৬৬. একটা গুণ্ডার দল

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

৬৬

আমি নিশ্চয়ই একটা গুণ্ডার দল খুলব। যত অন্যায় আর অবিচার আছে আর হচ্ছে সব কিছুকে তন্দরুস্থ করতে হবে।

আপার এই ঘোষণা শুনে খুবই অবাক হয়ে গেল বুকা আর অভিজিৎ। বুবকা বলল, গুণ্ডার দল খুলবে? আপা, তোমার মাথাটাই গেছে।

আপা একটু উষ্মার সঙ্গে বলল, তোমাদেরও মাথা আমার মতোই খারাপ হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তোমাদের কোনও ইনভলভমেন্ট নেই বলে হচ্ছে না। তোমরা আছ নিজের ধান্ধায়। নিজের উন্নতি, নিজের ভবিষ্যৎ। আমার মতো যদি দুনিয়াটাকে দেখতে তো বুঝতে।

তা বলে গুণ্ডার দল!

আমাদের পিছনের বস্তি থেকে একটা লোক তার বউ আর তিনটে বাচ্চাকে রেখে আর একজনের বউ নিয়ে পালিয়ে গেছে। সেই লোকটাকে আমি অন্তত দশ জায়গায় খুঁজেছি। তারপর ধরেছি গোবিন্দপুর বস্তিতে। লোকটা আমার চেনা, পাম্প আর পাইপ সারাত। নাম গোপাল। যখন ধরলাম তখন আমাকে তেড়ে এল, জানো? সঙ্গে আরও দশ-বারোটা নোক আর সেই ভেগে আসা মেয়েটা! আমাকে হয়তো মারধরও করত! কী গালাগাল!

অভিজিৎ অবাক হয়ে বলে, তুমি গেলে কেন? লোয়ার ক্লাসের লোকদের তো ওরকম কত হয়।

আপা অভিজিতের দিকে ভৎসনার চোখে চেয়ে বলল, লোয়ার ক্লাস বলে উপেক্ষা করলে চলবে? ওই লোকটার বউ ডলি আমাদের বাড়িতে এক সময়ে ঘরের কাজ করত। গোপাল পালিয়ে যাওয়ার পর তিনটে বাচ্চা নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছে। দুবেলা খাওয়া জুটছে না।

অভিজিৎ বলল, তুমি পুলিশকে জানালে পারতে। ইটস্ এ কেস অফ বাইগ্যামি। পুলিশ যা করার করত।

তুমি বড্ডই ভাল ছেলে অভিজিৎ। বাইগ্যামি হল ভদ্রলোকদের টার্ম, নিচুতলার লোকদের কাছে ওসব শব্দ অচেনা। পুলিশের কথাও আর বলল না। আমাদের পাড়ার একটা ফ্ল্যাটবাড়ির পাম্পসেট চুরি গিয়েছিল। থানায় কি বলল জানো? বলল, কারা চুরি করেছে তা আমরা জানি, কিন্তু কিছুই করার নেই। করলেই এক ঘণ্টার মধ্যে পাঁচশো লোক এসে থানা ঘিরে ফেলবে। তাই আমি পুলিশের কাছে যাইনি। নিজেই গিয়েছিলাম, যদি লোকটাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাতে পারি।

বুবকা বলল, অ্যান্ড ইউ ওয়্যার টট এ লেসন।

আপা একটু হেসে বলল, আমাকে অত সহজে শিক্ষা দেওয়া যায় বলে তুমি বিশ্বাস করো?

তা হলে তুমি এখন কী করবে?

আমি লোকটাকে জোর করে ধরে আনব। বউটাকেও। ওদের এরকম কাজ করার অধিকার নেই।

জোর করবে? তার জন্যই তোমার গুণ্ডা দরকার?

আপা মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ। তবে প্রফেশনাল গুণ্ডা নয়। তারা লোভী, অন্যায়কারী। আমার গুণ্ডারা হবে অন্যরকম। সমাজের ভালোর জন্য তারা সব করতে প্রস্তুত থাকবে। ঘাড় ধরে লোককে দিয়ে যেটা ভাল তা করিয়ে নেবে। কোনওভাবেই তাদের চরিত্র কেউ নষ্ট করতে পারবে না।

বুবকা খুব গম্ভীর গলায় বলল, আপা, তুমি যে একটু পাগল তা কি তুমি জানো?

জানি। আমার মতো পাগলই এখন দরকার। প্লিজ অনীশ, তুমিও একটু পাগল হও।

দেখ আপা, তোমার জন্য একবার আমিও পাগলামি করেছি। ড্রাগ পেডলাররা যখন তোমাকে অ্যাটাক করেছিল—তখন জীবনে আমি যা করিনি—তাও করেছি। একজনকে ধরে বেধড়ক ঠেঙিয়েছি। মনে আছে?

আছে। সেই জন্য আমি তোমাদের ওপর রেগেও গিয়েছিলাম। ওদের মারাটা আমার প্রোগ্রামে ছিল না। কাজটা মোটেই ভাল করনি।

অ্যান্ড ইউ আর নট ইভন গ্রেটফুল।

কেন হব? তোমাদের বলেছিলাম লোকগুলোকে চিনে রাখতে। তোমরা ওদের মেরে তাড়িয়ে দিলে। ওদের আর পাত্তাই পাওয়া গেল না।

তা হলে ওরা তোমাকে মেরে ফেললেই ভাল হত নাকি?

মারলে মারত। কত লোেক তো রোজ কত কারণে মারা যাচ্ছে। ওটা কোনও ঘটনাই নয়। আমি চাইছি এসব জিনিসকে একদম উপড়ে ফেলতে। তার জন্য এখন আমার সত্যিই একটা গুণ্ডাবাহিনী দরকার।

অভিজিৎ ওয়েট লিটার। সে রীতিমতো ব্যায়াম করে এবং বিভিন্ন কম্পিটিশনে নামে। বিস্তর প্রাইজও পেয়েছে। সে বলল, আমি তোমার দলে নাম লেখাতে রাজি আছি। কিন্তু এটা তো জানো, এ যুগে শুধু গায়ের জোরে গুণ্ডামি চলে না, ইউ মাস্ট হ্যাভ আর্মস্। তোমাকে পিস্তল জোগাড় করতে হবে, সাব মেশিনগান, চপার।

আপা হতাশভাবে বলল, ওঃ! বুদ্ধ আর কাকে বলে। ওসব দরকার হয় মানুষকে মারার জন্য। আমি তো তা করব না। আমি শুধু ফোর্স করব। ফোর্স করে লোককে অন্যায় কাজ থেকে সরিয়ে আনব।

অভিজিৎ মাথা নেড়ে বলে, তুমি ইমপ্র্যাকটিক্যাল। শুধু ঘুষি দেখে আজকাল খুব কম লোকই ভয় পায়।

টিফিন পিরিয়ড চলছে। স্কুলের কম্পাউন্ডে অনেক ছেলেমেয়ে। তারা একটু তফাতে, একটা গাছের তলায় বসে।

আপা ঠোঁট উল্টে বলে, যাদের হাতে আর্মস থাকে তাদের কিন্তু নৈতিক জোর থাকে না।

তার মানে?

আপা একটু হেসে বলে, তোমরা আমাকে পাগল বলো। তা আমি একটু তো পাগলই। আমার মনে হয় মানুষ যখন হাতে কোনও মারণাস্ত্র পায় তখন তার নৈতিক সাহস আর দৃঢ়তা খানিকটা চলে যায়। ওই অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সে। অস্ত্রটা ব্যবহারের একটা অজুহাত খোঁজে সে।

বুবকা হেসে বলে, ওঃ, ইউ আর রিয়েলি ইমপসিবল্‌।

আপা করুণাভরে বুকার দিকে চেয়ে বলে, শোনো বুদ্ধ, আমি যে গুণ্ডাদের কথা বলছি তাদের। সবচেয়ে বড় অস্ত্র হবে নৈতিক চরিত্র আর ব্যক্তিত্ব। সেটাই মানুষের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

ওসব কথা বইতে লেখা থাকে আপা। প্র্যাকটিক্যাল কথা ওটা নয়। আজকাল মর‍্যাল কারেজের কোনও দামই নেই। একটা বোমা মেরে সব কারেজ-ফারেজ উড়িয়ে দেবে।

দিক না। একবার দু’বার পাঁচবার দেবে। তারপর দেখো, চাকা ঘুরে যাবে উল্টোদিকে। মানুষের হাতে বরাবরই তো অস্ত্র ছিল, তাই বলে কি সাহসী লোকেরা নিরস্ত্র অবস্থায় ভাল কাজ করেনি কখনও?

যুগ পাল্টে গেছে আপা।

যুগ আবার পাল্টে দেওয়া যায়।

বুবকা বলল, তোমার নিরামিষ গুণ্ডার দলে আমি নেই আপা।

তোমাকে আমি আমার তালিকার বাইরেই রেখেছি বুবকা।

বুবকা হেসে ফেলল, তোমার কি লিস্ট তৈরি হয়ে গেছে?

আপা হাসল না। গভীর হয়ে বলল, হচ্ছে।

কী করবে তারা? মারপিট?

দরকার হলে করবে। কিন্তু মারপিটের চেয়েও বড় কথা, দেশে যে সব অন্যায়, পাপ আর খারাপ ঘটনা ঘটছে তার একটা ছক আছে। ইংরিজিতে যাকে বলে প্যাটার্ন।

ইউ মিন নকশা?

হ্যাঁ। এই নকশাটাকে ধরাই সবচেয়ে বেশী দরকার। মানুষ তো যা খুশি করছে। কেন করছে তা না জানলে কিছু করা যাবে না। এই যে গোপালের কথা বলোম, এ কোন সাহসে এরকম কাজ করল? এর পিছনেও একটা নকশা আছে। ও জানে, এরকম একটা অন্যায় করলেও কিছু হবে না। ওর বউ কয়েক দিন কান্নাকাটি করবে, দু-চার দিন হয়তো ওকে একটু বকাঝকা করবে। তারপর মেনে নেবে। তাই না?

বুবকা গম্ভীর হয়ে বলে, এটা হল একটা পারমিসিভনেস। তুমি এটাকে আটকাতেও পারবে না। আপার ক্লাসেও কি ওরকম হয় না? কত ডিভোর্স হচ্ছে।

সেটা হোক। কিন্তু বউটার মাসোহারা গোপালের কাছ থেকে আদায় করে দাও তা হলে। উঁচু সমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদ হলে মাসোহারার ব্যবস্থা থাকে।

বুবকা মাথা নেড়ে বলে, তুমি বেসরকারি গোয়েন্দা আর সৈন্যবাহিনী গড়তে চাইছ কেন? ওকে পুলিশে ধরিয়ে দাও।

চেষ্টা করেছি। হয়নি। আইনে অনেক ফাঁক থাকে অনীশ। সেই ফাঁক দিয়ে অপরাধীরা গলে যায়। তুমি কি জানো শতকরা সত্তর-আশিটা রেপ কেস-এ আসামীর কোনও সাজা হয় না?

আমি অত জানি না।

আমি জানি। পুলিশ কেস সাজায় না, সাক্ষীরা ঠিকমতো সাক্ষী দেয় না, আরও নানারকম ব্যাপার আছে। আইনের ফাঁক দিয়ে যেসব অপরাধী বেরিয়ে আসবে আমার গুণ্ডারা তাকেও ধরবে।

ধরে কি করবে আপা?

তাকে দিয়ে অপরাধ স্কুল করাবে, ক্ষতিপূরণ আদায় করবে, কৃতকর্মের জন্য তাকে অনুতপ্ত হতেই হবে।

তুমি একটা প্যারালাল গভর্নমেন্ট তৈরি করতে চাও?

ঠিক তাই চাই।

বুবকা আর অভিজিৎ হাসল।

অভিজিৎ বলল, আইডিয়া ইজ গুড।

বুবকা বলে, বাট ইমপ্র্যাক্টিকেবল্‌। আপা রবিন হুড হতে চাইছে।

অভিজিৎ বলে, চম্বলের ডাকাতরাও নাকি এরকম সব কী করত। কমন লোকাল পিপল লাইকড্‌ দেম।

আপা বিরক্তির সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, ডাকাতের কথা উঠছে কেন?

প্ল্যানটা অনেকটা ওরকম বলেই।

তোমরা আমাকে সমর্থন করছে না তা হলে?

অভিজিৎ বলে, করছি।

বুবকা মাথা নেড়ে বলে, আমি করছি না।

টিফিন শেষ হওয়ায় ক্লাসে ফিরে যেতে হল তাদের। কিন্তু বুবকার মাথায় সারাক্ষণ আপার অদ্ভুত প্ল্যানটা ঘুরতে লাগল। আপা গুণ্ডাবাহিনী তৈরি করতে চায়, এটা কোনও অদ্ভুত কল্পনা নয়। আপা হয়তো ওরকম কিছু একটা করবেও।

রাত্রিবেলা সে তার সবচেয়ে প্রিয় ও বিশ্বস্ত বন্ধু তার বাবাকে কথাটা বলে ফেলল, জানো বাবা, আপা একটা গুণ্ডার দল তৈরি করছে!

গুণ্ডার দল! বলিস কী?

এরা সব ডু-গুডার গুণ্ডা। সোস্যাল ইনজাসটিস আর করাপশনের এগেনস্টে লড়বে। শী ইজ অলরেডি ডুয়িং ইট। রিক্রুটমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। অভিজিৎ পাণ্ডা আজ আপার গুণ্ডার দলে জয়েন করেছে।

মণীশ একটু হাসল, আইডিয়াটা খারাপ নয়। কী করতে চায় আপা?

বললাম তো, সব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়।

তোকে রিক্রুট করেনি?

না, আমি বললাম, আমি ওসব পাগলামিতে নেই।

আপাকে বলিস ওর লিস্টে যেন আমার নামটা ঢুকিয়ে নেয়।

বুবকা অবাক হয়ে বলে, তুমি! তুমি আপার দলে জয়েন করবে?

আমার অনেক দিনের ইচ্ছে, পৃথিবীতে যত গুণ্ডামি আর শয়তানি হয় তার বিরুদ্ধে আর একটা গুণ্ডামি গড়ে তুলতে।

তুমি আপাকে সাপোর্ট করছ বাবা?

খুব। হান্ড্রেড পারসেন্ট।

বুবকা খুব হাসল। বলল, আইডিয়াটা আমারও খুব খারাপ লাগছিল না। কিন্তু ও বলছে, ওর গুণ্ডাদের কাছে আর্মস্‌ থাকবে না। শুধু মর‍্যাল ক্যারেকটার আর কারেজ।

আপা হয়তো একটু গান্ধীবাদী। কিংবা হয়তো ভাবে আর্মস্ হাতে পেলে এইসব ধর্মগুণ্ডারা আসল গুণ্ডা হয়ে যাবে।

আপা আরও গোলমেলে কথা বলছে। ওর ধারণা, আর্মস্‌ পেলে মানুষের নাকি মর‍্যাল ক্যারেকটার নষ্ট হয়ে যায়।

মণীশ হাসল, আর্মসের সঙ্গে লড়তে হলে আর্মও দরকার। অন্তত প্রাথমিকভাবে। তারপর অস্ত্র সংবরণ করা যেতে পারে।

বুবকা একটু চিন্তিত হল। বলল, হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আগে আপা এসব করে বেড়াচ্ছে, পড়ছে না। কিন্তু পরীক্ষায় দেখো, সবাইকে বিট করবে। এটা আপা কিভাবে পারে বাবা?

শী ইজ সারহ্যাপস্‌ এ জিনিয়াস!

আমার ধারণা কী জানো? আপা হায়ার সেকেন্ডারিতে ইচ্ছে করলেই ফাস্টও হতে পারে। কিন্তু পড়েই না। কেবল সোস্যাল ওয়ার্ক করে বেড়াচ্ছে। আমরা ক্যারিয়ারিস্ট বলে ঠাট্টাও করে।

মণীশ বলল, সেটাও হয়তো ওর দিক থেকে ঠিকই করে। কিন্তু তা বলে তুই আবার ক্যারিয়ারের চিন্তা ত্যাগ করিস না। সেটা ঠিক হবে না।

বুবকার ঘুম সাঙ্ঘাতিক। বালিশে মাথা রাখলেই ঘুমিয়ে পড়ে। আজ রাতে ঘুম আসতে পনেরো মিনিট সময় লাগল। কারণ, ওই সময়টায় সে আপার কথা ভাবল। আপা কি ঠিক বলছে? আর সে নিজে কি মস্ত ভুল করছে জীবনে? তার কি ক্যারিয়ারিস্ট হওয়া উচিত নয়? তার কি দরকার আরও সোস্যাল ইনভলভমেন্ট?

পরদিন সে আপাকে ফের ধরল টিফিন পিরিয়ডে, এই যে লেডি রবিন হুড!

আপা তার দিকে তাকিয়ে বলল, বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানী পড়নি অনীশ! কী বোকা তুমি! আমাকে দেবী চৌধুরানীও তো বলতে পারতে।

অনীশ দেবী চৌধুরানী পড়েনি। বইটার নাম অবশ্য শুনেছে। সে লজ্জা পেল। আপাকে ঘিরে এক গাদা ছেলেমেয়ে দাঁড়ানো। তাদের যেন কী একটা বোঝাচ্ছিল আপা। সবাই আপার কথা মন দিয়ে শুনছিল। পাগলী আপার কথা যতই অসম্ভব হোক, সবাই শোনে। এমন কি মিসরা পর্যন্ত।

বুবকা বলল, বাবা তোমাকে সাপোর্ট করেছে, জানো তো!

কাকাবাবু সমঝদার মানুষ, তোমার মতো নয়।

ইট সিমস্‌ সো। এমন কি, বাবা তোমার গ্রুপে নামও লেখাতে চেয়েছে। হি ওয়ান্টস্‌ টু জয়েন ইওর গ্রুপ অফ থাগস্‌।

আপা হাসল, কাকাবাবু খুব ভাল লোক। বলল, আমি তাঁর নাম টুকে নিয়েছি।

ছুটির পর আজ আপার সঙ্গেই বেরলো বুবকা। আর কেউ ছিল না সঙ্গে।

বুবকা বলল, তুমি কোথায় থামবে আপা? ইউ আর লিডিং এ ডেনজারাস লাইফ।

আমার বাঁধা জীবনে বিশ্বাস নেই অনীশ। আমি ওরকম ভাবে বেঁচে থাকতেও পারব না। তা বলে ভেবো না আমি হিংস্রতা পছন্দ করি বা মারধর খেতে ভালবাসি।

তুমি একটি রোগা দুর্বল মেয়ে। তুমি ঠিক বিপদে পড়বে।

বোকারাম, দুর্বল আর রোগা আর মেয়ে এই তিনটে কোনও শর্তই নয়। জোর কি শুধু গায়ের? এই যে অভিজিৎ বা অরোরা, ওদের গায়ে তো অনেক জোর। তা বলে কি ওরা সবাইকে হারিয়ে দিতে পারবে? না কি পারবে সমাজব্যবস্থা পাল্টে দিতে? মনের জোরই হল আসল জোর। আমি তো শরীরের শক্তির ওপর ভরসা করিনি।

বুবকা বিবর্ণ মুখে বলল, আই অ্যাডমিট দ্যাট। তোমার খুব সাহস। কিন্তু ইউ আর লিভিং এ ডেনজারাস লাইফ আপা। কেউ কেউ তোমার ওপর রেগে যাচ্ছে নিশ্চয়ই।

আমি জানি। আমার যেমন অনেক শত্রু আছে, তেমন আবার অনেক বন্ধুও আছে।

বন্ধুরা কি তোমাকে সবসময়ে বাঁচাতে পারবে?

আপা অবাক হয়ে বলে, বাঁচাবে! বাঁচাবে কি করে, তারা তো সবসময়ে আমার সঙ্গে থাকে না। বাঁচানোর দরকারই নেই। আমি যা করতে চাইছি সেটা তারা বুঝতে পারলে আর সমর্থন করলেই যথেষ্ট।

তুমি এই বয়সে এত পাকা হলে কি করে?

আপা হাসল। বলল, আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর। মনে আছে?

বুবকা অবাক হয়ে বলে, তোমারও মনে আছে?

তোমার আঠারো বছর বয়স পেরিয়ে গেল অনীশ, কিন্তু তুমি তো ভয়ংকর হতে পারলে না! কাকাবাবু মিথ্যেই চিন্তা করলেন।

ভয়ংকর হব আপা? সেটা কিভাবে হওয়া যায়? আমি তো পোয়েট্রিটা কখনও পড়িনি।

কেন পড়নি?

কোথায় পাব?

আপা হাসল, থাকগে, তোমার ওসব পড়ার দরকারও নেই।

তার মানে আমাকে তুমি পাত্তাই দিচ্ছ না?

আপা হাসল। বলল, হি-ম্যান-এর মতো চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ালে আর পরীক্ষায় গাদা গাদা নম্বর পেলেই কি পাত্তা পাওয়া যায়? তোমার গায়ে কতটা জোর বা লেখাপড়ায় তুমি কতটা ভাল তা নিয়ে দুনিয়ার মানুষের তো মাথাব্যথা নেই।

তা হলে কী করব? ভয়ংকর কিভাবে হওয়া যায়?

তোমাকে কেউ ভয়ংকর হতে তো বলেনি। বলেছে, আঠারো বছর বয়সটাই ভয়ংকর। এই বয়সে এসে মানুষ সব কিছু ভাঙচুর তছনছ করে দেয়। এই বয়সে যুবক-যুবতীদের বাঁধ ভাঙার সময়।

আমি ওসব একদম বুঝি না আপা।

অথচ কবিতাটা তোমাকে এক সময়ে খুব ভাবিয়ে তুলেছিল।

বুবকা একটু হাসল, কবিতাটা আমাকে একবার পড়াবে?

পড়াব। এখন বাড়ি যাও, ভাল ছেলে।

শেষ কথাটা বোধ হয় অপমান। আপা তাকে মাঝে মাঝে মৃদু অপমান করে। করতেই পারে। বুবকা এখনও কত কী জানে না, কত কিছুর খবর রাখে না। এমন কি দক্ষিণ ভারতীয় আপার কাছে বাংলা নলেজেও সে কত পিছিয়ে আছে!

সন্ধেবেলা আজ মাকে বাড়িতে একা পেল বুবক। বাবা ফেরেনি। দিদি বা অনুও নেই।

খাওয়ার টেবিলে বসে পায়েস দিয়ে লুচি খেতে খেতে বুবকা বলল, আচ্ছা মা, তোমরা আমাকে অ্যাডাল্ট হতে দিচ্ছ না কেন বলল তো!

অপর্ণা একটু অবাক হয়ে বলে, ও মা! সে কি কথা?

কথাটা কি ঠিক নয়?

তোকে অ্যাডাল্ট হতে দেব না কেন?

তোমরা যে আমার ওপর অনেক রেস্ট্রিকশন চাপাও, এটা করিস না, ওটা করিস না, এর সঙ্গে মিশিস না।

আহা, ছেলের ভালোর জন্য সব মা-বাবাই বলে। তাতে তোর অ্যাডাল্ট হওয়া আটকাচ্ছে কিসে?

আপাকে তার বাড়ি থেকে অনেক ফ্রিডম দেয়, তা জানো?

আপা! ওই তোদের সকলের মাথাটা খাচ্ছে। এবার আসুক, খুব বকব। কী বলছে আপা এখন শুনি!

শুনলে তুমি রেগে যাবে।

তবু শুনব।

আচ্ছা মা, আমি তো কখনও দুষ্টু ছেলে ছিলাম না, না?

না। দুষ্টু কেন হতে যাবি?

আমি খুব ভাল ছেলে?

অপর্ণা হাসল, ভালই তো। খুব ভাল।

কেন আমি ভাল ছেলে মা? কেন দুষ্ট নই?

এসব আজ কী বলছিস? কী পোকা ঢুকেছে মাথায়?

ভাল ছেলেগুলো ভীষণ ভ্যাতভ্যাতে টাইপের হয়, না মা?

কে বলল ও কথা?

ভাল ছেলেরা খুব আন-ইন্টারেস্টিংও।

তোকে বলেছে!

দেখ মা, সেই ছোট্টো বেলা থেকে আমি ভীষণ শান্ত, সব কথা শুনে চলি, পড়াশুনো করি, ভাল নম্বর পাই, জিনিসপত্র ভাঙি না, মারপিট করি না। সব সময়ে গুড বুক-এ আছি।

ডানপিটে হওয়া কি খুব ভাল নাকি? তোর বাবা অবশ্য খুব ডানপিটে ছিল। খুব সাহসীও। বিয়ের পরও মারপিট করেছে।

ওয়াজ হি ইন্টারেস্টিং?

অপর্ণার চোখে একটু রোমান্টিক ছায়া পড়ল। সামান্য হাসল সে। বলল, সবাই কি একই রকম হবে?

আমি বাবার মতো হলে কেমন হত?

তুই তোর মতো হয়েছিস।

বুবকা মাথা নেড়ে বলে, না মা, আই অ্যাম নট হ্যাপি উইথ মিসেলফ্‌। আমার নিজেকে ভাল লাগছে না। একদম ভাল লাগছে না।

সকল অধ্যায়

১. ১. বাদামতলায় রামজীবনের পাকা ঘর
২. ২. এয়ারলাইনস্ অফিসের কাছাকাছি
৩. ৩. নতুন কেনা সুটকেসটা
৪. ৪. একটা ন্যাকা বৃষ্টি
৫. ৫. দোকানটায় ঢুকতে একটু লজ্জা করছে
৬. ৬. নপাড়ার ছেলেরা
৭. ৭. পৃথিবী কি দাড়ি কামায়
৮. ৮. মেঘলা দিনের কালো আলো
৯. ৯. আই সি এস ই পরীক্ষায়
১০. ১০. কামিনী-কাঞ্চন থেকে তফাত
১১. ১১. কাল রাতে বামাচরণে আর রামজীবনে
১২. ১৩. যেমন ভ্যাতভ্যাতে বর্ষা তেমনি গুমসোনো গরম
১৩. ১৪. মায়ের সঙ্গে ঝুমকির বোঝাপড়ার অভাব
১৪. ১৫. দুদুটো প্রেমে পড়ে গেল হেমাঙ্গ
১৫. ১৬. বিষ্ণুপদর পেটটা একটু নেমেছে
১৬. ১৭. জানালা দুরকম হয়
১৭. ১৮. বীণাপাণির বিপদের কথা
১৮. ১২. লিফটবাহিত হয়ে
১৯. ১৯. এনি সার্জারি অন মাই হার্ট
২০. ২০. নতুন আফটার শেভ লোশন
২১. ২১. পুলিন ডাক্তার সব বিদ্যেই জানে
২২. ২২. প্লেন চলেছে ভোরের দিকে
২৩. ২৩. বনগাঁয়ের জমাটি অঞ্চলে নয়
২৪. ২৪. কাউকে কোনও উপলক্ষে ফুল দেওয়া
২৫. ২৫. খোঁচাখুঁচি করা হেমাঙ্গর একটা বদ অভ্যাস
২৬. ২৬. মেঘ দেখলে আনন্দ হয়
২৭. ২৭. শরীর ছাড়া মানুষের আর কী আছে
২৮. ২৮. বিড়ির গন্ধটা নিমাইয়ের সহ্য হচ্ছিল না
২৯. ২৯. ছেলেটাকে ধরেছিল আপা
৩০. ৩০. গাঁয়ের স্কুলের অডিট
৩১. ৩১. জলকাদায় বৃষ্টিতে গাঁ-গঞ্জের কাঁচা-পাকা রাস্তায়
৩২. ৩২. মোহিনী অনেকদিন ধরে তাকে বলছে
৩৩. ৩৩. ছিনের মরার কথা ছিল না
৩৪. ৩৪. প্রিয় ঋতু
৩৫. ৩৫. পোড়া মাংসের স্বাদ
৩৬. ৩৬. ভূতুরে ভয়
৩৭. ৩৭. কনফারেন্স, সেমিনার এবং বক্তৃতা
৩৮. ৩৮. নিমাইচরণ আছো নাকি
৩৯. ৩৯. কল্পনায় শহরটাকে ঠিকমতো সাজিয়ে গুছিয়ে
৪০. ৪০. গত সাত দিন ধরে হেমাঙ্গ ভাবছে
৪১. ৪১. তৰ্পণের দিন
৪২. ৪২. হেঁচকির শব্দ
৪৩. ৪৩. আজকাল বড্ড ভ্রম হয়ে যাচ্ছে
৪৪. ৪৪. লিভিং রুমের ঠিক মাঝখানটায়
৪৫. ৪৫. হেমাঙ্গর কোনও ওয়ারিশন থাকবে না
৪৬. ৪৬. সন্তৰ্পণে দরজাটি খুলল
৪৭. ৪৭. প্রফেসর শর্মা
৪৮. ৪৮. দুনিয়াটা চারদিকে হাঁ-হাঁ করা খোলা
৪৯. ৪৯. বড় মেয়ের বয়স
৫০. ৫০. ভাঙনে নদীর ধারে বাড়িঘর
৫১. ৫১. নিমকহারাম শব্দটা
৫২. ৫২. চিলেকোঠাটা এত ছোটো
৫৩. ৫৩. কাকা ডেকে পাঠিয়েছিলেন
৫৪. ৫৪. স্কুল-টুলেও বক্তৃতা
৫৫. ৫৫. সারা রাত ঘরের কাছে জলের ঢেউ
৫৬. ৫৬. এক-একটা দিন আসে
৫৭. ৫৭. চয়ন যখন পড়ায়
৫৮. ৫৮. ঘটনাটা ঘটল সন্ধেবেলায়
৫৯. ৫৯. বাড়ির প্ল্যান পাল্টাতে হল
৬০. ৬০. নদীর ধারে বাস করতে
৬১. ৬১. পড়াতে পড়াতে সব মনে পড়ে যাচ্ছে
৬২. ৬২. একটা নদী কত কী করতে পারে
৬৩. ৬৩. এরা মাটি ভাগ করতে চায়
৬৪. ৬৪. নিরঞ্জনবাবুর কাছে বসে থাকলে
৬৫. ৬৫. জ্যোৎস্না রাতে ছাদের রেলিং-এর ধারে
৬৬. ৬৬. একটা গুণ্ডার দল
৬৭. ৬৭. হেমাঙ্গর দাড়ি ক্ৰমে বেড়ে যাচ্ছে
৬৮. ৬৮. নিজেকে মুক্ত রাখা কি সোজা কথা
৬৯. ৬৯. চারুশীলা যে কেন তাকে এয়ারপোর্টে ধরে এনেছে
৭০. ৭০. টাকা আসছে
৭১. ৭১. অপর্ণার ইদানীংকালের জীবনে
৭২. ৭২. রশ্মি চলে যাওয়ার দিন
৭৩. ৭৩. শ্যামলীকে শাসিয়ে গেল
৭৪. ৭৪. যারা টিউশনি করে
৭৫. ৭৫. পনেরো দিন জ্বরে পড়েছিল বীণা
৭৬. ৭৬. পার্কের মধ্যে ঘাপটি মেরে
৭৭. ৭৭. ডারলিং আৰ্থ বইটা
৭৮. ৭৮. স্ট্রোক জিনিসটা কি
৭৯. ৭৯. দাদার সঙ্গে সম্পর্কটা
৮০. ৮০. চিঠিটা এল দুপুরে
৮১. ৮১. আপার মা আর বাবা
৮২. ৮২. দাড়ি আর গোঁফের কতগুলো অসুবিধের দিক
৮৩. ৮৩. বামাচরণকে প্রথমটায় চিনতেই পারেনি বিষ্ণুপদ
৮৪. ৮৪. লিফটে একাই ছিল চয়ন
৮৫. ৮৫. বীণা এত অবাক হল
৮৬. ৮৬. গ্যারেজের ওপর একখানা ঘর
৮৭. ৮৭. আর কী বাকি রাখলেন
৮৮. ৮৮. টাকা জিনিসটার যে কী মহিমা
৮৯. ৮৯. তার ভিজিটিং কার্ড নেই
৯০. ৯০. বুকের মধ্যে যেন একটা শাঁখ বেজে ওঠে
৯১. ৯১. আপাতত একতলা
৯২. ৯২. একটা মধ্যযুগীয় শাসনতন্ত্র
৯৩. ৯৩. পুত্রকন্যা শব্দগুলির অর্থ
৯৪. ৯৪. হেমন্তের স্নিগ্ধ বিকেল
৯৫. ৯৫. পালপাড়ায় গিয়ে একদিন
৯৬. ৯৬. মণীশের বাক্যহীন চেয়ে-থাকাটা
৯৭. ৯৭. পৃথিবীর রূপের জগৎ
৯৮. ৯৮. বিনীতভাবে নমস্কার
৯৯. ৯৯. একটু ফাঁকা লাগছিল চয়নের
১০০. ১০০. এত আনন্দ হল বাড়িতে
১০১. ১০১. কত সামান্য হলেই চলে যায়
১০২. ১০২. কাকা তাকে ডাকল না
১০৩. ১০৩. রবিবারের এক সকালে
১০৪. ১০৪. ছোট ফিয়াট গাড়ির মধ্যে
১০৫. ১০৫. চারদিকে সুখ
১০৬. ১০৬. মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় অরণ্যে
১০৭. ১০৭. মাসে মাসে পাঁচশো করে টাকা
১০৮. ১০৮. চারদিকে কত গাছ
১০৯. ১০৯. বডন স্ট্রিটের বাড়িতে
১১০. ১১০. বাংলাদেশে যাওয়ার আগে
১১১. ১১১. শোকের এমন প্রকাশ
১১২. ১১২. এইভাবেই দান উল্টে যায় পৃথিবীর
১১৩. ১১৩. মণীশের শরীর খারাপ হয়েছিল
১১৪. ১১৪. রাওয়াত নামে এক বন্ধু
১১৫. ১১৫. বিষ্ণুপদর শ্রাদ্ধাদি মিটে যাওয়ার এক মাস পর
১১৬. ১১৬. শীতের শুরুতেই দাদা-বউদি বেড়াতে গেল
১১৭. ১১৭. নিমাইয়ের পাঠানো টাকা
১১৮. ১১৮. একবিংশ শতকে কেমন হবে নর-নারীর সম্পর্ক
১১৯. ১১৯. ক্রাচে ভর দিয়ে
১২০. ১২০. একাকার হয়ে যাই

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন