অর্ধবৃত্ত – ৩৫

সাদাত হোসাইন

রফিকুল আলম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হঠাৎ করেই মোড় নিয়েছে। রফিকুল আলমের স্ত্রী জান্নাত স্বামীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের লকার খুঁজতে গিয়ে একটা মোবাইল ফোন পেয়েছেন। সম্ভবত চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে ফোনটি বন্ধ হয়ে আছে। সমস্যা হচ্ছে ফোনটিতে পাসওয়ার্ড দেয়া থাকায় চার্জ দেয়ার পরও ফোনটি খোলা যায়নি। সেই ফোন তিনি জমা দিয়েছেন আতাহার মিয়ার কাছে। বিষয়টা এই তদন্তে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো মনে হয়েছিল আতাহার মিয়ার। কিন্তু রহস্যময় ব্যাপার হচ্ছে সেই ফোন থেকেও পুলিশ তেমন কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি। ফোনে কোনো নম্বর সেভ পাওয়া যায়নি। এমনকি কোনো মেসেজও না। তবে এই ফোনে কখনো কোনো ফোন এসেছিল কিনা কিংবা কোনো নম্বরে ফোন গিয়েছিল কিনা সেটা খুঁজে বের করার জন্য পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সহায়তা নেয়া হয়েছিল। তাতে অবশ্য একটা ক্লু পাওয়া গেছে। যদিও সেই ব্লু পুরো বিষয়টিকে পরিষ্কার করার পরিবর্তে আরো ঘোলাটেই করে ফেলল। সর্বশেষ প্রায় বছর খানেকের মধ্যে এই নম্বর থেকে কোনো ফোন করা হয়নি। কোনো ফোন আসেওনি। তবে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট জানিয়েছে বছর খানেক আগে নিয়মিত একটি নম্বরে এই ফোন থেকে ফোন করা হতো। এমনকি সেই নম্বর থেকে ফোনও আসত এই নম্বরটিতে। পুলিশ সেই কল লিস্ট উদ্ধার করতে পেরেছে। সমস্যা হচ্ছে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর পলিসির কারণে এত আগের কল রেকর্ড খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর আগের ফোনকল রেকর্ড ফোন কোম্পানিগুলো মুছে ফেলে। তবে কল লিস্টে ওই একটামাত্র নম্বরই পাওয়া গেছে।

কল রেকর্ড না পাওয়ায় আতাহার মিয়া কিছুটা হতাশ হলেও তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন রফিকুল আলম হত্যাকাণ্ডে এই ফোনের গুরুতর ভূমিকা রয়েছে। কারণ রফিকুল আলমের ব্যবহার করা এমন গোপন একটা ফোনের কল লিস্টে একটামাত্র নম্বর থাকা যথেষ্ট সন্দেহজনক। যদিও সেই ফোন শেষবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে বছরখানেক আগে। তারপরও তিনি মনে করছেন, এই ঘটনায় এটি কোনো শক্ত ব্লু হয়ে উঠতে পারে। এবং সেই ব্লু থেকেই তিনি যথাযথ তদন্ত করতে সক্ষম হবেন। এই নতুন সম্ভাবনাটি তাকে একভাবে উত্তেজিতও করে তুলেছে।

চারপাশের পরিস্থিতি দেখে আতাহার মিয়া মনে মনে বিশ্বাস করেন, এই খুনের সাথে ফজলে নূর জড়িত নয়। বরং রাজনৈতিক কারণেই তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আশার ব্যাপার হচ্ছে, রফিকুল আলমের স্ত্রী জান্নাত বিষয়টা নিয়ে ওপর মহলে কথা বলেছেন। তারা ফজলে নূরকে আটক রেখেই মামলার যথাযথ ও নিরপেক্ষ তদন্তের বিষয়ে সবুজসংকেত দিয়েছেন। যদিও বিষয়টা নিয়ে আকবর আলী যারপরনাই বিরক্ত। কিন্তু এই নিয়ে এখন আর খুব একটা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই তার।

আতাহার মিয়া এসেছেন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে। সেখান থেকে একটা অদ্ভুত তথ্য দেয়া হলো। তথ্যটি হলো, প্রায় বছর পাঁচেক আগে মধু মিয়া নামক এক ব্যক্তির নামে রফিকুল আলমের ব্যবহার করা গোপন সিমটি নিবন্ধিত হয়। শুধু যে রফিকুল আলমের ব্যবহার করা সিমটিই মধু মিয়ার নামে নিবন্ধন করা, তা-ই নয়, বরং এই সিম থেকে যে নম্বরে কথা বলা হয়েছিল সেই নম্বরটিও মধু মিয়ার নামেই নেয়া। অর্থাৎ দুটি নম্বরই একই ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত। বিষয়টি খুবই গোলমেলে এবং রহস্যময়। তাহলে কি বিষয়টা এমন যে রফিকুল আলম কারো সাথে গোপনে কথা বলার জন্য মধু মিয়াকে দিয়ে দুটো সিম কিনিয়েছিলেন? একটি তিনি নিজের কাছে রেখেছিলেন আর অন্যটি যার সাথে কথা বলতেন তাকে দিয়েছিলেন! যদিও সেই সিমটিও দীর্ঘদিন থেকেই বন্ধ।

আতাহার মিয়া ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মধু মিয়ার নামে আরো একটি সিম নিবন্ধন করা আছে। সেই সিমটি সে এখনো ব্যবহার করছে। কিন্তু বাকি দুটো সিমই প্রায় বছরখানেক ধরে অব্যবহৃত রয়েছে। মধু মিয়াকে খুঁজে পেতে অবশ্য খুব একটা বেগ পেতে হলো না আতাহার মিয়ার। মধু মিয়া কাজ করেন একটা কন্সট্রাকশন ফার্মে। তার বয়স বত্রিশ। হাড় জিরজিরে শরীর। গালে মাংস বলতে কিছু নেই। ফলে দুই পাশের গালের হনু উঁচু হয়ে আছে। চোখ কোঁটরে ঢুকে গেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে এ জগতে কোথাও আছে! হাঁটার সময় একটা নির্দিষ্ট ছন্দে এদিক-ওদিক দুলতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, এই বুঝি হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাবে। কিন্তু মধু পড়ে না। সে এভাবেই হাঁটতে থাকে। তাকে থানায় ডেকে আনা হয়েছে। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে আতাহার মিয়ার সামনে বসে আছে। আতাহার মিয়া বললেন, ‘তোর নাম মধু?’

মধু ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল, ‘জে ছার।’

করস কী?’

‘পিয়ং।’

‘পিয়ং কী?’

‘এই ছার, চা বিড়ি সিকারেট আইন্যা দিই। ফটোকপি করি। ঘর ঝাড়ু দিই। মাঝে মইধ্যে রান্নাবাড়িও করি।’

‘ঢাকায় কতদিন?’

‘সতরো বছর বয়সে আইছি ছার।

‘আর কে কে আছে?’

‘কেউ নাই ছার।’

‘বিয়া করিস নাই?’

‘করছিলাম ছার। দুইডা।’ আঙুল তুলে দেখাল মধু।

‘বউ কই?’

‘নাই ছার। চইল্যা গেছে।

‘চলে গেছে ক্যান?’

‘এই যে ছার গাঞ্জা ভাং খাই। এইজন্য গেছেগা।

‘চোখ লাল ক্যান? এখনো কি গাঁজার মধ্যে আছিস?’

‘জে ছার। গাঞ্জার মইধ্যে আছি, এইজন্য চোউখ লাল।’

‘সবসময়ই খাস নাকি?’

‘জে ছার। খাওনের মইধ্যে ছার এই একটা জিনিসই একটু টেস কইর‍্যা খাই। অন্য আর কোনোকিছুতে টেস পাই না। অন্যকিছু মোহে দিলেই পাইনসা লাগে। পেট ঠেইল্যা বমি হয়। ওয়াক থুঃ!’ মধু থক করে এক দলা থুথু ফেলল মেঝেতে। থকথকে সেই থুথু দেখে আতাহার মিয়ার গা গুলিয়ে উঠল। একে নিয়েতো মহা বিপদ! তিনি মধুকে পেয়ে যে সম্ভাবনার আলো দেখতে পেয়েছিলেন, তা নিভে যেতে শুরু করেছে। তার সামনে বসেই মধু ঢুলছে। কথা বলছে এলোমেলো। এর থেকে কোনো তথ্য বের করা অসম্ভব। তিনি তারপরও চেষ্টা করলেন, ‘এর আগে কখনো পুলিশ ধরেছে?’

‘জে ছার, ধরছে। পাঁচ ছয়বার ধরছে। মাইর মুইরও দিছে ছার। তয় গায় লাগে না। শইলেতো কিছু নাই। হাড্ডিও শক্ত। ঠনঠন শব্দ হয়। ওইডাও পিনিক ছার। শইলড়াই পিনিক।’

আতাহার মিয়ার রীতিমতো বিরক্ত লাগছে। মধু ভারী গলায় বলল, ‘এহন ছার মারলে মারেন, কিচ্ছু করার নাই। আপনের যেমন ছার ভাত, আমার তেমন ছার গাঞ্জা। এহন ভাত খাওনের লাইগ্যা কেউ আপনেরে মারলে আপনে ভাত খাওন ছাড়তে পারবেন? পারবেন না। আমিও ছার এই জিনিস ছাড়তে পারব না। যেই জিনিসের লাইগ্যা বউ ছাইড়া দিলাম, মাইরের লাইগ্যা সেই জিনিস ছাড়লে ছার মান-ইজ্জত থাকে? গাঞ্জা খাই দেইখ্যা মান ইজ্জত থাকব না, এমনতো কোনো কথা নাই।’

মধুর সাথে সেদিন আর কথা এগোলো না। তবে তাকে চোখে চোখে রাখলেন আতাহার মিয়া। চোখে চোখে রেখেও অবশ্য লাভ হলো না। দিন কয় চলে গেলেও সন্দেহভাজন কিছু দেখতে পেলেন না। সারাক্ষণ গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে সে। মাঝে মধ্যে কাজকর্ম করে। তবে তার বর্তমান কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ করে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল। বেশ কয়েক বছর আগে মধু মিয়া কাজ করত আলম কন্সট্রাকশন ফার্মে। এই ফার্মের মালিক ছিলেন রফিকুল আলম। তথ্যটা যেনো আবারো আশাবাদী করে তুলল আতাহার মিয়াকে। তার মানে তার সন্দেহই ঠিক। রফিকুল আলম ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। মধু তখন তার অফিসে পিয়নের কাজ করত। ফলে তিনি হয়তো মধুকে বলেছিলেন দুটি সিম কিনে নিয়ে আসতে। আর মধু তখন নিজের নামেই সিম দুটি কিনে নিয়েছিল। ঘটনা এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তিনি মধুকে আবারো ডাকলেন, ‘রফিকুল আলমকে চিনিস?’

মধু উদাস গলায় জবাব দিল, ‘চিনতেও পারি, নাও চিনতে পারি।’

‘এই দেখ ছবি, ছবি দেখে বল চিনতে পারিস কিনা!’ আতাহার মিয়া রফিকুল আলমের কয়েকটা ছবি এগিয়ে দিলেন।

মধু দীর্ঘ সময় সেই ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে দার্শনিক ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘একবার মনে লয় চিনি, আরেকবার মনে লয় চিনি না। আসলে দুইন্যাতে কি ছার চেহারা ছবি দেইখ্যা মানুষ চেনন যায়? যায় না। এই মনে লয় চিনি, আবার লগে লগেই মনে লয় চিনি না।’

আতাহার মিয়া হাল ছেড়ে দিলেন। এভাবে হবে না। অন্য কোনো উপায় খুঁজতে হবে। এত দ্রুত তিনি হাল ছাড়তে চান না। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, তিনি ঘটনার খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন। কিন্তু সামান্য কোনো যোগসূত্রের অভাবে ঘটনাটা তিনি ধরতে পারছেন না। তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি সেটি পারবেন। খুব শিঘ্রই পারবেন।

সকল অধ্যায়

১. অর্ধবৃত্ত – ১
২. অর্ধবৃত্ত – ২
৩. অর্ধবৃত্ত – ৩
৪. অর্ধবৃত্ত – ৪
৫. অর্ধবৃত্ত – ৫
৬. অর্ধবৃত্ত – ৬
৭. অর্ধবৃত্ত – ৭
৮. অর্ধবৃত্ত – ৮
৯. অর্ধবৃত্ত – ৯
১০. অর্ধবৃত্ত – ১০
১১. অর্ধবৃত্ত – ১১
১২. অর্ধবৃত্ত – ১২
১৩. অর্ধবৃত্ত – ১৩
১৪. অর্ধবৃত্ত – ১৪
১৫. অর্ধবৃত্ত – ১৫
১৬. অর্ধবৃত্ত – ১৬
১৭. অর্ধবৃত্ত – ১৭
১৮. অর্ধবৃত্ত – ১৮
১৯. অর্ধবৃত্ত – ১৯
২০. অর্ধবৃত্ত – ২০
২১. অর্ধবৃত্ত – ২১
২২. অর্ধবৃত্ত – ২২
২৩. অর্ধবৃত্ত – ২৩
২৪. অর্ধবৃত্ত – ২৪
২৫. অর্ধবৃত্ত – ২৫
২৬. অর্ধবৃত্ত – ২৬
২৭. অর্ধবৃত্ত – ২৭
২৮. অর্ধবৃত্ত – ২৮
২৯. অর্ধবৃত্ত – ২৯
৩০. অর্ধবৃত্ত – ৩০
৩১. অর্ধবৃত্ত – ৩১
৩২. অর্ধবৃত্ত – ৩২
৩৩. অর্ধবৃত্ত – ৩৩
৩৪. অর্ধবৃত্ত – ৩৪
৩৫. অর্ধবৃত্ত – ৩৫
৩৬. অর্ধবৃত্ত – ৩৬
৩৭. অর্ধবৃত্ত – ৩৭
৩৮. অর্ধবৃত্ত – ৩৮
৩৯. অর্ধবৃত্ত – ৩৯
৪০. অর্ধবৃত্ত – ৪০
৪১. অর্ধবৃত্ত – ৪১
৪২. অর্ধবৃত্ত – ৪২
৪৩. অর্ধবৃত্ত – ৪৩
৪৪. অর্ধবৃত্ত – ৪৪
৪৫. অর্ধবৃত্ত – ৪৫
৪৬. অর্ধবৃত্ত – ৪৬
৪৭. অর্ধবৃত্ত – ৪৭
৪৮. অর্ধবৃত্ত – ৪৮
৪৯. অর্ধবৃত্ত – ৪৯
৫০. অর্ধবৃত্ত – ৫০
৫১. অর্ধবৃত্ত – ৫১
৫২. অর্ধবৃত্ত – ৫২
৫৩. অর্ধবৃত্ত – ৫৩

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন