ঈশ্বর-প্রয়োজন সত্যই কি আছে?

ঈশ্বর-প্রয়োজন—সত্যই কি আছে?

আধুনিক মানুষের কত অসংখ্য জিনিসেরই না প্রয়োজন ! বহু সামগ্রী-পুষ্ট বিশাল কোন একটি বিভাগীয় বিপণীর অন্দরমহলে ঢুকলেই এ বিষয়ে প্রত্যক্ষ ধারণা হবে। কিন্তু সেখানেও তার প্রয়োজনের এক অতি ক্ষুদ্রভগ্নাংশেরই মাত্র হদিশ পাওয়া যায়। অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় প্রভৃতি মানুষের কিছু মৌলিক চাহিদা ছাড়াও তার কিছু চিরাচরিত প্রয়োজনও আছে— যা চিরাচরিত বলেই তার পক্ষে অপরিহার্য। উপরন্তু তার প্রয়োজন আছে বিলাস সামগ্রীর, তার প্রয়োজন আছে কাল্পনিক অসংখ্য জিনিসের এবং তার প্রয়োজন আছে হাজারো অপ্রয়োজনীয় প্রয়োজনের।

কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, অমুক জিনিসটার প্রয়োজন কাল্পনিক অথবা অমুক জিনিসটি অপ্রয়োজনীয় একথা বলার অধিকার আমাদের কোথায়? এরূপ বললে আমাদের জীবনটাই অনাবশ্যক জটিল হয়ে উঠতে পারে, সন্দেহ নেই। অপরের কাছে যতই তুচ্ছ মনে হোক না কেন ব্যক্তিগতভাবে কারও হয়তো বিশেষ কোন জিনিসটির প্রয়োজন থাকতে পারে এবং তা তার পক্ষে একান্ত জরুরী একথা মনে করারও যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। অবশ্য সে কারণ যুক্তিযুক্ত কিনা তা ভিন্ন ব্যাপার।

কিন্তু আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘যুক্তিযুক্ত’ কার মতে? যে জিনিসে প্রয়োজন নেই মানুষ তা চায় না। সেরূপ ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রয়োজন কিছু থাকলেও ক্রমশই তার সে প্রয়োজন ফুরিয়ে আসতে থাকে।

অবশ্য আমরা নিজেরা যদি কোন বিশেষ বস্তুর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন নাও থাকি, তাহলেও তার প্রস্তুতকারকদের ভাড়া করা T.V. প্রভৃতি প্রচার মাধ্যমে সযত্ন চর্চিত মধুরতম হাসির সাহায্যে আমাদের জানিয়ে দেবে যে, যদি আমরা আধুনিক সংস্কৃতিবান ও কেতাদুরস্ত বলে সমাজে স্বীকৃতি পেতে চাই তবে যেন আমরা তার উৎপাদিত ঐ বিশেষ জিনিসটির ব্যবহার শুরু করি। আর্থিক উন্নত দেশগুলিতে আজকাল প্রতি পরিবারে গোটা দুই গাড়ি রাখা বিশেষ কোন ব্যাপারই নয় ; কিন্তু তাদের প্রয়োজন হলো কিছুদিন পরপরই গাড়িগুলোর মডেল বদল করা। কেবল পোশাক-পরিচ্ছদেই আমাদের প্রয়োজন ফুরায় না, আমাদের প্রয়োজন হয় ক্ষণে ক্ষণে তার ফ্যাশান বদল করা। কেবল আভরণেই আমরা তুষ্ট নই, আমরা চাই তার নিত্য নূতন ডিজাইন পরিবর্তন। আমাদের আকাঙ্ক্ষা কেবল প্রয়োজনীয়তার তালিকাবৃদ্ধি করাই নয়, আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে আধুনিকতম জিনিসটির।

গণতন্ত্রের মোলায়েম ভাষায় ‘অবাধ অর্থনীতি‘র মোদ্দা কথা হলো অধিক ব্যয়-ক্ষমতা। কিন্তু অধিক ব্যয়-ক্ষমতার প্রকৃত অর্থ কি?—অধিক ক্রয়-ক্ষমতা। আর ক্রয়ের অর্থ?—আরও আরও বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। অন্য কথায় আমাদের সেই বাসনার দাস করা, যা আমাদের অন্তহীন চাহিদাকে জীইয়ে রাখতে পারে। ভোগ্যপণ্যের অবিরাম সরবরাহের ফলে আমাদের ভোগজনিত আনন্দের ক্ষেত্রে ক্রম হ্রাস ঘটে। তাই ভোগের মায়াজাল সৃষ্টির জন্য ভোগ্যপণ্যের রকমফের করা হয়। এভাবে অর্থ-বিনিয়োগকে অব্যাহত রেখে শিল্পের চাকাকে সচল রাখা হয়। অর্থনীতির এই সূত্রটির গভীরে প্রবেশ করে চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তার সাফল্য নির্ভর করে আমাদের চাহিদার প্রবণতার উপর। অন্য কথায় অর্থনীতির মেরুদণ্ডের সরলতা নির্ভর করছে মূলতঃ কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টির উপর।

যে সমাজে কৃত্রিম প্রয়োজনের সৃষ্টি অনবরত হয়েই চলেছে, সেখানে একজন মানুষের পক্ষে, এমনকি উচ্চস্তরের একজন মানুষের সন্তোষপূর্ণ জীবনযাত্রার পক্ষে কত স্বল্পতম জিনিসের প্রয়োজন তা ধারণা করাও সম্ভব নয়। মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে দেখা গেল আছে মাত্র একটি চরকা, গুটিকয় খদ্দরের কাপড়, কিছু বই-পত্র, দুজোড়া পাদুকা—একজোড়া চামড়ার, আর একজোড়া কাঠের, একটি লাঠি, একজোড়া চশমা, একটি কলম, লেখার টেবিল, কাপ, চামচ, ঘড়ি, জপের একটি মালা এবং ভাবব্যঞ্জক বিখ্যাত সেই ‘তিন বানরের’ একটি মূর্তি। একজন মানুষের পক্ষে স্বল্পতম কতটুকু প্রয়োজন তা জানাই হলো প্রকৃত শিক্ষা।

আমাদের প্রয়োজন কতটুকু তা যে সব সময় আমরা নিজেরাই স্থির করি তা নয়। সে দায়িত্বটি নেয় অন্যে। এবং তা-ই হলো আমাদের বন্ধনের কারণ। ‘অবাধ অর্থনীতি‘র তত্ত্বে নির্ভরশীল ভোগ্যপণ্যের প্রস্তুতকর্তা বলে, “তোমাদের এই এই জিনিসটির দরকার” এবং অবশেষে আমাদের এমনটি ভাবতে বাধ্য করে যে উক্ত জিনিসের যেন আমাদের অতি অবশ্যই প্রয়োজন। যাকে বলা যায় ‘authoritarian economy’ (কর্তৃত্বময় অর্থনীতি)। সেখানে রাষ্ট্র বলে, “তোমার এ জিনিসটির প্রয়োজন” -এবং জনগণও তা মানতে বাধ্য হয় । তারা হয়তো চায় আরও অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়, কিন্তু রাষ্ট্র বলে, “না, তোমার প্রয়োজন ইস্পাতের”–এবং জনগণও তা স্বীকার করতেই বাধ্য।

আমরা জানি, নিছক জৈবিক প্রয়োজন ব্যতীত মানুষের আরও কিছু চাহিদা রয়েছে। তার হৃদয়ের আবেগজাত চাহিদা আছে, আছে বৌদ্ধিক ও সামাজিক চাহিদা। সত্যি বলতে কি, তার চাহিদার তালিকা অনন্ত এবং একান্ত ভীতিপ্রদ।

অধ্যায় ১ / ৮

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন