১.১৬ গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের সংকট

অম্লান দত্ত

গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের সংকট

কম্যুনিস্ট দুনিয়া আজ একটা বড় রকমের ওলটপালটের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। বিপর্যয়ের চেহারা একেক দেশে একেক রকম। ১৯৮৯ সালের মে-জুন মাসের চিত্রটা মনে করা যাক। পোল্যান্ডের নির্বাচনের ফলাফলে কম্যুনিস্ট দলের শঙ্কিত বোধ করবার যথেষ্ট কারণ দেখা দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ওদেশের পার্লামেন্টে এখনও অধিকাংশ আসন কম্যুনিস্ট দলের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু যে ক’টি আসনে কম্যুনিস্ট প্রার্থীর সঙ্গে বিরোধী ‘সলিডারিটি’র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ ছিল তার ভিতর শতকরা নলুইভাগেরও বেশি। আসনে ‘সলিডারিটি’ জয়ী হয়েছে। চীনের ছাত্রআন্দোলন কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও জনতার ভিতর অভূতপূর্ব সমর্থন লাভ করেছে। অন্য কোনোভাবে আন্দোলনকে দমাতে না পেরে চীন সরকার সৈন্য ডেকে রক্তাক্ত ছাত্রনিধনযজ্ঞ সম্পন্ন করেছে। সোভিয়েত দেশে গর্বাচভের নেতৃত্বের গুণে ঐরকম কোনো অমানুষিক কাণ্ড এখনও ঘটেনি। ওখানে বাকস্বাধীনতা প্রসারিত হয়েছে। বহুবছর পর এই প্রথম ওদেশের পালামেন্টে বেসরকারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল। দক্ষিণ ও বামপন্থীদের মাঝামাঝি পথে গর্বাচভকে সাবধানে চলতে হচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

ঘটনার এই বৈচিত্র্যের ভিতরও একটা জায়গায় মিল চোখে পড়ে। সবদেশেই গণতন্ত্রের সপক্ষে মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ঐ একটি দাবি কম্যুনিস্ট দুনিয়ায় রক্ষণশীল নেতা ও শাসকদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছে। গণতন্ত্রের দাবির ভিতর রক্ষণশীল শাসকদল পশ্চিমী সংস্কৃতির প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন। বিষয়টি আরো একটু গভীরভাবে ভেবে দেখবার নিশ্চয়ই সময় এসেছে।

পশ্চিমী প্রভাব ক্যুনিস্ট দেশগুলিতে ক্রমেই বেশি করে এসে পৌচচ্ছে, এ কথাটা অস্বীকার করা যাবে না। তৃতীয় বিশ্বেও একই ব্যাপার ঘটছে। তবে আপাতত আমাদের আলোচনার বিষয় কম্যুনিস্ট দুনিয়া। পশ্চিমের সঙ্গে কম্যুনিস্ট দেশের যোগাযোগ বেড়ে চলেছে। ব্যাপারটা অনিচ্ছায় ঘটছে এমনও নয়। কম্যুনিস্ট দেশগুলি স্বেচ্ছায় যোগাযোগ বাড়িয়েছে। পশ্চিমী প্রযুক্তি তারা আগ্রহ করে চাইছে। মানুষ ও মালপত্রের যাতায়াত বাড়ছে। কয়েক বছরের ভিতর সংবাদবহনের আশ্চর্য উন্নতি ঘটেছে। টেলিভিশনের গুণে একদেশের ঘটনা ও জীবনযাত্রা অবিলম্বে ছবি হয়ে অন্যদেশের দর্শকদের সামনে পৌঁছে যাচ্ছে। এ-সব আজ ঠেকানো মুশকিল।

চীনের সাম্প্রতিক ছাত্রআন্দোলন নিয়ে যাঁরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা এর পিছনে পশ্চিমী প্রভাব দেখছেন। এখন প্রশ্নটা এই। তবে কি এইরকমের “অশান্তি” ঠেকাবার জন্য পশ্চিমের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে হবে? সেটা কি আজ সম্ভব? প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এমন একটা অবস্থায় কি আমরা পৌঁছে যাইনি যে নতুন করে দেয়াল তুলে পৃথিবীটাকে আর স্থায়ীভাবে খণ্ড খণ্ড করা যাবে না? আরো একটা প্রশ্ন আছে। চীনে কম্যুনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চল্লিশ বছর আগে। সোভিয়েত দেশে তত সত্তর বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। এই সময়ে সমগ্র জনতাকে ও বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে মার্ক্সবাদে, সরকারী মতবাদে, দীক্ষিত করবার চেষ্টা চলেছে অবিরত, সর্বউপায়ে। তবু কেন ছাত্রছাত্রীদের ভিতর “পশ্চিমী” প্রভাব এত দ্রুত, এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে? কম্যুনিস্ট মতবাদে দীক্ষাদানের প্রয়াস কেন ব্যর্থ হয়? পশ্চিমী প্রভাবের দোষত্রুটি অস্বীকার না করেও প্রশ্ন থেকে যায়, আন্দোলন বন্দুক দিয়ে দমন করেই কি শেষ পর্যন্ত ঐ প্রভাব আটকানো যাবে? এতে কি অনিবার্য পরিবর্তনকে অযথা আরো হিংসাত্মক করে তোলা হবে না?

প্রতিটি দেশের সমস্যা ও ঘটনাবলির পিছনে থাকে কিছুটা সেই দেশের বিশেষ পরিস্থিতির ঘাতপ্রতিঘাত আর কিছু যুগের সামান্য ধর্ম বা সাধারণ গতির প্রভাব। যেমন ধরা যাক চীনের সাম্প্রতিক ঘটনাচক্র। এর পিছনে উঁকিঝুঁকি মারে একটা ক্ষমতার লড়াই, যার একদিকে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী লি পেং আর অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক চাও জিয়াং। চাও ভরসা রেখেছিলেন ছাত্রআন্দোলনের ওপর; লি পেং নির্ভর করলেন সেনাবাহিনীর ওপর। প্রবীণ নেতা তেং শিয়াওপিং এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াং শাংকুন ছাত্রআন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, ফলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে চাও জিয়াং পরাজিত হলেন। সেনাবাহিনীর ভিতর বিভেদ ছিল। তবে তেং শিয়াওপিং কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান, তাঁর কর্তৃত্ব কার্যকর হল। এইসব চীনের বিশেষ পরিস্থিতির কথা, চীনবিশেষজ্ঞদের কাছে এইরকম নানা তথ্য পাওয়া যাবে।

এইসব অনুপুঙ্খ যত আকর্ষক হোক না কেন, যুগের বৃহত্তর পটভূমিকার সঙ্গে যুক্ত না করে তাদের তাৎপর্য সম্পূর্ণ বোঝা যাবে না। সেই পটভূমিকা সম্বন্ধে কয়েকটি কথা এবার বলা যাক। সাময়িক ঘটনার গতি মাঝেমাঝেই চমকপ্রদ মোড় নেয়, কিন্তু মানুষের। ইতিহাসের প্রশস্ত ধারায় দিক পরিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে।

.

(২)

এ যুগের আর্থিক ও সামাজিক পটভূমিকার একটা প্রধান অঙ্গ হল শিল্পায়ন, অর্থাৎ বৃহৎ শিল্প ও তৎসংক্রান্ত প্রযুক্তির অভুত্থান ও প্রসার। কৃষিতেও এসে পড়ে শিল্পবাণিজ্যের প্রভাব। গ্রামপ্রধান সমাজ ক্রমে হয়ে ওঠে শিল্পপ্রধান।

শিল্পায়নের ধারার সঙ্গে সঙ্গে চেতনারও পরিবর্তন ঘটে। এ্টা কোনো সরল প্রক্রিয়ায় হয়ে ওঠে না, পদে পদে দেখা দেয় বিরোধ ও আত্মখণ্ডন। পিছন ফিরে তাকিয়ে প্রক্রিয়াটা মোটামুটি বুঝে নেওয়া আজ আর তেমন কঠিন নয়। একদিকে চেতনার ভিতর বিভিন্ন উপাদানের সংঘাত দেখা যায়, অন্যদিকে মানুষের এই নতুন মনের সঙ্গে বিরোধ ঘটে প্রতিষ্ঠিত সমাজসংগঠনের। এই থেকে উদ্ভব হয় সংকটের।

শিল্পায়নের যুগে রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা জাতীয়তাবাদের শক্তিবৃদ্ধি। এ দুয়ের ভিতর যোগাযোগ আছে।

সেই যোগাযোগটা নানা দিক থেকে বোঝা যায়। শিল্পবাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বিচ্ছিন্ন বাজারকে ছাড়িয়ে বেড়ে উঠল দেশব্যাপী পরস্পর সংযুক্ত বৃহৎ বাজার। আর বিভিন্ন দেশের ভিতর বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা জোরালো হতে লাগল। আধুনিক জাতীয়তাবাদের আর্থিক বনিয়াদ এইভাবে তৈরি হল।

এরপর আসে সাংস্কৃতিক বনিয়াদের কথা। এ নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করব শুধু একটি মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের প্রতি। শিল্পের প্রসার ও নাগরিক সংস্কৃতির প্রাধান্যের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো পারিবারিক বন্ধনে ভাঙ্গন দেখা দিল। পল্লীসমাজে গোড়ার কথা পরিবার, নগরে স্বতন্ত্র ব্যক্তি। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের সৃজনশীল সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। আবার এর অন্যতম ফল বিচ্ছিন্নতাবোধ। অনেকের কাছে এটা। ক্লান্তিকর, রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের সংহতি ও উত্তেজনা আকর্ষণীয়। সেই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি মানুষকে দেয় অন্য এক ক্ষমতার স্বাদ। সার্বিক রাষ্ট্রের ভিত্তি ক্রমে প্রস্তুত হয়। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অস্ত্রশক্তি লাভ করে প্রচণ্ড রাজনীতিক গুরুত্ব। আধুনিক জাতীয়তাবাদে এইসব মিলেমিশে যায়, সামূহিক ঐক্যবোধ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

আধুনিক শিল্পের অভ্যুত্থানের সঙ্গে যোগ আছে শুধু জাতীয়তাবাদের নয়, শ্ৰেণীদ্বন্দ্বের তত্ত্বও এইখান থেকেই পুষ্ট হয়েছে। একদিকে ধনিকশ্রেণী প্রবল হয়ে উঠেছে মূলধনের শক্তিতে। অন্যদিকে বৃহৎ শিল্পের আশ্রয়েই শ্রমিকশ্রেণী এমন একটা সংহতি ও সাংগঠনিক শক্তি লাভ করেছে যার সঙ্গে অতীতের কোনো তুলনা হয় না। এইখানেই পাওয়া যাচ্ছে শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বের বাস্তব ভিত্তি।

কোনো একসময় মার্ক্সবাদের সঙ্গে জঙ্গী জাতীয়তাবাদের বিবাদ ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় শ্রমিকশ্রেণীকে জাতীয়তাবাদের প্রভাবমুক্ত করতে চেয়েছিলেন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী নেতারা। তারপর অবস্থা দ্রুত পালটে গেছে। মার্ক্সবাদ যেসব দেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেসব দেশে জাতীয়তাবাদ উল্লেখযোগ্য ভাবেই উপস্থিত। উদাহরণত বলা যায় যে, কম্যুনিস্ট চীন জঙ্গী জাতীয়তাবাদের প্রভাবমুক্ত নয়। আবার চীন সরকার সোভিয়েত দেশকে একদিন সোশ্যাল ইমপিরিয়ালিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী বলে গাল দিয়েছে। অর্থাৎ, চীনের দৃষ্টিতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতিকে জঙ্গী জাতীয়তাবাদের দোষে পুষ্ট বলে মনে হয়েছে।

জাতীয়তাবাদের মতোই শ্রমিকশ্রেণীর তত্ত্বেও ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টি বড় হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বটা জাতির নামেই হোক আর শ্রেণীর নামেই হোক, ব্যাপারটা এই রকমই ঘটে। দুই বিরোধী শ্রেণী অথবা গোষ্ঠীর ভিতর যুদ্ধং দেহি ভাব জেগে উঠলে সমষ্টিগত সংহতিটাই মহত্ত্ব পায়। ধনতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সম্পর্কটা এতকাল অনিবার্য দ্বন্দ্বের সম্পর্ক বলেই ধরা হয়েছে। সেই দ্বন্দ্ব শুধু চিন্তার ক্ষেত্রে আবদ্ধ নয়, বরং যে-কোনো সময়ে সেটা সশস্ত্র যুদ্ধের আকার ধারণ করতে পারে এইরকমই মনে করা হয়েছে। এই রণচণ্ডী অবস্থায় জঙ্গীজাতীয়তাবাদের মতোই মার্ক্সীয় শ্রেণীতত্ত্ব ও অহসহিষ্ণুতাকে স্বধর্ম করে তুলেছে। গণতন্ত্রের পক্ষে এটা কোনোমতেই সহায়ক ___ না।  

অর্থাৎ, আধুনিক জাতীয়তাবাদ ও মার্ক্সবাদী শ্ৰেণীতত্ত্ব উভয়েই শিল্পবিপ্লবের সন্তান। আর দুয়েতেই পাওয়া যাবে একদিকে ‘প্রগতি’র সহায়ক শক্তি, অন্যদিকে সামূহিক উত্তেজনার উপাদান। শিল্পায়নের মধ্যেই আবার এমন কিছু প্রবণতা আছে যাতে যূথবদ্ধ অসহিষ্ণুতা দুর্বল হয়ে আসে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হয়। এইসব প্রবণতাও দোষমুক্ত নয়। বরং ভালোমন্দ মেশানো। সংক্ষেপে এদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক।

শিল্পায়নের আগের যুগে একটা অনড় কর্মবিভাগ বৃহত্তর সমাজে প্রচলিত ছিল। ভারতীয় সমাজে বর্ণভেদরূপে যেটা অত্যন্ত প্রকট, অন্যান্য দেশেও সেটা নিতান্ত অনুপস্থিত নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, প্রাচীন সমাজে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও শিক্ষাদানের কাজটা ব্রাহ্মণ অথবা পুরোহিতবর্গের মধ্যেই প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল। বিভিন্ন বর্গের ভিতর উচ্চনীচবিভেদ স্পষ্ট ছিল। পশ্চিমী সমাজেও একদিন এই বর্গভেদ প্রচলিত ছিল। দীর্ঘ ঐতিহ্যের প্রভাবে সমাজ মেনে নিয়েছিল যে, মানুষের ভিতর অধিকার ও যোগ্যতার একটা স্বাভাবিক ভেদ ও অসাম্য আছে।

শিল্পায়নের ফলে এই স্বাভাবিক অসাম্যের তত্ত্ব একটা বড় রকমের নাড়া খেল। ধনীদরিদ্রের প্রভেদ দূর হল না, তবু একটা বড় পরিবর্তন এসে গেল। শাস্ত্রের গুহ্যজ্ঞান নয়, যন্ত্রবিদ্যা ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের মর্যাদার বৃদ্ধি হল। এর পরিণাম সুদূরপ্রসারী। বর্গভেদের দেয়ালগুলি সুরক্ষিত রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠল। যন্ত্রবিদ্যা ও বিজ্ঞানচর্চার অধিকার কোনো বর্গবিশেষে আবদ্ধ রইল না। এমন উদাহরণ ক্রমেই বাড়তে লাগল যেখানে সাধারণ মানুষ সমাজের একস্তর থেকে যাত্রা শুরু করে ধাপে ধাপে উচ্চতর স্তরে এসে পৌচেছে। এইভাবে মানুষের অনির্দিষ্ট সম্ভাবনার স্বীকৃতি এবং ঐহিক জীবনে সব মানুষের সমান অধিকারের তত্ত্ব যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল।

একই সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে শিল্পায়ত সমাজের অন্য এক বৈশিষ্ট্য। কোনো এককালে সমাজে প্রাধান্য ছিল আচারের। নতুন সমাজে জোর পড়ল পরীক্ষানিরীক্ষা আর। প্রয়োগের ওপর, প্রয়োজনীয় বিদ্যা ও কৌশলের ওপর। বৈজ্ঞানিক জানেন যে, বিশ্বজগতে যা কিছু ঘটে সবই পরস্পর সম্পৃক্ত। বৈজ্ঞানিকের চরম অভীপ্সা বিশ্বব্যাপী সমস্ত ঘটনাকেই সামান্য সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা। এইরকম কোনো পরম তত্ত্ব শেষ অবধি লভ্য কি না সে-বিষয়ে অবশ্য সন্দেহ আছে। প্রয়োগ জিনিসটার ক্ষেত্র ও উদ্দেশ্য সীমাবদ্ধ। শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যে মানসিকতা প্রবল ও প্রধান হয়ে ওঠে তাকে নাম দেওয়া যেতে পারে কার্যসিদ্ধিবাদ বা উপযোগবাদ। বিশ্বদৃষ্টির জন্য তৃষ্ণা সেটা নয়। অপরিপক্ক অথবা কল্পিত বিশ্বদৃষ্টি মানুষকে একরকম ধমোন্মাদ করে তুলতে পারে। আধুনিক মন এ বিষয়ে সতর্ক। যাতে বাস্তব প্রয়োজন মেটে সেটাই জরুরী।

শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আরো যেটা বৃদ্ধি পায় সেটা হল ভোগবাদ। ধর্ম ও মতাদর্শ নিয়ে উন্মাদনা যখন কমে তখন ভোগবাদের দিকে ঝোঁক বাড়া তেমন আশ্চর্য নয়। আধুনিক প্রযুক্তি ভোগের উপকরণ বাড়িয়ে তুলেছে। প্রযুক্তিরই গুণে আবার একদেশের ভোগের আয়োজন অন্যদেশের দৃষ্টির সামনে সহজে পৌঁছে যাচ্ছে। এইসবের একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে। যুদ্ধের সময় দেশের স্বার্থে ভোগ্যবস্তুর ওপর নানারকম নিয়ন্ত্রণ সবাই মেনে নেয় সহজে। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর সেইসব নিয়ন্ত্রণ বেশিদিন লোকে মানতে চায় না। প্রশাসনেও যখন দুর্নীতি বড় আকারে চোখে পড়ে তখন বিশেষ কোনো মতাদর্শের নামে সংযমের বিধানকে অনেকের কাছেই আর গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। মোট কথা, আধুনিক প্রযুক্তি ভোগের উপকরণকে আকর্ষণীয় করে তোলে। কার্যসিদ্ধিবাদের প্রভাবে সেই আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আধুনিক শিল্পপ্রধান সমাজের এই অভিজ্ঞতা।

এই যে সংস্কৃতি, যাতে মানুষের সমান অধিকারের দাবি, প্রয়োগবাদী দৃষ্টি আর ভোগবাদের প্রবণতা মিলেমিশে আছে, আর আধুনিক শিল্পায়নের সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, এ থেকে মানুষ শেষ অবধি শান্তি পাবে এমন নয়। এ পথে সমস্যার অন্ত নেই। কিন্তু এর ভিতর দিয়ে কিছুদূর গিয়ে তবেই একে অতিক্রম করা যাবে। অতিক্রমণের চিহ্ন ধীরে। ধীরে এরই ভিতর দেখা যাচ্ছে। সেই বিষয়ে আমাদের সচেতন হওয়া চাই। সাবধানতা। প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে এ পথে হিংসা নয়, নবরচনার কাজটাই প্রধান। শিল্পাশ্রিত সমাজের “পশ্চিমী” সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করে তাকে অতিক্রম করতে গেলে পূর্ববর্তী যুগের। অসহিষ্ণুতা ও তামসিকতায় প্রত্যাবর্তনের বিপদ আছে। দিকে দিকে বীভৎস “মৌলবাদ” সেই বিপদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক করছে।

.

(৩)

সাম্যবাদী দেশগুলির সংকটজনক পরিস্থিতির দিকে এইবার দৃষ্টিপাত করা যাক।

সোভিয়েত দেশে কম্যুনিস্ট দল শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণীর নামে ক্ষমতা দখল করেছিল। উৎপাদনের প্রধান প্রধান উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সেখানে। প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজের কর্তৃত্ব, এইরকম ছিল লক্ষ্য। সাম্যবাদের এই আদর্শ বহু মানুষকে সেদিন অনুপ্রাণিত করেছিল।

অচিরেই সেদেশে প্রতিষ্ঠিত হল রাষ্ট্রের মালিকানা, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর সুরক্ষিত কম্যুনিস্ট দলের কর্তৃত্ব। দ্রুত গড়ে উঠল এক অতিকেন্দ্রিক অর্থনীতি। মূলত সেটা এক জঙ্গী। অর্থনীতি, যার প্রধান লক্ষ্য দেশকে সাময়িকভাবে শক্তিশালী করে তোলা। স্তালিনের নেতৃত্বের প্রধান কৃতিত্ব এই; ইউরোপ এশিয়া জুড়ে বিশাল পশ্চাৎপদ দেশে সাম্যবাদী এক সামরিক অর্থনীতি মাথা তুলে দাঁড়াল। তাঁর অন্যান্য সুকৃতি ও অপকীর্তি নিয়ে বিতর্ক চলবে, কিন্তু স্তালিনের মহামান্যতার প্রধান স্তম্ভ ঐ জঙ্গী অর্থনীতি।

স্তালিনভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, স্তালিনের নেতৃত্ব ও নীতির গুণেই রুশদেশকে হিটলারী সেনাবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করা গেছে। এই যুক্তি দাঁড়ায় না। যেমন পরাক্রান্ত মার্কিন সেনাবাহিনী ভিয়েতনাম জয় করে নিতে পারেনি, যেমন সোভিয়েত সেনাবাহিনী বিপুল রণসম্ভার সত্ত্বেও আফগানিস্তান থেকে হটে আসতে বাধ্য হয়েছে, তেমনি জামান সেনাবাহিনীর পক্ষেও কোনোক্রমেই রুশদেশ অধিকার করে নেওয়া সম্ভব ছিল না। সোভিয়েত দেশের বিশাল আয়তন আর সোভিয়েত জনগণের দেশপ্রেমিক প্রতিরোধের জনাই সেটা অসম্ভব ছিল। এজন্য স্তালিনমহত্ত্বের দ্বারস্থ হওয়া ভুল। এরকম ব্যক্তিপুজোর সঙ্গে মার্ক্সবাদের সামঞ্জস্য নেই।

এইসব বিতর্কের বাইরে থেকে স্তালিনী জঙ্গী অর্থনীতির কিছু পরিণাম স্পষ্টভাবে লক্ষ করা সম্ভব। এ যাবৎ পরিকল্পিত অর্থনীতিতে কেন্দ্রের প্রাধান্য দেখা গেছে। সামরিক পরিবেশে যখন পরিকল্পনা রূপলাভ করে তখন এই অতিকেন্দ্রীয় ঝোঁক আরো প্রবল হয়ে ওঠে। এই ব্যাপারটা অনেকদিন ধরে চললে আমলাতন্ত্রের শক্তি অত্যধিক বেড়ে যায়। সোভিয়েত ব্যবস্থায় তাই ঘটেছে। উৎপাদনের যন্ত্রের ওপর সামাজিক কর্তৃত্বের নামে আসলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একদলীয় শাসকগোষ্ঠীর ও আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা। জঙ্গী অর্থনীতির অন্য এক পরিণাম এই যে, ভারিশিল্প ক্রমাগত অগ্রাধিকার পেয়ে গেছে, ভোগ্যবস্তুর উৎপাদন অবহেলিত থেকেছে। গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নতির ক্ষেত্রেও যুদ্ধের প্রয়োজন বিপুলভাবে সমর্থন পেয়েছে। যুদ্ধের অস্ত্রে তাই সোভিয়েত দেশ পশ্চিমী অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে নেই। কিন্তু ভোগ্যবস্তুর মান অনুন্নত থেকে গেছে।

একদলীয় অতিকেন্দ্রিক আমলাতান্ত্রিক এই সাম্যবাদী শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে মার্ক্সীয় মতাদর্শ। মার্ক্স কখনো বলেছিলেন, সবকিছুকে সংশয়ের চোখে দেখা চাই। কিন্তু রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট মার্ক্সবাদ ভিন্ন জিনিস। ইসলামি রাষ্ট্রে যেমন ইসলামের সমালোচনা অবৈধ, সাম্যবাদী দেশগুলিতে তেমনি মার্ক্সবাদ সমালোচনার উর্ধ্বে। শুধু তাই নয়, শাসকদল ও দলের নেতাও এতকাল ঐরকমই একটা স্থান অধিকার। করেছিলেন। স্তালিনের যুগে তাঁকে সমালোচনা করাটা ছিল মহা অপরাধ। এখনও লেনিনের স্থান সমালোচনার ঊর্ধ্বে। “দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি। সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?” এ এক শ্বাসরোধকারী অবস্থা যেখানে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ সম্বন্ধে সমস্ত সংশয়ের উচ্চারণই কার্যত নিষিদ্ধ।

অল্পস্বল্প অদলবদলসহ অন্যান্য সাম্যবাদী দেশগুলিতেও একই অবস্থা। শিল্পায়নের পথে সোভিয়েত দেশের তুলনায় চীন পিছিয়ে আছে। তেং শিয়াও পিং চান আধুনিকীকরণ, শিল্প ও প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ এবং সেই উদ্দেশ্যে পশ্চিমী জগতের সঙ্গে সহযোগিতা। কিন্তু দলীয় একাধিপত্যের প্রশ্নে তিনি কঠোরভাবে রক্ষণশীল। দলীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছাত্রআন্দোলন তাঁর কাছে অসহ্য। তাঁর বিচারে পেরেস্ত্রইকার প্রয়োজন আছে, কিন্তু গ্লাসনস্ত সম্বন্ধে তিনি সাবধান। আসলে গর্বাচভ এ দুয়ের সম্পর্ক যেভাবে বুঝেছেন চীনের বৃদ্ধ নেতার কাছে সেটা অগ্রাহ্য। মার্ক্সবাদকে তেং ব্যবহার করছেন পশ্চিমী প্রযুক্তির সপক্ষে, পশ্চিমী সংস্কৃতির বিপক্ষে। ইতিমধ্যে চীনদেশে বেকারি, মূল্যস্ফীতি আর প্রশাসনে দুর্নীতি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাম্যবাদী দুনিয়ায় এই অবস্থার ভিতর থেকেই উঠে আসছে আজকের প্রতিবাদী আন্দোলন ও পরিবর্তনের জন্য ক্রমবর্ধমান দাবি। এইসব দাবি অনেকটাই সরল ও সহজবোধ্য। মানুষ আর চাইছে না যুদ্ধের পরিমণ্ডল ও বাধ্যতার ভিতর বাস করতে, চাইছে শান্তির পরিবেশ। চাইছে আরো স্বচ্ছন্দ জীবন, পরিমাণে বেশি ও গুণগত মানে আরো উৎকৃষ্ট ভোগ্যবস্তু। চাইছে বাকস্বাধীনতা, নির্ভয়ে সমালোচনা করবার অধিকার। চাইছে না আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব, দলের কর্তাদের স্বজনপোষণ। এইসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে এদের গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন।

মার্ক্সবাদীর প্রশ্ন, এরা কারা? অর্থাৎ, কোন শ্রেণীভুক্ত? মার্ক্সবাদীর প্রত্যয়, সব ঐতিহাসিক দাবি ও আন্দোলনের পিছনেই থাকে শ্ৰেণীদ্বন্দ্ব; অতএব প্রশ্ন, সাম্যবাদী সমাজে আজ নতুন দাবি নিয়ে এগিয়ে আসছে কারা? উত্তরে এইটুকুই বলা যায়, এইসব দাবির সঙ্গে বাস্তব অবস্থার যোগ আছে, সাধারণ মানুষেরই দাবি এইসব। আন্দোলনের চেহারা বিভিন্ন সাম্যবাদী দেশে বিভিন্ন, আন্দোলনের পুরোভাগে বিভিন্ন স্থানে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন রকমের মানুষ। পোল্যান্ডে বিরোধী শ্রমিকসংগঠন, ‘সলিডারিটি’, প্রতিবাদ আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় চীনে ছাত্রসংগঠন। সলিডারিটি সাধারণ মানুষের দাবিকেই ভাষা দিয়েছে, সাম্প্রতিক নির্বাচনে তাদের বিপুল জয়লাভের ভিতর দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়েছে। চীনে ছাত্রআন্দোলনের প্রতি শহরে শহরে অগণিত মানুষের সমর্থন ছিল উল্লেখযোগ্য। সোভিয়েতদেশে পরিবর্তনের দাবি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন স্বয়ং গর্বাচভ, তাঁর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করছে যে এইসব দাবির সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনের যোগ আছে। প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক সংগ্রামকেই সুনির্দিষ্ট শ্রেণীসংগ্রামের রূপ নিতে হবে এই প্রত্যাশা মান্য নয়। এরপরও অনিবার্যভাবে প্রশ্ন ওঠে, দাবি যদি সাধারণ মানুষেরই তবে বাধা দিচ্ছে কারা? এর একটা সহজ উত্তর আছে। বাধা দিচ্ছে তারাই যারা পুরনো ব্যবস্থায় সুবিধাভোগী। একদলীয় ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসকদলের, আমলাতন্ত্রের ও সেনাবাহিনীর অনেকেই সুবিধাভোগী। তাছাড়া যারা একটা বিশেষ সমাজব্যবস্থা ও মতবাদে বহুকাল অবধি অভ্যস্ত তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যবস্থাকে মনের ভিতর গ্রহণ করা কঠিন হয়। যেমন স্বার্থের বশে তেমনি মনের গঠনেও কিছু লোক রক্ষণশীল। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার নিশ্চয়তাকে ত্যাগ করে অনিশ্চিত অবস্থার দিকে পা বাড়াতে সবাই চায় না। পরিবর্তন প্রয়োজন হলেও সেটা প্রায়ই কষ্টসাধ্য হয়।

সাম্যবাদী ব্যবস্থার ভিতর সংকট জমে উঠছে। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেই পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত একদলীয় শাসনের কাঠামোর ভিতর আবদ্ধ থাকবে এমন বলা যায় না। সেই পরিবর্তন কোনো বিশেষ মতাদর্শের সীমারেখাকে মান্য করে চলবে এমনও মনে হয় না। কেউ হয়তো বলবেন, মার্ক্সবাদ তো যুক্তি ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, তবে তাকে অতিক্রম করবার কথা ওঠে কেন? প্রশ্নটা ঐভাবে তোলা ঠিক নয়। মানুষের ধ্যানধারণার সীমা যে-কোনো বিশেষ মতবাদের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই অধিক প্রশস্ত। যেমন ধরা যাক আবারও পোল্যান্ডের কথা। সেখানে কিছু লোক মার্ক্সীয় তত্ত্বে বিশ্বাসী, নিরীশ্বরবাদী। আবার অনেক মানুষ খ্রীষ্টান, অর্থাৎ, ঈশ্বরে বিশ্বাসী। একই সমাজে এই দু’রকমের বিশ্বাসীরই স্থান হওয়া প্রয়োজন, যদিও একটি মতাদর্শের পরিধির ভিতর ঈশ্বরে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের একই সঙ্গে স্থান হওয়া কঠিন। কার্যত সাম্যবাদী সমাজ এই অবস্থাটাকে মেনে নিচ্ছে। তবে মার্ক্সবাদই সেখানে রাষ্ট্রের নিজস্ব মতাদর্শ বলে স্বীকৃত। নতুন প্রজন্ম কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষপাতপুষ্ট ঐ মতাদর্শে ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারাচ্ছে। পুরনো মার্ক্সবাদীদের দৃষ্টিতে এটা এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি, যেমন পুরনো ধর্মবিশ্বাসীদের চোখে নতুন প্রজন্মের সংশয়বাদী মনোভাব বিপজ্জনক। জুনের ছাত্রহত্যার পর চীনের নেতারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, মার্ক্সবাদী শিক্ষাকে আরো জোরালো করা দরকার। এর ফলে কিন্তু ছাত্রদের মনে মার্ক্সবাদী প্রচার সম্বন্ধে বিতৃষ্ণা বেড়ে যাবার আশংকা আছে। ছাত্রদের আন্দোলন ছিল মূলত অহিংস। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রনিযুক্ত হিংসার এই প্রয়োগ কি মার্ক্সবাদের নামেই সমর্থনযোগ্য?

আজ থেকে বছর ষাটেক আগে যখন ধনতন্ত্রের ভিতর আর্থিক সংকট ভয়ংকর হয়ে দেখা দেয় তখন প্রশ্ন উঠেছিল, ধনতান্ত্রিক সমাজ কি শান্তিপূর্ণ পথে আবশ্যক পরিবর্তন ঘটতে দেবে? না কি আত্মরক্ষার জন্য সে সামরিক নিপীড়নের বর্বর ফাশিশু উপায় বেছে নেবে? চীনের সাম্প্রতিক ছাত্রনিধনপর্বের পর একই প্রশ্ন ফিরে আসছে নতুন ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে। সাম্যবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন কি সংঘটিত হবে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথে? চীনের ছাত্রেরা সেনাবাহিনীর আক্রমণে সাম্যবাদের ফাশিস্ত চেহারাই দেখেছে এবং মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই মর্মে ধিক্কার উচ্চারণ করেছে।

মার্ক্স বলেছিলেন, উৎপাদনের জন্য বিশেষ যুগের বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত যেসব সম্পর্ক স্থাপিত হয়, প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে নতুন উৎপাদিকা শক্তির যখন বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে তখনই বুঝতে হবে যে, সংকট সমাগত আর বৈপ্লবিন্ধু পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত। এইরকমই একটা বিরোধ সাম্যবাদী সমাজের ভিতর আজ আকার গ্রহণ করেছে। পুরনো আর্থিক কাঠামোর ভিতর বিবর্তিত হয়ে উঠেছে নতুন বাস্তব পরিস্থিতি এবং নতুন চেতনা। শুধু উচ্চতর প্রযুক্তি নয়, চেতনার গতিকেও নতুন উৎপাদিকা শক্তি বলে চিনে নিতে হবে। এর সঙ্গে পুরনো রাষ্ট্রতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সামঞ্জস্য আজ ভেঙে পড়েছে। বন্দুকের নল দিয়ে এই ভাঙ্গন আর জোড়া দেওয়া যাবে না।

অতএব বাকি পৃথিবীর মতোই সাম্যবাদী দুনিয়াও এসে দাঁড়িয়েছে এক যুগান্তকারী সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের মুখে। মনে হয় তার গতি হবে কেন্দ্রীয়তা থেকে বিকেন্দ্রীকরণের অভিমুখে, বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ও দলীয় শাসন থেকে ছোটো ছোটো মানবগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের দিকে, সমাজসংগঠনে একান্ত মতাদর্শের প্রচণ্ডতা থেকে অনেকান্ত দৃষ্টিভঙ্গীর মান্যতায়, হিংসা থেকে অহিংসায়। এইসব পরিবর্তনের সঠিক রূপরেখা আমরা জানি না। কিন্তু মানুষের প্রতি যাঁদের সদিচ্ছা অটুট তাঁরা চাইবেন যে, পরিবর্তনের পথ নির্ধারিত হোক গণতান্ত্রিক উপায়ে, সভ্যতার কিছু মৌল মূল্যবোধের প্রতি আস্থা রক্ষা করে। অনেকে বলছেন, সমাজতান্ত্রিক জগৎ আজ ফিরে যাচ্ছে ধনতন্ত্রের পথে। এভাবে বললে পুরনো বিবাদটাকেই দীঘায়ু করা হয়। আসলে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বলতে আমরা এতদিন যা বুঝেছি বা দেখে অভ্যস্ত হয়েছি, মানুষের সভ্যতা আজ সেই দুই ব্যবস্থাকেই অতিক্রম করে যেতে চলেছে।

দেশ, ২২ জুন ১৯৮৯

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ গণতন্ত্রের আধ্যাত্মিক ভিত্তি
২. ১.০২ সত্যাসত্য
৩. ১.০৩ গণযুগ ও গণতন্ত্র
৪. ১.০৪ শ্রমিক ও গণতন্ত্র
৫. ১.০৫ সাধারণ নির্বাচন ও গণতন্ত্র
৬. ১.০৬ আটষট্টির সন্ধিক্ষণে
৭. ১.০৭ গণতন্ত্র ও সমাজবিবর্তন
৮. ১.০৮ ব্যক্তি ও গণসমাজ
৯. ১.০৯ সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ
১০. ১.১০ জাতীয় সংহতি
১১. ১.১১ জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে
১২. ১.১২ মাতৃভাষা, ইংরেজী ও হিন্দী
১৩. ১.১৩ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে
১৪. ১.১৪ সীমান্ত চিন্তা
১৫. ১.১৫ বাংলাদেশ দেখে এলাম
১৬. ১.১৬ গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের সংকট
১৭. ১.১৭ চীনের ছাত্র আন্দোলন
১৮. ১.১৮ পূর্ব ইউরোপ মার্ক্সবাদ সাম্যবাদ
১৯. ১.১৯ ঐক্য ও শান্তি
২০. ১.২০ ঐক্য নিয়ে আরো কিছু চিন্তাভাবনা
২১. ২.১ খাদ্য ও কৃষি সমস্যা
২২. ২.২ আমরা দেশ গড়বো কবে?
২৩. ২.৩ শ্লোগান বনাম সত্য
২৪. ২.৪ আর্থিক উন্নতির শর্ত
২৫. ২.৫ কর্মসংস্থান ও আর্থিক পুনর্গঠন
২৬. ২.৬ উন্নয়নের তত্ত্ব ও ভবিষ্যৎ
২৭. ৩.০১ বিজ্ঞান ও প্রগতির পথ
২৮. ৩.০২ স্বজন ও সজ্জন
২৯. ৩.০৩ পঞ্চপ্রীতি
৩০. ৩.০৪ ধর্ম, যুক্তিবাদ ও স্বাধীন সমাজ
৩১. ৩.০৫ সনাতন ও আধুনিক
৩২. ৩.০৬ সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে
৩৩. ৩.০৭ পল্লী ও নগর
৩৪. ৩.০৮ প্রেম ও নিয়ম
৩৫. ৩.০৯ তিন দিগন্ত
৩৬. ৩.১০ যুক্তি ও প্রতিষ্ঠান
৩৭. ৩.১১ আচার বিচার আনন্দ
৩৮. ৩.১২ দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ মঙ্গলবোধ
৩৯. ৩.১৩ সমাজ সংগঠনের পথের সন্ধানে
৪০. ৩.১৪ বাংলার সংকট ও কলকাতা
৪১. ৩.১৫ বাংলার নবজাগরণ ও আজকের সংকট
৪২. ৩.১৬ উনিশশতকী বাংলা নবজাগরণের গৌরব ও অপূর্ণতা
৪৩. ৩.১৭ নারী মুক্তি
৪৪. ৩.১৮ দ্বন্দ্ব
৪৫. ৩.১৯ দ্বন্দ্বের রূপভেদ
৪৬. ৩.২০ মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ
৪৭. ৩.২১ ইতিহাস চিন্তা
৪৮. ৩.২২ ইতিহাস ও দর্শন
৪৯. ৩.২৩ দুর্নীতি
৫০. ৪.১ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার সমস্যা
৫১. ৪.২ শিক্ষা ও ভাষা সমস্যা
৫২. ৪.৩ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ
৫৩. ৪.৪ শিক্ষার সমস্যা – ১
৫৪. ৪.৫ শিক্ষার সমস্যা – ২
৫৫. ৪.৬ শান্তিনিকেতন ও শিক্ষার দ্বন্দ্ব
৫৬. ৫.০১ মার্ক্সের মূল্যায়ন
৫৭. ৫.০২ গান্ধীবাদ কি অচল?
৫৮. ৫.০৩ গান্ধী ও মাও
৫৯. ৫.০৪ গান্ধী ও সংসদীয় গণতন্ত্র
৬০. ৫.০৫ গান্ধী ও ঈশ্বর
৬১. ৫.০৬ গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ
৬২. ৫.০৭ রবীন্দ্রনাথ ও যুক্তিবাদ
৬৩. ৫.০৮ আনন্দের সন্ধানে রাসেল
৬৪. ৫.০৯ রামমোহন রায়
৬৫. ৫.১০ মানবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারা প্রসঙ্গে
৬৬. ৫.১১ মানবেন্দ্রনাথ রায় জাতীয়তাবাদ থেকে মার্ক্সবাদ
৬৭. ৫.১২ মানবেন্দ্রনাথ ও নবমানবতাবাদ
৬৮. ৫.১৩ বিনয় কুমার সরকার : দ্বন্দ্ব ও “শক্তিযোগ”
৬৯. ৫.১৪ ভীমরাও রামজী আম্বেডকর
৭০. ৬.১ কানুদা
৭১. ৬.২ অরুণকুমার সরকার
৭২. ৬.৩ এযুগের বুদ্ধদেব
৭৩. ৭.১ মানুষ! মানুষ!!
৭৪. ৭.২ ধর্ম
৭৫. ৭.৩ ধর্ম ও যুক্তি
৭৬. ৭.৪ শিল্পচিন্তা
৭৭. ৭.৫ উত্তরণের শর্ত
৭৮. ৭.৬ প্রেম ও পূজা
৭৯. ৭.৭ হে মহাজীবন! হে মহামরণ!
৮০. ৮.০১ তৃতীয় চরণ (কমলা বক্তৃতা)
৮১. ৮.০২ বর্তমান সংকটে কর্তব্য
৮২. ৮.০৩ বাংলার সংকট ও সমাধানের পথ
৮৩. ৮.০৪ শান্তিনিকেতন : উপাসনা ও ভাষণ
৮৪. ৮.০৫ মূল বইগুলির ভূমিকা ও পরিশিষ্ট
৮৫. ৮.০৬ ভারতে ও চীনে খাদ্যোৎপাদন
৮৬. ৮.০৭ “সাম্যবাদ ও প্রগতির পথ”
৮৭. ৮.০৮ “মার্ক্সের মূল্যায়ন”
৮৮. ৮.০৯ “গান্ধীবাদ কি অচল?”
৮৯. ৮.১০ “মানুষ! মানুষ!!”

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন