আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেনঃ”মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিসম্পাত।” (আল বাকারা) তিনি আরো বলেনঃ “আল্লাহ তায়ালা মিথুক অপচয়ীকে সুপথ দেখান না।” (মুমিন) সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ সত্যবাদিতা মানুষকে সততার পথে টেনে নিয়ে যায়, আর সততা টেনে নিয়ে যায় জান্নাতের দিকে। কোন ব্যক্তি ক্রমাগত সত্য বলতে থাকলে এবং সত্যের পথ অন্বেষণ করতে থাকলে এক সময় তাকে সিদ্দীক তথা “পরম সত্যনিষ্ট” বলে আল্লাহর কাছে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর মিথ্যা মানুষকে পাপাচারের দিকে এবং পাপাচার জাহান্নামের দিকে টেনে নেয়। আর কোন ব্যক্তি ক্রমাগত মিথ্যা বলা ও মিথ্যার পথ অন্বেষণ করতে থাকলে এক সময় আল্লাহর দরবারে তাকে “মিথুক’ লেখা হয়। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ তিনটি জিনিস মুনাফিকের আলামত – “চাই সে যতই নামায রোযা করুক এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করুক। কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তা খেলাফ করে এবং আমানত রাখলে তার খেয়ানত করে।” সহীহ আল বুখারীতে অপর এক হাদীসে আছে যে, রাসুল (সা) বলেছেনঃ চারটি দোষ যার ভেতরে থাকবে সে খাটি মুনাফিক। আর যার ভেতরে এর একটি থাকবে, সে তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার ভেতরে মুনাফেকীর একটি আলামত থেকে যাবেঃ আমানতের খেয়ানত করা, ওয়াদা খেলাপ করা, মিথ্যা বলা ও ঝগড়ার সময় গালিগালাজ করা। সহীহ আল বুখারীতে যে দীর্ঘ হাদীসে রাসূল (সা) এর স্বপ্নের বৃতান্ত দেয়া হয়েছে, তাতে এক জায়গায় রাসূল (সা) বলেনঃএক শায়িত ব্যক্তির কাছে আমরা উপস্থিত হলাম। দেখলাম, এক ব্যক্তি তার পাশে দাড়িয়ে লোহার একটি অস্ত্র দিয়ে একবার তার ডানপাশের চোয়াল ও চোখ একেবারে পেছন পর্যন্ত ফেড়ে দিচ্ছে। তারপর যখনই বাম দিকে অনুরূপ ফেড়ে দিচ্ছে, তখন ডান দিকটা আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। আবার ডান দিকে পুনরায় চোয়াল ফেড়ে দিলে বাম দিক ভালো হয়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ এই ব্যক্তি কে? আমার সংগী ফিরিশতাদ্বয় বললেনঃ সে বাড়ী থেকে বেরিয়ে একটা মিথ্যে গুজব রটিয়ে ছেড়ে দিতে এবং তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো। আর একটি হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেনঃ মুমিনের স্বভাবে সব রকমের দোষ থাকা সম্ভব, কিন্তু মিথ্যা ও খেয়ানত থাকা সম্ভব নয়। রাসূল (সা) বলেনঃ”তোমরা কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করোনা। কেননা খারাপ ধারণা জঘন্যতম মিথ্যাচার।” (সহীহ আল বুখারী ও মুসলিম) মুসলিম শরীফের হাদীসে আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের দিকে দৃষ্টি দেবেন না এবং তাদেরকে গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন নাঃ ব্যভিচারী বৃদ্ধ, মিথুক শাসক এবং অহংকারী দরিদ্র। মুসনাদে আহমদের হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “মানুষকে হাসানোর জন্য যে মিথ্যা বলে তার সর্বানশ হোক, তার সর্বনাশ হোক, তার সর্বনাশ হোক।” মিথ্যার মধ্যে অধিকতর মারাত্মক হচ্ছে মিথ্যা শপথ। সূরা আল মুনাফিকুনে আল্লাহ তায়ালা এটিকে মুনাফিকদের স্বভাব বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ মুনাফিকরা জেনে শুনেও মিথ্যা শপথ করে। (২৬ নং কবীরা গুনাহ দ্রষ্টব্য) আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও বায়হাকীতে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ তিনজনের সাথে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন কথাও বলবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না, অধিকন্তু তাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত থাকবে। যে ব্যক্তির উদ্বৃত্ত পানি আছে, কিন্তু পথিককে তা ব্যবহার করতে দেয় না, যে ব্যক্তি খরিদ্দারকে মিথ্যা শপথ করে বলে যে, আমি এত দামে কিনেছি, আর খরিদ্দার তা বিশ্বাস করে তা অধিক মূল্যে কিনে নেয়, অথচ আসলে সে সেই দামে তা কেনেনি, এবং যে ব্যক্তি কোন নেতার প্রতি নিছক দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য আনুগত্য করার ওয়াদা করে, অতঃপর নেতা তাকে স্বার্থ দিলে সে তার আনুগত্য করে, নচেত করেনা। রাসূল (সা) আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি তোমাকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করে, তার সাথে মিথ্যা কথা বলা নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতকতা।” রাসূল (সা) আরো বলেনঃ “আল্লাহর সাথে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি হলো কোন ব্যক্তি যা দেখেনি, তাই দেখেছে বলে দাবী করা।” অর্থাৎ সে বলে আমি এরূপ স্বপ্নে দেখেছি, অথচ তা সে দেখেনি।” হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃকোন বান্দা ক্রমাগত মিথ্যা বলতে থাকলে তার হৃদয়ে প্রথমে একটা কালো দাগ পড়ে, অতঃপর সেই দাগ বড় হতে হতে পুরো হৃদয়টা কালো হয়ে যায়। তখন আল্লাহর কাছে তাকে মিথ্যাবাদী লেখা হয়।
সুতরাং সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কল্যাণ নিহিত আছে এমন অবস্থা ছাড়া কোন মুসলমানের কোন অবস্থাতেই মিথ্যা বলা উচিত নয়। তার উচিত হয় সত্য বলা, নচেত চুপ থাকা। রাসুল (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে সে যেন ভালো কথা বলে, নচেত চুপ থাকে।” এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কোন কথার কল্যাণকরিতা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত না হলে সে কথা বলা উচিত নয়। হযরত আবু মূসা (রা) বলেনঃ’আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, হে রাসূল! মুসলমানদের মধ্যে কে উত্তম? রাসূল (সা) বললেন। যার জিহবা ও হাত দ্বারা অন্য মুসলমান কষ্ট পায় না।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী) অপর হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ জেনে শুনে হারাম বাক্য উচ্চারণ করে, সে জাহান্নামে এত নিচে নিক্ষিপ্ত হবে, যা পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত অপেক্ষাও দূরে অবস্থিত। উল্লেখ্য যে, কারো প্রাণ রক্ষা, দুইপক্ষের কলহ প্রশমিত করা এবং দাম্পত্য সম্পর্কে ভাংগন রোধ করার প্রয়োজনে মিথ্যা বলার শুধু অনুমতি আছে তা নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা অবশ্য কর্তব্য। তবে এরূপ ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট মিথ্যা বলার চাইতে দ্ব্যর্থবোধক কথা বলা ভাল। যেমন সূর পর্বতগুহায় যাওয়ার সময় এক ব্যক্তি হযরত আবু বকরকে রাসূল (সা) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো, ইনি কে? আবু বকর বললেনঃ উনি আমার পথ প্রদর্শক। জনৈক মনীষী বলেছেনঃ মানুষের ভেতরে প্রায় আট হাজার চারিত্রিক দোষ রয়েছে। কিন্তু একটি গুণ তার সব দোষ ঢেকে দিতে সক্ষম। সে গুণটি হলো বাকসংযম। আর একটি গুণ তার সব দোষ দূর করতে পারে। তাহচ্ছে সত্যবাদিতা।
.
আল্লাহ তায়ালা সুরা আল মায়েদায় বলেনঃ “আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে যারা বিচার ও শাসন করে না তারা জালেম”… “আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে যারা বিচার ও শাসন করেনা তারা কাফের”… “যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার ও শাসন করে না তারা ফাসেক।” রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে বিচারক বা শাসক আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফায়সালা করে না, আল্লাহ তার নামায কবুল করেন না। (হাকেম) রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ বিচারক তিন প্রকারের তন্মধ্যে দুপ্রকারের বিচারক জাহান্নামে যাবে এবং এক প্রকারের বিচারক জান্নাতে যাবে। যে বিচারক সত্য ও ন্যায় কি, তা জানে এবং তদনুযায়ী বিচার করে সে জান্নাতে যাবে। আর যে বিচারক সত্য ও ন্যায় কি তা জানে না, আর যে বিচারক সত্য ও ন্যায় কি তা জেনেও ন্যায়বিচার করেনা, এরা উভয়ে দোজখবাসী। জিজ্ঞাসা করা হলো যে, যে জানেনা তার কি দোষ? রাসূল (সা) বললেনঃ “সে না জেনে বিচারক হয়েছে এটাই তার দোষ।”(হাকেম, আবু দাউদ, তিরমিযী) হযরত আবু হুরাইয়া (রা) বলেনঃ যাকে বিচারক নিয়োগ করা হলো, তাকে যেন ছুরি ছাড়াই যবাই করা হলো।” হযরত ফযীল বিন ইয়ায বলেনঃ “একজন বিচারপতির উচিত একদিন বিচারকার্য পরিচালনা করা, আর একদিন নিজের জন্য কান্নাকাটি করা।” ইমাম মুহাম্মাদ বিন ওয়ালে (রহ) বলেনঃ কিয়ামতের দিন সবার আগে বিচারকদেরকেই হিসাবের জন্য ডাকা হবে।” রাসূল (সা) বলেছেনঃ একজন ন্যায় বিচারককে যখন কিয়ামতের দিন হিসাবের সম্মুখীন করা হবে তখন হিসাবের কঠোরতা দেখে সে আক্ষেপ করবে যে, “একটা খোরমা সংক্রান্ত বিবাদেও যদি আমি দু’জনের বিচার না করতাম।” হযরত আলী (রা) বলেনঃ রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি যে, প্রত্যেক শাসক ও বিচারককে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে পুলসিরাতে দাঁড় করিয়ে সমগ্র মানব জাতির সামনে তার গেপন আমলনামা পাঠ করা হবে। অতঃপর সে যদি ন্যায় বিচারক সাব্যস্ত হয়, তবে আল্লাহ তাকে মুক্তি দেবেন, নচেত পুলসিরাত সহ সে জাহান্নামে পতিত হবে।”
.
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের অর্থ আত্মসাত করোনা, শাসকদের কাছে অর্থ নিয়ে যেওনা, যাতে তোমরা মানুষের অর্থের একাংশ অন্যায় পন্থায় ভোগ করতে পার। অথচ তোমরা জান” অর্থাৎ তোমরা শাসকদেরকে উৎকোচ দিয়ে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করার ব্যবস্থা করোনা, অথচ তোমরা তো জান যে, এ রকম করা বৈধ নয়। রাসূল (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ ঘুষদাতা ও ঘুষখোর উভয়কে অভিসম্পাত দিয়েছেন। ইমামগণ একমত হয়ে বলেছেন যে, ঘুষদাতার ওপর অভিসম্পতি তখনই পতিত হবে, যখন সে তা দ্বারা অন্যের ক্ষতি সাধনে ব্রতী হবে অথবা নিজের প্রাপ্য নয় এমন কোন সুবিধা আদায় করতে চাইবে। কিন্তু সে যদি নিজের কোন ন্যায্য প্রাপ্য জিনিস বা অধিকার আদায়ের জন্য অনন্যোপায় হয়ে ঘুষ দেয় এবং কারো জুলুম থেকে বাঁচার জন্য ঘুষ দেয়, তবে তার ওপর অভিসম্পাত পতিত হবেনা। এ সংক্রান্ত যে হাদীস আবু দাউদ ও তিরমিযী উদ্ধৃত করেছেন, তাতে ঘুষদাতা ও ঘুষখোরের মাঝে তৃতীয় যে ব্যক্তি উভয়কে সাহায্য করে, তাকে অভিশপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ব্যক্তি যদি ঘুষদাতা কর্তৃক নিযুক্ত হয়, তবে ন্যায্য অধিকার আদায় ও জুলুম থেকে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে তার অবস্থা ঘুষদাতার মত হবে এবং সে অভিসম্পাতের যোগ্য হবেনা। নচেত অভিসম্পাতের যোগ্য হবে। তবে শাসকের জন্য ঘুষ আদান প্রদান সর্বাবস্থায় হারাম— চাই তা কারো অধিকার বিনষ্ট করার মাধ্যমেই করুক, অথবা কোন জুলুম প্রতিহত করার জন্যই করুক।
রাসূল (সা) আরো বলেছেন : যে ব্যক্তি কারো জন্য সুপারিশ করলো, অতঃপর যার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে, সে তাকে কোন হাদিয়া বা উপহার দিল, সে যদি এই হাদিয়া গ্রহণ করে, তবে তা হবে একটি বড় ধরনের সুদ খাওয়ার পর্যায়ভুক্ত। হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ “তোমার ভাই এর প্রয়োজন পূরণ করে দিয়ে তার কাছ থেকে যদি উপহার গ্রহণ কর তবে তা হবে হারাম।” (উল্লেখ থাকে যে, যে ব্যক্তি কোন কাজের জন্য বেতনভূক্ত কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত থাকে, সে যদি তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত কোন কাজ করে দিয়ে যার জন্য কাজ করেছে তার কাছ থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ করে, তবে সেটা সর্বসম্মতভাবে ঘুষ – চাই তা উপহার, উপঢৌকন, হাদিয়া বা বখশিস যে নামেই প্রদত্ত হোক না কেন। আর যদি দায়িত্বের অতিরিক্ত হয় এবং চাকুরীর সময়ের বাইরে করা হয় তবে সে জন্য পারিশ্রমিক বা পারিতোষিক নিলে তা ঘুষ হবেনা। —অনুবাদক)।
বর্ণিত আছে যে, একবার একজন খৃষ্টান বৈরুতে ইমাম আওযায়ীর সাথে সাক্ষাত করে অভিযোগ করলো যে, বালাকের শাসক তার ওপর অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত খাজনা আরোপ করেছে। সে এই জুলুমের প্রতিকারে সুপারিশমূলক চিঠি লেখার জন্য ইমাম সাহেবকে অনুরোধ করলো এবং তাকে হাদিয়া হিসাবে এক বোতল মধু দিল। ইমাম আওযায়ী তাকে বললেনঃ আমি চিঠি লিখে দেব এবং মধুর বোতলটি তোমাকে ফেরত দিব। লোকটি মধুর বোতল ও চিঠি নিয়ে চলে গেল। এবং ইমাম সাহেবের অনুরোধক্রমে বালাকের শাসক তার খাজনা থেকে ৩০ দিরহাম কমিয়ে দিল।
.
সহীহ বুখারী, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাতে হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যেসব পুরুষ নারীর সাথে এবং যে সব নারী পুরুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বেশভূষা গ্রহণ করে তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত।” উল্লেখ্য যে, পুরুষ কর্তৃক নারীর এবং নারী কর্তৃক পুরুষের কণ্ঠস্বর অনুকরণও এর আওতাভুক্ত।
সুতরাং নারী যখন পুরুষের মত আটশাট, পাতলা ও শরীরের আবরণযোগ্য অংশ অনাবৃত থাকে এমন পোশাক পরে, তখন সে পুরুষের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং অভিসম্পাতের যোগ্য হয়। তার এই আচরণ যদি তার স্বামী মেনে নেয় এবং তাকে এ থেকে বিরত না রাখে, তবে সেও অভিসম্পাতের যোগ্য হবে। কেননা স্ত্রীকে আল্লাহর আদেশের অনুগত রাখতে এবং তার নাফরমানী থেকে বিরত রাখতে সে আদিষ্ট। আল্লাহ বলেছেন : “হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর..” অর্থাৎ তাদেরকে সদাচরণ শিক্ষা দাও, আল্লাহর আনুগত্য করতে আদেশ দাও এবং আল্লাহর নাফরমানী থেকে বিরত রাখ, যেমন তোমাদের নিজেদের বেলায় এসব জরুরী। তাছাড়া রাসূল (সা) বলেছেনঃ “তোমাদের সকলেই দায়িত্বশীল, প্রত্যেক নিজ নিজ অধিনস্থা সম্পর্কে দায়ী। পুরুষ তার পরিবার সম্পর্কে দায়ী এবং কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।” (সহীহ আল বুখারী ও মুসলিম) রাসূল (সা) আরো বলেছেন পুরুষরা যখন স্ত্রীদের আস্থাবহ হবে, তখন পুরুষরা ধ্বংস হবে।” এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, নারীর শাসনকর্ত্রী হওয়াও পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনের পর্যায়ে পড়ে এবং পুরুষ কর্তৃক নারীর আজ্ঞাবহ হওয়াও নারীর অনুকরণের পর্যায়ভুক্ত। রাসূল (সা) বলেনঃ “দুই শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামী হবেঃ যারা গরুর লেজ সদৃশ বেত দ্বারা মানুষকে প্রহার করে এবং যে সব নারী এত পাতলা পোশাক পরে যে তার ভেতর দিয়ে শরীরের রং দেখা যায় এবং অহংকারীর বেশে হেলে দুলে পথ চলে। এই সকল নারী জান্নাতের ঘ্রাণও পাবেনা, যা বহুদুর থেকে পাওয়া যায়।” (সহীহ মুসলিম) হযরত নাফে’ (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, একদিন হযরত ইবনে উমার ও আবদুল্লাহ ইবনে আমর হযরত যুবাইরের কাছে ছিলেন। এমতাবস্থায় এক মহিলা ঘাড়ে ধনুক বহন করে মেষ পাল হাকাতে হাকাতে এগিয়ে এল। আবদুল্লাহ ইবনে উমার তাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি পুরুষ না মহিলা? সে বললোঃ মহিলা। তখন তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমরের দিকে তাকালে তিনি বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবীর মুখ দিয়ে পুরুষদের সাথে সাদৃশ অবলম্বনকারী মহিলাদেরকে এবং মহিলাদের সাথে সাদৃশ অবলম্বনকারী পুরুষদেরকে অভিসম্পাত করেছেন। এ থেকে বুঝা গেল, পুরুষসুলভ পেশা অবলম্বন করে পুরুষোচিত ভংগীতে বেপর্দাভাবে চলাফেরা ও কাজ করা নারীদের জন্য পুরুষের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বনের পর্যায়ে পড়ে। তবে পর্দা সহকারে পেশা অবলম্বন করা ও তার কাজ করা যায়।
আর যে সমস্ত কাজের জন্য নারীদেরকে অভিশম্পাত করা হয় তা হলো বাহিরে চলাচলের সময় দেহের সৌন্দর্য ও গহনাপত্র প্রদর্শন, সুগন্ধি দ্রব্য গায়ে বা কাপড়ে মেখে চলা এবং খাট আটসাট ও পাতলা পোশাক পরা, যা দ্বারা ছতর ঢাকে না ও পর্দা হয় না। এ সবই তাবাররুজের অন্তর্গত। যার বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) কঠোর সমালোচনা করেছেন। অধিকাংশ মহিলা, এগুলোতে লিপ্ত হয় বলেই রাসূল (সা) বলেছেন আমি মিরাজের রাত্রে জাহান্নাম দেখেছি এবং তার অধিকাংশ অধিবাসী দেখেছি মহিলা। তিনি একথা বলেছেন যে, “আমি পুরুষদের জন্য নারীর চেয়ে ক্ষতিকর কোন জিনিস রেখে যাইনি।”
.
রাসূল (সা) বলেছেনঃ “তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। যে ব্যক্তি পিতামাতার অবাধ্য, দায়ুস অর্থাৎ পরিবারের মধ্যে অশ্লীলতা ও পাপাচারের প্রশ্রয়দাতা এবং পুরুষসুলভ আচরণকারী নারী।” নাসায়ীর বর্ণনায় রাসূল (সা) বলেনঃ তিন জনের ওপর আল্লাহ জান্নাত হারাম করেছেন। মদখোর, পিতামাতার অবাধ্য ও আপন পরিবারে অশ্লীলতা ও পাপাচারের প্রশ্রয়দাতা।
যে ব্যক্তি নিজের স্ত্রী অশ্লীলতার মধ্যে লিপ্ত আছে বলে অনুমান করে, কিন্তু তার হাতে কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই, এবং স্ত্রীকে ভালোবাসার কারণে তাকে কিছু বলতে পারেনা, অথবা স্ত্রীর কাছে এমনভাবে ঋণগ্রস্ত আছে যে তার পরিশোধ করতে সে অপরাগ, সে বিপুল পরিমাণ দেনমোহরের দায়গ্রস্ত, অথবা বহুসংখ্যক শিশুসন্তান রয়েছে যাদের খোরপোশের দাবী নিয়ে স্ত্রী আদালতের শরণাপন্ন হবে – এরূপ আশংকা রয়েছে বলে শৈথিল্য প্রদর্শন করে তাকে দায়ুস বলা যাবে না। তবে যার ভেতরে অশ্লীলতার প্রতি ঘৃণা বর্তমান নেই এবং স্ত্রী ও সন্তানদেরকে ইসলামী বিধান বিশেষত পর্দা মেনে চলতে বাধ্য করেনা তার ইহকালে ও পরকালে কোন কল্যাণ নেই এবং সে দায়ুস বলেই গণ্য হবে।
(উল্লেখ্য যে, উপরে যে ব্যতিক্রমমূলক কয়েকটি অবস্থার উল্লেখ করা হলো, তার কথা বাদ দিলে সাধারণভাবে একজন মানুষের নিজ স্ত্রী ও সন্তানদের ওপর নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও একচ্ছত্র আধিপত্য বিদ্যমান, যা অনেকটা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতার মতই। পিতা ও স্বামী হিসাবে সন্তান ও স্ত্রীদের প্রায় শর্তহীন ও অবাধ আনুগত্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে শরীয়তের বিধি ও সামাজিক প্রথা উভয়ের আলোকেই। তাই নিরংকুশ কর্তৃত্বের এই পরিমন্ডলে সে যাতে নিজের ক্ষমতা প্রয়োেগ করে পরিবারকে সৎপথের ওপর বহাল রাখে, সেজন্য পবিত্র কুরআনে এই আদেশ দেয়া হয়েছে যে, “তোমাদের নিজেদেরকে ও পরিবার পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর।” আর যারা এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে তাদেরকে দায়ুস বলা হয়। পরিবারে পর্দার ব্যাপারে ও শরিয়াতের অন্যান্য বিধানের ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করলে তার জন্য পরিবার-প্রধানকেই দায়ী হতে হবে এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে সে দায়ুস হবে। —অনুবাদক)
.
(অর্থাৎ বিনা সহবাসে তালাক দেয়ার শর্তে বিয়ে করা, যাতে তালাক প্রাপ্তা নারী তার পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল হয়।) নাসায়ী ও তিরমিযীতে বর্ণিত হাদীসে হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ যে ব্যক্তি কোন তালাক প্রাপ্ত নারীকে তার পূর্ববর্তী স্বামীর জন্য হালাল করার উদ্দেশ্যে বিয়ে করে ও বিয়ের শর্ত অনুসারে বিনা সহবাসে তালাক দেয়, তাকে এবং যার জন্য হালাল করে তাকে রাসূল (সা) অভিশাপ দিয়েছেন। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ হযরত উমর (রা) আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) এবং তাবেয়ী ফকীহগণ এই হাদীস অনুসারে কাজ করতেন। ইমাম আহমাদও স্বীয় মুসনাদে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ রাসূল (সা) কে তাহলীল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দিলেনঃ না, স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারে ব্যতীত কোন বিয়ে চলবে না। বিয়ের নামে কোন ছলচাতুরী চলবে না। (অর্থাৎ কেবল বিয়ের ভান বা অভিনয় করা হবে, আসলে বিয়ে করা হবে না। এটা জায়েজ নয়।) আল্লাহর কিতাবের সাথে উপহাস করার অবকাশ নেই। সহবাস ছাড়াই স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়ার বাধ্যবাধকতা গ্রহণযোগ্য নয়। উকবা ইবনে আমের থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “ভাড়াটে পাঠা কে বলবো?” সবাই বললো : হা, বলুন! তখন রাসূল (সা) বললেনঃ “সহবাস না করে তালাক দিতে হবে-এই শর্ত মেনে নিয়ে যে বিয়ে করে, সেই হচ্ছে ভাড়াটে পাঠা।” আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের শর্তাধীন বিয়েকারী ও যার জন্য সে বিয়ে করে, তাকে অভিশাপ দিয়েছেন। (ইবনে মাজা) এক ব্যক্তি হযরত ইবনে উমর (রা) কে জিজ্ঞাসা করলো যে, একটি তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে আমি বিয়ে করেছি। আমি তাকে তালাক দিয়ে তার পূর্ববর্তী স্বামীর জন্য হালাল করে দিতে চাই। অথচ তার পূর্বতন স্বামী আমাকে আদেশও করেনি, আর আমি যে তার জন্য এ কাজ করছি তা সে জানেও না। এ সম্পর্কে আপনার মত কি? ইবনে উমর (রা) বললেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছামূলক বিয়ে ছাড়া আর সমস্তু বিয়ে অচল। তোমার যদি ভালো লাগে তবে তাকে রেখে দেবে, নচেত ছেড়ে দেবে। এ ধরনের কাজকে আমরা রাসূল (সা) এর আমলে ব্যভিচার গণ্য করতাম। হযরত উমর (রা) এ ধরনের বিয়েকে ব্যভিচার গণ্য করতেন এবং যে এ ধরনের বিয়ে করে ও যার জন্য করে- উভয়কে তিনি “রজম” (প্রস্তারাঘাতে মৃত্যুদন্ড প্রদান) করার সংকল্প প্রকাশ করতেন। হযরত ইবনে উমার (রা) তাহলীল করার উদ্দেশ্যে বিয়ে করে বিশ বছর কাটিয়ে দিলেও স্বামী-স্ত্রী উভয়কে ব্যভিচারী আখ্যায়িত করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলোঃ আমার চাচাতো ভাই স্বীয় স্ত্রীকে এক সাথে তিন তালাক দিয়ে এখন অনুতপ্ত। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বললেনঃ “সে আল্লাহর নাফরমানী করেছে। ফলে আল্লাহ তাকে এই অনুতাপজনক অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন। সে শয়তানের ফরমাবরদারী করেছে। তাই শয়তান তাকে এই সংকটজনক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে এবং এখান থেকে বেরুবার পথ রাখেনি। লোকটি বললোঃ যদি কেউ তার জন্য তার স্ত্রীকে হালাল করে দেয়ার উদ্যোগ নেয় তাহলে কেমন হয়? ইবনে আব্বাস (রা) বললেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহকে ধোকা দেবে, আল্লাহ তাকে ধোকা দেবেন। হযরত ইবরাহীম নাখয়ী (বিশিষ্ট তাবেয়ী ইমাম) বলেন প্রথম স্বামী, স্ত্রী ও দ্বিতীয় স্বামী- এই তিনজনের কারো যদি তাহলীলের নিয়ত থাকে, তাহলে পরবর্তী স্বামীর সাথে অনুষ্ঠিত বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে এবং এ ধরনের বিয়ে দ্বারা ঐ স্ত্রী সাবেক স্বামীর জন্য হালাল হবেনা। হাসান বশরী, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব, মালেক বিন আনাস, লাইস বিন সাদ, সুফিয়ান সাওরী ও ইমাম আহমাদ- এঁরা সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, এক্ষেত্রে স্ত্রী সাবেক স্বামীর জন্য হালাল হবেনা। ইমাম শাফেয়ীর মতে তাহলীলের শর্তে আকদ সম্পন্ন হলে সেই বিয়েই অবৈধ। কেননা তা মুতীয়া বিয়ের ন্যায় অস্থায়ী, যা শরীয়তসিদ্ধ নয়।
.
প্রস্রাব থেকে সঠিকভাবে পবিত্রতা অর্জন না করা মূলতঃ খৃষ্টানদের রীতি। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “তোমরা পোশাককে পবিত্র কর।” (সূরা আল-মুদ্দাসসির) হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা) দুটো কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেনঃ “এই কবর দুটির অধিবাসীদ্বয় আযাব ভোগ করবে। কারণ এদের একজন চোগলখুরি করে বেড়াতো। অপরজন প্রস্রাব থেকে যথাযথভাবে পবিত্রতা অর্জন করতো না।” (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম) রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ “তোমরা প্রস্রাব থেকে পবিত্রতা অর্জন কর। কেননা অধিকাংশ কবরের আযাব এ কারণেই হয়ে থাকে।” (দারকুনী)
যে ব্যক্তি পেশাব থেকে ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করেনা, তার দেহ ও পোশাক উভয়ই অপবিত্র হয়ে যায় এবং তার নামায হয়না। তাবরানী ও ইবনে আবিদ্দুনিয়া বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেন : জাহান্নামবাসী তো এমনিতেই অবর্ণনীয় দুঃখ ও যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকবে। উপরন্তু চার শ্রেণীর মানুষের কারণে তাদের দুঃখ যন্ত্রণা আরো বেড়ে যাবে। ফলে তারা উত্তপ্ত পানি ও আগুনের মধ্য দিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকবে এবং নিজেদের জন্য মৃত্যু ও ধ্বংস কামনা করতে থাকবে। অতঃপর জাহান্নামবাসী একে অপরকে বলবেঃ এ চারটি লোকের পরিচয় কি, যারা জাহান্নামে প্রবেশ করে আমাদের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিয়েছে। তখন অপরজন বলবেঃ ওদের একজনকে একটি আগুনের খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। অপরজন নিজের বেরিয়ে পড়া নাড়িভুড়ি টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে। অপরজনের মুখ থেকে অনবরত পুঁজ ও রক্তের বমি হচ্ছে। আর একজন নিজের শরীরের গেশত কামড়িয়ে খাচ্ছে। অতঃপর খাঁচায় আবদ্ধ লোকটিকে লক্ষ্য করে বলা হবেঃ এই অভিশপ্ত লোকটির কি হয়েছে, যে আমাদের যন্ত্রণার ওপর যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিয়েছে? সে বলবেঃ আমি অভিশপ্ত এজন্য যে, নানাভাবে মানুষের সম্পদ লুটেপুটে খেতাম, অতঃপর সেই সমস্ত দায়দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েই মারা গিয়েছিলাম। অতঃপর যে ব্যক্তি নিজের নাড়িভুড়ি টেনে নিয়ে বেড়ায়, তাকে একই কথা জিসা করা হবে। সে বলবে আমি অভিশপ্ত এ জন্য যে, প্রস্রাব সম্পর্কে সাবধান থাকতাম না। এবং তা ধুয়ে পরিষ্কার করতাম না। অতঃপর যার মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত ও পুঁজের বমি হতে থাকবে, তাকে একইভাবে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলবেঃ আমি অভিশপ্ত এজন্য যে, আমি যে কোন খারাপ কথা শুনে মজা পেতাম এবং একজনের কথা অপরজনের কাছে পৌছে দিয়ে চোগলখুরি করে শত্রুতা বাধিয়ে দিতাম। অতঃপর যে নিজের দেহের গেশত কামড়ে খাবে তাকে একই কথা জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলবেঃ আমি এজন্য অভিশপ্ত যে, আমি মানুষের গেশত খেতাম, অর্থাৎ গীবত করতাম।’ আল্লাহ আমাদের সকলকে এ সব জঘন্য পাপ থেকে রক্ষা করুন!
.
আল্লাহ তায়ালা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য ও আলামত হিসাবে বর্ণনা করে বলেনঃ “তারা মানুষকে দেখায় এবং আল্লাহকে কদাচিৎ স্মরণ করে।” (সূরা আন নিসা) “সেই সব নামাযীর জন্য ধ্বংস, যারা তাদের নামায সম্পর্কে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য নামায পড়ে এবং মানুষকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে সাহায্য করে না।” (সূরা আল মাউন) “হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের সৎকাগুলো খোটা দিয়ে নষ্ট করে দিওনা, যেমন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দানকারী ব্যক্তি নষ্ট করে।” (সূরা আল বাকারাহ) “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাত লাভের আশা করে, তার সৎ কাজ করা উচিত এবং নিজের রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক করা উচিত নয়।” (সূরা আল কাহফ) অর্থাৎ অন্যকে দেখিয়ে খুশী করার উদ্দেশ্যে ইবাদাত করা উচিত নয়।
হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথমে তিন ব্যক্তির বিচার অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছিল। তাকে হাজির করে তাকে দেয়া আল্লাহর নিয়ামতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সে সকল নিয়ামতের স্বীকৃতি দেবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তুমি এই সমস্ত নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কী কাজ করেছ? সে বলবে আমি তোমার জন্য লড়াই করে শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেনঃ “তুমি মিথ্যা বলেছ। আসলে তোমাকে যাতে লোকে বীর বলে সেইজন্য লড়াই করেছিলে। লোকেরা তোমাকে তো বীর বলেছে।” অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়া হবে। দ্বিতীয় ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে প্রচুর ধনসম্পদ লাভ করেছিল। তাকে হাজির করে আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। সে আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্বীকার করবে। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হবেঃ তুমি এই বিপুল সম্পদ ছাড়া কী সৎ কাজ করেছ? সে বলবেঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার পথে যেখানেই অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন দেখেছি, সেখানে অর্থ ব্যয়ে ইতস্তত করিনি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি আমার পথে নয়, বরং লোকে যাতে তোমাকে দানশীল বলে প্রশংসা করে, সেই জন্য দান করেছ। লোকেরা তোমাকে তো দানশীল বলেছেই।” অতঃপর তাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তৃতীয় ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে ইসলামের জ্ঞান অর্জন করেছিল, অন্যকেও জ্ঞান বিতরণ করতো এবং কুরআন অধ্যয়ন করতো। তাকে হাজির করে তাকে প্রদত্ত আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে এবং সে তা স্বীকার করবে। জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তুমি এই ইসলামী জ্ঞান দ্বারা কী কাজ করেছ? সে বলবে আমি ইসলামী জ্ঞান অর্জন করেছি, জ্ঞান বিতরণও করেছি এবং তোমার সন্তুষ্টির জন্য আল কুরআন অধ্যয়ন করেছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি আমার সন্তুষ্টির জন্য নয়, বরং লোকেরা যাতে তোমাকে কারী বলে প্রশংসা করে, সেই জন্য অধ্যয়ন করেছ। অতঃপর তাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হবে।” (সহীহ মুসলিম)
রাসূল (সা) আরো বলেন! “যে ব্যক্তি মানুষকে শুনানোর জন্য সৎ কাজ করে, আল্লাহ তাকে শুনাবেন। আর যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য করে, আল্লাহ তাকে দেখাবেন।” (সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম) ইমাম খাত্তাবী বলেন, এ হাদীসের মর্ম এই যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তোষের জন্য নয় বরং মানুষকে শুনানো ও দেখানোর জন্য কাজ করে, আল্লাহ তাকে এভাবে শাস্তি দেবেন যে, তার কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য ফাঁস করে দিয়ে কিয়ামতের দিন জনসমক্ষে অপমানিত করবেন। রাসূল (সা) আরো বলেনঃ সামান্যতম রিয়াও শিরকের শামিল। (তাবরানী, হাকেম) রাসূল (সা) আরো বলেনঃ তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসটি ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করি, সেটি হচ্ছে ছোট শিরক। জিজ্ঞাসা করা হলো যে, হে রাসূলাল্লাহ! ছোট শিরক কী? তিনি বললেনঃ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করা। আল্লাহ যেদিন তার বান্দাদেরকে কর্মফল দেবেন সেদিন বলবেনঃ যাদেরকে দেখানোর জন্য তোমরা সৎ কাজ করতে, তাদের কাছে চলে যাও, এবং দেখ তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কিনা।” (আহমাদ, বায়হাকী) পবিত্র আল কুরআনে আল্লাহ বলেনঃ”তাদের সামনে আল্লাহর পক্ষ হতে এমন জিনিস প্রতিভাত হবে, যা তারা কল্পনাও করেনি।” এর ব্যাখ্যা প্রসংগে কেউ বলেন যে, তারা এমন সব কাজ করতো, যাকে তারা দুনিয়ার সৎ কাজ মনে করতো, কিন্তু কিয়ামতের দিন তা খারাপ কাজ বলে প্রতিভাত হবে। এই আয়াত পড়ে কোন কোন বুযুর্গ বলতেন রিয়াকারদের সর্বনাশ হোক।” ইবনে আবিদ্দুনিয়া বর্ণনা করেন যে, কিয়ামতের দিন রিয়াকারকে চারটি নাম ধরে ডেকে বলা হবে : ওহে রিয়াকার, ওহে ভণ্ড, ওহে পাপিষ্ঠ, ওহে ক্ষতিগ্রস্ত; যাও, যাকে খুশী করার জন্য কাজ করেছিলে, তার কাছ থেকে তোমার পুরস্কার নাওগে। আমার কাছে তোমার জন্য কিছুই নেই।” বর্ণিত আছে যে, হযরত উমর (রা) এক ব্যক্তিকে ঘাড় নিচু করে চলতে দেখলেন। তিনি বললেনঃ তুমি ঘাড় উঁচু করে চল ঘাড় নিচু করাতে বিনয় নেই- বিনয় থাকে অন্তরে।” হযরত আবু উমামা বাহেলী (রা) এক ব্যক্তিকে দেখলেন, মসজিদে সিজদায় থাকাকালে উচ্চস্বরে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে। আবু উমামা তাকে বললেনঃ এরূপ কান্নাকাটি তোমার বাড়ীতে বসে করলেই ভালো করতে ! ইমাম মুহাম্মদ বিন আল-মুবারক বলেনঃ”তোমার কাকুতি মিনতি রাত্রিকালে প্রকাশ্যে কর। কেননা রাত্রিকালে ওঠা আল্লাহর জন্য আর দিনের বেলায় ওটা মানুষের জন্য হয়ে থাকে।” হযরত আলী (রা) বলেনঃরিয়াকারের আলামত এই যে, একাকী থাকলে উদাসীন ও অলস হয়ে যায়, আর লোকজনের মধ্যে থাকলে সক্রিয় হয় এবং প্রশংসা করলে বেশী করে সৎ কাজ করে, আর ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে বা নিন্দা সমালোচনা করলে সৎ কাজ কমিয়ে দেয়। হযরত ফযীল বিন ইয়ায বলেনঃমানুষকে খুশী করার জন্য সৎ কাজ করা শিরক, আর মানুষের রোষের ভয়ে সৎ কাজ ছেড়ে দেয়া রিয়াকারী। ইখলাস হলো উভয় অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করার নাম। আল্লাহ আমাদেরকে রিয়া থেকে মুক্তি দিন ও ইখলাস দান করুন। আমীন।
(উল্লেখ্য যে, মানুষের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্য না থাকলে অথবা মানুষকে সৎ কাজে উৎসাহিত করা উদ্দেশ্য থাকলে প্রকাশ্যে সৎ কাজ করা দোষের নয়। যেমন আল্লাহ বলেনঃ”যারা দিনে ও রাতে প্রকাশ্যে ও গেপনে অর্থ দান করে, তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে।” –অনুবাদক)
.
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। (সূরা ফাতির) অর্থাৎ আল্লাহ সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে। ইবনে আব্বাস বলেনঃ অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে যারা তার ক্ষমতা ও প্রতাপ সম্পর্কে অবগত আছে তারাই তাকে ভয় করে। ইমাম শা’বী বলেনঃযে আল্লাহকে ভয় করে, সে-ই জ্ঞানী। রবী ইবনে আনাস বলেনঃযে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না, সে জ্ঞানী নয়। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ”আমি যে সুস্পষ্ট বাণী পথ নির্দেশিকা নাযিল করেছি, তা আমি মানুষের জন্য এই কিতাবে বিশদভাবে বর্ণনা করার পরও যে ব্যক্তি তা গেপন করে, আল্লাহ ও অভিশাপকারীরা তাদেরকে অভিসম্পাত করেন।”(সূরা আল বাকারা)
এ আয়াত ইহুদী আলেমদের সম্পর্কে নাযিল হয়। এতে “সুস্পষ্ট বাণীসমূহ” দ্বারা হত্যা ও ব্যভিচার প্রভৃতির শরীয়ত নির্দেশিত শাস্তির বিধান ও অন্যান্য আইন, “পথ নির্দেশিকা” দ্বারা রাসূল (সা) এর আনীত সামগ্রিক বিধান ও তার প্রশংসা, “মানুষ” দ্বারা বনী ইসরাইল, “কিতাব” দ্বারা তাওরাত এবং “অভিশাপকারীরা” দ্বারা জিন ও মানুষ ছাড়া আর সব কিছুকে বুঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃযে কোন দু’জন মুসলমান পরস্পরকে অভিশাপ দিলে তা ইহুদী ও খৃস্টানদের দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। কেননা তারা মুহাম্মাদ (সা) সংক্রান্ত বৃত্তান্ত তাদের কিতাবে থাকা সত্ত্বেও তা গেপন করে।
আল্লাহ অন্যত্র বলেনঃ”যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের কাছ থেকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, তোমরা এই কিতাবকে মানুষের কাছে পুরোপুরিভাবে প্রকাশ করবে এবং কোনক্রমেই তার কিছুমাত্র গেপন করবে না। কিন্তু তারা এই প্রতিশ্রুতিকে পেছনে ফেলে রাখলো এবং এর বিনিময়ে জঘন্য স্বার্থ খরিদ করলো। তাদের খরিদ করা জিনিস অত্যন্ত নিকৃষ্ট।”
ইমাম ওয়াহেদী বলেনঃএ আয়াত মদীনার ইহুদীদের সম্পর্কে নাযিল হয়। আল্লাহ তাওরাতে তাদের কাছ থেকে অংগীকার নিয়েছেন (অর্থাৎ কঠোর আদেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন অবশ্যই মুহাম্মাদ (সা) এর ব্যাপারে বর্ণিত তথ্যাবলী, তার প্রশংসা ও নবুওয়াতের বিষয়গুলো প্রকাশ করে এবং কোনক্রমেই তা গেপন না করে। কিন্তু সেই অংগীকার বা আদেশ তারা পেছনে ফেলে রাখলো অর্থাৎ অমান্য করলো। রাসূল (সা) বলেনঃযে জ্ঞান বা বিদ্যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় সেই জ্ঞান বা বিদ্যা যে ব্যক্তি শুধু পার্থিব লাভের উদ্দেশ্যে শিখবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। (সুনান আবু দাউদ, সুনান ইবন মাজাহ) রাসূল (সা) আরো বলেনঃযে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করলো এই উদ্দেশ্যে যে, সে সকল জ্ঞানীদের মধ্যে গৌরবের অধিকারী হবে, অথবা বেকুফ লোকদের সাথে তর্কে লিপ্ত হবে, অথবা জনগণের মন তার দিকে আকৃষ্ট হবে, সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। (জামে আত্ তিরমিযী) রাসূল (সা) আরো বলেনঃযার কোন বিষয় জানা আছে, অথচ তাকে সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে সে উক্ত জ্ঞানকে গেপন করে কিয়ামতের দিন তার ঘাড়ে আগুনের লাগাম পরানো হবে। সহীহ মুসলিম, জামে আত্ তিরমিযী ও সুনান আন্ নাসায়ীতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) এই বলে দোয়া করতেন যে, “যে জ্ঞান আমার উপকার করেনা (অর্থাৎ আখেরাতে) তা থেকে পানাহ চাই।” তিরমিযী ও ইবনে মাজাহাতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি (দীন সংক্রান্ত) জ্ঞান অর্জন করলো, অথচ তদনুযায়ী আমল করলো না, তার জ্ঞান কেবল তার অহংকারই বাড়াবে। আবু দাউদ ও তিরমিযীতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ অসৎকর্মশীল আলেমকে কেয়ামতের দিন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সে সময় লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করবে যে, আপনার এ অবস্থা কেন হলো? আমরা তো আপনার কাছ থেকে হেদায়েত লাভ করতাম। সে বলবেঃ আমি তোমাদেরকে যে কাজ করতে নিষেধ করতাম, নিজে তা করতাম।
.
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন : “হে মুমিনগ! তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তোমাদের ওপর ন্যস্ত আমানতের খেয়ানত করোনা। অথচ তোমরা এর গুরুত্ব জান।” (আল আনফাল)
ইমাম ওয়াহেদী (রহ) বলেন যে, এ আয়াত সাহাবী আবু লুবাবা সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। বনু কুরাইযা গেত্রের পল্লীতে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা বসবাস করছিল। রাসূল (সা) বনু কুরাইযাকে অবরোধ করে রেখেছিলেন। তিনি আবু লুবাবাকে কোন প্রয়োজনে বনু কুরাইযার কাছে পাঠিয়েছিলেন। বনু কুরাইযার লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো : “হে আবু লুবাবা! আমাদের ব্যাপারে সা”দের রায় অনুসারে আমরা যদি নেমে আসি, তা হলে আমাদের কি হবে বলে তোমার মনে হয়? আবু লুবাবা নিজের গলার দিকে ইংগিত দিয়ে বুঝালেন যে, তোমাদেরকে যবাই করা হবে। কাজেই নেমনা। তাঁর এ কাজটি আল্লাহ ও তার রাসূলের খিয়ানত বা বিশ্বাস ঘাতকতা ছিল। আবু লুবাবা নিজেও স্বীকার করেন যে, আমি কাজটি করার সংগে সংগেই বুঝতে পারলাম যে, আমি খিয়ানত করে ফেলেছি। এরপর আবু লুবা মসজিদে নববীর একটি খুঁটির সাথে নিজেকে ছয়দিন যাবত বেঁধে রাখেন এবং তার তওবা কবুল হবার ঘোষণা আসার পরই নিজেকে মুক্ত করেন। হযরত ইবনে আব্বাস বলেনঃ আল্লাহ তার বান্দাদের ওপর যা কিছুই ফরয করেন তাই আমানত। আর আল্লাহর আদেশ বা নিষেধ অমান্য করাই আমানতের খেয়নত।
রাসূল (সা) বলেছেনঃ ‘মুনাফিকের আলামত তিনটিঃ যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন ভংগ করে এবং যখন তার কাছে কিছু আমানত রাখা হয় তখন তার খেয়ানত করে। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম) সহীহ মুসলিমে যে কথাটি সংযোজন করা হয়েছে তা হলোঃ “যদিও সে নামায রোযা করে এবং নিজেকে মুসলমান বলে মনে করে।” রাসূল (সা) আরো বলেনঃ যে আমানতদার নয় তার ঈমান নেই এবং যে ওয়াদা পালন করেনা তার দীন নেই। (আহমাদ, বাযায, তাবরানী) খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা সব কিছুতেই খারাপ। তবে একটা অপরটার চেয়ে খারাপ হতে পারে। যে ব্যক্তি সামান্য জিনিসে আমানতের খেয়ানত করে, সে কারো ধন সম্পদ ও পরিবার পরিজনের ব্যাপারে যে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং বড় বড় অন্যায় করে, তার মত নয়। রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে তোমাকে বিশ্বাস করে তার বিশ্বাস রক্ষা কর আর যে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করোনা। আবার হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেনঃ মুমিনের মধ্যে আর যত দোষই থাক, খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যাচার থাকতে পারেনা। (আহমদ) রাসূল (সা) বলেনঃ আল্লাহ বলেছেন, দুই ব্যক্তি যখন একত্রে কোন কাজ করে, তখন আমি তাদের তৃতীয় জন হই। যতক্ষণ তারা একে অপরের সাথে খিয়ানত অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকতা না করে। (অর্থাৎ খিয়ানত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক শরীক কাজে আল্লাহর রহমত থাকে।) (আবু দাউদ) রাসূল (সা) আরো বলেনঃ মানুষের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম যে সদগুণটি তিরোহীত হবে তা হচ্ছে আমানতদারী বা বিশ্বস্ততা, আর সর্বশেষ যা অবশিষ্ট থাকবে, তা হচ্ছে নামায এবং অনেক নামাযী এমন রয়েছে যে কল্যাণ লাভ করেনা। হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, “আমানতে খেয়ানতকারীকে কেয়ামতের দিন হাজীর করা হবে এবং বলা হবে তোমার আমানত ফেরত দাও।” সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে ফেরত দেব? দুনিয়া তো ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন তার কাছে যে জিনিসটি আমানত রাখা হয়েছিল, তাকে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থলে হুবহু যে আকারে রাখা হয়েছিল সেই আকারে দেখানো হবে। অতপর বলা হবে যে, তুমি ওখানে নেমে যাও এবং ওটা বের করে নিয়ে এস। অতঃপর সে নেমে যাবে এবং জিনিসটি ঘাড়ে করে নিয়ে আসবে। জিনিসটি তার কাছে দুনিয়ার সকল পাহাড়ের চেয়ে ভারী মনে হবে। সে মনে করবে যে, জিনিসটি নিয়ে আসলে সে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু জাহান্নামের মুখের কাছে আসা মাত্র আবার আমানতের জিনিসসহ জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে পড়ে যাবে এবং সেখানে চিরকাল থাকবে। অতঃপর ইবনে মাসউদ বলেনঃ নামায, ওযু, গেছল, ক্রয়বিক্রয়ের ব্যবহৃত দাড়িপাল্লা সবই আমানত। আর গচ্ছিত সম্পদ সবচেয়ে বড় আমানত।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন