মঙ্গল সংক্রান্তির কথা

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

সমান মাস, শুক্লপক্ষ, সংক্রান্তি মঙ্গলবার হলে মঙ্গল সংক্রান্তি বলে। একদিন এক বাড়ির বউয়েরা সব মিলে গিন্নিকে বললে, ‘মা! মঙ্গল সংক্রান্তি করো।’ গিন্নি বললেন, ‘না বাছা! আমি শুকিয়ে থাকতে পারব না।’ বউয়েরা মঙ্গল সংক্রান্তি করলে, কিন্তু গিন্নি রেঁধে বেড়ে ভাত খেলেন। কিছুদিন পরে গিন্নির ব্যায়রাম হল। কত ভালো ভালো কবিরাজ দেখলে, কিছুতেই রোগ ভালো হল না। দিন দিন রোগের বৃদ্ধি হতে লাগল। খায় দায় শুকিয়ে যায়। ছেলেরা বউদের গালাগালি দেয়, বলে,—‘তোরা আমাদের মাকে যত্ন করিস না, খেতে দিস না, তাই মা রোগা হয়ে যাচ্ছেন।’ ছেলেরা নিজে নিজে মাকে যত্ন করতে লাগল। তেল মাখান, স্নান করান, ক্ষীর ছানা মাখন ভালো ভালো জিনিস খাওয়ান, কিছুতেই মা সারে না। মার আরও দিন দিন খোনা সুর হয়ে যেতে লাগল, গায়ের গন্ধে কেউ কাছে যেতে পারে না। গিন্নি একলা শুয়ে থাকেন, রাত্রে ঘরের ভেতর গাঁ গাঁ, গোঁ গোঁ, ঠক ঠক, থপ থপ শব্দ হয়। ছেলেরা ও বউয়েরা ভয়ে অস্থির, মায়ের ঘরে এ কীসের শব্দ!

একদিন বউয়েরা ও ছেলেরা সকলে এক হয়ে বললে, ‘এসো, আমরা জেগে থাকি, দেখি ব্যাপারটা কী!’ সেদিন মায়ের ঘরের দরজা খুলে রেখে সকলে এক জায়গায় বসে রইল। গিন্নি প্রথম প্রহরে শাঁক হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল, দ্বিতীয় প্রহরে তাম্রকুন্ড হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল, তৃতীয় প্রহরে গোরু হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল, চতুর্থ প্রহরে রক্তসরা হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ছেলেরা বউয়েরা সকলেই এই সব ব্যাপার দেখে আর কেউ কাছে যেতে পারলে না, তার পরদিন একজন ভালো রোজা আনিয়ে মাকে দেখালে। রোজা বললে, ‘তোমাদের মা তো বেঁচে নেই বাপু। মেয়েমানুষ ঋতুকালে ব্রাহ্মণ ছুঁলে রক্তসরা হয়, শাঁক ছুঁলে শাঁক হয়, তামা ছুঁলে তাম্রকুন্ড হয়, গোরু ছুঁলে গোরু হয়। তোমার মায়ের সেই সব দোষ হয়েছে। সমান মাস, শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে সংক্রান্তি হলে, সেই মঙ্গল সংক্রান্তি স্ত্রীলোকের করা উচিত। কারণ মেয়েদের তাহলে আর কোনো দোষ থাকে না। যারা মঙ্গল সংক্রান্তি না করে, তাদের কষ্ট পেতে হয়।’

এই কথা শুনে ছেলেরা বললে, ‘তবে কি আমাদের মায়ের কোনো উপায় হবে না? রোজা বললে, ‘হতে পারে, যদি কেউ একটি মঙ্গল সংক্রান্তির ফল দেয়। সেই ফল ধুয়ে খাইয়ে দিলে তোমার মায়ের গতি হবে।’ বউদের বলতে কেউ দিতে স্বীকার হল না। কেবল ছোটো বউ বললে, ‘আমার সাতটি সুপারি আছে, আমি তার একটি মাকে দিতে পারি। তা বলে কি আমার শাশুড়ি চিরকাল কষ্টভোগ করবেন?’ পরদিন সকালবেলা ছোটো বউ স্নান করে পুরোহিতকে ডাকিয়ে লালসুতো বাঁধা একটি সুপারি ফল এনে দিলে। সেই ফল শাশুড়ির নামে সংকল্প করে বললে, ‘মা, আমার এই মঙ্গল সংক্রান্তির ফলটি তোমাকে দিলাম; তুমি এর পুণ্য ভোগ করো।’ এই বলে সেই সুপারিটি ধুয়ে জল খাইয়ে দিলে। সুপারিটি গিন্নির হাতে দেবামাত্র গিন্নী মুক্তিলাভ করলেন। তখন সকলে আশ্চর্য হয়ে গেল। এই কথা চারিদিকে রাষ্ট্র হল। ক্রমে দেশ-বিদেশে এই মঙ্গল সংক্রান্তির কথা প্রচার হল। সকল স্ত্রীলোকেরই এই মঙ্গল সংক্রান্তির ব্রত করা উচিত।

মঙ্গল সংক্রান্তির ব্রতকথা সমাপ্ত।

সকল অধ্যায়

১. ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা
২. কার্তিক মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা
৩. পৌষ মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা
৪. চৈত্র মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা
৫. কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার কথা
৬. ক্ষেত্র ব্রতকথা
৭. মঙ্গলচন্ডী
৮. বারোমেসে মঙ্গলচন্ডী
৯. হরিষ মঙ্গলচন্ডী
১০. জয় মঙ্গলবারের ব্রতকথা
১১. অগ্রহায়ণ মাসের কুলুই মঙ্গলবারের কথা
১২. সংকট মঙ্গলবারের কথা
১৩. সংকটার কথা
১৪. সুয়ো দুয়োর কথা
১৫. নাটাই ব্রতকথা
১৬. মঙ্গল সংক্রান্তির কথা
১৭. ষষ্ঠীর কথা
১৮. অরণ্য ষষ্ঠীর কথা
১৯. লোটন ষষ্ঠীর কথা
২০. চাপড়া ষষ্ঠীর কথা
২১. দুর্গা ষষ্ঠীর কথা
২২. মুলা ষষ্ঠীর কথা
২৩. পাটাই ষষ্ঠীর কথা
২৪. শীতল ষষ্ঠীর কথা
২৫. অশোক ষষ্ঠীর কথা
২৬. নীল ষষ্ঠীর কথা
২৭. মনসার কথা
২৮. ইতুর কথা
২৯. রালদুর্গার ব্রতকথা
৩০. মৌনী অমাবস্যার ব্রতকথা
৩১. জিতাষ্টমীর ব্রতকথা
৩২. বারমেসে অমাবস্যার কথা
৩৩. সাবিত্রী চতুর্দশী ব্রতকথা
৩৪. শিবব্রত
৩৫. পুণ্যি-পুকুর ব্রত
৩৬. দশ-পুত্তল ব্রত
৩৭. হরির চরণ ব্রত
৩৮. অশ্বত্থ পাতা ব্রত
৩৯. গো-কল ব্রত
৪০. পৃথিবী ব্রত
৪১. যমপুকুর ব্রত
৪২. যমপুকুর ব্রতকথা
৪৩. সেঁজুতি ব্রত
৪৪. তুঁষ-তুঁষুলি ব্রত
৪৫. এয়ো-সংক্রান্তি ব্রত
৪৬. গুপ্তধন ব্রত
৪৭. ষোলো-কলা ব্রত
৪৮. রূপ-হলুদ ব্রত
৪৯. অক্ষয়-সিঁদুর ব্রত
৫০. অক্ষয়-ফল ব্রত
৫১. অক্ষয়-কুমারী ব্রত
৫২. মধু-সংক্রান্তি ব্রত
৫৩. ফল-গছানো ব্রত
৫৪. নিত্য-সিঁদুর ব্রত
৫৫. নিৎ-সিঁদুর ব্রত
৫৬. নখছুটের ব্রত
৫৭. সন্ধ্যামণির ব্রত
৫৮. কলাছড়া ব্রত
৫৯. আদা-হলুদ ব্রত
৬০. অক্ষয়-ঘট ব্রত
৬১. সৌভাগ্য-চতুর্থী ব্রত
৬২. আদর-সিংহাসন ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন