আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের দানখয়রাতের দোহাই দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে দানখয়রাতকে নষ্ট করে দিওনা।” (সূরা আল বাকারাহ) সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পাপ থেকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নির্দিষ্ট রয়েছেঃ পায়ের গেড়ালীর নীচ পর্যন্ত কাপড় পরিধানকারী, নিজের কৃত দান সদকা ও অনুগ্রহের দোহাই দাতা ও প্রচারকারী এবং মিথ্যা কসম খেয়ে পণ্যদ্রব্য বিক্রয়কারী।” সুনানে নাসায়ীতে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ তিন ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না: পিতামাতাকে অসন্তুষ্টকারী, মদ্যপায়ী ও নিজের কৃত অনুগ্রহ ও দানখয়রাতের প্রচারকারী ও দোহাই দানকারী।” অর্থাৎ যে কাউকে কিছু দান করে ও তারপর সেই দানের দোহাই দেয় ও প্রচার করে। রাসূল (সা) বলেছেনঃ তোমরা নিজেদের কৃত দানের প্রচার করোনা এতে দানের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায় ও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার অধিকার বাতিল হয়ে যায়। ইমাম ইবনে সিরিন শুনতে পেলেন এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বলছেঃ আমি তোমাকে অমুক জিনিস দিয়েছি, অমুক উপকার করেছি। ইবনে সিরীন তাকে বলেনঃ চুপ কর, উপকার করে তার হিসাব করলে কোন সওয়াব হয়না।
.
আল্লাহ তায়ালা সূরা আল কামারে বলেনঃ “আমি প্রতিটি জিনিস পরিচ্ছন্নভাবে সৃষ্টি করেছি।” ইমাম ইবনুল জাওসী বলেন যে, এ আয়াতের নাযিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে দুটো মত রয়েছে। প্রথম মত এইযে, মক্কার মুনাফিকরা রাসূল (সা) এর কাছে এসে অদৃষ্ট নিয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছিল। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। আর আবু উমামা (রা) এর বর্ণনা অনুসারে এ আয়াত নাযিল হয় অদৃষ্টে অবিশ্বাসী গেষ্ঠী সম্পর্কে। দ্বিতীয় মত এই যে, নাজরানের খৃস্টান পাদ্রী রাসূল (সা) এর কাছে এসে বলেছিল যে, হে মুহাম্মাদ! তুমি কি মনে কর পাপ কাজ অদৃষ্ট মোতাবিক হয়ে থাকে। আসলে তা নয়। তখন রাসূল (সা) বললেনঃ “তোমরা খোদাদ্রোহী।” এই সময় আয়াত নাযিল হয়। সূরা আল হাদীদে আল্লাহ বলেনঃ “পৃথিবীতে এবং তোমাদের জীবনে যে বিপদ মুসিবত আসুক, তা তোমাদের সৃষ্টির আগে থেকেই একটি পুস্তকে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এটা আল্লাহর কাছে খুবই সহজ কাজ। কাজেই তোমরা যা হারাও তার জন্য আফসোস করোনা এবং আল্লাহ যা কিছু তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য গর্বিত ও উল্লাসিত হয়োনা। আল্লাহ অহংকারী ও গর্বিত মানুষকে ভালবাসেন না।”
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেনঃ আল্লাহ যখন কিয়ামতের দিন পূর্ববর্তীদেরকে ও পরবর্তীদেরকে একত্রিত করবেন, তখন তার আদেশক্রমে জনৈক ফেরেশতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী শুনতে পারে এত জোরে ঘোষণা করবেন যে, আল্লাহর অবাধ্যরা কোথায়? তখন কাদরিয়াগণ (অর্থাৎ অদৃষ্টের অবিশ্বাসীগণ) উঠে দড়াবে। তাদেরকে তৎক্ষণাত জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। কাদরিয়া গেষ্ঠীর মতবাদ এই যে, আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে গুনাহর কাজের ক্ষমতা দেবেন, আবার তাকে শাস্তিও দেবেন, এটা সম্ভব নয়। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এইযে, আল্লাহ মানুষকে ভালমন্দ সব রকম কাজের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা দিয়ে তাকে পরীক্ষা করেন। ভালো কাজ করলে সে পরীক্ষায় কৃতকার্য হয় ও পুরস্কৃত হয়। আর মন্দ কাজ করলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয় ও শাস্তি পায়। আল্লাহ তায়ালা এই বিষয়টিই নিম্নের আয়াতে বর্ণনা করেছেন। “আল্লাহ তোমাদেরকে ও তোমাদের কাজকে সৃষ্টি করেছেন।” অর্থাৎ মানুষের ভালোমন্দ সব কাজ আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। অন্য আয়াতে বলেছেনঃ “তিনি মানুষের বিবেককে পাপ ও পুণ্য জানিয়ে দিয়েছেন।” অর্থাৎ তাকে পাপ ও পুণ্য উভয়ের জন্য তাকে ক্ষমতা ও সুযোগ দিয়েছেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা এক শ্রেণীর মানুষকে অনুগ্রহপূর্বক সৎ কাজের প্রেরণা দেন এবং তাদেরকে তার রহমতের অন্তর্ভুক্ত করেন, আর অপর এক শ্রেণীর মানুষকে পরীক্ষার সম্মুখীন করেন, ফলে তাদেরকে অপমানিত করেন। তাদের অপকর্মের জন্য তাদেরকে ধিকৃত করেন এবং যে কাজ দ্বারা তিনি তাদেরকে পরীক্ষা করেন, তা ছাড়া অন্য কোন কাজে তারা সমর্থ হয়না। অতপর তাদেরকে শাস্তি দেন। অথচ এ সব সত্ত্বেও আল্লাহ ন্যায় বিচারক।”
রাসূল (সা) বলেছেনঃ জেনে রাখ, সমগ্র মানব জাতি যদি তোমার কোন উপকার করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়, তবুও তারা আল্লাহ যতটুকু তোমার জন্য লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন তার চেয়ে বেশী উপকার করতে পারবেনা। আর যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়, তবুও আল্লাহ যেটুকু নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তা ছাড়া আর কোন ক্ষতি করতে পারবেন। “কলমগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং কাগজগুলো শুকিয়ে গেছে।” অর্থাৎ অদৃষ্টে যা কিছু লেখা হয়েছে তা চূড়ান্ত। নতুন করে আর কিছু লেখা হবেনা এবং নতুন কিছু সংঘটিতও হবেনা।
[উল্লেখ্য যে, তাকদীর বা অদৃষ্টে বিশ্বাস করা রিসালাত, আখেরাত ও কিতাবে বিশ্বাস করার ন্যায় ঈমানের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। তাই তাকদীরে অবিশ্বাস করা শুধু কবীরা গুনাহ নয়, কুফরীও বটে। এ বিষয়টি নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি ও মতভেদ রয়েছে তবে সকল মতভেদের উর্ধ্বে উঠে এই মর্মে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা ভালো ও মন্দ কাজের নিয়ত বা ইচ্ছা করাতে এবং সে জন্য চেষ্টা করার ক্ষমতা ও স্বাধীনতা দিয়েছেন। আর এই স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে সে যে ইচ্ছা ও চেষ্টা করবে, তার জন্যই তাকে পুরস্কৃত করা বা শান্তি দেয়া হবে। কিন্তু কাজটি সমাধা করার ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়নি এবং তার জন্য সে দায়ীও হবেনা। উদাহরণ স্বরূপ, এক ব্যক্তি কাউকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল এবং সে জন্য সে তাকে উপযুক্ত অস্ত্র দ্বারা আঘাত করলো। এতে আহত ব্যক্তি যনি নিহত না হয়, তবুও আক্রমণকারী আল্লাহর কাছে খুনের দায়ে দোষী হবে এবং শাস্তি পাবে। কেননা আয়ু না ফুরালে ও মৃত্যুর নির্ধারিত সময় সমাগত না হলে কারো মৃত্যু ঘটানো যায়না। কিন্তু ইচ্ছা ও সক্রিয় চেষ্টার জন্য হত্যার গুনাহ সে এড়াতে পারবেনা। কারণ তার ক্ষমতায় যা ছিল তা সে পুরোপুরি করেছে। এ বক্তব্যের সপক্ষে একটি হাদীস উল্লেখ কর যাচ্ছে। রাসূল (সা) বলেছেনঃ যখন দুই ব্যক্তি পরস্পরকে হত্যা করার জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ে জাহান্নামী হবে। জিজ্ঞাসা করা হলো যে, যে হত্যা করেছে সে জাহান্নামী হবে এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু নিহত ব্যক্তি কেন দোজখে যাবে? রাসূল (সা) বললেনঃ সেও তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে চেয়েছিল।” অনুবাদক]
.
আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ তোমরা গেপনীয় জিনিসের তল্লাশী করোনা। তাফসীরকারগণ বলেনঃ এর অর্থ মানুষের গুপ্ত দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ গেয়েন্দাগিরী করতে নিষেধ করা হয়েছে। একবার হযরত ইবনে মাসউদকে বলা হলো যে, ওয়ালীদ ইবনে উকবার দাড়ি থেকে ফোটা ফোটা মদ গড়িয়ে পড়ে। তিনি বললেনঃ গেয়েন্দাগিরী করতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। তবে কোন কিছু প্রকাশিত হয়ে গেলে সেটি আমরা বিবেচনা করবো।
রাসূল (সা) বলেনঃ “যে ব্যক্তি কারো কথাবার্তা তার সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও আড়ি পেতে শুনে কিয়ামতের দিন তার কানে গলিত শীসা ঢালা হবে।”একটি হাদীসে বিনা অনুমতিতে কারো চিঠি পড়তেও কঠোরভাবে নিষেধ করা করা হয়েছে।
.
(ইসলামের চিরস্থায়ী বিধান হলো, কারো প্রশংসা করতে হলে তার অসাক্ষাতে আর সমালোচনা করতে হলে সাক্ষাতে করতে হয়। এই বিধান লংঘন করে যখনই কারো অসাক্ষাতে নিন্দা, সমালোচনা বা কুৎসা রটানো হয়, তখন তা শরীয়ত বিরোধী কাজে পরিণত হয়। এ ধরনের কাজ তিন রকমের হতে পারে এবং তিনটিই কবীরা গুনাহ। প্রথমত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে অভিযোেগ বা দোষ আরোপ করা হয়, তা যদি মিথ্যা, বা প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণহীন হয়, তবে তা নিছক অপবাদ। আরবীতে একে বুহতান বা কাযাফ বলা হয়। ইসলামী শরীয়তে এটি শুধু কবীরা গুনাহ নয়, বরং আইনত দণ্ডনীয় ফৌজদারী অপরাধ। শরীয়তে এর শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে ৮০ ঘা বেত্রদন্ড এবং চির জীবনের জন্য সাক্ষ্য দানের অযোগ্য ঘোষিত হওয়া। ইতিপূর্বে ২২ নং কবীরা গুনাহতে এটি সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ আরোপিত দোষ বা অভিযোেগ যদি সত্য হয়, কিন্তু তা ইসলামের বিধি অনুসারে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে ও নিভৃতে বুঝিয়ে বলে আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়ার পরিবর্তে কোন ব্যক্তি বিশেষের কাছে ফাস করে দিয়ে উভয়ের মধ্যে শক্রতার সৃষ্টি করা বা তাদের সুসম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তাকে নামীমা বা চোগলখুরি বলে। তৃতীয়তঃ যদি ব্যক্তি বিশেষের পরিবর্তে সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশ করে দিয়ে তাকে জনসমক্ষে হেয় করার চেষ্টা করা হয়, তবে তাকে গীবত বলা হয়। অসাক্ষাতে পরনিন্দার এই তিনটি রূপই কবীরা গুনাহ ও ঘৃণ্য অপরাধ। তিনটিতেই লংঘিত হয় হক্কুল ইবাদ তথা মানবাধিকার। কেননা এদ্বারা অবৈধভাবে তার মান ইজ্জত ও সন্ত্রম বিনষ্ট করা হয়। অথচ তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হয় না। তাই এ অপরাধ সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষমা না করলে আল্লাহও ক্ষমা করেন না। – অনুবাদক)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেনঃ “সেই ব্যক্তির অনুসরণ করোনা, যে কথায় কথায় শপথ করে, যে লাঞ্ছিত, যে অসাক্ষাতে নিন্দা করে, যে একজনের কথা আরেকজনের কাছে লাগায়।” (সূরা আল কালাম)
সহীহ বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযীতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা) বলেছেন যে, চোগলখোর জান্নাতে যাবে না। অপর হাদীসে আছে যে, একবার রাসূল (সা) দুটি কবরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেনঃ “এই দুটি কবরের অধিবাসীদ্বয় আযাবে ভুগছে। তবে কোন বড় ধরনের গুনাহের জন্য তারা আযাবে ভুগছেন। একজন পেশাব করে ভালোভাবে পবিত্র হতোনা। আর অপরজন চোগলখুরী করে বেড়াতো। অতঃপর তিনি খেজুরের দুটি কাটা ডাল নিয়ে উভয়ের কবরে একটি করে গেড়ে দিলেন এবং বললেনঃ ডাল দুটো না শুকানো পর্যন্ত হয়তো ওদের আযাব কম থাকবে।”
এই হাদীসে “কোন বড় ধরনের গুনাহের জন্য তারা আযাবে ভুগছেনা” এ উক্তির অর্থ এই যে, তাদের ধারণায় তাদের কৃত গুনাহ তেমন বড় ধরনের ছিলনা। এ জন্য কোন কোন রেওয়াতে আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “তবে অবশ্যই তা বড় গুনাহ ছিল।” সহীহ বুখারী, মুসলিম ও মুয়াতায়ে ইমাম মালিকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ তোমরা সবচেয়ে অধম লোক দেখতে পাবে সেই ব্যক্তিকে, যে বিভিন্ন জনের কাছে গিয়ে নিজেকে বিভিন্ন আকারে প্রকাশ করে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ায় দোমুখো আচরণ করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাকে দুটো আগুনের জিহবা দেবেন। দোমুখো আচরণ দ্বারা বুঝায় দু’জনের সাথে দু’রকমের কথা বলা। ইমাম গাযযালী (রহ) বলেছেনঃ “দোমুখো লোক বলতে সাধারণতঃ চোখলখোরকে বুঝানো হয়ে থাকে, যে একজনকে গিয়ে বলে অমুক তোমার সম্পর্কে এরূপ কথা বলেছে। সংশ্লিষ্ট দু’পক্ষের যে কোন পক্ষ অথবা তৃতীয় কোন পক্ষ যে গেপনীয় বিষয় প্রকাশ করা অপছন্দ করে, সেটার প্রকাশ করাই চোগলখুরি, চাই তা কথা, লেখা, ইশারা ইংগিত বা অন্য যে কোন মাধ্যমেই করা হোক না কেন, এবং প্রকাশিত বিষয়টি কারো কথা বা কাজ বা কোন দোষত্রুটি- যাই হোক না কেন। মোটকথা, চোগলখুরি হলো, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কেউ অথবা তৃতীয় কেউ অপছন্দ করে এমন কোন গেপন তথ্য ফাঁস করা। মানুষের যে অবস্থাই নজরে পড়ুক না কেন, তা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করায় যদি সমাজের উপকার না হয় বা তা দ্বারা সমাজকে কোন গুনাহ থেকে রক্ষা করা না যায়, তাহলে তা থেকে বিরত থাকা উচিত।” ইমাম গাযযালী আরো বলেছেনঃ যার কাছে কেউ কারো সম্পর্কে চোগলখুরি করে, এবং বলে যে, অমুক তোমার সম্পর্কে এই এই কথা বলেছে। তার উচিত ছয়টি কাজ করা। প্রথমতঃ তাকে অবিশ্বাস করবে। কেননা সে একজন চোগলাখার ও ফাসেক। সে বিশ্বাসযোগ্য নয়। দ্বিতীয়তঃ তাকে ঐ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলবে, কাজটির তীব্র সমালোচনা করবে এবং সদুপদেশ দেবে। তৃতীয়তঃ তাকে মন থেকে ঘৃণা করবে। কেননা সে আল্লাহর কাছে ঘৃণিত। আর আল্লাহর ঘৃণিত ব্যক্তিকে ঘৃণা করা ওয়াজিব। চতুর্থতঃ যে ব্যক্তির সম্পর্কে চোগলখোর খারাপ সংবাদ দিয়েছে, তার সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে খারাপ ধারণা পোষণ করবেনা। কেননা আল্লাহ বলেছেনঃ “তোমরা বেশী ধারণা পোষণ থেকে বিরত থাকবে। কেননা কিছু কিছু ধারণায় গুনাহ হয়। পঞ্চমতঃ তার বর্ণিত সংবাদকে এতটা গুরুত্বও দেবেনা যে, তার সত্যাসত্য তদন্ত করতে আরম্ভ করে দেবে। কেননা আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা গেয়েন্দাগিরি করোনা।” যষ্ঠতঃ চোগলখোরকে দেয়া উপদেশ নিজেই যেন লংঘন না করে। চোগলখোর যা বলেছে, তা নিয়ে সে নিজে যেন অন্যের সাথে আলোচনা না করে। বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি হযরত উমর ইবনু আবদুল আযীযকে কারো সম্পর্কে একটি খারাপ খবর দিল। তিনি বলেনঃ তুমি যদি চাও তাহলে তোমার খবরটা নিয়ে অগ্রসর হই। তুমি যদি সত্য বলে থাক, তাহলে তোমার ওপর এই আয়াত প্রযোজ্য হবে, “তোমাদের কাছে কোন ফাসেক যদি কোন খবর নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা নিয়ে তদন্ত চালাও।” আর যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও, তাহলে তোমার ওপর এই আয়াত প্রযোজ্য হবে, “যে পশ্চাতে নিন্দা করে, যে একের কথা অপরের কাছে লাগায়।” আর যদি তুমি চাও, তোমাকে মাফ করে দিই। সে বললোঃ আমীরুল মুমিনীন, আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমি আর এ কাজ করবোনা।”
হযরত হাসান বাসরী বলেনঃ যে ব্যক্তি তোমার কাছে অন্যের কথা লাগায়, জেনে রেখ, সেও তোমার কথা অন্যের কাছে লাগায়।
এক ব্যক্তি জনৈক বিশিষ্ট আলেমের নিকট এসে অপর একজনের নামে বিভিন্ন দুর্নাম আরোপ করতে লাগলো। তখন ঐ আলেম বললেনঃ “তুমি আমার কাছে তিনটি অপরাধ করেছ। প্রথমতঃ আমার এক দীনী ভাই-এর প্রতি আমার মনে ক্ষোভ ও বিদ্বেষের সৃষ্টি করেছ। দ্বিতীয়তঃ তার কারণে আমার মনকে দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত করেছ। তৃতীয়তঃ তুমি আমার কাছে বিশ্বস্ততা হারিয়েছ। কোন কোন মনীষী বলতেনঃ “যে ব্যক্তি কারো গালি তোমার নিকট পৌঁছায়, সে যেন নিজেই তোমাকে গালি দেয়।” এক বক্তি হযরত আলী (রা) এর নিকট এসে বললো : অমুক আপনার নামে দুর্নাম রটিয়েছে ও গালি দিয়েছে। তিনি বললেনঃ আমাকে তার কাছে নিয়ে চল। সে তাকে ঐ ব্যক্তির কাছে নিয়ে গেল। লোকটি ভেবেছিল, হযরত আলী তার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু তিনি তাকে গিয়ে বললেনঃ “ওহে ভাই! তুমি যা বলেছ, তা যদি সত্য হয়, তবে আল্লাহর কাছে আমি ক্ষমা চাই। আর যদি মিথ্যা হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে তোমার জন্য ক্ষমা চাই।” কোন কোন তাফসীরকার সূরা লাহাবের যে জায়গায় আবু লাহাবের স্ত্রীকে “হাম্মালাতাল হাতাব” বলা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেনঃ এর শাব্দিক অর্থ কাষ্ঠ বহন কারীনী। সে একজন চোগলখোর ছিল। চোগলখুরি স্বভাবটাকে কাষ্ঠ বলা হয়েছে, কেননা কাষ্ঠ যেমন আগুন জ্বালাতে সাহায্য করে, তেমনি চোগলখুরি দু’জনের মধ্যে শক্রতার আগুন জ্বালাতে সাহায্য করে।
একটি ঘটনাঃ কথিত আছে যে, একবার এক ব্যক্তি দেখতে পেল, বাজারে একজন নিজের দাস বিক্রি করছে। বিক্রেতা এভাবে হাকডাক করছেঃ “এ গেলামের একটু চোগলখুরির অভ্যাস ছাড়া আর কোন দোষ নেই।” লোকটি এ দেষটাকে গুরুত্ব না দিয়ে গেলামকে কিনে নিল। গেলামটি তার বাড়ীতে থাকতে লাগলো। কিছুদিন পর সে তার মনিবের স্ত্রীকে বললোঃ আমার মনিব আর একটি বিয়ে করতে চাইছেন এবং তিনি আপনার প্রতি আর তেমন অনুরক্ত নেই। আপনি কি এই বিয়ে ঠেকাতে চান এবং আপনার স্বামী আগের মত আপনাকে ভালোবাসুক- এটা চান, তাহলে উনি যখন ঘুমাবেন, তখন একটা ছুরি দিয়ে তার কণ্ঠনালীর ওপরের একটা পশম কেটে নিয়ে নিজের কাছেই রাখুন। অপর দিকে মনিবকে সে বললো, আপনার স্ত্রী তলে তলে অন্য একজনকে ভালোবাসে এবং সে তার সাথে চক্রান্ত করে আজ আপনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় যবাই করবে। আপনি যদি বাঁচতে চান তাহলে আপনি না ঘুমিয়ে কেবল ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকবেন। দেখবেন, আপনার স্ত্রী কিভাবে আপনার গলায় ছুরি চালাতে চেষ্টা করে। মনিব ঠিক তাই করলো। রাত্রে যেই তার স্ত্রী ছুরি নিয়ে তার গলার পশম কাটতে গেছে, অমনি মনিব উঠে তার হাত ধরে বসলো এবং ছুরি কেড়ে নিয়ে স্ত্রীকে সংগে সংগে খুন করলো। অতঃপর স্ত্রীর আত্মীয়রা এসে মনিবকে খুন করলো। অতঃপর উভয় পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এবং তাতে উভয় পক্ষ সর্বস্বান্ত হয়ে গেল।
.
রাসূল (সা) বলেছেনঃ “মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকী ও তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া কুফরী।” (আবু দাউদ ব্যতীত সকল সহীহ হাদীস গ্রন্থ) তিনি আরো বলেছেন যে, “কোন মুমিনকে অভিশাপ দেয়া তাকে হত্যা করার শামিল।” (ইবনে মাজা ব্যতীত সকল সহীহ হাদীস গ্রন্থ) সহীহ মুসলিমে বর্ণিত যে, রাসূল (সা) বলেছেন, “অভিশাপকারীরা কিয়ামতের দিন কারো সুপারিশকারীও হবেনা, সাক্ষীও হবেনা।” হাদীসে আরো আছে : “মুমিন কখনো অভিশাপকারী, কটুভাষী, অশ্লীলভাষী ও অশালীনভাষী হতে পারেনা।” সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে যে রাসূল (সা) বলেছেনঃ “কোন বান্দা যখন কাউকে অভিশাপ করে (বদ দোয়াও অভিশাপের কাছাকাছি- অনুবাদক) তখন তা আকাশে উঠে যায়। কিন্তু আকাশের দরজা বন্ধ করে দিয়ে তার প্রবেশ রোধ করা হয়। অতঃপর তা পৃথিবীতে নেমে আসে। কিন্তু তার জন্য পৃথিবীর পথ রুদ্ধ করা হয়। অতঃপর তা ডানে ও বামে ছুটাছুটি করতে থাকে। যখন বেরুবার কোন পথ পায়না, তখন যার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করা হয়েছে, সে তার উপযুক্ত হলে তার ওপর কার্যকর হয়, নচেত স্বয়ং অভিশাপকারীর ওপরই কার্যকর হয়।” হযরত ইমরান বিন হাসীন বর্ণনা করেন যে, একবার রাসূল (সা) কোন সফরে যান। সেই সফরে এক আনসারী মহিলা স্বীয় বাহন উটকে উচ্চস্বরে গালাগালি করে উঠলো ও অভিশাপ দিল। এটা শুনতে পেয়ে রাসূল (সা) বললেনঃ “এই উটের পিঠে যে সব মালপত্র আছে তা নামাও এবং উটটাকে ছেড়ে দাও। কেননা সে তো অভিশপ্ত। ইমরান বলেনঃআমি যেন এখনো মহিলাটিকে দেখতে পাচ্ছি যে, অসহায়ভাবে লোকদের সাথে হেঁটে চলছে, কেউ তাকে সাহায্য করতে আসছেনা।” (সহীহ মুসলিম) রাসূল (সা) আরো বলেছেন : সবচেয়ে খারাপ সুদ হলো, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে অপমানজনক ভাষা প্রয়োগ করা।
অবশ্য কতিপয় সুনির্দিষ্ট পাপ কার্যে জড়িত ব্যক্তিকে অভিশাপ দেয়া যায়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ “অত্যাচারীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। . . . মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ।” রাসূল (সা) বিভিন্ন ব্যক্তিকে, যথা সুদের সাথে জড়িত, তাহলীলের সাথে জড়িত এবং ঘুষ, মদ ও জুয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তিকে অভিসম্পাত করেছেন, যারা চুলের সাথে চুল গিরে দিয়ে বাঁধে, ভ্রুর চুল ফেলে দেয়, বিপদে ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার ও আহাজারী করে, চুল কামায় ও কাপড় ছিড়ে ফেলে দেয়, তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন। তিনি চিত্রকর, ভাস্কর ও যারা অন্যের জমি দখল করার জন্য সীমানার চিহ্ন তুলে ফেলে বা পাল্টে ফেলে, তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন। অনুরূপভাবে তিনি নিজের পিতামাতার ওপর অভিশাপ বর্ষণকারী, গালিগালাজ বর্ষণকারী, কোন অন্ধ ব্যক্তিকে পথভ্রষ্টকারী, জীবজন্তুর সাথে কুকর্মকারী, সমকামী, নিজ স্ত্রীর সাথে পশ্চাদ্বারে সংগমকারী, ভাগ্য গণনাকারী ও তার কাছে গমনকারী, মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চস্বরে ক্রন্দনকারীনী এবং পেশাদার ক্রন্দনকারীনী ও তার সহকর্মী, জনগণ অপছন্দ ফরা সত্ত্বেও জোরপূর্বক তাদের নেতা বা শাসকের পদ দখলকারী, স্বামী অসন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় যে স্ত্রী রাত কাটিয়ে দিয়েছে, আযান শুনতে পেয়েও যে ব্যক্তি বিনা ওযরে জামায়াতে উপস্থিত হয়নী, আল্লাহ ছাড়া আর কারো নামে জীবজন্তু জবাইকারী, চোর, সাহাবীগণকে গালিগালাজকারী, পুরুষের বেশভূষা ও সাদৃশ্যধারনকারী স্ত্রী লোক এবং স্ত্রীলোকের বেশভূষা ও সাদৃশ্য ধারনকারী পুরুষ, মানুষের চলাচলের পথে মলমূত্র ত্যাগকারী, হাতে মেহেদী ও চোখে সুর্মা ব্যবহারে বিমুখ (অর্থাৎ সৌন্দর্য চর্চার মাধ্যমে স্বামীকে খুশী রাখতে অনাগ্রহী) রমনী, স্বামী স্ত্রী ও চাকর-মনিবের সম্পর্ক বিনষ্টকারী, ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে সংগমকারী, কোন মানুষকে অস্ত্র দেখিয়ে ভীতি প্রদর্শনকারী, যাকাত দিতে অস্বীকারকারী, নিজের পিতা নয় এমন কাউকে পিতা এবং নিজের মনিব নয় এমন কাউকে মনিব পরিচয় দানকারী, কোন জীবজন্তুর গায়ে তপ্ত লোহার শলাকা দিয়ে দাগ অংকনকারী, শরীয়তের বিধান অনুসারে কোন অপরাধীর বিরুদ্ধে বিচারক কর্তৃক শান্তি ঘোষণা করার সম্ভাবনা দেখে তা থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য সুপারিশকারী ও সুপারিশ গ্রহণকারী, স্বামীগৃহ থেকে স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে কোথাও গমনকারীনী মহিলা, স্বামীর বিছানা ছেড়ে রাত যাপনকারিনী মহিলা, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সৎকাজে আদেশ দান অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করণে বিমুখ, মদ পানকারী ও মদের উৎপাদন, ক্রয়বিক্রয়, পরিবহন ও এইসবের সাথে জড়িত ও সহযোগিতাকারীকে অভিশাপ দিয়েছেন। অপর হাদীসে আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ ছয় ব্যক্তিকে আমি অভিশাপ দিয়েছি, আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন এবং প্রত্যেক নবী অভিশাপ দিয়েছেন, আর প্রত্যেক নবীর দোয়া কবুল হওয়া নিশ্চিত। সেই ছয় ব্যক্তি হলো আল্লাহর নির্ধারিত অদৃষ্টকে অস্বীকারকারী, আল্লাহর কিতাবে কোন কিছু সংযোজনকারী, আল্লাহ যাদেরকে সম্মানিত করেছেন তাদেরকে অপমানিত করা এবং আল্লাহ যাদেরকে অপমানিত করেছেন তাদেরকে সম্মানিত করার জন্য জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলকারী, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তাকে হালাল প্রতিপন্নকারী এবং আল্লাহ যা হালাল করেছেন তাকে হারাম প্রতিপন্নকারী এবং আমার প্রদর্শিত পথ বর্জনকারী। এছাড়া রাসূল (সা) প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারকারীকে, হস্তমৈথুনকারীকে, কোন মহিলা ও তার কন্যাকে এক সাথে বিবাহকারীকে, ঘুষখোর, ঘুষদাতা ও ঘুষের দালালকে, বিদ্যা গেপনকারীকে, খাদ্য গেলাজাতকারীকে, কোন মুসলমানের অপমানকারীকে, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মজলুম মুসলমানকে যে সাহায্য করে না তাকে, নির্দয় শাসককে, বিয়ে না করার জন্য প্রতিজ্ঞাকারী পুরুষ ও স্ত্রীকে এবং কোন নির্জন প্রান্তরে বিনা প্রয়োজনে একাকী গমনকারীকেও অভিসম্পাত করেছেন।
নিরপরাধ মুসলমানকে অভিশাপ দেয়া সর্বসম্মতভাবে হারাম। আর অসচ্চরিত্র লোকদেরকে নামোল্লেখ ব্যতিরেকে অভিসম্পাত করা সর্বসম্মতভাবে বৈধ। যেমন কেউ যদি বলে, অত্যাচারীদের ওপর বা মিথ্যাবাদীদের ওপর বা কাফেরদের ওপর অভিসম্পাত, তবে তা সর্বসম্মতভাবে জায়েয। পক্ষান্তরে কোন পাপ কাজে জড়িত ব্যক্তিকে নামোল্লেখপূর্বক অভিসম্পাত করা সম্পর্কে মতভেদ আছে। অনেকের মতে এটা জায়েয। কিন্তু ইমাম গাযযালীর মতে, যে ব্যক্তি তওবা ছাড়া মারা গেছে বলে নিশ্চিত জানা যায়, যেমন আবু লাহাব, আবু জেহেল, ফিরাউন, হামান প্রমুখ কেবলমাত্র তাদের ওপরই অভিশাপ করা জায়েয। কারো অকল্যাণ কামনা করে বদ দোয়া করাও অভিশাপের কাছাকাছি। যে যে ক্ষেত্রে অভিশাপ অবৈধ, সেই সেই ক্ষেত্রে বদ দোয়াও অবৈধ। এমনকি যালেমের বিরুদ্ধে বদ দোয়া করা অনুচিত তবে প্রতিরোধের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হলে মযলুম স্বয়ং যালেমের বিরুদ্ধে বদদোয়া করতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও অভিসম্পাত করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
.
আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ “তোমরা ওয়াদা পালন কর। নিশ্চয়ই ওয়াদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” যুজ্জাজ বলেন আল্লাহ যা কিছু করতে আদেশ করেছেন এবং যা কিছু করতে নিষেধ করেছেন, তার সবই ওয়াদার অন্তর্ভুক্ত। কেননা এসব পালনে মুসলমনিরা আল্লাহর সাথে ওয়াদাবদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেনঃ “হে মুমিনগণ! তোমরা চুক্তি পালন কর।” হযরত ইবনে আব্বাস বলেনঃ চুক্তির অর্থ যা কিছু কুরআনে হালাল ও হারাম করা হয়েছে এবং যা কিছু নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত করা হয়েছে। মুকাতিল বলেনঃ চুক্তি অর্থ কুরআনের মাধ্যমে বান্দার ওপর আরোপিত হালাল ও হারাম এবং বৈধ ও অবৈধ সংক্রান্ত আল্লাহর বিধান এবং মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পাদিত যাবতীয় চুক্তি, অংগীকার ও প্রতিশ্রুতি।
রাসূল (সা) বলেছেনঃ চারটি দোষ যার ভেতরে থাকবে সে পুরোপুরি মুনাফিক। আর যার ভেতরে এর কোন একটি দোষ থাকবে, তার মধ্যে মুনাফেকীর একটা উপাদান থাকবে যতক্ষণ সে তা বর্জন না করে যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে, যখন তার কাছে কোন জিনিস আমানত তথা গচ্ছিত রাখা হয়, তখন সে তাতে, খেয়ানত করে। যখন সে কোন অংগীকার করে বা প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন সে তা ভংগ করে এবং যখন কারো সাথে তার বিরোধ দেখা দেয়, তখন সে সীমা ছাড়িয়ে যায়। (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম) একটি হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ বলেনঃ তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি বাদী হব। যে ব্যক্তি ওয়াদা করে তার খেলাপ করেছে, যে ব্যক্তি কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রী করে তার মূল ভোগ করে এবং যে ব্যক্তি কোন কর্মচারী নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পুরো কাজ আদায় করে কিন্তু তার পারিশ্রমিক দেয় না। (সহীহ আল বুখারী) রাসূল (সা) আরো বলেনঃ যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মারা যায় যে, সে কোন বাইয়াতে (অংগীকারে) আবদ্ধ নয়, সে জাহেলী মৃত্যু বরণ করে। (সহীহ মুসলিম) রাসূল (সা) আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি কোন নেতার আনুগত্যের অংগীকার করে, তার উচিত সাধ্যমত তার আনুগত্য করা।” (সহীহ মুসলিম)
.
আল্লাহ বলেনঃ “যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করোনা। নিশ্চয় চোখ, কান হৃদয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” ইমাম ওয়াহেদী এ আয়াতের তাফসীর প্রসংগে বলেনঃ অর্থাৎ তুমি যা জানেনা তা বলোনা। কাতাদা বলেনঃ অর্থাৎ তুমি যা দেখনি তা দেখেছ, যা শোননি তা শুনেছ এবং যা জানোনি তা জেনেছ বলে দাবী করোনা। এক কথায়, কোন ব্যাপারে যা জানোনা তা বলো না। হযরত ইবনে আব্বাস আয়াতের শেষাংশের ব্যাখ্যায় বলেনঃ অর্থাৎ চোখ কান ও হৃদয় কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সে কথা আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন। এ কথার মাধ্যমে যা দেখা হারাম তা দেখতে, যা শুনা হারাম তা শুনতে এবং যে ইচ্ছা পোষণ করা নিষেধ তা পোষণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ”আল্লাহই একমাত্র অদৃশ্যজ্ঞ। তিনি ভার অদৃশ্য জ্ঞান নিজের মনোনীত কোন রাসূলকে ব্যতীত আর কাউকে দেন না।” ইমাম ইবনুল জাওযী বলেনঃ অর্থাৎ অদৃশ্য বা গায়েবের জ্ঞানের ওপর আল্লাহর একচ্ছত্র অধিকার। এ অধিকারে তার কোন শরীক নেই। এই গায়েবের জ্ঞান তিনি কোন মনোনীত রাসূল ছাড়া কাউকে দেননা। শুধুমাত্র রাসূলকে যতটুকু গায়েবের জ্ঞান দিতে চান দেন। কেননা এই গায়েব বা অদৃশ্যের তথ্য জানানোই নবীর নবুয়তের প্রমাণ। এ থেকে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি নক্ষত্রকে অদৃশ্য জ্ঞানের উৎস মনে করে সে কাফের। রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন জ্যোতিষী বা ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে যায় এবং সে যা বলে তা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মাদ (সা) এর ওপর নাযিলকৃত কিতাব ও ওহিকে অস্বীকার করে। (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) এক হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেনঃ আমার বান্দাদের ভেতর কেউ হয় মুমিন এবং কেউ হয় কাফের। যে বলে যে, আল্লাহর অনুগ্রহে বৃষ্টি হয়েছে, সে আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রে অবিশ্বাসী। আর যে বলে যে, বৃষ্টি হয়েছে অমুক ধরনের আবহাওয়ার কারণে বা বাতাসের কারণে, সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী এবং নক্ষত্রে বিশ্বাসী।
অভিজ্ঞ মনীষীগণ বলেছেনঃ বিশেষ ধরনের আবহাওয়ার কারণে বৃষ্টি হয়েছে একথা বলার সময় কোন মুসলমান যদি মনে করে যে, বিশেষ ধরনের আবহাওয়াই বৃষ্টির স্রষ্টা, তাহলে সে নিঃসন্দেহে কাফের ও মুরতাদ হয়ে যায়। আর যদি কেউ মনে করে যে, বিশেষ ধরনের আবহাওয়া বৃষ্টির আলামত বা লক্ষণ মাত্র, তাহলে কাফের হবেনা। তবে অধিকাংশ আলেমের মতে এরূপ না বলাই ভালো।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ যে ব্যক্তি কোন গণকের কথায় বিশ্বাস করে, তার চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল হয়না। সহীহ বুখারী ও মুসলিমের এক হাদীসে আছে যে, একদল লোক রাসূল (সা) কে গণক ও জ্যোতিষীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন। “ও সব কিছুই নয়।” “ওসব কিছুই নয়।” তখন কয়েকজন বললেনঃ হে রাসূল! অমুক জ্যোতিষী না অমুক কথা বলেছে? রাসূল (সা) বললেনঃ “কিছু সত্য কথা জিনেরা সংগ্রহ করে, অতঃপর তা তার মনিব মানুষটির কানে কানে বলে দেয়। অতঃপর সে তার সাথে শত শত মিথ্যা সংযজিত করে প্রচার করে।” বুখারী শরীফের এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেন। ফেরেশতারা মেঘের ভেতরে নেমে আসে অতঃপর যে সব বিষয়ের যে ফায়সালা হয়ে গেছে তা নিয়ে আলোচনা করে। শয়তান এই সব কথা আড়ি পেতে শুনে জ্যোতিষীদের কাছে পৌঁছায়। অতঃপর জ্যোতিষীরা তার সাথে শত শত মিথ্যা যোগ করে।”
রাসূল (সা) আরো বলেনঃ”পাখির উড্ডয়নের গতি ও অন্যান্য আলামত দ্বারা শুভাশুভ নির্ণয় করা সুস্পষ্ট শিরক।”
.
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “যে সব স্ত্রী অবাধ্যতা প্রকাশ করবে বলে তোমরা আশংকা কর, তাদেরকে উপদেশ দাও, বিছানায় তাদের থেকে পৃথক হও, এবং মারধর কর। এতে যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা চিন্তা করোনা।”
ইমাম ওয়াহেদী বলেনঃ এখানে অবাধ্যতার অর্থ হলো স্বামীর অবাধ্য হওয়া এবং তার বিরুদ্ধাচরণ করা। আতা বলেনঃ স্ত্রী স্বামীর প্রতি এ যাবত যে ধরনের আনুগত্য দেখিয়ে আসছিল তা পাল্টে যাওয়া এবং স্বামীকে বিনা ওযরে যৌন মিলনে বাধা দান এর পর্যায়ভুক্ত। “উপদেশ দাও” অর্থ হলো, আল্লাহর কিতাব ও তার আদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়া। ইবনে আব্বাস বলেনঃ বিছানায় পৃথক হওয়ার অর্থ হলো, স্ত্রীর দিকে পিঠ দিয়ে শয়ন করা এবং কথা না বলা। শা’বী ও মুজাহিদের মতে, এর অর্থ বিছানা একেবারেই পৃথক করে ফেলা এবং স্ত্রীর সাথে এক বিছানায় শয়ন না করা। আর “মারধর কর” অর্থ মৃদু মারধর করা, যাতে খুব বেশী ব্যথা না পায়। ইবনে আব্বাসের মতে খালি হাতে কিল থাপ্পড় ইত্যাদি এর বেশী নয়।
রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যখন কোন স্বামী স্বীয় স্ত্রীকে বিছানায় ডাকে এবং সে সেই ডাকে সাড়া দেয়না, তখন ভোর হওয়া অবধি তার ওপর ফেরেশতারা অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে।” (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
অপর হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেন : তিন ব্যক্তির নামায এবং কোন সৎকাজ কবুল হয়না; পালিয়ে যাওয়া গেলাম বা চাকর যতক্ষণ ফিরে না আসে, স্বামীর অবাধ্য স্ত্রী, যতক্ষণ স্বামী তার ওপর সন্তুষ্ট না হয়, এবং মদ খেয়ে মাতাল হওয়া ব্যক্তি যতক্ষণ তার হুঁশ ফিরে না আসে।”
রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন নারীকে সর্ব প্রথম যে প্রশ্ন করা হবে তা হবে তার নামায ও স্বামী সম্পর্কে। রাসূল (সা) আরো বলেনঃ কোন
পক্ষে তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া নফল রোযা রাখা এবং তার ঘরে অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া বৈধ নয়। (সহীহ আল বুখারী) রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ আমি যদি কাউকে কারো সামনে সিজদার আদেশ দিতাম, তবে স্ত্রীকে স্বামীর সামনে সিজদা করার আদেশ দিতাম। (তিরমিযী) একবার এক মহিলা রাসূলের (সা) নিকট স্বীয় স্বামীর কথা উল্লেখ করলে তিনি বললেনঃ “তুমি তার তুলনায় কতটুকু মর্যদার অধিকারী তা ভেবে দেখ। সে তোমার বেহেশত ও দোজখ।” (নাসায়ী) রাসূল (সা) আবো বলেনঃ”স্ত্রী সব সময়ই স্বামীর মুখাপেক্ষী। তথাপি যে স্ত্রী স্বামীর কৃতজ্ঞ নয়, আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না।” (নাসায়ী) রাসূল (সা) আরো বলেছেন : “স্ত্রী যখন স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার গৃহ ত্যাগ করে, তখন সে ফিরে না আসা পর্যন্ত ফেরেশতারা তারপর অভিসম্পাত করতে থাকে।” (তাবরানী) রাসূল (সা) আরো বলেনঃ “স্বামীকে সন্তুষ্ট রেখে যে স্ত্রী মারা যায়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (তিরমিযী) তবে স্বামীকে কোন হারাম কাজে সহযোগিতা করা স্ত্রীর পক্ষে বৈধ নয়, এবং অবৈধ কাজে সহযোগিতা না করায় স্বামী অসন্তুষ্ট হলেও তার জন্য সে গুনাহগার হবে না। বৈধ সীমার মধ্যে স্বামীর পরিপূর্ণ আনুগত্য করা স্ত্রীর জন্য ওয়াজিব। স্বামীর অনুমতি ছাড়া নিজেকে এমন কোন কাজে নিয়োজিত করা বৈধ নয়, যার ফলে স্বামী তার সাহচর্য থেকে সাময়িকভাবে বঞ্চিত হয়। স্বামীর ধনসম্পদে বিনা অনুমতিতে হস্তক্ষেপ করা স্ত্রীর বৈধ নয়। নিজের অধিকারের ওপর স্বামীর অধিকারকে এবং নিজের আত্মীয়দের অধিকারের ওপর স্বামীর আত্মীয়দের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়া স্ত্রীর পক্ষে অপরিহার্য। সব সময় পূর্ণ পরিচ্ছন্নতা সহকারে স্বামীর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নিজের সৌন্দর্যের জন্য তার ওপর বড়াই করা এবং স্বামীর মধ্যে বিদঘুটে কিছু থাকলে তার জন্য তাকে দোষারোপ করা বাঞ্ছনীয় নয়।
স্ত্রীর উচিত স্বামীর সামনে সর্বদা লজ্জাশীলা থাকা, তার সামনে চোখ নামিয়ে রাখা, তার আদেশের অনুগত থাকা, তার কথা মনোযোগের সাথে শোনা, তার কথা বলার সময় চুপ থাকা, তার গৃহে আগমনের সময় দরজায় এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানানো, তার বাইরে যাওয়ার সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া ও কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা, সে যা যা অপছন্দ করে তা থেকে দূরে থাকা, তার ঘুমানোর সময় তার কাছে উপস্থিত থাকা, তার অনুপস্থিতিতে তার গৃহ, সম্পত্তি ও নিজের সতিত্বকে আমানত হিসাবে সংরক্ষণ করা, নিয়মিত দাঁত মাজা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ও তার কাছে নিজেকে সব সময় সুসজ্জিত ও সুবাসিত রাখা, তার অসাক্ষাতে তার কোন নিন্দা না করা। তার আত্মীয়স্বজনের যত্ন করা এবং তার ক্ষুদ্র উপকারকে বড় করে দেখা।
রাসূল (সা) বলেছেন “স্ত্রী যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিক ঠিক মত পড়বে, রমযান মাসের রোযা ঠিকমত রাখবে এবং স্বামীর অনুগত থাকবে, তখন সে যে দরজা দিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করতে চাইবে, করতে পারবে।” (আহমাদ, তাবরানী)
রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ “স্বামীর অনুগত স্ত্রীর জন্য পাখি, মাছ, সূর্য, চন্দ্র ও ফেরেশতারা পর্যন্ত আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চায়। আর স্বামীর অবাধ্য স্ত্রীর জন্য আল্লাহ, ফেরেশতা ও সমগ্র মানব জাতির পক্ষ থেকে অভিসম্পাত আসে। যে স্ত্রী স্বামীর সামনে মুখ কালো করে থাকে, সে পুনরায় হাসিমুখ হয়ে স্বামীকে সন্তুষ্ট
করা পর্যন্ত আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্ট থাকবেন। যে স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাড়ীর বাইরে যাবে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত ফেরেশতাদের অভিশাপ কুড়াতে থাকবে।”
রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ চার রকমের নারী জান্নাতে এবং চার রকমের নারী জাহান্নামে যাবে : আল্লাহর ও স্বামীর অনুগত সতী নারী, অধিক সন্তান উৎপাদনে সক্ষম, ধৈর্যশীল ও অল্পে তুষ্টা নারী, লজ্জাশীলা নারী, যে স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের সতিত্ব ও স্বামীর সম্পদ সংরক্ষণ করে এবং তার উপস্থিতিতে তার সাথে বাকসংযম করে এবং শিশু সন্তানসহ বিধবা হওয়ার পর যে নারী সন্তাদেরকে আঁকড়ে ধরে থাকে এবং তাদের ক্ষতির আশংকায় বিয়ে না করে তাদের লালন পালনে নিয়োজিত থাকে। আর যে চার রকমের নারী জাহান্নামী হবে তারা হচ্ছেঃ (১) যে নারী স্বামীর প্রতি কটু বাক্য বর্ষণ ও
ভর্ৎসনা করে এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের সতিত্ব রক্ষা করেনা, আর সে উপস্থিত থাকলে তাকে কটুবাক্য দ্বারা কষ্ট দেয় (২) যে নারী স্বামীর ওপর তার সাধ্যাতীত বোঝা চাপায় এবং যা তার ক্ষমতার বাইরে, তা তাকে করতে বাধ্য করে। (৩) যে নারী পর পুরুষ থেকে নিজেকে ঢেকে রাখেনা (পর্দার বিধান মেনে চলে না) এবং সাজসজ্জা করে ও রূপের প্রদর্শনী করে বাইরে বের হয় (৪) যে নারীর পানাহার ও ঘুম ছাড়া আর কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই এবং নামায আল্লাহ রাসূল ও স্বামীর আনুগত্য করতে চায়না। এসব দোষ যে নারীর রয়েছে, সে যখন স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে বাইরে বের হয়, তখন সে অভিশাপ কুড়ায় ও জাহান্নামের যোগ্য হয়। কেবলমাত্র তওবা দ্বারা সে এই পরিণাম থেকে রক্ষা পেতে পারে। রাসূল (সা) বলেছেনঃ (মেরাজের রাতে) আমি জাহান্নাম পরিদর্শন করেছি। দেখেছি যে, সেখানকার অধিকাংশ অধিবাসী মহিলা। কারণ তারা আল্লাহ, রাসূল ও স্বামীর আনুগত্য কম করে এবং “তাবাররুজ” করে। তাবাররুজ হলো, বাইরে চলাফেরার সময় সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরা, অধিক পরিমাণে সাজসজ্জা করা এবং অধিক সৌন্দর্য প্রদর্শনী করে জনসাধারণকে প্রলুব্ধ করা, অন্য কথায় বেপর্দায় চলাফেরার নামই তাবাররুজ। রাসূল (সা) বলেছেনঃ নারী পর্দায় থাকার জন্যই সৃষ্ট। সে যখন ঘর থেকে বের হয়, তখন শয়তান তাকে অভিনন্দন জানায়।
হাদীসে আছেঃ নারীরা যতক্ষণ আপন গৃহে অবস্থান করে ততক্ষণই আল্লাহর চোখে সবচেয়ে মর্যাদাশীলা থাকে। হাদীসে আরো আছে যে, নারী আপন গৃহে অবস্থান, আল্লাহর ইবাদাত ও স্বামীর আনুগত্যের মাধ্যমে যতটা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে, ততটা আর কোনভাবে করতে পারে না। একবার হযরত আলী (রা) স্বীয় স্ত্রী হযরত ফাতিমা (রা) কে জিজ্ঞাসা করলেন নারীর মংগল কিসে? হযরত ফাতিমা বললেনঃ ‘বেগানা পুরুষের প্রতি দৃষ্টিপাত না করা এবং বেগানা পুরুষকে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করার সুযোগ না দেয়ার মধ্যেই নারীর মংগল নিহিত।’
হযরত আলী (রা) বলতেনঃ “তোমাদের কি লজ্জা নেই, তোমাদের কি আত্মসম্মানবোধ নেই যে, তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে বাইরে যেতে দাও, আর তারা পরপুরুষদের দিকে তাকায় এবং পরপুরুষেরাও তাদের দিকে তাকায়? আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাতে বর্ণিত আছে যে, একদিন হযরত আয়িশা (রা) ও হযরত হাফসা (রা) রাসূল (সা) এর নিকট উপস্থিত ছিলো। এই সময় অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাকতুম এলেন। রাসূল (সা) তাঁর স্ত্রীদ্বয়কে বললেনঃ তোমরা তার কাছে থেকে পর্দায় চলে যাও। তারা উভয়ে বললেনঃ উনি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখতেও পাননা, চেনেনও না। রাসূল (সা) বললেনঃ তোমরা দু’জনও অন্ধ নাকি? তোমরা কি তাকে দেখতে পাওনা?
এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, পুরুষ ও নারী উভয়েই পরস্পরের প্রতি তাকানো থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সূরা নূরে বলেছেন : “মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা যেন নিজ নিজ দৃষ্টি সংযত রাখে ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।, , , আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা যেন নিজ নিজ দৃষ্টি সংযত রাখে ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।”
হযরত আলী (রা) বলেনঃ একবার আমি ও ফাতিমা রাসূল (সা) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে দেখলাম, তিনি অত্যন্ত অধীরভাবে কাদছেন। আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসূল, আপনার জন্য আমার পিতামাতার প্রাণ উৎসর্গ হোক! আপনি কি জন্য কাঁদছেন। রাসূল (সা) বললেনঃ “হে আলী! মিরাজের রাত্রে আমি আমার উম্মাতের নারীদেরকে নানা রকমের আযাব ভোগ করতে দেখেছি। সেই কঠিন আযাবের কথা মনে করে কাঁদছি। আমি দেখেছি, এক মহিলাকে তার চুল দিয়ে জাহান্নামের আগুনের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে তার মাথার ঘিলু টগবগ করে ফুটছে। আর এক মহিলাকে দেখলাম, তার জিহবা টেনে লম্বা করে তা দিয়ে তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তার গলায় গরম পানি ঢালা হচ্ছে। আর এক মহিলাকে দেখলাম, তার দুই পা দুই স্তনের সাথে এবং দুই হাত কপালের চুলের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর এক মহিলাকে দেখলাম তার স্তনে রশি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর এক মহিলাকে দেখলাম, তার মাথা শুকরের মাথার মত। তার দেহ পাধার দেহের মত এবং তাকে হাজার হাজার রকমের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। আর এক মহিলাকে দেখলাম, সে কুকুরের আকৃতি পেয়েছে। আগুন তার মুখ দিয়ে ঢুকছে এবং মলদ্বার দিয়ে বেরুচ্ছে। আর ফেরেশতারা তার মাথায় লোহার হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে।”
হযরত ফাতিমা উঠে দাঁড়ালেন এবং এইসব মহিলার এইসব আযাবের কারণ কি জানতে চাইলেন। রাসূল (সা) বললেনঃ “হে ফাতিমা! যে মহিলাকে চুল দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সে পর পুরুষের দৃষ্টি থেকে নিজের মাথাকে ঢেকে রাখতোনা। যে মহিলাকে তার জিহ্বা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সে প্রতিবেশীকে কটুবাক্যদ্বারা কষ্ট দিত। স্তনে রশি দিয়ে বেঁধে যাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সে স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের সতিত্ব সংরক্ষণ করতোনা, অর্থাৎ ব্যভিচারীনী ছিল। আর যার দুই পা দুই স্তনের সাথে এবং দুই হাত কপালের চুলের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সে সহবাস ও ঋতুজনিত অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন করতোনা এবং নামায নিয়ে তামাশা করতো। যার মাথা শুকরের মত ও দেহ পাঁধার মত হয়ে গেছে, সে ছিল চোগলখোর ও মিথ্যাবাদী। আর যে কুকুরের আকারে রূপান্তরিত হয়েছে, সে ছিল হিংসুটে এবং দান করে খোঁটা দিত।
রাসূল (সা) বলেছেনঃ কোন নারী নিজের স্বামীকে কষ্ট দিলে জান্নাতের হুর উক্ত নারীকে অভিসম্পাত দেয়।
উল্লেখ আছে যে, পিতামাতা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনকে দেখার জন্য এবং অন্যান্য জরুরী প্রয়োজনে স্বামীর অনুমতি নিয়ে এবং পর্দা সহকারে বাইরে যাওয়াতে কোন দোষ নেই।
(খ) স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর অধিকার লংঘন
স্ত্রী যেমন স্বামীর আনুগত্য করতে ও তাকে সন্তুষ্ট রাখতে আদিষ্ট, তেমনি স্বামীও আদিষ্ট স্ত্রীর প্রতি সদাচরণ ও বিনম্র ব্যবহার করতে, তার পক্ষ থেকে কোন দুর্ব্যবহার ইত্যাদি প্রকাশ পেলে তাতে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করতে এবং স্ত্রীকে খোরপোশ ও সম্মানজনক জীবন যাপনের সুযোগ দিতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার কর। রাসূল (সা) বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখো। মনে রেখো, তোমাদের স্ত্রীদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপরও স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে। তোমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার এই যে, তোমরা তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে, তাদের খোরপোশ দেবে। আর তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার এই যে, তারা তাদের সতিত্ব ও শ্লীলতা রক্ষা করবে এবং তোমাদের কাছে যারা অবাঞ্ছিত তাদেরকে গৃহে প্রবেশ করতে দেবেনা। (ইবনে মাজাহ, তিরমিযী)
ইবনে হাব্বান বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে তার পরিবার পরিজনের সাথে অধিকতর সদ্ব্যবহারকারী।” কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে, “সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে আপন পরিবারের সাথে সর্বাধিক বিনম্র আচরণকারী। রাসূল (সা) স্ত্রীলোকের প্রতি অত্যধিক বিনম্র আচরণ করতেন। রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নিজ স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে ধৈর্য ধারণ করবে, সে হযরত আইয়ুব (আ) এর মত পুরস্কৃত হবে। আর যে স্ত্রী স্বামীর দুর্ব্যবহারে ধৈর্য ধারণ করবে, সে ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিমের ন্যায় পুরস্কৃত হবে।
এক হাদীসে আছে যে, এক ব্যক্তি হযরত উমরের নিকট নিজের স্ত্রীর দুর্ব্যবহারের অভিযোগ পেশ করার জন্য উপস্থিত হলো। সে হযরত উমরের বাড়ীর ফটকে দাঁড়িয়ে তার বাইরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। এই সময় শুনতে পেল, হযরত উমরের স্ত্রী তাকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করছেন। কিন্তু হযরত উমর তার কোন জবাব না দিয়ে নীরবে সহ্য করছেন। এটা শোনার পর লোকটি ফিরে যেতে উদ্যত হলো। সে ভাবলো, এমন দুর্দন্ড ও প্রতাপান্বিত খলিফার যখন এই অবস্থা, তখন আমি আর কোথাকার কে? ঠিক এই সময় হযরত উমর বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, লোকটি চলে যাচ্ছে। তিনি ডেকে বললেন তুমি কেন এসেছিলে আর কেনই বা দেখা না করে চলে যাচ্ছ? সে বললোঃ আমীরুল মুমিনীন! আমার সাথে আমার স্ত্রী যে দুর্ব্যবহার করে ও কটুবাক্য প্রয়োগ করে, তার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করার জন্য আমি আপনার কাছে এসেছিলাম। কিন্তু শুনতে পেলাম স্বয়ং আপনার স্ত্রীও তদ্রপ। তাই ফিরে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম যে, আমীরুল মুমিনীনের অবস্থা যখন এরূপ, তখন আমি আর কোথাকার কে? হযরত উমর বললেনঃ শোন, ‘ভাই আমার ওপর তার কিছু অধিকার আছে বলেই আমি তাকে সহ্য করলাম। দেখ, সে আমার খাবার রান্না করে, রুটি বানায়, কাপড় ধোয়, এবং আমার সন্তানদের দুধ খাওয়ায়। অথচ এসব কাজ তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তবে এসব কাজ করে দিয়ে সে আমার মনকে হারাম উপার্জন থেকে ফিরিয়ে রাখে। এ জন্যই আমি তাকে সহ্য করি। লোকটি বললোঃ আমীরুল মুমিনীন! আমার স্ত্রীও তদ্রুপ। হযরত উমর বললেনঃ “তাহলে তাকে সহ্য করতে থাক, ভাই। দুনিয়ার জীবনটা তো নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী।”
কথিত আছে যে, একবার জনৈক নেককার ব্যক্তির এক নেককার দ্বীনী ভাই তার বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি প্রতি বছর একবার বেড়াতে আসতেন। এসে দরজায় কড়া নাড়তেই তার স্ত্রী দরজা খুলে দিয়ে আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করলেনঃ “কে আপনি?” আগন্তুক বললেনঃ “আমি আপনার স্বামীর দ্বীনী ভাই। তাকে দেখতে এসেছি।” স্ত্রী অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় বললোঃ “সে জংগলে কাঠ কাটতে গেছে। আল্লাহ যেন ওকে নিরাপদে ফিরিয়ে না আনে। আল্লাহ যেন ওর অমুক করে, তমুক করে ইত্যাদি ইত্যাদি …।” এভাবে অনুপস্থিত স্বামীর বিরুদ্ধে সে প্রচন্ডভাবে নিন্দাবাদ করতে লাগলো। ইতিমধ্যে সহসা তার স্বামী এসে উপস্থিত হলেন। একটা সিংহের পিঠে করে বিরাট এক কাঠের বোঝা নিয়ে এবং নিজে তার ওপর আরোহণ করে পাহাড়েরর দিক থেকে ফিরে এলেন। তিনি তাঁর দ্বীনী ভাইকে সালাম করলেন এবং মোবারকবাদ জানালেন। অতঃপর তিনি গৃহের ভেতরে ঢুকে সিংহের পিঠ থেকে কাঠ নামালেন এবং সিংহকে বললেনঃ যাও, আল্লাহ তোমার কল্যাণ করুন। অতঃপর তিনি তার দ্বীনী ভাইকেও ভেতরে এনে বসালেন। তার স্ত্রী তখনো তাকে বকা ঝকা করছিল। অথচ তার স্বামী ছিলেন নিরুত্তর। অতঃপর খাওয়া দাওয়া শেষে অতিথি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। তিনি তার বন্ধুর মুখরা স্ত্রীর ব্যবহার ও তার বন্ধুর ধৈর্য দেখে অবাক হয়ে গেলেন। পরের শছর একই সময় তিনি আবার এলেন। তিনি কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলঃ দরজায় কে? আগন্তুক বললেন আমি আপনার স্বামীর দ্বীনী ভাই অমুক। তখন মোবারকবাদ বলে মহিলা দরজা খুলে দিল। সে আরো বললো। “আপনি বসুন, আমার স্বামী ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই ফিরে আসবেন। আল্লাহ তাকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনুন, ইত্যাদি ইত্যাদি।” আগন্তুক তার সুমিষ্ট ব্যবহার ও কথাবার্তায় অবাক হয়ে গেলেন। একটু পরেই গৃহকর্তা কাঠের বোঝা নিয়ে বাড়ী ফিরে এলেন। কিন্তু এবার কাঠের বোকা সিংহের পিঠে করে নয় – নিজের পিঠে করে আনলেন। অতঃপর তারা অতিথিকে যত্ন করে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় করলেন। বিদায় কালে তিনি তার বন্ধুকে বললেন “গত বছর যখন এসেছিলাম তখন আপনার স্ত্রীর কর্কশ ব্যবহার ও দুর্বিনীত ভাষণ শুনেছিলাম। তিনি সর্বদাই আপনার নিন্দা করছিলেন। আর আপনি সিংহের পিঠে করে কাঠের বোঝা বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এ বছর দেখলাম আপনার স্ত্রীর সুমধুর ব্যবহার। অথচ আপনি বোঝা বয়ে এনেছেন নিজের পিঠে করে। ব্যাপারটা কি বলুন তো?” তিনি বললেন: “হে ভাই! সেই কর্কশভাষিণী নারীর মৃত্যু হয়েছে। আমি তার ওপর ধৈর্য ধারণ করতাম। ফলে আল্লাহ সেই সিংহটিকে আমার বশীভূত করে দিয়েছিনি। পরে আমি এই সদাচারীনী মহিলাকে বিয়ে করেছি। আমি তার সাথে সুখে আছি। কিন্তু সেই সিংহ আমার হাতছাড়া হয়ে গেল। তাই আমি নিজের ঘাড়ে করে কাঠ বহন করতে বাধ্য হয়েছি এই অনুগত সৎস্বভাবা স্ত্রীর সাথে আমার সুখময় জীবন যাপনের খাতিরে।
.
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ”যারা আল্লাহকে ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে অভিসম্পাত করবেন এবং তাদের জন্য লাঞ্ছনাকর শান্তি প্রস্তুত রাখবেন।” এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে ইকরামা বলেনঃ যারা ছবি তৈরী করে তারাই আল্লাহ ও রাসূলকে কষ্ট দেয়। রাসূল (সা) বলেছেনঃ যারা ছবি তৈরী করে, তাদেরকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে এবং বলা হবেঃ “তোমরা যা বানিয়েছিলে, তাতে প্রাণ দাও।” (সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম) হযরত আয়িশা (রা) বর্ণনা করেন যে, একবার রাসূল (সা) এক সফর থেকে গৃহে ফিরলেন। তখন আমি আমার ঘরের দেয়ালের কুঠুরিকে এমন একটা পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম, যাতে কতকগুলো ছবি ছিল। পর্দাটি দেখা মাত্র রাসূল (সা) এর মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেনঃ “হে আয়িশা! যারা নিজের সৃষ্টিকে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করবে, কিয়ামতের দিন তারাই কঠোরতম শান্তি ভোগ করবে।” হযরত আয়িশা বলেনঃ এরপর আমি সেই পর্দাটা কেটে দু’ভাগ করে ফেলি এবং তা দিয়ে দুটো বালিশ বানাই। (বুখারী মুসলিম) রাসূল (সা) বলেছেনঃ “প্রত্যেক চিত্রকর দোজখবাসী হবে। তার প্রতিটি ছবির জন্য তাকে এক একটা প্রাণ দেয়া হবে এবং প্রত্যেকটা প্রাণ জাহান্নামের আগুনে আযাব ভোগ করবে।” (বুখারী-মুসলিম) রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি পৃথিবীতে কোন প্রাণীর প্রতিচ্ছবি বা ছবি তৈরী করেছে, কিয়ামতের দিন তাকে ঐ প্রতিচ্ছবি বা ছবিতে প্রাণ সঞ্চার করার নির্দেশ দেয়া হবে। কিন্তু তা সে কখনো পারবেনা।” (বুখারী)
রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ “আল্লাহ তায়ালা বলেন যে, যে ব্যক্তি আমার সৃষ্টির মত সৃষ্টি করার ঔদ্ধত্য দেখায়, তার চেয়ে বড় অপরাধী আর কে আছে। সে একটা দানাই সৃষ্টি করুক না! একটা গমের দানা অথবা একটি কলাই সৃষ্টি করুক তো দেখি।” (বুখারী, মুসলিম)
তিরমিযীতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন দোজখ থেকে একটি মাথা উঠে বলবে যে, তিন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়ার জন্য আমার কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। এই তিনজন হলো, আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার প্রতিপন্নকারী, স্বৈরাচারী শাসক, এবং চিত্রকর।” বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত অপর হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “যে গৃহে কুকুর কিংবা প্রাণীর ছবি আছে, সেই গৃহে ফিরিশতারা প্রবেশ করেনা।” ইমাম খাত্তাবী বলেন যে, এ দ্বারা রহমত ও বরকতের ফিরিশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতারা সকল গৃহেই যেয়ে থাকে। আর কুকুর দ্বারা বুঝানো হয়েছে নিছক সখের বশে পালিত কুকুরকে। শিকার ধরা, পাহারা দেয়া ইত্যাদি কাজের জন্য কুকুরের প্রয়োজন হলে তাতে কোন বাধা নেই। আর ছবি বলতে বুঝানো হয়েছে যে কোন প্রাণীর ছবি বা প্রতিকৃতিকে, চাই তা যে জিনিসের ওপর যেভাবেই রক্ষিত থাকনা কেন। এ ধরনের সকল ছবি ও প্রতিকৃতিকে সাধ্যমত অপসারণ বা ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, হযরত আলী (রা) সকল ছবি বা প্রতিকৃতিকে ধ্বংস করার এবং সকল উচু কবরকে সমান করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
.
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি (শোক দুঃখ প্রকাশার্থে) মুখ ও কপাল চাপড়ায়, পোশাক ছিড়ে ফেলে, এবং জাহেলী প্রথা অনুযায়ী দোয়া করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” ইতিপূর্বে আমরা বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করেছি যে, রাসূল (সা) উচ্চৈস্বরে ক্রন্দন, চুল কামানো ও চুল টেনে ছেড়া এবং কাপড় ছেড়ার মাধ্যমে শোক প্রকাশকারিনীকে অভিসম্পাত করেছেন। এ সকল কাজ সর্বসম্মতভাবে হারাম। অনুরূপভাবে মুখ কপাল চাপড়ানো, মুখ খামচানো এবং মৃত্যু ও ধ্বংস কামনা করে দোয়া করাও হারাম। হযরত উম্মে আতিয়া (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) আমাদের কাছ থেকে অংগীকার নিয়েছেন যে আমরা কখনো উচ্চৈস্বরে কেঁদে শোক প্রকাশ করবোনা। (বুখারী) রাসূল (সা) আরো বলেছেনঃ “দুটি কাজ কুফরীর পর্যায়ভুক্ত। কারো বংশ নিয়ে টিটকারি দেয়া এবং মৃত ব্যক্তির ওপর উচ্চৈস্বরে কান্নাকাটি করা।” (মুসলিম)
আবু দাউদে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) উচ্চৈস্বরে ক্রন্দনকারিনী ও তার শ্রোতাদেরকে অভিসম্পাত দিয়েছেন। বুখারী, ইবনে মাজা ও নাসায়ীতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) তীব্র যন্ত্রণায় অচেতন হয়ে পড়লে তার এক আত্মীয়া মহিলা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। হুঁশ ফিরে এলে তিনি বলেনঃ রাসূল (সা) যাকে অবাঞ্ছিত গণ্য করেছেন, আমিও তাকে অবাঞ্ছিত গণ্য করি। উচ্চৈস্বরে ক্রন্দন, চুল ছেড়া, কাপড় ছেড়া ইত্যাদির মাধ্যমে শোক প্রকাশকে রাসূল (সা) অবাঞ্ছিত গণ্য করেছেন।
সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ উচ্চৈস্বরে কাদার কারণে মৃত ব্যক্তি কবরে আযাব ভোগ করে। রাসূল (সা) বলেছেনঃ দুটি নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ ও পাপজনক শব্দ থেকে আমাকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে একটি গানবাজনার শব্দ, অপরটি বিপদের সময় মুখ চাপড়ানো ও শয়তানের মত চিৎকার করার শব্দ। বর্ণিত আছে, যে হযরত ওমর (রা) এক পেশাদার ক্রন্দসীকে স্বহস্তে প্রহার করেন এবং বলেনঃ আমি এই ক্রন্দসীকে প্রহার করছি কেননা তাকে প্রহার করা নিষিদ্ধ নয়, সে তোমাদের অংশীদার হয়ে কাদেনা, বরং তোমাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য কাঁদে। সে তোমাদের মৃতদেরকে কবরে কষ্ট দেয় এবং জীবিতদের শোক যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। কেননা সে ধৈর্য ধারণ করতে নিষেধ করে, অথচ আল্লাহ তার আদেশ দিয়েছেন, সে ব্যাকুলভাবে দিতে উদ্বুদ্ধ করে, অথচ আল্লাহ তা করতে নিষেধ করেছেন।
আলেমগণ বলেছেন পেশাদার ভাড়াটে ক্রন্দসীদের ক্রন্দন এবং উচ্চৈস্বরে দিশাহারা হয়ে ক্রন্দন করা ছাড়া নিছক শোক বিহবল হয়ে মৃদুস্বরে আন্তরিকভাবে ক্রন্দন হারাম নয়। সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) রুগ্ন সা’দ বিন উবাদাকে দেখতে গিয়ে কেঁদে দেন। তার কান্না দেখে সমবেত সাহাবীগণও কাঁদেন। অতঃপর রাসূল (সা) বললেনঃ শুনে রাখ, আল্লাহ চোখের পানি ফেলা ও হৃদয়ের আবেগ প্রকাশ করার জন্য আযাব দেননা তিনি শুধু এই জিনিসটির জন্য শাস্তি দেন অথবা অনুগ্রহ করেন—এ কথা বলে জিহবার দিকে ইশারা করলেন। অপর রেওয়ায়েতে আছে যে, রাসূল (সা) কেঁদে দিলে হযরত সা’দ জিজ্ঞাসা করলেন “হে আল্লাহর রাসূল! এ কী?” তিনি বললেনঃ “এটা বান্দাদের হৃদয়ে আল্লাহর সৃষ্টি করা করুণা ও সহানুভূতি। আল্লাহ করুণা ও সহানুভূতিসম্পন্ন বান্দাদের প্রতিই করুণা বর্ষণ করেন।” সহীহ আল বুখারীতে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) যখন তার মুমূর্ষ পুত্র ইবরাহীমের কাছে গেলেন, তখন রাসূল (সা) এর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তা দেখে আবদুর রহমান বিন আওফ বললেনঃ হে রাসূল! আপনিও কাঁদছেন! রাসূল (সা) বললেনঃ এটা স্নেহ মমতার প্রকাশমাত্র। অতঃপর বললেনঃ “চোখ অশ্রু বর্ষণ করে ও হুদয় মর্মাহত হয়। কিন্তু আল্লাহ যাতে সন্তুষ্ট, তা ছাড়া আমরা আর কিছু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারিনা। হে ইবরাহীম, তোমার বিচ্ছেদে আমরা ব্যখিত।”
“এখানে উল্লেখ্য যে, বিপদ আপদে ও প্রিয়জনের বিচ্ছেদে মাত্রাতিরিক্ত কান্নাকাটিকে নিরুৎসাহিত করার কারণ এই যে, আল্লাহ ও তার রাসুল (সা) ধৈর্য ও আত্মসংযমের নির্দেশ দিয়েছেন এবং হতাশা ও অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : “হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামায দ্বারা শক্তি অর্জন কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।…… আর আমি অবশ্য অবশ্য তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, সম্পদহানি, প্রাণহানি ও শস্যহানি দ্বারা পরীক্ষা করবো। যারা ধৈর্য ধারণ করে, যারা বিপদে পতিত হয়ে বলে যে, আমরা আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবো। তাদেরই সুসংবাদ দিয়ে দাও।” (সূরা আল বাকারা) হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন-এর তাৎপর্য এই যে, তিনি তাদেরকে সাহায্য করেন এবং লাঞ্ছিত করেন না। আর যারা বিপদে পতিত হলে বলে যে, আমরা আল্লাহরই জন্য”, এ কথার মর্ম এই যে, “আমরা আল্লাহর বান্দা, তাই তিনি আমাদের সাথে যা ইচ্ছা, তাই আচরণ করতে পারেন।”
রাসূল (সা) বলেছেনঃ “মুমিন বান্দার ওপর যে বিপদই আসুক না কেন, এমন কি তার পায়ে যদি একটা কাটাও ফোটে, তবে তা দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহ মুছে দেন।” (সহীহ মুসলিম) তিরমিযীতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “কোন বান্দার সন্তান মারা গেলে আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন যে, যখন তোমরা আমার বান্দার সন্তানের প্রাণ সংহার করছিলে, তখন সে কী বলেছে? ফিরিশতারা বলেনঃ “সে তোমার প্রশংসা করেছে এবং তোমার কাছে তার ফিরে যাওয়ার কথা স্মরণ করেছে।” তখন আল্লাহ বলেনঃ আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটা বাড়ী তৈরী কর এবং তার নাম রাখ “বাইতুল হামদ” (প্রশংসার বাড়ী)। এক হাদীসে কুদসীতে আছে যে, আল্লাহ বলেনঃ”যখন আমার বান্দার কোন প্রিয়জনের মৃত্যু হয় এবং সে তাতে ধৈর্য ও সংযম অবলম্বন করে, তখন জান্নাত ছাড়া তাকে দেয়ার মত আর কোন প্রতিদান আমার কাছে থাকেনা।” (সহীহ আল বুখারী)
রাসূল (সা) বলেছেনঃ “আল্লাহর ফায়সালা অম্লান বদনে মেনে নেয়া আদম সন্তানের জন্য সৌভাগ্যজনক আর তাতে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্টি হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।” হযরত উমর (রা) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে যে, মৃত্যুর ফিরিশতা মুমিনের প্রাণ সংহার করে বিদায় হওয়ার সময় যখন তার পরিবার পরিজন বুক চাপড়ে, চুল এলিয়ে এবং নিজেদের মৃত্যু ও ধ্বংস কামনা করে শোক প্রকাশ করতে আরম্ভ করে, তখন তা দেখে তিনি ক্ষণিকের জন্য বাড়ীর ফটকে দাড়ান এবং বলেনঃএত হাহুতাশ ও কান্নাকাটি কেন? আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের কারো আয় কমাইনি, কারো জীবিকা ছিনিয়ে নেইনি এবং কারো ওপর যুলুম করিনি। তোমাদের অভিযোগ ও অসন্তোষ যদি আমার বিরুদ্ধে হয়ে থাকে, তাহলে খোদার কসম, আমি আল্লাহর আদেশের অনুগত। আর যদি তোমাদের ক্ষোভ মৃত ব্যক্তির ওপর হয়ে থাকে, তাহলে তোমরা কাফের হয়ে গেছ। আমাকে তো আরো বহুবার আসতে হবে এবং এক সময় তোমাদের কেউ আর অবশিষ্ট থাকবেনা। রাসূল (সা) বলেনঃ আল্লাহর কসম, লোকেরা যদি তার এ ভাষণ শুনতো এবং তাকে দেখতো, তাহলে তাদের মৃতের কথা ভুলে যেত এবং নিজেদের জন্যই কেঁদে দিশেহারা হতো।
কারো বিপদের খবর শুনলে শোক বা সহানুভূতি প্রকাশ করা ছওয়াবের কাজ। তিরমিযী শরীফে আছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কোন বিপন্নের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে, তাহলে স্বয়ং ঐ বিপন্ন ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করলে যে ছওয়াব পায়, সেও তদ্রুপ হওয়াব পাবে। রাসূল (সা) আরো বলেছেন : সন্তানহারা মাতাকে সমবেদনা জ্ঞাপন ও সান্ত্বনা দান করলে আল্লাহ জান্নাতের মূল্যবান পোশাক পরাবেন।” (তিরমিযী)
উল্লেখ্য যে, শোক ও সমবেদনা প্রকাশ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সান্তনা দান, ধৈর্য ধারণের উপদেশ দান, তার দুঃখ, শোক ও বিপদের অনুভূতিকে হালকা করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তাই এটি মুস্তাহাব। এটি সৎ কাজের আদেশ দান অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা এবং সততা ও খোদাভীতির কাজে সহযোগিতার আওতাভুক্ত। সমবেদনা ও সান্ত্বনার সর্বোত্তম ভাষা রাসূল (সা) এর নিম্নোক্ত হাদীস থেকে জানা যায়। সহীহ আল বুখারী ও সহী মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এর এক কন্যা রাসূল (সা) এর কাছে এই মর্মে খবর পাঠালো যে, তার এক পুত্র মৃত্যুর মুখোমুখি। রাসূল (সা) দূতকে বললেনঃ “যাও, ওকে (কন্যাকে) বল যে, আল্লাহ যা নেন, তা তারই জিনিস, আর যা দেন, তাও তারই জিনিস। সব কিছুই বান্দার কাছে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য রয়েছে। তাকে বল সে যেন ধৈর্য ধারণ ও সংযম অবলম্বন করে।”
এক সাহাবীকে দরবারে অনুপস্থিত দেখে রাসূল (সা) তার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। এক ব্যক্তি বললোঃ হে রাসূল! তার ছেলে মারা গেছে। রাসূল (সা) তার সাথে সাক্ষাত করে তার প্রতি সমবেদনা জানালেন। অতঃপর বললেনঃ “শোনো, তোমার ছেলে সারা জীবন তোমরা কাছে থাকুক-এটা তোমার বেশী পসন্দনীয়, না সে তোমার আগে গিয়ে জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকুক এবং তুমি মারা গেলে সে তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দিক-এটা পসন্দনীয়? সাহাবী বললেন সে আমার আগে জান্নাতে গিয়ে আমার জন্য দরজা খুলে দিক এটাই পসন্দীয়। রাসূল (সা) বললেনঃ তাহলে তোমার জন্য সেটিই নির্ধারিত রইল। সাহাবী জিজাসা করলেনঃ এটা কি শুধু আমার জন্য? রাসূল (সা) বললেনঃ না, সকল মুসলমানের জন্য।” (আহমাদ, নাসায়ী)
হযরত আবু মূসা (রা) বর্ণনা করেন যে, একদিন রাসূল (সা) জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে দেখলেন এক মহিলা একটি কবরের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদছে। রাসূল (সা) তাকে বললেনঃ হে আল্লাহর বাদী, আল্লাহকে ভয় কর ও ধৈর্য ধারণ কর। মহিলা বললোঃ ওহে আল্লাহর বান্দা, আমি এক সন্তানহারা জননী। সুতরাং আমি যা করছি তা আমার জন্য অশোভন কিছু নয়।” রাসূল (সা) আবার বললেনঃ তুমি ধৈর্য ধারণ কর। মহিলা বললোঃ “যথেষ্ট হয়েছে। তোমার কথা শুনেছি। এবার তুমি যাও।” রাসূল (সা) তার কাছ থেকে চলে গেলেন। জনৈক সাহাবী মহিলাকে দেখে বললেনঃ এই ব্যক্তি তোমাকে কি বললোঃ মহিলা সব কথা জানালো। সাহাবী বললেনঃ তুমি জান ঐ ব্যক্তি কে? সে বললোঃ না। সাহাবী বললো সর্বনাশ! উনিতো রাসূলুল্লাহ (সা)। মহিলা একথা শোনা মাত্র ছুটে গিয়ে রাসূল (সা) এর সাথে দেখা করলো এবং বললোঃ হে রাসূল! আমি ধৈর্য ধারণ করবো। রাসূল (সা) বললেনঃ “প্রথম আঘাতের সময়ই ধৈর্য ধারণ করা উচিত।” অর্থাৎ আকস্মিক বিপদ দেখা দেয়ার সময় ধৈর্য অবলম্বন করা উত্তম। নচেত পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিকভাবেই মন শান্ত হয়ে আসে।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, আবু তালহা নামক সাহাবীর একটি ছেলে মারা যায়। সে সময় তিনি বিদেশে ছিলেন এবং ছেলের মৃত্যুর কথা মোটেই জানতেন না। অতঃপর তিনি যখন বাড়ী এলেন, তার স্ত্রী পরিবারের সবাইকে আগে ভাগে বলে দিলেন যে, “ছেলের মৃত্যুর কথা তোমরা কেউ এর কাছে ফাঁস করোনা। যখন যা বলতে হয় আমিই বলবো।” অতঃপর তিনি আবু তালহার খাবার দাবারের ব্যবস্থা করলেন। রাত্রে শোবার পর তাকে বললেনঃ ওহে আবু তালহা, কেউ যদি কাউকে কোন জিনিস ধার হিসাবে দেয়, অতঃপর তা ফেরত চায়, তাহেল তা ফেরত দিতে অস্বীকার করা কি তার উচিৎ তালহা বললেনঃ না। তখন তার স্ত্রী সকল ঘটনা জানালেন এবং বললেনঃ “তাহলে তোমার ছেলের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ কর।” এ কথা শুনে আবু তালহা রাগান্বিত হলেন। তিনি বললেনঃ তুমি এত দেরীতে এটা আমাকে জানালে? অতঃপর তিনি রাসূল (সা) এর নিকট গিয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। শুনে রাসূল (সা) বললেনঃ “গত রাতে তোমাদের আচরণকে আল্লাহ অভিনন্দিত করেছেন। হাদীসে আরো আছে যে, “ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও প্রশস্ত কোন জিনিস কাউকে দেয়া হয়নি।”
বর্ণিত আছে যে, যখন হযরত উসমান (রা) কে ঘাতকরা আঘাত করে, তখন তার দড়ির ওপর দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকা অবস্থায় তিনি বলেনঃ “লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনা যালেমীন। হে আল্লাহ! আমি তাদের বিরুদ্ধে তোমার কাছে সাহায্য চাই এবং সকল বিষয়ে সাহায্য চাই, আর আমাকে তুমি যে পরীক্ষায় নিক্ষেপ করেছ, তাতে আমি ধৈর্য চাই।”
জামে তিরমিযীতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বলেনঃ “যার দুটো অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান মারা যায়, সে জান্নাতে যাবে।” সহীহ মুসলিমে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল (সা) বলেনঃ “অপ্রাপ্ত বয়স্ক মৃত সন্তানেরা জান্নাতের সর্বত্র অবাধে ঘুরে বেড়াবে। কেয়ামতের মাঠে তারা তাদের পিতামাতাকে পেয়ে তাদেরকে জাপটে ধরবে এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ না করিয়ে ছাড়বেনা।”
হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহ) বলেনঃ যৌবনে আমি মদে আসক্ত ছিলাম। এই সময় আমার দুবছর বয়স্কা একটি মেয়ে মারা যায়। মেয়েটিকে আমি খুবই ভালোবাসতাম। তাই তার মৃত্যুতে আমি এত ব্যথিত হই যে, মদ পান অনেকটা কমিয়ে দেই। একদিন ঘুমিয়ে আমি স্বপ্নে দেখি, কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে এবং আমি আমার কবর থেকে উঠেছি। সহসা দেখলাম বিরাটকায় একটি অজগর সাপ আমাকে তাড়া করছে। আমি তার ভয়ে ছুটে পালাতে লাগলাম। কিন্তু সাপটা তেড়ে আসতেই লাগলো। পথিমধ্যে সাদা কাপড় পরিহিত এক বৃদ্ধকে দেখে বললাম, “দয়া করে আমাকে আশ্রয় দিন। একটা সাপ আমাকে তেড়ে আসছে।” তিনি বললেনঃ “আমি দুর্বল। আর এই সাপ আমার চেয়ে সবল। তুমি ছুটে পালাতে থাক। আল্লাহ হয়তো তোমাকে রক্ষা করবেন।” আমি ছুটতে ছুটতে একটি পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে উঠলাম। সেখানে দেখলাম কতকগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খেলা করছে। তাদের প্রত্যেকের মুখ চাঁদের মত উজ্জ্বল। দেখলাম, তাদের মধ্যে আমার মেয়েটিও রয়েছে। সে আমাকে দেখে নিচে নেমে এল এবং একটি প্রদীপ সাপের দিকে ছুঁড়ে মারলো। এতে সাপটি পালিয়ে গেল। এরপর আমার মেয়ে আমার কোলে এসে কুরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করলো। সেই সময় কি এখনো আসেনি যখন মুমিনদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে নিবিষ্ট হবে এবং তিনি যে সত্য বিধান নাযিল করেছেন তার প্রতি আকৃষ্ট হবে?” আমি বললামঃ ওহে কচি মেয়ে! তুমি আবার কুরআনও জান নাকি? সে বললোঃ আব্বু! আমরা তোমাদের চেয়েও বেশী জানি। আমি বললাম তোমার সাথীরা কারা এবং এখানে তোমরা কী কর? সে বললোঃ আমরা এখানে সবাই মুসলমান বাবামার মৃত শিশু। কিয়ামত পর্যন্ত এখানে বাবামায়ের আগমনের অপেক্ষায় থাকবে। আমি বললামঃ ওহে আমার কচি মেয়ে! এই সাপটা আমার পিছু নিয়েছিল কেন জান? সে বললোঃ আব্বু ওতো তোমার অসৎ কাজ। তুমি ওকে নিজেই শক্তিশালী বানিয়েছ। আমি বললাম ঐ বৃদ্ধ লোকটি ক? সে বললোঃ সে তো তোমার সৎ কাজ-যা তোমার অবহেলার কারণে দুর্বল হয়ে গেছে। তুমি তওবা কর। তাহলে নাজাত পাবে। এরপর আমার ঘুম ভেংগে যায় এবং আমি তৎক্ষণাৎ তওবা করি।
রাসূল (সা) বলেছেনঃ কোন বান্দার ওপর যখনই কোন বিপদ মুসিবত আসে, তখন তা হয় তাকে এমন কোন গুনাহ থেকে পবিত্র করার জন্য আসে, যাকে আল্লাহ ঐ বিপদ ছাড়া আর কোন ভাবে ক্ষমা করবেন না বলে স্থির করেছেন, নচেৎ তাকে এমন কোন উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করার জন্য আসে, যার জন্য আল্লাহ আর কোন বিকল্প রাখেননি।
উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি বিপদ মুসিবতে পড়ে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” বলবে এবং দোয়া করবে যে, হে আল্লাহ! আমাকে এই মুসিবতে আশ্রয় দাও এবং আমাকে এর চেয়ে ভালো বিকল্প দান কর, আল্লাহ তাকে উপযুক্ত পুরস্কার ও উত্তম বিকল্প দেবেন। হযরত উম্মে সালমা (রা) বলেনঃ”এরপর আমার স্বামী আবু সালমা মারা গেলে আমি অনুরূপ দোয়া করেছিলাম। ফলে আল্লাহ আমাকে রাসূলুল্লাহর (সা) ন্যায় স্বামী দান করলেন।” (সহীহ মুসলিম)
বিচারপতি শুরাইহ (রাহ) বলতেনঃ আমি কোন বিপদে পড়লে চারবার আল্লাহর প্রশংসা করি। প্রথমবার এই জন্য যে, বিপদটা আরো মারাত্মক হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। দ্বিতীয়বার যখন আল্লাহ আমাকে সহ্য করার তওফীক দেন। তৃতীয়বার যখন আমাকে “ইন্নালিল্লাহ …” পড়ার সুযোগ দেন। এবং চতুর্থবার যখন দেখি যে বিপদটা আমার ইসলাম থেকে পদস্খলনের আকারে হয়নি।
পক্ষান্তরে কেউ যদি বিপদাপদে অস্থির হয়, নিজের মৃত্যু ও ধ্বংস কামনা করে, চুল ও কাপড় ঘেঁড়ে, মুখে ও বুকে থাপ্পড় ও খামচি মারে এবং প্রবল জোরে চিৎকার করে কাঁদে বা ভাড়াটে দিয়ে কাঁদায়, তবে তার ওপর আল্লাহ অবশ্যই অসন্তুষ্ট হবেন। অভিসম্পাত করবেন এবং কোন কোন রেওয়ায়েত অনুসারে তার নেক আমল নষ্ট করে দেবেন। কেননা এসব তৎপরতা তাকদীর তথা আল্লাহর ফায়সালাকে অবিশ্বাস করার শামিল। বিশেষ করে নিজের মৃত্যু ও ধ্বংস কামনা করা এক ধরনের আত্মহত্যার চেষ্টা বটে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন