এই জগতে একশ্রেণীর সৎ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে যাঁরা নিজেদের কম্যুনিষ্ট অথবা নাস্তিক বলে প্রচার করেন না, কিন্তু তাঁরা পূজাবেদীর চেয়ে গবেষণাগার, দেবালয় অপেক্ষা পরমাণু চুল্লী, ধ্যান অপেক্ষা নিঃস্বার্থপরতা, ধর্মতত্ত্ব অপেক্ষা কারিগরি-বিদ্যা, জপ-তপাদি অপেক্ষা সংখ্যাতত্ত্ব চর্চায় অধিকতর উৎসাহী। তাঁরা নৈতিক জীবনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন, কিন্তু তার জন্য ঈশ্বরের কোন ভূমিকা আছে বলে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা একধরনের নৈতিক শুদ্ধতা রক্ষার প্রয়োজন স্বীকার করেন, কিন্তু আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তার দাবি নাকচ করে দেন। তাঁরা বলেন, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সদাচরণের প্রয়োজন আছে; কিন্তু সৎ হতে হলে আমরা ঈশ্বর নামক এক শাসনকারীর আমদানি করতে রাজি নই। অধিকন্তু, তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কেও সন্দেহের অবকাশ আছে। ঈশ্বর অন্বেষণের অর্থ মিথ্যা মরীচিকার পশ্চাতে বৃথা ছোটাছুটি করা এবং সেরূপ উদ্যোগ সংসার-জীবনে অহেতুক সমস্যারই সৃষ্টি করে থাকে।
এই জাতীয় সৎ ব্যক্তিগণ একটি সমাজের প্রত্যাশা করে থাকেন সত্য কথা, এবং তাদের বিশ্বাস সৎ জীবনই হলো সৎ সমাজের ভিত্তি ভূমি; তাই ঈশ্বর সেখানে নিষ্প্রয়োজন।
স্বভাবতই তাই প্রশ্ন জাগে—সৎ চরিত্রের প্রকৃত সংজ্ঞা কি? সাধারণভাবে তার অর্থ—অপরের ক্ষতি না করা, আপনাপন কর্তব্য যোগ্যতার সঙ্গে নিঃস্বার্থভাবে সম্পন্ন করা এবং জীবনের দুর্যোগ ও সঙ্কটকালে মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখার অনুশীলন করা।
এখন পুনরায় প্রশ্ন করা যায়, কোন্ প্রেরণা মানুষকে সৎ জীবন যাপনে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত করে রাখবে? সৎ জীবন যাপনে কি তার প্রেরণা? উচ্চতর নিঃস্বার্থপরতার লক্ষ্যে কে তাকে অগ্রসর করাবে? তার দ্বন্দ্ব ও সন্দেহের নিরসন কে করবে? তার সৎ হবার মূল যুক্তি কি? স্বার্থগত কারণে কি মানুষ সৎ থাকতে পারে? সঙ্কটকালে, প্রলোভনের হাত-ছানিতে অধিকার খর্বের সন্ধিক্ষণে মানুষকে ন্যায় ও নীতি আঁকড়ে থাকার শক্তি যোগাবে কে?
কেউ নয়, কিছুটি নয়। সর্বকালে সর্ব-পরিস্থিতিতে মানুষকে সৎ থাকার শক্তি একমাত্র ঈশ্বর ব্যতীত আর কেউই দিতে পারে না। আমাদের শাস্ত্র, আমাদের ঋষি মহাপুরুষদের বাণীই তাই। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন
“বিষয়া বিনির্বতন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ রসঃবর্জ্যং রসোঽপাস্য পরৎ দৃষ্ট্বা নির্বততে৷” (২/৫৯)
কৃচ্ছ্রতা সাধন করে ইন্দ্রিয়সকল দমন করলেও তার বিষয়সকল—কাম-ক্রোধ-লোভ প্রভৃতি রিপুসমুহ সূক্ষ্মভাবে মনের গোপনে বাসা বেঁধে থেকে যায়। একমাত্র ঈশ্বরলাভ হলেই মানুষের বিষয়-ভোগ-বাসনা ত্যাগ হয় ৷ অর্থাৎ, কৃচ্ছ্রসাধনকারী প্রলোভনে পড়ে পুনরায় বিষয়াসক্ত হতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের আকর্ষণই তাকে সে পথ হতে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম। একমাত্র ঈশ্বরলাভ হলে তবেই তার বিষয়-ভোগ-বাসনা নিঃশেষে দগ্ধ হয়ে যায় এবং তখন সে হয় সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত।
এখন, যে ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা কখনো অনুভব করেনি, সে যে চিরকাল সর্বাবস্থায় সৎ থাকবে তার নিশ্চয়তা কি? কিছুই না। অতি অল্পমাত্র মানসিক দ্বন্দ্বের সঙ্কটমুহূর্তে তার সৎ থাকার প্রতিজ্ঞা ভেসে যেতে পারে। তার ফলে সে হীন প্রবৃত্তির দাস হয়ে এবং মন্দ শক্তির সামিল হয়ে সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
সেজন্য ভারতবর্ষের এক প্রাচীন ঋষি এবং নীতিবিদ্ তিরুবল্লুবার বলেছেন,
“ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধরে থাক প্রাণপণে। যে-সকল বন্ধন তোমার আত্মাকে বন্দী করে রেখেছে তা ছিন্ন করে, যদি মুক্তি পেতে চাও, তাহলে তাঁর বন্ধনকে অটুট রাখ।”
অপর এক মহাপুরুষ নাম্মালবার বলেছেন,
“বন্ধন ঘুচলেই মুক্তির আলো। যদি আসক্তি হতে সম্পূর্ণ মুক্তি পেতে চাও এবং অনাসক্তিতে চিরপ্রতিষ্ঠিত হতে চাও তবে নিজেকে ঈশ্বরে নিঃশেষে সমৰ্পণ কর।”
যারা সৎ হতে চায় এবং একটি আদর্শ সমাজ গঠনের আশা করে তারা যদি তাদের আদর্শের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিকগুলি নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করে দেখে, তাহলে তারা উপলব্ধি করবে যে ঈশ্বরকে উড়িয়ে দেওয়ার কোন যুক্তিই থাকতে পারে না। অবশ্য এ-কথার দ্বারা আমরা এমনটি বুঝাতে চাই না যে ঈশ্বরকে আদর্শ সমাজ গঠনের এক পবিত্র মশলারূপে মাত্র গণ্য করা হোক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন