কবীরা গুনাহ – ২০

২০. মদ্যপান

আল্লাহ তায়ালা সূরা আল মায়েদায় বলেনঃ “হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া ও ভাগ্য গণনা শয়তানের নোংরা কাজ। এগুলিকে পরিহার করে চল। তাহলে তোমরা সাফল্য লাভ করবে। শয়তান শুধু তোমাদের মধ্যে ক্ষমতা ও বিদ্বেষ সংঘটিত করতে চায় মদ ও জুয়ার মধ্য দিয়ে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিরত রাখতে চায়। তোমরা কি তাহলে বিরত থাকবে?”

“সুতরাং এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত যে, আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে মদ পান করতে নিষেধ করেছেন এবং তা থেকে সাবধান করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “তোমরা মদ পরিত্যাগ কর। কারণ ওটা সকল ঘৃণ্য কাজের জননী।” এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি মদ পরিত্যাগ করেনা, সে আল্লাহ ও তার রাসূলের নাফরমানী করে এবং এ জন্য সে আযাবের যোগ্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা আন্ নিসায় বলেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে এবং তার সীমা লংঘন করে, আল্লাহ তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ”মদপানের নিষেধাজ্ঞা নাযিল হওয়ার পর সাহাবীগণ একে অপরের কাছে গিয়ে বলতে থাকেন যে, মদকে হারাম করা হয়েছে এবং তাকে শিরকের সমপর্যায়ের গুনাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে।”

তাবারানী ও হাকেম বর্ণিত এক হাদীস অনুসারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর মদ পানকে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ গণ্য করতেন। এটা যে যাবতীয় নোংরা ও গর্হিত কাজের প্ররোচনার উৎস বা জননী, সে ব্যাপারে কোন দ্বিমতের অবকাশ নেই। আবু দাউদ শরীফে হযরত ইবনে উমার, ইবনে মাজাহ ও তিরমিযি শরীফে হযরত আনাস এবং আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমাদে হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত একাধিক হাদীসে মদ পানকারীর ওপর অভিশাপ বর্ষণ করা হয়েছে। সহীহ মুসলিম বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃপ্রত্যেক মাদক ও নেশাকর দ্রব্যই মদ এবং প্রত্যেক মদই হারাম। যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে মদ খাওয়ায় অভ্যস্ত থেকেছে এবং তওবা ছাড়াই মরে গেছে, সে আখিরাতে জান্নাতের পানীয় থেকে বঞ্চিত থাকবে। হাদীসটি সহীহ বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী, আবু দাউদ ও বায়হাকীতেও বর্ণিত হয়েছে। সহীহ মুসলিম ও নাসায়ীকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃযে ব্যক্তি কোন মাদক দ্রব্য সেবন করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামীদের ঘর্ম ও মলমূত্র পান করাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু হুরাইরা বর্ণিত হাদীস রাসূল (সা) বলেনঃ “মদ্যপায়ী ব্যক্তি মূর্তি পূজাকারীর সমান।”

সহীহ নাসায়ীতে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “দুই ব্যক্তি জান্নাতে যাবে। পিতামাতার অবাধ্য ও মদ্যপায়ী।” অপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ “তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে নাঃ মদ্যপায়ী, পিতামাতার অবাধ্য ও দায়ূস।” দায়ূস হলো সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের সদস্যদেরকে অসৎ কর্মে লিপ্ত জেনেও বাধা দেয় না।

রাসূল (সা) বলেনঃ “তিন ব্যক্তির নামায কবুল হয়না এবং কোন সৎ কর্ম উর্দ্ধে আরোহন করে না। পলাতক গেলাম যতক্ষণ তার মনিবের নিকট ফিরে না আসে, যে স্ত্রীর ওপর তার স্বামী অসন্তুষ্ট-যতক্ষণ সে তার ওপর খুশী না হয়, আর মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যাওয়া ব্যক্তি- যতক্ষণ তার হুশ ফিরে না আসে।”

মানুষের বিবেক বুদ্ধিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় এমন যে কোন মাদক দ্রব্যই মদ, চাই তা তরল পানীয় হোক বা শক্ত খাদ্য হোক, এবং শুকনো হোক কিংবা ভিজা হোক। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “মদ্যপায়ীর দেহে যতক্ষণ বিন্দুমাত্রও মদ অবশিষ্ট থাকবে ততক্ষণ আল্লাহ তার নামায কবুল করবেন না।” অপর হাদীসে আছেঃ “মদ্যপায়ীর কোন সৎ কর্মই আল্লাহ কবুল করেন না, আর মদ পানের কারণে মাতাল হয়ে যাওয়া ব্যক্তির ৪০ দিনের নামায কবুল হবে না। সে যদি তওবা করে আবার মদ পান করে, তবে আল্লাহ তাকে জাহান্নামের গলিত তামা ভক্ষণ করাবেনই।” রাসূল (সা) আরো বলেনঃ”যে ব্যক্তি মদ পান করলো, কিন্তু মাতাল হলো না, আল্লাহ তায়ালা ৪০ রাত পর্যন্ত তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন। আর যে মদ পান করে মাতাল হয়, আল্লাহ তার কোন সাদাকাহ ও সৎকাজ ৪০ রাত পর্যন্ত গ্রহণ করেন না। এই সময়ের মধ্যে সে মারা গেলে সে পৌত্তলিকের মত মরবে। আর আল্লাহ তাকে জাহান্নামীর মলমূত্র ও ঘাম পান করাবেন।”

রাসূল (সা) বলেছেনঃ “চোর মুমিন অবস্থায় চুরি করে না, ব্যভিচারী মুমিন অবস্থায় ব্যভিচার করে না, মদ্যপায়ী মুমিন অবস্থায় মদ পান করে না। পরে তওবা তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে।” (সহীহ আল বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী)

রাসূল (সা) আরো বলেছেন : “যে ব্যক্তি যিনা করে কিংবা মদ পান করে। আল্লাহ তার কাছ থেকে ঈমান ছিনিয়ে নেন, যেভাবে কোন ব্যক্তি তার জামা মাথার ওপর দিয়ে খুলে ফেলে।”(হাকেম)

রাসূল (সা) আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় মদ পান করে, সে ভোর পর্যন্ত মুশরিক থাকবে। আর যে ব্যক্তি সকালে মদ পান করবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুশরিক থাকবে।” রাসূল (সা) আরো বলেনঃ “জান্নাতের ঘ্রাণ পাঁচশো বছরের দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়। অথচ পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, দান করে যে খোটা দেয়, মদ্যপায়ী ও মূর্তি পূজারী এই ঘ্রাণ পাবেনা।” (তাবারানী) রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ “মদ্যপায়ীকে জাহান্নামে ব্যভিচারী নারীদের যৌনাংগ থেকে নির্গত পানি পান করানো হবে।

রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ “আল্লাহ তায়ালা আমাকে রহমত ও হেদায়াত হিসাবে পাঠিয়েছেন। বাদ্যযন্ত্র ও জাহেলিয়াতের কর্মকান্ড উচ্ছেদ করার জন্য পাঠিয়েছেন। আমার প্রভু শপথ করেছেন যে, আমার কোন বান্দা এক কাতরা মদ পান করলেও তাকে আমি জাহান্নামের উত্তপ্ত পানি পান করবো। আর যে বান্দা আমার ভয়ে মদ ত্যাগ করবে, আমি তাকে সর্বোত্তম সাথীদের সাথে জান্নাতের সম্ভান্ততম স্থানে পানীয় পান করাবো।”(আহমাদ)

রাসূল (সা) বলেছেনঃ “মদের ওপর, মদ পানকারীর ওপর, যারা মদ পান করায় তাদের ওপর, মদের ক্রেতা, বিক্রেতা, উৎপাদনকারী, বহন-পরিবহনকারী, সংগ্রহকারী, সরবরাহকারী ও মদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ জোগকারী সকলের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করা হয়েছে। (আবু দাউদ, আহমাদ)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস বলেন: “মনখোররা রোগাক্রান্ত হলে তাদেরকে দেখতে যেয়োনা।” ইমাম বুখারী বলেন ইবনে উমার বলেনঃ “মদখোরদেরকে সালাম করোনা।” রাসূল (সা) বলেছেনঃ “মদখোরদের সাথে ওঠাবসা করোনা। রোগাক্রান্ত হলে তাদেরকে দেখতে যেয়োনা। তাদের জানাযায় হাজির হয়োনা। মদখোর যখন কিয়ামতের ময়দানে হাজির হবে, তখন তার জিহবা তার বুকের ওপর ঝুলতে থাকবে, তা থেকে লালা ঝরতে থাকবে, তাকে যেই দেখবে ঘৃণা করতে ও ধিক্কার দিতে থাকবে এবং সকলেই তাকে মদখোর হিসাবে চিনবে।”

মুসলিম মনীষীগণের কেউ কেউ বলেছেন : “মদ্যপায়ী রোগাক্রান্ত হলে তাকে দেখতে যাওয়া এবং তাকে সালাম করা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ এই যে, মদ্যপায়ী ফাসিক ও অভিশপ্ত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। তবে সে তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন।”

হযরত উম্মু সালামা (রা) বলেন যে, “আমার এক মেয়ে রোগাক্রান্ত হলে আমি তার চিকিৎসার জন্য খানিকটা মদ তৈরী করলাম। এই সময় রাসূল (সা) আমার ঘরে প্রবেশ করে বললেনঃ হে উম্মু সালামা! এ কি হচ্ছে? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! ওটা দিয়ে আমি আমার মেয়ের চিকিৎসা করছি। রাসূল (সা) বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা যে জিনিসকে আমার উম্মতের ওপর হারাম করেছেন, তাতে তার রোগ নিরাময়ের কোন গুণ রাখেননি।”

আবু মূসা (রা) বলেনঃ রাসূল (সা) এর নিকট একটি কলসীতে রক্ষিত কিছু রস আনা হলো। সেই রসে কিছুটা পচন ধরে গিয়েছিল। রাসূল (সা) বললেনঃ “এই কলসিটাকে দেয়ালের সাথে ছুড়ে মারো। কারণ এতে যে পানীয় রয়েছে, ওটা আল্লাহতে অবিশ্বাসী ও আখেরাতে অবিশ্বাসীদের পানীয়।”

রাসূল (সা) আরো বলেনঃ”যার বুকে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত রক্ষিত আছে, সে মদ পান করলে কিয়ামতের দিন ঐ আয়াতের প্রতিটি অক্ষর তার কাছে বাদী হয়ে আসবে এবং আল্লাহর দরবারে তাকে আসামী হিসাবে দাঁড় করাবে। আর কিয়ামতের দিন আল কুরআন যার বাদী হবে, তার জন্য দুঃসংবাদ।

রাসূল (সা) আর একটি হাদীসে বলেনঃ”কোন দল দুনিয়াতে কোন নেশাকর দ্রব্য সেবনে ঐক্যবদ্ধ হলে জাহান্নামে আল্লাহ তাদেরকে একত্রিত করবেন। অতঃপর তারা সবাই পরস্পরকে উক্ত মাদক দ্রব্য সেবনে প্ররোচিত করার জন্য দোষারোপ করবে। প্রত্যেকে অপরকে বলবেঃ তুমিই আমাকে এই নিষিদ্ধ জিনিস সেবনে উদ্বুদ্ধ করেছিলে।”

রাসূল (সা) আরো বলেনঃ”যে ব্যক্তি মদ পান করবে, জাহান্নামে আল্লাহ তাকে এমন মারাত্মক বিষ পান করাবেন যে, সেই বিষের পেয়ালা মুখের কাছে নেয়া মাত্রই এবং বিষ পান করার আগেই ঐ পেয়ালার ভেতরে তার মুখের গেশত খসে পড়বে। আর বিষ পান করার পর তার দেহের সমস্ত গেশত ও চামড়া খসে পড়ে যাবে। তার দুর্গন্ধে সমগ্র জাহান্নামবাসী যন্ত্রণা ভোগ করবে। মনে রেখ, মদ পানকারী, মদ উৎপাদনকারী, পরিবহন ও সরবরাহকারী, ক্রয়-বিক্রয়কারী এবং এর বিক্রয়মূল্য ভোগকারী – সকলেই এর পাপের অংশীদার। তাদের নামায, রোযা, হজ্জ – কিছুই আল্লাহ কবুল করবেন না যতক্ষণ তারা তওবা না করে। তওবা না করে মারা গেলে আল্লাহ তাকে প্রতি ঢোক মদ পানের বিনিময়ে জাহান্নামের অধিবাসীদের রক্ত পূজ পান করাবেন। মনে রেখ, যে কোন নেশাকর ও মাদক দ্রব্য মদ হিসাবে গণ্য এবং মদ মাত্রেই হারাম।”

একটি হাদীসে আছে যে, মদখোরদেরকে দোজখের প্রহরীরা পুলসিরাতের ওপর থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে এবং দোজখে তাদেরকে যে নোংরা পানীয় পান করানো হবে, তা আকাশের ওপর পতিত হলে তার উত্তাপে গেটা আকাশ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত।

হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ”কোন মদ্যপায়ী মারা গেলে তাকে একটি কাষ্ঠ খন্ডের ওপর শূলবিদ্ধ করে কবরস্থ কর। পরে কবর খুলে দেখ। যদি দেখতে পাও যে তার মাথা পশ্চিম দিক থেকে ফিরে যায়নি, তাহলে তাকে শূল থেকে খুলে স্বাভাবিকভাবে দাফন কর। নচেত তাকে শূলবিদ্ধ অবস্থায়ই রাখো।”

হযরত ফযীল ইবনে ইয়ায একবার তার মুমূর্ষ শিষ্যকে দেখতে গিয়ে তাকে কলেমা পড়তে বলেন। কিন্তু সে কলেমা পড়তে পারছিল না। তিনি বারবার তাকে কলেমা শেখালেন। কিন্তু সে বললোঃ আমি কলেমা পড়তে পারছিনা। আর কলেমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ফযীল কাদতে কাঁদতে তার কাছ থেকে চলে গেলেন। অতঃপর কিছু দিন পর তাকে স্বপ্নে দেখলেন। দেখলেন তাকে জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বললেনঃ তোমার কলেমার জ্ঞান কিসে ছিনিয়ে নিয়েছিল। সে বললোঃ একবার আমার অসুখ হয়েছিল। চিকিৎসক আমাকে চিকিৎসার জন্য মদ পান করতে বলেছিল। তাই আমি মদ পান করতাম। বস্তুতঃ চিকিৎসার্থে মদ পানকারীর যদি এই দশা হয়ে থাকে, তাহলে সখের বসে ও নেশার বশে মদ পানকারীর কী অবস্থা হবে, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।

মদ ছাড়াও কিছু তরল বা কঠিন আকৃতির মাদক দ্রব্য রয়েছে, যা খেলে বা পান করলে মাদকতা আসে, বিবেকবুদ্ধি ও মেজাজ সাময়িক বা স্থায়ীভাবে পাল্টে যায়, আংশিক অথবা পুরোপুরি মাতলামীর সৃষ্টি করে, মাত্রাতিরিক্ত যৌন উত্তেজনার সৃষ্টি করে ব্যভিচারে প্ররোচিত করে, স্বভাবে হিংস্রতা এনে গালিগালাজ, মারামারি বা দাংগা ফাসাদের উস্কানি দেয়, আর নামায-রোযা ও অন্যান্য ইবাদাত থেকে সেবনকারীকে বিরত রাখে, এমন কি মাত্রারিক্ত সেবন করলে সেবনকারীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়। গাজা, ভাং, আফিম, তাড়ি, হিরোইন, হাশিশ ও অনুরূপ দেশীবিদেশী বস্তু মাদক দ্রব্য এর আওতাভুক্ত। এর সব কটিই হারাম। “সকল মাদক দ্রব্যই হারাম চাই তা পরিমাণে বেশী হোক বা কম হোক”- এই একটি দ্ব্যর্থহীন বাক্য দ্বারা রাসূল (সা) এগুলিকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছেন এবং মদখোরের শরীয়ত বিহিত শাস্তি ৮০টি বেত্রাঘাত প্রত্যেক মাদকখোরেরই প্রাপ্য।

একটি ঘটনা : উমাইয়া শাসক আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের কাছে এক যুবক ক্রন্দনরত অবস্থায় এসে বললোঃ হে আমীরুল মুমিনীন, আমি কবর খুঁড়ে মৃতদের কাফন চুরি করতাম। একটি কবর খুঁড়ে দেখি, তার ভেতরে শায়িত মানুষটি শুকরের আকৃতি ধারণ করে রয়েছে। আমি ভয়ে কবরটি ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, এমন সময় গায়েবী আওয়ায হলোঃ “তুমি তো চলে যাচ্ছ। এই লোকটাকে কেন শুকরে পরিণত করা হয়েছে জান?” আমি বললামঃ না। আমাকে বলা হলোঃ “সে মদ খেত এবং তওবা না করেই মারা গেছে। তাকে এই অবস্থায় কিয়ামত পর্যন্ত আযাব ভোগ করানো হবে।” আল্লাহ আমাদেরকে এই ভয়ংকর পাপ কাজ থেকে রক্ষা করুন।

.

২১. জুয়া

মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, দেবতার নামে বেদীতে বলি দেয়া ও লটারী দ্বারা ভাগ্য গণনা শয়তানের নোংরা কাজ। এসব থেকে দূরে থাক। তাহলে তোমরা সফলকাম হবে। মদ ও জুয়ার মধ্য দিয়ে শয়তান তোমাদের মধ্যে শক্রতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে ও নামায থেকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে রাখতে চায়। তোমরা কি বিরত থাকবে?” (সূরা আল মায়েদা)

যে কোন ধরনের জুয়াই এই আয়াতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, চাই তা দাবা, তাস, পাশা, গুটি অথবা অন্য কোন জিনিসের দ্বারা খেলা হোক। এটা আসলে অবৈধ পন্থায় মানুষের সম্পদ আত্মসাং ও লুণ্ঠন করার আওতাভুক্ত। যাকে আল্লাহ তায়ালা সূরা আল বাকারার এই আয়াতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন “তোমরা পরস্পরের সম্পদ অবৈধ পন্থায় খেয়োনা।” রাসূল (সা) এক হাদীসে বলেছেনঃ “কিছু লোক অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদে হস্তক্ষেপ করে। তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব।” (সহীহ আল বুখারী) সহীহ বুখারীর অপর এক হাদীসে আছে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “কেউ যদি এরূপ প্রস্তাব বা দাওয়াত দেয় যে, এস তোমার সাথে জুয়া খেলবো, তবে তার (গুনাহ মাফের জন্য) সদকা করা উচিত।” বস্তুতঃ জুয়া সম্বন্ধে শুধু কথা বললেই যদি সদকা বা কাফফরা দিতে হয়, তবে কাজ করলে কী পরিণতি হতে পারে ভেবে দেখুন তো!

তাস ও দাবা ইত্যাদি খেলা যদি আর্থিক হারজিত থেকে মুক্ত হয় এবং নিছক চিত্তবিনোদনমূলক হয়, তবে তা নিয়ে মতভেদ আছে। কারো মতে হারাম, কারো মতে হালাল। কিন্তু আর্থিক হারজিত যুক্ত থাকলে তা যে হারাম, সে ব্যাপারে সকল মাযহাবের আলেম ও ইমামগণ একমত। মারদ বা পাশা জাতীয় জুয়া খেলা হারাম হওয়া সম্পর্কে ইমামগণ একমত হয়েছেন। কেননা রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি পাশা খেললো, সে যেন নিজের হাতকে শুকরের গেশত ও রক্তের মধ্যে ডুবিয়ে রঞ্জিত করলো।”(মুসলিম) সহীহ আল-বুখারী বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “যে ব্যক্তি পাশা খেলে, সে আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানী করে।” হযরত ইবনে উমার (রা) বলেনঃ “পাশা খেলা এক ধরনের জুয়া এবং তা শুকরের চর্বি দিয়ে পালিশ করার মত হারাম কাজ।”

দাবা খেলা ত অধিকাংশ আলেমের মতে হারাম, চাই তাকে কোন কিছু বন্ধক রাখা তথা আর্থিক হারজিতের বাধ্যবাধকতা থাক বা না থাক। তবে বন্ধক রাখা এবং হেরে যাওয়া খেলোয়াড়ের বন্ধক বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা, অন্য কথায় আর্থিক হারজিত যুক্ত থাকলে তা সর্বসম্মতভাবে জুয়া ও হারাম। বন্ধক রাখা ও আর্থিক হারজিত যুক্ত না থাকলেও অধিকাংশ আলেমের মতে দাবা খেলা হারাম। কেবলমাত্র ইমাম শাফেয়ী একে হালাল মনে করেন শুধু এই শর্তে যে, তা ঘরোয়াভাবে খেলা হবে এবং নামায কাযা অথবা অন্য কোন ফরয ওয়াজিব বিনষ্ট হওয়ার কারণ হবেনা। ইমাম নবাবী ইমাম শাফেয়ীর এই মতানুসারে ফতোয়া দিতেন। সেই সাথে তিনি পারিশ্রমিক বা পুরস্কারের বিনিময়ে দাবা খেলাকে জুয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে রায় দেন।

যে সমস্ত আলেম দাবা খেলাকে হারাম বলেন, তাদের প্রমাণ হলো সূরা আল মায়েদার তৃতীয় আয়াতের এই উক্তিঃ “ওয়া আন তাসতাকসিমু বিল আযলাম।” ইমাম সুফিয়ান ও ওয়াকী ইবনুল জাররাহ ব্যাখ্যা দেন যে, “আযলাম” অর্থ দাবা খেলা। হযরত আলী (রা) বলেনঃশাতরান্তু বা দবি হলে অনারবদের জুয়া। হযরত আলী (রা) একদিন দাবা খেলায়রত একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখে বললেনঃ “তোমরা যা নিয়ে এরূপ ধ্যানে মগ্ন আছ এটি কী? এগুলো স্পর্শ করার চেয়ে জ্বলন্ত আগুন স্পর্শ করাও ভাল। আল্লাহর কসম, তোমাদেরকে এজন্য সৃষ্টি করা হয়নি।” হযরত আলী (রা) আরো বলেনঃ “দাবাড়ুর ন্যায় মিথ্যাবাদী আর কেউ নেই। সে বলে আমি হত্যা করছি। অথচ সে হত্যা করেনি। সে বলে, এটা মরেছে। অথচ কোন কিছুই মরেনি।” হযরত আবু মূসা আশয়ারী রাজিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ গুনাহগার ব্যক্তি ছাড়া কেউ দাবা খেলেনা। ইমাম ইসহাক বিন রাহওয়াহকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, দাবা খেলাতে আপনার মতে আপত্তি আছে। তিনি বললেনঃ দাবা পুরোপুরি আপত্তিকর। তাঁকে বলা হলো দূর্গের সৈন্যরা যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে দাবা খেলে। তিনি জবাব দিলেনঃ এটি গুনাহর কাজ। মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল কারযী দাবা খেরা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেনঃদাবা খেলার ন্যূনতম ক্ষতি এই যে, দাবাড়ু কিয়ামতের দিন বাতিল পন্থীদের সাথে সমবেত হবে।

হযরত ইবনে উমার (রা) দাবাকে পাশার চেয়েও খারাপ এবং ইমাম মালিক (রহ) দাবাকে পাশার সমপর্যায়ের এবং উভয়ে এ দুটিকে হারাম বলেছেন। ইমাম মালিক আরো বলেন। আমি শুনেছি যে, হযরত ইবনে আব্বাস জনৈক ইয়াতীমের সম্পতির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি ঐ সম্পত্তিতে দাবা খেলার সরঞ্জাম পেয়ে তা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। দাবা খেলা বৈধ হলে ইয়াতীমের সম্পত্তির এই ক্ষতি সাধন তার দ্বারা সম্ভবপর হতো না। হারাম বলেই তিনি এ কাজ করতে পেরেছিলেন – যেমন কোন ইয়াতীমের সম্পত্তিতে মদ থাকলে তা ঢেলে ফেলা ওয়াজিব। ইবরাহীম নখয়ী (রহ) এর মতে দাবা একটি অভিশপ্ত খেলা।

এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “আল্লাহ তায়ালা প্রতিদিন তার সৃষ্টির প্রতি ৩৬০ (তিনশো ষাট) বার রহমতের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। যে দাবা খেলে, সে এর একটি দৃষ্টিও পায়না।” হযরত আবু হুরাইরা বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “দাবা পাশা ও অন্যান্য অলসতা সৃষ্টিকারী খেলায় নিমগ্ন লোকদের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সালাম দিওনা। কেননা তারা যখন খেলায় মত্ত হয়, তখন শয়তান তার দলবল নিয়ে তাদের মাঝে সমবেত হয়। যখনই কেউ খেলা ছেড়ে চলে যায়, শয়তান তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কেননা শয়তান ও তার দলবল তাকে ঘৃণা করে, দাবাড়ুরা খেলা শেষে যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে চলে যায় তখন তারা মরা জন্তুর লাশ খেয়ে পেট ভরা কুকুরদের মত চলে যায়। অপর এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেনঃ “দাবাড়ুরা কিয়ামতের দিন কঠিন আযাব ভোগ করবে।”

.

২২. সতী নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “যারা সতী ও সরলমনা মুমিন নারীদের বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং সেই দিন তাদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে, যেদিন তাদের জিহবা, হাত ও পা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে।” (সূরা আন নূর) “যারা সতী নারীদের ওপর অপবাদ দেয়, অতঃপর চারজন সাক্ষী হাজির করেনা, তাদেরকে ৮০টি দোররা মারো এবং আর কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। তারাই হচ্ছে ফাসিক।”(সূরা আন নূর)

এ সব আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, কোন সতী নারীর বিরুদ্ধে ব্যভিচার ও অশ্লীল কর্মে লিপ্ত হওয়ার অপবাদ আরোপকারী দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তার জন্য কঠিন আযাব নির্ধারিত রয়েছে। পৃথিবীতে তার শাস্তি এই যে, তাকে ৮০টি দোররা (বিশেষভাবে সজ্জিত প্রহার দন্ড) মারা হবে এবং সে সত্যবাদী হলেও তার সাক্ষ্য কখনো গ্রহণ করা হবেনা। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রাসূল (সা) সাতটি বৃহত্তম কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন এবং এই সাতটির অন্যতম হচ্ছে সতী ও সরলমনা মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদ রটনা করা। অপবাদ রটনার বিভিন্ন পন্থা রয়েছে, যেমনঃ কোন নির্দোষ মুসলিম নারীকে এরূপ সম্বোধন করা “ওহে, ব্যভিচারীনী, ওহে বেশ্যা, ওহে অসতী, অথবা তার স্বামীকে সম্বোধন করা, “ওহে ব্যভিচারীনীর বা বেশ্যার স্বামী, অথবা তার সন্তানকে বলা “ওহে হারামজাদা বা হারামজাদী, ওহে বেশ্যার সন্তান বা ব্যভিচারীনীর সন্তান” ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, বিনা প্রমাণে ব্যভিচারের অভিযোগ উত্থাপন স্ত্রী বা পুরুষ যার বিরুদ্ধেই করা হোক এবং যে ভাষাতেই করা হোক, আর সেই অভিযুক্ত পুরুষ বা স্ত্রী স্বাধীন বা দাসদাসী যাই হোক না কেন – অভিযোগ আরোপকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির আবেদন সাপেক্ষে ৮০টি দোররা মারা হবে।

(ব্যভিচার ব্যতীত অন্যান্য পাপাচার সংক্রান্ত অপবাদ আরোপের বিষয়টি পরবর্তীতে আলাদাভাবে বর্ণনা করা হবে। কেননা সেগুলি কবীরা গুনাহ হলেও সেগুলোর জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কোন পার্থিব শান্তি নির্ধারিত নেই। – অনুবাদক)।

পরিতাপের বিষয় যে, সাধারণতঃ অজ্ঞ মুসলমানেরা এ ধরনের অশ্লীল কথাবার্তা রটনা করে দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত হয় ও আযাব ভোগ করে। এ জন্য রাসূল (সা) মানুষের জিহবাকে সংযত রাখতে বলেছেন। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “লোকেরা বিনা সাক্ষ্য প্রমাণে কোন কোন কথা বলে জাহান্নামের এত গভীরে নিক্ষিপ্ত হয়, যার দূরত্ব সূর্যাস্তের স্থান ও সূর্যোদয়ের স্থানের মধ্যের দূরত্বের চেয়েও বেশী। এ কথা শুনে হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল বললেনঃ “হে রাসূলুল্লাহ! আমাদের কথাবার্তার জন্যও কি আমাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে?” রাসূল (সা) বললেনঃ “ওহে মুয়াম! মানুষের মুখ দ্বারা সংঘটিত পাপ ছাড়া আর কোন পাপ কি এমন আছে, যা তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপের কারণ হবে?” রাসূল (সা) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে হয়, নিরব থাকুক, না হয় ভালো কথা বলুক।” এছাড়া পবিত্র আল কুরআনের এ আয়াতটিতে ও জিহবার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছেঃ “সে যে কথাই উচ্চারণ করুক না কেন, তা লিখে রাখার জন্য তার কাছে সদা প্রকৃত প্রহরী রয়েছে।” (সূরা কাফ) হযরত উকবা ইবনে আমের (রা) রাসূলকে (সা) জিজ্ঞাসা করলেনঃ “ইয়া রাসূলাল্লাহ! মুক্তি কিভাবে পাওয়া যাবে? তিনি বলেনঃ তোমার জিহবাকে সংযত রাখো, তোমার বাড়ীর প্রশস্ততা যেন তোমার জন্য যথেষ্ট হয় (অর্থাৎ অন্যের ভূমির প্রতি লোভ করোনা, তোমার গুনাহর জন্য কাঁদো, এবং মনে রেখ যে, নিষ্ঠুরমনা লোকেরা আল্লাহ থেকে সবচেয়ে বেশী দূরবর্তী।” (আবু দাউদ ও তিরমিযী)

রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হচ্ছে অশ্লীল কথাবার্তা উচ্চারণকারী।” (তিরমিযী) এ হাদীস থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, অশ্লীল কাজে লিপ্ত লোকেরা তাহলে কত বেশী ঘৃণিত। তিনি আরো বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আমার জন্য তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী অংগ (জিহবা দাঁত ও খাদ্যনালী) এবং দুই উরুর মধ্যবর্তী অংগকে (যৌনাংগ) সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নেবে, আমি তার জন্য জান্নাতেও দায়িত্ব নেব।”

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, চরিত্রবান ও চরিত্রব্ৰতী লোকদের সম্মান রক্ষা এবং সমাজে অশ্লীলতার বিস্তার রোধের উদ্দেশ্যেই ৪ জন চাক্ষুস সাক্ষী ব্যতীত ব্যভিচারের অভিযোগ প্রকাশ্যে উচ্চারণে এইরূপ কঠোর আইনগত কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছে। এ দ্বারা প্রকৃত ব্যভিচারীদেরকে রক্ষা করা শরীয়তের উদ্দেশ্য নয়। (নাউজু বিল্লাহ) প্রকৃত অপরাধীদেরকে শান্তি দানের জন্য যথাযথ নিয়মে আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে হবে।

.

২৩. রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাত করা

সরাসরি কোষাগার থেকে এবং যাকাতের তহবিল থেকে আত্মসাত করাও এর আওতাভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “নিশ্চয় আল্লাহ খেয়ানতকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”(সূরা আত তাওবা) “কোন নবীর পক্ষে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাত করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি আত্মসাত করবে, সে কিয়ামতের দিন আত্মসাতকৃত জিনিস সাথে নিয়ে হাজির হবে। (আলে ইমরান)

হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন যে, একদিন রাসূল (সা) ভাষণ দিলেন। সেই ভাষণে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাত করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করলেন। অতঃপর বললেনঃ আমি কিয়ামতের দিন তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর একটা উট থাকবে এবং সেই উট ডাকতে থাকবে। তখন ঐ ব্যক্তি আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল “আমাকে উদ্ধার করুন। তখন আমি বলবোঃ আমি তোমাকে কোন সাহায্যই করতে সক্ষম নই, তোমাকে আমি আগেই আল্লাহর বিধান জানিয়ে দিয়েছি। কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর একটা ঘোড়া থাকবে এবং তা উচ্চস্বরে ডাকতে থাকবে। ঐ ব্যক্তি আমাকে বলবে : হে রাসূল! আমাকে উদ্ধার করুন। আমি বলবোঃ আমি তোমার কোন সাহায্য করতে সক্ষম নই, তোমাকে আগেই আল্লাহর বিধান জানিয়ে দিয়েছি। তোমাদের কাউকে আমি কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ে একটা ছাগল থাকবে এবং সেই ছাগল উচ্চস্বরে ডাকতে থাকবে। ঐ ব্যক্তি আমাকে বলবেঃ হে রাসূল! আমাকে উদ্ধার করুন। আমি বলবোঃ আমি তোমাকে কোন সাহায্য করতে সক্ষম নই। আমি তোমাকে আগেই আল্লাহর বিধান জানিয়ে দিয়েছি। আমি তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ে চিৎকাররত কোন প্রাণী থাকবে। ঐ ব্যক্তি আমাকে বলবোঃ হে রাসূল! আমাকে উদ্ধার করুন। আমি বলবোঃ আমি তোমার কোন সাহায্য করতে সক্ষম নই। আমি তোমার কাছে আগেই আল্লাহর বিধান পৌছিয়ে দিয়েছি। আমি তোমাদের কাউকে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ের ওপর কাপড় চোপড়ের স্থূপ থাকবে এবং সে আমাকে বলবেঃ হে রাসূল! আমাকে উদ্ধার করুন। কিন্তু আমি বলবোঃ আমি তোমাকে সাহায্য করতে অক্ষম। আমি আগেই তোমার কাছে আল্লাহর বিধান পেীছিয়ে দিয়েছি। আমি তোমাদের কাউকে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, তার ঘাড়ে নীরব বস্তু (স্বর্ণ রৌপ্য) থাকবে, এবং সে বলবেঃ হে রাসূল! আমাকে রক্ষা করুন। কিন্তু আমি বলবোঃ আমি তোমাকে সাহায্য করতে অক্ষম। আমি আগেই তোমার কাছে আল্লাহর বিধান পৌছিয়ে দিয়েছে।” (সহীহ মুসলিম)

বস্তুতঃ যে ব্যক্তি এই সকল বস্তু যুদ্ধলব্ধ (রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সম্পদ) হিসাবে আসার পর তা সরকারীভাবে বিতরণের আগেই অথবা বাইতুল মাল থেকে অথবা যাকাত হিসাবে সংগৃহীত হওয়ার পর তা থেকে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা দায়িত্বশীলের অনুমতি ছাড়া কোন কিছু গ্রহণ করবে, কিয়ামতের দিন তা তার ঘাড়ে চড়াও হবে। পবিত্র আল কুরআনে এই দিকে ইংগিত করে বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি আত্মসাত করবে, সে আত্মসাতকৃত জিনিস নিজের সাথে নিয়ে আসবে।”

রাসূল (সা) বলেছেনঃ “সরকারের পক্ষে আদায়কৃত সম্পদের একটা সুই সুতোও যদি কারো কাছে থাকে, তবে তা জমা দিয়ে দাও। আত্মসাত করা থেকে বিরত থাক। কেননা আত্মসাতকারী কিয়ামতের দিন নিদারুণ অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হবে।” ইবনুল লাতবিয়া নামক জনৈক সাহাবীকে একবার যাকাত সদকা আদায়ের কাজে নিয়োগ করা হয়। তিনি কিছু সদকার জিনিস আদায় করে রাসূলের (সা) কাছে উপস্থিত করেন। তিনি কিছু জিনিসকে দেখিয়ে বলেন এটা আপনাদের। আর কিছু জিনিসকে দেখিয়ে বলেনঃ এটা আমাকে উপঢৌকন হিসাবে দেয়া হয়েছে। এ কথা শোনা মাত্র রাসূল (সা) মসজিদের মিম্বরে আরোহণ করেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে নিম্নরূপ ভাষণ দেনঃ আল্লাহর কসম, তোমাদের কেউ যেন বিনা অধিকারে কোন জিনিস গ্রহণ না করে। তাহলে কিয়ামতের দিন সে ঐ জিনিসকে বহন করে হাজির হবে। যে ব্যক্তি সেদিন নিজের ঘাড়ে চিৎকাররত উট, গরু বা ছাগল বহন করে আল্লাহর সামনে হাজির হবে, তাকে আমি চিনবোনা। অতঃপর হাত উঁচু করে বললেন “হে আল্লাহ! আমি কি তোমার নির্দেশ পৌছিয়ে দিয়েছি।” (অপর রেওয়াতে আছে যে, রাসূল (সা) আদায়কারীকে বলেছিলেনঃ তুমি যদি সরকারী আদায়কারী হয়ে না যেতে এবং ঘরে বসে থাকতে, তাহলে কি কেউ তোমাকে উপঢৌকন দিতা) (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেনঃ আমরা রাসূলের (সা) সাথে খাইবারে গিয়েছিলাম (অতঃপর তা আমাদের হাতে বিজিত হয়। সেখানে আমরা যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মধ্যে কোন স্বর্ণ বা রৌপ্য পাইনি। আমরা শুধু খাদ্য দ্রব্য ও কাপড়চোপড় পেয়েছিলাম। এরপর আমরা ওয়াদিউল কুরায় চলে গেলাম। রাসূল (সা) এর সাথে বণী জুযামের এক ব্যক্তি দেয়া একটি ভৃত্য ছিল। (সে বনী যুবাইব গেত্রের রিফায়া বিন এযীদ নামে পরিচিত ছিল।) আমরা যখন ওয়াদীতে যাত্রা বিরতি করলাম, সেই সময়ে রাসূলের (সা) ভূতটি কাফেলার উষ্ট্রবহরে অবস্থান করেছিল। এই সময়ে কোথা থেকে নিক্ষিপ্ত একটি তীরে বিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়। আমরা বললামঃ ইয়া রাসূল! লোকটির কী সৌভাগ্য যে, শহীদ হয়ে গেল। রাসূল (সা) বললেন। “কখনো নয়। যে আল্লাহর হাতে আমার জীবন, তার শপথ করে বলছি সে একটি কম্বল গনিমতের সম্পদ থেকে তুলে নিয়েছে। অথচ ওটা তাকে সরকারীভাবে বিতরণ করা হয়নি। ঐ কম্বল তার দেহে আগুন হয়ে জ্বলবে।” এ কথা শুনে সাহাবীগণ ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং যার কাছে একটা বা দুটো জুতোর ফিতে ছিল, তাও তিনি এনে জমা দেন এবং বলেনঃ আমি এটা খাইবারের যুদ্ধের দিন পেয়েছি।) রাসূল (সা) বলেনঃ একটা কিংবা দুটো জুতোর ফিতে আগুনের অন্তর্গত। (মালেক, আহমদ, আবু দাউদ, নাসায়ী। ইবনে মাজাহ, বুখারী ও মুসলিম)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) বর্ণনা করেন যে, একবার এক সফরে রাসূলের (সা) মালপত্রের পাহারায় কিরকিরা নামক এক ব্যক্তিকে রাখা হয়। সে মারা গেলে রাসূল (সা) বলেন, সে দোজখবাসী। লোকেরা তাকে দেখতে গেলে দেখতে পেল, সে একটি আলখেল্লা আত্মসাত করেছে। হযরত যায়দ বিন খালেদ জুহানী (রা) বলেন যে, খাইবারের যুদ্ধে এক ব্যক্তি কোন দ্রব্য আত্মসাত করে। পরে সে মারা গেলে রাসূল (সা) তার জানাযা পড়েননি। তিনি বললেন, তোমাদের এই সংগীটি আল্লাহর পথের সম্পদ আত্মসাত করেছে। আমরা তার জিনিসপত্র তল্লাশী করে দুই দিরহাম মূল্যের একটি রেশমী বত্র পেলাম, যা যুদ্ধে ইহুদিদের কাছ থেকে হস্তগত হয়েছিল। ইমাম আহমাদ বলেনঃ আত্মসাতকারী ও আত্মহত্যাকারী ছাড়া রাসূল (সা) আর কারো জানাযা পড়া থেকে বিরত থেকেছেন বলে আমার জানা নেই। রাসূল (সা) আরো বলেছেন : কর্মচারীদের প্রাপ্ত উপহার আত্মসাতের পর্যায়ভুক্ত।” (সহীহ মুসলিম)

রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ আল্লাহ পবিত্রতা ছাড়া যেমন নামায কবুল করেননা, তেমনি আত্মসাতকৃত সম্পদের সদকাও গ্রহণ করেননা। (সহীহ মুসলিম)

আত্মসাত সম্পর্কে আরো বহু হাদীস রয়েছে। সে সব হাদীসের কতক যুলুম (অত্যাচার) সংক্রান্ত অধ্যায়ে আসবে। যুলুমকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ এক, অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ হরণ। দুই, কাউকে হত্যা, প্রহার ও আহত করার মাধ্যমে যুলুম করা। তিন, পালিগালাজ, অভিসম্পাত, গীবত ও মিথ্যা অপবাদ দানের মাধ্যমে কারো ইজ্জতের ওপর যুলুম করা। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (সা) এই সব কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেছিলেন : “মনে রেখ! তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জত তোমাদের কাছে পবিত্র যেমন এই শহরে এই মাসে আজকের দিন পবিত্র।” (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

.

২৪. চুরি করা

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “চোর-স্ত্রী বা পুরুষ যাই হোক না কেন, তাদের হাত কেটে দাও, তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তিস্বরূপ। আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।”(সূরা আল মায়েদা)

এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে ইবনে শিহাব বলেনঃ মানুষের সম্পদ অপহরণের অপরাধের জন্য আল্লাহ হাত কাটার শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। তিনি চোরের প্রতিশোধ গ্রহণে পরাক্রমশালী এবং হাত কাটাকে বাধ্যতামূলক করার কাজে প্রাজ্ঞ।

রাসূল (সা) বলেছেনঃ “কোন চোর ঈমানদার অবস্থায় চুরি করেন। তবে তওবা করলে ঈমান বহাল হয়।”(আবু দাউদ, তিরমিযী)

হযরত ইবনে উমার (রা) বর্ণনা করেন যে, তিন দিরহাম মূল্যের দ্রব্য চুরির ঘটনায় রাসূল (সা) হাত কেটেছেন। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম) হযরত আয়িশাহ (রা) বলেনঃ রাসূল (সা) সিকি দিনার বা তার বেশী চুরিতে হাত কেটে দিতেন। (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম) একাধিক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, সিকি দিনার বা তিন দিরহামের কম চুরিতে হাত কাটা যাবেনা। তৎকালে ১২ দিরহামে এক দিনার হতো। তবে চুরির পরিমাণ যাই হোক এবং হাত কাটার শাস্তির উপযুক্ত হোক বা না হোক, সর্বাবস্থায় তা কবীরা গুনাহ ও জঘন্য অপরাধ।

সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত এক হাদীসে হযরত আয়িশাহ (রা) বলেন যে, বনু মাখযুম গেত্রের এক মহিলা বিভিন্ন জিনিস ধার নিয়ে পরে অস্বীকার করতো। রাসূল (সা) তার হাত কাটার নির্দেশ দিলেন। তার পরিবারের লোকেরা রাসূলের (সা) পালকপুত্র যায়েদের ছেলে উসামার কাছে এসে ঐ মহিলার অব্যাহতির জন্য সুপারিশ করতে অনুরোধ করলো। উসামা সুপারিশ করলে রাসূল (সা) বললেনঃ হে উসামা! আমি আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত শাস্তির ব্যাপারে তোমাকে সুপারিশ করতে দেখতে চাইনা।” অতঃপর সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললেনঃ “তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো শুধু একজন্যই ধ্বংস হয়েছে যে, তাদের মধ্যে কোন সম্ভ্ৰান্ত ব্যক্তি চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর কোন দুর্বল ব্যক্তি চুরি করলে তার হাত কেটে দিত। আল্লাহর কসম, মুহাম্মদের (সা) কন্যা ফাতিমও যদি চুরি করতো, তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম।” অতঃপর বনু মাখযুমের ঐ মহিলার হাত কেটে দেয়া হলো।

তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীসে হযরত আবদুর রহমান ইবনে জারীর বলেন আমরা ফুযালা বিন উবাইদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম চোরের হাত কাটার পর কর্তিত হাত চোরের কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া কি রাসূলের (সা) সুন্নাত? তিনি বললেনঃ হাঁ, রাসূল (সা) কর্তিত হাত চোরের কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।

আলেমগণ বলেনঃ চুরি করা জিনিস মালিকের নিকট ফেরত দেয়া ব্যতীত চোরের তওবায় কোন লাভ হবেনা। তবে সে গরীব হলে মালিকের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারে।

.

২৫. ডাকাতি করা

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে অরাজকতা ছড়ায়, তাদের একমাত্র শাস্তি এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে, অথবা শূলে চড়ানো হবে, অথবা তাদের বিপরীত দিকের হাত ও পা কেটে দিতে হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। এটা তাদের পার্থিব অপমান। আরো তাদের জন্য আখেরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি।”(সূরা আল মায়েদা)

ইমাম ওয়াহেদী উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ”আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার” অর্থ আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করা ও তাদের আদেশ-নিষেধ অমান্য করা। আদেশ অমান্যকারী প্রকৃত পক্ষে যুদ্ধে ও বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে থাকে। পৃথিবীতে অরাজকতা ছড়ায় অর্থাৎ হত্যা ও সম্পদ অপহরণের মাধ্যমে অরাজকতা ছড়ায়। মুমিনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণকারী আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ ঘোষণাকারী রূপে বিবেচিত। ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আওযায়ী এই মত পোষণ করতেন। “অথবা” শব্দটি বারবার ব্যবহার করা দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, এই ব্যবস্থাগুলোর মধ্য হতে যে রোপে ইসলামী সরকারের স্বাধীনতা রয়েছে। অর্থাৎ ইচ্ছা করলে তাকে হত্যা করা যাবে, ইচ্ছা করলে শূলে চড়ানো যাবে, এবং ইচ্ছা করলে তাকে বহিষ্কার করা যাবে। এই মতটি হযরত ইবনে আব্বাস, হাসান, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়া ও মুজাহিদের। ইমাম আতিয়ার মতে এ দ্বারা স্বাধীনতা নয় বরং অপরাধের মাত্রার তারতম্য অনুসারে শান্তি বিধান করা বুঝায়। যে ডাকাত হত্যা ও সম্পদ হরণ এই দুই অপরাধই করবে তাকে হত্যাও করা হবে অতঃপর শূলে চড়ানো হবে। যে ডাকাত সম্পদ কেড়ে নেবে কিন্তু কাউকে হত্যা করবেনা, তাকে শুধু হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কাটা হবে। যে ডাকাত শুধু রক্তপাত করবে। এবং সম্পদ হরণ করবেনা তাকে হত্যা করা হবে। আর যে ব্যক্তি হত্যাও করবেনা, সম্পদও হরণ করবেনা, কিন্তু অস্ত্র নিয়ে বা অন্য কোন উপায়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করবে, তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। এটি শাফেয়ী মাযহাবের মত। ইমাম শাফেয়ী আরো বলেন যে, প্রত্যেককে তার অপরাধের মাত্রা অনুসারে শাস্তি দেয়া হবে। হত্যা ও শুল দুটোই যার প্রাপ্য, তাকে প্রথমে হত্যা করা হবে অথবা ৩ বার শূলে চড়িয়ে নামিয়ে রাখা হবে যাতে তার শাস্তিকে খুবই ঘৃণ্য করে প্রকাশ করা যায়। আর যার কেবল হত্যার শাস্তি প্রাপ্য তাকে হত্যা করে লাশ আপনজনদের হাতে অর্পণ করতে হবে। আর যার শুধু কর্তন দন্ড প্রাপ্য, তার প্রথমে ডান হাত কাটা হবে। সে পুনরায় চুরি ডাকাতি করলে তার বাম পা কাটা হবে। পুনরায় এই অপরাধ করলে তার বাম হাত কাটা হবে। কেননা আবু দাউদ নাসায়ী বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেনঃ “প্রথমবার চুরি করলে তার হাত কেটে দাও, দ্বিতীয়বার চুরি করলে তার পা কেটে দাও, পুনরায় চুরি করলে হাত কেটে দাও, পুনরায় চুরি করলে পা কেটে দাও।” হযরত আবু বকর ও হযরত উমারের (রা) খিলাফতকালে এই হাদীস অনুসারেই কাজ করা হতো এবং কোন সাহাবীই এর বিরোধিতা করেননি।

আয়াতে যে বলা হয়েছে “অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে” এর ব্যাখ্যা প্রসংগে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ যাকে ধরা সম্ভব হবেনা, তার সম্পর্কে সরকার ঘোষণা দিয়ে দেবেন যে, যে ব্যক্তি তাকে ধরতে পারবে, সে যেন তাকে হত্যা করে। আর যে ধরা পড়বে, তাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকাতে হবে। কেননা এতে তার দেশে ঘুরে ঘুরে অপরাধ করার পথ বন্ধ হবে এবং এটাই তার বহিষ্কার।

বস্তুতঃ শুধুমাত্র হত্যার ভয় দেখানো এবং সন্ত্রাস ছড়ানোই কবীরা গুনাহ। এর ওপর কেউ যদি জিনিসপত্র ছিনতাইও করে এবং খুন জখমও করে, তবে সে তো এক সাথে অনেকগুলো কবীরা গুনাহ সংঘটিত করে। এ ছাড়া এ ধরনের অপরাধীরা সাধারণতঃ মদখুরী, ব্যভিচার, সমকাম, নামায তরক ইত্যাদি কবীরা শুনাহে তো লিপ্ত থাকেই।

.

২৬. মিথ্যা শপথ করা ও আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে ওয়াদা করে ও কসম খেয়ে তার বিনিময়ে ক্ষুদ্র স্বার্থ লাভ করে, আখেরাতে তাদের কিছুই প্রাপ্য থাকবেনা, আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে দৃষ্টি দেবেন না, এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। অধিকন্তু তাদের জন্য রয়েহে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”(আলে ইমরান)

ইমাম ওয়াহদী বলেনঃ একবার একটি জমির মালিকানা নিয়ে দুই ব্যক্তি পরস্পর বিরোধী দাবী জানাতে থাকে এবং তাদের বিবাদের মীমাংসার জন্য তারা উভয়ে রাসূলের (সা) নিকট গমন করে। বিবাদী যখন নিজের দাবীর স্বপক্ষে কসম খেতে উদ্যত হলো, অমনি এই আয়াত নাযিল হলো। ফলে সে কসম খাওয়া থেকে বিরত হয় এবং জমির ওপর বাদীর মালিকানা মেনে নেয়।

এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃযে ব্যক্তি নিজে হকদার না হয়েও অপরের সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য কসম খায়, সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময় তাকে রাগান্বিত দেখবে। আশয়াস বলেনঃ উপরোক্ত আয়াতটি আমার সম্পর্কেই নাযিল হয়েছিল। জনৈক ইহুদীর সাথে একটি জমি নিয়ে আমার বিরোধ ছিল। আমি তাকে রাসূলের (সা) কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি আমাকে বললেনঃ তোমার কি সাক্ষী বা প্রমাণ আছে? আমি বললাম না। তখন রাসূল (সা) উক্ত ইহুদীকে বললেন তুমি শপথ করে বল যে ঐ জমি তোমার। আমি বললাম। হে রাসূল! ইহুদীকে শপথ করার সুযোগ দিলে তো সে শপথ করে আমার জমি নিয়ে নেবে। এই সময় এই আয়াত নাযিল হয়। আয়াতটিতে যে “ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা পার্থিব স্বার্থকেই বুঝানো হয়েছে, যার জন্য লোকেরা সচরাচর মিথ্যা কসম খেয়ে থাকে।

প্রসংগতঃ উল্লেখ্যযোগ্য যে, ইসলামী আইন অনুসারে আদালতে বাদী উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণ উপস্থিত করতে অক্ষম হলে বিবাদী শপথ করার সুযোগ লাভ করে থাকে এবং এই শপথের ভিত্তিতেই আদালত বিবাদের নিষ্পত্তি করে থাকে। তাই এরূপ ক্ষেত্রে শপথ অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি নিজের প্রাপ্য নয় জেনেও কোন সম্পত্তির দাবীতে শপথ করে, সে আল্লাহকে রাগান্বিত অবস্থায় দেখতে পাবে। অতঃপর রাসূল (সা) এই আয়াতটি পাঠ করলেন যে, “যারা আল্লাহর নামে ওয়াদা করে ও কসম খেয়ে তার বিনিময়ে ক্ষুদ্র স্বার্থ লাভ করে …।”

হযরত আবু উমামা (রা) বলেনঃ আমরা রাসূলের (সা) কাছে বসা ছিলাম। রাসূল (সা) বললেনঃ যে ব্যক্তি নিজের শপথ দ্বারা কোন মুসলমানদের সম্পদ কুক্ষিগত করে, সে নিজের জন্য জাহান্নাম অবধারিত ও জান্নাত হারাম করে ফেলে। এক ব্যক্তি বললোঃ হে রাসূল! যদি তা খুব নগণ্য জিনিস হয় তবুও? তিনি বললেনঃ “যদি একটা গাছের ডালও হয় তবুও।”(সহীহ মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)

সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাতে হযরত আবু যর থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ”তিন ব্যক্তির সাথে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।” এ কথাটা তিনি তিনবার বললেন। হযরত আবু যর বললেনঃ “ওরা তো চরম ক্ষতিগ্রস্ত ও হতভাগ্য ব্যক্তি। হে রাসূল! তারা কারা?” রাসূল (সা) বললেনঃ যে ব্যক্তি পায়ের গেড়ালী সমান কাপড় পরে, যে দান বা উপকার করে তার খোটা দেয় এবং যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে তার পণ্য বিক্রী করে। অর্থাৎ শপথ করে মিথ্যামিথ্যি পণ্যের উচ্চতর ক্রয়মূল্য বা বিদেশী পণ্য বলে উল্লেখ করে, যাতে উচ্চ মূল্যে তা বিক্রি করা যায়, অথচ মিথ্যা শপথ করে পণ্যের ক্রটি গেপন করে। সহীহ আল বুখারীতে বর্ণিত অপর হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ কবীরা গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সাথে শরীক করা, পিতামাতাকে অসন্তুষ্ট করা, আত্মহত্যা করা ও মিথ্যা শপথ করা। ইচ্ছাকৃতভাবে যে মিথ্যা শপথ করা হয়, তাকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘ইয়ামীনে গমূস’ তথা নিমজ্জিতকারী শপথ বলা হয়। কারণ এই শপথ মানুষকে পাপে নিমজ্জিত করে। কারো কারো মতে তাকে আগুনে নিমজ্জিত করে বলে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।

আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করাও কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। যেমন নবীর কসম, কাবার কসম, ফেরেশতার কসম, আকাশের কসম, পানির কসম, জীবনের কসম, আমানতের কসম, প্রাণের কসম, মাথার কসম, অমুকের মাজারের কসম, ইত্যাদি।

মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক, সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজ্জাতে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের পিতৃপুরুষদের নামে শপথ করতে নিষেধ করেছেন। শপথ যদি করতেই হয় তবে আল্লাহর নামেই শপথ করবে, নচেত চুপ থাকবে।”

সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “তোমারা দেবদেবীর নামে বা বাপ-দাদার নামে শপথ করোনা।” আমার কথা সত্য নাহলে আমি অমুকের সন্তান নই-” এরূপ বলা বাপ-দাদার নামে শপথের পর্যায়ভুক্ত। আবুদাউদ, ইবনে মাজাহ ও হাকেম বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “যে ব্যক্তি এভাবে শপথ করে যে, আমার কথা সত্য না হলে আমি মুসলমান নই, সে মিথুক হলে যা বলেছে তাই হবে (ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে) আর সে সত্যবাদী হলেও সম্পূর্ণ নিরাপদে ইসলামের পথে বহাল থাকতে পারবেনা।”

সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “কেউ অভ্যাসবশতঃ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে ভুলক্রমে শপথ করলে তৎক্ষণাৎ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলবে।”

.

২৭. যুলুম বা অত্যাচার করা

যুলুম বা অত্যাচার নানাভাবে করা হয়ে থাকে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রচলিত রূপ হলো মানুষের সম্পদ হরণ, জোর পূর্বক অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া, মানুষকে প্রহার করা, গালিগালাজ করা, বিনা উস্কানীতে কারো ওপর আক্রমণ চালানো এবং আর্থিক, দৈহিক ও মর্যাদার ক্ষতিসাধন এবং দুর্বলদের ওপর নৃশংসতা চালানো ইত্যাদি।

পবিত্র কুরআনে সূরা ইবরাহীমে আল্লাহ বলেনঃ “যালেমদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহকে কখনো উদাসীন মনে করোনা। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করেন, যেদিন চক্ষুসমূহ বিস্ফারিত হবে, তারা মাথা নিচু করে উঠিপড়ি করে দৌড়াতে থাকবে, তাদের চোখ তাদের নিজেদের দিকে ফিরবেন, এবং তাদের হৃদয়সমূহ দিশাহারা হয়ে যাবে। মানুষকে আযাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও। সেদিন যুলুমবাজরা বলবেঃ হে আমাদের প্রভু! অল্প কিছুদিন আমাদেরকে সময় দিন, তাহলে আমরা আপনার দাওয়াত কবুল করবো এবং রাসূলদের অনুসরণ করবো। তোমরা কি ইতিপূর্বে কসম খেয়ে খেয়ে বলতেনা যে তোমাদের পতন নেই! যারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছে, তোমরা তো তাদের বাসস্থানেই বাস করে এবং সেই সব যালেমের সাথে আমি কেমন আচরণ করেছি, তা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি।”

সূর আশ শুরাতে আলহ বলেনঃ “শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে থাকে।” সূরা আশ শুরারার শেষ আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ “যুলুমবাজরা তাদের যুলুমের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে।”

রাসূল (সা) বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা যালেমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেননা। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেনঃ তোমার প্রভূর পকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি যুলুম রত জনপদ সমূহকে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।” (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে তিমি)

রাসুল (সা) আরো বলেনঃ”কেউ যদি তার কোন ভাই-এর সম্মান হানি কিংবা কোন জিনিসের ক্ষতি করে থাকে, তবে অজিই তার কাছ থেকে তা বৈধ করে নেয়া উতি (অর্থাৎ ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত) এবং সেই ভয়াবহ দিন আসার আগেই এটা করা উচিত, যেদিন টাকা কড়ি দিয়ে কোন প্রতিকার করা যাবেনা, বরং তার কাছে কোন নেক অমিল থাকলে তার বুলুমের পরিমাণ হিসাবে মযলুমকে উক্ত নেক আমল দিয়ে দেয়া হবে এবং তার কোন অসৎ কাজ না থাকলেও উক্ত মযলুমের অসং কাজ তার ওপর বর্তানো হবে।” (সহীহ আল বুখারী ও জামে তিরমিযী)

একটি হাদীসে কুদসীতে রাসূল (সা) বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : “হে আমার বান্দারা! আমি নিজের ওপর যুলুম হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পরের ওপর যুলুম করোনা।” (সহীহ মুসলিম, জামে ‘তিরমিযী)

অপর এক হাদীসে আছেঃ “রাসূল (সা) সাহাবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তোমরা কি জান, দরিদ্র কে? তাঁরা বললেনঃ আমাদের মধ্যে যার অর্থ নেই, সম্পদ নেই, সেই দরিদ্র। রাসূল (সা) বললেনঃ আমার উম্মতের মধ্যে দরিদ্র ব্যক্তি সেই, যে কিয়ামতের দিন প্রচুর নামায, যাকাত, রোযা ও হজ্জ সংগে করে আনবে, কিন্তু সে এমন অবস্থায় আসবে যে, কাউকে গালি দিয়ে এসেছে, কারো সম্পদ হরণ করে এসেছে, কারো সম্মানের হানি করেছে, কাউকে প্রহার করেছে, এবং কারো রক্তপাত করেছে। অতঃপর এই ব্যক্তির সৎ কার্যগুলো তাদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। এভাবে মযলুমদের ক্ষতি পূরণের আগেই তার সৎকাজগুলো শেষ হয়ে গেলে মযলুমদের গুনাহগুলো একে একে তার ঘাড়ে চাপানো হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (সহী আল বুখারী ও অন্যান্য সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহ) সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত অপর হাদীসে আছেঃ “যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণও অন্যের জমি জবর দখল করবে, কিয়ামতের দিন তার ঘাড়ে সাতটি পৃথবী চাপিয়ে দেয়া হবে।” একটি হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেনঃ আমি সেই ব্যক্তির ওপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হই, যে এমন ব্যক্তির ওপর অত্যাচার করে, যার আমি ছাড়া কোন সাহায্যকারী নেই।”

জনৈক আরব কবি বলেনঃ “ক্ষমতা থাকলেই খুলুম করোনা, যুলুমের পরিণাম অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। যুলুম করার পর তুমি তো সুখে নিদ্রা যাও, কিন্তু মযলুমের চোখে ঘুম আসেন। সে সারা রাত তোমার ওপর বদ দোয়া করে, এবং আল্লাহ তা শোনেন। কেননা তিনিও ঘুমান না।” জনৈক মনীষী বলেছেনঃ “দুর্বলদের ওপর যুলুম করোনা। তাহলে তারা একদিন চরম ক্ষতিকর শক্তিমান গেষ্ঠীতে পরিণত হবে।”

তাওরাতে বর্ণিত আছে যে, “পুলসিরাতের পাশ থেকে একজন ঘোষক কিয়ামতের দিন এই বলে ঘোষণা দিতে থাকবে “ওরে বলদর্পী, নিষ্ঠুর যালেমগণ! আল্লাহ নিজের মর্যাদা ও প্রতাপের শপথ করে বলেছেন যে, আজকের দিন কোন অত্যাচারী ব্যক্তি এই পুল পার হয়ে জান্নাতে যেতে পারবে না।”

হযরত জাবের (রা) বর্ণনা করেন যে, “মক্কা বিজয়ের বছর যখন আৰিসিনয়ায় হিজরতকারী মুহাজিরগণ রাসূলের (স) নিকট প্রত্যাবর্তন করলো, তখন রাসূল (সা) বললেনঃ তোমরা কি আমাকে আবিসিনিয়ায় থাকাকালীন কোন বিশ্বয়কর অভিজ্ঞতার কথা জানাবে? তখন মুহাজিরদের মধ্য হতে কতিপয় যুবক বললোঃ জ্বী, হে রাসূল! একদিন আমরা সেখানে বসা ছিলাম দেখলাম, আমাদের পাশ, দিয়ে এক বৃদ্ধা মাথায় এক কলসী পানি নিয়ে চলে যাচ্ছে। সহসা এক যুবক এসে তার ঘাড়ে হাত দিয়ে জোরে ঠেলা দিল। এতে বৃদ্ধা পড়ে গেল এবং তার পানির কলসীও পড়ে ভেংগে গেল। বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে সেই যুবকটির দিকে তাকিয়ে বললো ওহে বিশ্বাসঘাতক! আল্লাহ যেদিন আরশ স্থাপন করবেন, যেদিন আগের ও পরের সকল মানুষকে সমবেত করবেন, এবং যেদিন মানুষের হাত ও পা তদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে, সেই দিন তুই দেখে নিস, আল্লাহর সামনে তোর কি পরিণতি হয় এবং আমার কি অবস্থা হয়।” এ কথা শুনে রাসূল (সা) বললেনঃ বৃদ্ধা ঠিকই বলেছে। যে জাতি তার দুর্বলদের কল্যাণার্থে সবলদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেনা, সে জাতিকে আল্লাহ কিভাবে সম্মানিত করবেন?” (ইবন মাজাহ, ইবনে হাববান, বায়হাকী)

রাসূল (সা) বলেন, “পাঁচ ব্যক্তির ওপর আল্লাহর ক্রোধ অবশ্যম্ভাবী। তিনি ইচ্ছা করলে দুনিয়াতেই তাদের ওপর তা কার্যকর করবেন, নচেত আখেরাতে কার্যকর করবেন। (১) কোন জাতির শাসক, যে তার প্রজাদের কাছে থেকে রাষ্ট্রের প্রাপ্য আদায় করে নেয়, কিন্তু তাদের ওপর সুবিচার ও ইনসাফ করে না এবং তাদেরকে যুলুম থেকে রক্ষা করেনা। (২) এমন দলনেতা, গেত্রপতি ও জাতীয় নেতা, যাকে সবাই আনুগত্য করে ও যার নির্দেশ সবাই মেনে চলে, অথচ সে সবল ও দুর্বলের সাথে সমান আচরণ করে না এবং নিজের খেয়ালখুশীমত কথা বলে। (৩) যে ব্যক্তি নিজের পরিবার পরিজনকে ও সন্তান-সন্ততিকে আল্লাহর আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়না এবং তাদেরকে ইসলামের বিধান শিক্ষা দেয়না। (৪) যে ব্যক্তি নিজের নিযুক্ত কর্মচারীর নিকট থেকে আপন প্রাপ্য কাজ পুরোপুরি আদায় করে নিয়েও তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক পুরোপুরিভাবে বুঝিয়ে দেয়না। (৫) যে ব্যক্তি স্বীয় স্ত্রীকে মোহরানা থেকে বঞ্চিত করে ও তার ওপর অত্যাচার চালায়।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম বলেনঃ”আল্লাহ যখন সর্বপ্রথম তার সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন, তখন তারা আল্লাহ তায়ালাকে জিজ্ঞাসা করে বলে যে, হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি কার সাথে থাকেন? আল্লাহ, জবাব দিলেনঃ মযলুমের সাথে, যতক্ষণ তার প্রাপ্য তাকে ফিরিয়ে দেয়া না হয়।”

হযরত ওহাব বিন মুনাবিহ বলেনঃ “একজন পরাক্রমশালী রাজা একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। একদিন এক বৃদ্ধা ভিখারিনী এসে সেই প্রাসাদের পাশে একটা ঝুপড়ি বানিয়ে বাস করতে লাগলো। পরে একদিন রাজা প্রাসাদের ছাদে উঠে চারপাশ ঘুরে দেখার সময় ঐ ঝুপড়িটি দেখে জিজ্ঞাসা করলেনঃ ঝুপড়িটা কার? লোকেরা বললোঃ এক দরিদ্র বৃদ্ধার। সে ওখানে বাস করে। রাজা তৎক্ষণাত ঝুপড়িটি ভেংগে ফেলার নির্দেশ দিলেন। বৃদ্ধা তখন বাইরে ভিক্ষা করতে গিয়েছিল। একটু পরে এসে দেখলো, তার ঝুপড়িটা বিধ্বস্ত। সে আশপাশের লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলো আমার ঝুপড়ি কে ভেংগেছে। লোকেরা তাকে জানালো যে, রাজা ভেংগেছে। বৃন্ধা আকাশের দিকে মাথা তুলে বললোঃ হে আল্লাহ! আমি যখন আমার ঝুপড়িতে ছিলাম না, তখন তুমি কোথায় ছিলে? তুমি কি ওটা রক্ষা করতে পারনি? এরপর আল্লাহ জিবরীলকে ঐ প্রাসাদটি ধ্বংস করার নির্দেশ দিলেন এবং তা সংগে সংগে ধ্বংস করা হলো।

কথিত আছে, ক্ষমতা থেকে পতনের পর রাজা খালেদ বিন বারমকি ও তার ছেলে কারাবন্দী হলে তার ছেলে বললোঃ “আব্বা, এত সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকার পর এখন আমরা কারাগারে? খালেদ বললেনঃ হ্যা, বাবা। প্রজাদের ওপর যুলুম চালিয়ে আমরা যে রজনীতে তৃপ্তির সাথে নিদ্রা গিয়েছিলাম, আল্লাহ তখন জাগ্রত ছিলেন এবং মযলুমদের দোয়া কবুল করেছিলেন।” এযীদ বিন হাকীম বলতেন, “এক ব্যক্তির ওপর আমি যুলুম করেছিলাম। আমি জানতাম যে, আল্লাহ ছাড়া তার আর কোন সাহায্যকারী দুনিয়ায় নেই। কিন্তু সে যখন বললো, “আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, আমার ও তোমার মধ্যে ফায়সালা আল্লাহই করবেন, তখন আমি তাকে এত ভয় পেলাম যে, জীবনে আর কখনো কাউকে এত ভয় পাইনি।”

একবার খলিফা হারুনুর রশীদ কবি আবুল আতাহিয়াকে কারাগারে আটক করেন। কবি সেখান থেকে তাকে যে চিঠি লেখেন, তাতে এই লাইনটি ছিলঃ “আল্লাহর কসম, জেনে রেখ, অত্যাচার স্বয়ং অত্যাচারীর জন্যই ভয়ংকর অমংগল ডেকে আনে। অত্যাচারী সব সময়ই অসৎ। ওহে যালেম, কিয়ামতের দিন যখন আমরা একত্রিত হব, তখন কে প্রকৃত নিন্দিত তা তুমি জানতে পারবে।”

তাবরানী শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে যে, “অত্যাচারী যখন কেয়ামতের দিন পুলসিরাতের ওপর আসবে, অমনি যার যার ওপর সে অত্যাচার করেছে, অর্থাৎ যার যার হক নষ্ট ও ক্ষতি সাধন করেছে, তারা সবাই আসবে এবং ক্ষতিপূরণ হিসাবে তার কৃত সৎকর্মগুলো ছিনিয়ে নেবে। সব কয়টি সৎকর্ম কেড়ে নেয়ার পর মযলুমদের রাশি রাশি পাপ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হবে। ফলে অত্যাচারী জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে নিক্ষিপ্ত হবে।”

মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহর বান্দারা খালি পায়ে নগ্ন দেহে ময়দানে সমবেত হবে। এ সময়ে গুরুগম্ভীর স্বরে একটি আওয়ায ধ্বনিত হবে, যা দূরের ও নিকটের সবাই শুনতে পাবে। বলা হবেঃ “আমি সকলের অভাব পূরণকারী রাজাধিরাজ, কোন জান্নাতবাসীর পক্ষে জান্নাতে যাওয়া এবং জাহান্নামবাসীর পক্ষে জাহান্নামে যাওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত তার কৃত যুলুমের আমি প্রতিশোধ না নেই, এমনকি তা যদি একটি চড় থাপ্পড় বা লাথির পর্যায়েও হয়ে থাকে। তোমার প্রভু কারো উপর যুলুম করেন না।” আমরা বললামঃ হে রাসূল! সেটা কিভাবে সম্ভব হবে। আমরা তা সবাই খালি পায়ে ও নগ্ন দেহে থাকবো। রাসূল (স) বললেনঃ প্রত্যেকের কৃত সৎকর্ম ও অসৎকর্মের আদান-প্রদান দ্বারাই প্রতিশোধ নেয়া হবে। তোমাদের প্রতিপালক যালেম নন। অপর এক হাদীসে রাসূল (স) বলেনঃ “একটি বেতের আঘাতের জন্যও কিয়ামতের দিন প্রতিশোধ নেয়া হবে।”

কথিত আছে যে, “পারস্যের এক সম্রাট নিজের ছেলের জন্য একজন শিক্ষক রেখেছিলেন। ছেলেটি যখন যথেষ্ট বড় হয়ে উঠেছে, তখন একদিন ঐ শিক্ষক তাকে ডাকলেন এবং বিনা কারণে ও বিনা অপরাধে তাকে কঠোর শারীরিক শান্তি দিলেন। ছেলেটি তার শিক্ষকের ওপর রাগান্বিত এবং মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে রইল। অল্প দিন পরই রাজা মারা গেল এবং ঐ ছেলেটি সিংহাসনে আরোহণ করলো। তখন সে উক্ত শিক্ষককে দরবারে তলব করে জানতে চাইল যে, আপনি অমুক দিন আমাকে বিনা কারণে শান্তি দিয়েছিলেন কেন? শিক্ষক বললেনঃ ওহে সম্রাট, শুনুন, আমি যখন দেখলাম, আপনি বড় হয়েছেন এবং অচিরেই সিংহাসনে আরোহণ করতে যাচ্ছেন, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, বিনা কারণে প্রহার ও যুলম করলে কেমন কষ্ট লাগে, তার স্বাদ আপনাকে গ্রহণ করাবো, যাতে আপনি কারো ওপর যুলুম না করেন। একথা শুনে সম্রাট ধন্যবাদ দিয়ে বললেনঃ আল্লাহ আপনাকে এর উত্তম প্রতিদান দিন। অতঃপর স্বীয় প্রাক্তন শিক্ষককে প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে বিদায় করলেন।”

এতীমের ওপর যুলুম এবং প্রজার ওপর শাসকের যুলুম ইতিপূর্বে পৃথকভাবে আলোচিত হয়েছে। এখানে সকল স্তরে দুর্বলের ওপর সবলের যুলুমের বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে। অর্থাৎ যে কোন বান্দার হক বা অধিকার নষ্ট করাই যুলুম। এ প্রসংগে উল্লেখ্য যে, ধনী বা সক্ষম লোক কর্তৃক দরিদ্র পাওনাদারের প্রাপ্য মজুরী বা অন্য কোন জিনিস দিতে অহেতুক বিলম্ব করা ও তালবাহানা করাও যুলুমের শামিল। এজন্য হাদীসে মজুরের মজুরী তার গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই দিতে বলা হয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “ধনীর তালহাবানাও যুলুমের অন্তর্ভুক্ত।”

মুসনাদে আহমাদ ও তিরমিযীতে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “মযলুমের দোয়া মেঘের ওপরে উঠে যায় এবং আল্লাহ তখন বলেন আমার মর্যাদা ও প্রতাপের শপথ, আমি তোমাকে সাহায্য করবোই, চাই তা কিছু পরেই হোক। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর প্রাপ্য মোহরানা ও খোরপোশ না দেয়াও যুলুমের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল (সা) বলেনঃ “দুর্বলের সাথে সবলের বক্র আচরণ – যা দ্বারা সে তার সহায়-সম্পদ ও মর্যাদার ক্ষতি সাধন করে ও কষ্ট দেয়া – যুলুমের অন্তর্গত।”

হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে যে, “কিয়ামতের দিন পালাক্রমে প্রত্যেক নারীপুরুষকে হাত ধরে কিয়ামতের ময়দানে সমবেত সমগ্র মানব-মন্ডলীর সামনে উপস্থিত করা হবে এবং বলা হবে, এই যে অমুকের ছেলে বা মেয়ে অমুক। এর কাছে যদি কারো কিছু পাওনা থাকে তবে সে যেন এসে তার কাছ থেকে আদায় করে নেয়। এ সময় অধিকার বঞ্চিত স্ত্রীরা খুশী হবে এবং তাদের অধিকার হরণকারী পিতা, ভাই বা স্বামীর কাছ থেকে অধিকার আদায় করে নেবে। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন। সেদিন কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য হবেনা এবং কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করবেনা।” সেদিন আল্লাহ নিজের পাওনা সম্পর্কে যাকে ইচ্ছা মাফ করবেন, কিন্তু মানুষের হক তিনি মাফ করবেন না। অতঃপর যে নারী বা পুরুষকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলে, তাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখা হবে এবং দাবীদারদেরকে বলা হবেঃ “তোমাদের হক নিতে এগিয়ে এসো।” আল্লাহ তায়ালা ফিরিশতাদেরকে বলবেন, “প্রত্যেক পাওনাদারকে তার নেক আমল থেকে পাওনা অনুপাতে দিয়ে দাও। এভাবে সকল পাওনাদারকে দেয়ার পর যদি সামান্য কিছু নেক আমল অবশিষ্ট থাকে এবং সে যদি সামগ্রিক কৃতকর্মের বিচারে আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তি হয়, তবে তার অবশিষ্ট আমলকে এমনভাবে বাড়িয়ে দেয়া হবে যাতে সে জান্নাতে যেতে পারে। অতঃপর তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। কিন্তু সে যদি সামগ্রিকভাবে অসৎ ব্যক্তি হয়, এবং তার আর কোন নেক আমল অবশিষ্ট না থাকে, তবে ফিরিশতারা বলবেঃ হে আল্লাহ, ওর সব নেক আমল ফুরিয়ে গেছে, অথচ এখনো ঢের হকদার রয়েছে। তখন আল্লাহ বলবেন, হকদারদের গুনাহ ওর ওপর চাপিয়ে দাও এবং দোজখে প্রবেশ করাও।”

কোন অমুসলিমের ওপর যুলুম করলেও দুনিয়া ও আখেরাতে তার একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। কোন মুসলিমকে তার প্রাপ্য না দেয়া, কম দেয়া, ঠকানো, ধোকা দেয়া, তার ওপর তার ক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ চাপানো, স্বেচ্ছায় ও সানন্দে না দেয়া পর্যন্ত তার কোন জিনিস গ্রহণ করা যেমন যুলুম, কোন অমুসলিমের ক্ষেত্রেও এই সব কাজ সমান যুলুম। রাসূল (সা) বলেছেন, “কোন অমুসলিমের অধিকার যে হরণ করবে তথা তার জানমালের কোন ক্ষতি সাধন করবে, কিয়ামতের দিন আমি স্বয়ং আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে বিচার চাইবো।”

তাবরানী বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে বিবাদ বিচারের জন্য উঠবে তা হবে এক স্বামী ও তার স্ত্রী সংক্রান্ত। স্ত্রী কথা বলবেনা তবে তার হাত ও পা সাক্ষ্য দেবে তার স্বামীর প্রতি সে যে আচরণ করতো সে সম্পর্কে এবং স্বামীর হাত ও পা সাক্ষ্য দেবে স্ত্রীর প্রতি সে ভালো বা মন্দ যে আচরণ করতে সে সম্পর্কে। এরপর মামলা উঠবে মনিব ও চাকর চাকরানীদের সম্পর্কে। সেখানে কোন অর্থকড়ি দিয়ে বিবাদ মেটানো হবেনা। কেবল মযলুমকে যালেমের নেক আমল দিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর সকল প্রতাপশালী যালেম শাসককে লোহার শিকলে বেঁধে হাজির করা হবে এবং তাদেরকে জাহান্নামে পাঠানো হবে।”

কথিত আছে যে, বিশিষ্ট তাবেয়ী তাউস ইয়ামানী উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আবদুল মালিককে একবার উপদেশ দিলেন যে, “আপনি আযানের দিন সম্পর্কে সতর্ক হোন।” হিশাম বললেন, “কোন্ আযানের দিন” তাউস বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : “সেদিন একজন এই বলে আযান দেবে (অর্থাৎ ঘোষণা করবে) যালেমদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত!” এ কথা শুনেই হিশাম মুর্ছা গেলেন। তাউস বললেন, কিয়ামতের দিন যা ঘটবে তার বিবরণ শুনে যদি এই অবস্থা হয় তবে তা যখন বাস্তবে ঘটবে তখন তা স্বচোক্ষে দেখলে কী অবস্থা হবে?

যুলুমের পাশাপাশি যুলুমের সহযোগিতা ও যালেমদের সাথে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করাকেও ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। সূরা হুদে আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা যালেমদের সহযোগী হয়োনা, তাহলে তোমাদেরকে আগুন স্পর্শ করবে।” হযরত ইবনে আববাস এর তাফসীর প্রসংগে বলেনঃ অর্থাৎ তাদের সাথে পূর্ণ আন্তরিক ভালোবাসা পোষণ করোনা, নম্র ও বিনয়পূর্ণ ভাষায় তাদের সাথে কথা বলোনা এবং বন্ধুত্ব রেখনা। সুদ্দী বলেনঃ এর অর্থ যালেমদের সাথে আপোষকামী হয়োনা। ইকরাম বলেনঃ অর্থাৎ তাদের অনুগত হয়োনা। আবুল আলিয়া বলেনঃ অর্থাৎ যালেমদের কার্যকলাপকে খুশীমনে মেনে নিওনা। সূরা সাফফাতে আল্লাহ বলেনঃ”যারা যুলম করে তাদেরকে এবং তাদের সাংগপাংগদেরকে সমবেত করো।” অর্থাৎ তাদের সহযোগী ও অনুসারীদেরও একই পরিণামে ভুগতে হবে।

এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ”যে ব্যক্তি কোন যালেমকে যালেম জেনেও তার পক্ষ নেবে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে।” অপর এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ”এমন অনেক শাসকের আবির্ভাব ঘটবে, যাদের বহু অনুসারী থাকবে এবং সেই অনুসারীরাও মানুষের ওপর যুলুম ও মিথ্যাচার চালাবে। সে ব্যক্তি তাদের সাথে ওঠাবসা করবে, তাদের মিথ্যাচারকে সমর্থন দেবে এবং তাদের যুলুমের সহযোগিতা করবে আমি তার কেউ নই এবং সে আমার কেউ নয়। আর যে ব্যক্তি তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে এবং তাদের যুলুমের সহযোগিতা করবেনা, সে আমার আপনজন এবং আমিও আর আপনজন।” রাসূল (সা) বলেছেন : “যে ব্যক্তি কোন যালেমকে সাহায্য করবে তার উপর কোন না কোন যালেমকে চাপিয়ে দেয়া হবে।” হযরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়ার (র) বলেনঃ “যালেম শাসক ও ভার সাংগপাংগদের দিকে যখন তাকাবে, তখন অন্তরের ক্ষোভ ও অসন্তোষ সহকারে তাকাবে। নচেত তোমাদের কৃত নেক আমল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।” মাকহুল দামেস্কী বলেনঃ কিয়ামাতের দিন যখন যালেম ও যালেমের সাংগপাংগদের ডাকা হবে, তখন যালেমের কলমে যে কালি ভরে দিত, কিংবা কলম গুছিয়ে দিত বা এরূপ ছোটখাট কাজ বা এর চেয়ে বড় কাজ করে যে সাহায্য করতো সেও বাদ যাবেনা। সকল সহযোগীকে আগুনের একটি বাক্স ভরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

রাসূল (সা) এক হাদীসে বলেছেনঃ “যারা যালেম শাসকদের পক্ষে অস্ত্র নিয়ে ঘুরতো এবং তাদের মনতুষ্টির জন্য মানুষকে অকারণে প্রহার করতো, তারাই হবে সর্বপ্রথম জাহান্নামে প্রবেশকারী।” হযরত ইবনে উমার (রা) বলেনঃ”যালেমদের সাংগপাংগরা হবে জাহান্নামের কুকুর।”

রাসূল (সা) অপর এক হাদীসে বলেছেনঃ “যে স্থানে কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন বা হত্যা করা হয়, তোমরা কেউ সেই স্থানে থেকনা। কেননা যারা ঐ জায়গায় অবস্থান করে এবং যুলুম প্রতিহত করেনা, তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত নাযিল হয়ে থাকে।” (তাবরানী) অপর এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “এক ব্যক্তি কবরে যাওয়ার পর ফিরিশতারা তাকে বলবেঃ আমরা তোমাকে একশো ঘা বেত মারবো। লোকটি অনেক অনুনয় বিনয় করে অব্যাহত চাইবে। ফলে তাকে মাত্র একটি ঘা বেত মারা হবে। এরপর কবর আগুনে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। তখন লোকটি জিজ্ঞাসা করবে, তোমরা কী কারণে আমাকে মেরেছ? তারা বলবেঃ কেননা তুমি পবিত্রতা অর্জন ছাড়াই এক ওয়াক্ত নামায পড়েছিলে এবং তোমার পথের পাশে এক ব্যক্তির ওপর যুলুম হচ্ছিল, কিন্তু তুমি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে সাহায্য করোনি।” চিন্তার ব্যাপার এই যে, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি মযলুমকে সাহায্য করেনা তার যদি এই পরিণতি হয়, তাহলে যে ব্যক্তি স্বয়ং যুলুম করে তার কি দশা হবে।

সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ তোমার ভাই যালেম হলেও তাকে সাহায্য করো, মযলুম হলেও তাকে সাহায্য করো। সাহাবীগণ বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে যদি মযলুম হয় তবে তাকে সাহায্য করতে হবে, এ কথা তো বুঝলাম, কিন্তু যালেম হলে কিভাবে সাহায্য করবো? রাসূল (সা) বললেনঃ তাকে যুলুম থেকে ফিরাও। এটাই তাকে সাহায্য করা। কথিত আছে, জনৈক দরবেশ একদিন যুলুমবাজ সরকারী আমলাদের একজন সহযোগীকে তার মৃত্যুর কিছুকাল পর অত্যন্ত দুর্দাশাগ্রস্ত অবস্থায় স্বপ্নে দেখলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ মৃত্যুর পর তুমি কেমন আছ? সে বললোঃ দুর্বিসহ অবস্থায় আছি। আল্লাহর আযাব ভোগ করছি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমার মনিবরা অর্থাৎ যুলুমবাজ সরকারী কর্মচারীরা কোথায় আছে। সে বললোঃ তারা আছে আমার চেয়েও ভয়ংকর অবস্থায়। তারপর সে বললোঃ আপনি কি এ আয়াত পড়েননি: “যালেমরা অচিরেই জানতে পারবে তাদের কী পরিণতি হয়।”

জনৈক ঐতিহাসিক এ প্রসংগে আরো একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, একবার আমি এক ব্যক্তিকে দেখলাম তার এক হাত ঘাড় থেকে কর্তিত। সে উচ্চস্বরে বলছেঃ যারা আমাকে দেখবে তারা যেন কারো ওপর অত্যাচার না করে। আমি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলামঃ তোমার কি হয়েছে ভাই। সে বললোঃ একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে। আমি একজন অত্যাচারী ব্যক্তির বরকন্দাজ ছিলাম। একদিন দেখলাম, এক জেলে বড় একটা মাছ নিয়ে যাচ্ছে। মাছটি দেখে আমার ভীষণ লোভ হলো এবং জেলেকে প্রহার করে তার মাছটি কেড়ে নিলাম। মাছটি নিয়ে সানন্দে বড়ী যাচ্ছি। সহসা মাছটি আমার বুড়ো আংগুলে ভীষণ জোরে কামড় দিল। অতঃপর বাড়ী গিয়ে মাছটি আছড়ে ফেলে দিলাম। ব্যথায় সেদিন রাত্রে আমার ঘুম হলোনা। পরদিন সকালে দেখি আংগুলটা ভীষণভাবে ফুলে উঠেছে। আমি দ্রুত চিকিৎসকের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে জানালেন, বুড়ো আংগুলটা কেটে ফেলতে হবে। নচেৎ পরে পুরো হাত আক্রান্ত হবে। অগত্যা বুড়ো আংগুল কাটা হলো। কিন্তু এতেও ব্যথার উপশম হলো না। পুনরায় চিকিৎসকের কাছে গেলাম। এবার তিনি আমার হাতের পাতাটি পুরো কেটে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। কিন্তু তাতেও উপশম হলোনা। ক্রমে আমার পুরো হাতটাই কাটতে হলো। অতঃপর এক ব্যক্তি আমার সব ঘটনা শুনে আমাকে মাছের মালিকের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে বললেন, নচেৎ আমার পুরো দেহই রোগক্রান্ত হতে পারে বলে সতর্ক করে দিলেন। আমি অনেক খোঁজাখুঁজি করে জেলেটির সন্ধান পেয়েছি এবং তার কাছে পূর্বের সমস্ত ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পা ধরে মাফ চেয়েছি। এখন আমার বাদবাকী শরীর সুস্থ আছে। কেননা ঐ জেলে আমাকে মাফ করে দিয়েছে এবং আমাকে যে বদদোয়া করেছিল তা ফিরিয়ে নিয়েছে।

বস্তুতঃ মানুষের ওপর অত্যাচার এমন এক ভয়ংকর গুনাহ, যার শাস্তি কোন না কোন উপায়ে দুনিয়ার জীবনেই পাওয়া শুরু হয়ে যায়। যদিও অনেকেই তা উপলব্ধি করেনা। আর এ থেকে বাঁচার কার্যকর উপায় হলো পরোপকার ও জনসেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করা। লোভ, হিংসা ও ক্রোধ থেকে আত্ম সংবরণ করা এবং হালালভাবে প্রাপ্ত নিজের যা কিছু আছে, তাতে সন্তুষ্ট থাকা। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি অদৃষ্টের ওপর সন্তুষ্ট থাকে এবং অন্যের কাছে যা আছে তার থেকে নিরাশ হয় সে-ই প্রকৃত ঈমানের স্বাদ পায়।”

.

২৮. জোর পূর্বক চাঁদা আদায় করা

এটিও এক ধরনের জুলুম। পবিত্র কুরআনের নিম্নের আয়াতটিতে যে জুলুমের কথা বলা হয়েছে, এটিও তার অন্তর্ভুক্তঃ

“যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং পৃথিবীতে অবৈধভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়, কেবল তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।” (আশশূরা)

যারা জোর পূর্বক চাঁদা আদায় করে তারা নিজেরাও জুলুমবাজ এবং তারা জুলুমবাজদের সবচেয়ে বড় সাহায্যকারীও। চাদাবাজরা যে চাঁদা আদায় করে, তা যেমন তাদের প্রাপ্য নয়, তেমনি যে পথে তা ব্যয় করে তাও বৈধ পথ নয়। এ জন্য রাসূল (সা) বলেছেন : “অবৈধ চাঁদা আদায়কারী জান্নাতে যাবেনা।” (আবু দাউদ) এর কারণ এই যে, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়কারী আল্লাহর বান্দাদের ওপর জুলুম ও শোষণ চালায়। তাদের কষ্টোপার্জিত অর্থ কেড়ে নেয়। এ ধরনের লোকেরা কেয়ামতের দিন মজলুমদের প্রাপ্য দিতে পারবেনা। যদি তাদের কবুল কৃত কোন সৎকর্ম থাকে, তবে তাই দিতে হবে। নচেত মজলুমদের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামে যেতে হবে। এ সংক্রান্ত হাদীস ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত দরিদ্র হলো সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন প্রচুর নামায, রোযা, হজ ও যাকাত নিয়ে আসবে। কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়ে আসবে, প্রহার করে আসবে অথবা কারো সম্পদ আত্মসাত কত্রে আসবে। অতঃপর এই সকল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকে একে একে তার পুণ্যকর্ম দিয়ে দেয়া হবে। যখন পুণ্যকর্ম ফুরিয়ে যাবে, তখন মজলুমদের পাপ কাজ তার ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

যে হাদীসে এক ব্যভিচারিনী রমণীকে পাথর মেরে হত্যা করার বিবরণ এসেছে, তাতে রাসূল (সা) বলেনঃ এই মহিলা এমন তওবা করেছে যে, জোরপূর্বক চাঁদা আয়কারী যদি তেমন তওবা করতো, তবে তার গুনাহ মাফ হয়ে যেত। এ থেকে বুঝা যায় এটি কত বড় মারাত্মক গুনাহর কাজ। বস্তুতঃ জোরপূর্বক অর্থ আদায় করার কাজটি ডাকাতি রাহাজানি সদৃশ। জোরপূর্বক চাঁদা যে আদায় করে, যে তার সহযোগিতা করে, যে লেখে, যে সাক্ষী থাকে, তারা সবাই এই পাপের সমান অংশীদার। তারা সবাই হারামখোর। রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যে গেশতের টুকরাটি হারাম সম্পদ থেকে উৎপন্ন হয়, তা জাহান্নামের উপযুক্ত।” ইমাম ওয়াহেদী (রহ) “হে নবী তুমি বল, পবিত্র ও অপবিত্র জিনিস সমান হয়না”এই আয়াতের তাফসীর প্রসংগে অপবিত্র জিনিসের মধ্যে জোরপূর্বক আদায়কৃত জিনিসকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ কারো সম্পদ সে স্বেচ্ছায় না দিলে হালাল হয়না।

একবার হযরত জাবের (রা) রাসূল (সা) কে এসে বললেনঃ হে রাসূল, আমার মদের ব্যবসায় ছিল। সেই ব্যবসায় থেকে আমার বেশ কিছু সঞ্চিত নগদ অর্থ রয়েছে। আমি যদি তা দিয়ে আল্লাহর কোন ইবাদত বা পুণ্যের কাজ করি, তবে তাতে কি আমার উপকার হবে? রাসূল (সা) বললেনঃ তুমি যদি সেই অর্থ হজ্জ, জিহাদ, অথবা সদকায় ব্যবহার কর, তবে তা আম্লাহর কাছে একটা মাছির ডানার সমান মর্যাদা পাবেনা। আল্লাহ পবিত্র সম্পদ ব্যতীত কোন কিছু গ্রহণ করেন না। তখন আল্লাহ এই বক্তব্যের সমর্থনে নাযিল করলেনঃ “হে নবী! তুমি বল, পবিত্র ও অপবিত্র জিনিস সমান নয়, যদিও অপবিত্র জিনিসের আধিক্য তোমাকে মুগ্ধ করে।” ইমাম আতা ও হাসান বসরী বলেন, পবিত্র ও অপবিত্র দ্বারা যথাক্রমে হালাল ও হারামকে বুঝানো হয়েছে।

উপদেশঃ বল প্রয়োগে মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে যারা গণরোষ থেকে বাঁচার জন্য সুরক্ষিত দুর্গসম উচ্চ প্রাসাদ তৈরী করে বসবাস করেছে, যারা মনোরম ফুলের বাগান নির্মাণ করে পরম আয়েশী জীবন যাপন করেছে, পৃথিবীতে উচ্চ সম্মান ও ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছে— ভেবে দেখুন, তারা আজ কোথায়? পৃথিবীতে চিরস্থায়ী হবার সকল চেষ্টা এবং সকল স্বপ্ন তাদের ধূলিসাত হয়ে গেছে। তারা আজ তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল ভোগ করতে শুরু করেছে। সেই পরিণামের কথা চিন্তা করে জুলুম নির্যাতন ও পরস্ব অপহরণের পথ চিরতরে বর্জন করে যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সেই প্রকৃত বৃদ্ধিমান। যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে চায়, তার জীবনের যে কয়টি দিন অবশিষ্ট আসে, তাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করা উচিত।

.

২৯. হারাম খাওয়া ও যে কোন হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন ও ভোগ দখল করা

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেনঃ”তোমরা একে অপরের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগদখল করোনা।” হযরত ইবনে আব্বাস বলেনঃ এর অর্থ হচ্ছে, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন শপথ দ্বারা অন্যের সম্পত্তির ওপর নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করা। অবৈধভাবে তথা হারাম পন্থায় উপার্জন দুই রকমের হতে পারে। প্রথমতঃ সম্পূর্ণরূপে শক্তি প্রয়োগে ও অত্যাচারের মাধ্যমে, যেমন আত্মসাত, অপহরণ, জবরদখল, গচ্ছিত সম্পদ বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ভোগদখল চুরি ডাকাতি ইত্যাদি। দ্বিতীয়তঃ খেলাধুলা, চালাকী, প্রতারণা ইত্যাদি। লটারী ও জুয়ার মাধ্যমে অর্থ জেতাও এর আওতাভুক্ত। সহীহ বুখারীতে আছে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “কিছুলোক এমন আছে যারা আল্লাহর বান্দাদের সম্পদে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে। কিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্দিষ্ট রয়েছে।” সহীহ মুসলিমে আছে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধুলিধুসরিত দেহ নিয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে “হে প্রভু” “হে প্রভু” বলে মুনাজাত করে, অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারাই সে পুষ্টি অর্জন করে। তার মুনাজাত কিভাবে কবুল হবে?” হযরত আনাস (রা) বলেনঃ আমি বললাম, হে রাসূল, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন আমার দোয়া কবুল হয়। রাসূল (সা) বললেনঃ হে আনাস, তোমার উপার্জনকে হালাল রাখ, তোমার দোয়া কবুল হবে। মনে রেখ, কেউ যদি হারাম খাদ্যের এক প্রাসও মুখে নেয়, তাহলে চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার দোয়া কবুল হবেনা।” বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেন আল্লাহ তায়ালা যেমন তোমাদের মধ্যে তোমাদের জীবিকা বন্টন করেছেন, তোমাদের মধ্যে তোমাদের স্বভাব চরিত্রত্ত বন্টন করেছেন। দুনিয়ার সম্পদ তিনি যাকে ভালোবাসেন তাকেও দেন, যাকে ভালোবাসেন না তাকেও দেন। কিন্তু দীন তথা আখিরাতের সম্পদ কেবল তাকেই দেন, যাকে তিনি ভালোবাসেন। আল্লাহ যাকে দীন দান করেছেন, বুঝতে হবে যে, তিনি তাকে ভালোবেসেছেন। কোন বান্দা হারাম সম্পদ উপার্জন করে তা নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করলে তাতে সে বরকত ও কল্যাণ লাভ করবেনা। অন্যকে দান করলে সেই দানও কবুল হবেনা, আর যেটুকু সে দুনিয়ায় রেখে যাবে, তা তার জন্য জাহান্নামের সম্বল হবে। আল্লাহ মন্দকে মন্দ দিয়ে প্রতিহত করেন না, মন্দকে ভালো দিয়ে প্রতিহত করেন।” (মুসনাদে আহমাদ) হযরত ইবনে ওমর (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ পৃথিবী মিষ্ট ও শ্যামল। এখানে যে ব্যক্তি হালাল সম্পদ উপার্জন করবে এবং ন্যায়সংগত পথে তা ব্য করবে, আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ উপার্জন করবে এবং তা অন্যায় পথে ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে অপমানজনক স্থানে নির্বাসিত করবেন। আর হারাম সম্পদ হস্তগতকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন আগুনে জ্বলবে।” রাসূল (সা) আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করবে তার পরোয়া করেনা, আল্লাহ তায়ালা তাকে কোন দরজা দিয়ে জাহান্নামে ঢুকাবেন তার পরোয়া করবেন না। হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেনঃ”কোন মুসলমানের হারাম জিনিস খাওয়ার চেয়ে মাটি খাওয়াও ভালো।” (মুসনাদে আহমাদ) হযরত ইউসুফ বিন আসবাত (রহঃ) বলেনঃ কোন যুবক যখন ইবাদাতে মনোনিবেশ করে, তখন শয়তান নিজের সহকর্মীদেরকে বলেঃ খোঁজ নাও লোকটি কী খায়! সে যদি হারাম খায়, তাহলে সে যত ইচ্ছা ইবাদাত করে ক্লান্ত হোক, বাধা দিওনা। কেননা সে নিজেই নিজের ইবাদাত ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। হারাম খাওয়া অব্যাহত রেখে ইবাদাত তার কোন কাজে লাগবেনা।” এ উক্তিটি ইতিপূর্বে উক্ত সহীহ মুসলিমের হাদীস দ্বারা সমর্থিত। একটি হাদীসে বর্ণিত আছে যে, একজন ফিরিশতা বাইতুল মাকদিসে প্রতি রাতে ও দিনে ঘোষণা দিতে থাকে যে, “যে ব্যক্তি হারাম খায় আল্লাহ তার ফরয ও নফল কিছুই প্রহণ করেন না। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেনঃ”সন্দেহজনক একটি দিরহাম গ্রহণ করার চাইতে আমার কাছে লক্ষ টাকা দান করা অধিকতর পছন্দনীয়।” রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি হারাম অর্থ ব্যয় করে হজে গিয়ে বলে লাব্বায়েক (প্রভু আমি হাজির), তাকে একজন ফিরিশতা বলেঃ তোমার লাব্বায়েক গ্রহণযোগ্য নয়। তোমার হজ্জ তোমার মুখের ওপরই ছুড়ে দেয়া হলো।” (তাবারানী)

মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে যে রাসূল (সা) বলেছেন : “যে ব্যক্তি দশ দিরহাম দিয়ে কোন কাপড় কিনলো এবং তার মধ্যে এক দিরহাম অসৎ উপায়ে অর্জিত, সে যতদিন ঐ কাপড় পরিহিত থাকবে ততদিন তার নামায কবুল হবেনা।” ইমাম ওহাব ইবনুল ওয়ারদ বলেন! তুমি যদি জিহাদের ময়দানে যোদ্ধা অথবা প্রহরী হিসাবে নিয়োজিত থাক, তাতেও কোন ফায়দা হবেনা, যতক্ষণ তুমি যা খাচ্ছ তা হালাল না হারাম, তা লক্ষ্য না রাখ।” হযরত ইবনে আব্বাস বলেনঃ

আল্লাহর কাছে তওবা করে সৎ উপার্জনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহ কোন হারামখোরের নামায কবুল করেন না।” হযরত সুফিয়ান সাওরী বলেনঃ “যে ব্যক্তি হারাম অর্থ দ্বারা কোন সৎ কাজ করে, সে পেশাব দ্বারা কাপড় ধৌতকারীর মত। কাপড় পবিত্র পানি ছাড়া পাক হয় না। আর গুনাহর কাফফারাও হালাল উপার্জন ছাড়া সম্ভব নয়।” হযরত ওমর (রা) বলেন, “আমরা হারামের মধ্যে পতিত হওয়ার ভয়ে হালাল সম্পদের দশ ভাগের নয় ভাগ বর্জন করতাম।” রাসূল (সা) বলেনঃ “যে শরীর হারাম খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, তা জান্নাতে যাবেনা।” (তিরমিযী) সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকরের একজন গেলাম ছিল। সে হযরত আবু বকরকে মুক্তিপণ হিসাবে কিছু অর্থ দেয়ার শর্তে মুক্তি চাইলে তিনি তাতে সম্মত হন। অতঃপর সে প্রতিদিন তার মুক্তিপনের কিছু অংশ নিয়ে আসতো। হযরত আবু বকর তাকে জিজ্ঞেস করতেন, কিভাবে এটা উপার্জন করে এনেছ? সে যদি সন্তোষনক জবাব দিত তবে তিনি তা গ্রহণ ও ভোগ করতেন, নচেত করতেন না। একদিন সে রাতের বেলায় তার জন্য কিছু খাবার জিনিস নিয়ে এল। সেদিন তিনি রোযা ছিলেন। তাই তাকে ঐ খাদ্যের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভুলে গেলেন এবং এক লোকমা খেয়ে নিলেন। তার পর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ খাবার তুমি কিভাবে সংগ্রহ করেছ? সে বললোঃ আমি জাহেলিয়ত আমলে লোকের ভাগ্যগণনা করতাম। আমি ভালো গণনা করতে পারতাম না। কেবল ধোকা দিতাম। এ খাদ্য সেই ভাগ্যগণনার উপার্জিত অর্থ দ্বারা সংগৃহীত। হযরত আবু বকর (রা) বললেনঃ কী সর্বনাশ! তুমি তো আমাকে ধ্বংস করে ফেলার উপক্রম করেছ। তারপর গলার আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বমিতে খাওয়া জিনিস বেরুলোনা। উপস্থিত লোকেরা তাকে বললো যে, পানি না খেলে খাওয়া জিনিস বেরুবেনা। তখন তিনি পানি চাইলেন। পানি খেয়ে খেয়ে সমস্ত ভুক্ত দ্রব্য পেট থেকে বের করে দিলেন। লোকেরা বললোঃ আল্লাহ আপনার ওপর দয়া করুন। ঐ এক লোকমা খাওয়ার কারণেই কি এত সব? হযরত আবু বকর (রা) বললেনঃ ঐ খাদ্য বের করার জন্য যদি আমাকে মৃত্যু বরণ করতে হতো, তবুও আমি বের করে ছাড়তাম। কেননা আমি শুনেছি, রাসূল (স) বলেছেন : “যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে ওঠে তার জন্য দোজখের আগুনই উত্তম।” তাই আমি আশংকা করছিলাম যে, এই এক লোকমা খাদ্য দ্বারা আমার শরীরের কিছু অংশ গঠিত হতে পারে। বিজ্ঞ আলেমগণ বলেছেনঃ জোরপূর্বক অর্থ আদায় করা, খেয়ানত, চুরি, ধোকাবাজী ও জালিয়াতি, সুদ ও সুদের দালালী, মিথ্যা সাক্ষ্য দান, ধার করে নিয়ে পরে আত্মসাত, ঘুষ খাওয়া, মাপে ও ওজনে কমবেশী করা, পণ্যের দোষ গেপন করে বিক্রি করা, জুয়া, যাদু, জ্যোতিষ গণনা, ছবি আঁকা ও তোলা, ব্যভিচার, মৃত ব্যক্তির জন্য পেশাদারী কান্না, বিক্রেতার অনুমতি ছাড়া ক্রেতার কাছ থেকে দালালীর পারিশ্রমিক নেয়া, ক্রেতাকে অর্থের বিনিময়ে পণ্যের সন্ধান দান, স্বাধীন মানুষ বিক্রী, মদ ও শুকর বিক্রী বাবদ অর্জিত সম্পদ ও অপহরণকৃত এতিমের সম্পদ- এই সবই হারাম সম্পদ।

রাসূল (সা) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন কিছু লোক তাহামার পাহাড় সমান সৎ কর্ম নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সংগে সংগেই তাকে ধুলিকণার মত বানিয়ে উড়িয়ে দেবেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ হে রাসূল, এটা কিভাবে সম্ভব হবে? রাসূল (সা) বললেনঃ এই লোকগুলো নামায পড়তো, রোযা রাখতো, যাকাত দিতো ও হজ্জ করতো। কিন্তু যখনই কোন হারামের সংস্পর্শে আসতো, অমনি তাতে লিপ্ত হয়ে পড়তো। তাই আল্লাহ তাদের সকল নেক আমল বাতিল করে দিয়েছেন।” (তাবারানী)

বর্ণিত আছে যে, জনৈক পুণ্যবান ব্যক্তিকে কেউ স্বপ্নে দেখে তার অবস্থা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেনঃ আমি কোন আযাব ভোগ করছিনা। তবে দুনিয়ার জীবনে একটি সূচ ধার নিয়ে তা ফেরত দেইনি বলে আমার জান্নাতে যাওয়া স্থগিত রয়েছে।

উপদেশঃ আখিরাতের কঠিন ও অবধারিত শাস্তির কথা মনে রেখে সব সময় হারাম থেকে পরহেজ করে চলা উচিত।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন