তবে

হেমেন্দ্রকুমার রায়

একবার দেওঘরে গিয়ে বড়ো বিপদে পড়েছিলুম।

বাড়ি ভাড়া করেছিলুম নদীর ধারে। সেখান থেকে শহরে আসা-যাওয়ার একমাত্র পথের মাঝখানে ছিল মস্তবড়ো একটা ঝাঁকড়া বট গাছ। স্থানীয় লোকরা বলত, ঐ বট গাছের ডালে কবে কোন লোক উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করেছিল। তার প্রেতাত্মা আজও ওই গাছে বাস করে এবং রাতের পথিকদের দেখা দেয়।

একদিন মনে হল প্রেতাত্মা মহাশয় গাছ ছেড়ে আমারও ঘাড়ে চাপতে চান।

ফুটফুটে চাঁদনি রাত। চারিদিক নিরালা ও নির্জন। একলা পথিক বাসায় ফিরছি। বট গাছটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। ভৌতিক পরিস্থিতিকে যেন অধিকতর ঘোরালো করে তোলবার জন্যেই কোথা থেকে একটা প্যাঁচাও চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেরা গলায় চ্যাঁচাতে শুরু করে দিলে।

দু-দুটো অমানুষিক আগুন-চোখ দপদপিয়ে জ্বলতে জ্বলতে উপরে উঠছে, নীচে নামছে, কখনো ডাইনে আর কখনো বাঁয়ে সরে সরে যাচ্ছে।

স্বচক্ষে দীপ্ত চক্ষু দেখে আমার চক্ষুস্থির! ভূত মানি আর না মানি, সেদিন ভয় পাইনি বললে সত্য বলা হবে না। এগুতে বা পেছুতে পারিনি, স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম। তার পরের দিন সকালের আলোয় আবার যদি সেখানে তদারক করতে না যেতুম, তাহলে সেই ব্যাপারটা অকাট্য চাক্ষুষ প্রমাণ বলেই গ্রহণ করতুম।

গাছের ডালে ঝুলছিল আধহাত লম্বা টিনের ফালি— বাসা তৈরি করবার জন্যে কাক বা অন্য কোনো পক্ষী সেটাকে উপরে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল। টিনের দুইপ্রান্ত দুমড়ানো, তার উপরে প্রতিফলিত হয়েছিল চাঁদের আলো এবং বাতাসে আন্দোলিত তরুশাখা সেই নকল জ্বলন্ত চোখদুটোকে করে তুলেছিল নড়ন্ত।

আচ্ছা, এ গেল যেন চোখের ভ্রম। কিন্তু অতঃপর যে ঘটনার কথা বলব, তাকে আজও চোখের ভ্রম বলে মানতে রাজি নই।

আমাদের পাথুরিয়াঘাটার বসতবাড়ির পিছনে একটি হাত দেড়েক চওড়া পোড়োখানা ছিল, আগেই তার কথা বলা হয়েছে। সেইখানা দিয়ে বয়ে যেত কয়েক খানা বাড়ির নর্দমার জল। আমার ত্রিতলের শয়নগৃহের নীচের দিকে ছিল সেইখানা।

সহধর্মিণী ও আমি শুয়ে আছি আপন আপন শয্যায়। গভীর রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে গেল এবং কিছুতেই চোখের পাতায় লাগল না আর ঘুমের আমেজ। বিরক্ত হয়ে বিছানার উপরে উঠে বসলুম।

নিঝুম রাত। আকাশে চাঁদের আলো। ঘর অন্ধকার। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছি।

আচম্বিতে অদ্ভুত একটা মূর্তি খানার ভিতর থেকে জানালার উপরে এসে উঠল। ছোটো মূর্তি, অবিকল মানবশিশুর মতো।

পিছনকার চাঁদনিতে সমুজ্জ্বল আকাশপটে মূর্তিটাকে দেখাচ্ছিল যেন গাঢ় কালি দিয়ে আঁকা। কিন্তু তার চোখদুটো গড়া যেন অগ্নিশিখা দিয়ে!

ছোটো ছোটো দুই হাতে জানালার দুটো লোহার গরাদে ধরে সেই শিশুমূর্তি জ্বলন্ত চক্ষু বিস্ফারিত করে আমার পানে তাকিয়ে রইল— মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে। তারপর আরও ভালো করে দেখতে-না-দেখতেই সে ঊর্দ্ধে দুইহাত তুলে ঘরের বাইরেকার খাড়া ও মসৃণ দেওয়ালের উপর দিয়ে ছাদের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল!

শঙ্কিত নয়, আমি হয়েছিলুম চমকিত ও বিস্মিত। এ যেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব এবং এর কোনো অর্থই হয় না।

মূর্তিটার অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে গেল আমার চটকা। একলাফে খাট থেকে পড়ে চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই ঘরের কোণ থেকে একগাছা বাঁশের লাঠি টেনে নিয়ে আমি বেরিয়ে গেলুম বাইরে। ভূত হোক, মানুষ হোক, পশু হোক, নিশুতি রাতে শয়নগৃহে বসে এমন অসামরিক উপদ্রব আমি সহ্য করব না।

তেতালার ছাদের উপরে নেই জনপ্রাণী। দিকে দিকে চোখের সামনে পড়ে রয়েছে অন্যান্য বাড়ির ছাদের পর ছাদ। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় কোথাও যেন রহস্য লুকিয়ে থাকবার উপায় নেই। এত তাড়াতাড়ি কোনো দৃশ্যমান বস্তুর অদৃশ্য হবার কথা নয় এবং তা সম্ভবপর বলেও বিশ্বাস করি না। মূর্তিটা তবে গেল কোথায়?

এবং সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে, কী সেটা? বিড়াল? হলফ করে বলতে পারি, এইমাত্র যে দেখা দিয়েছিল, তার পক্ষে চতুষ্পদ জীব হওয়া অসম্ভব। বিড়াল বা অন্য কোনো চতুষ্পদ জীব মানুষের মতো দুই হাত দিয়ে গরাদে ধরে উবু হয়ে বসতে পারে না। তার গোটা দেহের বহিঃরেখা নিশ্চিত রূপেই মানবশিশুর মতো এবং তার লাঙ্গুলও ছিল না।

বানর? কিছুতেই না। ও পাড়ায় বানরের অত্যাচার নেই। উপরন্তু জলভরা খানায় থাকে না বানরের ডেরা। সবচেয়ে উল্লেখ্য, নিশাচর বানরের কথা শোনা যায় না।

মাকড়সা প্রভৃতি এবং টিকটিকির মতো সরীসৃপ জাতীয় জীব ছাড়া আর কেউ মসৃণ দেওয়াল বয়ে উপরে উঠতে পারে না। জানালা ও ছাদের মাঝখানে ছিল অনেকটা খাড়া তেলা ও নিরেট দেওয়াল।

তবে?

এই প্রশ্নচিহ্নিত শব্দটির উত্তর অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি।

*  স্মরণের জাদুঘরে, ডি এস লাইাব্রেরি, প্রথম প্রকাশ ১৩৬৩

সকল অধ্যায়

১. মূর্তি
২. কী?
৩. ওলাইতলার বাগানবাড়ি
৪. বাঁদরের পা
৫. বাড়ি
৬. বন্দি আত্মার কাহিনি
৭. জ্বলন্ত চক্ষু
৮. কোর্তা
৯. জীবন্ত মৃতদেহ
১০. অভিশপ্ত মূর্তি
১১. ভূতের রাজা
১২. অদৃশ্যের কীর্তি
১৩. ছায়া-কায়া-মায়া
১৪. কঙ্কাল-সারথি
১৫. এক রাতের ইতিহাস
১৬. কিসমৎ
১৭. ডাকবাংলো
১৮. দিঘির মাঠে বাংলো
১৯. পিশাচ
২০. ভীমে-ডাকাতের বট
২১. রুদ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি
২২. কে?
২৩. মিসেস কুমুদিনী চৌধুরি
২৪. চিলের ছাতের ঘর
২৫. খামেনের মমি
২৬. ক্ষুধিত জীবন
২৭. শয়তান
২৮. ভেলকির হুমকি
২৯. শয়তানী-জুয়া
৩০. বাঘের চোখ
৩১. জাগ্রত হৃৎপিণ্ড
৩২. টেলিফোন
৩৩. সূর্যদেবতার পুরোহিত
৩৪. ভৌতিক, না ভেলকি?
৩৫. ‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!
৩৬. মাঝরাতের ‘কল’
৩৭. পেপির দক্ষিণ পদ
৩৮. নবাব কুঠির নর্তকী
৩৯. মামূর্তের দানব-দেবতা
৪০. মুক্তি
৪১. নবাবগঞ্জের সমাধি
৪২. কলকাতার বিজন দ্বীপে
৪৩. বাদশার সমাধি
৪৪. অভিশপ্ত নীলকান্ত
৪৫. পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক
৪৬. আয়নার ইতিহাস
৪৭. রামস্বামীর উপল মণি
৪৮. বাড়ি, বুড়ো, বুট
৪৯. আধ খাওয়া মড়া
৫০. আজও যা রহস্য
৫১. রহস্যময় বাড়ি
৫২. মানুষ, না পিশাচ?
৫৩. ঐন্দ্রজালিক
৫৪. অভিশপ্তা
৫৫. নসিবের খেলা
৫৬. বিছানা
৫৭. লোটা
৫৮. কিন্তু
৫৯. কায়া কি ছায়া কি মায়া
৬০. তবে
৬১. নবাব বাহাদুরের বংশধর
৬২. মৃতদেহ
৬৩. নরকের রাজা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন