৫.১৪ ভীমরাও রামজী আম্বেডকর

অম্লান দত্ত

ভীমরাও রামজী আম্বেডকর

‘হিন্দু হয়ে আমি জন্মেছি, হিন্দু হয়ে মরব না।’ এই ছিল বাবাসাহেব আম্বেডকরের সংকল্প। জীবনের শেষ বছরে বহু অনুগামীকে নিয়ে বাবাসাহেব বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। কিন্তু আরো অনেক আগেই হিন্দুধর্ম ত্যাগ করবার সিদ্ধান্ত তিনি ঘোষণা করেছিলেন।

অথচ এই সংকল্পে তিনি সহসা পৌঁছননি। অনুমান করা যায়, তাঁর ভিতর একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল দীর্ঘকাল। ১৯৩০ সালে নাগপুরে এক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন যে, উচ্চবর্ণের মানুষের শত অত্যাচার সত্ত্বেও হিন্দুধর্ম ত্যাগ করবেন না! এরপর কিছুকালের মধ্যেই কিন্তু মত পালটালেন।

হিন্দুধর্মের তিনি কঠোর সমালোচক ছিলেন। কিন্তু হিন্দুত্ব কাকে বলে? আম্বেডকরের নিজের মনেই এ বিষয়ে দুটি ভিন্ন ধারণা পাশাপাশি স্থান পেয়েছিল। অমরাবতীতে ১৯২৭ সালে এক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, হিন্দুত্বের গৌরববৃদ্ধিতে কত মানুষ তাঁদের সাধনার ফল যোগ করে গেছেন, যাঁদের মধ্যে অছেন বশিষ্ঠের মতো ব্রাহ্মণ, কৃষ্ণের মতো ক্ষত্রিয়, হর্ষের মতো বৈশ্য, আবার তুকারামের মতো শূদ্র। এই যে হিন্দুত্ব যা দেয়াল দিয়ে ঘেরা নয়, যা গ্রহিষ্ণু সহিষ্ণু চলিষ্ণু, এর পাশে আবার আছে আরেক হিন্দুসমাজ যেখানে অনুদার ব্রাহ্মণ্যবাদের একাধিপত্য! ধর্ম সেখানে আচারের দেয়ালে ঘেরা আর উচ্চনীচের বিভেদ সেখানে মানবতার অধিকারকে পদে পদে নির্লজ্জভাবে খণ্ডিত করে চলেছে। ‘আমার আত্মসম্মানের সঙ্গে একে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না, এই বলে ব্রাহ্মণ্যবাদে আশ্রিত হিন্দুধর্মকে আম্বেডকর ত্যাগ করেছিলেন। হিন্দুদর্শনে যে সব উচ্চভাবের কথা বলা হয়েছে বাবাসাহেব সেই সবের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সর্বজীবে শিবদর্শন আবার কোটি কোটি মানুষকে অস্পৃশ্যজ্ঞানে দূরে ঠেলে রাখার ভিতর যে আত্মবিরোধ ও নৈতিক শঠতা আছে, ভীমরাও রামজী আম্বেডকরের কাছে সেটা ঘৃণ্য ও অসহ্য মনে হয়েছিল।

রামজী তাঁর পিতার নাম, ভীমরাও-এর জন্ম হয়েছিল মহার পরিবারে, জন্মসূত্রে তিনি অস্পৃশ্য। বিদ্যালয়ে তাঁকে সংস্কৃত পাঠ করতে দেওয়া হয়নি, কারণ নীচকুলে জন্ম, শাস্ত্রপাঠে তাঁর অধিকার নেই। অথচ ভীমরাও আম্বেডকরের স্বাভাবিক জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল অসাধারণ। সৌভাগ্যের কথা বরোদার মহারাজার আনুকূল্য তিনি লাভ করেছিলেন, যার ফলে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে পেরেছিলেন। সেখানে অর্থনীতি রাষ্ট্রদর্শন সমাজবিজ্ঞান-সহ বহু বিদ্যায় তিনি কৃতিত্ব অর্জন করেন। অল্পবয়সেই ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন কলম্বিয়া ও লন্ডন দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তা ছাড়া লন্ডনে তিনি আইন অধ্যয়ন করেন।

এত বিদ্যা সত্ত্বেও অস্পৃশ্যতার কালিমা তাঁর ঘুচল না। দেশে, ফিরবার পর বরোদা রাজ্যে সামরিক সচিবের পথে তিনি নির্বাচিত হন মহারাজার উদার নীতির ফলে। কিন্তু দেশীয় সমাজ তাঁকে গ্রহণ করল কই? বরোদায় পৌঁছবার পর কোনো হোটেলেই তাঁকে থাকবার স্থান দেওয়া হল না, কারণ তিনি নীচজাতের মানুষ। সীডেনহাম কলেজে অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদে তিনি নিযুক্ত হলেন। কিন্তু কলেজেরই কিছু অধ্যাপক আপত্তি তুললেন; অধ্যাপকদের জন্য যে জলের পাত্র নির্দিষ্ট ছিল তা থেকে আম্বেডকর জল নিতে পারবেন না, কারণ তাঁর স্পর্শে পাত্র অপবিত্র হবে। বোম্বাই নগরে উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানে যদি ধর্মীয় আচারের নামে মনুষ্যত্বের অবমাননা এতদূর যেতে পারে তবে দেশের অন্যত্র কী আশা করা যায়?

যে অবিচার ও অপমান আবাল্য ব্যঙ্গ করছিল বাবাসাহেবকে, তিনি জানতেন যে তাঁর দেশবাসী অগণিত দুভাগা মানুষকে ততোধিক সহ্য করতে হয় অহরহ। তিনি আরো জানতেন যে এই নির্যাতন, এই বিবেকহীনতা, দেশময় চলছে শাস্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের আশ্রয়েই। উচ্চবর্ণের ভিতর মুষ্টিমেয় মানুষ একে অন্যায় বলে মানে, অধিকাংশের আচরণে আছে এর প্রতি নিঃশব্দ সমর্থন। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেশীয় সমাজে সমর্থন পায় না, বরং প্রতিবাদকে মনে করা হয় ধৃষ্টতা, যার দণ্ডবিধানে সমাজ মুহূর্তে হিংস্র হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে সেই হিংস্রতার পরিচয় পেয়েছিলেন আম্বেডকর বারবার।

পূর্ববর্তী হিন্দু সমাজসংস্কারকদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্ণের মানুষ। এঁদের অনেকেই স্মরণীয় ও বরণীয়। এঁরা প্রতিবাদ করেছেন সতীদাহের বিরুদ্ধে, সমর্থন করেছেন বিধবাবিবাহ, আন্দোলন করেছেন স্ত্রীশিক্ষার জন্য। এঁদের সঙ্গে আম্বেডকরের। পার্থক্য আছে। উদাহরণ হিসেবে বিধবাবিবাহের কথা ধরা যাক। আম্বেডকরের মনে হয়েছে, এইসব সংস্কারের আধার পরিবার। হিন্দুসমাজসংগঠনের মূলে আছে যে জাতিভেদপ্রথা তার ওপর সরাসরি আঘাত আসছে না এই রকম সংস্কারে। ঐখানে আঘাত হানতে চেয়েছিলেন আম্বেডকর। প্রকৃত অর্থে তাঁর পূর্বসূরী নন রামমোহন বা রানডে তাঁর পূর্বসূরী মহাত্মা ফুলে।

রামমোহন ঠিকই জাতিভেদপ্রথার সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্মকাণ্ডে সেটা প্রাধান্য পায়নি, বরং এ ব্যাপারে তাঁর মধ্যে যেন খানিকটা দুর্বলতাই ধরা পড়ে জাতিভেদ ভাঙবার জন্য নিম্নবর্ণের মানুষকে নিয়ে কোনো আন্দোলন তিনি গড়ে তোলেন না। পরবর্তী যুগের উচ্চবর্ণের নেতারাও ঐ পথে বড় অগ্রসর হননি। এইখানে আম্বেডকরের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নিম্নবর্ণের মানুষের মুক্তি সম্ভব সংগঠিত আত্মশক্তির ভিতর দিয়ে। উচ্চবর্ণের মানুষের কাছ থেকে দয়া অথবা দান হিসেবে নিম্নবর্ণের মুক্তি আসবে না।

সাম্যবাদী যেমন বিশ্বাস করেন যে, শ্রমিকশ্রেণীর শৃঙ্খল ভাঙবার জন্য ধনিকের দয়ার ওপর নির্ভর করা ভুল, জাতীয়তাবাদী নেতারা যেমন ক্রমে এই সিদ্ধান্তেই আসনে যে বিদেশী শাসকদের কাছ থেকে ভিক্ষা করে স্বাধীনতা লাভ করা যাবে না, জনগণের। সংঘবদ্ধ শক্তি এজন্য আবশ্যক, সেই ভাবেই বাবাসাহেব আম্বেডকরও অস্পৃশ্য মানুষের মুক্তির জন্য স্বাবলম্বী ও সংগ্রামী আন্দোলনের প্রয়োজনে বিশ্বাসী ছিলেন। যেহেতু জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল প্রধানত উচ্চবর্ণের নেতাদের হাতে, অতএব “বহিষ্কৃত”দের জন্য তিনি স্বতন্ত্র নেতৃত্ব ও স্বতন্ত্র সংগঠন চেয়েছিলেন। এইখানেই জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে ছিল তাঁর মূল পার্থক্য।

একটা জায়গায় অবশ্য তুলনাটা ঠিক খাটে না। বিপ্লবী সাম্যবাদীর লক্ষ্য ধনিকশ্রেণীর বিনাশ। সংগ্রামী জাতীয়তাবাদীরা চেয়েছিলেন দেশ থেকে বিদেশী শাসকদের বিতাড়ন। নিম্নবর্ণের লক্ষ্য উচ্চবর্ণের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়া। তবু এটাও একটা সংগ্রাম। যেহেতু উচ্চবর্ণের হাতেই ছিল ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকার অতএব ভাগ করা। মানেই, অন্তত কিছু পরিমাণে, ক্ষমতা ত্যাগ করা। আম্বেডকর দাবি করেছিলেন অস্পৃশ্যদের জন্য দেশের আইনসভায় সংরক্ষিত আসন। এটাও যথেষ্ট নয়। আইনের প্রণয়নেই নয়, প্রয়োগেও অবিচার থাকে। দেশের যাঁরা প্রশাসক তাঁরা যদি সবাই। উচ্চবর্ণের মানুষ হন তবে আইন ভালোমন্দ যাই হোক না কেন, কার্যত আইনের প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব থেকে যায়। কাজেই প্রশাসনেও অস্পৃশ্যদের অংশগ্রহণের বিশেষ ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। এইসবের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আম্বেডকর চেয়েছিলেন। জাতিবিশেষের জন্য বিশেষ সুবিধা নয়, বরং সকলের জন্য সমান অধিকারটাই লক্ষ্য। তবে ঘোরতর অসাম্য থেকে সাম্যের দিকে অগ্রসর হতে চাইলে প্রথম পর্যায়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য বিশেষ সুযোগসুবিধা দরকার হয়ে পড়ে।

আইনের গুরুত্ব তিনি মানতেন। তবু একথাটাও তিনি জানতেন যে, শুধু আইনের জোরে মানুষে মানুষে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সে জন্য প্রয়োজন আরো কিছু। ১৯৪৩ সালে রানডের স্মৃতিসভায় এক বিখ্যাত ভাষণে আম্বেডকর বলেছিলেন, মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হয় না আইনের জোরে, সেজন্য চাই সমাজে অন্য এক শক্তি, জাগ্রত বিবেক, সংগঠিত নীতিবোধ। হিন্দুসমাজে এরই পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন চাতুর্বর্ণের যুক্তিনির্ভর মৌল সমালোচনা।

এই সমালোচনার কয়েকটি প্রধান কথা এবারে তুলে ধরা যাক।

গীতায় বলা হয়েছে, গুণ ও কর্মের বিভাগের দ্বারা ভগবান চাতুর্বর্ণ সৃষ্টি করেছেন। এই তত্ত্বের সঙ্গে কিন্তু বাস্তব অবস্থান মিল নেই। হিন্দুসমাজে ব্যক্তির বর্ণ ও জাতি নির্ধারিত হয়ে চলেছে জন্মের দ্বারা, গুণের দ্বারা নয়। ব্রাহ্মণকুলে যার জন্ম সে ব্রাহ্মণ, শূদ্রের ছেলে শুদ্র। জন্মসূত্রেই আম্বেডকর বিদ্যালয়ে সংস্কৃতপাঠের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, গুণগত যোগ্যতার তো তাঁর অভাব ছিল না। আজকের চাতুর্বর্ণ ব্যক্তির গুণগত। যোগ্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কোনোকালে অন্য অবস্থা ছিল কি না তা নিয়ে নানা কথা সম্ভব। কিন্তু চাতুর্বর্ণের সমালোচক আক্রমণ করছেন আজকের বাস্তব ব্যবস্থাকে। গীতায়। উক্ত তত্ত্বের সঙ্গে এই বাস্তবের সম্পর্ক নেই। প্রচলিত জাতিভেদপ্রথার কোনো তাত্ত্বিক সমর্থন যুক্তিসঙ্গত নয়।

এরপর আসে দ্বিতীয় কথা। বর্ণভেদ যদি গুণ ও কর্মের বিভাগের ওপরই কঠোরভাবে প্রতিষ্ঠিত হত তাতে কি সেটা সমর্থনযোগ্য হত? আম্বেডকর বলছেন, তা হলেও সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। কিছু মানুষ আবদ্ধ থাকবে কায়িক শ্রমে, তাদের জ্ঞানচর্চার অধিকার থাকবে না; কিছু মানুষ থাকবে জ্ঞানচর্চা নিয়ে, তাদের কায়িক শ্রম করতে হবে না; গুণ ও কর্মের এইরকম বিভাগ ভালো নয়। বৌদ্ধিক ও কায়িক শ্রমের ভিতর বিচ্ছিন্নতাকে গান্ধী অথবা টলস্টয় সুব্যবস্থা মনে করেননি, মনে করবার যথেষ্ট কারণও নেই। সামরিক কলাকৌশল প্রয়োগ করবার অধিকার ক্ষত্রিয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এটাও সমর্থনযোগ্য নয়। আম্বেডকর চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে তথাকথিত অস্পৃশ্যদের বিশেষভাবে স্থান হোক, জাতিধর্মনির্বিশেষে সব মানুষের জন্যই সেই সুযোগ ও অধিকার থাকুক। বৈশ্য শুধু বাণিজ্য নিয়ে থাকবে, বিদ্যার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিষ্প্রয়োজন, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর ভিতর এমন স্থায়ী বিরোধ দেশের প্রগতির সহায়ক নয়। একথা ব্যাখ্যা করে বলাটাও আজ বাহুল্য। গুণ ও কর্মের বিভাগ কিছুদূর পর্যন্ত স্বাভাবিক ও সঙ্গত, কিন্তু এই বিভাগের যে আতিশয্য বর্ণভেদ ও জাতিভেদে প্রশ্রয় পায় সেটা সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের পক্ষে অতিশয় হানিকর। GITIO

জাতিভেদ ব্যবস্থার আরো এক কুফল এই যে এতে করে দেশের ভিতর বৃহত্তর ঐক্যের ধারণা স্ফুর্তি পায় না, জাতপাতের চিন্তাটাই প্রধান হয়ে ওঠে। দেশের সামনে যখন এমন কোনো বিপদ দেখা দেয় যেটার বিরুদ্ধে কোনো বর্ণবিশেষের একক চেষ্টাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন হয় বর্ণনির্বিশেষে সমবেত প্রয়াস, তখন ঐ ভেদবুদ্ধি সর্বনাশ ডেকে আনে। এই কথাটার ওপরও আম্বেডকর জোর দিয়েছিলেন। বর্ণভেদ ও জাতীয় সংহতির মধ্যে একটা বিরোধ আছে। আর এই বিরোধটা শুধু রাষ্ট্রীয় স্তরে দেখা দেয় এমন নয়, গ্রামে গ্রামে এটা ছড়িয়ে আছে এবং চোখের সামনে গৃহযুদ্ধের বীজ বপন করে চলেছে।

জাতিভেদে মানবতার একটা অপমান শাস্ত্রীয় সমর্থন পায়, দৈনন্দিন অভ্যাসের সেটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চনীচ ভেদ সব সমাজেই আছে। কিন্তু হিন্দুর জাতিভেদ শুচিতা সম্বন্ধে সামাজিক ধারণাকে যে সূক্ষ্ম অংন্ধ সর্বব্যাপী কুসংস্কার করে তুলেছে অন্য কোনো ধর্মে তার তুলনা পাওয়া কঠিন। বর্ণহিন্দুর রন্ধনশালায় কুকুর ঢুকলে খাদ্যবস্তু কিছুই অপবিত্র হয় না, অশ্য মানুষ ঢুকলে সবই অপবিত্র হয়। অস্পৃশ্যের ছায়া পর্যন্ত অপবিত্র। এটা যে মনুষ্যত্বের অতি বড় অপমান একথা সনাতনপন্থী হিন্দুসমাজ স্বীকার করে না, যেমন না কি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বিভেদমূলক আচরণে বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গর কোনো অপরাধ দেখে না।

গত চল্লিশ বছরে অস্পৃশ্যতার প্রকোপ কিছুটা কমেছে। কিন্তু নিম্নবর্ণের হিন্দুর প্রতি উচ্চবর্ণের একটা গভীর অবজ্ঞা থেকেই গেছে। সব মানুষকে জাতিধর্মনির্বিশেষে সমান মনে করবার অভ্যাস আমাদের সমাজে নেই, সংবিধানে সমানাধিকারের স্বীকৃতি সত্ত্বেও। মন্দিরে অন্ত্যজদের প্রবেশের অধিকার নেই, এ নিয়ে আমরা লজ্জিত নই। এই অধিকারভেদ আমাদের বিব্রত করে না। পশ্চিমবঙ্গের বর্ণহিন্দুরাও এ ব্যাপারে নির্বিকার। আমাদের ভিতর এমন কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, জাতিভেদ ভারতের অন্যত্র আছে, পশ্চিমবঙ্গে উঠে গেছে। কিন্তু এটাই কি ঘটনা? নিম্নবর্ণের মানুষকে কি আমরা আপন। জন বলে ভাবি?

সংবিধানে বলা হয়েছিল, দশ বছরের ভিতর নিরক্ষরতা দূর করা হবে। চল্লিশ বছর কেটে গেল, নিরক্ষরতা দূর হল না। অথচ উচ্চশিক্ষার অভূতপূর্ব প্রসার ঘটেছে, উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েরা বৃহৎ সংখ্যায় দেশের সীমানা পার হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশ মানুষই উচ্চবর্ণ। উচ্চবর্ণের ছেলেমেয়েরাই প্রধানত কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। অনেক সমস্যা আছে সেখানেও, ডিগ্রী লাভের পর বেরোজগারির বিপদ। তবু একটা কথা অস্বীকার করা যায় না। এদেশের সরকার উচ্চশিক্ষার বিস্তারের দিকে যতটা মনোযোগ দিয়েছে, নিরক্ষরতা দূর করবার কাজে ততটা নয়। চীনের তুলনায় আমরা উচ্চশিক্ষার প্রসারে পিছিয়ে নেই, কিন্তু সাক্ষরতার ক্ষেত্রে অনেকখানি পিছিয়ে আছি। আসলে এদেশে পিছিয়ে-পড়া মানুষদের প্রতি একটা গভীর অবহেলা দীর্ঘকাল ধরে সমাজের চেতনায় প্রোথিত। এরই ফলে নীচুজাতের মানুষের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণের অভিযান কখনো প্রবল হয়ে উঠতে পারেনি। অনুসূচিত জাতিসমূহের ভিতর নিরক্ষরতার প্রাদুর্ভাব কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও এতদিন ধরে থেকেই গেছে। আম্বেডকর যে জাগ্রত বিবেকের কথা বলেছিলেন তা যদি পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যেত তবে এটা ঘটত না। এরাজ্যে অন্ত্যজদের আমরা ততটা হিংসা করি না যতটা অবজ্ঞা করি। রাজনীতির কারণে ওদের আমরা সাধ্য অনুযায়ী ব্যবহার করেছি কিন্তু পূর্ণ মনুষ্যত্বের মর্যাদা দিইনি।

যদি সেই মর্যাদা দেওয়া হত তবে আম্বেডকরের কয়েকটি ____ সহজেই মেনে নেওয়া যেত। সনাতনপন্থা হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণই পুজোপার্বণে পৌরোহিত্য করবার অধিকারী। এই অসাম্য কেন? সকলেরই শাস্ত্রপাঠ ও অধ্যয়নের সুযোগ থাকবে, শাস্ত্রে কার কতটা অধিকার জন্মেছে সেটা পরীক্ষা করে দেখা হবে, যাঁরা সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ তাঁরাই পৌরোহিত্য করবার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন, এটাই তো যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব। এই প্রস্তাবে যাদের আন্তরিক সায় নেই তারা আসলে জাতিভেদের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। অধিকারের যে সাম্য আম্বেডকর চেয়েছিলেন সেটাই ন্যায়সঙ্গত। বিবাহের প্রশ্নেও একই বিচারধারা গ্রাহ্য হওয়া উচিত। মানুষের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক প্রীতিভাবের বিস্তার জাতপাতের সীমানা দিয়ে খণ্ডিত হওয়া দুঃখজনক। যে ধর্ম এই অনুদারতাকে সমর্থন করে তার সঙ্গে মানবধর্মের বিরোধ আছে। বিবাহযোগ্যতার বিচারে জাতপাতের সীমা যত লঙঘন করা যাবে ততই সামাজিক সাম্য ও ঐক্য বিস্তার লাভ করবে।

বিবাহ ও পৌরোহিত্যের অধিকার সম্বন্ধে এই প্রত্যয়গুলি অধিকাংশ বাঙ্গালী কি মেনে নিতে পেরেছে? যদি না পেরে থাকে তবে জাতপাতের প্রভাব থেকে বঙ্গের হিন্দুসমাজ মুক্ত একথা বলা যাবে না। আসলে জাতিভেদ সারা ভারতের সমস্যা, পশ্চিমবঙ্গ এখনও মুক্তাঞ্চল হয়ে ওঠেনি।

অস্পৃশ্য ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আর্থিক উন্নতির বিষয় নিয়ে আম্বেডকর আলোচনা করেছিলেন। এখানে দুটি জিনিসের ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে হবে। এক, শিক্ষা; দ্বিতীয়, জমির পুনর্বণ্টন, অর্থাৎ ক্ষেতমজুর ও দরিদ্রতম চাষীদের ভিতর উদ্বৃত্ত জমির বণ্টন। ক্ষেতমজুরদের অধিকাংশই নিম্নবর্ণের মানুষ। দেশের জনতার এরা এক বৃহৎ অংশ। এজন্য বাবাসাহেব জমির পুনর্বণ্টনের কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন। সরকারী চাকরিতে বা প্রশাসনে সংরক্ষিত পদের জন্য দাবি মূলত রাজনীতিক দাবি। রাজনীতিক বলেই সেটা অগ্রাহ্য এমন নয়। তবে তার চেয়ে আরো মৌল প্রয়োজন হল দলিতদের জন্য শিক্ষার বিশেষ সুযোগসুবিধা। গ্রামে গ্রামে সবচেয়ে পিছিয়ে-পড়া জাতের ভিতর থেকে প্রতিশ্রুতিময় ছেলেমেয়েদের খুঁজে বের করতে হবে, তাদের জন্য প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চতর শিক্ষার স্তর পর্যন্ত বিশেষ সহায়তার সবরকমের ব্যবস্থা করতে হবে। অনুসূচিত জাতির ভিতরও অবশ্য কিছু সমৃদ্ধ পরিবার আছে, বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থার ভিতর তাদের স্থান দেওয়া প্রয়োজন নয়। পারিবারিক আয়ের দিক থেকে যারা দরিদ্র আবার সামাজিক অবস্থানের বিচারেও যারা সবার নীচে তাদের এই দ্বিবিধ প্রতিকূলতার সমষ্টিগত বাধাটাকে ভাঙবার জন্যই শিক্ষার ক্ষেত্রে সজাগ নীতি সবচেয়ে প্রয়োজন।

আম্বেডকরের জীবন এ ব্যাপারে আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। তাঁর বিরাট সাফল্যের মূলে ছিল একদিকে বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও-এর সহৃদয় বিবেকবান সহায়তা, অন্যদিকে বাবাসাহেবের নিজস্ব মেধা ও আত্মোন্নতির জন্য নিরলস উদ্যোগ ও অনুশীলন। আজকের নিম্নবর্ণের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্যও একদিকে যেমন সমাজের পক্ষ থেকে বিশেষ ও ব্যাপক সহায়তার প্রয়োজন আছে, অন্যদিকে তেমনি তাদের নিজস্ব উদ্যোগ ও অনুশীলনও সমানভাবে আবশ্যক। তা যদি না হয় তবে নিম্নবর্ণের অসংখ্য মানুষের ভিতর থেকে কেবল বিশেষ সুবিধাভোগী ছোটো একটি গোষ্ঠী তৈরি হবে। আর সংরক্ষণ-আশ্রিত এই গোষ্ঠীর ভিতর যদি বাবাসাহেবের জীবন থেকে প্রাপ্ত স্বাবলম্বন ও অক্লান্ত অনুশীলনের প্রেরণা কার্যকরী না হয় তবে তার ফলে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর ভিতর দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষ যতটা বাড়বে সমাজের সামগ্রিক উপকার ততটা হবে না। মনে রাখতে হবে যে, স্বাবলম্বন ও সামগ্রিক উন্নতিই ছিল আম্বেডকরের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে রাজনীতির দ্বন্দ্বটাকেই প্রধান করে তুললে ভুল করা হবে।

আম্বেডকর ও গান্ধীর ভিতর বিরোধ তৎকালীন ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অথচ এই দুই বিরাট পুরুষের ভিতর কোথাও একটা গভীর মিল ছিল যেটা ঢাকা পড়ে যায় খণ্ড খণ্ড বিরোধের কোলাহলে। গান্ধীজীকে ভবিষ্যতের মানুষ মনে রাখবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধের প্রবক্তা ও নায়ক হিসেবে। আম্বেডকর অহিংসাকে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করেননি, যেমন করেননি জবাহরলাল নেহরু এবং আরো অনেকে। কিন্তু অহিংসার প্রতি যে তাঁর একটা প্রবল আকর্ষণ ছিল সেটা কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। যে সব গণআন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যেমন ১৯২৭ সালে মহাড়ের আন্দোলন, তার ইতিহাস থেকেই সেটা সুস্পষ্ট। মহাড়ের আন্দোলন যখন উত্তেজনার তুঙ্গে তখন উচ্চবর্ণের পক্ষ থেকে কিছু উদ্ধত মানুষ আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করে ও দৈহিকভাবে আঘাত করে। আন্দোলনকারী মহারদের প্রতিআক্রমণের শক্তি ছিল, অনেকের সামরিক শিক্ষাও ছিল। শুধুমাত্র আম্বেডকরের দৃঢ় নিযেধের ফলেই হিংসার বদলে সেদিন হিংসার প্রয়োগ ঘটেনি। তাঁর ভাষা মসৃণ ছিল না, কিন্তু হৃদয়ে ওদাৰ্য ছিল।

হিংসার পথে যে বাবাসাহেব আস্থাস্থাপন করেননি তার একটা মূল কারণ আছে। হিংসার দ্বারা ভয় সৃষ্টি করা যায়, হিংসা দিয়ে হিংসা জাগানো যায়, কিন্তু মানুষের বিবেককে জাগ্রত করা যায় না। আম্বেডকর বিশ্বাস করতেন, চেতনার গভীরতর পরিবর্তন ছাড়া সমাজের মুক্তি সম্ভব নয়। এখানে উল্লেখযোগ্য, এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি রুশবিপ্লবেরও স্মরণীয় সমালোচনা করে গিয়েছিলেন। হিংসাত্মক বিপ্লবের ফলে শুধু ক্ষমতার হস্তান্তর হয়, হৃদয়ের পরিবর্তন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কাঠমাণ্ডুতে বুদ্ধজয়ন্তী। উপলক্ষে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ক্যুনিস্ট ব্যবস্থা হিংসার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ঐ ব্যবস্থার ব্যর্থতার চিহ্ন পরিষ্কার হয়ে উঠছে। ধরুন কাল যদি ঐ দেশে ডিক্টেটরশিপের পতন ঘটে তারপর কী হবে? আমি তো দেখতে পাচ্ছি, তারপর ওদের নিজেদের ভিতর আবারও মারামারি শুরু হয়ে যাবে।’ আম্বেডকরের এই ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর মৃত্যুর পঁয়ত্রিশ বছর পর গভীর অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন বলেই মনে হয়। চেতনার যে পরিবর্তনের ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন সেটা যে হিংসার পথে ঘটে না, রুশ দেশেও ঘটেনি, একথা তিনি পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলেন।

আম্বেডকর যদিও হিন্দুধর্ম ও চাতুর্বর্ণের কঠোর ও অক্লান্ত সমালোচক ছিলেন তবু ধর্মের প্রয়োজন তিনি অস্বীকার করেননি। হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেও তিনি তাঁর অনুগামীদের। নিয়ে আশ্রয়গ্রহণ করেন অন্য এক ধর্মে, বৌদ্ধধর্মে। প্রশ্ন ওঠে, ধর্মকে কেন তাঁর আবশ্যক মনে হয়েছিল। ধর্ম মানুষকে এমন কী দিতে পারে যা সামান্য যুক্তি থেকে লাভ করা কঠিন? আম্বেডকর নানা সময়ে এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলেছেন। অতি সংক্ষেপে দুয়েকটি কথা ব্যাখ্যা করে বলা যাক।

মানুষ শুধু স্বার্থের গণনা থেকে পরম্পর আবদ্ধ থাকে না, আরো গভীর কোনো বন্ধন সমাজকে ধরে রাখে। ধর্ম মানুষকে দেয় সেই সংঘবদ্ধতার শক্তি, যাকে হারালে সমাজ ভেঙ্গে পড়ে। ধর্ম মানুষকে আরো দিতে পারে এক অদম্য আশা। যুক্তির কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে বিশেষ উদ্যোগে সাফল্য ও ব্যর্থতার সম্ভাবনা সম্বন্ধে কিছু হিসেব। কিন্তু উৎসাহ নিয়ে বাঁচবার জন্য, কোনো মহৎ উদ্যোগে আত্মনিয়োগের জন্য, দরকার হয় অন্য এক প্রেরণা, বেহিসেবী আত্মত্যাগ, মৃত্যুঞ্জয়ী আশা, ধর্ম থেকে যা লাভ করা যায়। বৌদ্ধধর্মে আম্বেডকর বিশেষভাবে দেখেছিলেন, প্রজ্ঞা, সমতা ও করুণার সমন্বয়, যেটা তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সেই প্রজ্ঞায় যুক্তি নির্ভর আশ্রয় পায়; সেই সময় আম্বেডকর দেখেছিলেন জাতিভেদবিরোধী তাঁর সমস্তপ্রয়াসের প্রকৃষ্ট সমর্থন; সেই করুণায় তিনি দেখেছিলেন মানুষের শুদ্ধতম বিবেকের অব্যর্থ ভিত্তি।

বাবাসাহেব আম্বেডকরকে অবশ্য আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করব ধর্মের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়। তিনি নিজে একবার বলেছিলেন, ইতিহাসের মঞ্চে কিছু মহাপুরুষ অবতীর্ণ হন ঝাড়ুদারের ভূমিকায়, সমাজে ভূপীকৃত আবর্জনা সাফ করবার কাজে তাঁরা নিযুক্ত হন। ঐরকম একটা ভূমিকাই ভীমরাও বেছে নিয়েছিলেন। হিন্দু ঐতিহ্যের যে দিকটা মানবতার সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়েছে, পরিণত হয়েছে অসাম্যদুষ্ট কুসংস্কারগ্রস্ত বুদ্ধিহীনতায়, তারই বিরুদ্ধে এক বদ্ধসংকল্প সংগ্রামী সমালোচক হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে এদেশের নেতারা যখন ভারতীয় ঐতিহ্যের গৌরব প্রচারে আগ্রহী আর বিদেশী সাম্রাজ্যবাদকে ভারতের সমস্ত দুভাগ্যের মূল কারণ বলে শনাক্ত করতে ব্যস্ত, তখন আম্বেডকরে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে অন্য এক সুর। বাইরের। শক্তির ওপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া ভুল, তাতে ভিতরের অন্যায় ও মূঢ়তা প্রশ্রয় পায়। সেই মূঢ়তা আজও সদর্পে চলছে। আম্বেডকর বললেন আমাদের দুর্বলতা ও দুর্দশার প্রধান কারণ আছে আমাদের ভিতরে, এদেশের সমাজ ও মননের সংকীর্ণতায়, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের অন্যায়ে, অন্ত্যজের অধিকারহীনতায়, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিচারহীন অসাম্যপীড়িত ঔদ্ধত্যে।

এইসব কথা সেদিন এদেশের অনেক মানুষের পছন্দ হয়নি। আবার কিছু মানুষ তাঁর বিদ্রোহের ভঙ্গী দেখেই আকৃষ্ট হয়েছে, তাঁর চিন্তাকে গভীরভাবে বুঝবার চেষ্টা করেনি। আজও তাঁর জন্মশতবার্ষিকীর বছরে দেখি এদেশের মানুষের একাংশ তাঁর প্রতি অনাগ্রহী, নিতান্ত সৌজন্যের বশে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে দূরে ঠেলে রাখতে অভ্যস্ত। অন্য কিছু মানুষ তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বাসময়, সেই উচ্ছ্বাসে কোনো বৌদ্ধিক প্রজ্ঞা নেই। অথচ ভীমরাও রামজী আম্বেডকর যে প্রশ্নটা তুলে ধরেছিলেন সেটা মৌল প্রশ্ন, উপেক্ষায় অথবা উচ্ছ্বাসে তার প্রতি কিছুতেই সুবিচার হয় না।

মনুস্মৃতিকে যিনি একদিন অগ্নিতে সমর্পণ করেছিলেন তিনিই বিশ বছর পরে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করলেন। সকল ভারতীয়ের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা সেই সংবিধানে ঘোষিত হল। তবু ভীমরাও আম্বেডকর জানতেন যে, তাঁর জীবনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হতে আরো অনেক দেরি। সংবিধান রচনার কাজ যখন সমাপ্ত তখন তিনি বললেন, ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে ভারতের নাগরিকেরা গণতান্ত্রিক অধিকার লাভ করবে, কিন্তু সামাজিক ও আর্থিক অসাম্যের সঙ্গে আমাদের গণতান্ত্রিক বিধানের একটা অন্তর্বিরোধ থেকেই যাবে। এই বিরোধ যদি দ্রুত দূর করা না যায় তবে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। শান্তিপূর্ণ পথে, তবু দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে, মনুষ্যত্বের জয়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবার মন্ত্র তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। বিভক্ত ভারত নয়, তিনি কামনা করেছিলেন ঐক্যবদ্ধ ভারত, আর সেই ঐক্যকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন মানুষের সমান অধিকারের ভিত্তিতে।

জীবৎকালে যে-সব বিবাদ ও বিতর্কে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন সেইসব পার হয়ে আজ তাঁর জীবনের স্বপ্নই বড় হয়ে দেখা দেয়। স্বাধীনতা সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণী ছিল। তাঁর কাছে প্রিয়, এই তিনের সমন্বয় তাঁর সমস্ত চিন্তা ও কর্মের শেষ লক্ষ্য। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সামাজিক সাম্যের জন্য অসমাপ্ত সংগ্রামে জন্মসূত্রে অস্পৃশ্য বাবাসাহেব আম্বেডকর এক নমস্য মানব।

দেশ, ১৮ মে ১৯৯১

.

উল্লেখপঞ্জী

১। শ্রীমতী মীরা চৌধুরীর খাতায় স্বাক্ষর করে গান্ধী লিখেছিলেন “Never make a promise in hastc. Having once made it fulfil it at the cost of your life.”

২। এই উদ্ধৃতিটি ও পরবর্তী অধিকাংশ উদ্ধৃতি রাসেলের আত্মজীবনীর দ্বিতীয় ভল্যুম থেকে গৃহীত।

৩। সিলেক্টেড ওয়ার্কস অফ এম. এন. রায়, ভল্যুম ওয়ান (১৯১৭-২২) (সং) শিবনারায়ণ রায়, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লী।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ গণতন্ত্রের আধ্যাত্মিক ভিত্তি
২. ১.০২ সত্যাসত্য
৩. ১.০৩ গণযুগ ও গণতন্ত্র
৪. ১.০৪ শ্রমিক ও গণতন্ত্র
৫. ১.০৫ সাধারণ নির্বাচন ও গণতন্ত্র
৬. ১.০৬ আটষট্টির সন্ধিক্ষণে
৭. ১.০৭ গণতন্ত্র ও সমাজবিবর্তন
৮. ১.০৮ ব্যক্তি ও গণসমাজ
৯. ১.০৯ সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ
১০. ১.১০ জাতীয় সংহতি
১১. ১.১১ জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে
১২. ১.১২ মাতৃভাষা, ইংরেজী ও হিন্দী
১৩. ১.১৩ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে
১৪. ১.১৪ সীমান্ত চিন্তা
১৫. ১.১৫ বাংলাদেশ দেখে এলাম
১৬. ১.১৬ গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের সংকট
১৭. ১.১৭ চীনের ছাত্র আন্দোলন
১৮. ১.১৮ পূর্ব ইউরোপ মার্ক্সবাদ সাম্যবাদ
১৯. ১.১৯ ঐক্য ও শান্তি
২০. ১.২০ ঐক্য নিয়ে আরো কিছু চিন্তাভাবনা
২১. ২.১ খাদ্য ও কৃষি সমস্যা
২২. ২.২ আমরা দেশ গড়বো কবে?
২৩. ২.৩ শ্লোগান বনাম সত্য
২৪. ২.৪ আর্থিক উন্নতির শর্ত
২৫. ২.৫ কর্মসংস্থান ও আর্থিক পুনর্গঠন
২৬. ২.৬ উন্নয়নের তত্ত্ব ও ভবিষ্যৎ
২৭. ৩.০১ বিজ্ঞান ও প্রগতির পথ
২৮. ৩.০২ স্বজন ও সজ্জন
২৯. ৩.০৩ পঞ্চপ্রীতি
৩০. ৩.০৪ ধর্ম, যুক্তিবাদ ও স্বাধীন সমাজ
৩১. ৩.০৫ সনাতন ও আধুনিক
৩২. ৩.০৬ সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে
৩৩. ৩.০৭ পল্লী ও নগর
৩৪. ৩.০৮ প্রেম ও নিয়ম
৩৫. ৩.০৯ তিন দিগন্ত
৩৬. ৩.১০ যুক্তি ও প্রতিষ্ঠান
৩৭. ৩.১১ আচার বিচার আনন্দ
৩৮. ৩.১২ দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ মঙ্গলবোধ
৩৯. ৩.১৩ সমাজ সংগঠনের পথের সন্ধানে
৪০. ৩.১৪ বাংলার সংকট ও কলকাতা
৪১. ৩.১৫ বাংলার নবজাগরণ ও আজকের সংকট
৪২. ৩.১৬ উনিশশতকী বাংলা নবজাগরণের গৌরব ও অপূর্ণতা
৪৩. ৩.১৭ নারী মুক্তি
৪৪. ৩.১৮ দ্বন্দ্ব
৪৫. ৩.১৯ দ্বন্দ্বের রূপভেদ
৪৬. ৩.২০ মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ
৪৭. ৩.২১ ইতিহাস চিন্তা
৪৮. ৩.২২ ইতিহাস ও দর্শন
৪৯. ৩.২৩ দুর্নীতি
৫০. ৪.১ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার সমস্যা
৫১. ৪.২ শিক্ষা ও ভাষা সমস্যা
৫২. ৪.৩ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ
৫৩. ৪.৪ শিক্ষার সমস্যা – ১
৫৪. ৪.৫ শিক্ষার সমস্যা – ২
৫৫. ৪.৬ শান্তিনিকেতন ও শিক্ষার দ্বন্দ্ব
৫৬. ৫.০১ মার্ক্সের মূল্যায়ন
৫৭. ৫.০২ গান্ধীবাদ কি অচল?
৫৮. ৫.০৩ গান্ধী ও মাও
৫৯. ৫.০৪ গান্ধী ও সংসদীয় গণতন্ত্র
৬০. ৫.০৫ গান্ধী ও ঈশ্বর
৬১. ৫.০৬ গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ
৬২. ৫.০৭ রবীন্দ্রনাথ ও যুক্তিবাদ
৬৩. ৫.০৮ আনন্দের সন্ধানে রাসেল
৬৪. ৫.০৯ রামমোহন রায়
৬৫. ৫.১০ মানবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারা প্রসঙ্গে
৬৬. ৫.১১ মানবেন্দ্রনাথ রায় জাতীয়তাবাদ থেকে মার্ক্সবাদ
৬৭. ৫.১২ মানবেন্দ্রনাথ ও নবমানবতাবাদ
৬৮. ৫.১৩ বিনয় কুমার সরকার : দ্বন্দ্ব ও “শক্তিযোগ”
৬৯. ৫.১৪ ভীমরাও রামজী আম্বেডকর
৭০. ৬.১ কানুদা
৭১. ৬.২ অরুণকুমার সরকার
৭২. ৬.৩ এযুগের বুদ্ধদেব
৭৩. ৭.১ মানুষ! মানুষ!!
৭৪. ৭.২ ধর্ম
৭৫. ৭.৩ ধর্ম ও যুক্তি
৭৬. ৭.৪ শিল্পচিন্তা
৭৭. ৭.৫ উত্তরণের শর্ত
৭৮. ৭.৬ প্রেম ও পূজা
৭৯. ৭.৭ হে মহাজীবন! হে মহামরণ!
৮০. ৮.০১ তৃতীয় চরণ (কমলা বক্তৃতা)
৮১. ৮.০২ বর্তমান সংকটে কর্তব্য
৮২. ৮.০৩ বাংলার সংকট ও সমাধানের পথ
৮৩. ৮.০৪ শান্তিনিকেতন : উপাসনা ও ভাষণ
৮৪. ৮.০৫ মূল বইগুলির ভূমিকা ও পরিশিষ্ট
৮৫. ৮.০৬ ভারতে ও চীনে খাদ্যোৎপাদন
৮৬. ৮.০৭ “সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ”
৮৭. ৮.০৮ “মার্ক্সের মূল্যায়ন”
৮৮. ৮.০৯ “গান্ধীবাদ কি অচল?”
৮৯. ৮.১০ “মানুষ! মানুষ!!”

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন