পণ্ডিতদের মতে উপনিষদ-গুচ্ছে পুথির সংখ্যা একশো আটটি৷ এগুলির প্রত্যেকটিই মূল পুথি ও স্বতন্ত্র বলে স্বীকৃত৷ এ ছাড়া উপনিষদ নামধেয় আরও অনেক পুথির সন্ধান পাওয়া গেছে, কিন্তু সেগুলি কৃত্রিম বা জাল বলেই বিবেচিত৷
দক্ষিণাপথের ‘মুক্তিকা’ উপনিষদ-গুচ্ছের মধ্যে এই একশো আটটিই রয়েছে৷ ‘নারায়ণ’ উপনিষদ-গুচ্ছে রয়েছে বাহান্নটি৷ এ ছাড়া আরো অনেক গুচ্ছ আছে-তাতে পুথির সংখ্যা নানারূপ৷
মোগল সম্রাট সাজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র দারাশিকো উপনিষদের ভক্ত ছিলেন৷ তিনি সপ্তদশ শতকের মানুষ৷ তাঁর গুচ্ছে ছিল পঞ্চাশটি পুথি; এগুলি তাঁর নিজের তত্ত্বাবধানে ফারসি ও আরবিতে অনূদিত হয়৷ ফারসি ও আরবি থেকে পরে কিছু কিছু ভাষান্তরিত হয় লাতিনে এবং তা থেকে ইংরেজিতে৷ তারপর প্রধানত লাতিন ও ইংরেজির কাঁধে ভর করে উপনিষদের পরিক্রমা শুরু হয় সারা পাশ্চাত্যে৷ পাশ্চাত্যের মহাবিদ্যালয়গুলিতে সংস্কৃতজ্ঞ মনীষীরাও এ-ব্যাপারে কম সাহায্য করেননি৷
ভারতীয় দর্শন-শাস্ত্রের মধ্যে বেদান্তদর্শনই যে সর্বপেক্ষা প্রাণবন্ত তাতে সন্দেহ নেই৷ শংকরাচার্যের অসাধারণ মনীষাই তার প্রাণ-সঞ্চারের প্রধান কারণ৷ অন্যান্য ভারতীয় দর্শনের মতো বেদান্তেরও মূল প্রেরণা ও উপাদান উপনিষদের৷ কিন্তু শংকরাচার্য সে উপাদান উপনিষদ-গুচ্ছের একশো আটটি থেকেই সংগ্রহ করেননি, করেছেন মাত্র চৌদ্দটি থেকে৷ কিন্তু এ চৌদ্দটিও একেবারে নির্ভেজাল কিনা সে সম্পর্কে তাঁর সংশয় ছিল বলে মনে হয়, কারণ এদের মধ্যে মাত্র এগারোটিরই তিনি টীকাটিপ্পনী লিখেছেন, কারও কারও মতে দশটির৷ উপনিষদের যত টীকাটিপ্পনী রয়েছে তার মধ্যে শংকরের ভাষ্যই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান ও যথাযথ বলে দেশে ও বিদেশে গৃহীত হয়েছে৷ শংকর অন্যান্য উপনিষদের ব্যাখ্যা লেখার সময় পাননি এ ওজরও সমীচীন নয়৷ কাজেই, তিনি যে-কয়টি উপনিষদের ভাষ্য লিখেছেন, অর্থাৎ উল্লিখিত এগারোটিই যে অবিকৃত ও প্রামাণিক, সে কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ এই এগারোটিই প্রামাণিক ও প্রধান পুথি বলে গণ্য ও আদৃত৷
পণ্ডিতেরা সাধারণত এই পুথি-কয়টি নিয়েই তাঁদের বিচার-বিবেচনা, আলাপ-আলোচনা করেন; কেউ কেউ কদাচিৎ অন্যান্য উপনিষদ নিয়ে নাড়াচাড়া করেন৷ আমরা তাই এই ক্ষুদ্র আলোচনার পরিধিও শংকরের অনুমোদিত এই এগারোটির মধ্যে নিবদ্ধ রাখব৷
পূর্বেই বলা হয়েছে যে উপনিষদগুলি মানুষ-প্রজাতির আদিম গ্রন্থ, বেদেরই অংশবিশেষ৷ এখন বেদ-চতুষ্টয়ের সঙ্গে এদের অঙ্গাঙ্গিসম্পর্ক নির্ণয় করা যাক৷
| শংকরের অনুমোদিত প্রামাণিক উপনিষদ | যে বেদের এটি অংশ-বিশেষ | 
| ১. ছান্দোগ্য | সামবেদ | 
| ২. বৃহদারণ্যক | শুক্ল-যজুর্বেদ | 
| ৩. তৈত্তিরীয় | কৃষ্ণ-যজুর্বেদ | 
| ৪. ঐতরেয় | ঋগ্বেদ | 
| ৫. কেন | সামবেদ | 
| ৬. মুণ্ডক | অথর্ববেদ | 
| ৭. কঠ | কৃষ্ণ-যজুর্বেদ | 
| ৮. ঈশ | শুক্ল-যজুর্বেদ | 
| ৯. শ্বেতাশ্বতর | কৃষ্ণ-যজুর্বেদ | 
| ১০. প্রশ্ন | অথর্ববেদ | 
| ১১. মাণ্ডূক্য | অথর্ববেদ | 
বেদ মূলত চারটি হলেও, যজুর্বেদ দুটি; মাসের পক্ষের মতো দ্বিধাবিভক্ত-একটি শুক্ল, অন্যটি কৃষ্ণ৷ শুক্লে ও কৃষ্ণে ভাষাগত বা আদর্শগত প্রভেদ নেই৷ এ পক্ষভেদের সম্পর্কে যে আখ্যায়িকা প্রচলিত তারই উল্লেখ করছি৷
কথিত আছে, বেদব্যাস বেদমন্ত্রের শ্রেণিবিভাগ করেন৷ এই শ্রেণিবিভাগ শেষ হবার পরে, তিনি তাঁর চারজন প্রধান শিষ্যের প্রত্যেককে, এক-একটি বিশেষ বেদে ব্যুৎপন্ন করে, যার যার অধিগত বিদ্যা প্রচারের আদেশ দেন৷ শিষ্য বৈশম্পায়নের উপর ন্যস্ত হয় যজুর্বেদ প্রচারের ভার৷ বৈশম্পায়ন স্বনামখ্যাত যাজ্ঞবল্ক্যের গুরু; তিনি বিশেষ যত্ন করে শিক্ষা দেন তাঁর প্রিয়শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্যকে৷ কিন্তু বিদ্যার ভারে যাজ্ঞবল্ক্য বিনীত না হয়ে, হয়ে পড়েন ক্রমে উদ্ধত৷ ফলে, বৈশম্পায়ন তাঁকে বেদচর্চার অনুপযুক্ত বলে মনে করে তাঁর অধীত বিদ্যা উদ্গিরণ করে দিতে বলেন৷
অধিগত বিদ্যা উগরিয়ে ফেলে দিয়ে যাজ্ঞবল্ক্য পাণ্ডিত্য-হীন হলেন বটে, কিন্তু বমির সঙ্গে যে-জ্ঞান বাইরে এসে পড়ল, তা এত মূল্যবান যে তাকে চিরবর্জন করা অসংগত ও অবিধেয় বলে বিবেচিত হল৷ কিন্তু এমন মানুষ কে আছে যে এ ক্লেদ গলাধঃকরণ করে তা রক্ষা করবে? তা নেই৷ কাজেই বৈশম্পায়নের অন্যান্য শিষ্যেরা তিতির পাখির রূপ ধরে এই ক্লেদাক্ত বিদ্যা পুনর্গ্রহণ করলেন৷ ফলে, তা যথাযথ সংরক্ষিত হল বটে, কিন্তু ক্লেদাক্ত বিদ্যাকে আর পূর্ব-গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করা চলল না৷ তাই তাকে বলা হল, কৃষ্ণ-যজুর্বেদ বা ক্লেদাক্ত যজুর্বেদ৷
এদিকে যাজ্ঞবল্ক্যের কি হল? পাণ্ডিত্য-হীন হয়ে তিনি যজুর্বেদ শিক্ষার জন্য বহুদিন সূর্যের তপস্যা করলেন; বেদে সূর্যের দক্ষতা ছিল অসাধারণ৷ তাঁর তপস্যায় সিদ্ধ হয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের আবার যজুর্বেদে পূর্ণজ্ঞান লাভ হল৷ সূর্য থেকে সরাসরি এ জ্ঞানকে বলা হল শুক্ল বা নির্মল যজুর্বেদ৷
এবার বেদ ছেড়ে উপনিষদে আসা যাক৷ যাঁরা এ পুথিগুলির রচয়িতা তাঁদের কি কোনো সন্ধান মেলে? বলা বাহুল্য, মেলে না৷ অবশ্য পুথিগুলির মধ্যে বহু ঋষি বা মুনির নাম রয়েছে, কিন্তু এঁদের কাউকেই যে বিশেষ করে কোনো উপনিষদের রচয়িতার পদে বসানো চলে, তা নয়৷
প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রগ্রন্থগুলিকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছে; একভাগের নাম শ্রুতি, অন্যভাগকে বলা হয় স্মৃতি৷ শ্রুতি স্বয়ং বিশ্বস্রষ্টার সরাসরি দান অর্থাৎ ধ্যান-জগতে তাঁর সঙ্গে সংযোগের ফল; আর, স্মৃতি পরম্পরাগত বিদ্যা-এর জনক পৃথিবীরই মানুষ৷ উপনিষদ পড়েছে শ্রুতির দলে, তাই একে ‘অপৌরুষেয়’ বলা হয় অর্থাৎ যা মানুষের রচিত নয়৷
এবার বিচার করে দেখা যাক, শংকর তাঁর বেদান্তদর্শন রচনা করতে কোন কোন উপনিষদের সাহায্য গ্রহণ করেছেন৷ দেখা যায়, তিনি সব চেয়ে বেশি আনুকূল্য পেয়েছেন ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক উপনিষদ-দুটি থেকে৷ তৈত্তিরীয়, মুণ্ডক ও কঠ উপনিষদ-ত্রয়ের উদ্ধৃতিও মোটামুটি কম নয়৷ কেন ও ঈশ উপনিষদ-দুটি থেকেও তিনি সামান্য কিছু সংগ্রহ করেছেন৷ কিন্তু এই উদ্ধৃতি ও সাহায্যলাভের ভিত্তিতে এসব উপনিষদের মূল্য নির্ধারণ করতে গেলে ভুল করা হবে৷ মনে রাখতে হবে, শংকরের পক্ষে এসব উদ্ধৃতির প্রয়োজন ছিল একটি বিশেষ কারণে মাত্র, অর্থাৎ তাঁর বেদান্তদর্শনের ভিত্তি-স্থাপনের প্রয়োজনে৷ সে প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য তাঁর যেসব অংশের প্রয়োগ সুসংগত বলে মনে হয়েছে, শুধু সেটুকুই তিনি গ্রহণ করেছেন৷ প্রকৃতপক্ষে এই প্রত্যেকটি উপনিষদই এক-একটি রত্নের খনি; কোনটির চেয়ে কোনটি বেশি মূল্যবান তা বলা দুষ্কর৷ রত্ন-ব্যবসায়ীরা প্রত্যেকটি খনির মধ্যে প্রবেশ করেই চমৎকৃত হন, তবে সেখান থেকে কোন রত্নটি তিনি সংগ্রহ করবেন তা নির্ভর করে তাঁর মানসিক গতি ও অভিলাষের উপর৷
উপনিষদ-রচয়িতাদের নাম-ধাম জানার কোনো উপায় নেই বটে, তবে তাঁরা সবাই যে একই তীর্থযাত্রী তা স্পষ্ট বোঝা যায়৷ সবারই একমাত্র লক্ষ্য বিশ্বজগতের পরম সত্তার অনুসন্ধান৷ সে অন্বেষণের জন্য তাঁরা বিভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করেছেন বটে, কিন্তু যে-পথ তাঁরা পরিক্রম করেছেন তা মোটামুটি একই; পথের অভিজ্ঞতার মধ্যেও বিশেষ বিভেদ নেই, আর সর্বশেষ যে-গন্তব্য বা সিদ্ধান্তে তাঁরা পৌঁছেছেন তা মূলত অভিন্ন৷ আমরা ক্রমে তার পরিচয় পাব৷
উপনিষদগুলির মধ্যে কোনটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন? এ প্রশ্ন স্বভাবতই মনে জাগে৷ এ নিয়ে পণ্ডিতদের বিচার-বিবেচনাও চলেছে বহুদিন৷ কালানুসারী শ্রেণিবিভাগে ভাষা-পরীক্ষা একটি প্রধান উপায়৷ তা ছাড়া অন্যান্য সাক্ষ্যেরও মূল্য রয়েছে৷ সব দিক বিবেচনা করে পণ্ডিতেরা বলেন, শংকর যে এগারোটি উপনিষদের ভাষ্য লিখেছেন, কালানুসারে তাদের তিনভাগে বিভক্ত করা সমীচীন৷ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন দলে পড়ে ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, তৈত্তিরীয় ও ঐতরেয়৷ এদের সবারই বাহন কেবল গদ্য, আর সে গদ্যে বহু প্রাচীন আর্ষ প্রয়োগ ও আদিম ভাষাগত স্থূলতা ও অসৌকর্যের চিহ্ন বর্তমান৷
কেন উপনিষদের খানিকটা রচিত হয়েছে গদ্যে, খানিকটা পদ্যে৷ খুব সম্ভবত এটির জন্মকাল এর পুরোবর্তী গদ্যময় ও আর্ষ-বহুল উপনিষদের যুগ ও পরবর্তী পদ্যময়, শব্দকুশলী ও প্রাণবন্ত উপনিষদের কালের সংযোগস্থলে৷ কেন উপনিষদখানির মধ্যে এই সংক্রান্তির ছাপ পূর্ণমাত্রায় বর্তমান৷
সাহিত্যিক মূল্যবিচারে এই দ্বিতীয় উপনিষদগুলির রমণীয়তা সর্বজনস্বীকৃত৷ এদের ভাষাও ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃত-ঘেঁষা, বেদের প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার প্রভাব এর মধ্যে অকিঞ্চিৎকর৷ যদিও প্রশ্ন ও মাণ্ডূক্য উপনিষদ-দুটি গদ্যে লেখা, তবুও এরা যে এই দ্বিতীয় যুগেরই, ভাষাই তার সাক্ষী৷ দ্বিতীয় যুগের পদ্যময় উপনিষদ বাকি চারটি, অর্থাৎ মুণ্ডক, কঠ, ঈশ ও শ্বেতাশ্বতর৷
উপনিষদের জন্ম-ইতিহাস ও তাদের অন্তর্নিহিত মুখ্য ভাব-বিকাশের কারণ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মতভেদ রয়েছে৷ বেদের আদিপর্ব ক্রিয়াকাণ্ডবহুল; যজ্ঞ, হোম প্রভৃতি কর্মই তার অবলম্বন৷ কিন্তু বেদের অন্তে স্থিত উপনিষদগুলির মধ্যে জ্ঞানমার্গের প্রাধান্য৷ এতে অন্যান্য দেবতার কথা রয়েছে বটে, কিন্তু তারা একমাত্র সত্যবস্তু ব্রহ্মের তুলনায় নগণ্য৷ এই পরমসত্তা ব্রহ্মের অবতারণা ও প্রচারই উপনিষদগুলির মূলতত্ত্ব; কাজেই বেদের প্রথম পর্বের সঙ্গে শেষ পর্বের অপরিসীম অসংগতি বর্তমান৷
পণ্ডিতদের মতানৈক্য এই প্রভেদের কারণ সম্পর্কে৷ কারও কারও মতে বেদ ও উপনিষদ মূলত দু-দল বিভিন্ন শ্রেণির লোকের সৃষ্টি; একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো সম্পর্ক নেই৷ কেউ বলেছেন, উপনিষদ বেদবিরোধী দলের সৃষ্টি৷ তৃতীয় দল বলেন, বেদের বহুদেববাদ আদিম মানবসমাজের অপরিহার্য চিন্তাধারা; মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপনিষদের অদ্বৈতবাদে তার পরিণতি৷
কিন্তু এসব বাদানুবাদের বিশেষ কোনো অর্থ নেই; সবই পণ্ডিতি তর্ক-বিতর্ক মাত্র৷ উপনিষদের স্রষ্টারা কোথাও বহুদেববাদের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি; কোনো উপনিষদে তো বহুদেবের কথা স্পষ্ট করেই স্বীকার করা হয়েছে৷ তারপর, বেদোক্ত যজ্ঞ ও কর্মকাণ্ডকে কোনো উপনিষদেই মূল্যহীন বা নিষ্ফল বলে বলা হয়নি৷ কাজেই বেদের আদি ও অন্তের মধ্যে অসামঞ্জস্য বা বিরোধের স্থান কোথায়? এ কথা সত্যি বটে যে উপনিষদে জ্ঞানপন্থার উপর জোর দেওয়া হয়েছে, আর বেদের বাকি অংশে কর্মপন্থারই প্রাধান্য; কিন্তু তা দিয়ে এটা প্রমাণ করা চলে না যে একটির ক্রমবিকাশে অন্যটির জন্ম৷ এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে উপনিষদ ‘আরণ্যক’ সৃষ্টি অর্থাৎ অরণ্যজাত; বানপ্রস্থী প্রৌঢ় মানুষের মানসলোকের সৃষ্টি৷ সংসারত্যাগী মানুষের পক্ষে জ্ঞানযোগের অনুসরণই স্বাভাবিক৷ অরণ্যে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে৷ ইন্দ্র, বরুণের অনুগ্রহ সংসারক্ষেত্রে ধর্ম, অর্থ ও কামের পক্ষে পরম শুভদ মনে হলেও, অরণ্যের নির্জনতায় সেসব ‘শ্বোভাবা’ বা নিতান্তই ক্ষণভঙ্গুর বলে মনে হয়, আর মনে বিশ্বজগতের চরম সত্তা ও পরম শান্তির প্রতি আকর্ষণ জন্মে৷ এর মধ্যে অসংগতি বা অস্বাভাবিকতা কোথায়?
সে কথা থাক৷
হিন্দুর শাস্ত্রে মোক্ষ বা কৈবল্য-লাভের তিনটি পথ; কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান৷ শ্রুতির মধ্যে রয়েছে শুধু কর্ম ও জ্ঞানের কথা৷ অনেকের মতে, ভক্তিবাদ এসেছে অনেক পরে৷ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে এর প্রথম স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, এবং কঠোপনিষদে রয়েছে এর আভাস৷ এর প্রতিপক্ষ বলেন, বেদে ভক্তিবাদ তো ওতপ্রোত রয়েছে, নইলে এত হোম, যজ্ঞ ও পূজার ভিত্তি কি? তারপর কারো কারো কতে, ঋগ্বেদের বিষ্ণু তো প্রেম ও ভক্তিরই প্রতিমূর্তি৷ কোনো কোনো মন্ত্রে তো ভক্তি বা প্রেমের কথা অতি স্পষ্টভাবেই রয়েছে৷ আর রয়েছে পরমপুরুষের প্রতি দাস্যভাব, সখ্যভাব, এমনকি রাগাত্মিকা ক্রীড়াকৌতুকের কথা৷ তা যা-ই হোক, এই তিনটি পন্থার সামঞ্জস্য হয়েছে বেদ-উপনিষদের অনেক পরে, হিন্দুর নিত্যপাঠ্য প্রখ্যাত শাস্ত্র ভগবদগীতায়৷
শংকরের পরোক্ষ ইঙ্গিতের সূত্র ধরে আমরা প্রধান ও সর্বাপেক্ষা অকৃত্রিম উপনিষদগুলির সন্ধান পেয়েছি৷ এবার গঙ্গাজলেই গঙ্গাপূজা করব৷ অর্থাৎ, শংকরের ভাষ্য অনুসরণ করেই এদের মোটামুটি পরিচয় দিতে চেষ্টা করব৷
উপনিষদ-পাঠের পূর্বে অধ্যাপক বা আচার্যের ও তাঁর শিষ্যের বা ছাত্রের কয়েকটি অবশ্য-কর্তব্য পালনের কথা লেখা হয়েছে৷ প্রথমত, তাঁরা উভয়ে একসঙ্গে এ-শাস্ত্র পাঠ করবেন৷ দ্বিতীয়ত, আচার্য তাঁর শিষ্য নিজে মনোনয়ন করবেন, শিষ্যও নিজে আচার্য বরণ করবেন৷ তাঁদের উভয়ের মধ্যে যে এক গড়ে উঠবে তা হবে দৃঢ় ও স্বাভাবিক৷ তৃতীয়ত, শিষ্য প্রাথমিক তপস্যা দ্বারা নিজেকে শিক্ষালাভের যোগ্য না করলে তাঁকে শিক্ষাদান অসম্ভব৷ আচার্যকেও আত্মজ্ঞ বা ব্রহ্মজ্ঞ হতে হবে৷
প্রতিটি উপষিদই শুরু হয়েছে যে মন্ত্র দিয়ে, শেষও হয়েছে সে মন্ত্রটি উদ্ধৃত করেই৷ এ মন্ত্রটি কিন্তু বেদানুগ, অর্থাৎ উপনিষদটি যে বেদের অংশ, সে বেদ-সংযুক্ত সমস্ত উপনিষদের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য৷ যেমন, বৃহদারণ্যক ও ঈশ উপনিষদ দুইটি শুক্ল-যজুর্বেদের অংশ, কাজেই একই মন্ত্রেই এ দুটি উপনিষদের শুরু ও শেষ৷ যজুর্বেদের বিভাগ ধরে বেদ পাঁচটি; কাজেই এ মন্ত্রের সংখ্যাও পাঁচ৷ এ পাঁচটি মন্ত্রকে বলা হয় শান্তিমন্ত্র৷ এ শান্তিমন্ত্র পাঠ করতে হয় প্রত্যেক উপনিষদের শুরুতে ও শেষে৷ সব-কয়টি শান্তিমন্ত্রই বেদ থেকে গৃহীত হয়েছে৷
এ শান্তিমন্ত্র কয়টি সত্যি মনোরম এবং উন্নত মানব-মনের আকাঙ্ক্ষা ও প্রার্থনার অপূর্ব নিদর্শন৷ অনেকে হয়তো বেদ বা মূল উপনিষদগুলি পাঠ করেননি, কিন্তু এ শান্তিমন্ত্রের কোনো-না-কোনোটি যে তাঁদের কানে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই৷ এ কয়টির মধ্যে যে দু-তিনটির সাধারণের কানে আসার বিশেষ সম্ভাবনা, আমরা এখানে সেগুলিরই পূর্ণ রূপ ও অর্থ উদ্ধৃত করছি৷
১
অথর্ব বেদের শান্তিমন্ত্র :
 ”ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা৷
 ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ৷
 স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টু বাংসস্তনূভি-
 ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ৷৷
 ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ৷’’
হে দেবগণ, আমরা কর্ণে যেন শুচি-বাক্যই শ্রবণ করি, চক্ষে যেন কল্যাণময় দৃশ্যই দেখি৷ সুস্থ দেহে, ভগবানের প্রার্থনারত হয়ে, দেবগণেরও আকাঙ্ক্ষিত যে আয়ু তা যেন ভোগ করতে পারি৷
[এক্ষেত্রে স্মরণীয়, উপনিষদ-স্রষ্টাদের মানসলোকে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য ও নিত্য৷ দেবত্বও ক্ষণস্থায়ী, নিত্য নয়৷]
শান্তি, শান্তি, শান্তি৷
২
শুক্ল-যজুর্বেদীয় শান্তিমন্ত্র :
 ”ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে৷
 পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে৷৷
 ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ৷’’
বিশ্বজগতে ইন্দ্রিয়াতীত বস্তুগুলি সনাতন ব্রহ্মদ্বারা পূর্ণ৷ ইন্দ্রিয়-গোচর বস্তুও ব্রহ্মদ্বারা ব্যাপ্ত৷ ইন্দ্রিয়াতীত বা ইন্দ্রিয়গোচর সমস্ত বস্তুই একমাত্র ব্রহ্মেরই অভিব্যক্তি৷ ব্রহ্ম পূর্ণস্বভাব; তাই তাঁর ব্যাপ্তি ও বিস্তার যতই প্রসারিত ও ব্যাপক হোক-না-কেন, তিনি নিরন্তর চিরপূর্ণই থাকেন৷
৩
”ওঁ সহ নাববতু৷ সহ নৌ ভুনক্তু৷ সহ বীর্যং কারবাবহৈ৷
তেজস্বি নাবধীতমস্তু, মা বিদ্বিসাবহৈ৷
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ৷৷’’
ব্রহ্মন্! আমাদের উভয়কেই, অর্থাৎ আচার্য ও শিষ্যকে রক্ষা করুন৷ আমাদের উভয়কেই বিদ্যা বা জ্ঞানের ফলদান করুন৷ আমরা উভয়েই যেন জ্ঞানলাভের শক্তি সঞ্চয় করতে পারি, কেউ কাকেও বিদ্বেষ না করি৷
শান্তিমন্ত্র-পাঠের সঙ্গে সঙ্গে এবার আমরা উপনিষদের সিংহদ্বারে পৌঁছে গেছি৷ এবার শুরু হবে তীর্থ পরিক্রমণ৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন