অর্ধবৃত্ত – ৫১

সাদাত হোসাইন

ড. আব্দুল বাতেন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছেন। তবে ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝার উপায় নেই যে তার কপাল সামান্য কুঞ্চিত। তার সামনে জড়সড় ভঙ্গিতে বসে আছে রাফি। ড. বাতেন বললেন, ‘আপনি কি তাহলে আমাকে ঘটনাটা খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?’

রাফি সামান্য চুপ করে থেকে মাথা নাড়ল, ‘জি।’

‘এক্ষুনি বলতে চান? না অন্য কোনো সময়?

‘এক্ষুনি।’

‘জি বলুন।’

রাফি গলা খাকড়ি দিয়ে গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করল। তারপর বলল, ‘আমার চেয়ে বয়সে বড় এমন একজনের সাথে আমার সম্পর্ক আছে।’ বলে একটু থামল রাফি। তারপর বলল, ‘সে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সমস্যা হচ্ছে সেই স্কুলের অথোরিটিদের মধ্য থেকেই প্রভাবশালী একজনের সাথে ওর দীর্ঘদিনের একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। কিন্তু একটা সময় এসে সে সম্পর্কটা আর কন্টিন্যু করতে চাইছিল না। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে সমস্যা তৈরি হতে থাকে। এমনিতে পার্সোনাল লাইফেও মেয়েটির নানারকম সমস্যা যাচ্ছিল। এই সবকিছু নিয়ে একটা সময় গিয়ে প্রচণ্ড ফ্রাসট্রেটেড হয়ে পড়ে সে। আর ঠিক ওই সময়টাতেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়! এবং খুব দ্রুতই আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে।’

রাফি একটু থামলেও ড. বাতেন কোনো কথা বললেন না। তিনি উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছেন। রাফি বলল, ‘তো মেয়েটি যখন ওই ভদ্রলোকের সাথে সম্পর্কটা আর কন্টিন্যু করতে চাইছিল না, সমস্যা শুরু হয় তখনই। ভদ্রলোক বিষয়টা মানতে চাইলেন না। নানাভাবে বিরক্ত করা শুরু করলেন। সারাক্ষণ ফোন করতেন। একটা সময় ভদ্রলোকের সবগুলো নম্বরই নিজের ফোন থেকে ব্লক করে দিল মেয়েটা। আর স্কুলে যেহেতু সবার সামনে মেয়েটাকে আলাদাভাবে পাওয়া সহজ ছিল না, ভদ্রলোক তাই নানাভাবে তাকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করলেন

‘আচ্ছা।’

‘বিষয়টা দিন দিন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। ভদ্রলোক দিনরাত ড্রিংক করা শুরু করলেন। এখানে-সেখানে সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করতেন। কখনো কখনো মাঝরাতে ড্রিংক করে মেয়েটার বাড়ির সামনে অবধি চলে আসতেন। শেষের দিকে কয়েকদিন এমনও হয়েছে যে উনি মাঝরাতে এসে মেয়েটার বাড়ির গেট ধরে টানাটানি পর্যন্ত করেছেন। কী ভয়াবহ আতঙ্কের ব্যাপার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?’

‘হুম।’

‘বাড়ির কেউ যদি ব্যাপারটা জানতে পারত, খুব খারাপ হয়ে যেত। এ কারণে মেয়েটা প্রায় সারারাতই জেগে থাকত। আর গেটে সামান্য শব্দ টের পেলেই নিচে চলে যেত। তারপর ভদ্রলোককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠাত।’

রাফি একটু থামল। তারপর বলল, ‘আমি একটু-আধটু কবিতা লিখি। মেয়েটা আমার কবিতা খুব পছন্দ করে। ফলে প্রায়ই মাঝরাতে আমি তাকে কবিতা শোনাতে যেতাম। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে ফোনে কবিতা পড়ে শোনাতাম। সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। তারপরও আমি গেলাম। সাইকেলটা পাশে দাঁড় করিয়ে আমরা দীর্ঘসময় কথা বললাম। কথা শেষে আমি কেবল ফিরছি, ঠিক এই মুহূর্তে মেয়েটা আমাকে ফোন করল। সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, এক্ষুনি একটু গেটের কাছে আসো, দ্রুত। আমি গিয়ে দেখি গেটের বাইরে ওই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। পুরোপুরি মাতাল সে। মেয়েটা গেটের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু লোকটা শক্ত হাতে মেয়েটার হাত ধরে গায়ের জোরে টানছে। ওই অবস্থায় সংগত কারণেই মেয়েটা চিৎকার করে কারো সাহায্যও চাইতে পারছে না। কোনো শব্দও করতে পারছে না। লোকটা হঠাৎ জোরে হ্যাঁচকা টান দিল। মেয়েটা গেটের সাথে বাড়ি খেয়ে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। লোকটা তারপরও ছাড়ল না। এবার মেয়েটার চুল ধরে টানতে লাগল। সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগাল। আমার হঠাৎ যে কী হলো! গেটের পাশেই পড়ে থাকা একটা ইট তুলে নিলাম আমি। তারপর লোকটার মাথায় ঠুকে দিলাম। লোকটা মাথা চেপে ধরে একবার ঘুরে আমাকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তারপর মুহূর্তের মধ্যে টলে উঠল। আমি গিয়ে দু হাতে ধরলাম। কিন্তু লোকটা ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে পড়ল।’

রাফি আবারো থামল। টেবিলে রাখা জগ থেকে ঢেলে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল সে। তারপর বলল, ‘আমি তখনো বুঝিনি এটা সিরিয়াস কিছু। আমি বরং ভেবেছিলাম লোকটা যেহেতু বদ্ধ মাতাল, হয়তো এ কারণেই ওভাবে নেতিয়ে পড়েছে। তা ছাড়া মেয়েটাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম আমি। এতক্ষণ যে শব্দ হয়েছে তাতে বাড়ির যে কেউ জেগে উঠতে পারে! আমি তাই দ্রুত মেয়েটাকে ওপরে উঠে যেতে বললাম। তারপর লোকটাকে টেনে নিয়ে এলাম রাস্তার উল্টোদিকে অনেকটা দূর পর্যন্ত। তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। ফজরের নামাজ পড়তে লোকজন মসজিদে যাবে। তো এইজন্য একটা ভয় ছিল। তারপরও যতটুকু সম্ভব ওই বাড়ি থেকে দূরে এনে লোকটাকে ফুটপাতে শুইয়ে দিলাম আমি।’

‘তারপর?’

রাফি চুপ করে রইলো। টেবিলের ওপর রাখা তার হাত দু খানা কাঁপছে। মুখ পাংশুবর্ণ। সে প্রায় ভাঙা গলায় বলল, ‘বিশ্বাস করুন, আমি তখনো জানতাম না যে লোকটা নেই! আমি বরং ভেবেছিলাম, লোকটা যেহেতু মদ খেয়ে পাঁড়মাতাল হয়েছিল, হয়তো সে কারণেই ওইটুকু আঘাতেই অমন নেতিয়ে পড়েছে। রাস্তার পাশেই সে মরার মতো ঘুমাতে থাকবে।’

‘ঘটনা কখন জানলেন?’

‘ওই দিন সন্ধ্যায়।’

‘এত দেরিতে?’

‘হুম। কারণ আমার ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। ফোন খুলতেই দেখি মেয়েটির ফোন। কিন্তু ফোনে সে কিছুই বলতে চাইল না। বলল খুবই জরুরি, সরাসরি দেখা করতে হবে। আমি সাথে সাথে তার স্কুলের সামনে গেলাম। গিয়ে শুনি…।’

‘হুম।’ গম্ভীর গলায় বললেন ড. বাতেন, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী! সে আমাকে বলল, এ বিষয়ে আমরা কেউ কারো সাথে

ফোনে কোনো কথা বলব না। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করব।’

‘কিন্তু পোস্টমর্টেম করলেইতো পুলিশের অনেক তথ্য পেয়ে যাওয়ার কথা?’

‘উহু। পাওয়ার কথা না!

‘কেন?’

‘কারণ আমি সেদিন সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিলাম। একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছিল বলে ফুল হাতা রেইনকোর্ট পরা ছিলাম আমি। আর আমার হাতে সাইকেল চালানোর গ্লাভস ছিল। তবে ওই গ্লাভস জোড়া সচরাচার সাইকেলের গ্লাভস যেমন থাকে তেমন নয়। পুরো হাত ঢাকা খুব কম্ফোর্টেবল গ্লাভস’।

‘ওহ। পুলিশ আলামত সংগ্রহে গিয়েও কিছু পায়নি?’

‘নাহ, কারণ লাশটা যেখানে ছিল সেখান থেকে গেটটা অনেকটাই দূরে। তা ছাড়া ওখানে আশপাশে অনেক বাড়ি। আর সম্ভবত দুপুরে ঘটনা শুনেই মেয়েটা ওই ইটের টুকরোটাও সরিয়েও ফেলেছিল।’

‘হুম।’ ড. বাতেন খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন।

রাফি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল, ‘প্রথম কয়েকদিন খুব একটা সমস্যা হয়নি। কিন্তু এরপরই সমস্যা হতে শুরু করে। ঘুম হয় না। নানা দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আর…।’

ড. বাতেন কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তবে তাকালেন। রাফি বলল, ‘আর খুব ভয় হতে থাকে। নানাভাবে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। বরং দিনদিন ভয়াবহ মানসিক সমস্যা তৈরি হতে থাকল। মাঝে মাঝে একদম স্বাভাবিক হয়ে যাই, কিন্তু তারপর আবার…।’

ড. বাতেন দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাফির চোখের দিকে। রাফি সেই চোখের দৃষ্টি যেন সহ্য করতে পারল না। সে চকিতে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর তাকিয়ে রইলো নিচে। ড. বাতেন তবুও চোখ সরালেন না। যেমন ছিলেন তেমনই তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি আমার কাছে একটা সত্য লুকিয়েছেন রাফি।’

রাফি চমকে উঠল, ‘কী সত্য?’

‘খুনটা আপনি করেননি।’

রাফি অবাক গলায় বলল, ‘খুনটা আমি করিনি?’

‘উহু।’

তাহলে কে করেছে?’

‘আপনি জানেন খুনটা কে করেছে।’ বলে একটু থামলেন ড. বাতেন। তারপর বললেন, ‘আপনি রোজ রাতে তাকে স্বপ্নে দেখেন। ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। কারণ আপনি সাবকনসাস মাইন্ডে তাকে ভয়ও পান।’

ড. বাতেন বললেন, ‘মেয়েটা যখন আপনাকে ফোন করল। আপনি সাইকেল চালিয়ে দ্রুত সেখানে গেলেন। কিন্তু গিয়েই আপনি দৃশ্যটা দেখতে পান যে মেয়েটাকে লোকটা বাজেভাবে টানা হ্যাঁচড়া করছে। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়েটা শক্ত ইট বা কিছু দিয়ে লোকটার মাথায় আঘাত করে। তখনও আপনারা জানতেন না যে লোকটা মারা গেছে। কিন্তু যখন থেকে আপনি তার মৃত্যুর ঘটনা জানলেন। তখন থেকে শুরু হলো আপনার প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা, চাপ। ফলে এরপর থেকে আপনি নিয়মিত স্বপ্নে ওই ঘটনা দেখতে থাকলেন। মূলত মেয়েটাকে ভয় পেতে থাকলেন আপনি। আপনার সাব কনসাস মাইন্ড বারবার আপনাকে এই স্বপ্ন দেখাতে লাগল যে মেয়েটা ভারি কিছু দিয়ে আপনার মাথায় আঘাত করছে। তাই না?’

রাফি এবারও কথা বলল না। চোখ তুলে তাকালও না। আগের মতোই মাথা নিচু করে আনমনে জুতার ডগা দিয়ে মেঝেতে অর্ধবৃত্ত আঁকার চেষ্টা করছে সে।

সকল অধ্যায়

১. অর্ধবৃত্ত – ১
২. অর্ধবৃত্ত – ২
৩. অর্ধবৃত্ত – ৩
৪. অর্ধবৃত্ত – ৪
৫. অর্ধবৃত্ত – ৫
৬. অর্ধবৃত্ত – ৬
৭. অর্ধবৃত্ত – ৭
৮. অর্ধবৃত্ত – ৮
৯. অর্ধবৃত্ত – ৯
১০. অর্ধবৃত্ত – ১০
১১. অর্ধবৃত্ত – ১১
১২. অর্ধবৃত্ত – ১২
১৩. অর্ধবৃত্ত – ১৩
১৪. অর্ধবৃত্ত – ১৪
১৫. অর্ধবৃত্ত – ১৫
১৬. অর্ধবৃত্ত – ১৬
১৭. অর্ধবৃত্ত – ১৭
১৮. অর্ধবৃত্ত – ১৮
১৯. অর্ধবৃত্ত – ১৯
২০. অর্ধবৃত্ত – ২০
২১. অর্ধবৃত্ত – ২১
২২. অর্ধবৃত্ত – ২২
২৩. অর্ধবৃত্ত – ২৩
২৪. অর্ধবৃত্ত – ২৪
২৫. অর্ধবৃত্ত – ২৫
২৬. অর্ধবৃত্ত – ২৬
২৭. অর্ধবৃত্ত – ২৭
২৮. অর্ধবৃত্ত – ২৮
২৯. অর্ধবৃত্ত – ২৯
৩০. অর্ধবৃত্ত – ৩০
৩১. অর্ধবৃত্ত – ৩১
৩২. অর্ধবৃত্ত – ৩২
৩৩. অর্ধবৃত্ত – ৩৩
৩৪. অর্ধবৃত্ত – ৩৪
৩৫. অর্ধবৃত্ত – ৩৫
৩৬. অর্ধবৃত্ত – ৩৬
৩৭. অর্ধবৃত্ত – ৩৭
৩৮. অর্ধবৃত্ত – ৩৮
৩৯. অর্ধবৃত্ত – ৩৯
৪০. অর্ধবৃত্ত – ৪০
৪১. অর্ধবৃত্ত – ৪১
৪২. অর্ধবৃত্ত – ৪২
৪৩. অর্ধবৃত্ত – ৪৩
৪৪. অর্ধবৃত্ত – ৪৪
৪৫. অর্ধবৃত্ত – ৪৫
৪৬. অর্ধবৃত্ত – ৪৬
৪৭. অর্ধবৃত্ত – ৪৭
৪৮. অর্ধবৃত্ত – ৪৮
৪৯. অর্ধবৃত্ত – ৪৯
৫০. অর্ধবৃত্ত – ৫০
৫১. অর্ধবৃত্ত – ৫১
৫২. অর্ধবৃত্ত – ৫২
৫৩. অর্ধবৃত্ত – ৫৩

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন