চার – ব্রহ্ম ও ব্রহ্মবিদ্যা

উপনিষদে ব্রহ্মের কল্পনা অপূর্ব, অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ৷ এ-উপলব্ধি বুদ্ধিগম্য নয়; বিশ্বজগতের চরম সত্তা ও পরম সত্য মেধাভিত্তিক বিচারবুদ্ধির দর্পণে কখনও ধরা যাবে না৷

উপনিষদের ব্রহ্ম ও আত্মা অভিন্ন৷ উপলব্ধির কথা ছেড়ে দিয়ে, ধ্যানযোগীরা ব্রহ্মকে ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে যা বলেছেন, আমরা সে কথাই বলব৷

ব্রহ্ম বিশ্বাত্মা৷ তিনি সর্বব্যাপী, শাশ্বত সত্তা, যা বিশ্বজগতের সর্বত্র ওতপ্রোত রয়েছেন৷ তিনি স্বয়ম্ভূ বা নিজে নিজেই জন্মেছেন৷ তাঁর অস্তিত্বও কোনো-কিছুর উপরই নির্ভর করে না; না-কালের, না-স্থানের৷ সে অস্তিত্বের কোনো কারণও নেই৷ তিনি পরম সত্য৷

তাঁর সত্তার দুটি দিক৷ সবগুলি উপনিষদেই তার ব্যাখ্যা রয়েছে৷ এর একটিকে বলা হয় তাঁর স্বরূপ লক্ষণ, অর্থাৎ বিমূর্ত রূপ; অন্যটি তাঁর তটস্থ লক্ষণ বা মূর্ত রূপ৷ বিমূর্তরূপে তিনি শুধু ধ্যানগম্য, মূর্তরূপে তিনি ইন্দ্রিয়বোধ্য৷

কোথাও জীবাত্মা ও বিশ্বাত্মাকে অভিন্ন বলা হয়েছে, কোথাও-বা বলা হয়েছে জীবাত্মা বিশ্বাত্মার অংশ৷ মূলত বিশ্বাত্মা ও সমস্ত জীবাত্মা একই; উপনিষদে বারবার এ-কথা উচ্চারিত হয়েছে৷ সকল জীবাত্মাই যখন মূলত অভিন্ন, তবে দৃশ্যত তাদের মধ্যে এত প্রভেদের কারণ কী? শুচিতায় ও পবিত্রতায় তো তাদের মধ্যে অনেকক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল প্রভেদ৷

এর কারণ জন্মান্তরবাদের মধ্যে নিহিত৷ প্রতিটি জন্মে তাদের কর্মের বিভিন্নতাই এর মূলগত কারণ৷ গন্তব্যস্থল সব জীবাত্মারই এক; পথযাত্রা যখন প্রথম শুরু করেছিল তখন তাদের শুচি-শুভ্রতার তারতম্যও ছিল না, কিন্তু নিজ নিজ কর্মে তারা বিভিন্ন হয়েছে৷ কর্মের দ্বারা কেউ হয়েছে উঁচু, কেউ হয়েছে নীচু৷

ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণের কথা নানাভাবে বলা হয়েছে৷ যেমন, “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম’ অথবা ব্রহ্ম সত্য ও অন্তহীন জ্ঞান৷ অথবা, ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ অর্থাৎ ব্রহ্ম অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দময়৷

কোথাও বলা হয়েছে, “রসো বৈ সঃ’ অর্থাৎ ব্রহ্ম আনন্দরস৷

তটস্থ লক্ষণে ব্রহ্মের মূর্তরূপ অর্থাৎ যে-রূপে তিনি বুদ্ধি বা ইন্দ্রিয়গম্য৷ সেখানে তাই তাঁর কর্মজগতের রূপ৷ সে-রূপে তিনি বিশ্বস্রষ্টা, বিশ্বপালক এবং বিশ্বনাশক৷ এ-সকল রূপ-ব্যাখ্যার পটভূমিকায় ব্রহ্মের অপূর্ব কল্পনাটি স্পষ্টতর হয়েছে; ব্রহ্মের মধ্যেই বিশ্বজগতের উদ্ভব হয়েছে, তাঁর মধ্যেই এর বিলয় ঘটবে৷

কিন্তু কোনো কোনো উপনিষদ, যেমন কঠ, ব্রহ্মকে বিশ্বজগতের বাইরে ঠেলে দিয়েছে৷ যে-উপনিষদগুচ্ছ এ-মতাবলম্বী, তাদের বলা হয় “ব্যতিরেকী’৷ বেশির ভাগ উপনিষদই, যেমন মুণ্ডক, ঈশ ইত্যাদি, বিশ্বজগৎ ও ব্রহ্মকে একীভূত করেছে৷ এদের বলা হয় “অন্বয়ী’৷

“আত্মা’ শব্দটি ব্যুৎপন্ন হয়েছে “অদ্’ ধাতু থেকে৷ “অদ্’ ধাতুর মূলগত অর্থ সর্বদা সঞ্চরমান অথবা যার সত্তা সর্বব্যাপী৷ “আত্মা’ ও “ব্রহ্ম’কে উপনিষদে এক করে দেখা হয়েছে; অর্থাৎ ব্রহ্মের কল্পনা এই “অদ্’ ধাতুর অর্থের সঙ্গেই জড়িত৷

ব্রহ্ম ও ঈশ্বর এ-দুটি কল্পনার পার্থক্য কী? ঈশ্বরের চলে পূজা, ব্রহ্মের হয় ধ্যান৷ হিন্দুরা সাধারণত ঈশ্বরের পুজাই করে-তাঁকে কল্পনা করে ব্যক্তিগত দেবতা-রূপে, যে-রূপে তিনি সহজবোধ্য, আপনজন৷ নিরাকারত্বের বা বিমূর্তের কল্পনা সাধারণজনের কাছে শূন্যতাবোধেরই সামিল, তাদের চিন্তাজগতের বাইরে৷ বিমূর্ত ব্রহ্ম তাই ধ্যান-জগতের ব্রহ্ম৷

শংকর এই বিমূর্ত ব্রহ্মের উপাসক; তাঁর মতে ব্রহ্ম নির্গুণ৷ যে-সব গুণ তাঁর মধ্যে আরোপ করা হয়, সবই মায়া; এই মায়ার প্রভাবেই তিনি সগুণ৷ এদিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রামানুজ বলেন, ব্রহ্ম সগুণ; তাঁর গুণের সংখ্যাও অনেক৷ শংকরের মতে ব্রহ্ম আনন্দ; রামানুজের মতে তিনি আনন্দরসে ভরপুর৷ এ-দুটি তথ্যের মধ্যে যে সূক্ষ্ম প্রভেদ, ব্রহ্ম ও ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্যও সেটুকুই৷

ব্রহ্মের এই সগুণ কল্পনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে হিন্দুর মূর্তিপুজা৷ ব্রহ্মের গুণকল্পনাও যত বেড়েছে, তাঁর মূর্তির সংখ্যাও তত বেড়েছে৷ সব মূর্তিই যে সকলের সমান ভালো লেগেছে তা নয়, তাই তা নিয়ে হয়েছে দলাদলি, তর্কবিতর্ক৷ ফলে, নানা মত ও নানা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে৷ তবু কোনো হিন্দুর মনে সন্দেহ নেই যে মূলত সব কল্পনার ভিত্তিই এক; পরমাত্মা বা বিশ্বের পরম সত্তা এক-ই৷ ভিন্নধর্মাবলম্বীর চোখে হিন্দুর এ-মূলগত এক বোধের কল্পনা অত স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়নি৷

অধিবিদ্যা জগতের এসব তর্কবিতর্কের কথা ছেড়ে দিয়ে উপনিষদগুলিতে ব্রহ্মকে কী রূপে আঁকা হয়েছে তাই দেখা যাক৷ পূর্বেই বলা হয়েছে, ব্রহ্মবিদ্যাই প্রতিটি উপনিষদের মূলগত তত্ত্ব৷

ছান্দোগ্য বলে, সৃষ্টির পূর্বে আত্মা বা ব্রহ্ম ছিলেন এক ও অদ্বিতীয়: আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ং (৪৫৩/৬) তারপর? তাঁর ইচ্ছা হল, তিনি বহু হবেন : তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি (৪৫৫/৬)৷ এক বহু হলেন বটে, কিন্তু তাতে মূল সত্তার কোনো পরিবর্তন ঘটল না৷ তাই মুনিবর উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতুকে বললেন, তৎসত্যং, স আত্মা, তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি (৪৮৯/৭)৷ তাই সত্যস্বরূপ এই অণুত্ব বিশ্বজগতে পরিব্যাপ্ত হল; তুমিও সেই আত্মাই, আর কিছুই নয়৷

এই হল তত্ত্বজ্ঞান বা আত্মজ্ঞান৷ এ-আত্মজ্ঞান লাভ হলে মানুষ আত্মক্রীড়, আত্মরতি হয় অর্থাৎ আত্মা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে তার আর কোনো ঔৎসুক্য থাকে না৷

ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে ছান্দোগ্য বলেছে, সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি শান্ত উপাসীত (২৪৫/৩)৷ এ-বিশ্বজগতের উদ্ভব হয়েছে ব্রহ্ম থেকে, ব্রহ্মেই এর স্থিতি, আবার ব্রহ্মের মধ্যেই এর বিলয় ঘটবে৷ ব্রহ্মের উপাসনা করবে শান্ত মনে৷

বৃহদারণ্যকে রয়েছে ব্রহ্মের দ্বিবিধ রূপের কথা৷ দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে মূর্ত্তঞ্চৈবামূর্ত্তঞ্চ (১০৫/২)৷ ব্রহ্ম দুটি রূপেই প্রসিদ্ধ; একটি তাঁর মূর্ত রূপ, অন্যটি অমূর্ত-একটি সাকার, মরণশীল; অন্যটি নিরাকার, মরণরহিত৷

তা সাকার বা নিরাকার যা-ই হোন-না-কেন, ব্রহ্ম বা আত্মাই মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু৷ তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ (৪৫/১/৪)৷ তিনি অন্তরতম, পুত্র অপেক্ষাও প্রিয়, বিত্ত অপেক্ষাও প্রিয়-প্রিয় বস্তুগুলির মধ্যে তিনি সর্বাপেক্ষা প্রিয়৷

তিনি কেমন? তিনি বিরজঃ পর আকাশদজ আত্মা মহান্ ধ্রুবঃ (৩১০/৪/৪); তিনি নির্মল, আকাশের চেয়েও সূক্ষ্ম, মহৎ, জন্মরহিত ও নিত্য বা পরিবর্তনহীন৷

কোহল যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, সর্বান্তর আত্মা বা বিশ্বাত্মার স্বরূপ কী? যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, যোহশনায়া-পিপাসে শোকং মোহং জরাং মৃত্যুমত্যেতি (১৭০/৩/৫)৷ তাঁর ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, শোক নেই, মোহ নেই, জরা ও মৃত্যু নেই-তিনি এসব দৈহিক ও মানসিক ক্লেশের অতীত৷ শুধু তাঁকে জানতে পারলেই মানুষ পুত্র, বিত্ত, স্বর্গ প্রভৃতি লাভের ইচ্ছা থেকে মুক্তি পেতে পারে-তখন সে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করে৷

কিন্তু এই আত্মার দর্শন বা আত্মোপলব্ধি ঘটে কার ভাগ্যে? বৃহদারণ্যক বলে, অথাকাময়মানো যোহকামো নিষ্কাম আপ্তকাম আত্মকামঃ ন তস্য প্রাণা উৎক্রামন্তি ব্রহ্মৈব সন্ ব্রহ্মাপ্যেতি (২৯৬/৪/৪)৷ যাঁর মনে কোনো আকাঙ্ক্ষা, কামনা থাকে না, কর্মফলে যাঁর কোনো আসক্তি নেই, শুধু সেই ভাগ্যবানের ভাগ্যেই ব্রহ্মদর্শন ঘটে৷ এমন যে ভাগ্যবান, তিনি আপ্তকাম অর্থাৎ বাইরের কোনো বস্তুর প্রতিই তাঁর আসক্তি থাকে না৷ তিনি অমর; দেহাবসানের পর তিনি পরলোকে যান না, তাঁর ঘটে ব্রহ্মপ্রাপ্তি অর্থাৎ তিনি ব্রহ্ম লাভ করেন৷

জীবাত্মা যখন পরমাত্মায় বিলীন হয় অর্থাৎ মানুষ যখন ব্রহ্মত্ব লাভ করে তখন প্রকৃতপক্ষে তাঁর কী অবস্থান্তর ঘটে? যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে বললেন, (১১৮/২/৪) একখণ্ড লবণ জলে ফেলে দিলে কী হয়? লবণকে কি আর জল থেকে বিচ্ছিন্ন করা চলে? তা চলে না; লবণ জলের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়৷ তেমনি পরমাত্মায় বিলীন হলে জীবাত্মার অহং-জ্ঞান, সংজ্ঞা বা স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের চেতনার অবসান ঘটে৷

তৈত্তিরীয় উপনিষদে ব্রহ্মের স্বরূপ-ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,

”যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে৷

যেন জাতানি জীবন্তি৷

যৎ প্রযন্ত্যভিসংবিশন্তি৷

তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব তদ্ব্রহ্মেতি৷’’ (১/৪১ ভৃগুবল্লি)

ব্রহ্মের লক্ষণ কী? বরুণ ঋষিপুত্র ভৃগুকে বললেন, যা থেকে বিশ্বজগৎ বা সমস্ত জৈব ও অজৈব বস্তুর উদ্ভব হয়েছে, উদ্ভূত হয়ে এ-সব যাঁর মধ্যে বেঁচে বা বর্তমান থাকে, আর পরিশেষে বিনাশকালে যাঁর মধ্যে সে-সব বিলীন হয়-তিনিই ব্রহ্ম৷ সে ব্রহ্মকেই বিশেষরূপে জানার চেষ্টা কর৷

জানার চেষ্টা করলেন ভৃগু৷ কিন্তু সে চেষ্টায় কোনো ফললাভ হল না বহুবার৷ প্রতিবারই অসম্পূর্ণ তপস্যায় ব্রহ্মের যে স্বরূপবোধ তাঁর হল, প্রমাণিত হল তা মিথ্যা৷ কিন্তু পরিশেষে অধ্যবসায়ের ফল ফলল৷ তিনি উপলব্ধি করলেন, আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ (১/৪৬ ভৃগুবল্লি)-আনন্দই ব্রহ্ম৷ জৈব ও অজৈব সমস্ত বস্তুরই উদ্ভব হয়েছে আনন্দের মধ্যে; আনন্দের মধ্যেই তাদের স্থিতি এবং পরিশেষে আনন্দের মধ্যেই তাদের বিলয় ঘটবে৷

কাজেই বিশ্বজগতের পরমসত্তা বস্তুগত নয়, জ্ঞানগম্য৷

কিন্তু এ-আনন্দের স্বরূপোলব্ধি সহজ কথা নয়৷ বাক্য বা মন কেউ তা প্রকাশ করতে পারে না; ব্রহ্মানন্দ মানুষকে দেয় পরম অভয়, করে তোলে নির্ভীক, জন্ম-জরা-মরণের ভয় তাঁর থাকে না৷ আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্ ন বিভেতি কদাচনেতি৷ (১/৩১ ব্রহ্মানন্দবল্লি)

ঐতরেয় উপনিষদে বলা হয়েছে, প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম৷ দেখা যাক, প্রজ্ঞানের অর্থ কী৷ প্রজ্ঞান পরম চেতনা বা চরম উপলব্ধি৷ মানুষের মনের সমস্ত কার্যকলাপ ও বিশ্বজগতের যাবতীয় জৈব ও অজৈব বস্তুই মানুষের সহজ জ্ঞানকে প্রজ্ঞানে পরিণত করার সহায়৷

কেন উপনিষদের মতে, মানুষের যখন বিশ্বাস হয় যে সে ব্রহ্মকে জেনেছে, তখন বুঝতে হবে যে সে তাঁর স্বরূপ বিন্দুমাত্রও বোঝেনি৷ কারণ, মানুষের সৃষ্টি ব্রহ্মের সান্নিধ্যে যেতে পারে না, বাক্যও তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করতে পারে না, এমনকি মনও সে রূপ উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় না৷ আচার্য বা গুরু আকারে-ইঙ্গিতে যেটুকু প্রকাশ করতে চেষ্টা করেন, সেটুকুও মানুষের জ্ঞানগম্য হয় না৷ (১/৩)

তবে উপায় কী? সাধারণজনের বোধগম্য করার জন্য উপনিষদই বলেছে, ব্রহ্ম দেবতাদের দেবতা৷ ইন্দ্র, বরুণ, বায়ু, অগ্নি-এঁরা সবাই তাঁর কাছ থেকেই তাঁদের শক্তি লাভ করেন৷ তিনিই বিশ্বজগতের সমস্ত শক্তি ও বীর্যের মূল৷

মনে হয়, অদ্বৈতবাদকে সাধারণজনের বোধগম্য করার প্রথম সোপান হিসাবেই বহুদেবতাবাদের সৃষ্টি হয়েছে৷ অবশ্য স্থূলবিচারে সাধারণজনের চোখে এটি বহুদেবতাবাদ ঘটে, কিন্তু সূক্ষ্মবিচারে একে Henotheism বা অনুক্ত একেশ্বরবাদ বলা অধিকতর সংগত৷ কারণ, বেদের দেবতা বহু বটে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে রয়েছে সম্মানের সমতা অর্থাৎ কেউ উঁচু, কেউ নীচু নন৷ তারপর যখন একজনের পূজা করা হয়েছে তখন তাঁকেই সর্বোচ্চ বলে ধরা হয়েছে; অর্থাৎ সে-সময়টুকুর জন্য তিনিই রয়েছেন একমাত্র দেবতা৷

কঠোপনিষদে ব্রহ্মকে “অশব্দম্, অস্পর্শম্, অরূপম্, অব্যয়ম্, তথারসম্ নিত্যম্, অগন্ধবচ্চ’ (৬৯/১৫) বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ দিয়ে তৈরি বলেই এ বিশ্বজগৎ মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য; কিন্তু ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন৷ তাই তাঁর স্বরূপ এই পাঁচটি গুণের অতীত৷ এ-সব গুণের সংস্পর্শ যে স্থূলতার ভিত্তি সে কথা অন্যত্রবলা হয়েছে৷ এসব গুণের অতীত যে সূক্ষ্মতা তা অব্যক্ত ও অব্যয়৷ ব্রহ্মজ্ঞান সেই সূক্ষ্মতারই উপলব্ধি৷ গুণ বা স্থূলতার অতীত বলেই ব্রহ্মের কোনো পরিবর্তন সম্ভবপর নয়, তিনি চিরন্তন৷ শুধু তাঁকে উপলব্ধি করেই মানুষ সংসার-বন্ধন এড়িয়ে যেতে পারে৷ এ-বন্ধন মৃত্যুর করাল গ্রাসের নামান্তর মাত্র৷

কিন্তু ব্রহ্ম মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হন না কেন? কারণ, ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টিই হয়েছে বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার জন্য; কাজেই, স্বাভাবিকভাবেই এদের দৃষ্টি যাবে বাইরে৷ অতি মুষ্টিমেয় মানুষই এই স্বাভাবিক প্রকৃতির দাবি লঙ্ঘন করে ইন্দিয়গুলিকে অন্তর্মুখী করতে সমর্থ হন৷ তার ফলেই হয় তাঁদের ব্রহ্মদর্শন৷

এ-উপনিষদে নানা উপমা ও অলংকারের সহযোগে ব্রহ্মের যে-সব স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে তার ভাষা যেমন কাব্যধর্মী, তেমনি শ্রুতিমধুর৷

ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে, বিশ্বজগতে দৃশ্যমান সমস্ত বস্তুই ব্রহ্ম বা ঈশ দিয়ে আবৃত৷ অর্থাৎ যা দেখা যায় সবই মিথ্যা, কল্পনা; এদের অন্তরালে যে মুলবস্তু বর্তমান, তা-ই সত্য; তা-ই ব্রহ্ম৷

এ পরম সত্য উপলব্ধি করলে মানুষের কী পরিবর্তন ঘটে? ঈশোপনিষদ বলে,

”যস্মিন সর্ব্বাণি ভূতানি আত্মৈবাভূদ্ বিজানতঃ

তত্রকো মোহঃ কঃ শোক একত্রমনুপশ্যতঃ৯’’ ৭৷

যিনি উপলব্ধি করেছেন যে একমাত্র সত্য আত্মা থেকেই সমস্ত বস্তুর উদ্ভব হয়েছে, অর্থাৎ যাঁর আত্মদর্শন ঘটেছে, তাঁর শোক বা মোহ কিছুই থাকে না৷ প্রিয়-বিরহে বা অপ্রিয়-লাভে শোক ও মোহগ্রস্ত হয় তারাই, যাদের ভেদবুদ্ধি রয়েছে, অর্থাৎ প্রিয়, অপ্রিয় জিনিস ও নিজের মধ্যে যারা মূলগত একত্ব অনুভব করে না৷ এই একত্বর স্পষ্ট উপলব্ধি শোক ও মোহ দূর করে দেয়৷

এ-উপনিষদটিতে ব্রহ্মের যে একটি পরম রমণীয় ব্যাখ্যা রয়েছে তার উল্লেখ অন্যত্র করা হয়েছে৷

শ্বেতাশ্বতর বলে, ব্রহ্মের হাত নেই, তবু তিনি জগতের সমস্ত বস্তুই ধরে আছেন৷ পা নেই বটে, তবু তিনি সর্বত্র সঞ্চরমান৷ কান নেই বটে, তবু সমস্ত-কিছুই তিনি শুনতে পান৷ চোখ নেই, তবু সবই দেখেন৷ মনও নেই, তবু সবই বুঝতে পারেন৷ কেউ তাঁকে জানে না; শুধু তত্ত্বদর্শীরা বলেন যে তিনি সমস্ত বিশ্বজগতের মূলীভূত কারণ (৩/১৯)৷

ধ্যানযোগে তত্ত্বজ্ঞরা ব্রহ্মের যে স্বরূপ দর্শন করেছেন তার ব্যাখ্যায় শ্বেতাশ্বতর বলে, তাঁর কোনো কলা বা অংশ নেই, তিনি নিরবয়ব, কোনো কার্য তিনি করেন না, তাঁর কোনো বিকারও নেই৷ তিনি সমস্ত মলিনতার ঊর্ধ্বে, সর্ব-আসক্তিবর্জিত৷ তিনিই অমৃতত্বের পথদর্শক; দগ্ধ কাষ্ঠের ধূমহীন জ্যোতির মতোই তাঁর দীপ্তি (৬/১৯)৷

ব্রহ্মজ্ঞ না-হলে কারও শোক দূর হওয়া অসম্ভব, যেমন অসম্ভব নিরবয়ব আকাশকে আবৃত করে রাখা৷

মুণ্ডকোপনিষদের ব্রহ্মের স্বরূপ-ব্যাখ্যাও ওই একই ধরনের৷ ব্রহ্ম অদৃশ্য, বুদ্ধির দ্বারা তাঁকে জানা যায় না, তাঁর কোনো মূলও নেই, রূপও নেই৷ হাত, পা, চোখ বা কান কিছুই তাঁর নেই৷ অতি সূক্ষ্ম তিনি; ঋষিগণ পরাবিদ্যা আয়ত্ত করে তাঁর দর্শনলাভ করেন (১/৬)৷

এ-উপনিষদে ব্রহ্মস্বরূপকে “আনন্দরূপং অমৃতং যদ্বিভাতি’ বলা হয়েছে৷ এর অর্থ অন্যত্র উল্লেখ করাও হয়েছে৷

প্রশ্নোপনিষদে ব্রহ্মকে ষোলো কলায় ভাগ করা হয়েছে৷ তিনি আমাদের দেহের মধ্যেই বাস করেন৷ কলাগুলি তাঁর বিভিন্ন ঐশ্বর্যের দ্যোতক৷ নদী যেমন সমুদ্রের মধ্যে নিজের নাম ও রূপ হারিয়ে ফেলে, তেমনি ব্রহ্মের মধ্যে এ-কলাগুলিরও স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের লোপ হয়৷ নদীর জন্ম সমুদ্রে হয় না (অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে), কিন্তু কলার উদ্ভব ব্রহ্ম থেকেই৷

মাণ্ডূক্যোপনিষদেও ব্রহ্মস্বরূপের ধারণা ওই একই মত৷ তিনি অদৃশ্য, কোনোরূপে ব্যবহারযোগ্য নন৷ তিনি আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন, তিনি চিহ্নরহিত, মানুষের চিন্তাজগতে তাঁর স্থান নেই, শব্দ দিয়ে তাঁকে নির্দেশ করা যায় না৷ “তিনি আছেন’ শুধু এই প্রতীতিই তাঁর অস্তিত্বজ্ঞাপক৷ তিনি শান্ত, মঙ্গলময়, অদ্বৈত এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য বস্তু (১/৭)৷

যদিও বিভিন্ন উপনিষদে ব্রহ্মের স্বরূপ-ব্যাখ্যার ইতরবিশেষ রয়েছে, তবুও মূলবস্তু যে এক তা স্পষ্ট৷ মানুষের চিন্তাধারা কত উঁচুতে উঠলে যে এমন সূক্ষ্ম, যুক্তিযুক্ত, সাবলীল ও স্বচ্ছ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়৷ এ-চিন্তাধারাকে অত্যাধুনিক বলে ভুল করাই স্বাভাবিক, তাই এটা বারবার স্মরণ করতে হবে যে উপনিষদের চিন্তাধারা মানুষ-প্রজাতির শৈশবের কথা৷ সে কথা আমাদের বিরাট পৃথিবীর একটি ছোটো অংশের মানুষের মনের ইতিহাস৷ তখনও পৃথিবীর বহুস্থলেই আদিম মানুষের মেধা পরিপুষ্ট হয়নি৷ মানুষের বয়স তারপর হাজার হাজার বছর বেড়েছে সত্য, কিন্তু তার এ-শৈশবের চিন্তাধারাকে, অধিবিদ্যার জগতে, তার অপেক্ষাকৃত পরিণত মন কি এখনও অতিক্রম করতে পেরেছে?

ব্রহ্মস্বরূপের কথায় ছেদ টেনে এবার ব্রহ্মবিদ্যার কথা আলোচনা করা যাক৷

ব্রহ্মবিদ্যা ব্রহ্মজ্ঞানের নামান্তর৷ উপনিষদগুলির লক্ষ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার৷ অবশ্য সাধারণজন এ-জ্ঞান লাভ করতে অসমর্থ, কারণ বিদ্যালাভের যোগ্য না হলে কোনো বিদ্যাই গ্রহণ করা যায় না৷

ব্রহ্মবিদ্যা কী করে লাভ করা যায়? এ-সম্পর্কে উপনিষদগুলির বক্তব্য কী?

এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া চলে দুই ভাবে৷ একদিকে বলা হয়েছে কোন কোন পথে এ-বিদ্যা লাভ করা চলে না, যদিও সাধারণ বিদ্যার ক্ষেত্রে সে-সব পথ ফলপ্রসূ৷ যেমন, ব্রহ্মবিদ্যা শাস্ত্রাধ্যয়নের দ্বারা লাভ করা চলে না; মেধা বা বুদ্ধির দ্বারাও এর প্রতীতি জন্মে না৷ লৌকিক আচারবিচারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই৷

অন্যদিকে দেখা যাক, কোন পথে চললে ব্রহ্মবিদ্যালাভ ঘটতে পারে৷ ব্রহ্মবিদ আচার্যের শরণ নিলে সে সৌভাগ্য সহজ হয়ে আসে৷

মুণ্ডকোপনিষদে পথটির কথা স্পষ্টতর হয়েছে৷ আমাদের মধ্যেই জ্যোতির্ময়, নির্মল পরমাত্মাকে উপলব্ধি করা যায় সত্যকে অবিচলিত হয়ে গ্রহণ করলে৷ কিন্তু তার সঙ্গে চাই তপস্যা বা পরম মনঃসংযম ও ব্রহ্মচর্য, অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক শুদ্ধি৷ (৪৯/৫)

অন্য বলা হয়েছে যে আদিম পর্যায়ের উপনিষদগুচ্ছের মধ্যে জ্ঞানমার্গের প্রতিপত্তি৷ বৃহদারণ্যকে দেখা যায়, যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর সহধর্মিণী মৈত্রেয়ীকে বলছেন, মৈত্রেয়ি, প্রথম শাস্ত্রালোচনা করে পরে ব্রহ্মবিদ আচার্যের শরণ নিয়ে ব্রহ্মস্বরূপের যথাযথ ধারণা করতে হবে৷ তারপর নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে স্থির করবে বিশ্বের পরমসত্তা কী৷ তা স্থির করে সে সত্তার ধ্যানে মগ্ন হবে৷ (১১১/৫)

পরবর্তী উপনিষদগুচ্ছে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভক্তিবাদ৷ সঙ্গে সঙ্গে এসেছে ব্রহ্মের করুণার কথা৷ যে-ভক্তকে তিনি করুণা করেন, শুধু সে-ই ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতে পারে৷ এই করুণার প্রশস্তি গেয়েছে বলে কঠোপনিষদের যে-বিখ্যাত মন্ত্রটিকে হাজির করা হয়, তার অর্থ : ব্রহ্মকে শুধু শাস্ত্রের মর্ম উপলব্ধি করে বা তর্কবিতর্ক করে জানা যায় না; কল্পনার প্রসার ঘটিয়ে বা গুরুর উপদেশেও তাঁকে বুঝতে পারা অসম্ভব৷ ব্রহ্ম নিজে যদি মনে করেন যে জ্ঞানার্থীটি সত্যি ব্রহ্মজ্ঞানলাভের যোগ্য, তবেই তাঁর ব্রহ্মদর্শন বা আত্মদর্শন ঘটে৷ (৫২/২৩)

ব্রহ্মবিদ্যালাভে মানুষের কী পরিণতি ঘটে? আমরা সাধারণভাবে যাকে বলি মুক্তিলাভে-তা-ই ঘটে; উপনিষদের ভাষায় তা-ই অমৃত৷

এ-অমৃতত্বের অর্থ কী, তা অন্য বলা হয়েছে৷ তবু এর ব্যাখ্যায় একটু কথা জুড়ে দেবার বাকি আছে৷ সেটুকু অমৃতত্বের বৈপরীত্যের ধারণা স্পষ্ট করার জন্য৷

এ-জগতের সকল অনিত্য বস্তুরই ছয়টি অবস্থান্তর ঘটে৷ প্রথম জন্ম; দ্বিতীয় সত্তা বা অস্তিত্ব; তৃতীয় বৃদ্ধি; চতুর্থ বিপরিণাম অর্থাৎ বৃদ্ধি ও ক্ষয়ের মধ্যবর্তী অবস্থা; পঞ্চম ক্ষয়; ষষ্ঠ বিনাশ৷ নিত্যবস্তু বা ব্রহ্মে বা অমৃতত্ব লাভের পর মানুষকে আর এই-সব অবস্থার দাস হয়ে ফিরে আসতে হয় না৷

অমৃতত্বের কথা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর সহধর্মিণী মৈত্রেয়ীকে৷ সে-কথা রয়েছে বৃহদারণ্যকের পাতায়৷ কোনো স্থানে দুটি জীব বর্তমান থাকলে একে অন্যকে দেখতে পায়, একে অন্যের কথা চিন্তা করে৷ কিন্তু যখন সে দু-জন একে পরিণত হয়, অর্থাৎ, মানুষ যখন নিজেই ব্রহ্ম লাভ করে, তখন সে নিজেই তো হয় বিশ্বের পরমসত্তা; সে আর কাকে দেখবে, কার কথা শুনবে, কার কথা চিন্তা করবে? আত্মজ্ঞান লাভের পর এই যে এক বোধ তা-ই অমৃতত্ব ৷ (২/৪/১৪)

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন