কায়া কি ছায়া কি মায়া

হেমেন্দ্রকুমার রায়

কায়া কি ছায়া কি মায়া

আমি কাল্পনিক ভূতের গল্প বলেছি অনেক। কিন্তু সত্য সত্যই ভূতের অস্তিত্ব আছে কিনা, এ নিয়ে তর্কের অন্ত নেই।

এসব নিয়ে দরকার নেই আমাদের মাথা ঘামিয়ে। কারুকেই আমি ভূত বিশ্বাস করতে বলি না। অন্তত ভূত মানলেও ভূতকে ভয় করবার কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না।

কিন্তু ভূত মানি আর না মানি, মাঝে মাঝে এমন কতকগুলো আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যাদের কোনো মানে হয় না। সেগুলো ভূতের কীর্তি না হতে পারে, কিন্তু তাদের মূলে নিশ্চয়ই কোনো অপার্থিব শক্তি কাজ করে।

ছত্রিশ কী সাঁইত্রিশ বৎসর আগে কলকাতার জয় মিত্র স্ট্রিটের একটি বাড়িতে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করে। কোথাও কিছু নেই, বদ্ধ ঘরের মধ্যে হঠাৎ একরাশ ইট বা রাবিশ বৃষ্টি হল। চোখের সামনে ঘটি-বাটি-থালা মাটি থেকে উঠে শূন্য উড়তে লাগল পাখির মতো, তারপর ঝন ঝন করে আবার মাটির উপরে পড়ে ভেঙেচুরে গেল। থানায় খবর দেওয়া হল, পুলিশ বাহিনী এসে বাড়ি ঘেরাও করে সতর্ক পাহারা দিতে লাগল, তবু ওইসব উপদ্রব বন্ধ হল না। অথচ তার কিছুকাল পরে পুলিশ যখন হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে সরে পড়েছে— তখন সমস্ত উৎপাত আপনা-আপনি আবার থেমে গেল! ওই উপদ্রবের কাহিনি সংবাদপত্রেও প্রচারিত হয়েছিল এবং দলে দলে লোক ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বচক্ষে সমস্ত ব্যাপার দর্শন করেছিল।

আমাদের নিজেদের ভিতরে দুইবার দুটি বিচিত্র ঘটনা ঘটে।

অনেক দিন আগে আমরা রাওলপিণ্ডিতে গিয়ে এক বৎসর বাস করেছিলুম। পরিবারের মধ্যে বাবা, মা, আমি আর দুই বোন। পে-অফিস-লেন নামক রাস্তায় যে বাড়িখানা আমরা ভাড়া করেছিলুম, সেখানা এখনও বর্তমান আছে কিনা জানি না; কিন্তু তখন সে-বাড়িতে সহজে কেউ থাকতে চাইত না। আমরা ভাড়া নেবার পরেই পাড়ার লোকের মুখে খবর পাওয়া গেল, এ বাড়িতে নাকি অনেকরকম ভয় আছে। এর মধ্যে একজন পাঠান নিহত হয়েছে এবং আর এক পাঠান করেছে আত্মহত্যা। তারপর থেকে এখানে আর কেউ বাস করতে পারে না। বাবা কিন্তু ওসব কথা গ্রাহ্যের মধ্যে আনলেন না।

আমার বয়স তখন অল্প। সব কথা ভালো করে মনে পড়ে না, তবে কোনো কোনো ঘটনা এখনও ভুলিনি। এক রাত্রে মায়ের ডাকাডাকিতে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল।

বাবা বিছানার উপরে উঠে বসে বললেন, ‘ব্যাপার কী?’

মা বললেন, ‘দেখবে এসো।’

আমাদের শোবার ঘরের সামনেই ছিল একটা দালান, তারপর উঠান এবং উঠানের তিনদিকে কয়েক খানা ঘর। বাবা ও মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, আমিও গেলুম তাঁদের পিছনে পিছনে।

দালান থেকে বেরিয়েই অবাক হয়ে দেখলুম, উঠানের উপরে মাটি থেকে প্রায় চার হাত উঁচুতে জ্বলছে আশ্চর্য একটা আলো। দেখলেই বুঝতে বিলম্ব হয় না যে, প্রদীপ, বাতি, লণ্ঠন বা মশাল থেকে সে-আলোর উৎপতি নয়। নীলাভ আলো, আকার ক্রিকেট বলের মতন! চাঁদের কিরণে ধবধবে উঠানের উপরে আলোটা এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত নেচে নেচে বেড়াচ্ছে এবং মাঝে মাঝে এক-একটা ঘরের দরজার কাছে ঠোকর খেয়েই আবার ফিরে আসছে।

মায়ের বাধা না মেনে বাবা উঠানের দিকে অগ্রসর হলেন— আলোটাও হঠাৎ নিবে গেল!

তারপর কয়েক রাত ধরে আর একরকম কাণ্ড! গভীর রাত্রে উঠানের ধারের ঘরগুলোর দরজায় দরজায় শিকল বেজে ওঠে ঝন ঝন! বাবা বাইরে ছুটে যান, কিন্তু কারুকে দেখতে পান না! হয়তো বাইরের দুষ্ট লোক এসে ভয় দেখাচ্ছে এই ভেবে ভিতরে ঢুকবার দুই দরজায় তালাচাবি লাগানো হল, কিন্তু তবু থামল না শিকল-সংগীত।

মা তো ভয়ে সারা। বলেন, এ অলক্ষুণে বাড়ি ছেড়ে চলো! বাবা কিন্তু অটল। বলেন, ‘আলো দেখিয়ে আর শিকল বাজিয়ে কোনো পাঠান-ভূত আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না।’

‘পাঠান-ভূতরা’ই শেষটা হতাশ হয়ে আলো দেখানোর ও শিকল বাজানোর কাজে ইস্তফা দিলে।

দ্বিতীয় ঘটনাস্থল হচ্ছে কলকাতা।

আমাদের পৈতৃক বসতবাড়ি ছিল পাথুরিয়াঘাটায়। তিনমহলা বাড়ি, তারপরে একটি হাত দেড়েক চওড়া খানা, দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়দের একসারে তিনখানা বাড়ি। শেষোক্ত তিনখানা বাড়ির মধ্যে একখানা ছিল খালি— ভৌতিক বাড়ি বলে তার ভিতরে কেউ বাস করতে পারত না।

ছেলেবেলা থেকেই আমি ভূতকে ভয় করি না; যদিও ভূতের গল্প শুনতে বা পড়তে খুব ভালোবাসি। মনে আছে, বালক বয়সে একদিন কৌতূহলী হয়ে ছাদ থেকে পাঁচিল বেয়ে সেই হানাবাড়িতে নেমেছিলুম, ভূতকে বধ করবার জন্যে আমার হাতে ছিল একখানা কাটারি!

দোতলা ও একতলার প্রত্যক ঘরে ঢুকে দেখলুম খালি দু-ইঞ্চি পুরু ধুলো এবং ধুলোর উপরে নানা আকারের পদচিহ্ন। একটা ঘরে রয়েছে ধুলোভরা তৈলহীন প্রদীপের ভিতরে আধপোড়া সলিতা এবং আর একটা কঙ্কাল। কেউ যেন চমকে উঠবেন না, কারণ সেটা হচ্ছে বিড়ালের কঙ্কাল। ভূত দেখাও দিলে না, কোনোরকম শব্দ-টব্দ করবার বা কথা কইবারও চেষ্টা করলে না— বোধ হয় আমার হাতে কাটারি দেখে ভয় পেয়েছিল!

অথচ এই বাড়িরই ছাদের উপরে ঘটে একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা! তখন আমার বয়স দশ বৎসরের বেশি নয়।

আমার বাবার একটি অভ্যাস ছিল। গ্রীষ্মকালের রাত্রে তিনি খোলা ছাদের উপরে শয়ন করতেন। একদিন অনেক রাতে বিষম গোলমালে আমার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি, কাকারা আমার বাবার অচেতন দেহ বহন করে তেতালার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছেন।

খানিকক্ষণ চেষ্টার পর বাবার জ্ঞান হল। তারপর তখন এবং পরেও বাবার মুখে একাধিকবার যে কাহিনিটি শুনেছি তা হচ্ছে এই—

ছাদের উপরে উঠে ঘুমোবার আগে বাবা খানিকক্ষণ পায়চারি করতেন।

দুই-তিন দিন পায়চারি করতে করতে বাবা দেখতে পেলেন, খানার ওপাশে হানাবাড়ির ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে আছে এক শ্বেতবসনা নারীমূর্তি।

ওদিকের পাশাপাশি তিন বাড়ির একটা ছাদে উঠলেই অন্য দুটো ছাদের উপরেও অনায়াসে যাওয়া চলত। হানাবাড়ির ও তার পাশের বাড়ির ছাদে ওঠবার সিঁড়ি ছিল না। বাকি যে বাড়ির সিঁড়ি ছিল তার মধ্যে বাস করতেন ‘রাঙা গিন্নি’ নামে এক বিধবা নারী ও ‘তুলসীর মা’ নামে এক মহিলা। ছাদের উপরে প্রথম দুই-তিন দিন নারীমূর্তি দেখে বাবা ভেবেছিলেন, গ্রীষ্মাধিক্যের জন্যে নিশ্চয় রাঙা গিন্নি বা তুলসীর মা ছাদের উপরে উঠে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।

ঘটনার দিন বাবা অনেক রাতে থিয়েটার দেখে বাড়ি ফিরেছিলেন। আহারাদি সেরে তিনি যখন ছাদের উপরে শয়ন করতে যান রাত তখন প্রায় তিনটে।

আজ বাবার মনে সন্দেহ হল। ওই হানাবাড়িকে পাড়ার সকলেই ভয় করে। ও বাড়ি কেউ ভাড়া পর্যন্ত নেয় না। এই স্তব্ধ শেষরাতে ওই ছাদের উপরে পাড়ার মেয়ের নিয়মিত আবির্ভাব দেখে তিনি বিস্মিত হলেন।

দূর থেকে বাবা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওখানে কে তুমি দাঁড়িয়ে আছ?’

কোনো সাড়া নেই।

বাবা এগুতে এগুতে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি রাঙাগিন্নি নাকি?… তুলসীর মা?’ মূর্তি উত্তর দিলে না।

বাবা তখন খানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এতক্ষণে তিনি লক্ষ করলেন, মূর্তির মুখে ঘোমটা। রাঙা গিন্নি বা তুলসীর মা বাবার সামনে ঘোমটা দিতেন না। ওখানে অন্য কোনো মেয়ের আসবার কথাও নয়। তবে কে এই নারী?

মূর্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরিপূর্ণ চাঁদের আলোতেও তার কাপড়ের ভিতর থেকে দেহের কোনো অংশই দেখা যাচ্ছে না। তার ভাবভঙ্গি বৃদ্ধার মতন নয় বটে, কিন্তু সে যুবতী কি প্রৌঢ়া, তাও বোঝবার উপায় নেই।

বাবা অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে খানা ডিঙিয়ে পাশের ছাদের উপরে গিয়ে উঠলেন। তিনি স্থির করলেন, নিশ্চয় এ কোনো মেয়েচোর ধরা পড়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বাবা তার দিকে অগ্রসর হতেই সে পায়ে পায়ে পিছোতে লাগল।

বাবা বললেন, ‘দাঁড়াও! শীগগির বলো, কে তুমি?’

কোনো জবাব না দিয়ে মূর্তি পিছোতে লাগল। ক্রমে তার সঙ্গে বাবাও হানাবাড়ির ছাদের উপরে গিয়ে পড়লেন।

নারীমূর্তি একেবারে ছাদের ধারে গিয়ে দাঁড়াল— তারপর আর পিছোবার উপায় নেই।

‘আর কোথায় পালাবে? এখন আমার কথার জবাব দাও। কে তুমি?’ বলে বাবা আরও দুই পা এগিয়ে গেলেন।

তারপর যা হল সেটা একেবারেই কল্পানীত। বাবা যখন মূর্তির কাছ থেকে মাত্র এক হাত তফাতে, তখন পূর্ণ চন্দ্রালোকে সেই অদ্ভুত স্ত্রীলোকটি সশরীরেই যেন হাওয়ার ভিতরে একেবারে মিলিয়ে গেল!

বাবা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন, তিনি যে ভূতকে ভয় করতেন না একথা আমি জানি। কিন্তু এই অপার্থিব ও অসম্ভব দৃশ্য দেখে তাঁর মাথা ঘুরতে লাগল এবং তিনি চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

এই ঘটনার কিছুকাল পরে আমাদের বসতবাড়ি চার ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং আমাদের অংশে বাড়ির পিছনদিকটা। খানার ধারে হানাবাড়ির ঠিক পাশেই তেতালার ঘরে আমি বহু বৎসর শয়ন করেছিলুম, কিন্তু প্রেতনি দর্শনের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনোদিন আমার হয়নি।

বাবা এর পরেও গ্রীষ্মকালে ছাদে শয়ন করতেন, কিন্তু কোনো ছায়ামূর্তিই আর তিনি দেখতে পাননি। হানা বাড়িখানাও পরে সংস্কার করে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়াই ভূতের ভয় পেয়েছে বলে অভিযোগ করেনি।

বাবা ছিলেন অত্যন্ত সত্যবাদী, নির্ভীক, স্বল্পবাক ও গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তিনি যে মিথ্যা ভয় পেয়েছিলেন বা কাল্পনিক গল্পকে সত্য বলে চালিয়েছিলেন, এমন অসম্ভব কথা আমি স্বপ্নেও বিশ্বাস করতে পারি না।

* স্মরণের জাদুঘরে, ডি এস লাইাব্রেরি, প্রথম প্রকাশ ১৩৬৩।

সকল অধ্যায়

১. মূর্তি
২. কী?
৩. ওলাইতলার বাগানবাড়ি
৪. বাঁদরের পা
৫. বাড়ি
৬. বন্দি আত্মার কাহিনি
৭. জ্বলন্ত চক্ষু
৮. কোর্তা
৯. জীবন্ত মৃতদেহ
১০. অভিশপ্ত মূর্তি
১১. ভূতের রাজা
১২. অদৃশ্যের কীর্তি
১৩. ছায়া-কায়া-মায়া
১৪. কঙ্কাল-সারথি
১৫. এক রাতের ইতিহাস
১৬. কিসমৎ
১৭. ডাকবাংলো
১৮. দিঘির মাঠে বাংলো
১৯. পিশাচ
২০. ভীমে-ডাকাতের বট
২১. রুদ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি
২২. কে?
২৩. মিসেস কুমুদিনী চৌধুরি
২৪. চিলের ছাতের ঘর
২৫. খামেনের মমি
২৬. ক্ষুধিত জীবন
২৭. শয়তান
২৮. ভেলকির হুমকি
২৯. শয়তানী-জুয়া
৩০. বাঘের চোখ
৩১. জাগ্রত হৃৎপিণ্ড
৩২. টেলিফোন
৩৩. সূর্যদেবতার পুরোহিত
৩৪. ভৌতিক, না ভেলকি?
৩৫. ‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!
৩৬. মাঝরাতের ‘কল’
৩৭. পেপির দক্ষিণ পদ
৩৮. নবাব কুঠির নর্তকী
৩৯. মামূর্তের দানব-দেবতা
৪০. মুক্তি
৪১. নবাবগঞ্জের সমাধি
৪২. কলকাতার বিজন দ্বীপে
৪৩. বাদশার সমাধি
৪৪. অভিশপ্ত নীলকান্ত
৪৫. পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক
৪৬. আয়নার ইতিহাস
৪৭. রামস্বামীর উপল মণি
৪৮. বাড়ি, বুড়ো, বুট
৪৯. আধ খাওয়া মড়া
৫০. আজও যা রহস্য
৫১. রহস্যময় বাড়ি
৫২. মানুষ, না পিশাচ?
৫৩. ঐন্দ্রজালিক
৫৪. অভিশপ্তা
৫৫. নসিবের খেলা
৫৬. বিছানা
৫৭. লোটা
৫৮. কিন্তু
৫৯. কায়া কি ছায়া কি মায়া
৬০. তবে
৬১. নবাব বাহাদুরের বংশধর
৬২. মৃতদেহ
৬৩. নরকের রাজা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন