ঈশ্বরই মানুষের চরম প্রয়োজন

ঈশ্বরই—মানুষের চরম প্রয়োজন

ধর্ম মানুষের মানুষের একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন । সৌভাগ্যক্রমে ডঃ জুয়াং-এর নেতৃত্বে একদল মনস্তত্ববিদ্‌ একথা স্বীকার করছেন। ডঃ জুয়াং তাঁর বিখ্যাত পুস্তক ‘Modern Man in Search of a Soul’ পুস্তকে জানিয়েছেন :

জীবনের দ্বিতীয় ভাগে উপনীত, ধরা যাক পঁয়ত্রিশ বৎসর উত্তীর্ণ, আমার সকল রোগীদের মধ্যে এমন একজনও পাওয়া যাবে না, যার অন্তিম আশ্রয়ের সমস্যা জীবনের মধ্যে একটা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির খোঁজ করা নয়। ”

এটি শুভ সঙ্কেত যে, আজ কিছু মনস্তত্ত্ববিদ স্বীকার করেছেন যে ধর্ম মানুষের একটি মানসিক প্রয়োজন। কিন্তু এ স্বীকৃতি আজও ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়নি যে, ঈশ্বরকে-ই মানুষের প্রাথমিক ও জৈবিক প্রয়োজন। যেহেতু ঈশ্বর তার মৌল প্রয়োজন, সেইজন্য ধর্ম ও তার মানসিক প্রয়োজন।

কিন্তু ধর্ম অথবা ঈশ্বর যে মানুষের অপরিহার্য এবং মৌল প্রয়োজন একথার তাৎপর্য কি ? আচ্ছা, একটা বৃক্ষের কথা ধরা যাক। তার বৃক্ষ-জীবন সার্থক করতে, পরিপূর্ণতা লাভ করতে তার চাই আলো-বাতাস-জল । এগুলি হলো তার মৌলিক প্রয়োজন। তা স্বাভাবিক অথবা কৃত্রিম যে ভাবেই যোগান হোক না কেন, তা বিচাৰ্য নয়, কিন্তু এই তিনটি উপাদানই তার মূল প্ৰয়োজন।

অনুরূপ ভাবে, মানব-জীবনেও পরিপূর্ণতা লাভ করতে হলে তার অতি অবশ্য প্রয়োজন ঈশ্বরকে। ঈশ্বর ছাড়া জীবনের কোন পূর্ণতা নেই। এবং পরিপূর্ণতার অন্য নামই ঈশ্বর। ঈশ্বরই উপায়, ঈশ্বরই পরিণতি। “আমিই উপায়, আমিই সত্য, আমিই জীবন” – বলেছেন যীশু। ঈশ্বর মানুষের প্রয়োজন কারণ, তাঁকে অবলম্বন না করে সে পরিপূর্ণতার পথে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারে না।

মানব-জীবনের পরিপূর্ণতার অর্থ কি? এটি হলো সেই অবস্থা, যেখান পৌঁছে মানুষ তার সত্য স্বরূপকে উপলব্ধি করে এবং সেই উপলব্ধির ফলস্বরূপ সে জীবনের সকল বন্ধন হতে মুক্তি পায় ; তার সকল আশা আকাঙ্ক্ষার বিলয় হয় এবং অসীমের স্তরে উত্তরণ ঘটে।

মানুষের মনে প্রতি মুহূর্তে যে অসংখ্য বাসনার বুদ্বুদ সশব্দে উত্থিত হচ্ছে, সে সকল বিশ্লেষণ করে তিনটি মূল সূত্রে তাদের প্রকাশ করা যায়ঃ

(১) মানুষ মরতে চায় না, সে চায় অমর হতে।

(২) মানুষ চায় সকল অজ্ঞানতার ঊর্ধ্বে উঠতে। সে চায় সবকিছু জানতে, অর্থাৎ চায় সর্বজ্ঞ হতে।

(৩) মানুষ সকল প্রকার দুঃখ অতিক্রম করতে চায়, সে চায় শাশ্বত আনন্দময় হয়ে থাকতে। এইগুলি মানুষের অতি কাল্পনিক অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা, নয় কি? এর উত্তর, জাগতিক দৃষ্টিতে ‘হ্যাঁ’, কিন্তু পারমার্থিক দৃষ্টিতে ‘না’

মানুষ যদি নিছক দেহ-সর্বস্ব অস্থি-রক্ত-মাংস সমন্বিত এক জড়পিণ্ডমাত্র হয়, যা স্থান কাল ও কার্য-কারণ সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত, তাহলে তার পক্ষে কখনই সর্বজ্ঞ, শাশ্বত, অথবা চির আনন্দের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের শাস্ত্র বলেছেন, মন-বুদ্ধি-দেহধারী এই মানুষটি প্রকৃতপক্ষে তার অন্তঃস্থিত যে দুয়ে আত্মা, তারই ছদ্মবেশ মাত্র। আত্মার প্রকৃত ধর্ম সৎ চিৎ ও আনন্দ—সত্য, জ্ঞান, আনন্দ। অতএব, পারমার্থিক দৃষ্টিতে মানুষের এই আকাঙ্ক্ষা অতি স্বাভাবিক। তার সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় যদি সে তার আত্মার স্বরূপকে জানতে পারে, উপলব্ধি করে যে সে স্বয়ং আত্মস্বরূপ। এই অর্থেই মানুষের প্রয়োজন ভগবানকে, কারণ তিনি তার মৌলিক উপাদান ।

উপরোক্ত ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের কোন ভূমিকার উল্লেখ নেই। তাহলে মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের, যাঁর কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর সম্পর্ক কি? আর আত্মার সঙ্গেই বা তার কি সম্পর্ক?

স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় বলা যায়ঃ

সামঞ্জস্য যদি এই বিশ্বের বিধান হয়, তাহা হইলে বিশ্বের প্রতিটি অংশ সামগ্রিকভাবে একই পরিকল্পনা অনুসারে নির্মিত হইবে। সুতরাং আমরা স্বভাবতই মনে করিতে পারি যে, যাহাকে আমরা এই ‘বিশ্ব’ বলি, তাহার স্থূল জড়রূপের অন্তরালে সূক্ষ্মতর উপাদানের একটি বিশ্ব নিশ্চয়ই আছে; তাহাকেই আমরা বলি মনন বা চিন্তা। আবার তাহারও অন্তরালে আছেন আত্মা—যিনি এই সব চিন্তাকে সম্ভব করেন, যিনি আদেশ দেন, যিনি এই বিশ্ব-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাজা। প্রতিটি মন এবং প্রতিটি দেহের অন্তরালে যে আত্মা, তাহাকেই বলে জীবাত্মা; আর বিশ্বের অন্তরালে ইহার

প্রত্যগাত্মা—চালক শাসক ও নিয়ামকরূপী যে আত্মা, তিনিই ঈশ্বর।” (বাণী ও রচনাঃ ২য়ঃ পূঃ ২৬২ নবম সং—১৯৮৯ ইং)

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন