প্রশ্ন হতে পারে, ঈশ্বর যদি আমাদের একান্তই মৌল প্রয়োজন, তবে কেন অধিকাংশ মানুষই সে বিষয়ে সচেতন নয়?
প্রথমতঃ এই কথাটি পরিষ্কার করে নেওয়া ভাল যে, প্রয়োজন সম্পর্কে অনবহিত থাকাটা তার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বকে অপ্রমাণ করে না। সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতা সত্যকে বাতিল করে দেয় না। এটি অতি বাস্তব সত্য যে, বেশির ভাগ মানুষই তার ঈশ্বর প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন নয়। তথাপি তাঁর প্রয়োজন মানুষের পক্ষে একান্ত সত্য। কেন সে তার এই পরম প্রয়োজনটি সম্পর্কে উদাসীন, তার দুটি কারণ বিদ্যমান। প্রথম কারণ, আমাদের উপাধি যা আমাদের সত্য দৃষ্টিকে আবরিত করে রাখে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে বিভূতি, যা আমাদের আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক স্বরূপ এবং যা জড়ের সীমানায় আমাদের বন্দী করে রাখে। এই উপাধি কি? আর বিভূতিই বা কি?
বেদান্ত মতে মানুষ স্বরূপতঃ দিব্য চৈতন্যস্বরূপ, আত্মা, যা পরমতত্ত্ব ব্রহ্ম হতে অভিন্ন।
কিন্তু তৎসত্ত্বেও মানুষ মায়ার বশে তার স্থূল দেহের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলে। আত্মা হতে ভিন্ন আর যা কিছু বহিরঙ্গ—দেহ-মন-বুদ্ধি প্রভৃতি এবং অপর যাকিছু জাগতিক বিষয় মানুষ ইহজীবনে সংগ্রহ করে, যথা— আত্মীয়-সম্পর্ক, শিক্ষা-সংক্রান্ত বিভিন্ন উপাধি, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠা এসকলই তার উপাধি। এই উপাধিসকলের মোহে পড়ে মানুষ তার স্বরূপ ভুলে যায়। এই বিস্মৃতির ফলেই তার পক্ষে সম্ভব হয় ঈশ্বর-প্রয়োজনকে অনুভব না করা।
সত্যলাভের সাধনায় অগ্রসর হওয়ার পথে আমাদের কাছে কতকগুলি শক্তির আবির্ভাব ঘটে, সাধারণভাবে এই শক্তিগুলিকেই বলা যায়, বিভূতি। এই বিভূতিরূপ শক্তিগুলি আধ্যাত্মিক অথবা জাগতিক দুই-ই হতে পারে।
এগুলি যেন একপ্রকার খেলনা, যা আমাদের পথভ্রষ্ট করে। যদি আমরা সেই তুচ্ছ শক্তির চমৎকারিত্বে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ি, তাহলেই আমাদের সকল আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তখনই আর আমরা ঈশ্বরের প্রয়োজন বোধ করি না।
মা কাজে ব্যস্ত থাকলে ছেলের হাতে খেলনা দিয়ে তাকে ভুলিয়ে রাখে। ছেলেও খেলনা পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য মাকে সম্পূর্ণ ভুলে খেলনা নিয়েই আনন্দে খেলতে থাকে। কিন্তু যখন মাকে মনে পড়ে, তখন এক নিমেষে সে সব ফেলে ‘মা যাব’ বলে কাঁদতে শুরু করে। শিশু যখন কান্নাকাটি করে মাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, মা তার হাতের কাজ ফেলে, তার উপন্যাস, টি.ভি., রেডিও, রান্না-বান্না ইত্যাদি ফেলে এসে তাকে কোলে তুলে নেন।
শিশু যেমন খেলনা নিয়ে মেতে থাকে, আমরাও তেমনি আধুনিক বিজ্ঞানের বিভূতি নানা প্রকার ভোগ্যবস্তু নিয়ে মশগুল হয়ে থাকি। হয় মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে লাল চুষি নিয়ে খেলি অথবা বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে আমরা পেশী আর মস্তিষ্ক আস্ফালন করে নেতৃত্ব নিয়ে লড়াই করি ; উভয়ক্ষেত্রেই আমরা সেই খেলনা নিয়েই খেলা করি। তাহলে আমরা ভগবানের প্রয়োজনবোধটা করব কখন?
উপাধিসমূহের অসারত্ব অথবা বিভূতিলাভের বিপদ উপলব্ধি করতে আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা সহায়েই অগ্রসর হতে হবে। যতদিন সে অভিজ্ঞতা না হচ্ছে, আধ্যাত্মিক জাগরণ-যা ঈশ্বরের প্রয়োজন বোধ করাতে সাহায্য করে, তা ঘটে না। অর্থাৎ, প্রতিটি ব্যক্তির বোধোদয় হবার জন্য সময়রূপ একটা ব্যাপার কাজ করে। কেউ কেউ অতি কম বয়সে ঈশ্বরের অভাব বোধ করে, আবার কেউ বা পরিণত বয়সেও তা বোধ করে না। বাহ্যিক হাব-ভাবে কেউ খুব ধর্মভাবাপন্ন বলে প্রতিভাত হলেও, অন্তরে সে হয়তো কখনো ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা বোধ করেনি। আবার অন্যপক্ষে ; কারাকক্ষে বন্দী এক অপরাধীও হয়তো অন্তরে অন্তরে ভগবানের জন্য প্রবল তৃষ্ণা অনুভব করছে। একজন সাধক আন্তরিকভাবে কতটা আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন অন্তর্দ্রষ্টা ব্যতীত আর কারও পক্ষে তা জানার উপায় নেই। আমরা নিজেরা যতদিন সেরূপ অন্তর্দ্রষ্টা হতে না পারছি, ততদিন বক্তৃতা অথবা উপদেশাদি দ্বারা অপরকে ঈশ্বর সাধনায় ব্রতী হতে অনুপ্রাণিত করতে পারি না। অপরের চেষ্টার দ্বারা ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না।
এ ব্যাপারে কি তবে কারও কিছুই করার নেই? না। কেবলমাত্র সমগ্র জগতময় ধর্মের বাণী প্রচার করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। হয়তো পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে সে দিব্য বাণীর এক অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ উপযুক্ত ভূমিতে পতিত হয়ে কোন এক মহাপ্রাণকে ঈশ্বরলাভের ব্যাকুলতায় উদ্বেল করে তুলবে। সেরূপ উন্মুখ হৃদয় বাহির হতে এতটুকু অনুপ্রেরণা পেলেই দপ্ করে জ্বলে ওঠে।
এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধ এবং ব্রহ্মাসম্পাতির কাহিনীটি স্মরণ করা যেতে পারে। বোধিলাভের অব্যবহিত পরে বুদ্ধ দীর্ঘ ঊনপঞ্চাশদিন নির্বাণের প্রগাঢ় আনন্দে নির্জনে মগ্ন ছিলেন। প্রথমে তিনি তাঁর উপলব্ধ সত্য প্রচারে নিরুৎসাহ ছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল সাংসারিক মানুষ সে উচ্চতত্ত্ব ধারণা করতে পারবে না। সুতরাং, তিনি তা প্রচার করা থেকে বিরত থাকবেন, এরূপ স্থির করেছিলেন। তাঁর সে-সিদ্ধান্ত অনুধাবন করে ব্রহ্মাসম্পাতি বিচলিত হলেন। কথিত আছে; তিনি স্বর্গ হতে অবতরণ করে বুদ্ধের সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁর চরণ বন্দনা করে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, বুদ্ধ যেন জগতে তাঁর বাণী প্রচার করেন। যে যুক্তির জোরে অবশেষে বুদ্ধ তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে রাজি হয়েছিলেন, তা হলো, “এমন কোন কোন পবিত্রাত্মা পৃথিবীতে আছেন সংসারের মালিন্য যাঁদের এতটুকুও স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁরা যদি বুদ্ধের এই মহান বাণী না জানতে পারেন তাহলে তাঁরা নিঃশেষে বিলীন হয়ে যাবেন ; আর যদি তাঁরা তা জানার সুযোগ পান, তাহলে তাঁরা তা গ্রহণ করবেন এবং নির্বাণ লাভ করবেন।”
অবশ্য একথাটি স্বরণ রাখা ভাল যে, আমরা কেউ বুদ্ধ নই। আমাদের পক্ষে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, বন্ধু অথবা পাড়া-প্রতিবেশী প্রভৃতি ঈশ্বরের জন্য কে কতটা আগ্রহী তা জানার বিশেষ আবশ্যকতা নেই। আমাদের পক্ষে যে প্রশ্ন একান্তই ব্যক্তিগত তা হলো, ‘আমি নিজে ঈশ্বরের জন্য কতটা ব্যাকুল?’ সকল ছল চাতুরী ত্যাগ করে আমরা যেন নিজেদের মধ্যেই তার জবাব খোঁজার চেষ্টা করি প্রত্যূষের শান্ত মুহূর্তে অথবা রাত্রির নির্জন গভীরে। এই প্রশ্নই যেন শুধাই নিজেদের, যখন আমরা সাফল্যের সুউচ্চ শিখরে অবস্থিত থাকব এবং যখন আমরা বিফলতার সঙ্কটময় মুহূর্তে পতিত হব—তখনো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন