অর্ধবৃত্ত – ৪৬

সাদাত হোসাইন

নাদিয়া দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। বৃষ্টির সাথে সাথে ঝোড়ো হাওয়াটাও যেন বাড়ছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। ঝড়ে গাছের ডালপালা ভেঙে ইলেকট্রিকের তারের ওপর পড়লে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। সম্ভবত এ কারণেই ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে একটা গা ছমছমে ভাব। ঠিক এই মুহূর্তে বিকট শব্দ তুলে একটা সাদা মাইক্রোবাস এসে ঢুকল সামনের উঠানে। মাইক্রোবাস থেকে একে একে পাঁচ-ছজন লোক নেমে এলো। সবার শেষে নামল সাদা আলখাল্লা পরা লম্বা গড়নের একজন। লোকটা সম্ভবত হুজুর। মুখভর্তি সাদা দাড়ি। মাথায় টুপি। বাকিদের একজনকে নাদিয়া চেনে। সেদিন বাবার কলেজে দেখা জহিরুল। জহিরুলের পরনেও সাদা পাঞ্জাবি। তার সাথে আরো কজন রয়েছে। তাদের হাতে নানা ধরনের প্যাকেট। একজনের হাতে সম্ভবত মিষ্টির প্যাকেটও রয়েছে। এ বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান নাকি আজ? নাদিয়া ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। তবে সে বুঝতে পারছে, একটা তীব্র অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। বিষয়টাকে পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা করল নাদিয়া। কিন্তু পারল না।

.

নিচ থেকে কাজের মেয়ে সুফিয়া এলো দোতলায়। নাদিয়ার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘আপা আপনের ঘরখান একটু গুছাই দিয়া যাই।’

নাদিয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা।’

সুফিয়া অবশ্য খুব একটা সময় নিল না। সে কোনোমতে ঘরটা গুছিয়ে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনোকিছু নিয়ে খুব ব্যস্ত সে। নাদিয়া তাকে ডাকল, ‘শুনুন।‘

সুফিয়া শুনল কিনা বোঝা গেল না। তবে সে নাদিয়াকে অগ্রাহ্য করার ভঙ্গিতেই নিচের সিঁড়ির দিকে যেতে লাগল। নাদিয়া আবার ডাকল, ‘এই যে, একটু শুনবেন?’

সুফিয়া এবার ঘুরে তাকাল। একটা কাঁচুমাচু ভাব তার মধ্যে। নাদিয়া অবশ্য বিষয়টা পাত্তা দিল না। সে বলল, ‘কী হচ্ছে নিচে? কোনো প্রোগ্রাম আজ?’

সুফিয়া যেন নিজেকে সামলে নিল। তারপর রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল, ‘সময় হইলেই জানতে পারবেন।’

‘মানে?’

‘মানে কিছু না।’ বলেই আবার হাসল সুফিয়া। তার সেই হাসি অস্বাভাবিক, অস্বস্তিকর।

নাদিয়া বলল, ‘রাতে যে এ বাসায় কোনো অনুষ্ঠান আছে এমন কিছুইতো উনি আমাকে বলেননি!’

‘উনি কে? ম্যাডাম?’

‘হুম।’

‘বলবেন, বলবেন। এত অধৈর্য হইয়েন নাতো আপা। আপনেরে নিয়া ঘটনা

আর আপনে জানবেন না?’

‘আমাকে নিয়ে ঘটনা!’ নাদিয়ার বুকটা আচমকা ধক করে উঠল। সুফিয়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতে যেতে বলল, ‘আইছেন যহন, তহনতো আর না জাইনা যাইতে পারবেন না! যেই জন্য এইহানে আইছেন, সেই জিনিসতো জানতেই হইব।’

নাদিয়া কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তার হঠাৎ মনে হলো কোনো একটা ঝামেলা আছে। এবং সেই ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দু সে নিজে। কিন্তু ঝামেলাটার মুখোমুখি হওয়ার জন্য তার সাথে কেউ নেই। সে দৌড়ে ঘরে ঢুকল। বাবাকে ফোন করতে হবে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো ঘরে যেখানে তার ফোন রাখা ছিল, সেখানে ফোনটা নেই। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো নাদিয়ার। সে আঁতিপাতি করে খুঁজেও ফোনটা কোথাও পেল না। খানিক আগে সুফিয়া কি তবে তার ফোন নিয়ে যেতেই এসেছিল? নাদিয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ভয়ের শীতল স্রোত নেমে গেল। এই প্রথম তার মনে হলো সে খুব বড় ধরনের একটা বিপদের মধ্যে এসে পড়েছে। এবং এই বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করার কেউ নেই। কারণ, তার বাবাকেও কাজের অজুহাতে আগেভাগে ময়মনসিংহে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন সে এখানে একা। সম্ভবত এটি পূর্বপরিকল্পিত কোনো ঘটনার অংশ। এবং এই পরিকল্পনার সাথে জহিরুলও যুক্ত। এ কারণেই কি সেদিন কলেজে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এত প্রশ্ন করছিল জহিরুল?

ঘটনা পরিষ্কার হতে অবশ্য সময় লাগল না। খানিকবাদে আফসানা নিজেই এলো। সে গম্ভীর, থমথমে। নাদিয়া হাসার চেষ্টা করল, ‘কী হচ্ছে নিচে?’

আফসানা গম্ভীর গলায়ই বলল, ‘তুমি বসো। তোমাকে কিছু কথা বলব।’

‘কী কথা?’ নাদিয়া অস্থির ভঙ্গিতে বলল।

আফসানা শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘অস্থির হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন?’

নাদিয়া কিছু বলতে গিয়েও কথা খুঁজে পেল না। সে বারকয়েক ঢোক গিলে বলল, ‘জি।’ এই আফসানাকে নাদিয়া এ কদিন দেখেনি। তার সামনে যেন অন্য এক মানুষ। প্রথমদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে যাকে দেখে ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠেছিল!

আফসানা জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘তুমি বড় হয়েছো, তোমার অনেক কিছু জানতে বুঝতে হবে। তাই না?’

নাদিয়া কথা বলল না। আফসানা বলল, ‘তুমি যে এখানে এসেছো, তোমার মধ্যে কোনো প্রশ্ন জাগেনি যে তোমার বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা কী?’

নাদিয়া এবারও কথা বলল না। আফসানা বলল, ‘তুমি এ বিষয়ে কিছু জানো?’ নাদিয়া ডানে-বায়ে মাথা নাড়াল। আফসানা খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘আমরা বিয়ে করেছি।’

নাদিয়া ঝট করে মুখ তুলে তাকাল। তবে কোনো কথা বলল না। আফসানা বলল, ‘পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ঘটনা আমি লুকিয়ে রেখেছি। কেবল তোমার জন্য।’

বাবার বিয়ের কথা শুনে যতটা চমকে গিয়েছিল নাদিয়া। এবার তার চেয়েও বেশি চমকাল, ‘আমার জন্য?’

‘শুধু তোমার না, তোমার আর তোমার বোনের জন্য। তার ধারণা এতে তোমাদের বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। আর ঠিক এ কারণেই তোমাদের বিয়ের জন্য আমি যতটা সম্ভব ধৈর্য ধরেছি। এমনকি নাবিলার বিয়ের সব খরচও আমি বহন করেছি। কিন্তু তারপরও আশফাক কথা রাখেনি। কথা ছিল এরপরই সে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবে, কিন্তু সে কোনো চেষ্টাই করেনি। বরং এটা-সেটা বলে বছরের পর বছর সময় পার করেছে সে

নাদিয়া কথা বলল না। বাবার ব্যাপারে কিছু কিছু বিষয় সবাইই কম-বেশি আঁচ করতে পেরেছিল। কিন্তু সেটি যে ভেতরে ভেতরে এতটা বিস্তৃত তা সে ধারণা করেনি। আফসানা বলল, ‘আজ রাতে তোমার বিয়ে।’

‘মানে!’ নাদিয়া বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে রইল। আফসানা একইরকম ভঙ্গিতে বলল, ‘গত মাসে আমি কনসিভ করেছি। সো বুঝতেই পারছো, আমার হাতে সময় বেশি নেই। যত দ্রুত সম্ভব আমাকে আমার বিয়ের কথা সবাইকে জানাতে হবে। আর সেটার জন্য তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়াটা জরুরি। জহিরুলের সাথে আজ রাতে এখানেই তোমার বিয়ে হবে। জহিরুল ছেলে ভালো। আর এ নিয়ে তোমার কোনো দুশ্চিন্তাও করতে হবে না। আমি সবকিছু বহন করব। তোমাদের সব খরচ।‘

‘কী বলছেন আপনি!’ নাদিয়ার গলা কাঁপছে।

আফসানা নির্বিকার কণ্ঠে বলল, ‘যা বলেছি, সেটাই সত্যি। আশফাককে আমি অনেক সময় দিয়েছি। সে প্রতিবার আমার উদারতাকে দুর্বলতা ভেবেছে। কিন্তু তার এটা বোঝা উচিত, আমি দুর্বল নই।’

নাদিয়া কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এত অসহায় এর আগে কখনো তার লাগেনি। সে আচমকা আফসানার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে হয়ে যাবে। মা সব কথা ফাইনাল করে ফেলেছে।’

আফসানা হাসল, ‘আমাকে আর এসব কথা বলে লাভ নেই। এমন কথা আশফাকের মুখে আমি বহুবার শুনেছি। আজ বিয়ে, কাল বিয়ে। ছেলে ঠিক হয়ে গেছে। এইসব অনেক কিছু।’

‘বিশ্বাস করুন, এমনকি বাবাও জানে না এবারের ঘটনা। আমার এক্ষুনি বিয়ে হয়ে যাক, এটা বাবা চায়না বলেই মা এমনকি বাবাকেও কিছু জানায়নি।’

আফসানা এবার সশব্দেই হেসে উঠল, ‘বাহ। তোমার বাবাও জানে না এবার?’ নাদিয়া এবার প্রায় কেঁদেই ফেলল, ‘বিশ্বাস করুন। আমি একটুও মিথ্যে বলছি না। আপনার বিশ্বাস না হলে আমার ফোনটা দিন, আমি মাকে ফোন করে আপনাকে ধরিয়ে দিই?’

আফসানা কঠিন গলায় বলল, ‘সেটা তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর দিও মা-বাবা দুজনকেই ফোনে বিয়ের খবর জানিয়ে দিও।’

নাদিয়া আরো কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু আফসানা তার কথা শুনল না। সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আমি সুফিয়াকে পাঠাচ্ছি। ও তোমাকে রেডি করে দেবে।’

নাদিয়া পাগলের মতো ছুটে গিয়ে আফসানার পথ রোধ করে দাঁড়াল। তারপর আচমকা আফসানার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আফসানা অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। সে নাদিয়াকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। নাদিয়া কতক্ষণ মেঝেতে অচেতনের মতো পড়েছিল সে জানেনা। তার মনে হচ্ছিল এই ঘটনাটি বাস্তবে ঘটছে না। বরং সে দুঃস্বপ্ন দেখছে। নিশ্চয়ই এই দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাবে। কিন্তু তার দুঃস্বপ্ন ভাঙলো না। সুফিয়া তাকে মেঝে থেকে টেনে তুললো। নাদিয়া উঠতে চাইছিল না। কিন্তু সুফিয়ার সাথে আরো একজন মহিলা। সে শক্ত হাতে নাদিয়াকে চেপে ধরলো। নাদিয়া চিৎকার করে তার মাকে ডাকতে লাগল, তার বাবাকে ডাকতে লাগল। কিন্তু তার সেই কান্নার শব্দ ওই চার দেয়ালের বাঁধা পেরিয়ে, ওই অন্ধকারের গহীন অরণ্য পেরিয়ে কারো কাছেই পৌঁছাল না।

.

নাদিয়া খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটছে। তার পা খালি। খালি পায়ে কিছু একটা ফুটেছে। কিন্তু অন্ধকারে সেটি দেখার উপায় নেই। পা ফেলতেই প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে। তারপরও ব্যথা নিয়ে ভাবছে না নাদিয়া। এই মুহূর্তে এই ব্যথাকে পাত্তা দেয়ার মতো অবস্থা তার নেই। সে অন্ধকারে পাগলের মতো ছুটছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর হিমেল হাওয়া বইছে। তার পায়ের নিচে ভেজা মাটি। চারদিকে গহিন বন। দিনের আলোতেই এই বনের পথ সে চিনতে পারবে না। অথচ এই অন্ধকারে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে ছুটে চলছে সে। নাদিয়া জানে না সে কোথায় যাচ্ছে। সে কেবল জানে তাকে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। অনেক দূরে। যেখানে আফসানার মতো ভয়ংকর এক নারীর ছায়া নেই। কিন্তু কোথায় যাবে সে?

নাদিয়া বেরিয়েছে অদ্ভুত এক উপায়ে। তাকে সাজিয়ে রেখে সুফিয়া গিয়েছিল নিচে। এ বাড়িতে কাজের লোকের সংখ্যা কম। বাড়িতে আসা লোকজনের জন্য নিচে রান্নাবান্নার কাজও করতে হচ্ছে সুফিয়াকে। ফলে নাদিয়ার কাছে বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ তার নেই। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে এমন দুর্গম অচেনা-অজানা জায়গায় নাদিয়াকে নিয়ে আলাদা করে সতর্ক থাকারও কিছু নেই। সুফিয়া তাই তার সাথের কাজের মেয়েটাকে নিয়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাদিয়া ততক্ষণে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, যেকোনো উপায়েই হোক এই বিয়ে সে ঠেকাবেই। প্রয়োজনে এই দুই তলা খোলা বারান্দা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়বে সে। তাতে যা হবার হবে। ঘর থেকে বের হয়ে প্রথমেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে যে দরজাটা ছিল সেটি বন্ধ করে দিল নাদিয়া। তারপর বারান্দার এপাশ থেকে ওপাশ অবধি তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করল। এখান থেকে নামার কোনো উপায় নেই। বারান্দা লাগোয়া কোনো গাছও নেই। আবার লাফিয়ে পড়লে বড় ধরনের ক্ষতি হবার সম্ভাবনাও কম। তবে সে শারীরিকভাবে আহত হবে সেটি নিশ্চিত। কিন্তু তাতে তার সমস্যা না কমে বরং বেড়েই যাবে। চট করেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল নাদিয়ার। তার ঘরের পেছন দিকে একটা দরজা। দরজাটা বন্ধ। অনেকদিন খোলা হয় না বলে মরিচা ধরে গেছে। একটা আলনা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে দরজাটা। তবে দরজার পাশেই একটা কাচের জানালা। জানালার ওপাশে একটা সঙ্কীর্ণ বারান্দা। বারান্দাটাও বহুকাল ব্যবহার করা হয় না। ফলে বাড়ির পেছন দিকের দেয়াল বেয়ে ওঠা লতাগুল্মে অপরিচ্ছন্ন হয়ে আছে ছোট্ট পরিসরটুকু। জানালার কাচ গলে ঘর থেকে এক চিলতে আলো গিয়ে পৌঁছালেও জায়গাটা তাতে আলোকিত হলো না। বরং একটা ঝাঁকড়া আমগাছের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ডাল-পালায় অন্ধকার হয়ে আছে। চট করে নাদিয়ার মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেল। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঝটপট পরনের শাড়ি খুলে সালোয়ার কামিজ পরে নিল। তারপর আলনাটা সরিয়ে খুলে ফেলল পেছনের দরজাটা। এক ঝলক তাজা দমকা হাওয়া ঢুকে পড়লো ঘরে। নাদিয়া আগে কখনো গাছে চড়েনি। ফলে এত চমৎকার ডালপালাওয়ালা একটা আমগাছ থাকা সত্ত্বেও সেটা বেয়ে নিচে নামার সাহস হচ্ছিল না তার। কিন্তু নাদিয়া জানে, এখান থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। আচমকা শাড়িটার কথা মনে পড়ে গেল তার। ত্রস্ত পায়ে আবার ঘরে ঢুকল নাদিয়া। তারপর শাড়িটা নিয়ে গিয়ে একটা প্রান্ত আমগাছের ডালে বেঁধে ফেলল। অন্যপ্রান্ত নিজের কোমরের সাথে বেঁধে দৃষ্টিকটু উপায়ে গাছ বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল সে। নাদিয়ার হাত ছিলে গেল। বার কয়েক গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে ব্যথায় টনটন করতে থাকল শরীর। কিন্তু সেসব গ্রাহ্যই করল না সে। যখন পায়ের নিচে ভেজা মাটির স্পর্শ পেল, যেন নতুন জীবন পেল নাদিয়া। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো সে। তারপর সোজা বাড়ির পেছন দিকে ছুটল। সেখানে বুনো লতাপাতায় ছাওয়া অনেকটা খোলা জায়গা। তার ওপারে উঁচু পাঁচিল। তবে সেই পাঁচিল টপকাতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না নাদিয়ার। সম্ভবত বাড়িতে কোনো নির্মাণকাজ চলছে। ফলে দেয়ালঘেঁষে ইট ও বালি স্তূপ করে রাখা। নাদিয়া হেঁটে সেই বালির স্তূপের ওপর উঠে গেল। তারপর লাফিয়ে পড়লো দেয়ালের ওপারে। তারপর বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল।

.

সেই থেকে নাদিয়া ছুটছে। অন্ধকারে কতক্ষণ ছুটেছে সে জানে না। কোথায় যাচ্ছে তাও জানে না। তবে দূরে একটা আলোর উৎস দেখা যাচ্ছে। নাদিয়া সেই আলোর উৎস লক্ষ করেই ছুটছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর হিমেল হাওয়ায়ও ঘামছে সে। দুই পা ভারী হয়ে গেছে। বুক ধড়ফড় করে কাঁপছে। নাদিয়ার ধারণা এতক্ষণে ঘটনা সবাই টের পেয়ে গেছে। নিশ্চয়ই আফসানা দলবল নিয়েই তাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। ফলে কোনোভাবেই থামতে চাইছে না সে। আর কিছুক্ষণ পরপরই প্রবল আতঙ্ক নিয়ে পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে এতক্ষণেও কারো কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। এক ফোঁটা পানির জন্য তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ হা করে বৃষ্টির পানি জিভে ছোয়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু যতটুকু পেল, তাতে তেষ্টা কমার বদলে যেন আরো বেড়ে গেল। নাদিয়ার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। তারপরও সে ছুটছে। যেন একটা ঘোরের ভেতর ছুটে চলছে। তার চারপাশে ঘন শালবন। শালবনে গাঢ় অন্ধকার। মেঘে ঢেকে যাওয়া চাঁদ। সেই অন্ধকার শালবনে ছুটতে ছুটতেই নাদিয়ার আচমকা মায়ের কথা মনে পড়লো। তাকে নিয়ে দেখা মায়ের দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ল। সে হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। সেই কান্নার ভেতর জমাট বাঁধা যন্ত্রণার মতো চাপা চিৎকার ভেসে আসতে লাগল, ‘মা, ও মা, মাগো, আম্মা, ও আম্মা, আম্মা…’

নাদিয়া জানে তার মা তার এই কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। তারপরও সে ফিসফিস করে তাকে ডাকতে লাগল, ‘ও মা, মা, মাগো… ও আম্মা, আম্মা, আম্মাগো…।’

.

রাত তখন কত নাদিয়া জানে না। সে দাঁড়িয়ে আছে চওড়া একটা পিচঢালা রাস্তার পাশে। রাস্তায় গাড়ি খুব একটা নেই। তবে মাঝে মাঝে সাঁইসাঁই করে দুয়েকটা প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যে। নাদিয়া সতর্কভঙ্গিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। আশপাশে কোনো লোকালয় চোখে পড়ছে না তার। তবে সে জানে, এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কোনো ভুল করা যাবে না। এই রাতে অচেনা-অজানা জায়গায় সে কোনো প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাসে উঠতে চায় না। সে অপেক্ষা করছে কোনো বাসের। বাসে নিশ্চয়ই অনেক যাত্রী থাকবে। সেটি বরং সব দিক থেকেই নিরাপদ। তবে পরপর দুটি বাস দেখে সে থামানোর জন্য হাত তুলে ইশারাও করেছিল। কিন্তু একটা বাসও থামেনি। নাদিয়া আরো খানিক অপেক্ষা করল। প্রচণ্ড ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তায় তার শরীর ভেঙে পড়ছে। কিন্তু এতোদূর আসার পর আর হাল ছেড়ে দিতে চায় না নাদিয়া। যে করেই হোক তাকে ঢাকায় পৌছাতে হবে। বাবাকে একটা খবর দিতে হবে। বাসে নিশ্চয়ই কারো ফোন থেকে সে বাবাকে একটা ফোন করতে পারবে। এতরাতে মাকে এই খবর না জানানোটাই ভালো হবে। নাদিয়া বাস পেল আরো মিনিট কুড়ি পর। কিন্তু বাসে উঠে দমে গেল নাদিয়া। রাত বেশি বলেই কিনা কে জানে, বাসে যাত্রী মাত্র তিনজন। সাথে বাস ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর। তারা সকলেই নাদিয়ার দিকে এমন অদ্ভুত চোখে তাকাল যে নাদিয়ার খুব অস্বস্তি হতে লাগল। সে জড়সড় হয়ে গিয়ে জানালার পাশে একটা সিট দেখে বসে পড়লো। সে জানে তার এই চেহারা, জামা কাপড়ের এই অবস্থা দেখে যে কেউই সন্দেহের চোখে তাকাবে। তার কর্দমাক্ত খালি পা। ভেজা, ময়লা কাপড়। বিধ্বস্ত, ঘর্মাক্ত চেহারা। এতরাতে এই নির্জন রাস্তায় এমন একজন মেয়েকে দেখে খুব স্বাভাবিকভাবেই লোকে সন্দেহের চোখেই তাকাবে। এই অবস্থায় কারো কাছে আর ফোন চাওয়ার সাহস হলো না নাদিয়ার। সে চুপচাপ বসে রইলো। বাস কতক্ষণ চলেছে নাদিয়া জানে না। রাস্তার পাশে ছোট্ট এক সুনসান চায়ের দোকানের সামনে বাকি যাত্রী তিনজনও নেমে গেল। আবার চলতে শুরু করল বাস। বাসে যাত্রী বলতে নাদিয়া একা। তার হঠাৎ কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। সে একবার পেছন ফিরে তাকাল। পুরো বাসটা ফাঁকা। ড্রাইভার হঠাৎ গলা উঁচু করে জিজ্ঞেস করল, ‘যাইবেন কই আপা?’

নাদিয়া কোনো মতে উত্তর দিল, ‘ঢাকা।’

‘এই গাড়িতো ঢাকায় যাইব না।’

‘কোথায় যাবে তাহলে?’

ড্রাইভার অবশ্য নাদিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আপনে কইত্থেইকা আসছেন?’

নাদিয়াও ড্রাইভারের প্রশ্নের উত্তর দিল না। তবে সে তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করল, ‘এই গাড়ি কোথায় যাবে?’

ড্রাইভার এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তবে সে কন্ডাক্টরকে ডেকে কিছু একটা বলল। কন্ডাক্টর নাদিয়াকে বলল, ‘আপনের কাছে ভাড়া আছে আপা?’

নাদিয়ার হঠাৎ মনে পড়ল, তার কাছে টাকা নেই। সে তাড়াহুড়ায় তার ব্যাগ আনতে ভুলে গেছে। সে মিনমিন করে বলল, ‘আমি ঢাকায় পৌঁছে টাকা দিয়ে দেব।’

কন্ডাক্টর দাঁত বের করে হাসল। তারপর নরম গলায় বলল, ‘আপনার ভাড়া দেওন লাগত না আপা।’

নাদিয়া বলল, ‘কেন? ভাড়া দেয়া লাগবে না কেন? আমি ঢাকায় পৌঁছেই…।’

নাদিয়া কথা শেষ হবার আগেই কন্ডাক্টর নাদিয়ার পাশে বসে পড়ল। তারপর আরো খানিকটা কাছে চলে এলো। তারপর নাদিয়ার একদম গা ঘেঁষে বসে বলল, ‘ভাড়া আর কয়টাকা দিবেন আপা? তারচাইতেও বেশি কতকিছু দেওনের আছে, সেইটা দিলেই হইবো।’ বলেই লোকটা দুই হাতে শক্ত করে নাদিয়াকে জড়িয়ে ধরল। তারপর টেনেহিঁচড়ে তাকে বাসের পেছন দিকে নিয়ে যেতে লাগল। প্রবল আতঙ্কে নাদিয়ার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। পুরো জগৎ সংসার মুহূর্তেই অন্ধকার মনে হতে লাগল তার। সে বুঝতে পারছে, এতক্ষণ যাকে সে ভয়াবহ বিপদ বলে ভাবছিল, আসলে তার চেয়েও হাজারগুণ বিপদ তার সামনে। পৃথিবীতে এর চেয়ে ভয়ংকর কোনো বিপদ আর নেই। সে চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকতে লাগল। তার মাকে ডাকতে লাগল। কিন্তু তার সেই ডাক কেউ শুনল না। নাদিয়াকে চেপে ধরে শুইয়ে দেয়া হলো পেছনের বড় সিটগুলোর আড়ালে। সেখানে সে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মুক্তির আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু লাভ হলো না। এক নির্জন অন্ধকার রাস্তায় বাসটা তখন ঢিমেতালে চলছে। নাদিয়া চিৎকার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সেই চিৎকার শোনার মতো কেউ এখানে নেই |

তবে বাসের ড্রাইভার চিৎকার করে তার কন্ডাক্টরকে যা বলল সেটি সে শুনল। কন্ডাক্টরও চিৎকার করে জবাব দিল। সে বল্ল, ‘আপনে আগে আহেন ওস্তাদ। আমি ততক্ষণে গাড়ি চালাই।’

ততক্ষণে বৃষ্টি নেমেছে জোরে। আকাশজুড়ে বিদ্যুৎ চমকের মাতম লেগেছে। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। ঘণ্টাখানেক বাদে নাদিয়াকে যখন ছুঁড়ে ফেলা হলো চলন্ত বাস থেকে। তখন তার ক্ষতবিক্ষত শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে। তার গলায় শক্ত করে পেঁচানো ওড়না। একটা নির্জীব নিথর দেহ রাস্তা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে স্থির হয়ে রইলো একটা গাছের গোড়ায়। নাদিয়ার শরীরের রক্তগুলো ধুয়ে যেতে থাকল প্ৰবল বৃষ্টিতে। তবে তাতে ক্ষতগুলো আরো জেগে উঠতে লাগল।

সকল অধ্যায়

১. অর্ধবৃত্ত – ১
২. অর্ধবৃত্ত – ২
৩. অর্ধবৃত্ত – ৩
৪. অর্ধবৃত্ত – ৪
৫. অর্ধবৃত্ত – ৫
৬. অর্ধবৃত্ত – ৬
৭. অর্ধবৃত্ত – ৭
৮. অর্ধবৃত্ত – ৮
৯. অর্ধবৃত্ত – ৯
১০. অর্ধবৃত্ত – ১০
১১. অর্ধবৃত্ত – ১১
১২. অর্ধবৃত্ত – ১২
১৩. অর্ধবৃত্ত – ১৩
১৪. অর্ধবৃত্ত – ১৪
১৫. অর্ধবৃত্ত – ১৫
১৬. অর্ধবৃত্ত – ১৬
১৭. অর্ধবৃত্ত – ১৭
১৮. অর্ধবৃত্ত – ১৮
১৯. অর্ধবৃত্ত – ১৯
২০. অর্ধবৃত্ত – ২০
২১. অর্ধবৃত্ত – ২১
২২. অর্ধবৃত্ত – ২২
২৩. অর্ধবৃত্ত – ২৩
২৪. অর্ধবৃত্ত – ২৪
২৫. অর্ধবৃত্ত – ২৫
২৬. অর্ধবৃত্ত – ২৬
২৭. অর্ধবৃত্ত – ২৭
২৮. অর্ধবৃত্ত – ২৮
২৯. অর্ধবৃত্ত – ২৯
৩০. অর্ধবৃত্ত – ৩০
৩১. অর্ধবৃত্ত – ৩১
৩২. অর্ধবৃত্ত – ৩২
৩৩. অর্ধবৃত্ত – ৩৩
৩৪. অর্ধবৃত্ত – ৩৪
৩৫. অর্ধবৃত্ত – ৩৫
৩৬. অর্ধবৃত্ত – ৩৬
৩৭. অর্ধবৃত্ত – ৩৭
৩৮. অর্ধবৃত্ত – ৩৮
৩৯. অর্ধবৃত্ত – ৩৯
৪০. অর্ধবৃত্ত – ৪০
৪১. অর্ধবৃত্ত – ৪১
৪২. অর্ধবৃত্ত – ৪২
৪৩. অর্ধবৃত্ত – ৪৩
৪৪. অর্ধবৃত্ত – ৪৪
৪৫. অর্ধবৃত্ত – ৪৫
৪৬. অর্ধবৃত্ত – ৪৬
৪৭. অর্ধবৃত্ত – ৪৭
৪৮. অর্ধবৃত্ত – ৪৮
৪৯. অর্ধবৃত্ত – ৪৯
৫০. অর্ধবৃত্ত – ৫০
৫১. অর্ধবৃত্ত – ৫১
৫২. অর্ধবৃত্ত – ৫২
৫৩. অর্ধবৃত্ত – ৫৩

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন