প্রশ্নোপনিষদে আশ্বলায়ন তাঁর গুরু পিপ্পলাদকে প্রশ্ন করছেন, প্রাণের জন্ম হল কী করে?
পিপ্পলাদ জবাব দিলেন, প্রাণের জন্ম হয়েছে আত্মা বা ব্রহ্ম থেকে৷ আলোর সঙ্গে ছায়ার যেমন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, আত্মার সঙ্গে প্রাণেরও তেমনি৷ প্রাণ আত্মার ছায়ামাত্র৷ যখন আত্মা প্রাণীদেহ ত্যাগ করে, সঙ্গে সঙ্গে প্রাণও চলে যায়৷ প্রাণ সত্যবস্তু নয়, সত্যবস্তুর ছায়া মাত্র৷
তৈত্তিরীয় উপনিষদও এই মতেরই পোষক৷ এ-ছাড়াও এ-উপনিষদে প্রাণের জন্মকাহিনির একটি পরম্পরীণ আলেখ্য দেওয়া হয়েছে৷
”তস্মাদ্বা এতস্মাদাত্মন আকাশঃ সম্ভূতঃ৷
আকাশাদ্বায়ুঃ৷ বায়োরগ্নিঃ৷ অগ্নেরাপঃ৷ অদ্ভ্যঃ পৃথিবী৷ পৃথিব্যা ওষধয়ঃ৷ ওষধীভ্যোহন্নম৷ অন্নাৎ পুরুষঃ৷’’ (১/২৮ ব্রহ্মানন্দবল্লি)
ব্রহ্ম, বা বিশ্বজগতের একমাত্র সত্যবস্তুই সর্বাপেক্ষা সূক্ষ্ম৷ এই সূক্ষ্মতম, বা নির্গুণ বস্তু থেকে জন্ম হয়েছে আকাশের যা স্থূলতর৷ আকাশের গুণ একটি, যাকে বলা হয় শব্দ৷ আকাশ থেকে জন্মেছে বায়ু যার গুণ দুইটি : শব্দ ও স্পর্শ৷ এমন করেই জন্মেছে আমাদের পঞ্চভূতভিত্তিক পৃথিবী৷ [গুণের সংখ্যা বাড়লে যে-ক্রমে স্থূলতা বেড়ে যায় তা বলা হয়েছে মুণ্ডকোপনিষদের কথায়৷]
কিন্তু পৃথিবী প্রাণহীন, জড়৷ তার বুকে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হল উদ্ভিদের মধ্যে [তখন অন্য কোনো প্রাণীর উদ্ভব হয়নি]৷ উদ্ভিদ থেকে হল অন্ন; অন্ন থেকে ক্রমে হল মানুষ৷ অর্থাৎ স্পষ্টত এটি অভিব্যক্তিবাদ নয়, তবে তার ইঙ্গিত৷
ঐতরেয় উপনিষদেও উদ্ভিদের মধ্যেই যে প্রথম প্রাণের স্পন্দন ঘটেছে তা বলা হয়েছে৷ আর, ঘনীভূত জল থেকে জন্মেছে উদ্ভিদ যার পরিণতি অন্নে৷
এখানেও সে অভিব্যক্তিবাদেরই ইঙ্গিত৷ প্রাণ যে জলভিত্তিক সে-কথা স্পষ্ট৷ জলই প্রাণের আধার৷ অজৈব থেকে জৈব বস্তুর উদ্ভব হয়েছে জলেরই সাহায্যে৷ [হয়তো রসায়নে যাকে অনুঘটন বলা হয়, জল এক্ষেত্রে তা-ই করেছে, অর্থাৎ জল হয়েছে অনুঘটক বা catalyst৷]
প্রাচীনতম উপনিষদ ছান্দোগ্যেও জলকেই প্রাণের আশ্রয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে :
”স হোবাচ কিং মে বাসো ভবিষ্যতীত্যাপ ইতি হোচুঃ৷’’ (৩৭৪/৫)
প্রাণ [ইন্দ্রিয়গণকে] জিজ্ঞাসা করল, আমার আধার বা আচ্ছাদন কী হবে? তারা জবাব দিল, তোমার আচ্ছাদন হবে জল৷
বলা বাহুল্য, এ-সব প্রাণের জন্মকাহিনির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নয়-চিন্তার সূত্রমাত্র৷ চিন্তার সূত্রহিসাবেই এর মূল্য৷ হাজার হাজার বছর পরেও সে ব্যাখ্যা পূর্ণ হয়নি, চিন্তার এ-আদিম সূত্রও অবিচ্ছিন্ন রয়েছে৷
সবগুলি উপনিষদেই প্রাণের স্থান সর্বোচ্চ বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ প্রাণ ও দেহের অন্যান্য ইন্দ্রিয়দের বিবাদের কথা অন্যত্র উল্লেখ করাও হয়েছে৷ এ-বিবাদের মধ্যে স্বীকৃত হয়েছে প্রাণের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব৷
এবার দেখা যাক, মৃত্যু-সম্পর্কে উপনিষদগুলির ধারণা কী৷
প্রাণের উদ্ভবের পূর্বে বিশ্বজগৎ মৃত্যুদ্বারাই আচ্ছাদিত ছিল৷ তখন তার স্বরূপ ছিল কেমন? বৃহদারণ্যক বলে,
”নৈবেহ কিঞ্চনাগ্র আসীৎ মৃত্যুনৈবেদমাবৃতমাসীদশনায়য়া৷’’ (৩/১)
সৃষ্টির পূর্বে বিশ্বজগতে কিছুই ছিল না; এ-জগৎ ক্ষুধারূপ মৃত্যুদ্বারা আবৃত ছিল৷ অর্থাৎ ক্ষুধারই নামান্তর মৃত্যু৷
ঐতরেয় উপনিষদে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে দেবতার উপায়নে অর্থাৎ দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত বস্তুতে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার অংশ রয়েছে৷ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মানিকজোড়; এরা প্রাণের জন্মের প্রত্যক্ষ কারণ না হতে পারে, তবু এরা যে একাধারে প্রাণকে রক্ষা ও পরিশেষে বিনাশ করে তাতে সন্দেহ নেই৷ প্রাণ ও এ-দুটি মানিকজোড়ের মধ্যে চলে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার খেলা৷
একটা সাধারণ উপমার কথা বলা যাক৷ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা পর (পজিটিভ) ও অপর (নেগেটিভ) বিদ্যুতের মতো৷ এরা দুটি মিলে জন্মমৃত্যুর চিরন্তন প্রবাহকে অক্ষুণ্ন রাখে, যেমন রাখে বিদ্যুৎপ্রবাহকে অব্যাহত পর ও অপর মানিকজোড়৷
বৃহদারণ্যকে মৈথুন-সঞ্জাত প্রাণের জন্মকাহিনি বলা হয়েছে৷ (৪০/১)
স্রষ্টা একাকী তৃপ্তিলাভ করতে পারলেন না৷ এজন্য কোনো মানুষও একাকী তৃপ্ত থাকে না৷ স্রষ্টা তাঁর একজন দোসর কামনা করলেন; সে কামনার ফলে তাঁর মনের অবস্থা হল এমন, যেমন হয় স্ত্রী-পুরুষের সম্মিলিত আলিঙ্গনের মধ্যে৷ ফলে তাঁর দেহ হল দ্বিধাবিভক্ত; রচিত হল একটি যৌন-পূর্ণতা; একটি পুরুষ, অন্যটি স্ত্রী৷
উপনিষদে জন্মমৃত্যুর স্বরূপের কথা ছেড়ে দিয়ে এবার দেখা যাক মুমূর্ষ মানুষের আলেখ্য এবং তার মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা৷
প্রাচীনতম উপনিষদ ছান্দোগ্যে বলা হয়েছে, মৃত্যু যখন মানুষের অতি সন্নিকটে আসে তখন তার বাগিন্দ্রিয় মিলিত বা বিলীন হয় মনে; মন বিলীন হয় তার প্রাণশক্তির মধ্যে৷ প্রাণশক্তির লক্ষণ থাকে শুধু দেহের উত্তাপে৷ সে-উত্তাপ ক্রমশ ব্রহ্মে বা আত্মায় বিলীন হয়ে যায়৷ (৪৮৮/৬)
প্রশ্নোপনিষদে এরই প্রতিধ্বনি শোনা যাবে৷ এ-উত্তাপের বহিঃপ্রকাশ হয় উদান বায়ুর মধ্যে [উদান বায়ুর কথা যথাস্থানে বলা হয়েছে]৷ এই উদান বায়ুতে ভর করেই প্রাণ করে দেহত্যাগ; এটা স্পষ্ট বোঝা যায় কারণ মুমূর্ষুর রক্তের তাপ ক্রমশ কমে আসে৷
মৃত্যুকালে মানুষ প্রথমেই তার বাগিন্দ্রিয়ের শক্তি হারিয়ে ফেলে৷ কিন্তু তার মন থাকে সক্রিয়৷ অনুভব-শক্তি তার থাকে; কাজেই থাকে সুখ-দুঃখ-বোধ৷ পরে মনও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে; শুধু দেহ-কম্পনের মধ্যে তার প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়৷ তারপর নাড়ি-কম্পনও ক্রমশ শেষ হয়ে আসে, শুধু রক্তের তাপ থাকে বর্তমান৷ এ-তাপ যখন ব্রহ্মে বা আত্মায় বিলীন হয়, তখন আত্মা দেহত্যাগ করে৷
বৃহদারণ্যকে মহাপ্রয়াণের আলেখ্য আরও স্পষ্ট করা হয়েছে৷ (২৯২/৪)
মুমূর্ষু মানুষকে লক্ষ করে অন্য সকলে বলে, এর দৃষ্টিশক্তি এখন হৃদয়ে একীভূত বা বিলীন হয়েছে তাই এ আর দেখে না; এর ঘ্রাণেন্দ্রিয়, জিহ্বা, বাগিন্দ্রিয়ও একীভূত হয়েছে, কাজেই এরা আর সক্রিয় নয়৷ মনও ক্রমশ একীভূত হয়ে পড়ছে, তাই মুমূর্ষু আর চিন্তাও করতে পারছে না; বুদ্ধিও একীভূত হয় উঠেছে, কাজেই জ্ঞানও এর পরিপূর্ণ নেই৷
হৃদয়ের যে-অগ্রভাগ দিয়ে আত্মা নির্গত হয়, অর্থাৎ সে নাড়িদ্বারটি, এ-সময়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ আত্মা সেই পথে নির্গত হয়ে মুমূর্ষুর কর্মফলানুসারে যথাযোগ্য লোকে প্রয়াণ করে৷ সূর্যলোকে যেতে হলে আত্মা নির্গত হয় চক্ষু দিয়ে; ব্রহ্মলোকে যেতে হলে যায় ব্রহ্মরন্ধ্র-পথে; অন্যান্য লোকে যেতে হলে যায় শরীরের অন্যান্য অবয়বের পথে৷ আত্মার সঙ্গে সঙ্গে যায় প্রাণ, যায় অন্যান্য ইন্দ্রিয়৷ জীবাত্মার ঐহিক কর্ম ও প্রাক্তন জ্ঞানসংস্কারও তার অনুগমন করে৷
কিন্তু জীবাত্মা, অর্থাৎ যে-আত্মা মুমূর্ষুর দেহ থেকে নির্গত হয়, আর পরমাত্মা বা ব্রহ্ম এ-ক্ষেত্রে এক নয়৷ কারণ জীবাত্মা মুমূর্ষুর কৃত কর্মফলে ও নানা অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার ভারে হয়ে পড়ে দূষিত ও ক্লেদাক্ত৷
প্রকৃতপক্ষে পরলোকের পথে ওই তিনটি জিনিস জীবাত্মার অনুগমন করে৷ এক, বিশ্বজগতে আহৃত সমস্ত জ্ঞান৷ এর মধ্যে সবই থাকে; এর কিছুটা কল্যাণকর, কিছুটা অকল্যাণকর, কিছুটা কল্যাণ বা অকল্যাণ কোনোটাই করে না৷ দুই, মৃতের সমস্ত কৃতকর্ম; শুভ, অশুভ আর যা শুভাশুভ কোনোটাই নয়৷ তিন, মৃতের মরজগতের সমস্ত অভিজ্ঞতা, এর কিছুটা তার আত্মার উৎকর্ষের সহায়, কিছুটা তার পরিপন্থী, কিছুটা উৎকর্ষ বা অপকর্ষের সোপান নয়৷ মৃতের এ-তিনটি অনুগামী সহচরই পরলোকে তার গন্তব্যস্থল নিরূপিত করে দেয়; শুধু তা-ই নয়, ইহলোকে তার পরবর্তী জীবনের ধারাও নির্দিষ্ট করে দেয়৷
মৃত্যুর পরে জীবাত্মা তার স্থূলদেহ ত্যাগ করে যে সূক্ষ্মদেহ গ্রহণ করে তার নাম “অতিবাহিক’ দেহ৷ এ-দেহ গ্যাস বা বাষ্প দিয়ে গড়া; তাই, মানুষের কাছে তা অদৃশ্য৷ “অতিবাহিক’ দেহের কাজ শুধু জীবাত্মাকে তার যথাযোগ্য গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়া৷ সে কাজ শেষ হলেই সে-দেহ লুপ্ত হয়ে যায়৷ তখন জীবাত্মা তার স্বাভাবিক স্বরূপ ফিরে পায়৷
উপনিষদে তাই তিন প্রকার দেহের কল্পনা রয়েছে৷ প্রথম, স্থূলদেহ, যা আমরা মরজগতে দেখি৷ দ্বিতীয়, “অতিবাহিক’ বা বাহকদেহ৷ তৃতীয়, জীবাত্মার স্বাভাবিক সূক্ষ্মদেহ৷
অতিবাহিক দেহ দিয়ে কোনো শারীরিক বা মানসিক সুখ-দুঃখ ভোগ করা চলে না৷ কাজেই জীবাত্মাকে তার লৌকিক কামনা তৃপ্তির জন্য আবার ইহলোকের স্থূলদেহ গ্রহণ করতে হয়৷ স্থূলদেহের অংশ সতেরোটি৷ এর মধ্যে পাঁচটি প্রাণেন্দ্রিয়, পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি৷ জীবাত্মায় জীবাত্মায় যে-প্রভেদ তা এই অংশগুলিরই প্রভেদ, কারণ এ-অংশগুলি তাদের ক্রমবিকাশের পথে নানা স্তরে বর্তমান থাকে৷
মৃতের পরলোক-যাত্রার পথের কথা বিস্তৃতভাবে লেখা হয়েছে ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে৷ সঙ্গে সঙ্গে এসেছে পিতৃযান, দেবযান, দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ণের কথা৷
এখানে বৃহদারণ্যক থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক৷ যারা নিজের শুভকর্মের ফলে স্বর্গলোকে যাওয়ার অধিকারী হয়েছে, তারা মৃত্যুর পরে প্রথম যায় একটি ধূমাবৃত দেশে৷ তারপর সেখান থেকে তারা যায় আঁধার বা রাত্রির দেশে৷ তারপর দক্ষিণায়ন শুরু হলে (অর্থাৎ বছরের যে-ছয়মাস-শ্রাবণ থেকে পৌষ-সূর্যের গতি ক্রমশ দক্ষিণ দিকে সরতে থাকে)-তারা যায় পিতৃলোকে, অর্থাৎ তাদের ইহলোকের পূর্বপুরুষেরা যে যে লোকে বাস করে৷ সর্বশেষ তারা যায় চন্দ্রলোকে, সেখানে দেবতাদের সঙ্গে তারা বাস করে৷
তারপর স্বর্গলোকে বাসের মেয়াদ শেষ হলে, আবার তাদের ইহলোকে ফিরে আসতে হয়৷ ফেরার পথে তারা প্রথম আসে আকাশলোকে৷ সেখানে বায়ু তাদের বৃষ্টির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় এবং বৃষ্টির সঙ্গে এসে পড়ে তারা ইহলোকের মাটিতে৷ জল ও মাটির সংস্পর্শে তারা ক্রমে ঢুকে পড়ে শস্যের মধ্যে যে-শস্য মানুষকে করে পুষ্ট৷ সে পুষ্টির অংশ পায় সে মানুষেরই সন্তান অর্থাৎ তারই সন্তানরূপে যারা জন্মগ্রহণ করে৷ এই হল জন্মমৃত্যুচক্র৷
যাঁর ব্রহ্মলাভ বা আত্মদর্শন ঘটেনি, তাঁর এ-জন্মমৃত্যুচক্রও শেষ হবে না৷
কিন্তু যাঁর আত্মদর্শন ঘটেছে, তাঁর দেহাবসানের পরে কী হবে? আবার ওই উপনিষদেরই অনুসরণ করা যাক৷
দেহরক্ষার পরে তাঁর জীবাত্মা প্রথমে যাবে আলোকের দেশে৷ তারপর দিনের দেশে৷ তারপর উত্তরায়ণ শুরু হলে (মাঘ থেকে আষাঢ়) তিনি যান দেবলোকে৷ সেখান থেকে যাত্রা করেন সূর্যলোকে৷ সেখানে তিনি দেখা পান বিদ্যুতের মত উজ্জ্বল একটি মহাজ্যোতির৷ তারপর তিনি পৌঁছে যান ব্রহ্মলোকে-যেখান থেকে আর তাঁর কোথাও ফিরে আসতে হয় না৷ উপনিষদ বলে, “তেষাং ন পুনরাবৃত্তিঃ’ অর্থাৎ তাঁরা আর এই জন্মমৃত্যুচক্রের অধীন হন না৷
যারা দক্ষিণায়ন বা উত্তরায়ণ কোনো পথ দিয়েই পরলোকযাত্রা করতে পারে না, তারা পরবর্তী জীবনে কীটপতঙ্গ ইত্যাদি হয়ে জন্মগ্রহণ করে৷
উপনিষদে কল্পিত স্বর্গ ও নরকভোগের কাল সীমাবদ্ধ৷ চিরন্তন স্বর্গ বা চিরন্তন নরকের কথার কোথাও উল্লেখ নেই৷ দেবতাদের দেবত্ব বা স্বর্গবাসও তাই ক্ষণস্থায়ী-চিরন্তন নয়৷ তাঁদের স্বর্গবাস বা দেবত্বের কালও ইহলোকের কর্মফলের দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছে৷ বহু পরবর্তী কালে মানুষের এ-আদিম চিন্তাধারার অশেষ পরিবর্তন ঘটেছে; তাই পুরাণে, কোরানে ও বাইবেলে রচিত হয়েছে চিরন্তন স্বর্গ ও নরকের কল্পনা৷
পিতৃযান পূর্বপুরুষদের প্রদর্শিত পন্থা, দেবযান দেবতাদের বা জ্ঞানী পুরুষদের প্রচলিত পথ৷ যারা তাদের কর্মফলে নিম্নগামী হয় না, তারা সাধারণত এ-দুটি পথের একটি দিয়ে পরলোকে যাত্রা করে; অবশ্য কোন পথে যাবে তা নির্ধারিত করে দেয় তার কর্মফল৷
মৃতের পারলৌকিক মঙ্গল কামনা করে যে-কৃত্য করা হয় তার নাম শ্রাদ্ধ৷ শ্রাদ্ধ এখন নিষ্প্রাণ, লৌকিক আচারমাত্র৷ কারও কারও মতে, উপনিষদের যুগে সে-কৃত্য ছিল প্রাণবন্ত, অত্যন্ত শ্রদ্ধার বস্তু৷ তখন তত্ত্বদর্শীদের মধ্যে এমন কিছু কিছু মানুষ বর্তমান ছিলেন যাঁরা মৃতের পরলোক-যাত্রার পথটি ধ্যানালোকে স্পষ্ট দেখতে পেতেন এবং তাঁদের চিন্তাশক্তির প্রভাবে তাদের সে পথযাত্রায় সাহায্যও করতে পারতেন৷ পিতৃযান অর্থাৎ পিতৃপুরুষদের প্রচলিত পথেই জনসাধারণের গতায়াত৷ এ-পথে প্রথমে পড়ে ধূমের দেশ, পরে অন্ধকারের দেশ৷ এ-সব দেশ পার হতে হলে চাই মনে ভরসা ও বল৷ শ্রাদ্ধের লক্ষ্য ছিল তাকে সে-শক্তি দান করা৷
এ-সব তত্ত্বের অনেক সূক্ষ্ম দার্শনিক ব্যাখ্যা চলে এবং তা হয়েছেও৷ আমাদের এ-আলোচনার মধ্যে তার স্থান নেই৷
উপনিষদে তাই মানুষকে একটি চিরন্তন যাত্রী হিসাবেই কল্পনা করা হয়েছে৷ পথচলাই এ-যাত্রীটির কাজ, অবশ্য যতক্ষণ সে তার লক্ষ্যে না-পৌঁছোয়; সে লক্ষ্য ব্রহ্মবিদ্যালাভ বা আত্মদর্শন৷ জন্মান্তরবাদ তাই এ-কল্পনার অবিচ্ছেদ্য সহচর৷
পূর্বেই বলা হয়েছে, তিনটি জিনিস মৃতের সঙ্গে সঙ্গে পরলোকে যায়৷ এক, তার ইহলোকে সংগৃহীত জ্ঞান; দুই, তার ইহলোকে কৃত কর্ম; তিন, তার অভিজ্ঞতা৷ এবং এ-সবের সম্মিলিত ফলেই তার পরলোকের গতি ও পুনর্জন্মের স্থান ও কাল নির্দিষ্ট হয়৷
এই তিনটি জিনিসের সমষ্টির নামই কর্ম৷ বিশ্বজগতে সমস্ত ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া রয়েছে; তাই কর্মেরও রয়েছে প্রতিক্রিয়া এবং তা অবশ্যম্ভাবী, একে নিরোধ করা বা এড়িয়ে চলা যায় না৷
এই যে প্রতিক্রিয়া তা থাকে একের পরে এক ধাপে ধাপে৷ প্রথম ধাপে যা থাকে তাকে বলা হয় “প্রারব্ধ’৷ প্রারব্ধ মানুষের বর্তমান জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে৷ দ্বিতীয় ধাপে থাকে “সঞ্চিত’; যা প্রারব্ধের ফলভোগ শেষ হলে শুরু হবে৷ তৃতীয় ধাপে থাকে বর্তমান জীবনের কৃতকর্ম ফল; একে বলা হয় “ক্রিয়মাণ’৷ এর ফলভোগ শুরু হবে “সঞ্চিত’ কর্মের ফলভোগ শেষ হলে৷
কাজেই জন্মমৃত্যুর এই যে কর্মচক্র তা মানুষের নিজেরই রচনা৷ যতদিন তার ব্রহ্মদর্শন বা আত্মজ্ঞান লাভ না-ঘটে, ততদিনই চলে এ-কর্মচক্র৷ এর বিরাম, বিশ্রাম নেই৷ তাই, জীবাত্মার এই যে পথযাত্রা তা অশেষ ও অনির্দিষ্টকালব্যাপী৷ উপনিষদ তাই বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে এ-কর্মফল থেকে মানুষের মুক্তি পেতে হলে আছে শুধু একটিমাত্র পথ-সে পথ ব্রহ্মবিদ্যা-লাভ৷
জন্মান্তর সম্পর্কে কঠোপনিষদে বলা হয়েছে,
”যোনিমন্যে প্রপদ্যন্তে শরীরত্বায় দেহিনঃ৷
স্থাণুমন্যেহনুসংযন্তি যথাকর্ম্ম যথাশ্রুতম্৯’’ (৯৩/৭)
যাদের ব্রহ্মবিদ্যা-লাভ ঘটেনি, তাদের মধ্যে [অপেক্ষাকৃত সুজনেরা] যোনিপথে পুনরায় মানুষ হয়ে জন্মায়৷ অধম ব্যক্তিরা স্থাণুত্ব পায় অর্থাৎ বৃক্ষ, লতা ইত্যাদি হয়ে জন্মায়৷ ইহলোকের কর্মানুযায়ীই তাদের পুনর্জন্ম ঘটে৷
কঠোপনিষদের মন্ত্র প্রাচীনতর বৃহদারণ্যকেরই প্রতিধ্বনি৷
”স যথাকামো ভবতি তৎক্রতুর্ভবতি যৎক্রতুর্ভবতি তৎ কর্ম্ম কুরুতে, যৎ কর্ম্ম কুরুতে, তদভিসম্পদ্যতে৷’’ (২৯৫/৪)
বিশ্বজগতে মানুষের আকাঙ্ক্ষার অন্ত নেই৷ তাদের চিন্তাধারা সেই আকাঙ্ক্ষার বাহনমাত্রা; তাদের কর্ম সে-চিন্তাধারারই ফল৷ কাজেই তাদের নানারূপ জন্মান্তর ঘটে নিজেদেরই কর্মফলে৷ চরম বিশ্লেষণে সে-কর্মফল তাদের কামনা-বাসনার প্রতিমূর্তি বলে নির্ধারিত করা ছাড়া উপায় নেই৷
অর্থাৎ, অন্যভাবে বলতে গেলে, মানুষের মধ্যে তার নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই রচনা করার ক্ষমতা রয়েছে৷ তাকে ভাগ্যের দাস বলা চলে না৷ এটা সত্য বটে সে তার পূর্বকৃত কর্মফলের দাস, তাকে এড়িয়ে যাবার ক্ষমতা তার নেই; কিন্তু, সুদূর হলেও, তার ভবিষ্যৎ রচনা করার ক্ষমতা তার নিজের হাতেই রয়েছে৷ প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও সংকল্পের শক্তিতে সে তার জীবনের গতির মোড় ফেরাতে পারে৷ এই চিরন্তন পথ-যাত্রার সমাপ্তি ঘটাবার শক্তি তারই করায়ত্ত৷ কোন পথে চললে তা সহজসাধ্য হবে তা অবশ্য অন্য কথা৷
সকল উপনিষদেই বলা হয়েছে যে জীবাত্মা পরমাত্মার অংশবিশেষ; এদের মধ্যে মূলত কোনো প্রভেদ নেই৷ শুধু জীবাত্মা মানুষের কর্মফলে মলিন হয়ে পড়ে৷ জীবাত্মা যে শুধু বর্তমান জীবনেই তার ভবিষ্যৎ দেহ ও প্রতিবেশ রচনার ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে তা নয়, ভবিষ্যৎ জীবনেও তার সে ক্ষমতা অব্যাহত থাকবে৷ ফলত, যে প্রতিবেশ ও দেহ গ্রহণ করলে সে তার অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে তা-ই সে গ্রহণ করে৷ কাজেই যদি তার আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি ঘটে অথবা তার মধ্যে আত্মরতি জন্মে, তবে আর তার কোনো দেহের প্রয়োজন ঘটবে না; তাই আর জন্মগ্রহণও করতে হবে না৷
তখন জীবাত্মার কী হবে? জীবাত্মার হবে আত্মদর্শন অর্থাৎ সে উপলব্ধি করবে যে নিজেই পরমাত্মা বা “অহং ব্রহ্মাস্মি’; সঙ্গে সঙ্গে তার এই চিরন্তন পথযাত্রারও শেষ হবে৷
বৃহদারণ্যক বলেছে, জীবাত্মা সদাসর্বদা উচ্চতর সোপানে ওঠবার চেষ্টা করছে; প্রতিটি জন্মে নিজেকে উন্নততর করার চেষ্টা সে করে৷ সব জন্মেই যে তা সম্ভবপর হয় তা নয়, তার চেষ্টাও হয়তো সকল সময় ফলপ্রসূ হয় না; তবু চেষ্টা যে তার চিরন্তন তাতে সন্দেহ নেই৷ প্রতিটি জন্মেই সে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত করছে, তার পরজন্মের স্বরূপও নির্ধারিত করছে৷ অবশ্য সব সময়ে যে সজ্ঞানে সে তা করে তা নয়, অজ্ঞানতও সে তা করে চলছে৷ অন্য কোনো শক্তি, অর্থাৎ মানুষের তথাকথিত ভাগ্য, কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করে না; সে নিজেই তার নিজের স্রষ্টা, রক্ষক ও বিনাশকারী৷
এই যে জীবাত্মার নিজের উন্নতির জন্য অবিরত প্রচেষ্টা, এর সঙ্গে স্বর্ণকারের কাজের উপমা দেওয়া হয়েছে বৃহদারণ্যক উপনিষদে৷ (২৯৪/৪) এ-মন্ত্রটিতে বলা হয়েছে যে পেশস্কারী অর্থাৎ স্বর্ণকার যেমন পুরোনো সোনা দিয়ে নূতন নূতন অলংকারের মধ্যে নবতর রূপের সৃষ্টি করে, তেমনি জীবাত্মাও জন্মান্তরে বা দেহান্তরে নবতর রূপের সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়৷ এ-চিরন্তন যাত্রার শেষ না-হলে এ-প্রয়াসেরও শেষ হয় না৷
মানুষের মধ্যেই যে স্বভাবত এ-শক্তি রয়েছে, সে যে একটা বিরাট শক্তির আকর, মূলত যে সে তার নিজের ও সর্বপ্রতিবেশের স্রষ্টা, সে যে সবার উপরে চরম সত্য-এ-কথা তারস্বরে প্রচার করেছে উপনিষদ৷ তারপর সর্বজগতে উপনিষদের এ-মহামন্ত্রটিই নানা জ্ঞানী গুণী প্রচার করেছেন; মানুষের আদিম চিন্তাধারার সে-সূত্রটি নব নব রূপে মানুষের চোখে প্রতিভাত হয়েছে, তার মর্মে প্রবেশ করেছে৷ সে আদিম চিন্তাধারার সূত্রটি আজও ছিন্ন হয়নি৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন