তুঁষ-তুঁষুলি ব্রত

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

ব্রতকাল—অঘ্রান মাসের সংক্রান্তি থেকে আরম্ভ করে সারা পৌষ মাস ভোর রোজ তুঁষ-তুঁষুলি ব্রত করতে হয়। চার বৎসর পালন করার পর হয় ব্রত উদযাপন।

ব্রত উদযাপন—উদযাপনের সময় কোথাও কোথাও ব্রাহ্মণকে দিয়ে করানো হয় নারায়ণ-শিলার পুজো আর হোম। ষোড়শোপচারে পুজোই প্রশস্ত, অভাবে পঞ্চোপচারে পুজো করাও চলে। পুজোর পর ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে, ব্রাহ্মণকে দিতে হয় কাপড়, চাদর, আর একটি টাকা দক্ষিণা।

ব্রত অনুষ্ঠান—ব্রত অনুষ্ঠানের জন্যে চাই আলোচালের তুঁষ, এক রঙের কালো গাইয়ের গোবর, সরষে ফুল, আর দূর্বা। কোথাও কোথাও এসব জিনিসের উপর আবার দেয় মুলোর ফুল।

গোবরের সঙ্গে তুঁষ মিশিয়ে ভালো করে মাখবে, তারপর তা দিয়ে নাড়ু তৈরি করবে ছবুড়ি ছগণ্ডা অর্থাৎ ১৪৪টা। প্রত্যেকটি নাড়ুর মাথায় পাঁচগাছি করে দূর্বা গুঁজে দিয়ে, নাড়ুগুলো রাখবে একটা মালসায়। কোথাও কোথাও সেঁজুতির কিছু দুর্বা তুলে রাখার বিধি আছে; তা থেকে দেয় পাঁচগাছি দূর্বা।

নাড়ু তৈরির নিয়মও সব জায়গায় এক রকমের নয়—কোথাও নাড়ু করে ৩১টি, কোথাও ৬২টি, কোথাও বা ১৪৪টি।

পূব কী উত্তরমুখে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পুজো করতে হয়। যারা ৩১টি নাড়ু করবে তারা রোজ একটি করে নাড়ু নিয়ে পুজো করবে। যারা ৬২টি নাড়ু করবে তারা পুজো করবে রোজ দুটি নাড়ু দিয়ে। আর যারা ১৪৪টি নাড়ু করবে তারা রোজ নেবে ৪টি করে নাড়ু। কোথাও কোথাও আবার শনি-মঙ্গলবারে ৬টি নাড়ু নিয়ে পুজো করে।

নাড়ু আর সরষের ফুল (এবং তার সঙ্গে মুলোর ফুলও) হাতে নিয়ে মন্ত্র পড়বে। মন্ত্র:

তুঁষ-তুঁষুলি কাঁধে ছাতি

বাপ মার ধন যাতাযাতি

স্বামীর ধন নিজবতী।

ঘর করব নগরে

মরব গিয়ে সাগরে

জন্মাব উত্তম ব্রাহ্মণ কুলে।

তুঁষুলি গো রাই, তুঁষুলি গো ভাই,

তোমায় বেত্ত করে কী বর পাই

ছবুড়ি ছগণ্ডা ক্ষীরের নাড়ু খাই।

বেত্ত করলে কী হয়

আড়ি মাপা সিঁদুর চায়।

দরবার আলো পুত পায়।

হেঁসেল আলো বউ পায়।

সভা আলো জামাই পায়।

মেঝে আলো ঝি পায়।

আলনায় কাপড় দলমল করে,

সিঁথে সিঁদুর ঝকমক করে,

মুখে পান টপ টপ করে।

গোয়ালে গোরু মরাই ধান

বৎসর বৎসর পুত্র দান।

হবে পুত্র মরবে না

চক্ষের জল পড়বে না।

স্বামীর কোলে পুত্র দিয়ে

মরণ হয় যেন একগলা গঙ্গাজলে।

পুজো হয়ে গেলে নাড়ুগুলো একটা আলাদা হাঁড়িতে তুলে রাখবে।

তারপর মন্ত্র পড়ে নমস্কার করবে। মন্ত্র:

গৌরী গো মা, তোমার কাছে

মাগি এই বর,

স্বামী-পুত্র নিয়ে যেন

সুখে করি ঘর।।

এইভাবে সারা মাস পুজোর পর পৌষ-সংক্রান্তির দিন ৪টি নাড়ু বেশি থাকবে সে কয়টিকেও ফুল-দুর্বা দিয়ে পুজো করে রেখে দেবে সেই আলাদা হাঁড়িটাতে।

তারপর সেই পৌষ-সংক্রান্তির দিনই চাল কী ময়দা দিয়ে ছোটো ছোটো ছবুড়ি ছগণ্ডা (১৪৪টি) নাড়ু করে, নতুন হাঁড়িতে দুধ দিয়ে হাঁড়ি উনুনে চড়িয়ে দেবে। দুধ ফুটলে নাড়ুগুলো দেবে তার মধ্যে ছেড়ে। বেশ সেদ্ধ হয়ে গেলে পর নাবিয়ে নেবে।

তারপর সুবিধেমতো সময় নাড়ু খাবে। খাবার সময় নাড়ুর হাঁড়ি থাকবে পেছন দিকে, তাতে দেবে আগুন। কোথাও কোথাও কুলকাঠের আগুন দেবার নিয়ম আছে।

নাড়ু খাবার সময় মন্ত্র বলবে। মন্ত্র:

তুঁষুলি গো রাই, তুঁষুলি গো ভাই,

তোমার দৌলতে আমি ছবুড়ি ছগণ্ডা খাই।।

খাওয়ার পর সেই আগুনের হাঁড়ি মাথায় করে নিয়ে গিয়ে পুকুরে (বা নদীতে) ভাসিয়ে দিয়ে বলবে। মন্ত্র:

তুঁষ-তুঁষুলি গেল ভেসে,

বাপ-মার ধন এল হেসে।।

তুঁষ-তুঁষুলি গেল ভেসে,

আমার স্বামীর ধন এল হেসে।।

তারপর আবার ‘গৌরী গো মা, তোমার কাছে মাগি এই বর’ ইত্যাদি মন্ত্র পড়ে নমস্কার করবে।

তুঁষ-তুঁষুলি ব্রত সমাপ্ত।

সকল অধ্যায়

১. ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা
২. কার্তিক মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা
৩. পৌষ মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা
৪. চৈত্র মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা
৫. কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার কথা
৬. ক্ষেত্র ব্রতকথা
৭. মঙ্গলচন্ডী
৮. বারোমেসে মঙ্গলচন্ডী
৯. হরিষ মঙ্গলচন্ডী
১০. জয় মঙ্গলবারের ব্রতকথা
১১. অগ্রহায়ণ মাসের কুলুই মঙ্গলবারের কথা
১২. সংকট মঙ্গলবারের কথা
১৩. সংকটার কথা
১৪. সুয়ো দুয়োর কথা
১৫. নাটাই ব্রতকথা
১৬. মঙ্গল সংক্রান্তির কথা
১৭. ষষ্ঠীর কথা
১৮. অরণ্য ষষ্ঠীর কথা
১৯. লোটন ষষ্ঠীর কথা
২০. চাপড়া ষষ্ঠীর কথা
২১. দুর্গা ষষ্ঠীর কথা
২২. মুলা ষষ্ঠীর কথা
২৩. পাটাই ষষ্ঠীর কথা
২৪. শীতল ষষ্ঠীর কথা
২৫. অশোক ষষ্ঠীর কথা
২৬. নীল ষষ্ঠীর কথা
২৭. মনসার কথা
২৮. ইতুর কথা
২৯. রালদুর্গার ব্রতকথা
৩০. মৌনী অমাবস্যার ব্রতকথা
৩১. জিতাষ্টমীর ব্রতকথা
৩২. বারমেসে অমাবস্যার কথা
৩৩. সাবিত্রী চতুর্দশী ব্রতকথা
৩৪. শিবব্রত
৩৫. পুণ্যি-পুকুর ব্রত
৩৬. দশ-পুত্তল ব্রত
৩৭. হরির চরণ ব্রত
৩৮. অশ্বত্থ পাতা ব্রত
৩৯. গো-কল ব্রত
৪০. পৃথিবী ব্রত
৪১. যমপুকুর ব্রত
৪২. যমপুকুর ব্রতকথা
৪৩. সেঁজুতি ব্রত
৪৪. তুঁষ-তুঁষুলি ব্রত
৪৫. এয়ো-সংক্রান্তি ব্রত
৪৬. গুপ্তধন ব্রত
৪৭. ষোলো-কলা ব্রত
৪৮. রূপ-হলুদ ব্রত
৪৯. অক্ষয়-সিঁদুর ব্রত
৫০. অক্ষয়-ফল ব্রত
৫১. অক্ষয়-কুমারী ব্রত
৫২. মধু-সংক্রান্তি ব্রত
৫৩. ফল-গছানো ব্রত
৫৪. নিত্য-সিঁদুর ব্রত
৫৫. নিৎ-সিঁদুর ব্রত
৫৬. নখছুটের ব্রত
৫৭. সন্ধ্যামণির ব্রত
৫৮. কলাছড়া ব্রত
৫৯. আদা-হলুদ ব্রত
৬০. অক্ষয়-ঘট ব্রত
৬১. সৌভাগ্য-চতুর্থী ব্রত
৬২. আদর-সিংহাসন ব্রত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন