৯০. বুকের মধ্যে যেন একটা শাঁখ বেজে ওঠে

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

৯০

থেকে থেকে বুকের মধ্যে যেন একটা শাঁখ বেজে ওঠে, মা! মা! বুকটা বড় হা-হা করে, বড় ফাঁকা হয়ে যায়, ধু-ধু হয়ে যায়। ক’টা দিন বড় কেঁদেছে নিমাই। এত কেঁদেছে যে আজও তার মাথা ভার হয়ে আছে। পুরো এক মাস অশৌচ পালন করেছে সে, তারপর নিষ্ঠার সঙ্গে শ্রাদ্ধ। তার বোকা মা কোন্ অজানায় পাড়ি দিল, ভগবান তার সহায় হোক।

মরণের কাছে যে মানুষ কত অসহায় তা যত ভাবে ততই দুনিয়াটাকে তার তুচ্ছ বলে মনে হয়।

তার অবস্থা দেখে ভয় খেয়ে বাবা বলল, ওরে, তুই অত মনমরা হয়ে থাকলে মাথার দোষ হয়ে পড়বে। যা না, বন্ধুদের সঙ্গে একটু কথা-টথা কয়ে আয়, না হলে কাঁচরাপাড়ায় হোটেলে গিয়ে খানিকটা সময় বোস।

মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা আছাড়ি-পিছাড়ি হয়ে কেঁদেছে বটে, কিন্তু নিমাইয়ের অবস্থা দেখে বাবা ভয় খেয়ে চুপ মেরে গিয়েছিল। ছেলেটার না আবার কিছু হয়ে যায়। মায়ের শোকে হয়তো মরেই যাবে।

ধড়া গায়ে, উসকো-খুসকো চুল, এক মুখ দাড়ি নিয়ে বাবার আদেশে অশৌচের মধ্যেও কাঁচরাপাড়ায় গিয়ে হোটেলের কাজকর্ম দেখেছে নিমাই। কর্মচারী দুজন মিলে চালিয়ে নিয়েছে বটে, কিন্তু ক’দিনেই বড় নোংরা করে ফেলেছে চারধার। প্লেট কাপও ঠিকমতো ধোয়া হয় না, ঝাট-পাট ঠিকমতো পড়ছে না, ঝুল-টুল জমেছে, তরকারির খোসা, মাছের আঁশ পচছে রান্নাঘরের কোণে। নিমাই থাকলে এসব হতে পারে না, তার দোকানের পরিচ্ছন্নতার নাম আছে। অশেীচের মধ্যে নিমাই কিছু ছোঁবে না, তবু দাঁড়িয়ে থেকে সব পরিষ্কার করাল। দোকানের বাইরে একখানা টুলে চুপচাপ কুশাসন পেতে উদাস ভাবে বসে রইল। চেনা মানুষরা এসে কত সমবেদনা প্রকাশ করে গেল।

বুকটা বড় ফাঁকা, বড় উদাস, বেঁচে থাকার রসটাই যেন মরে গেল মায়ের সঙ্গে সঙ্গে। বীণাপাণির সঙ্গে বনগাঁ চলে গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতে অনেকটা ফাঁক পড়ে গিয়েছিল। মায়ের জন্য কত কী করার ছিল তার, কত কী করেনি, সেসব উল্টোপাল্টা হয়ে বারবার মনে পড়ে আর চোখ জলে ভাসতে থাকে।

বাবা একদিন খরখরে গলায় জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, বীণাপাণি যে এল না!

তাকে খবর দিইনি বাবা।

বাবা একটু স্তম্ভিত হয়ে বলে, খবর দিসনি? এ খবর তো দিতেই হয়।

নিমাই মাথা নেড়ে বলে, ঠিক কথা। কিন্তু সে তো আর আমাদের জন নেই বাবা। তার এখন অন্য রকম জীবন।

বুড়ো মানুষ এসব হেঁয়ালি বুঝতে পারে না। গম্ভীর মুখে খানিকক্ষণ বসে থেকে বলল, ঘরের বউ তো, তাকে না জানানো কি ঠিক হল?

ঘরের বউ কি আর বাঁধা আছে বাবা? সে যুগ আর নেই। এখন সব অন্যরকম হয়ে গেছে।

বুড়ো মানুষটি তবু ঠিক বুঝতে চায় না। বলে, যাত্রা-টাত্রায় নামা ভাল কথা নয়। ওটাই একটা ভুল হয়ে গেছে।

নিমাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বাঁচতে গেলে কত কী করতে হয়। তার কী দোষ বল? সে তো আমাকে বাঁচাতেই রোজগার করতে নেমেছিল। দোষ তার নয় বাবা।

বাবা কিছুই তেমন বুঝতে পারে না। চুপ মেরে যায়। মনটা ভাল লাগে না বোধ হয়।

নিমাই বলে, এবার পালপাড়ার পাট তুলে দিলে হয় বাবা।

তুলে দিবি?

মা যখন নেই তখন আর এ-বাড়িতে থেকে তোমার কাজ কী? কাঁচরাপাড়ায় দিব্যি থাকতে পারবে।

বাবা কিছুক্ষণ তোম্বা মুখে বসে থাকে। তারপর বলে, ওই যে সব গাছপালা ওসব তোর মায়ের লাগানো, ওই যে কাপড় শুকুতে দেওয়ার দড়ি, ওটি সে টাঙিয়েছিল। সারা বাড়িতে এখনও ম-ম করছে তার গন্ধ। এ বাড়ি বেচতে পারবি? আমার তো কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয়, মরেনি, কোথাও পাড়া-বেড়াতে গেছে। এখুনি এসে পড়বে।

নিমাই এ কথা শুনে হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে, না বাবা, থাক তাহলে। এ বাড়ি থাক।

শ্রাদ্ধ ভালরকমই করল নিমাই। গায়ের সব লোককে নেমন্তন্ন দিল, খুব খাওয়াল। নিয়মভঙ্গের পরদিন বাবাকে বলল, তাহলে কি আমি আসব বাবা? কাঁচরাপাড়ায় অনেক কাজ পড়ে আছে।

এসো গিয়ে।

একা লাগবে না তো তোমার?

না না, একা কেন? তোর মা তো আছেই। চারদিকে ছড়ানো রয়েছে স্মৃতি। বেশ থাকব, মাঝে মাঝে আসবি।

সে তো আসবই। ভাবি, শরীর-টরীর হঠাৎ খারাপ করলে দেখবে কে? আমাদের তো জনের অভাব।

আমাকে নিয়ে ভাবিস না। পাড়ার লোক আছে। ভুরো রইল।

ভুরো একজন বয়স্কা বিধবা। ইদানীং সে-ই রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। তবে তার ঘরসংসার আছে বলে এ বাড়িতে থাকে না। নিমাইয়ের চিন্তাটা তাই গেল না।

হ্যাঁ রে, বীণাপাণি কি আর ফিরবে না?

না বাবা।

ছাড়ান কাটান হয়ে গেছে নাকি?

সেরকমই ধরে নাও।

আমি ভাবি তোকে তাহলে দেখবে কে? তোরও তো বয়স হচ্ছে।

তোমাকে যে দেখবে, আমাকেও সে-ই দেখবে। ভয় কি?

কাঁচরাপাড়ায় ফিরে এল নিমাই একটা শ্মশান-বৈরাগ্য নিয়ে। সবই করে যাচ্ছে, কিন্তু যন্ত্রের মতো। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে একটা শাঁখ শুধু বেজে উঠছে, মা!

একদিন সন্ধেবেলা কাকা এসে হাজির।

নিমাই কেমন আছ?

নিমাই তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল, ভাল আছি কাকা।

তোমার মায়ের গত হওয়ার খবর পেয়েছি।

বসুন কাকা, কিছু খেয়ে যেতে হবে আজ।

তোমার কেবল খাওয়া আর খাওয়া। আজকাল খাওয়া অনেক বাদ দিতে হয়েছে। প্রেশার দেখা দিয়েছে। এখন আর আমদা খাওয়া-দাওয়া করি না।

তবু কিছু মুখে না দিলে ছাড়ছি না। কবে এসেছেন?

আজই। রাতের বাস ধরে ফিরে যাবো। শোনো, অনেক মিথ্যে কথা-টথা বলে বীণাপাণিকে সেই পাঁচ হাজার টাকা গছিয়েছি।

বড় ভাল লাগল শুনে। তাকে আরও কিছু দিতে পারলে হত। কিন্তু মায়ের কাজ গেল, অনেক খরচ হয়ে গেছে।

অত অস্থির হচ্ছ কেন? তার তো অভাব নেই।

জানি কাকা। তবে আমি বড় ঋণী হয়ে আছি।

স্বামীর জন্য স্ত্রী করলে কি ঋণ হয়?

নিমাই মাথা নেড়ে বলে, তা ঠিক। তবে আমাদের সম্পর্ক তো জানেন। ঠিক স্বামী-স্ত্রীর মতো নয়। সে আমাদের প্রতিপালন করেছে। কষ্ট করেই করেছে।

শাশুড়ি মারা গেল, কিন্তু অশৌচটুকুও তো মানল না দেখলাম।

নিমাই জিব কেটে বলল, তাকে খবরই দেওয়া হয়নি।

কাকা অবাক হয়ে বলল, কে বলল খবর দেওয়া হয়নি? খবর সে সময়মতোই পেয়েছে। কিন্তু মানল না।

নিমাইয়ের মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গল, খবর পেয়েছে?

নিশ্চয়ই। কুসুম নিজে তাকে খবর দিয়েছে।

নিমাই একটু চুপ করে থেকে বলে, না মানুক, সম্পর্ক তো আর নেই যে মানতে হবে।

কাকা একটু হাসল। বলল, তা বটে। তবে সম্পর্ক না থাক, এক সময়ে ঘর তো করেছে। সেই সুবাদে হবিষ্যি বা শ্রাদ্ধের বাবদ কিছু টাকাও তো পাঠাতে পারত।

নিমাই হাসল, ভগবানের দয়ায় তার আর দরকার কী? বীণাপাণির টাকায় আমার মা-বাপ একসময়ে খেয়েছে পরেছে, সেটাই যথেষ্ট।

কাকার মুখটা কিছু গম্ভীর হল। তারপর হঠাৎ গলা পাল্টে গেল। একটু থমথমে গলায় বলল, আজ তোমার কাছে একটা বিশেষ প্রয়োজনে আসা।

গলাটা শুনে আর একবার তটস্থ হল নিমাই। বলল, আজ্ঞে, বলুন। গুরুতর কথা নাকি?

খুবই গুরুতর। একটু আড়ালে বলতে চাই। বাইরে চলো।

নিমাই চটিজোড়া পায়ে দিয়ে কাকার সঙ্গে বেরিয়ে এল। কাছেই একটা ফাঁকা জায়গা। লোক চলাচল নেই।

নিমাই, তোমাকে আমি সত্যবাদী বলে জানি। মিথ্যে কথা বলতে বোধ হয় তুমি জানোই না। আজ তোমার কাছে একটা কথা জানতে চাইলে বলবে?

নিমাইয়ের বুকটা একটু কেঁপে গেল। লক্ষণ সে ভাল বুঝছে না। কাকা যখন ভাল তখন অতিশয় ভদ্রলোক। কিন্তু কাকা যদি ক্ষেপে ওঠে তাহলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যায়।

একটু ভয়ে ভয়ে নিমাই বলল, কিছু কবুল করতে হবে নাকি?

যদি করো তাহলে ভাল হয়।

নিমাই এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, একটা কথা বলে নিই কাকা। যদি এমন কিছু কবুল করতে বলেন যা করলে কারও ক্ষতি হয় তবে আমি কিন্তু মুখ খুলতে পারব না।

কাকা একটু হাসল, তাহলেই হবে।

এবার বলুন।

তোমার কি মনে আছে বনগাঁয়ে পগা নামে একটা ছেলে খুন হয়েছিল?

বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা একটা পেল্লায় লাফ মারল নিমাইয়ের। দাঁতে দাঁত চেপে সে মৃদু গলায় বলল, আছে।

বীণার সঙ্গে তার একটু খাতির ছিল। তাই না?

যে আজ্ঞে।

পগার কাছে অনেক ডলার আর পাউণ্ড ছিল। যে রাতে সে খুন হয় সেই রাত থেকেই টাকাগুলো হাওয়া।

সব জানি কাকা।

ভোলার কথা নয়। সেই ডলার আর পাউন্ডের জন্য আমার দলের দুজন খুন হয়, আমার ব্যবসা লাটে ওঠার অবস্থা হয়। মনে আছে?

আছে কাকা।

সেই ডলার আর পাউন্ডের হদিশ আজও আমরা পাইনি।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

নিমাই, তোমার কাছে আজ কথাটা জানতে চাই।

কী বলব কাকা?

সেই টাকাটার কী হল?

নিমাই মাথা নেড়ে বলল, জানি না।

কাকা তার দিকে একটু চেয়ে থেকে বলল, জানো না?

না কাকা।

কিন্তু টাকাটা কে নিয়েছিল, কার কাছে গচ্ছিত ছিল তা কি জানো নিমাই?

নিমাই চুপ করে থাকে।

এ কথাটার জবাব দেবে না?

না কাকা। এ কথাটার জবাব আমার কাছে চাইবেন না।

তবে কি তুমি জানো?

জানতাম।

শোনো, পল্টু আমাকে কয়েকদিন আগে বলেছে যে, ওর কাছে বীণাপাণি একবার ডলার ভাঙিয়েছিল। আর সনাতন গতকাল বলেছে যে, তোমাকে ও ঘরের ভিত খুঁড়ে ডলার আর পাউন্ড বার করতে দেখেছে। সত্যি?

নিমাইয়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছিল। গলায় কান্নার হেঁচকি তুলে সে কাকার দু’ খানা হাত ধরে বলল, কত বললাম ওকে, শুনল না। আমাকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিল। আজ ভাবি কোন পাপে সেদিন ইদুরের গর্ত বোজাতে গিয়ে ওই অলক্ষুণে পাপের টাকাগুলো টেনে তুললাম গর্ত থেকে।

কেঁদো না নিমাই, তোমার তো দোষ নয়।

কাঁদতে কাঁদতে নিমাই বলল, কতগুলো প্রাণ চলে গেল কাকা। কত পাপ হল!

কাকা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, বীণাপাণি তার ঘরের মেঝে বাঁধিয়ে নিয়েছে। তোমার কি মনে হয় যে ওর কাছেই টাকাটা আছে?

আমি কিছু জানি না কাকা।

কাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, দু-একজন সন্দেহ করছে যে, ওই টাকাটা বীণাপাণি তোমাকেই দিয়েছে। আর সেই টাকাতেই তুমি হোটেল খুলেছ। তোমাদের মধ্যে ঝগড়া ছাড়াছাড়িটা লোক দেখানো ব্যাপার।

নিমাই হাঁ করে কাকার মুখের দিকে তাকাল। তারপর কথা খুঁজে না পেয়ে চোখ বুজল। দুটো হাত মুঠো পাকাল, খুলল। তারপর হঠাৎ খুব শান্ত হয়ে গিয়ে বলল, যদি তাই হয় কাকা, তবে একটা কাজ করবেন? আমার যা আছে সব আপনি নিন। এই হোটেল, নগদ যা টাকা আছে আমার সব কালই লেখাপড়া করে দেবো আপনাকে। খুব কম হবে না কাকা। ঋণটা শোধ হয়ে যাবে।

কাকা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, তুমি কি স্বীকার করছ যে, ডলার আর পাউন্ড তুমিই নিয়েছ?

কান্নার মধ্যেও হাসল নিমাই, আমাকে কবুল করতে বলছেন কেন? তার পাপের স্খালন হোক, আপনি আমার সব নিয়ে নিন।

তুমি কি ভাবো যে আমি ওসব কথায় বিশ্বাস করেছি?

নিমাই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, অবিশ্বাসেরও ব্যাপার নয়। আমার মাথাতেই শুধু খেলেনি। ঠিকই তো, বীণাপাণির হাতে ডলার আর পাউন্ড এল আর নিমাইও হোটেল খুলল, এ তো দুইয়ে দুইয়ে চার কাকা। অবিশ্বাসের কিছু তো নয়। আপনার হাত দিয়েই তাকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছি, সেটাও তো সন্দেহজনক। তাই না?

হ্যাঁ নিমাই, খুবই সন্দেহজনক। নিমাই, তোমাকে আজ না বলে আমার উপায় নেই। ব্যাপারটা এতই সন্দেহজনক যে আমার দলের ছেলেরা খুবই গরম হয়ে আছে। তারা হয়তো ভেবেও দেখবে না, তুমি কতটা ভাল লোক বা সত্যবাদী। তারা বীণার ওপরেও রেগে আছে বটে, কিন্তু তাদের ধারণা টাকাটা তোমার কাছেই আছে। অবস্থাটা বুঝতে পারছ নিমাই?

নিমাই ঘাড় নেড়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, পারছি কাকা। খুব পারছি। শুধু বলুন, আমাকে কী প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

প্রায়শ্চিত্ত? সেটা আবার কি রকম?

আমার যা আছে সব যদি দিয়ে দিই তাহলে কি হবে? নাকি আমাকে খুন করতে চায় তারা? তাহলেও আমার কোনও আপত্তি নেই কাকা। যখন যেখানে বলবেন আমি হাজির হয়ে যাবো, যা শাস্তি দেবেন তা মাথা পেতে নেবো। বীণাপাণিকে শুধু ছেড়ে দেন আপনারা। সে অসহায় মেয়েমানুষ।

কাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তুমি বড় গণ্ডগোলে ফেলে দিলে আমাকে। সোজা কথা বলো তো, টাকাটা কি তুমি নিয়েছ, না নাওনি?

হাতের পিঠে চোখ মুছে নিমাই বলে, আমি কিছু বলতে পারব না কাকা। মাপ করুন।

কাকা কিছুক্ষণ থম ধরে থেকে বলল, তুমি একবার বনগাঁয়ে যেতে পারবে?

এখনই!

না, এখন নয়। হুট করে হাজির হলে তোমার বিপদ হতে পারে। আমার ছেলেরা কেমন তা তো জানো।

জানি কাকা। তারা খারাপ তো নয়।

খুবই খারাপ। তারা ক্ষেপে আছে।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, একটা কথা বলি কাকা। আমাকে একটা ভিক্ষে দিতে হবে।

কী চাও নিমাই?

আপনারা বীণাপাণিকে কিছু করবেন না। তার প্রাণটা ভিক্ষে চাই।

কাকা হাসল, বলল, বীণাপাণির অনেক গুণ। আমি গুণের খুব সমঝদার। তাকে কিছু বলা হয়নি, শাস্তি দেওয়ার কথাও ওঠেনি এখনও। তবে ছেড়েও দেওয়া হবে না।

তার দায় যদি আমি ঘাড়ে নিই?

বলেছি তো, তুমি আজ আমাকে খুব গণ্ডগোলে ফেলে দিয়েছ। আমি কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছি না। বনগাঁয়ে ফিরে গিয়ে আজ রাতেই দলের ছেলেদের নিয়ে বসব। তারপর যা হয় ঠিক হবে। ওই ডলার আর পাউন্ডের জন্য আমাদের কত ক্ষতি হয়েছে তা তুমি জানো না। আমার দুটো লোক খুন হয়েছে, তার ওপর টেনশন, মারদাঙ্গা।

নিমাই দু’ হাতে মুখ ঢাকল।

বীণার যদি মনুষ্যত্ব থাকত নিমাই, তাহলে সে এসব চোখে দেখেও চুপ করে থাকত না। অথচ তার দুর্দিনে আমার অনেক অসুবিধে সত্ত্বেও তার জন্য কম করিনি। দুধকলা দিয়ে কালসাপ পোষা হয়েছে।

নিমাই দু’ হাত মুখ থেকে নামিয়ে কাকার হাত দুটো চেপে ধরে বলল, তাকে মারবেন না কাকা। প্রাণে মারবেন না।

কাকার মুখটা খুব থমথমে। বলল, আমি তোমাকে খবর পাঠাবো। খবর নিয়ে যে ছেলেটি আসবে তার সঙ্গেই বনগাঁয়ে চলে যেও। বুঝেছ?

আমি আপনার সঙ্গে আজ রাতেই যাই না কেন? আমার যে বড় উদ্বেগ হচ্ছে।

না নিমাই। বোকার মতো কাজ কোরো না। তোমাদের এক সময়ে ভাল চোখে দেখতুম, তাই তোমাদের ক্ষতি হোক তা চাই না। আগে আমাকে দলের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে দাও।

যে আজ্ঞে। একটু দেখবেন দয়া করে।

কাকা চলে যাওয়ার পর মাঠের মধ্যে অন্ধকারে ভূতগ্রস্তের মতো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে নিমাই। তারপর হঠাৎ একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে সজোরে নিজের কপালে মারল সে, প্রায়শ্চিত্ত! প্রায়শ্চিত্ত হোক ভগবান!

তারপর ফিরে এল নিমাই। কপাল ফেটে গাল বেয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে জামায়। চোখ মুখ উদ্‌ভ্রান্ত।

বিশে, বিলু ইত্যাদি তার কর্মচারীরা দৌড়ে এল, কে মারল আপনাকে বাবু? ওই লোকটা নাকি?

নিমাই মাথা নেড়ে বলে, না না, সে বড় ভাল লোক। সে কত করেছে আমাদের জন্য। আমরাই নিমকহারাম। পড়ে গিয়ে চোট হল কপালে।

প্রায় সারা রাত কাঁদল নিমাই। এক ফোঁটা ঝিমুনি এল না তার গুদামঘরের গুমটিতে পাহারা দিতে বসে। সারা রাত ভগবানকে ডাকল, সারা রাত মনস্তাপে হাহাকার করল বুক। না, তার একটুও লোভ নেই। তার যা আছে সব সে দিয়ে দেবে কাকাকে। তারপর কাকা ছোরা বা গুলি যাই দিয়েই মারুক শান্তভাবেই মরবে নিমাই। কর্মফল ক্ষয় হোক।

ওদিকে রাত ন’টা নাগাদ বনগাঁয়ে বীণার দরজায় ধাক্কা পড়ল, বীণা দরজা খোলো শিগগির।

বিরক্ত হয়ে বীণা উঠে এল, এত রাতে জ্বালাতে এলেন বাবু। কী গো, কী চাই?

সজলকে কিছু উদ্‌ভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। বলল, বীণা, আমি ছুটতে ছুটতে আসছি। একটা কথা ছিল।

বীণা মুখ টিপে হেসে বলল, রসের কথা তো! অনেক বলেছ।

বীণা, কথাটা জরুরি। তোমার বিপদ!

বিপদ!

সকল অধ্যায়

১. ১. বাদামতলায় রামজীবনের পাকা ঘর
২. ২. এয়ারলাইনস্ অফিসের কাছাকাছি
৩. ৩. নতুন কেনা সুটকেসটা
৪. ৪. একটা ন্যাকা বৃষ্টি
৫. ৫. দোকানটায় ঢুকতে একটু লজ্জা করছে
৬. ৬. নপাড়ার ছেলেরা
৭. ৭. পৃথিবী কি দাড়ি কামায়
৮. ৮. মেঘলা দিনের কালো আলো
৯. ৯. আই সি এস ই পরীক্ষায়
১০. ১০. কামিনী-কাঞ্চন থেকে তফাত
১১. ১১. কাল রাতে বামাচরণে আর রামজীবনে
১২. ১৩. যেমন ভ্যাতভ্যাতে বর্ষা তেমনি গুমসোনো গরম
১৩. ১৪. মায়ের সঙ্গে ঝুমকির বোঝাপড়ার অভাব
১৪. ১৫. দুদুটো প্রেমে পড়ে গেল হেমাঙ্গ
১৫. ১৬. বিষ্ণুপদর পেটটা একটু নেমেছে
১৬. ১৭. জানালা দুরকম হয়
১৭. ১৮. বীণাপাণির বিপদের কথা
১৮. ১২. লিফটবাহিত হয়ে
১৯. ১৯. এনি সার্জারি অন মাই হার্ট
২০. ২০. নতুন আফটার শেভ লোশন
২১. ২১. পুলিন ডাক্তার সব বিদ্যেই জানে
২২. ২২. প্লেন চলেছে ভোরের দিকে
২৩. ২৩. বনগাঁয়ের জমাটি অঞ্চলে নয়
২৪. ২৪. কাউকে কোনও উপলক্ষে ফুল দেওয়া
২৫. ২৫. খোঁচাখুঁচি করা হেমাঙ্গর একটা বদ অভ্যাস
২৬. ২৬. মেঘ দেখলে আনন্দ হয়
২৭. ২৭. শরীর ছাড়া মানুষের আর কী আছে
২৮. ২৮. বিড়ির গন্ধটা নিমাইয়ের সহ্য হচ্ছিল না
২৯. ২৯. ছেলেটাকে ধরেছিল আপা
৩০. ৩০. গাঁয়ের স্কুলের অডিট
৩১. ৩১. জলকাদায় বৃষ্টিতে গাঁ-গঞ্জের কাঁচা-পাকা রাস্তায়
৩২. ৩২. মোহিনী অনেকদিন ধরে তাকে বলছে
৩৩. ৩৩. ছিনের মরার কথা ছিল না
৩৪. ৩৪. প্রিয় ঋতু
৩৫. ৩৫. পোড়া মাংসের স্বাদ
৩৬. ৩৬. ভূতুরে ভয়
৩৭. ৩৭. কনফারেন্স, সেমিনার এবং বক্তৃতা
৩৮. ৩৮. নিমাইচরণ আছো নাকি
৩৯. ৩৯. কল্পনায় শহরটাকে ঠিকমতো সাজিয়ে গুছিয়ে
৪০. ৪০. গত সাত দিন ধরে হেমাঙ্গ ভাবছে
৪১. ৪১. তৰ্পণের দিন
৪২. ৪২. হেঁচকির শব্দ
৪৩. ৪৩. আজকাল বড্ড ভ্রম হয়ে যাচ্ছে
৪৪. ৪৪. লিভিং রুমের ঠিক মাঝখানটায়
৪৫. ৪৫. হেমাঙ্গর কোনও ওয়ারিশন থাকবে না
৪৬. ৪৬. সন্তৰ্পণে দরজাটি খুলল
৪৭. ৪৭. প্রফেসর শর্মা
৪৮. ৪৮. দুনিয়াটা চারদিকে হাঁ-হাঁ করা খোলা
৪৯. ৪৯. বড় মেয়ের বয়স
৫০. ৫০. ভাঙনে নদীর ধারে বাড়িঘর
৫১. ৫১. নিমকহারাম শব্দটা
৫২. ৫২. চিলেকোঠাটা এত ছোটো
৫৩. ৫৩. কাকা ডেকে পাঠিয়েছিলেন
৫৪. ৫৪. স্কুল-টুলেও বক্তৃতা
৫৫. ৫৫. সারা রাত ঘরের কাছে জলের ঢেউ
৫৬. ৫৬. এক-একটা দিন আসে
৫৭. ৫৭. চয়ন যখন পড়ায়
৫৮. ৫৮. ঘটনাটা ঘটল সন্ধেবেলায়
৫৯. ৫৯. বাড়ির প্ল্যান পাল্টাতে হল
৬০. ৬০. নদীর ধারে বাস করতে
৬১. ৬১. পড়াতে পড়াতে সব মনে পড়ে যাচ্ছে
৬২. ৬২. একটা নদী কত কী করতে পারে
৬৩. ৬৩. এরা মাটি ভাগ করতে চায়
৬৪. ৬৪. নিরঞ্জনবাবুর কাছে বসে থাকলে
৬৫. ৬৫. জ্যোৎস্না রাতে ছাদের রেলিং-এর ধারে
৬৬. ৬৬. একটা গুণ্ডার দল
৬৭. ৬৭. হেমাঙ্গর দাড়ি ক্ৰমে বেড়ে যাচ্ছে
৬৮. ৬৮. নিজেকে মুক্ত রাখা কি সোজা কথা
৬৯. ৬৯. চারুশীলা যে কেন তাকে এয়ারপোর্টে ধরে এনেছে
৭০. ৭০. টাকা আসছে
৭১. ৭১. অপর্ণার ইদানীংকালের জীবনে
৭২. ৭২. রশ্মি চলে যাওয়ার দিন
৭৩. ৭৩. শ্যামলীকে শাসিয়ে গেল
৭৪. ৭৪. যারা টিউশনি করে
৭৫. ৭৫. পনেরো দিন জ্বরে পড়েছিল বীণা
৭৬. ৭৬. পার্কের মধ্যে ঘাপটি মেরে
৭৭. ৭৭. ডারলিং আৰ্থ বইটা
৭৮. ৭৮. স্ট্রোক জিনিসটা কি
৭৯. ৭৯. দাদার সঙ্গে সম্পর্কটা
৮০. ৮০. চিঠিটা এল দুপুরে
৮১. ৮১. আপার মা আর বাবা
৮২. ৮২. দাড়ি আর গোঁফের কতগুলো অসুবিধের দিক
৮৩. ৮৩. বামাচরণকে প্রথমটায় চিনতেই পারেনি বিষ্ণুপদ
৮৪. ৮৪. লিফটে একাই ছিল চয়ন
৮৫. ৮৫. বীণা এত অবাক হল
৮৬. ৮৬. গ্যারেজের ওপর একখানা ঘর
৮৭. ৮৭. আর কী বাকি রাখলেন
৮৮. ৮৮. টাকা জিনিসটার যে কী মহিমা
৮৯. ৮৯. তার ভিজিটিং কার্ড নেই
৯০. ৯০. বুকের মধ্যে যেন একটা শাঁখ বেজে ওঠে
৯১. ৯১. আপাতত একতলা
৯২. ৯২. একটা মধ্যযুগীয় শাসনতন্ত্র
৯৩. ৯৩. পুত্রকন্যা শব্দগুলির অর্থ
৯৪. ৯৪. হেমন্তের স্নিগ্ধ বিকেল
৯৫. ৯৫. পালপাড়ায় গিয়ে একদিন
৯৬. ৯৬. মণীশের বাক্যহীন চেয়ে-থাকাটা
৯৭. ৯৭. পৃথিবীর রূপের জগৎ
৯৮. ৯৮. বিনীতভাবে নমস্কার
৯৯. ৯৯. একটু ফাঁকা লাগছিল চয়নের
১০০. ১০০. এত আনন্দ হল বাড়িতে
১০১. ১০১. কত সামান্য হলেই চলে যায়
১০২. ১০২. কাকা তাকে ডাকল না
১০৩. ১০৩. রবিবারের এক সকালে
১০৪. ১০৪. ছোট ফিয়াট গাড়ির মধ্যে
১০৫. ১০৫. চারদিকে সুখ
১০৬. ১০৬. মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় অরণ্যে
১০৭. ১০৭. মাসে মাসে পাঁচশো করে টাকা
১০৮. ১০৮. চারদিকে কত গাছ
১০৯. ১০৯. বডন স্ট্রিটের বাড়িতে
১১০. ১১০. বাংলাদেশে যাওয়ার আগে
১১১. ১১১. শোকের এমন প্রকাশ
১১২. ১১২. এইভাবেই দান উল্টে যায় পৃথিবীর
১১৩. ১১৩. মণীশের শরীর খারাপ হয়েছিল
১১৪. ১১৪. রাওয়াত নামে এক বন্ধু
১১৫. ১১৫. বিষ্ণুপদর শ্রাদ্ধাদি মিটে যাওয়ার এক মাস পর
১১৬. ১১৬. শীতের শুরুতেই দাদা-বউদি বেড়াতে গেল
১১৭. ১১৭. নিমাইয়ের পাঠানো টাকা
১১৮. ১১৮. একবিংশ শতকে কেমন হবে নর-নারীর সম্পর্ক
১১৯. ১১৯. ক্রাচে ভর দিয়ে
১২০. ১২০. একাকার হয়ে যাই

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন