বাড়ি

হেমেন্দ্রকুমার রায়

বাড়ি

পাঁচ বছর আগে আমার ভারি অসুখ হয়েছিল। সেই সময়ে রোজই রাত্রে আমি ঠিক একই স্বপ্ন দেখতুম।

স্বপ্নে দেখতুম, আমি যেন শহরের বাইরে এক পাড়াগাঁয়ে গিয়েছি।

আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে রোজই এগিয়ে যাই। পথের দু-ধারে কোথাও কলা গাছের ঝাড়, বাতাসে সবুজ নিশান উড়িয়ে দিয়েছে; কোথাও মেদি গাছের বেড়া দেওয়া নানান ফুলের বাগান, মৌমাছি আর প্রজাপতিরা সেখানে মধু চয়নের খেলা খেলছে; কোথাও তালকুঞ্জের ছায়া-দোলানো এবং কাঁচা রোদের সোনা-ছড়ানো ঝরঝরে সরোবর, ঘাটে ঘাটে নববধূরা ঘোমটায় মুখ ঢেকে কলসিতে জল ভরে নিচ্ছে।

পথ যেখানে ফুরিয়ে গেছে, সেইখানে একখানি মস্ত বাড়ি— দূর থেকে ছবির মতন দেখতে।

সামনেই ফটক, কিন্তু সেখানে কোনো দারোয়ান নেই। বাড়ির চারিদিকে জমিতে কত রকমের গাছ— গন্ধরাজ, বকুল, রঙন, শিউলি, আরও কত কী! মাঝে মাঝে কিছু ঝোপে রং-বেরঙের মেলা।

রোজই বেড়াতে বেড়াতে বাড়িখানির সামনে গিয়ে দাঁড়াই— অপলক চোখে তার পানে তাকিয়ে থাকি, ভিতরে যাবার জন্যে প্রাণে সাধ জাগে।

কিন্তু জনপ্রাণীকে দেখতে পাই না। ফটকের কাছ থেকে চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করলেও কেউ সাড়া দেয় না। পরের বাড়ি, না-জানিয়ে ভিতরে ঢুকতেও ভরসা হয় না। ফিরে আসি।

রাতের-পর-রাত যায়, আমি খালি ওই একই স্বপ্ন দেখি। বার বার অনেক বার ওই একই স্বপ্ন দেখে দেখে আমার মনে দৃঢ় ধারণা হল যে, অজ্ঞাত শৈশবে নিশ্চয়ই কারুর সঙ্গে আমি ওই বাড়িতে গিয়েছিলুম।

আমার অসুখ সেরে গেল। কিন্তু তবু সেই স্বপ্নে-দেখা বাড়িকে ভুলতে পারলুম না। মাঝে মাঝে এদেশ-ওদেশ বেড়াতে যেতুম। পথে বেরুলেই চারিদিক লক্ষ করে দেখতুম, স্বপ্নের বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় কি না।

একবার এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে কুসুমপুর গ্রামে যাই।

বৈকালে বেড়াতে বেরিয়ে একটা গেঁয়োপথ পেলুম। দেখেই চিনলুম, এ আমার সেই স্বপ্নে দেখা পথ। পথের দু-ধারে সেই কলা গাছের ঝাড়, মেদি গাছের বেড়া দেওয়া বাগান, আলো-ছায়া-ভরা পুকুরঘাট। অনেক দিন অদর্শনের পর পুরোনো বন্ধুকে দেখলে মনে যে আনন্দের ভাব জাগে, আমারও মনে তেমনি ভাবের ছোঁয়া লাগল।

আঁকাবাঁকা পথের শেষে ছবির মতন সেই বাড়িখানি।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। ডাকাডাকি করতে লাগলুম।

ভেবেছিলুম, কারুর সাড়া পাব না। কিন্তু আমার ডাক শুনেই একজন বুড়ো দারোয়ান ভিতর থেকে বেরিয়ে এল।

‘কাকে চান?’

‘কারুকে নয়। এই বাড়িখানা আমার বড়ো ভালো লেগেছে। ভিতরে ঢুকে একবার দেখতে পারি কি?’

‘আসুন না! এ বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে।’

‘বাড়িওয়ালা কোথায় থাকেন?’

‘এইখানেই থাকতেন। কিন্তু কিছুদিন হল, এ বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন।’

‘বলো কী! এমন চমৎকার বাড়ি কেউ ছেড়ে দেয়?’

‘ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।’

‘কেন?’

‘ভূতের উপদ্রবে।’

‘ভূত! একালেও লোকে ভূত বিশ্বাস করে নাকি?’

দারোয়ান গম্ভীর মুখে বললে, ‘আমিও বিশ্বাস করতুম না। কিন্তু এখন বিশ্বাস না-করে উপায় নেই। যে ভূতটার ভয়ে আমার মনিব এ বাড়ি ছেড়েছেন, রাত্রে আমিও তাকে স্বচক্ষে অনেক বার দেখেছি। তার মুখ আমি ভুলিনি।’

অবহেলার হাসি হেসে আমি বললুম, ‘ডাহা গাঁজাখুরি গল্প।’

দারোয়ান বিরক্তভাবে আমার মুখের দিকে তাকালে। বললে, ‘গাঁজাখুরি গল্প? অন্তত আপনার মুখে এ কথা শোভা পায় না। অনেক বার যে ভূতকে আমি দেখেছি, যার মুখ আমি এ জীবনে ভুলব না— সে হচ্ছেন আপনি নিজে! আমি আপনাকেই দেখেছি!’

সকল অধ্যায়

১. মূর্তি
২. কী?
৩. ওলাইতলার বাগানবাড়ি
৪. বাঁদরের পা
৫. বাড়ি
৬. বন্দি আত্মার কাহিনি
৭. জ্বলন্ত চক্ষু
৮. কোর্তা
৯. জীবন্ত মৃতদেহ
১০. অভিশপ্ত মূর্তি
১১. ভূতের রাজা
১২. অদৃশ্যের কীর্তি
১৩. ছায়া-কায়া-মায়া
১৪. কঙ্কাল-সারথি
১৫. এক রাতের ইতিহাস
১৬. কিসমৎ
১৭. ডাকবাংলো
১৮. দিঘির মাঠে বাংলো
১৯. পিশাচ
২০. ভীমে-ডাকাতের বট
২১. রুদ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি
২২. কে?
২৩. মিসেস কুমুদিনী চৌধুরি
২৪. চিলের ছাতের ঘর
২৫. খামেনের মমি
২৬. ক্ষুধিত জীবন
২৭. শয়তান
২৮. ভেলকির হুমকি
২৯. শয়তানী-জুয়া
৩০. বাঘের চোখ
৩১. জাগ্রত হৃৎপিণ্ড
৩২. টেলিফোন
৩৩. সূর্যদেবতার পুরোহিত
৩৪. ভৌতিক, না ভেলকি?
৩৫. ‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!
৩৬. মাঝরাতের ‘কল’
৩৭. পেপির দক্ষিণ পদ
৩৮. নবাব কুঠির নর্তকী
৩৯. মামূর্তের দানব-দেবতা
৪০. মুক্তি
৪১. নবাবগঞ্জের সমাধি
৪২. কলকাতার বিজন দ্বীপে
৪৩. বাদশার সমাধি
৪৪. অভিশপ্ত নীলকান্ত
৪৫. পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক
৪৬. আয়নার ইতিহাস
৪৭. রামস্বামীর উপল মণি
৪৮. বাড়ি, বুড়ো, বুট
৪৯. আধ খাওয়া মড়া
৫০. আজও যা রহস্য
৫১. রহস্যময় বাড়ি
৫২. মানুষ, না পিশাচ?
৫৩. ঐন্দ্রজালিক
৫৪. অভিশপ্তা
৫৫. নসিবের খেলা
৫৬. বিছানা
৫৭. লোটা
৫৮. কিন্তু
৫৯. কায়া কি ছায়া কি মায়া
৬০. তবে
৬১. নবাব বাহাদুরের বংশধর
৬২. মৃতদেহ
৬৩. নরকের রাজা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন