অর্ধবৃত্ত – ৩১

সাদাত হোসাইন

নাদিয়ার বিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি উন্মুখ হয়েছিল আফসানা। গত পাঁচ বছরে এই নিয়ে আশফাকের সাথে তার তুমুল দ্বন্দ্ব। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বেও আশফাক এতটুকু নড়েননি। তিনি কিছুতেই চাননি এক্ষুনি নাদিয়ার বিয়ে হোক। এ কারণে আফসানার একের পর এক প্রবল দাবির মুখেও তিনি তার সংকল্প থেকে এতোটুকুও বিচ্যুত হননি। নানা অজুহাতে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কিংবা বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে আশফাককে কোনো না কোনোভাবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই হবে। তবে সেদিন রাতে আফসানার নমনীয় আচরণ কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করেছে আশফাককে। তিনি জানেন, আফসানা তার নিজের জীবন নিয়েই শঙ্কিত, সন্দিগ্ধ, উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। সুতরাং তার অস্থিরতার জন্য তাকে দোষও দেয়া যায় না। কিন্তু আশফাকের পক্ষে চট করে একটা ভালো পাত্র দেখে নাদিয়ার বিয়ে দেয়াটাও প্রায় অসম্ভব। কারণ এই কাজটি করার জন্য যে ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেগুলোর জন্যও উপযুক্ত মানুষ আশফাক নন। তারপরও কেবল আফসানার অবস্থা বিবেচনা করেই তিনি মাঝেমধ্যে চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু সেই চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। তবে আফসানা নিজেই যেহেতু এবার দায়িত্বটা নিতে চাইছে, সেহেতু কিছুটা হলেও নির্ভার বোধ করছেন আশফাক। এমনিতেও নাবিলা ও নাদিয়ার জন্যতো কম কিছু করেনি আফসানা। নাবিলার বিয়ে থেকে শুরু করে দু বোনের পড়াশোনা, হাফসার চিকিৎসা সহ নানা ক্ষেত্রে অভাবনীয় সহযোগিতা করেছে আফসানা। আর আফসানার অনুযোগটাও মিথ্যে নয়, নাবিলা-নাদিয়ার ওপর নিঃসন্দেহে একটা অধিকার তার রয়েছেই। আশফাকের বিশ্বাস, নাদিয়ার ক্ষতি হয় এমন কিছুই আফসানা করবে না। তা ছাড়া, নাদিয়ার যদি ভালো একটা বিয়ে হয়, তাহলে তাতে মূলত আফসানারই লাভ। সে তখন নির্বিঘ্নে আশফাকের সাথে তার বিয়ের ঘোষণা দিতে পারবে।

কিন্তু কথাটা বাসায় বলবে কী করে আশফাক? এই কথা কোনোভাবেই বাসায় বলা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় নাদিয়াকে একবার আফসানার কাছে নিয়ে আসতে পারলে। তারা দুজন প্রথমে নিজেদেরকে জানুক, বুঝুক। পরস্পরের প্রতি একটা আস্থার জায়গা তৈরি হোক। তারপর না হয় সেই অনুযায়ী নাদিয়ার জন্য একটা ভালো পাত্রের ব্যবস্থা করবে আফসানা। তা ছাড়া নাদিয়ার পছন্দ-অপছন্দ জানাটাও তার জন্য জরুরি। কিন্তু নাদিয়াকে কীভাবে এখানে আনবে আশফাক? এটাই এখন তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বেশ কিছুদিন পরে এক ভরদুপুরে বাড়িতে এলেন আশফাক। আফজাল আহমেদ ছেলেকে দেখে খুবই অবাক হলেন। তিনি বললেন, ‘তুই ঠিক আছিস?’

‘আছি বাবা। তুমি?’

‘আমি?’ আফজাল আহমেদের কণ্ঠে সামান্য বিস্ময়। আশফাক কখনো তাকে এই কথা জিজ্ঞেস করেছে বলে তার মনে পড়ে না। তিনি বললেন, ‘এই বয়সেতো আর নিজের পক্ষে ভালো-মন্দ থাকার উপায় থাকে না। অন্যরা যেমন রাখে, তেমনই আছি।’

‘আমার ওপর তোমার অনেক রাগ, তাই না বাবা?’ আশফাক হঠাৎই প্রশ্নটা করলেন। আফজাল আহমেদ হাসলেন, ‘রাগ থাকবে কেন? রাগ নেই।’

আমি টের পাই বাবা। আর এইজন্যই তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে ভয় পাই।’

‘সামনে আসতে ভয় পাবি কেন? সন্তান যদি তার বাবার সামনে এসেই দাঁড়াতে না পারে, তবে সেই লজ্জা যতটা না সন্তানের তারচেয়ে অনেক বেশি বাবার। সে সন্তানকে অতটুকু শক্ত করে তৈরি করতে পারে নি।’

একটু থেমে আফজাল আহমেদ বললেন, ‘কী হয়েছে তোর?’

‘তেমন কিছু না বাবা। মাঝে মাঝে এমন হয় না যে মনে হয়, জীবনটা খুব অর্থহীন? মনে হয় যা করেছি সবই ভুল!’

আফজাল আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জীবনতো ভুলই। যাকে দেখে মনে হয় তার জীবনে কোনো ভুল নেই, শতভাগ সফল মানুষ, তার কাছে গিয়ে দেখ, তার বুকেও কত দীর্ঘশ্বাস জমা আছে! আফসোস আর আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস। আসলে জীবন হলো আক্ষেপের অন্য নাম।

‘তাহলে জীবনে সফলতা-ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই?

‘থাকবে না কেন, অবশ্যই আছে। তবে জীবনে আসল সফলতা হলো সন্তুষ্টি। এখন ওটা কে কীভাবে নেয়, কে কীভাবে দেখে, সেটা হলো ইম্পর্ট্যান্ট।’

‘আমাকে নিয়ে তোমার কোনো আক্ষেপ নেই বাবা? আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল তোমার!’

‘হ্যাঁ, আছে। কিন্তু আমার প্রত্যাশা পূরণের দায়তো তোর নয়। তুই কেন অন্য একজনের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পেরে আজীবন কষ্টে থাকবি?’

‘কিন্তু বাবা, তুমিই তো বললে তোমার জীবনের ভালো থাকা মন্দ থাকা আর তোমার ওপরে নির্ভর করে না, অন্যদের ওপর নির্ভর করে। নিশ্চয়ই তোমার পরিবার, তোমার সন্তানদের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে। তাই না?’

আফজাল আহমেদ আনমনে হাসলেন, ‘কিন্তু দিন শেষেতো যার যার জীবন তার তারই।’

‘তারপরও বাবা। একজনের জীবনেতো অন্যজনের জীবনের ছায়া পড়ে। পড়ে না?’

‘তা পড়ে। তবে মানুষতো আর গাছ নয় যে স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে। মানুষকে ওই ছায়া আর মায়া কাটাতে পারতে হয়।’

‘তুমি পারো বাবা?’

‘চাইলে হয়তো পারা যায়। কিন্তু কাটাতে চাই না।’

‘কেন?’

অভ্যাস হয়ে যায়। আর মায়া কাটানো সহজ ব্যাপার না। যাকে সহ্য হয় না, অসহ্য লাগে। মনে হয় তার থেকে দূরে গেলেই বোধহয় ভালো থাকব। কিন্তু দূরে যেতেই দেখি তার জন্যও কষ্ট হয়। তখন আর ভালো থাকা হয় না। মায়া বড় ভয়ানক, রহস্যময় এক ব্যাপার।

কথাটা কোথায় যেন গেঁথে রইলো আশফাকের। তিনি এক তীব্র আক্ষেপের, অশান্তির জীবন কাটাচ্ছেন। তার এই জীবনে তিনি আসলে কী চান? আফসানার কাছ থেকে মুক্তি? কিন্তু যদি মুক্তিই চাইবেন, তাহলে বন্দিই বা হলেন কেন? এই বন্দিত্বে আসলেই কি কোনো দায় নেই তার?

এই প্রশ্নের উত্তর থেকেও যেন পালিয়ে বেড়াতে চান আশফাক। যেন নিজের ভেতরের একটা সত্ত্বাকে তিনি অস্বীকার করতে চান। কেন অস্বীকার করতে চান সেটিও তিনি জানেন, কিন্তু মানতে চান না। তার নিজেকে প্রবল পরাধীন মনে হয়। মনে হয়, তার চারপাশের জগতের কাছে তিনি এক মুখোশ মানব। এই মুখোশ খুলতে তার তীব্র ভয়। কিন্তু মুখোশের ওজনটাও তিনি আর বইতে পারছেন না।

নাদিয়া ক্লাস থেকে ফিরে দেখে আশফাক বসে আছেন বারান্দায়। সে বলল, ‘এই অবেলায় তুমি বাবা?’

‘এটা অবেলা হলো?’ আশফাক মুগ্ধ চোখে নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। নাদিয়ার পরনে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি। তাকে দেখতে যে কী সুন্দর লাগছে!

‘তোমার জন্যতো অবেলাই বাবা।’ বলল নাদিয়া।

‘অবেলা কেন হবে?’

‘কখনোতো এসময়ে আসো না!’

‘এলে কী লাভ? তুইতো এমন সময় থাকিস না।’

‘আমি না থাকলে কী? আম্মা তো থাকে। বাড়ির অন্যরাতো থাকে।

‘তা থাকে।’ আশফাক আর কথা বাড়ালেন না। তিনি যে কারণে এসেছেন সেই কথাটি কীভাবে বলবেন সেটি ভাবছেন।

নাদিয়া বাইরের পোশাক ছেড়ে এসে বাবাকে ভাত খেতে দিল। হাফসা শুয়ে আছেন বিছানায়। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আশফাকের দিকে। নাদিয়ার বিয়ের ব্যাপারে এক্ষুনি কিছু বলা যাবে না আশফাককে। মুকিতের মতো এত ভালো একটা পাত্র পেয়েছেন, সেটি বলার লোভ সম্বরণ করাও কঠিন। কিন্তু তারপরও সংযতই রইলেন হাফসা। বলা যায় না, নাদিয়ার বিয়ের কথা শুনে আশফাক না আবার একটা গোলমাল বাধিয়ে ফেলে। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে চিন্তিত বোধ করছেন হাফসা। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আশফাককে খুব অস্থির আর অগোছালো লাগছে। বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছেন তিনি। আশফাক বললেন, ‘তোমার শরীর এখন কেমন?’

হাফসা হাসলেন, ‘কী ব্যাপার বলোতো?’

‘কী ব্যাপার মানে?’

‘শেষ কবে আমার খবর নিয়েছো মনে পড়ছে না!’

‘আমি তোমার খবর নেই না?’

‘কেন নেবে না? নিশ্চয়ই নাও। আমার খবর না নিলে এমন অসময়ে তুমি বাড়ি আসো?’ হাফসা টিপ্পনী কাঁটলেন।

আশফাক সামান্য বিরক্ত হলেন, ‘তুমি কখনো আমার সাথে ভালো করে কথা বলতে পারো না?’

হাফসা শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘লাভ নেই।

‘মানে?’

‘পুরুষ যখন পর নারীতে আসক্ত হয়, তখন সবচয়ে রূপবতী স্ত্রীকেও লাগে দাসী-বান্দি। আর স্ত্রীর সুরেলা কণ্ঠকেও মনে হয় হাইড্রোলিক হর্ন।’

নাদিয়া সামনে দাঁড়ানো। আশফাকের ভারি অস্বস্তি হতে লাগল। হাফসা অবশেষে প্রশ্নটা করল, ‘তোমার উদ্দেশ্যটা কী বলোতো?’

‘কী উদ্দেশ্য?’

হাফসা ম্লান হাসলেন, ‘তোমার চেহারা দেখলেই সব বোঝা যায়। ঘটনা খুলে বলো?’

নাদিয়া কথা বলল, ‘তুমি এমন করে কথা বলছো কেন আম্মা?’

হাফসা আচমকা ধমকে উঠলেন, ‘তুই চুপ থাক! যেটা বুঝিস না সেটার মধ্যে কথা বলবি না। এই লোককে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। বাইরে আলাভোলা একটা ভাব ধরে থাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আস্ত বদমাশ।’

‘আম্মা!’ নাদিয়া প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।

হাফসা আগের চেয়েও উচ্চকিত হলেন, ‘একদম চিৎকার করবি না। চুপ, একদম চুপ। সবাই মিলে আমাকে কী পেয়েছিস তোরা, হ্যাঁ? আমি পাগল, বদ্ধ উন্মাদ?’

হাফসা থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। ঘরে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা। হাফসা এবার আশফাককে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমার বউ অসুস্থ। ঘরে মরার মতো পড়ে আছে। তো তুমি আরেকটা বিয়ে করতেই পারো। এতেতো অসুবিধার কিছু নাই। কিন্তু মুখে ওরকম সাধু সাধু ভাব ধরে সবার কাছে মহাপুরুষ সেজে আছো কেন?’

হঠাৎ হাফসার এই রণাঙ্গিনী মূর্তি দেখে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। হাফসা নিজেই বললেন, ‘এখন বলো, কী উদ্দেশ্যে এসেছো?’

‘উদ্দেশ্য আবার কী?’ আশফাক মিনমিন করে বললেন। ‘আমার বাড়িতে আমি আসতে পারি না?’

‘পারবে না কেন? অবশ্যই পারো। তুমি চাইলে তোমার বাড়ি থেকে আমাকে বেরও করে দিতে পারো। সেটা যে দিচ্ছো না সে জন্য তোমার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। আমার উচিত দিনরাত তোমার পা ধরে বসে থাকা। কিন্তু ধরবো কী করে? তুমিতো সারাক্ষণ অন্য একজনের আঁচলের তলায় পড়ে থাকো।’

লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে আশফাকের। তার সামনে নাদিয়া। তিনি নাদিয়ার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না। হাফসা অবশ্য নাদিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এত বড় মেয়ে হইছিস, বাপ-মায়ের কোন কথার মধ্যে থাকতে হয় আর কোন কথার মধ্যে থাকতে হয় না এইটা বোঝোস না? যাহ এখান থেকে। যাহ।’

নাদিয়া কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আশফাক অবশ্য মনে-প্রাণে চাইছেন নাদিয়া তার সামনে থেকে না যাক। তিনি একা হাফসার মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছেন। নাদিয়া অবশ্য উঠল। একবার ভাবল মাকে কিছু বলে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সিদ্ধান্ত বদলাল। কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

হাফসা হঠাৎ যেভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন, ঠিক সেভাবেই আবার শান্ত হয়ে গেলেন। তারপর নরম গলায় বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছা তুমি করো, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার একটা কথা তোমাকে রাখতেই হবে।’

আশফাক বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে, ‘কী কথা?’

‘আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি তুমি করোনা।’

‘মানে!’ যেন আকাশ থেকে পড়লেন আশফাক।

হাফসা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘আমি তোমার পায়ে পড়ি। আমার যা করার করো। কিন্তু আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি তুমি করো না।’

আশফাক এবার সত্যি সত্যি দিশেহারা বোধ করছেন। এসব কী বলছেন হাফসা? তিনি উঠে হাফসার কাছে গিয়ে বসলেন। তারপর আলতো করে হাফসার হাত ধরে বললেন, ‘এসব তুমি কী বলছো? আমি নাদিয়ার ক্ষতি করব? নাদিয়ার?’

হাফসা কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। তুমি এখন যে কারো ক্ষতি করতে পারো। তুমি এক কাজ করো।’

‘কী কাজ?’

‘আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলো। বিষও খাওয়াতে পারো। আমাকে গুলে দিলে আমি এক চুমুকে খেয়ে ফেলব। তাও আমার মেয়েকে মেরো না। তার কোনো ক্ষতি করো না।’

আশফাক অসহায়ের মতো বললেন, ‘আমি তোমাদের কেন ক্ষতি করব?’

আরেক বউ ঘরে আনার জন্য। সেই ঘরের বউয়ের কি বাচ্চা আছে? কী বাচ্চা? ছেলে না মেয়ে? তাদের জন্য তুমি নাদিয়ার কোনো ক্ষতি করো না।’

হাফসা কেঁদে ফেললেন। তার চোখের কোল গড়িয়ে জল ঝরে পড়ছে বালিশে। আশফাক হাত বাড়িয়ে জল মোছানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তিনি বললেন ‘এগুলো তুমি কী বলছো হাফসা! নাদিয়া-নাবিলা তোমার একার মেয়ে? তারা আমার মেয়ে না?’

হাফসা কান্নাজড়িত গলায়ই হাসলেন, ‘ছোটবেলায় দাদিজানের কাছে শুনছিলাম, মা মরলে বাপ হয় তালুই। এই কথা সত্য। এই কথা এক শ ভাগ সত্যি। আমি নিজের চোখে এমন কত দেখেছি।’

‘তুমিতো মরে যাও নাই! ‘

হাফসা অবাক হবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি তাইলে এখনো বেঁচে আছি! কী বলো তুমি? আমি এখনো বেঁচে আছি!’ বলেই আবার কাঁদতে লাগলেন তিনি, ‘আচ্ছা, যে মহিলা বেঁচে থাকতেও তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করে, সেই মহিলা কি আসলেই বেঁচে থাকে? তার বাঁচা-মরার পার্থক্য তুমি বোঝো? বোঝো?’

‘আমি বিয়ে করেছি এই কথা তোমাকে কে বলেছে?’

‘কেউ বলে নাই। এইগুলা কারো বলতে হয় না। শোনো নাই, মায়ের সন্তান যদি দূর দেশেও মারা যায়, সেই খবর কেউ জানার আগেই মা জেনে যায়! এই কথা যেমন সত্যি, তেমনি এই কথাও সত্যি, স্বামী যদি অন্য মেয়ের কাছে যায়, সেই কথা কেউ জানার আগে স্ত্রী জেনে যায়।’

আশফাক চুপ করে বসে রইলেন। তার বুকের ভেতর বিশাল এক হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন পাথুরে দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই কঠিন দেয়াল সে ভাঙতে পারছে না। অথচ প্রতিটি আঘাতে তার বুক ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে।

রাতে কথাটা নাদিয়াকে বললেন আশফাক, ‘তোর ইউনিভার্সিটির কী অবস্থা?’

‘আগামী মাসে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল শেষ হবে বাবা।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী! অনেকদিন বন্ধ।’

‘ওহ। বন্ধে কী করবি তুই?’

‘কী আর করব? আমারতো আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বাড়িতেই থাকব।’

তোর আপুর বাসায় যাবি না?’

‘না বাবা। আপুর বাসায় যেতে আমার ভালো লাগে না।’

আশফাক চট করে কথাটা পাড়লেন, ‘তুই তাহলে তখন কিছুদিনের জন্য

আমার সাথে ঘুরতে যেতে পারিস!’

‘কী বলো বাবা!’ নাদিয়ার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। ‘সত্যি বলছো?’

‘হ্যাঁ সত্যি। ধর দু-চার দিনের জন্য গেলি। আমরা বাপ বেটি মিলে সারাদিন ঘুরলাম। ওদিকটা তে কী সুন্দর বন আছে। গেলে মনে হবে অন্য এক জগৎ। কত রকমের পাখি যে ডাকে! হুটহাট দেখবি গাছের মাথায় বানর!’

‘বানর! গায়ে এসে পড়ে যদি?’

‘ধুর! গায়ে এসে পড়বে কেন? আর বনের মাঝখান দিয়ে কী সুন্দর রাস্তা। পাশে একটা নদীও আছে। ছবির মতো সুন্দর।’

‘বাবা! এমন করে বলোনাতো। আমার ভাগ্য খুব খারাপ, যেটা নিয়ে খুব এক্সাইটেড থাকি সেটা আর হয় না।’

‘আচ্ছা, আর বলব না। তবে তুই মনে মনে রেডি হয়েই থাকিস।’

‘আচ্ছা বাবা।’

‘আরেকটা কথা?’

‘কী?’

‘তোর মাকে কিন্তু এখনই কিছু বলিস না!’

‘কেন? বলব না কেন?’

‘এমনি। এই যে দেখিস না, সারাক্ষণ কীসব আবোল-তাবোল বকতেই থাকে! শুধু শুধু অশান্তি করবে।’

‘তাও ঠিক।’ নাদিয়া বিষয়টা বুঝল। সে তার মাকে কিছু বলল না। কিন্তু আশফাক চলে যাওয়ার পর রাতে হাফসা তাকে ডাকলেন, ‘তোর বাবা কী বলল?’

‘কই? কিছু নাতো?’

‘আমার সাথে মিথ্যা বলিস না নাদিয়া। মা মরা হোক, আধমরা হোক দুনিয়াতে মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই। এই কথা যেই মুহূর্তে ভুলবি, সেই মুহূর্ত থেকে দুনিয়া জাহান্নাম হওয়া শুরু করবে। বল সে কী বলেছে?’

‘তুমি শুধু শুধু অশান্তি করো মা। বাবা কিছু বলেনি।’

হাফসা নাদিয়ার কথা বিশ্বাস করলেন না। তার কেন যেন খুব ভয় হতে লাগল। সেই রাতে তিনি আবারও ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন দেখলেন। একটা মেয়ে অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। পেছন থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটাকে কারা যেন তাড়া করছে। হাফসা খুব চেষ্টা করছেন মেয়েটার মুখ দেখতে। একবার তার মনে হচ্ছে মেয়েটা নাবিলা। একবার মনে হচ্ছে নাদিয়া। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে অন্য কেউ। মেয়েটা আচমকা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মেয়েটার চুলগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ে তার মুখ ঢেকে দিল। হাফসা নিজ হাতে সেই চুল সরালেন। মেয়েটার চেহারা দেখে তার দম বন্ধ হয়ে এলো। বুকের ভেতর থেকে যেন কলিজাটা ছুটে বের হয়ে আসতে চাইছে। তিনি দেখলেন, মেয়েটা নাদিয়া। সে অসহায়, ভীত, রক্তাক্ত চোখে হাফসার দিকে তাকিয়ে আছে!

সকল অধ্যায়

১. অর্ধবৃত্ত – ১
২. অর্ধবৃত্ত – ২
৩. অর্ধবৃত্ত – ৩
৪. অর্ধবৃত্ত – ৪
৫. অর্ধবৃত্ত – ৫
৬. অর্ধবৃত্ত – ৬
৭. অর্ধবৃত্ত – ৭
৮. অর্ধবৃত্ত – ৮
৯. অর্ধবৃত্ত – ৯
১০. অর্ধবৃত্ত – ১০
১১. অর্ধবৃত্ত – ১১
১২. অর্ধবৃত্ত – ১২
১৩. অর্ধবৃত্ত – ১৩
১৪. অর্ধবৃত্ত – ১৪
১৫. অর্ধবৃত্ত – ১৫
১৬. অর্ধবৃত্ত – ১৬
১৭. অর্ধবৃত্ত – ১৭
১৮. অর্ধবৃত্ত – ১৮
১৯. অর্ধবৃত্ত – ১৯
২০. অর্ধবৃত্ত – ২০
২১. অর্ধবৃত্ত – ২১
২২. অর্ধবৃত্ত – ২২
২৩. অর্ধবৃত্ত – ২৩
২৪. অর্ধবৃত্ত – ২৪
২৫. অর্ধবৃত্ত – ২৫
২৬. অর্ধবৃত্ত – ২৬
২৭. অর্ধবৃত্ত – ২৭
২৮. অর্ধবৃত্ত – ২৮
২৯. অর্ধবৃত্ত – ২৯
৩০. অর্ধবৃত্ত – ৩০
৩১. অর্ধবৃত্ত – ৩১
৩২. অর্ধবৃত্ত – ৩২
৩৩. অর্ধবৃত্ত – ৩৩
৩৪. অর্ধবৃত্ত – ৩৪
৩৫. অর্ধবৃত্ত – ৩৫
৩৬. অর্ধবৃত্ত – ৩৬
৩৭. অর্ধবৃত্ত – ৩৭
৩৮. অর্ধবৃত্ত – ৩৮
৩৯. অর্ধবৃত্ত – ৩৯
৪০. অর্ধবৃত্ত – ৪০
৪১. অর্ধবৃত্ত – ৪১
৪২. অর্ধবৃত্ত – ৪২
৪৩. অর্ধবৃত্ত – ৪৩
৪৪. অর্ধবৃত্ত – ৪৪
৪৫. অর্ধবৃত্ত – ৪৫
৪৬. অর্ধবৃত্ত – ৪৬
৪৭. অর্ধবৃত্ত – ৪৭
৪৮. অর্ধবৃত্ত – ৪৮
৪৯. অর্ধবৃত্ত – ৪৯
৫০. অর্ধবৃত্ত – ৫০
৫১. অর্ধবৃত্ত – ৫১
৫২. অর্ধবৃত্ত – ৫২
৫৩. অর্ধবৃত্ত – ৫৩

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন