কোর্তা

হেমেন্দ্রকুমার রায়

সরকারি কাজের জন্য বিহারে একটি ছোটো শহরে কিছুদিন আমাকে থাকতে হয়েছিল। শহরের নাম না বললেও চলবে।

বৈকালে একদিন বেড়াতে বেরিয়ে শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পড়লুম। আমার এপাশে-ওপাশে সবুজ মাঠ আর শস্য খেত। দূরে-দূরে দেখা যাচ্ছে ছোটো ছোটো পাহাড়। মাঝে মাঝে পড়ন্ত রোদে চকচক করছে নদীর জল। বেড়াতে ভালো লাগছিল।

ফেরবার মুখে আকাশে দেখা দিলে মস্ত একখানা কালো মেঘ। সূর্য তখনও অস্ত যায়নি, কিন্তু আলো হয়ে এল নিবু-নিবু। দেখতে দেখতে আকাশ ডুব দিলে অন্ধকারে। দূরে জেগে উঠল একটা অস্পষ্ট শব্দ, বুঝলুম ঝড় এসেছে।

এই খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ের সঙ্গে আলাপ করা সুবিধাজনক হবে বলে মনে হল না। খানিক তফাতে পথের ধারের জঙ্গলের ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছিল একখানা জীর্ণ সেকেলে বাড়ির খানিকটা। সেইদিকেই ছুটলুম।

মাঝারি আকারের দোতলা বাড়ি। তার গা থেকে মাঝে মাঝে চুন-বালির প্রলেপ খসে পড়েছে। এখানে-ওখানে গজিয়ে উঠেছে অশত্থ-বটের দল। কোনো কোনো জানলার পাল্লা ভাঙা। দেখলেই বলা যায়— এ হচ্ছে পরিত্যক্ত বাড়ি।

হোক পরিত্যক্ত, আমার এখন চাই খালি মাথার ওপরে একটা আচ্ছাদন। কারণ গাছে দোলা দিয়ে এবং চারিদিকে ধুলো-কাঁকর উড়িয়ে দুর্দান্ত ঝড় একেবারে কাছে এসে পড়েছে। কাছে এসে দেখলুম সদরের দু-খানা কবাটই ভেঙে পড়েছে। ভেতরে ঢুকেই বাঁ-দিকে পেলুম একখানা ঘর। মেঝের ওপরে পুরু ধুলো, কোথাও কোনো আসবাব নেই। তিনটে ভাঙা জানলা দিয়ে ঘরের ভিতরে হু-হু করে ঢুকছে ঝড়ের সঙ্গে কাঁকর, ধুলো, বালি।

এ ঘরে মন আশ্রয় নিতে চাইলে না। পায়ে পায়ে বাড়ির ভিতর দিয়ে এগিয়ে পেলুম একটি উঠোন। তারই এককোণে সিঁড়ির সার। আমি ওপরে উঠতে লাগলুম। যেখানে পা দিই, সেখানেই পুরু ধুলোর উপরে ছড়ানো হরেকরকম নোংরা জিনিস।

সিঁড়ির পাশেই ছিল একটি ঘর, তারও দরজা খোলা। কিন্তু ঘরের ভিতরে পা বাড়াতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম।

আমি ভীতু লোক নই, কোনোরকম কুসংস্কারও আমার নেই। কিন্তু কেন জানি না, আমার পা-দুটো যেন হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে আর আমাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইল না। কেন যে নীরবে আমার কানে কানে বললে, ‘ও ঘরে ঢুকো না, ও ঘর নিরাপদ নয়!’

এ-রকম অহেতুকী ভয় আমার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আকাশে মেঘের সমারোহ দেখছি চারিদিকে ঝড়ের গর্জনও শুনছি কিন্তু এখনও দিনের আলো মরে যায়নি। একবার উঁকি মেরেও ঘরের ভিতরে কারুকে দেখতে পেলুম না। নিজের মনে-মনেই হেসে হাতের মোটা ভারী লাঠিগাছা ভালো করে চেপে ধরে আমি ঘরের ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালুম।

দুই

শূন্য ঘর। কেবল মেঝের একদিকে পড়ে আছে একখানা ধূলি ধূসরিত ছেঁড়া মাদুর এবং দেওয়ালের একটা হুকে ঝুলছে লম্বা একটা কোর্তা।

কোর্তাটার সমানে গিয়ে দাঁড়ালুম। পুরোনো বেরঙা জামা গায়ে দিলে তার তলদেশটা গিয়ে পড়বে হাঁটুর নীচে। পুরু বনাতে তৈরি শীতবস্ত্র। কিন্তু এ জামাটাকে এখানে এমনি নিশ্চয়ই বেশিদিন আগে ঝুলিয়ে রেখে যায়নি। কারণ জামাটার কোথাও এতটুকু ধুলোর চিহ্ন নেই— যেন এখনও তাকে নিয়মিতরূপে ব্যবহার করা হয়।

হঠাৎ নীচের দিকে চোখ পড়ল। কোর্তার ঠিক তলায় ধুলোর ওপরে এবং ঘরের অন্যান্য দিকেও অদ্ভুত সব টানা-হ্যাঁচড়ার দাগ! এ-সব দাগ কীসের? অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম। মনে হল, কেউ যেন কোর্তাটাকে ধুলোর উপরে লুটিয়ে ঘরময় টানাটানি করে বেড়িয়েছে। হেঁট হয়ে দেখলুম, কোর্তার তলদেশে ধুলোর চিহ্ন রয়েছে বটে! এমন আশ্চর্য আচরণের অর্থ কী?

কোর্তাটার উপরে হাত রেখে আরও ভালো করে পরীক্ষা করতে করতে দেখলুম, বুক পকেটের উপরে রয়েছে একটা প্রায় এক ইঞ্চি চওড়া ছ্যাঁদা? আর এই ছ্যাঁদার চারিপাশে ওই শুকনো দাগটাই বা কীসের? এ কি রক্তের দাগ? কোর্তার উপরে কেউ কি ছোরার আঘাত করেছিল? তাহলে কি এই জামাটাকে কোনো মৃতদেহের গা থেকে খুলে নিয়ে এইখানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে?

মনের ভিতর জেগে উঠল কেমন একটা ঘৃণার শিহরণ। তারপরেই মনে হল, কোর্তার গা থেকে বেরুচ্ছে যেন পচা মাংসের দুর্গন্ধ। যদিও বুঝলুম, এ হচ্ছে আমার মিথ্যা সন্দেহ বা মনের ভ্রম; তবু কোর্তাটার কাছে আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা হল না। তাড়াতাড়ি সরে এসে ঘরের একটা জানালা খুলে দিলুম।

ঝড়ের গোলমাল কমে এসেছে বটে, কিন্তু তখনও মেঘের ঘোর কাটেনি এবং বৃষ্টি পড়ছে ঝম ঝম করে। দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে দেখা গেল প্রায় সিকিমাইল দূরে রয়েছে একখানি বৃষ্টিধৌত গ্রামের ছবি। মনে মনে বললুম, আগে জানা থাকলে এই ছমছমে ভাব-ভরা পোড়ো বাড়িতে না-এসে ওই গ্রামে গিয়েই আশ্রয় গ্রহণ করতুম। এ যেন অলক্ষুণে বাড়ি! ঘরের ভিতরটা ক্রমেই যেন কেমনতরো হয়ে উঠছে। এখানে আমি যেন আর একলা নই!

হঠাৎ বাইরের বারান্দায় ধপাস করে একটা শব্দ হল। কে যেন মাটির উপর এক বস্তা কাপড় ফেলে দিল।

দৌড়ে বাইরে গেলুম। বারান্দায় কোনো কাপড়ের বস্তা বা জনপ্রাণী নেই। এক মুহূর্ত আগে এখানে যে কেউ এসেছিল তারও প্রমাণ পেলুম না। যেইই আসুক, ধুলোর উপর পদচিহ্ন থাকতই। কিন্তু তবু একটা শব্দ যে আমি শুনেছি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কে শব্দ করলে? আর কীসেরই বা শব্দ? এ বাড়িতে কি আমি ছাড়া আর কেউ লুকিয়ে আছে? কে সে? চোর? ডাকাত? ফেরারি আসামি?

তারপরেই আমার সারা গায়ে কাঁটা দিলে। কারণ স্পষ্ট শুনলুম যে-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলুম তারই ভিতর থেকে যেন কে চাপা-গলায় হেসে উঠছে!

আর ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখবার সাহস হল না। হতে পারে, যা শুনেছি সবই আমার কানের বা মনের ভুল, তবু এ-রকম সন্দেহজনক বাড়ির ভিতরে আর থাকা উচিত নয়। এর চেয়ে বৃষ্টিতে ভেজাও ভালো!

মালকোঁচা মেরে কাপড় পরে সিঁড়ির দিকে এগুতে এগুতে ভয়ে ভয়ে আবার পিছন ফিরে তাকালুম। ঘরের দরজার ওপাশ থেকে একটা চলন্ত ছায়া যেন বারান্দার উপরে এসে পড়ল এবং পরমুহূর্তে দেখলুম দরজা জুড়ে বিরাজ করছে সেই সুদীর্ঘ কোর্তাটা!

আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম পাথরের মূর্তির মতন— কতক্ষণ ধরে জানি না! কে যেন বিষম এক সম্মোহন মন্ত্রে আমার নড়বার শক্তি একেবারে হরণ করে নিলে। আমার অসাড় হাত থেকে খসে লাঠিগাছা সশব্দে মেঝের উপর পড়ে গেল।

তিন

কিন্তু আমি ভাববার শক্তি হারালুম না। বেশ বুঝলুম, আমি দাঁড়িয়ে আছি নরকের দূতের সামনে। ও যদি একবার আমাকে স্পর্শও করে তাহলে কেবল আমার দেহই ধ্বংস হবে না— আমার আত্মাও হবে নরকস্থ!

কোর্তা সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে— তার ভিতরে এসে আবির্ভূত হয়েছে যেন কোনো ভয়াবহ অদৃশ্য দেহ! জামার হাতার বাইরে হাত নেই, তলদেশে পায়ের চিহ্নও নেই, কিন্তু এইবারে সেটা ধীরে ধীরে আমার দিকে অগ্রসর হতে লাগল!

তবু আমি নিশ্চল হয়ে বিস্ফারিত চক্ষে তাকিয়েই রইলুম।

কোর্তা আসছে, আসছে— এগিয়ে আসছে! পদশব্দ নেই, সে এগিয়ে আসছে যেন শূন্যপথে।… সে এগিয়ে এসে দাঁড়াল আমার সামনেই। তারপর হাত দুটো বাড়িয়ে দিলে আমার দিকে। এইবারে সে আমাকে স্পর্শ করবে।

হঠাৎ প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলুম, ‘ভগবান, ভগবান!’— সঙ্গে-সঙ্গেই ফিরে পেলুম আমার সমস্ত শক্তি!

পাগলের মতো হেঁট হয়ে পড়ে মাটির উপর থেকে তুলে নিলুম আমার মোটা লাঠিগাছা এবং সজোরে আঘাত করলুম কোর্তার উপরে! আশ্চর্য! পরমুহূর্তেই সেটা সাধারণ জামার মতোই ঠিকরে পড়লে আমার পায়ের তলায়।

একলাফে জামাটা পার হয়ে সিঁড়ির দিকে বেগে ছুটে গেলুম। নামবার আগে বিদ্যুতের মতন এবার ফিরে দেখলুম, কোর্তাটা আবার শূন্যে উঠে দাঁড়াচ্ছে— যেন সে আবার আমাকে অনুসরণ করবে।

তিন-চার লাফে এসে পড়লুম একতলায়।

মানুষ যে কত জোরে ছুটতে পারে, সেদিন সেটা প্রথম অনুভব করলুম। জানালা থেকে দেখা সেই গ্রামের এক মুদির দোকানে না-এসে থামলুম না।

মাটির উপরে এলিয়ে বসে পড়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললুম, ‘জল! এক গেলাস জল!’

চার

বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরে মুদির মুখে যা শুনলুম তা হচ্ছে এই—

পঁচিশ বছর আগে ওই বাড়িতে বাস করত এক দারোগা। তার প্রকৃতি ছিল এমন ভীষণ যে, এ অঞ্চলের সাধু-অসাধু সমস্ত লোকেই অতিষ্ঠ হয়ে পরিত্রাহি ডাক ছাড়তে আরম্ভ করেছিল।

হঠাৎ কে একদিন ছোরা মেরে দারোগাকে হত্যা করে যায়। সেই দিন থেকে ও-বাড়ি খালি পড়ে আছে। হাজার টাকা পুরস্কারের লোভ দেখালেও এ অঞ্চলের কোনো গরিব ভিখারিও ওই বাড়ির ভিতরে ঢুকতে চাইবে না।

সকল অধ্যায়

১. মূর্তি
২. কী?
৩. ওলাইতলার বাগানবাড়ি
৪. বাঁদরের পা
৫. বাড়ি
৬. বন্দি আত্মার কাহিনি
৭. জ্বলন্ত চক্ষু
৮. কোর্তা
৯. জীবন্ত মৃতদেহ
১০. অভিশপ্ত মূর্তি
১১. ভূতের রাজা
১২. অদৃশ্যের কীর্তি
১৩. ছায়া-কায়া-মায়া
১৪. কঙ্কাল-সারথি
১৫. এক রাতের ইতিহাস
১৬. কিসমৎ
১৭. ডাকবাংলো
১৮. দিঘির মাঠে বাংলো
১৯. পিশাচ
২০. ভীমে-ডাকাতের বট
২১. রুদ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি
২২. কে?
২৩. মিসেস কুমুদিনী চৌধুরি
২৪. চিলের ছাতের ঘর
২৫. খামেনের মমি
২৬. ক্ষুধিত জীবন
২৭. শয়তান
২৮. ভেলকির হুমকি
২৯. শয়তানী-জুয়া
৩০. বাঘের চোখ
৩১. জাগ্রত হৃৎপিণ্ড
৩২. টেলিফোন
৩৩. সূর্যদেবতার পুরোহিত
৩৪. ভৌতিক, না ভেলকি?
৩৫. ‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!
৩৬. মাঝরাতের ‘কল’
৩৭. পেপির দক্ষিণ পদ
৩৮. নবাব কুঠির নর্তকী
৩৯. মামূর্তের দানব-দেবতা
৪০. মুক্তি
৪১. নবাবগঞ্জের সমাধি
৪২. কলকাতার বিজন দ্বীপে
৪৩. বাদশার সমাধি
৪৪. অভিশপ্ত নীলকান্ত
৪৫. পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক
৪৬. আয়নার ইতিহাস
৪৭. রামস্বামীর উপল মণি
৪৮. বাড়ি, বুড়ো, বুট
৪৯. আধ খাওয়া মড়া
৫০. আজও যা রহস্য
৫১. রহস্যময় বাড়ি
৫২. মানুষ, না পিশাচ?
৫৩. ঐন্দ্রজালিক
৫৪. অভিশপ্তা
৫৫. নসিবের খেলা
৫৬. বিছানা
৫৭. লোটা
৫৮. কিন্তু
৫৯. কায়া কি ছায়া কি মায়া
৬০. তবে
৬১. নবাব বাহাদুরের বংশধর
৬২. মৃতদেহ
৬৩. নরকের রাজা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন