৬.২ অরুণকুমার সরকার

অম্লান দত্ত

৬.২ অরুণকুমার সরকার

১৯৭৯ সালের শেষদিকে অরুণকুমার সরকার অবসর গ্রহণ করেন সরকারী চাকরি থেকে। তখন তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ। অবসরগ্রহণের পর দু’মাসের ভিতরেই তিনি চিরবিদায় নেন। জীবনের ঐ শেষ কয়েক মাসে একাধিকবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তাঁর কণ্ঠে কাতরতা ছিল না, যদিও কঠিন কৰ্কটরোগে তাঁর দেহ তখন বিধ্বস্ত। মৃত্যুকে পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি অনায়াসে স্বধর্ম পালন করেছেন এবং আশ্চর্য স্বাভাবিকতার সঙ্গে বন্ধুত্বকে আসনে বসিয়েছেন। এমন গুণবান অথচ নিরহংকার মানুষ আমি বড় দেখিনি।

চাকরির ক্ষেত্রে অরুণ শ্রদ্ধা অর্জন করেন এমন একজন কর্মকর্তা হিসেবে, দুর্নীতির ছায়া যাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। কাজের বাইরে বন্ধুদের ভিতর ছিল অন্য পরিচয়। তাঁর মৃত্যুর পর সমসাময়িক এক কবিবন্ধু লিখেছেন, ‘আমাদের কৈশোর ও যৌবনকে যেন তারই কাছে জমা রেখেছিলাম আমরা।’ কোনো আশ্চর্য যাদুবলে কৈশোরের বন্ধুত্বপ্রিয়তাকে তাঁর জীবনে, আর যৌবনের আবেগকে কবিতায়, রক্ষা করতে পেরেছিলেন। অরুণ, প্রৌঢ়ত্বের প্রান্ত অবধি। অথবা, বলা ভালো, এতে ছিল না কোনো যাদু, ছিল শুধু যাদুর চেয়ে বিস্ময়কর অসামান্য এক সিদ্ধি। এ বিষয়ে মাত্র দুটি কথা বলাই আপাতত যথেষ্ট হবে।

অরুণ সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সাংসারিক যে-উচ্চাভিলাষ অথবা স্বার্থবুদ্ধিতে চেতনার সরল সৌকুমার্য আমরা ধীরে ধীরে হারাই, বন্ধুত্বকেও পণ্য হিসেবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হই এবং বহুবিধ ঈষা ও গ্লানিকে বাস্তববুদ্ধির সমার্থক বলে বিবেচনা করি, অরুণের মন উচ্চাকাঙ্ক্ষাজনিত সময়ের সেই ক্ষয় ও বিকৃতি থেকে মুক্ত ছিল। অতএব তাঁর কৈশোর জীর্ণ হয়নি।

প্রথম যৌবনেই অরুণ সরকার সেই মানবতাবাদের দ্বারা আকৃষ্ট হন, যুক্তিতে যার আস্থা আছে। অথচ একথা তাঁর আবাল্যলালিত কাব্যবুদ্ধির কাছে অজ্ঞাত ছিল না যে, একটি গভীর আবেগ অথবা প্রেমই আমাদের চৈতন্যকে প্রাত্যহিকতার মলিনতা এমন কি অর্থহীনতা থেকে ত্রাণ করতে সক্ষম। অরুণের কবিতায় ও মননে এই দ্বৈত এক অসাধারণ অদ্বৈতে পরিণতি লাভ করে। ভালোবাসাকে অরুণ ভাবালুতার প্রাকৃতিক আবরণ থেকে উদ্ধার করে কাব্যে আহরণ করতে পেরেছিলেন; যৌবনের আবেগ সেখানে তার স্বাভাবিক পচনশীলতা থেকে মুক্ত।

ভাবালুতাহীন শুদ্ধ আবেগ অরুণের কবিতার মূল বস্তু। পদ্মের কোমলতার কেন্দ্রে একটি মণির কাঠিন্য, সেই সন্নিবেশকে প্রকাশ করার যোগ্য সুবিন্যস্ত ধবনিময়তা ও শব্দ নৈপুণ্য তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য। নিঃশ্বাস সংযত করে ধীরে ধীরে পড়তে হয়; ‘নির্জনে বেদনাস্থির স্তব্ধতার আলো-অন্ধকারে কথাগুলো নিয়ে আমি ছুঁড়ে দিই নিস্তরঙ্গ জলে।” যেন এক আশ্চর্য শূন্যতা থেকে আকার লাভ করছে ছন্দ-ও-ধ্বনিময়তার উপাদানে গঠিত শুদ্ধ আবেগের একটি শাব্দিক আধার। কখনো-বা কবি বলেন, ‘সে-কোন নারীকে আমি ভালোবেসে ক্ষয়ে যেতে পারি? কিন্তু পর মুহূর্তেই শুনি, সে নারী কবিতা? কথা? অশরীরী শব্দের ব্যঞ্জনা?’ নারী ও কবিতা একাকার হয়ে যায়।

অরুণের যুক্তিধর্মী মন তাঁকে সুধীন্দ্রনাথের নিকটে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর বিশুদ্ধ আবেগ তাঁকে জীবনানন্দের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর ছন্দোময়তায় বিষ্ণু দের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। বুদ্ধদেবের অন্তরঙ্গদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। অথচ অরুণের রচনার পরিমাণ প্রায় দুঃখজনকভাব অল্প। অতি নিপুণ কিছু গদ্যরচনা বাদ দিলে, ‘দূরের আকাশ’ (১৯৫২) এবং ‘যাও উত্তরের হাওয়া (১৯৬৫) এ-দুটি কবিতার বইই। প্রধান। তিনি ছিলেন প্রধানত কবির কবি। বন্ধুরা অরুশকে ভুলবে না। আর উত্তরকাল যদি তাঁকে বিস্মৃত হয় তবে সেই ক্ষতি বাংলা কবিতার।

সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি (১৯৮৭)

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ গণতন্ত্রের আধ্যাত্মিক ভিত্তি
২. ১.০২ সত্যাসত্য
৩. ১.০৩ গণযুগ ও গণতন্ত্র
৪. ১.০৪ শ্রমিক ও গণতন্ত্র
৫. ১.০৫ সাধারণ নির্বাচন ও গণতন্ত্র
৬. ১.০৬ আটষট্টির সন্ধিক্ষণে
৭. ১.০৭ গণতন্ত্র ও সমাজবিবর্তন
৮. ১.০৮ ব্যক্তি ও গণসমাজ
৯. ১.০৯ সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ
১০. ১.১০ জাতীয় সংহতি
১১. ১.১১ জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে
১২. ১.১২ মাতৃভাষা, ইংরেজী ও হিন্দী
১৩. ১.১৩ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে
১৪. ১.১৪ সীমান্ত চিন্তা
১৫. ১.১৫ বাংলাদেশ দেখে এলাম
১৬. ১.১৬ গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের সংকট
১৭. ১.১৭ চীনের ছাত্র আন্দোলন
১৮. ১.১৮ পূর্ব ইউরোপ মার্ক্সবাদ সাম্যবাদ
১৯. ১.১৯ ঐক্য ও শান্তি
২০. ১.২০ ঐক্য নিয়ে আরো কিছু চিন্তাভাবনা
২১. ২.১ খাদ্য ও কৃষি সমস্যা
২২. ২.২ আমরা দেশ গড়বো কবে?
২৩. ২.৩ শ্লোগান বনাম সত্য
২৪. ২.৪ আর্থিক উন্নতির শর্ত
২৫. ২.৫ কর্মসংস্থান ও আর্থিক পুনর্গঠন
২৬. ২.৬ উন্নয়নের তত্ত্ব ও ভবিষ্যৎ
২৭. ৩.০১ বিজ্ঞান ও প্রগতির পথ
২৮. ৩.০২ স্বজন ও সজ্জন
২৯. ৩.০৩ পঞ্চপ্রীতি
৩০. ৩.০৪ ধর্ম, যুক্তিবাদ ও স্বাধীন সমাজ
৩১. ৩.০৫ সনাতন ও আধুনিক
৩২. ৩.০৬ সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে
৩৩. ৩.০৭ পল্লী ও নগর
৩৪. ৩.০৮ প্রেম ও নিয়ম
৩৫. ৩.০৯ তিন দিগন্ত
৩৬. ৩.১০ যুক্তি ও প্রতিষ্ঠান
৩৭. ৩.১১ আচার বিচার আনন্দ
৩৮. ৩.১২ দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ মঙ্গলবোধ
৩৯. ৩.১৩ সমাজ সংগঠনের পথের সন্ধানে
৪০. ৩.১৪ বাংলার সংকট ও কলকাতা
৪১. ৩.১৫ বাংলার নবজাগরণ ও আজকের সংকট
৪২. ৩.১৬ উনিশশতকী বাংলা নবজাগরণের গৌরব ও অপূর্ণতা
৪৩. ৩.১৭ নারী মুক্তি
৪৪. ৩.১৮ দ্বন্দ্ব
৪৫. ৩.১৯ দ্বন্দ্বের রূপভেদ
৪৬. ৩.২০ মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ
৪৭. ৩.২১ ইতিহাস চিন্তা
৪৮. ৩.২২ ইতিহাস ও দর্শন
৪৯. ৩.২৩ দুর্নীতি
৫০. ৪.১ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার সমস্যা
৫১. ৪.২ শিক্ষা ও ভাষা সমস্যা
৫২. ৪.৩ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ
৫৩. ৪.৪ শিক্ষার সমস্যা – ১
৫৪. ৪.৫ শিক্ষার সমস্যা – ২
৫৫. ৪.৬ শান্তিনিকেতন ও শিক্ষার দ্বন্দ্ব
৫৬. ৫.০১ মার্ক্সের মূল্যায়ন
৫৭. ৫.০২ গান্ধীবাদ কি অচল?
৫৮. ৫.০৩ গান্ধী ও মাও
৫৯. ৫.০৪ গান্ধী ও সংসদীয় গণতন্ত্র
৬০. ৫.০৫ গান্ধী ও ঈশ্বর
৬১. ৫.০৬ গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ
৬২. ৫.০৭ রবীন্দ্রনাথ ও যুক্তিবাদ
৬৩. ৫.০৮ আনন্দের সন্ধানে রাসেল
৬৪. ৫.০৯ রামমোহন রায়
৬৫. ৫.১০ মানবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারা প্রসঙ্গে
৬৬. ৫.১১ মানবেন্দ্রনাথ রায় জাতীয়তাবাদ থেকে মার্ক্সবাদ
৬৭. ৫.১২ মানবেন্দ্রনাথ ও নবমানবতাবাদ
৬৮. ৫.১৩ বিনয় কুমার সরকার : দ্বন্দ্ব ও “শক্তিযোগ”
৬৯. ৫.১৪ ভীমরাও রামজী আম্বেডকর
৭০. ৬.১ কানুদা
৭১. ৬.২ অরুণকুমার সরকার
৭২. ৬.৩ এযুগের বুদ্ধদেব
৭৩. ৭.১ মানুষ! মানুষ!!
৭৪. ৭.২ ধর্ম
৭৫. ৭.৩ ধর্ম ও যুক্তি
৭৬. ৭.৪ শিল্পচিন্তা
৭৭. ৭.৫ উত্তরণের শর্ত
৭৮. ৭.৬ প্রেম ও পূজা
৭৯. ৭.৭ হে মহাজীবন! হে মহামরণ!
৮০. ৮.০১ তৃতীয় চরণ (কমলা বক্তৃতা)
৮১. ৮.০২ বর্তমান সংকটে কর্তব্য
৮২. ৮.০৩ বাংলার সংকট ও সমাধানের পথ
৮৩. ৮.০৪ শান্তিনিকেতন : উপাসনা ও ভাষণ
৮৪. ৮.০৫ মূল বইগুলির ভূমিকা ও পরিশিষ্ট
৮৫. ৮.০৬ ভারতে ও চীনে খাদ্যোৎপাদন
৮৬. ৮.০৭ “সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ”
৮৭. ৮.০৮ “মার্ক্সের মূল্যায়ন”
৮৮. ৮.০৯ “গান্ধীবাদ কি অচল?”
৮৯. ৮.১০ “মানুষ! মানুষ!!”

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন