয়টি হয়েছে তিনজোড়া৷ এরা যথাক্রমে ন্যায়-বৈশেষিক, সাংখ্য-যোগ ও পূর্বমীমাংসা-উত্তরমীমাংসা (বা বেদান্ত)৷ এদের উদ্ভবকাল নিতান্তই অনুমানসাপেক্ষ; কাজেই কোনটি আগে, কোনটি পরে বলা প্রায় অসম্ভব৷ পণ্ডিতেরা সাধারণত যে কালক্রম মেনে চলেন, আমরা তারই অনুসরণ করছি৷

ক ন্যায়-বৈশেষিক

ন্যায় : ন্যায়ের মূলতত্ত্ব অভ্রান্ত ও যথাযথ চিন্তাসূত্রে শাশ্বত সত্তার অনুভূতি৷ পরিশেষে জীবাত্মার মুক্তিই অবশ্য এর লক্ষ্য; সে-মুক্তির অর্থ-সর্বপ্রকার দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা ও বেদনার পরিসমাপ্তি৷

ন্যায়দর্শন শাস্ত্রের চারটি ভাগ : ক জ্ঞানের সিদ্ধান্ত অর্থাৎ জ্ঞান কী করে লাভ করা যায়; খ বিশ্বজগৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত অর্থাৎ দৃশ্যমান বিশ্বজগৎ ও তার অন্তরালে যে-বিশ্বপ্রকৃতি বর্তমান, তাদের সম্পর্ক; গ জীবাত্মা ও তার মুক্তি; এবং ঘ পরমাত্মা বা ঈশ্বর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত৷

ন্যায়ের দুটি শাখা৷ প্রাচীন ন্যায় ও নব্যন্যায়৷ প্রাচীন ন্যায়ের ভিত্তি গৌতমের “ন্যায়সূত্র’, আর নব্যন্যায়ের ভিত্তি গঙ্গেশের “তত্ত্বচিন্তামণি’৷ গঙ্গেশের বাড়ি মিথিলায়, উত্তর-বিহারে; নব্যন্যায় তাই প্রথমে উৎকর্ষলাভ করেছে মিথিলায়৷ কিন্তু কালক্রমে এ-শাখাটি বাংলার নবদ্বীপে শুধু পল্লবিত হয়েই ওঠেনি, মূলকে অতিক্রম করে গিয়েছে নানাপ্রকারে৷ নবদ্বীপ তথা বাংলা তাই হয়ে উঠেছিল নব্যন্যায়ের পরম আশ্রয়৷ বিশ্লেষণাত্মক যুক্তিবাদের দিক থেকে নব্যন্যায়ের তুলনা মেলা ভার; এর তর্ক-বিতর্কের সূক্ষ্ম গলিঘুঁজি নিতান্তই দুর্গম; অনেক ক্ষেত্রে বিদ্বজ্জনের চোখেও ধাঁধা লাগায়৷ এর ফলে তর্ক-বিতর্কই এর প্রাণবস্তু হয়ে পড়েছে, শাস্ত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য অনেক দূরে সরে গিয়েছে৷

ব্রহ্ম বা ঈশ্বর সম্পর্কে ন্যায়ের সিদ্ধান্তের মূল রয়েছে বৃহদারণ্যক ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের পাতায়৷

ন্যায়ের চিন্তাসূত্র বাস্তবধর্মী ও পরম বিশ্লেষণাত্মক৷ সাধারণত প্রাচ্য দর্শনশাস্ত্রকে পাশ্চাত্যের দার্শনিকেরা পরম পরমত-অসহিষ্ণু ও স্বমতে অন্ধনৈষ্ঠিক বলে দুর্নাম দিয়েছেন৷ এই অপকলঙ্কের মূর্ত প্রতিবাদ ন্যায়শাস্ত্র৷

বৈশেষিক : অনেকের মতে, বৈশেষিক দর্শনের রচয়িতা কণাদ বুদ্ধেরও পূর্ববর্তী, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পূর্বে জন্মেছিলেন৷ সে যাই হোক-বৈশেষিক দর্শন যে অতি প্রাচীন সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ সাংখ্য প্রাচীনতম, তারপরেই বৈশেষিক৷ বৈশেষিকেরও মূল লক্ষ্য জীবাত্মার মুক্তি অর্থাৎ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি; এবং এ-শাস্ত্রের নির্দিষ্ট পন্থাও ন্যায়েরই মতো৷

বৈশেষিকের যা বিশেষত্ব তা এর পরমাণুবাদ৷ অবশ্য পরমাণুর উল্লেখ রয়েছে উপনিষদের পাতায়, কিন্তু কণাদই প্রথম এটিকে ব্যাবহারিক কাজে লাগিয়েছেন৷ কণাদের পরমাণুবাদই বিশ্বজগতের প্রথম মানুষ-প্রজাতির মানসলোকে বাস্তববাদী দর্শন৷ পরবর্তীকালে গ্রিসের লুকিপ্পাস, এম্পেডোকল্স, এনাক্সাগোরাস ও ডেমোক্রিটাস এই পরমাণুবাদকে অনুসরণ করে যাঁর যাঁর স্বমত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন৷ এঁদের মধ্যে এম্পেডোকল্সই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন৷ এঁর জন্ম হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে৷ কথিত আছে, পিথাগোরাসের মতো ডেমোক্রিটাসও ভারতবর্ষে এসে তাঁর জ্ঞান আহরণ করেছিলেন৷ কিন্তু গ্রিক পরমাণুবাদের সঙ্গে কণাদের পরমাণুবাদের পার্থক্য অনেক৷ কণাদের মতে ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরমাণুর সংযোগে বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়, এবং তাঁর ইচ্ছানুসারেই পরমাণুর বিভাগে বিশ্বজগতের বিলুপ্তি ঘটে৷ গ্রিকেরা মনে করতেন, পরমাণুর সংযোগ ও বিভাগ সম্পূর্ণ আকস্মিক; ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে নয়৷

কণাদের প্রাচীন পরমাণুবাদের সঙ্গে এখন থেকে মাত্র আড়াইশো বছর আগে রচিত ডালটন-নিউটনের পরমাণুবাদের কিছু কিছু সাদৃশ্য রয়েছে৷ আধুনিক পরমাণুবাদে অবশ্য এর কোনোটিরই স্থান নেই৷

মূলনীতিবাদ ও ব্যাবহারিক দিক থেকে ন্যায়ের ও বৈশেষিকের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে; তাই এদের জোড়া মিলিয়ে বলা হয়, ন্যায়-বৈশেষিক৷

খ সাংখ্য-যোগ

সাংখ্য : মনে হয়, সাংখ্যই ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে প্রাচীনতম৷ এর রচয়িতা কপিলও বিশ্বের শাশ্বত সত্তার জ্ঞান-আহরণের পথই নির্দেশ করেছেন৷ মুক্তির আদর্শ এখানেও মানুষের আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি এবং সে-দুঃখ তিন প্রকারের৷ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে যে তিন রকমের দুঃখের কথা বলা হয়েছে, এ-তিনটিও তারই প্রতিধ্বনি৷

ন্যায়-বৈশেষিকের মতে বিশ্বের মূলপদার্থ বহু; যেমন, পরমাণু, আত্মা, মন ইত্যাদি৷ কিন্তু সাংখ্যের মতে, মূলপদার্থ মাত্র দুটি-পুরুষ ও প্রকৃতি অর্থাৎ চেতনা ও জড়৷

আত্মা অমর, নিত্য ও স্বাধীন৷ আত্মা সম্পর্কে এই প্রকৃত জ্ঞানটি স্পষ্ট অধিগত হলে মানুষের সর্বপ্রকার দুঃখের অবসান ঘটে৷ সাংখ্যের লক্ষ্য এই পরম জ্ঞান আহরণ৷ এই জ্ঞান আহরণের জন্য কোনো ঈশ্বর-কল্পনার প্রয়োজন নেই, আর কপিলও মনে করেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভবপর নয়৷ এ-বিষয় নিয়ে অবশ্য বাদানুবাদের অন্ত নেই৷

ভারতীয় বহু প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে সাংখ্যের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় এর প্রভাব সুস্পষ্ট৷ গ্রিক বা রোমান দার্শনিক প্লটিনাসের “নিও-প্ল্যাটোনিজম!’ মতবাদের মধ্যে যে-সাংখ্যযোগের ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে বলে কথিত হয়, তা নিতান্ত অমূলক নয়৷ প্লটিনাস খ্রিস্টপরবর্তী তৃতীয় শতকের মানুষ৷ তাঁর শিষ্য পারফিরি (২৩২-৩০৪ খ্রিস্টাব্দ) যা প্রচার করেছিলেন তা নিতান্তই ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র-ঘেঁষা৷

যোগ : যোগকে অনেকেই একটা নিগূঢ় জ্ঞান বা “মিস্টিক’বাদ বলে মনে করেন৷ কিন্তু আদপে তা নয়৷ যোগও দর্শনশাস্ত্র; সাংখ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ৷ প্রকৃতপক্ষে সাংখ্যবাদের এটি ব্যাবহারিক দিক৷ তারপর, ভারতীয় প্রতিটি দর্শনশাস্ত্রই এর মূল্য স্বীকার করে৷ এর অন্তর্দৃষ্টি বা মনোবিদ্যা, এর আত্মশুদ্ধির অষ্টাঙ্গ সাধনা এই দর্শনশাস্ত্রের পরম বৈশিষ্ট্য৷ যোগদর্শন বলে যে, বিশ্বের পরমসত্তার স্পষ্ট অনুভূতির জন্য শুদ্ধ হৃদয় ও শান্ত মনের প্রয়োজন; এ-প্রয়োজনের কথা সর্ব দর্শনশাস্ত্রই মানে৷ যোগের এ-মূলতত্ত্ব আহৃত হয়েছে বিশেষ করে কঠ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে৷

যোগদর্শনের চারটি শাখা৷ এরা যথাক্রমে সমাধিপদ, সাধনাপদ, বিভূতিপদ ও কৈবল্যপদ৷ প্রথমটিতে রয়েছে যোগের প্রকৃতি, লক্ষ্য ও নানা প্রকারভেদের কথা; দ্বিতীয়টিতে রয়েছে সমাধিলাভের উপায়৷ তৃতীয়টিতে রয়েছে যোগীর অলৌকিক শক্তি বা বিভূতিলাভের কথা, আর চতুর্থটিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে মুক্তির প্রকৃতি ও প্রকারভেদের কথা৷

বিশ্লেষণাত্মক পথ ধরে যোগ “বিবেকজ্ঞান’-লাভের নিশ্চিত পন্থার নির্দেশ দিয়েছে৷ এই “বিবেকজ্ঞান’ই সাংখ্যের মতে মুক্তির সোপান৷ ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি যোগসূত্রের একটি প্রধান সূত্র; তাই এ-দর্শনশাস্ত্রটিকে “সেশ্বর সাংখ্য’ অর্থাৎ ঈশ্বরযুক্ত সাংখ্যও বলা হয়৷

গ পূর্বমীমাংসা-উত্তরমীমাংসা (বেদান্ত)

পূর্বমীমাংসা : চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধপন্থার সোজাসুজি প্রতিবাদের চেষ্টা থেকে এ-দর্শনশাস্ত্রটির উদ্ভব হয়েছে৷ পূর্বমীমাংসার মূলগত তথ্যের মধ্যে রয়েছে মৃত্যুর পরেও আত্মার অস্তিত্বের কাহিনি, বেদানুমোদিত আচার-বিচার প্রতিপালনের ফলে পরলোকে সুফল-লাভের কথা, আর অপরিহার্য কর্মফলের ব্যাখ্যা৷ এ-দর্শনশাস্ত্রটি বস্তুতন্ত্রবাদী; এর মতে, বিশ্বজগৎ পরম সত্য, মায়ার খেলা নয়৷ এটির সৃষ্টিও হয়নি, কাজেই এর ধ্বংসও নেই৷ কর্মচক্রই একে চালনা করছে৷

পূর্বমীমাংসার উদ্ভব যে বেদের ক্রিয়াকাণ্ডের প্রতি অতিমাত্রায় বিশ্বাসী মনেই ঘটেছে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু এতে দেবতাদের যে-প্রতিমূর্তি গড়া হয়েছে তাতে বেদোক্ত দেবতাদের প্রতিচ্ছায়া নেই-আছে পৌরাণিক দেবতাদের সাদৃশ্য৷

পূর্বমীমাংসার উদ্ভব বেদের প্রথম ভাগ থেকে, কিন্তু উত্তরমীমাংসার জন্ম হয়েছে দ্বিতীয় ভাগ থেকে৷ দৃষ্টিভঙ্গি এদের বিভিন্ন, তবে একই মূলোদ্ভব দুটি কাণ্ড থেকে জন্মেছে বলে এ-দুটির জোড়া মিলিয়ে দেওয়া হয়৷

উত্তরমীমাংসা বা বেদান্ত : বাদরায়ণের বেদান্তসূত্র বা ব্রহ্মসূত্র থেকে এর উদ্ভব ঘটেছে, মনে হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা তৃতীয় শতকে৷ বেদান্ত ভারতীয় ধর্ম ও চিন্তার ক্ষেত্রে এনেছে প্রবল প্রাণশক্তি৷

বেদান্তসূত্রের ব্যাখ্যাতাদের মধ্যে শংকর ও রামানুজ অগ্রণী৷ এঁরা দুজনেই দক্ষিণ ভারতের মানুষ৷ শংকরের অদ্বৈতবাদ ভারতীয় চিন্তাধারার মধ্যে অবিস্মরণীয় দান৷ এর তুলনা নেই৷ বৈদগ্ধ্য, শৌর্য ও গভীরতায় এর জুড়ি মেলে না, ভারতীয় কোনো দর্শনশাস্ত্রে তো নয়ই৷

বেদান্ত শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সমাদৃত হয়েছে৷ বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার যে-সব ব্রিটিশ ছাত্র ভারতীয় সিভিল সার্ভিস নিয়ে এ-দেশে আসতেন তাঁদের ভারতবর্ষীয় ধর্ম, সাহিত্য ইত্যাদির সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন৷ তিনি বলতেন, ”বেদান্তের যে শক্তিশিখা প্রত্যেকটি ভারতীয় হিন্দুর মন তার অতি অল্প বয়স থেকেই উজ্জীবিত করে রাখে তা কখনো নির্বাপিত হবে না৷ এ-শক্তি ওতপ্রোত রয়েছে সর্বপ্রকার প্রার্থনায়, এমনকি মূর্তিপূজার প্রার্থনায়ও; আর, দার্শনিক তত্ত্বে তো বটেই, এমনকি ভিক্ষুকদের বাচনেও৷ বেদান্তের শক্তি ভারতের শুধু নৈতিক শক্তি নয়, রাজনৈতিকও৷ সত্য কথা বলতে কি, বেদান্ত সম্পর্কে আমার দাবি আরও বেশি৷ আমি শুধু ভারতীয় সিভিল সার্ভিস গ্রহণেচ্ছুদেরই বেদান্ত পড়তে বলি না, দর্শনের ছাত্রমাত্রেরই তা পড়া প্রয়োজন৷ বেদান্ত জীবনসম্পর্কে একটা নূতন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেবে-যে-ভঙ্গি এ-পর্যন্ত দর্শনশাস্ত্রে যা-কিছু লেখা হয়েছে তার মধ্যে নেই৷’’

শংকরের অদ্বৈতবাদ অবিমিশ্র একেশ্বরবাদ৷ তাঁর মতে, বিশ্বজগতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্যবস্তু; অন্য সব-কিছু মিথ্যা৷ এ-অদ্বৈতবাদের পরিকল্পনায় তিনি প্রায় সব-কয়টি প্রামাণিক উপনিষদ থেকে সাহায্য পেয়েছেন৷ শাস্ত্রবাক্য ছাড়া প্রমাণ হিসাবে তিনি প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে মেনেছেন, আর বিশেষ করে মেনেছেন “অনুভব’কে অর্থাৎ অধ্যাত্মচেতনার অনুভূতিকে৷ দার্শনিক মতে এ-অনুভব তত্ত্ববিদ্যা বা Ontologyর বিষয়ভুক্ত৷

কিন্তু সত্যি যদি ব্রহ্মই একমাত্র সত্যবস্তু হয়ে থাকে, তবে বাস্তবে আমরা চারিদিকে যা দেখি সেগুলি কী? কি করেই বা সে-সব উদ্ভূত হয়? শংকর বলেন, এ-ছায়াবাজি-মায়ার খেলা; স্বয়ং ব্রহ্ম এ-ম্যাজিক বা জাদুবিদ্যা দেখাচ্ছেন৷

শংকর “মায়া’ ও “অবিদ্যা’ বলে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন৷ সাধারণত আমরা শব্দ-দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করি৷ কিন্তু এরা সমার্থ নয়, যদিও দুই-ই অজ্ঞানের বিভিন্ন মূর্তি৷ সমষ্টিগত অজ্ঞান, অর্থাৎ যে-ইন্দ্রজ্ঞালে বিশ্বজগতের একটা পরিপূর্ণ সত্তা আমরা উপলব্ধি করি, তা মায়া৷ ব্যষ্টিগত বা পৃথক পৃথকভাবে যা দেখা যায়, তা অবিদ্যার খেলা৷ সাম্প্রতিক কালে এ-প্রভেদটুকুর সূক্ষ্মবিচারে কিছু কিছু তর্ক-বিতর্ক উঠেছে৷

উপনিষদের যে যে মন্ত্র উদ্ধৃত করে শংকর তাঁর অদ্বৈতবাদ রচনা করেছেন, তার মধ্যে ব্রহ্মের নির্গুণ ও সগুণ, এই দ্বিবিধ রূপেরই কল্পনা রয়েছে৷ তাই উপনিষদের ব্যাখ্যাতা হিসাবে শংকরের পক্ষে এ-দুটি রূপের সামঞ্জস্যবিধানেরও প্রয়োজন পড়েছে৷ এ-সামঞ্জস্য ঘটেছে ব্রহ্মের স্বরূপলক্ষণ ও তটস্থ-লক্ষণের কল্পনায়৷

ব্রহ্মসূত্রের অন্যতম প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাতা রামানুজও তাঁর বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন ওই একই মূল থেকে৷ এঁদের বাদানুবাদের মূলতত্ত্বটুকু যথাস্থানে বলা হয়েছে৷

আমাদের কথা প্রায় শেষ হয়ে এল৷ শেষ করার আগে আরও একটি কথা বলা যাক৷ বেদ-মাননার সূত্র ছাড়া ষড়্দর্শনের মধ্যে কি আর কোনো সংযোগসূত্র রয়েছে? তা রয়েছে, আর সে-সূত্রগুলিও মূলগত৷

সবগুলি দর্শনশাস্ত্রেই পূর্ব ও পরজন্ম মানা হয়েছে৷ কাজেই মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যায় না৷ এর সঙ্গে মোটামুটিভাবে স্বতই এসে পড়েছে কর্মবাদ৷ সর্বক্ষেত্রেই দুঃখবাদ দিয়েই জীবনদর্শন শুরু হয়েছে বটে, কিন্তু তা দিয়েই শেষ হয়নি৷ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভবপর বলে বলেছে সবাই,-এক চার্বাক ছাড়া৷ চার্বাক পুরোপুরি জড়বাদী বা দেহাত্মবাদী৷ নিছক বুদ্ধিগত কৌতূহলের মধ্যে কোনো দর্শনপন্থারই জন্ম হয়নি, জীবনের পরিপূর্ণ সত্তার মধ্যে দুঃখের স্থান ও তার আত্যন্তিক নিবৃত্তির ব্যাবহারিক পথ খোঁজাই এদের লক্ষ্য৷ নিঃস্বার্থপরতা ও সর্বজনীন প্রেম ব্রহ্মপ্রাপ্তির সোপান; এবং আত্মশুদ্ধি ছাড়া তা ঘটে না বলে সবারই অভিমত৷ সবগুলি শাস্ত্রই মায়া, অবিদ্যা, পুরুষ প্রভৃতি প্রায় একই অর্থে ব্যবহার করেছে৷ এবং সর্বশেষ কথা, ব্রহ্মস্বরূপের কল্পনায় সবগুলি দর্শনশাস্ত্রই উপনিষদকেই অনুসরণ করেছে৷

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন