এক – পটভূমিকা

পৃথিবী ও মানুষের সৃষ্টি একই সময়ে ঘটেনি; পৃথিবীর বুকে মানুষ জন্মেছে পৃথিবীর জন্মের বহু বহু পরে৷ ঠিক কবে যে সে ঘটনা ঘটেছে তা কেউ বলতে পারে না; তার জন্মের ইতিহাস তাই অনুমান-সাপেক্ষ৷

বিজ্ঞানী প্রাণ-রহস্য নিয়ে বহুকাল তথ্যানুসন্ধান করেছেন, এখনও করছেন৷ কিন্তু কি করে ও কখন পৃথিবীতে প্রাণ-হীন পদার্থের মধ্যে প্রাণ-সঞ্চার হল তার উদ্দেশ তিনি এখনও পাননি৷ প্রাণের ভিত্তি “প্রোটোপ্লাজ্ম’কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে সত্য, তবু প্রাণ-রহস্য চিররহস্য বলে মনে না-করার কোনো কারণ এখনও দেখা যায়নি৷

ঊনবিংশ শতকে ইংরেজ জীববিজ্ঞানী ডারুইন এদিকে নূতন আলোকপাত করেছেন৷ তাঁর অভিব্যক্তিবাদের ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপর ভর করে পৃথিবীর সর্বশেষ সৃষ্ট জীব মানুষের জন্ম-ইতিহাস অনেকটা স্পষ্ট হয়ে এসেছে৷ জাভা, চীন ও উত্তর আফ্রিকায় যে জীবাশ্মের সন্ধান মিলেছে তার সঙ্গে মানুষের সাদৃশ্য স্পষ্ট নয়; বিজ্ঞানীর অনুমান, সেগুলি চার লক্ষ বছর পূর্বের; তারা মানুষেরই পূর্বপুরুষ৷ যাদের সঙ্গে বর্তমান মানুষের সাদৃশ্য পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে-তাদের বলা হয় ‘হোমো সেপিয়েন্স’; তারা মাত্র হাজার ত্রিশ-বত্রিশ বছর পূর্বের জীব৷

তা যাই হোক, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানুষের জন্মসূচনা অন্তত দশ লক্ষ বছর পূর্বে ঘটেছে৷ কিন্তু তার ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা মাত্র হাজার ছয়েক বছরের; এর পূর্বে তার জীবনে যা ঘটেছে তা নিতান্তই অনুমান৷

এখন থেকে ছ-হাজার বছর আগে মানুষের বসতি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি৷ আবার সব বসতিতে তাদের মেধা সমভাবেও বেড়ে ওঠেনি৷ ইতিহাসের সাক্ষ্যে দেখা যায়, তা বেড়েছিল চারটি বসতিতে৷ কিন্তু একথা বলা সম্ভবপর নয় যে, কোন বসতিতে তাদের মানসিক ঋদ্ধি সর্বপ্রথম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে৷

পূর্বদেশ থেকে গনতি করলে প্রথম পড়বে চীন, দ্বিতীয় ভারতবর্ষের সিন্ধুনদের তীর, তৃতীয় ব্যাবিলনের নদী টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের মধ্যবর্তী উর্বর ভূমিখণ্ড, চতুর্থ মিশরের নীল নদের তীর ও তারই গা-ঘেঁষা ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ ক্রীট৷

এসব বসতির মানুষের মনের গতি ও প্রকৃতির ইতিহাস বিভিন্ন বটে, তবু তাদের মধ্যে যে গভীর সংযোগ ছিল তাতে সন্দেহ নেই৷ এ-সকল পুরাবৃত্তের পাতায় রয়েছে মানুষের মেধার ক্রমবিকাশের ইতিহাস৷

ক্রীটের ও নীলনদের তীরের মানুষের মেধা প্রধানত স্থাপত্যশিল্পের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল৷ ক্রীটের অপূর্ব রাজপ্রাসাদ, মিশরের পিরামিড তার সাক্ষ্য৷ কিন্তু মানুষের জীবন ও পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক অথবা দেহ মন বা আত্মা নিয়ে কোনো প্রশ্ন-তাদের মনে বিশেষ করে জাগেনি বলেই মনে হয়৷ ভূমধ্যসাগরের তীরে তা প্রথম প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল ইতিহাস-প্রসিদ্ধ পিথাগোরাসের মনে৷ পিথাগোরাস এখন থেকে আড়াই হাজার বছর আগের মানুষ; ভারতবর্ষের বুদ্ধ ও চীনের কন্ফুসিয়াসের সমসাময়িক৷ ইরান বা পারস্যের ধর্মনেতা জরথুস্ট্র এঁদের কয়েক শতকের পূর্ববর্তী৷

মোটামুটি হিসাবে পিথাগোরাসকেই পাশ্চাত্যের প্রথম দার্শনিক বলে ধরা চলে৷ তিনি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন৷ শুধু তাই নয়, তাঁর ধারণা ছিল, মানুষের আত্মা চিরতরে তো বটেই, এমনকি অল্পক্ষণের জন্যও, তার দেহ পরিত্যাগ করে অন্য মানুষ, এমনকি ইতরপ্রাণীর দেহেও প্রবেশ করতে পারে৷ মানুষের দিব্যজীবন সম্পর্কেও তাঁর মনে একটা বিশেষ ধারণা গড়ে উঠেছে৷ তাঁর মতে, সে জীবন তপস্যালব্ধ; তিনি ভারতীয় যোগীর মতো নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন৷ সংঘও একটি গড়ে তুলেছিলেন-বৌদ্ধ ভিক্ষুসমাজের মতো৷ সে সমাজের লোকের মাছ, মাংস ও মদ্য ছিল বর্জনীয়; তাদের পাদুকাহীন পোশাকও ছিল বিশিষ্ট৷ অতি সাধারণ ও আড়ম্বরহীন ছিল তাদের জীবনযাত্রা৷

পাশ্চাত্যের দার্শনিক হলেও পিথাগোরাসের মনে যে প্রাচ্য আদর্শ ও ভাবের গভীর প্রভাব ছিল তাতে সন্দেহ নেই৷ সমসাময়িক জ্ঞানবীর বুদ্ধের প্রেরণার যে মূল, হয়তো তাঁরও তা-ই৷ বুদ্ধ দেশে ও বিদেশে যা প্রচার করেছিলেন তা উপনিষদেরই বাণী; হয়তো উপনিষদের ভাবধারাই পিথাগোরাসেরও প্রেরণার মূল৷ সেকালেও গ্রিস, মিশর প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সংযোগ ছিল এবং পিথাগোরাসও এদেশে এসেছিলেন বলে ইঙ্গিত করেছেন ফরাসি দার্শনিক ভলটেয়ার৷ আর, সে ইঙ্গিত স্পষ্ট সমর্থন করেছেন সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস-লেখক ম্যাকডোনেল৷ দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ঊর্ধ্বে মানুষ ও বিশ্বজগৎ, মানবাত্মা ও বিশ্বাত্মার সম্পর্ক নিয়ে মানুষের চিন্তাধারার প্রথম পরিচয় রয়েছে উপনিষদের পাতায়; এসব চিন্তাধারার জন্ম আনুমানিক বুদ্ধ ও পিথাগোরাসের অন্তত কয়েক শত বছর পূর্বেই ঘটেছে৷

এখানে ইরানের জরথুস্ট্র ও চীনের কন্ফুসিয়াস সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন৷

জরথুস্ট্র বিশ্বজগৎকে অলীক বলে মনে করেননি৷ তিনি বলতেন, পাপ ও পুণ্যের দ্বন্দ্বের মধ্যেই জীবনের গতি ও পরিণতি; এ দ্বন্দ্ব পরম পুরুষ অহুর মজদার সঙ্গে পাপের বা অর্হিমনের৷ মানুষকে অহুর মজদার শরণ নিতে হবে অর্হিমনের বিরুদ্ধে৷ এই দ্বৈতবাদ তাঁর প্রচারিত ধর্মের মূলকথা৷

কন্ফুসিয়াস কিন্তু কোনো ধর্মপ্রচার করেননি, কোনো দেবদেবীর বা ঈশ্বরের কথাও বলেননি৷ পরলোক সম্পর্কেও তাঁর কোনো মতবাদ নেই৷ তাঁর বিশ্বাস ছিল যে বিশ্বজগৎ একটা বিশেষ নৈতিক নিয়মের অধীন; সেই নিয়মের অনুসরণে তিনি সমাজ-সৃষ্টির কথা চিন্তা ও প্রচার করেছেন৷ চীনের যিনি আদিম ধর্মনেতা, তিনি লাওৎসে নামে অভিহিত৷ তবে তিনি ঐতিহাসিক মানুষ কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে৷ তাঁর ধর্মে রয়েছে বৌদ্ধধর্মের প্রতিচ্ছবি ও অতিয়ন্দ্রিয়বাদ৷

ব্যাবিলনের মানুষও ছিল মূলত ইহলোকেরই কারবারি, পরলোক নিয়ে তারা বিশেষ চর্চা করেছে বলে মনে হয় না৷ গণিত-জ্যোতিষে ছিল তাদের অসামান্য কৃতিত্ব৷ তারা এবং মিশরিরাও বিশ্বজগৎকে একটা বাক্সের মতো বলে মনে করত; পৃথিবীটা হল তার মেঝে৷

তা যাই হোক, বাইরের জগতেই ছিল তাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ৷ নিজেদের দিকে তারা কখনো দৃষ্টিপাত করেনি, মানুষের সমগ্র সত্তা সম্পর্কে কোনো চিন্তাও করেনি৷ মানুষের জন্ম, মৃত্যু, ইহলোক, পরলোক, চেতনা, আত্মা প্রভৃতি সম্পর্কে তাদের বিশেষ ধারণা ছিল না, থেকে থাকলেও তার কোনো পরিচয় ইতিহাসের পাতায় নেই৷

মানুষের নবোন্মেষিত মেধা যখন শুধু বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য রক্ষার চেষ্টা করছিল, তখন তাদেরই মধ্যে একদল মানুষ মানসলোকের দিকে দৃষ্টিপাত করে এক অপরূপ অতীন্দ্রিয় সত্তার আস্বাদে আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠেছিল৷ তাদের এই আনন্দধারার নিখুঁত পরিচয় রয়েছে উপনিষদের পাতায়৷

উপনিষদ মানুষের অতীন্দ্রিয় সত্তার প্রথম আস্বাদের চিত্র৷ জন্ম ও মৃত্যুরহস্য-ভেদের প্রথম চেষ্টা ও পরিকল্পনা৷ প্রাণের স্বরূপ কি? কোথায় এর জন্ম? মৃত্যুর স্বরূপই বা কী এবং মৃত্যুতেই কি মানুষের পরিসমাপ্তি? মৃত্যুর পরেও কি মানুষের সত্তা বর্তমান থাকে? মানুষের সঙ্গে জগতের সম্পর্কই বা কী? এসব চিন্তা কখনো-না-কখনো সকল মানুষের মনেই জেগে ওঠেনি৷ কেউ এ নিয়ে ভাবে, কেউ ভাবে না; এড়িয়ে চলে৷ উপনিষদের এসব প্রশ্নের যথাযথ মীমাংসার পথ দেখানো হয়েছে৷

উপনিষদ পৃথিবীতে মানুষ-প্রজাতির প্রথম চিন্তাধারার ফল; কিন্তু এর প্রাচীন সম্বন্ধে ধারণাই যে এর প্রকৃত পরিচয় তা নয়৷ পৃথিবীতে জরথুস্ট্র থেকে মহম্মদ পর্যন্ত যত ধর্মনেতা নানা ধর্মমত প্রচার করেছেন তারও বহু পূর্বে এর জন্ম৷ অর্থাৎ এর যখন জন্ম ঘটেছে তখন মানুষ-প্রজাতির মধ্যে কোনো ধর্মমত ও বিধি গড়ে ওঠেনি, তাদের মনও নানা সংস্কারবদ্ধ হয়নি৷ কাজেই উপনিষদ কোনো ধর্মমতাবলম্বীর নিজস্ব সম্পত্তি নয়; মানুষ-প্রজাতির সাধারণ সম্পত্তি৷ এর মধ্যে কোনো ধর্মমত-বিশেষের প্রেরণা নেই৷

কিন্তু শুধু তা-ই নয়৷ আরও একটি বড়ো কথা রয়েছে৷ শুধু বয়সের দিক থেকেই যে উপনিষদ মানুষের প্রাচীনতম চিন্তাধারার চিত্র তা নয়, চিন্তার দিক থেকেও এর মূল্য অসামান্য৷ এত অসামান্য যে এখনও অর্থাৎ এই একবিংশ শতকেও মানুষের চিন্তাধারা একে অতিক্রম করে যেতে পারেনি, অবশ্য অতীন্দ্রিয় সত্তার ক্ষেত্রে৷ উপনিষদের প্রচারিত সত্য এখনও চিরন্তন সত্য হয়েই রয়েছে৷

উপনিষদ পাঠের আগে এ দুটি তথ্য বারবার স্মরণ করা প্রয়োজন৷ আমাদের দেশে সাধারণজনের ইতিহাস-চেতনা বিশেষ নেই, তাই উপনিষদের সঙ্গে আমরা গীতা, বাইবেল, কোরান, পুরাণকে তুলনীয় করে তুলি৷

উপনিষদ কখন লেখা হয় তা নিয়ে বিদ্বজ্জনসমাজে প্রভূত মতানৈক্য রয়েছে৷ কেউ বলেন, যিশুখ্রিস্টের জন্মের আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্রামাণিক পুথিগুলি লেখা হয়েছিল; কেউ বলেন, ষোলোশো বছর আগে৷ কারও কারও মতে জরথুস্ট্র, বুদ্ধ, মহাবীর প্রভৃতির জন্মের মাত্র কয়েকশো বছর আগে; কারও মতে তারও পরে৷ পাশ্চাত্যের মনীষীরা উপনিষদকে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন বলে প্রতিপন্ন করতে চান; ভারতীয়েরা এর প্রাচীন প্রমাণে তৎপর৷ এই বিষম টানাটানি চলেছে যেমন বেদ সম্পর্কে, তেমনি উপনিষদ সম্পর্কেও৷ ঋগ্বেদের কাল যাঁরা খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে বলে অকাট্য প্রমাণ দিয়েছেন বলে দাবি করেন, তাঁরা প্রাচীনতম উপনিষদের কালকে খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছরের এদিকে মানতে নারাজ৷ কিন্তু সে কথা থাক৷

উপনিষদ একখানি পুথি নয়, বহু৷ এদের মধ্যে প্রামাণিক উপনিষদ বলতে কি বোঝা যায়, সে কথায় ক্রমে আসা যাবে৷ বুদ্ধ, মহাবীর, কন!ফুসিয়াস, লাওৎসে তো বটেই, এমন কি জরথুস্ট্রেরও পূর্বে যে অনেকগুলি উপনিষদ লেখা হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই বলেই সাধারণের অভিমত৷

সাংখ্য, বেদান্ত, কান্ট বা হেগেলের দর্শনের মতো উপনিষদ কোনো সুবিন্যস্ত দর্শনশাস্ত্র নয়৷ কোনো উপনিষদেই বিশেষ কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়নি৷ কোনো উপনিষদেই কোনো ধর্মমত গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেই৷ তবে ভারতবর্ষের নয়টি দর্শন-শাস্ত্রের বীজ এর মধ্যে ছড়ানো রয়েছে; সে সম্পর্কে পরে বলা যাবে৷

উপনিষদ যে দর্শন-শাস্ত্র বা ধর্মমতের পুথি নয় তার প্রধান কারণ এগুলি মানুষের মেধাবৃদ্ধির প্রথম ফল, প্রথম চিন্তাধারা৷ দ্বিতীয়, কোনো উপনিষদই একটি বিশেষ মানুষের রচনা নয়, একে যৌথরচনা বলাই অধিকতর যুক্তিসংগত৷ এর মধ্যে বহু মানুষের অতীন্দ্রিয় চেতনার অভিব্যক্তি৷ এঁরা সবাই একই তীর্থযাত্রী-দৈনন্দিন জীবনের বহু ঊর্ধ্বে এঁদের দৃষ্টি, আর এঁদের সবারই লক্ষ্য ‘অমৃতত্বম্!’ বা অমর অর্থাৎ এ মর-জগতের অতিক্রান্ত অবস্থা৷

এই ‘অমৃতত্বম্!’ বলতে তাঁরা কি বুঝতেন? এ কথা বহু উপনিষদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে৷ অমৃতত্ব স্বর্গসুখও নয়, এই দেহ নিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকার কল্পনাও নয়৷ তকে এটি কি? এটি এমন একটি অবস্থা যাতে মানুষ জগতের সর্বপ্রকার দুঃখ, কষ্ট ও পাপের ঊর্ধ্বে নিজেকে তুলে ধরতে পারে৷ যাতে সে পরম শান্তি ও চির-আনন্দের সন্ধান পায়৷

এই ‘অমৃতত্বম্!’-এর তীর্থযাত্রীরা তাঁদের যাত্রাপথ ও অভিজ্ঞতার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা যেমন সাবলীল তেমনি প্রাণবন্ত৷ জৈবধর্মের গূঢ় মর্ম, জীবন-মৃত্যুর চিররহস্য, মানুষের পরম লক্ষ্য তাঁদের কাছে যে সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাতে সন্দেহ নেই৷ তাঁরা যেন কোনো শৈলশিখরে আরোহণ করে সে গন্তব্যে পৌঁছোনোর পথের সমস্তটাই স্পষ্ট দেখতে পেরেছিলেন৷ তাই শৈলপাদমূলে বিচরণরত মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছেন, এসো, অমৃতত্বম্!-এর আস্বাদে আনন্দে ভরপুর হয়ে যাও৷ সর্বরহস্যরূপ ঘোর তমিস্রার পরপারে যে জ্যোতির্ময় লোক রয়েছে, আমরা তার সন্ধান পেয়েছি; সে যেন এক পরমপুরুষের সান্নিধ্যের মতো৷ তীর্থে আসার কিন্তু একটিমাত্র পথ-সেটি যেমন সংকীর্ণ তেমনি সরল৷

উপনিষদ সত্যদ্রষ্টা মানুষের আত্মদর্শনের আলেখ্য৷ কাজেই অতীন্দ্রিয়বাদই এর অবলম্বন৷ বিদ্বজ্জনেরা এই একই অতীন্দ্রিয়বাদ লক্ষ করেছেন ইরানের সুফিপন্থায়, গ্রিসের ‘নিও-প্ল্যাটোনিজ্ম’-বাদের মধ্যে, তারপর পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে স্পেনের খ্রিস্টান অতীন্দ্রিয়বাদীদের মধ্যে, এবং সর্বশেষ ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ারে৷ অর্থাৎ ভারতবর্ষের এই অধিবিদ্যার রাজ্য ইরান ও গ্রিসের মধ্য দিয়ে সারা পাশ্চাত্যে প্রসারিত হয়েছে৷ শোপেনহাওয়ার বারবার উচ্চারণ করেছেন, এ পৃথিবীতে যে-পুথি পাঠ করলে মন সবচেয়ে বেশি উন্নত ও উপকৃত হয় তা হল উপনিষদ৷ জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি সান্ত্ত্বনা পেয়েছি উপনিষদের মধ্যে, মরণেও তা-ই পাব৷

উপনিষদের রচয়িতা সত্যদ্রষ্টা মানুষেরা এটা স্পষ্ট অনুভব করেছেন যে দেহটা আত্মার আধার ছাড়া আর কিছুই নয়৷ সে আত্মা জগদাত্মক অর্থাৎ বিশ্বাত্মারই রূপান্তর-সে আত্মা বিশ্বের সৃষ্টি ও স্থিতি সম্পাদন করে পরিশেষে প্রলয়ের মধ্যে নিজেই তা গ্রহণ করেন৷ অর্থাৎ আত্মাই একমাত্র সত্যবস্তু৷ সকল উপনিষদেরই এই হল মর্মবাণী৷ এ তত্ত্বটিই নানারূপে প্রকাশ করেছে বিভিন্ন উপনিষদ৷ কোথাও বলা হয়েছে, ‘তত্ত্বমসি’ অর্থাৎ হে মানুষ, তুমিই সেই আত্মা৷ কোথাও বলা হয়েছে ‘ওঁ’, যার অর্থ ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ অর্থাৎ আমিই ব্রহ্ম বা বিশ্বাত্মা৷ কোথাও বলা হয়েছে, ‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং’ অর্থাৎ ব্রহ্ম সমস্ত বস্তু পরিব্যাপ্ত করে রয়েছেন৷ বিশ্বের যাবতীয় বস্তুই সেই আত্মারই প্রতিচ্ছবি৷

উপনিষদ বেদের অংশবিশেষ৷ বেদ চারটি৷ প্রাচীনতার শ্রেণিবিভাগে প্রথম ঋক, দ্বিতীয় যজুঃ, তৃতীয় সাম, চতুর্থ অথর্ব৷ ঋকের বাহন পদ্য, যজুঃ গদ্য, সামের গীত এবং অথর্বের পদ্য, গদ্য ও গীত৷

প্রত্যেক বেদেরই দুটি খণ্ড; একটিকে বলা হয় মন্ত্র বা সংহিতা, অন্যটিকে ব্রাহ্মণ৷ প্রথম খণ্ডে বিভিন্ন দেবতার স্তুতি, দ্বিতীয় খণ্ডে বেদের ক্রিয়াকাণ্ড৷ এই দ্বিতীয় খণ্ডের শেষে সাধারণত ‘আরণ্যক’ বলে একটি ভাগ যোগ করা হয়েছে৷ উপনিষদের অধিকাংশই এইসব ‘আরণ্যক’-খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত; কিছু কিছু উপনিষদ অবশ্য অন্যত্রও ছড়ানো রয়েছে৷

‘আরণ্যক’ শব্দের অর্থ অরণ্যজাত৷ উপনিষদের ক্ষেত্রে কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য৷ সংসারের কোলাহলের বহুদূরে অরণ্যের মধ্যেই ধ্যানজগতে এর জন্ম৷ ভারতবর্ষের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে যে আরণ্যক বলা হয়, এর কারণও এই সত্যের মধ্যে নিহিত৷

আধুনিক জগতে কেউই আর একান্তে নির্জনে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণের কথা চিন্তা করে না৷ সংসার থেকে সহসা বিচ্যুতি এখন মহাপ্রয়াণেরই নামান্তর৷ কিন্তু ভারতবর্ষের প্রাচীন সমাজে জীবনকে স্তরে স্তরে ভাগ করে তার পূর্ণ মহিমা ও লক্ষ্য উপলব্ধি করার প্রথা ছিল৷

এজন্য মানুষের জীবিতকালকে চারটি ভাগে বা আশ্রমে বিভক্ত করা হত৷ প্রথম, ব্রহ্মচর্য; এই আশ্রমকাল মোটামুটি জীবনের প্রথম পঁচিশ বছর৷ এ সময়ে কৃত্য ছিল-অধ্যয়ন ও পরবর্তী আশ্রমে প্রবেশের উপযোগী চরিত্রগঠন৷ দ্বিতীয়, গার্হস্থ্য৷ তৃতীয়, মোটামুটি পঞ্চাশ বছরে বানপ্রস্থ বা সংসার ত্যাগ করে অরণ্যবাস৷ চতুর্থ, সন্ন্যাস; মোটামুটি আরো পঁচিশ বছর পরে, অর্থাৎ পঁচাত্তরে, সর্বকর্ম পরিত্যাগ করে ঈশ্বরের চিন্তা ও মহাপ্রাণের জন্য প্রস্তুতি৷

উপনিষদ এই বানপ্রস্থী মানুষের সাধনার ফল৷ এ ফলটিকে বেদের সারাংশ বললে অত্যুক্তি হয় না৷

উপনিষদ-পাঠের পূর্বে যে দুটি তত্ত্ব আমাদের বারবার স্মরণ করা প্রয়োজন, এখানে আবার তারই পুনরুল্লেখ করছি৷ উপনিষদ যে শুধু মানুষ-প্রজাতির প্রথম চিন্তজগতের ফল তা-ই নয়, এর বহুলাংশেরই প্রকাশ-ব্যঞ্জনা এত অভিনব ও সার্বকালিক যে তা নিতান্ত আধুনিক বলে বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক৷ জগতের যে-কোনো ধর্মাবলম্বী মানুষই এর মধ্যে নিজ আদর্শ খুঁজে পাবে এবং পাঠকের নিশ্চিতই মনে হবে যে, যদিও মানুষ-প্রজাতি উপনিষদের যুগের পরে এখন বহু পথ পার হয়ে এসেছে, তার মেধাও অনেক বেড়েছে, তবুও অধিবিদ্যার জগতে মানুষের আধুনিক চিন্তাধারা উপনিষদের চিন্তাধারাকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি৷

এখন দেখা যাক উপনিষদ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কি৷ মূল ধাতুটি ‘সদ্’; এর দুটি অর্থ রয়েছে: এক, পাওয়া; দুই, হ্রাস করা৷ কিন্তু গোড়ায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে দুটি উপসর্গ; প্রথমটি ‘উপ’ বা সান্নিধ্যব্যঞ্জক, দ্বিতীয়টি ‘নি’ বা নিশ্চয়তা-জ্ঞাপক৷ এ-সকলের সমবায়ে উপনিষদের দুটি অর্থ দাঁড়ায়৷ এক, যে-জ্ঞান আহরণ করে শীঘ্র নিশ্চিতরূপে ব্রহ্মানন্দ লাভ করা যায়; দুই, যে-জ্ঞানে মানুষের অজ্ঞান দ্রুত ও নিশ্চিতরূপে হ্রাস পায় বা বিদূরিত হয়৷ ভাষাগত এ দুটি অর্থই উপনিষদের পক্ষে সম্পূর্ণ উপযুক্ত৷

উপনিষদ-পাঠের আগে আরও একটি কথা স্মরণ করা প্রয়োজন বলে মনে হয়৷ সেটির প্রয়োজন তুলনামূলক সমালোচনার জন্য নয়, ব্যাখ্যার জন্য৷ শুধু আমাদের দেশেই নয়, সর্বত্রই প্রায় বিদ্বজ্জন ও ধর্মোপদেষ্টারা পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মের নানা মতবাদের তুলনামূলক সমালোচনা করে যাঁর যাঁর ব্যক্তিগত ধর্মমতের বৈশিষ্ট্য প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করেন৷ এর মধ্যে উপনিষদের কথা টেনে এনে তার সঙ্গে খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম প্রভৃতির কথা জুড়ে দেন৷ আমরা পূর্বে যা বলেছি তাতে পাঠক হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে উপনিষদের সঙ্গে কোনো ধর্মমতের বিধিবদ্ধ সম্পর্ক নেই; প্রকৃতপক্ষে উপনিষদের পাতায় কোনো ধর্মমতের কথা লেখা নেই৷ এমনকি উপনিষদের যুগের বহু পরে মানুষ-প্রজাতির মধ্যে প্রথম ধর্মমতের সৃষ্টি হয়েছে৷ তারপর উপনিষদের চিন্তাধারার সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের ও ইসলামের চিন্তাধারার দুটি মূলগত প্রভেদ রয়েছে৷ এ প্রভেদের অর্থ এই নয় যে একটি চিন্তাধারা অন্যটির চেয়ে বেশি মূল্যবান; এগুলি শুধু যুগে যুগে মানুষ-প্রজাতির চিন্তাধারার গতি ও প্রকৃতির নির্ণায়ক৷

প্রত্যেকটি আস্তিক ধর্মেই, অর্থাৎ যে ধর্মে ঈশ্বরকে মানা হয়, স্বীকার করা হয়েছে যে ঈশ্বরই এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা৷ খ্রিস্টধর্মে ও ইসলামেও সে কথা স্বীকৃত৷ তবে উভয় ক্ষেত্রে এ-কথা বলা হয়েছে যে এই সৃষ্টির উপাদান কিছু ছিল না-এর উপকরণ শূন্যতা অর্থাৎ যার অস্তিত্ব নেই৷ উপনিষদের স্রষ্টারা কিন্তু সমস্বরে বলেছেন যে, ব্রহ্ম এর স্রষ্টা এবং তিনি নিজেই উপাদান৷ উপনিষদ বলেছে, ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা-কিছু সবই ব্রহ্ম৷ মাকড়সা যেমন নিজের দেহ থেকে তার চতুর্দিকে জাল বিস্তার করে, ব্রহ্মও তেমনি নিজে বহু হয়ে এ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন৷

আবার, খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের মতে মাত্র মানুষেরই আত্মা বর্তমান; উদ্ভিদ ও ইতর প্রাণীর আত্মা নেই৷ উপনিষদের মতে এদেরও আত্মা রয়েছে; মানুষ মনুষ্যত্ববোধহীন হলে ক্রমে জন্মান্তরে উদ্ভিদ ও ইতর প্রাণীতে পরিণত হয়৷

উপনিষদের যুগ এবং খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের যুগের মধ্যে কালের ব্যবধান অপরিসীম৷ স্থান, কাল ও পাত্রের ব্যবধানেই চিন্তাধারার এ প্রভেদের জন্ম৷

পূর্বে বলা হয়েছে যে উপনিষদগুলি বেদের অঙ্গ বটে, তবে সব ক্ষেত্রেই তা বেদের শেষে জুড়ে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ বেদের অন্তে; কাজেই উপনিষদকে বেদান্তও বলা হয়৷ কিন্তু বেদান্ত বলতে আমরা এখন বুঝি শংকরাচার্য-রচিত বেদান্ত-পন্থার বা দর্শনের কথা৷ অবশ্য উপনিষদই বেদান্ত-দর্শনের ভিত্তি ভারতীয় অন্যান্য দর্শনের মতো৷ সেকথা যথাস্থানে বলা যাবে৷

এখন থেকে প্রায় বারোশো বছর আগে শংকরাচার্য তাঁর বেদান্তদর্শন রচনা করে হিন্দুধর্ম উজ্জীবিত করেন৷ অনেকের মতে উপনিষদের প্রকৃত মর্মকথা এই দর্শনের মধ্যে নিহিত৷ কিন্তু এ-নিয়ে মতভেদ রয়েছে৷ প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় নয়টি দর্শন-শাস্ত্রই উপনিষদ থেকে তাদের সুবিন্যস্ত চিন্তাধারার প্রেরণা ও সূত্র পেয়েছে৷

সাধারণত আমরা ষড়দর্শনের কথাই বলে থাকি৷ এগুলি যথাক্রমে সাংখ্য, পাতঞ্জল, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা বা বেদান্ত; এদের বলা হয় আস্তিক-ধর্মী অর্থাৎ যার মধ্যে ঈশ্বরের স্থান রয়েছে৷ তা ছাড়া রয়েছে চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন-এগুলিও উপনিষদ-ভিত্তিক ভারতীয় দর্শন, তবে নাস্তিক-ধর্মী অর্থাৎ ঈশ্বরের স্থান এদের মধ্যে অনির্দিষ্ট বা অস্পষ্ট৷ এই ‘উপনিষদ-ভিত্তিক’ কথাটায় হয়তো কারও কারও আপত্তি আছে৷ কিন্তু আমরা কেন তা বলছি যথাস্থানে বলা যাবে৷

অন্যান্য ভারতীয় দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বেদান্তদর্শনের একটা মূলগত প্রভেদ রয়েছে৷ এখন সে কথাই বলছি৷

ধরুন, আমরা সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোকে পথের মধ্যে একখণ্ড দড়ি দেখে তাকে সাপ বলে ভয়ে আঁতকে উঠলাম৷ এই যে রজ্জুতে সর্পভ্রম, একে দর্শনের ভাষায় বলা হয় ‘বিবর্ত’৷ শংকর বলেন, আমরা যে আমাদের চতুর্দিকে বিশ্বজগৎ দেখি-সবটাই মায়া; অর্থাৎ তিনি বিবর্ত-বাদী৷ মোটামুটি বলতে গেলে অন্যান্য দর্শনের মতো তা নয়; তাঁদের মতে, এ বিশ্বজগৎ বিকার বা পরিণাম মাত্র অর্থাৎ অন্য কোনো জিনিসের পরিণাম, যেমন, দুধের পরিণাম দধিতে বা ছানায়৷

আমরা উপনিষদের কথায় এবার কিছুদূর অগ্রসর হয়েছি৷ আমরা উপনিষদের জন্ম-কাহিনি শুনেছি, তার জন্মকালে সারা মানুষ-প্রজাতির অবস্থা ও অবস্থানের কথা বিচার করেছি, এবং উপনিষদগুলির মর্মবাণী কি, তারও একটা আভাস পেয়েছি৷

পরবর্তী পরিচ্ছেদে উপনিষদ সম্পর্কে জ্ঞাতব্য আরও কয়েকটি কথা বলে উপনিষদের মধ্যে প্রবেশ করতে চেষ্টা করব৷

অধ্যায় ১ / ৭

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন