১১০. বাংলাদেশে যাওয়ার আগে

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

১১০

বাংলাদেশে যাওয়ার আগে বিষ্ণুপদ বলে দিয়েছিল, পূর্বপুরুষের ভিটেটা একটু দেখে আসিস বাবা। আমার তো আর যাওয়া হবে না। তুই দেখে এলেই আমারও এক রকম দেখাই হবে।

ঢাকায় নেমে নানা কনফারেন্সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কৃষ্ণজীবন। তারপর একদিন বাংলাদেশেরই একটি অমায়িক ছেলে আনোয়ার তাকে একখানা টয়োটা গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে গেল তার গাঁয়ে। যেতে যেতে বলল, কিছু চিনতে পারবেন না। সব পাল্টে গেছে।

কৃষ্ণজীবন হেসে বলল, চিনব কি? আমার তো কিছু মনেই নেই।

দু’বার ফেরী পেরিয়ে বেশ একটু ধকলের পর যখন গাঁয়ে পৌঁছালো কৃষ্ণজীবন তখন দুপুর। সেই খাড়া শারদীয় রোদে সে দেখল, কিছু আহামরি গ্রাম নয়। একটু ছন্নছাড়া। ক্ষেতে ফসল আছে। গাছপালা বিশেষ রকমের সতেজ।

আনোয়ার দু-চারজনকে জিজ্ঞেস করে একটা বাড়ি খুঁজে বের করল। বলল, দাদা, এইটেই আপনাদের বাড়ি ছিল।

কৃষ্ণজীবন নির্বিকার চোখে চারখানা টিনের ঘর আর একটা কোঠাবাড়ি আর উঠোন সমেত বাড়িটা নিরীক্ষণ করল। এই তাদের বাড়ি। এ বাড়ির স্মৃতিমেদুর মায়ায় বিষ্টুপুরে এক বৃদ্ধ ন্যুব্জ হয়ে বসে থাকে আজও। কৃষ্ণজীবন পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। সামনে আনোয়ার।

খবর পেয়ে বাড়ির মালিক বেরিয়ে এল। মধ্যবয়স্ক একজন রোগা মানুষ।

আসেন, আসেন। বলে নিয়ে গেল ভিতরে। কোঠাবাড়ির বারান্দায় চেয়ার পেতে দিল। বসাল।

দেখতে আসছেন? দেখেন, ভাল করে দেখেন।

কৃষ্ণজীবন একটু হেসে বলল, এ বাড়ি কি হাতবদল হয়েছে, নাকি আপনারাই প্রথম থেকে আছেন?

বিশ্বাসবাবুদের কাছ থেকে আমার আব্বাজান কিনেছিলেন। তারপর থেকে আমরাই আছি। এই কোঠাবাড়িটা ছিল না, আর ওই পশ্চিমের ঘরটা নতুন করে করা হয়েছে।

একটা পুকুর ছিল বলে শুনেছি। আছে?

আছে। এই কোঠাবাড়ির পিছনে।

একটা করমচা গাছ ছিল।

আছে।

এরা সম্পন্ন গৃহস্থ নয়। আবার একেবারে হা-ভাত জো-ভাতও নয়। এদের যা অবস্থা তার চেয়ে ভাল অবস্থা কি তাদের ছিল? মনে হয় না।

লোকটার নাম রজব আলি। মুখে হাসি লেগেই আছে। বলল, আজ এইখানেই দাওয়াত হোক। নিজের বাড়ি দেখতে এলেন, ছাড়ছি না।

কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলল, উপায় নেই সাহেব। আমাকে এখনই ফিরতে হবে।

আনোয়ারও ঘড়ি দেখে বলল, আর পনেরো মিনিটের মধ্যে রওনা না হলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখা যাবে না।

পনেরো মিনিটের মধ্যেই বাড়িটা ঘুরে দেখল কৃষ্ণজীবন। গাঁয়ের বাড়ি যেমন হয় তেমনি। কোনও আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই। এ বাড়িতে তাদের চার পুরুষের বাস ছিল। কিন্তু সেই ইতিহাস তো খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও। শুধু স্মৃতি, শুধু মায়া নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে তার বাবা। দেশ বলতেই ভিজে যায় মন।

রজব আলিকে আনোয়ার বোঝাচ্ছিল, ইনি একজন মস্ত মানুষ। চারদিকে নাম। দেশ-বিদেশের পণ্ডিতেরা চেনেন। মোটাসোটা কেতাব লেখেন।

রজব আলি এ সব শুনে যেন বিগলিত হয়ে যায়। নিজের ছেলেরা সবাই ক্ষেতখামারে কাজ করছে। তাদের ডেকে দেখাতে পারল না বলে দুঃখ করে বলল, আবার আসেন একবার। সারাদিন থাকবেন।

ফেরার সময় কৃষ্ণজীবন উঠোনের বাইরে একটা ঝুপসি আমগাছের নীচে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, এটা কি পুরনো গাছ?

জী। আপনার বাপ-দাদার আমলের। বুড়ো গাছ।

একটা ছোট পল্লব ভেঙে নেবো?

রজব আলি শশব্যস্তে বলল, নিশ্চয়ই। দাঁড়ান আমি পেড়ে দিই।

আমিই নিচ্ছি।

একটা পাতাসমেত ছোট ডাল গাছ থেকে ভেঙে নিল সে। এটার চেয়ে মহার্ঘ উপহার বাবার জন্য আর ভাবতে পারে না সে।

দু’ দিন বাদে ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরল সে। তারও দু’ দিন বাদে বিষ্টুপুর।

বিষ্ণুপদ হাঁ করে অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে সব শুনল। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না যে, গ্রামটা এখনও আছে, বাড়িটা আছে। বারবার তাকে স্পর্শ করল হাত বাড়িয়ে। বলল, সব দেখলি, অ্যাঁ! সব দেখলি?

হ্যাঁ বাবা, সব।

বল, আরও বল, সব শুনি।

বাবাকে কদাচিৎ এত উত্তেজিত দেখেছে কৃষ্ণজীবন। একটা মানুষের কত টান থাকে তার পূর্বপুরুষের ভিটের ওপর! অথচ সেখানে কীই বা ছিল আলাদা রকমের? কাঁচা বাড়ি, পুকুর, গাছপালা। কিন্তু ওভাবে তো দেখে না মানুষ। তার স্মৃতি, তার মায়া, তার পক্ষপাতই অন্য একটা মাত্রা যোগ করে দেয়। তখন আর সাধারণ একটা বাড়ি সাধারণ থাকে না। হয়ে যায় রূপকথার মতো অলৌকিক।

উঠোনের বাইরের দিকে একটা আমগাছ ছিল বাবা, মনে আছে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ । মধুকুলকুলি আম। আছে সেটা?

আছে। তার একটা পল্লব এনেছি আপনার জন্য।

সাগ্রহে পল্লবটা হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকায় বিষ্ণুপদ। কয়েকদিনে পল্লবটা একটু শুকিয়ে গেছে। বিষ্ণুপদ তবু অবাক চোখে পল্লবটার দিকে চেয়ে থাকে। যেন অবিশ্বাস্য কিছু দেখছে।

যারা আছে তারা কেমন লোক?

গরিব সাধারণ লোক। আদর-যত্ন করতে চেয়েছিল। সময় ছিল না।

করমচা গাছটা?

আছে।

ঘরগুলো বোধহয় ভেঙে আবার করেছে! না?

বোধহয়। তবে পরিবর্তন খুব একটা হয়নি শুনলাম।

বিষ্ণুপদ হাঁ করে শুনছে। স্মৃতিতে নতুন করে ঢেউ লাগছে। মন চলেছে উজানে। দুখানা স্বপ্নাতুর চোখ বিষ্টুপুর ছেড়ে কোথায় কোন গহীন অতীতের অন্ধকার ভেদ করার চেষ্টা করছে।

নয়নতারাও সব শুনল। কিন্তু অত ভাবাবেগ নিয়ে নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভাল করেছিস গিয়ে।

বাবাকে খুশি করতে পেরেছি, এইটেই যথেষ্ট।

নয়নতারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, মানুষটা মুখে তেমন কিছু বলে না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে দেশের কথা খুব ভাবে। কেন ভাবে কে জানে বাবা! আমি তো অত ভাবি না। দেশে যে কোন সুখটা ছিল! সেখানেও অভাবের সংসার, এখানেও অভাবের সংসার।

কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, তোমার হল প্র্যাকটিক্যাল চোখ। বাবার তো তা নয়। বাবা অন্য চোখ দিয়ে দেখে। দেশে থাকতেও কচু-ঘেঁচুই খেয়েছে তবু বলে, ওঃ, দেশে যা খেয়েছিলাম সেরকম আর হয় না। ওটা একটা মায়া।

হ্যাঁ বাবা, তোর বাবার মতো করে আমি দুনিয়াকে দেখি না কখনও।

কৃষ্ণজীবন সারাদিন ধরে বাবাকে ঘুরে ফিরে দেখল। বিষ্ণুপদ বড় নিঃঝুম হয়ে আছে আজ। কথা নেই। স্মৃতির তাড়নায় আজ বিষ্ণুপদ অনেক তফাত হয়েছে।

নয়নতারা একবার বলল, বড় ভয় লাগছে বাবা। ও যে মুখে একদম কুলুপ এঁটেছে।

কৃষ্ণজীবন বলল, আজ আর বাবাকে ঘাঁটিও না মা। আপনমনে থাকতে দাও। আজ বড় পিছুটান।

আম্রপল্লবটা সেই যে ধরে বসে আছে, একবারও ছাড়েনি।

পরদিন আম্রপল্লবটা ঠাকুরের সামনে রেখে বিষ্ণুপদ একসময়ে স্নান করল, ভাত খেল। খেতে বসে নয়নতারাকে বলল, কোঠাবাড়িতে থাকতে ইচ্ছে যায় না।

ও মা! কেন গো?

জুত পাই না। টিনের ঘর, মাটির ভিত সেই যেন ভাল ছিল।

তোমাকে নিয়ে আর পারি না। কৃষ্ণ এত পয়সা খরচ করে রাজার বাড়ি বানিয়ে দিল, তোমার তবু সয় না কেন?

আমার আর্ষ নেই গো। আমি বড্ড মাটির মানুষ যে!

তা জানি। বাবুগিরি তোমার কোনও কালে ছিল না। মোটা কাপড়, মোটা ভাত, এ সবই পছন্দ। তা জীবনে আরও তো নানারকম আছে। একটু চেখে দেখতে হয়।

চেখেই তো বলছি, এ আমার পোযাচ্ছে না।

হরি বলো মন। এখন কি আবার দালান ভেঙে পুরনো ঘর খাড়া করতে বলব নাকি কৃষ্ণকে?

বিষ্ণুপদ একটু হাসল। বলল, খুব ফুট কাটতে শিখেছো দেখছি। না, ওটার দরকার নেই। বললাম আর কি। তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলি!

আমাকেই তো বলো আর সেই জন্যই তো তোমার জন্য আমার কষ্টটাও বেশি।

আচ্ছা বলল তো, তোমার দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে না?

সত্যি কথা বলতে কি, তুমি যেখানে থাকো সেটাই আমার দেশ। আমি আর অন্য দেশ নিয়ে ভাবি না। দেশ বলতে আমার হচ্ছে জন।

বিষ্ণুপদ একটু হাসল, শোনো কথা! জন বলতে কি শুধু মানুষ, শুধু আত্মীয়? আর কিছু নয়?

আর কি?

গাছপালা, ঘরবাড়ি, মাটিটা পুকুরটা সবটাই তো জন।

তুমি বললে তাই।

আমাকে এসবও বলে দিতে হবে, তবে তুমি বুঝবে?

আমার বাপু অত মাথায় খেলে না। তুমি বোঝালে বুঝি।

বিষ্ণুপদ ভাতের গরাস নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, বুঝলে তুমিই হয়তো বুঝবে। তোমার মন বড় পরিষ্কার। কী জানো, এই চার ধারে যা কিছু আছে সবই যেন মানুষ। গাছটা, মাটিটা, ঘরটা সবই যেন বড় আপনার জন। দেশের বাড়িতে তাদেরই তো রেখে এসেছি কিনা!

এখানে এসে যে আবার নতুন করে সবাইকে পেলে। গাছ, মাটি, ঘর।

তা পেলাম। তবু পুরনোরা বেশি টানে। বাপ-দাদার ভিটে। পূর্বপুরুষদের বাস ছিল। ওর রকমটাই আলাদা। এই যে কৃষ্ণ একখানা গাছের ডাল হাতে করে এসেছে, কী বলব তোমাকে, সেই ডালখানাও যেন আমার সঙ্গে কত কথা কইল।

ওরকম হয়। তা বলে অমন চুপ মেরে যাও কেন? আমার যে ভয় করে।

ভয়! না, ভয়ের কি? পুরনো সব কথা মনে পড়ছিল। সামান্য সামান্য সব ঘটনা, তুচ্ছ সব কথা। তাই যেন মনটা রসস্থ হয়ে গেল।

তোমার বড় মায়া গো!

সেই জন্যেই তো দেহ ছাড়ে না।

বালাই ষাট। ওসব বলতে আছে?

কৃষ্ণকে দেশের বাড়ি দেখতে পাঠালাম। তা তার চোখ দিয়ে যেন আমারও দেখা। মনটা কিছু অস্থির হয়েছে তাই।

হ্যাঁ গো, তোমার যদি এতই মায়া তবে ঘুরে এসো না একবার। আজকাল কত লোক তো যাচ্ছে।

না না, সে ব্যাপারই নয়।

কেন বল তো!

গিয়ে কত পরিবর্তন দেখতে পাবো। সে কি ভাল লাগবে? মনটা খারাপ হয়ে যাবে। আমাদের কোঠাবাড়ি ছিল না, এখন হয়েছে। ঘরদোর, গাঁ সবই পাল্টে গেছে কত। ভাল লাগবে না। মন খারাপ হবে।

তাহলে বসে বসে ভাববে শুধু?

বিষ্ণুপদ একটু হাসল, ভাবতেই ভাল গো! ভাবনাও এক রকমের ওষুধ। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।

আমি যে কিছু ভাবি না, তাহলে আমার কী হবে?

তুমিও ভাবো। তবে নিষ্কর্মার মত নয়। তোমার আলাদা একটা রকম আছে, বাস্তববোধও আছে। আমার হল অলস-চিন্তা।

বিষ্ণুপদ কয়েকটা দিন ভেসে রইল মনের এরোপ্লেনে। মাটিতে পা দিল না। খুব রসস্থ মন, খুব আনমনা।

একদিন সকালে বিষ্ণুপদ নয়নতারাকে ডেকে বলল, আমার কত বয়স হল বলল তো! হিসেব আছে?

তা কেন থাকবে না?

হিসেব করে দেখ তো বেশ করে।

হঠাৎ আবার বয়সের দরকার পড়ল কেন?

অনেককাল বয়সের কথা ভাবছি না। একটু হিসেব করা ভাল। কত হল?

বোধহয় ছিয়াত্তর সাতাত্তর।

উহুঁ, বড্ড নামিয়ে ফেলছে। একটু ওপরে ওঠো।

অত চুলচেরা হিসেব কি আমরা পারি? দু-এক বছরের তফাত হতে পারে।

যতই কমাও, প্রকৃতির নিয়মে আমার বয়স আশি পেরিয়েছে।

ওম্মা গো! কী বলে রে ডাকাত! আশি! তোমার কি মাথা খারাপ নাকি?

আশি তো ছার, আমার হিসেবে বিরাশি।

কিছুতেই নয়, তোমাকে কি ভীমরতিতে ধরল, হ্যাঁ গা?

না। সে তোমাকেই ধরেছে।

তা আজ বয়স নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কেন বাপু? জন্মদিন করবে নাকি?

এক গাল হেসে বিষ্ণুপদ বলে, তা করলে হয়। সেবার— কবে যেন— আমার জন্য রেমো একটা কেক এনেছিল। এসে বলল, বাবা, জন্মদিনে সাহেবরা কেক খায় শুনেছি। তাই আনলাম। শুনে হেসে বাঁচি না। জন্মদিন কবে তারই ঠিক নেই, উনি কেক এনে হাজির। তবে জিনিসটা ছিল বেশ ভাল। এখনও মুখে স্বাদটা লেগে আছে। তা লাগাও একটা জন্মদিন। তারিখটা যখন মনে নেই তখন যে কোনও দিন লাগালেই হয়।

নয়নতারাও হাসছিল। বলল, অত সোজা নয়। শাশুড়ি ঠাকরুনের কাছ থেকে আমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করেছি। তোমার জন্ম কার্তিকে।

তাই বুঝি? সেজন্যই এমন পাথরচাপা কপাল।

কেন, কার্তিকে জন্মানো বুঝি খারাপ?

লোকে বলে, কার্তিকে রবি নীচস্থ থাকে। এ মাসের জাতকের উন্নতি করা খুব কষ্ট। তবে হলে ধীরে ধীরে হয়।

কপাল তোমার মোটেই খারাপ নয়। কষ্ট ছিল, কিন্তু আমাদের মতো বর-বউতে এমন ভাব খুঁজে বের করো তো! পাবে আর এক জোড়া?

তা ঠিক।

আজকাল বর-বউয়ের ঝগড়ায় বাড়িতে কাক-চিল বসতে পারে না। আমাদের কোনওদিন ঝগড়া হয়েছে বলো?

বিষ্ণুপদ মিটিমিটি হেসে বলল, সে একখানা বিশ্বরেকর্ডই বটে। জীবনে একবারটিও ঝগড়া করলে না। করলেও পারতে। তাতে একটু ঝাল-নুনের কাজ হত জীবনটায়।

কেন, ঝগড়া করিনি বলে কি আলুনি লেগেছে তোমার?

বিষ্ণুপদর হাসতে হাসতে চোখে জল এল। বলল, না গো ঠাট্টা করলাম। তুমি কি তেমন মেয়ে? কত কষ্ট দিয়েছি ভাত-কাপড়ের, কত খাটিয়েছি সংসারে, একবারটি নালিশ করোনি।

কেন করব নালিশ? যার কাছে নালিশ করব সে কিছু কম কষ্ট করেছে? তোমার কষ্ট দেখে নিজের কষ্টের কথা ভুলেই যেতাম।

সেই জন্যই তো তুমি রমণীরত্ন।

ও আবার কী? অত প্রশংসা করতে হয় না।

প্রশংসা করলে কী হয়?

লোকে বলবে বউয়ের আঁচলধরা।

তাহলে চেঁচিয়েই বলতে হয় কথাটা। লোকে নিন্দে করুক, তাতে আমার আনন্দই হবে।

ওম্মা গো! কী মানুষ তুমি গো?

বিষ্ণুপদ হাসতে হাসতে বলল, যাঃ, এক ধাক্কায় আমার বয়সটা বোধহয় সত্যিই কমিয়ে দিলে!

বয়স আবার কিভাবে কমল?

আনন্দে কমে, ফুর্তিতে কমে। তোমার কথায় আজ খুব আনন্দ হচ্ছে আমার। ওই ছিয়াত্তর সাতাত্তরই থাক।

অতও হয়তো নয়। আমাদের মোটা হিসেব। দু-চার বছর কমই হবে হয়তো। হ্যাঁ গো, কেক খেতে ইচ্ছে হয়েছে নাকি?

আনাবে?

তা আনাতে পারি। রোমোকে বলে দেবো’খন।

বিষ্ণুপদ ঘুরে ফিরে গিয়ে আম্রপল্লবটা দেখে। শুকিয়ে আসছে। তা হোক। ওটার গায়ে যেন পুব বাংলার আকাশ, বাতাস, মাটির রস, গন্ধ, গাঁয়ের ধুলো সব লেগে আছে। আম্রপল্লবটা হাতে নিয়ে মাঝে মাঝে বসে থাকে বিষ্ণুপদ। নয়নতারাকে বলে, হ্যাঁ গো, এটা পুঁতলে কি গাছ হবে?

তাই কখনও হয়! তুমি তো আমার চেয়ে চাষবাস কম বোঝো না।।

তা বটে। কলমের গাছ করলে হত। বলে দিলে কৃষ্ণ সেই বাড়ি থেকে একটা গাছের চারাও আনতে পারত।

ওগো, অত পুরনো আমল আঁকড়ে থাকতে নেই।

জানি। মনটা বড় উচাটন।

বিষ্ণুপদ সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে এই আশ্চর্য নির্মাণ দেখে। ভাঙা ঘর লোপাট করে রাজপ্রাসাদ উঠল। দুনিয়াতে এরকমই সব হয় কাণ্ডকারখানা।

ও দাদু! বলে পটল হুড়মুড় করে সাইকেল নিয়ে এসে ঢুকল।

কি রে?

চলো।

কোথায় যাবো?

পুলিন দাদুর হয়ে গেল।

পুলিন! পুলিনের কী হল?

আজ টিউবওয়েল পাম্প করছিল সকালবেলায়। সেইখানেই স্ট্রোক।

বলিস কি?

বটতলা থেকে ডাক্তার এসে দেখে বলল, হয়ে গেছে।

দূর! কী যে বলিস! পুলিন বয়সে আমার ছোটো যে!

চলো দেখবে।

বিষ্ণুপদর হাতে পায়ে হঠাৎ একটা থরথরানি উঠল। ক্ষীণ গলায় সে ডাকল, নয়নতারা!

নয়নতারা পান-দোক্তা খাচ্ছিল দোতলার বারান্দায়। ডাকটা শুনতে পেল না। কানে একটু কম শোনে ইদানীং ও। পটল তার হেঁড়ে গলায় ডাক ছাড়ল, ও ঠাকুমা?

নয়নতারা মুখ বাড়িয়ে বলল, কী রে?

পুলিনদাদু মারা গেল সকালে। দাদুকে নিয়ে যাচ্ছি।

সর্বনাশ! বলিস কি?

বিষ্ণুপদ অসহায় মুখ করে বলল, আমার শরীরটা কেমন করছে। এসসা তো!

নয়নতারা পক্ষিণীর মতো নেমে এল নিচে। বলল, কী হয়েছে তোমার?

একটু ধরো তো! ঘরে নিয়ে যাও।

পটল আর নয়নতারা বারান্দা অবধি আনতে পারল বিষ্ণুপদকে। বারান্দাতেই শুইয়ে দিতে হল। হাতে পায়ে কাঁপুনিটাই বড্ড বেশি।

ওরে, ডাক্তার ডেকে আন।

পটল গম্ভীর হয়ে বলল, ডাক্তারই তো পটল তুলেছে। বটতলা থেকে মিত্তিরকে ডেকে আনি ঠাকমা?

তাই যা দাদা। তাড়াতাড়ি যা।

পটল গেল।

কিন্তু বিষ্ণুপদ ততক্ষণে এগিয়ে পড়েছে অনেক। ধুলোপায়ে রাস্তা হাঁটছে। মাথার ওপর আলোভরা আকাশ, দু’ধারে ধানক্ষেত। খালধার। তারপর গাঁয়ের পথ। হাতে আম্রপল্লবটা ধরা। যাক, বহুকাল বাদে দেশে ফেরা হচ্ছে তাহলে!

সকল অধ্যায়

১. ১. বাদামতলায় রামজীবনের পাকা ঘর
২. ২. এয়ারলাইনস্ অফিসের কাছাকাছি
৩. ৩. নতুন কেনা সুটকেসটা
৪. ৪. একটা ন্যাকা বৃষ্টি
৫. ৫. দোকানটায় ঢুকতে একটু লজ্জা করছে
৬. ৬. নপাড়ার ছেলেরা
৭. ৭. পৃথিবী কি দাড়ি কামায়
৮. ৮. মেঘলা দিনের কালো আলো
৯. ৯. আই সি এস ই পরীক্ষায়
১০. ১০. কামিনী-কাঞ্চন থেকে তফাত
১১. ১১. কাল রাতে বামাচরণে আর রামজীবনে
১২. ১৩. যেমন ভ্যাতভ্যাতে বর্ষা তেমনি গুমসোনো গরম
১৩. ১৪. মায়ের সঙ্গে ঝুমকির বোঝাপড়ার অভাব
১৪. ১৫. দুদুটো প্রেমে পড়ে গেল হেমাঙ্গ
১৫. ১৬. বিষ্ণুপদর পেটটা একটু নেমেছে
১৬. ১৭. জানালা দুরকম হয়
১৭. ১৮. বীণাপাণির বিপদের কথা
১৮. ১২. লিফটবাহিত হয়ে
১৯. ১৯. এনি সার্জারি অন মাই হার্ট
২০. ২০. নতুন আফটার শেভ লোশন
২১. ২১. পুলিন ডাক্তার সব বিদ্যেই জানে
২২. ২২. প্লেন চলেছে ভোরের দিকে
২৩. ২৩. বনগাঁয়ের জমাটি অঞ্চলে নয়
২৪. ২৪. কাউকে কোনও উপলক্ষে ফুল দেওয়া
২৫. ২৫. খোঁচাখুঁচি করা হেমাঙ্গর একটা বদ অভ্যাস
২৬. ২৬. মেঘ দেখলে আনন্দ হয়
২৭. ২৭. শরীর ছাড়া মানুষের আর কী আছে
২৮. ২৮. বিড়ির গন্ধটা নিমাইয়ের সহ্য হচ্ছিল না
২৯. ২৯. ছেলেটাকে ধরেছিল আপা
৩০. ৩০. গাঁয়ের স্কুলের অডিট
৩১. ৩১. জলকাদায় বৃষ্টিতে গাঁ-গঞ্জের কাঁচা-পাকা রাস্তায়
৩২. ৩২. মোহিনী অনেকদিন ধরে তাকে বলছে
৩৩. ৩৩. ছিনের মরার কথা ছিল না
৩৪. ৩৪. প্রিয় ঋতু
৩৫. ৩৫. পোড়া মাংসের স্বাদ
৩৬. ৩৬. ভূতুরে ভয়
৩৭. ৩৭. কনফারেন্স, সেমিনার এবং বক্তৃতা
৩৮. ৩৮. নিমাইচরণ আছো নাকি
৩৯. ৩৯. কল্পনায় শহরটাকে ঠিকমতো সাজিয়ে গুছিয়ে
৪০. ৪০. গত সাত দিন ধরে হেমাঙ্গ ভাবছে
৪১. ৪১. তৰ্পণের দিন
৪২. ৪২. হেঁচকির শব্দ
৪৩. ৪৩. আজকাল বড্ড ভ্রম হয়ে যাচ্ছে
৪৪. ৪৪. লিভিং রুমের ঠিক মাঝখানটায়
৪৫. ৪৫. হেমাঙ্গর কোনও ওয়ারিশন থাকবে না
৪৬. ৪৬. সন্তৰ্পণে দরজাটি খুলল
৪৭. ৪৭. প্রফেসর শর্মা
৪৮. ৪৮. দুনিয়াটা চারদিকে হাঁ-হাঁ করা খোলা
৪৯. ৪৯. বড় মেয়ের বয়স
৫০. ৫০. ভাঙনে নদীর ধারে বাড়িঘর
৫১. ৫১. নিমকহারাম শব্দটা
৫২. ৫২. চিলেকোঠাটা এত ছোটো
৫৩. ৫৩. কাকা ডেকে পাঠিয়েছিলেন
৫৪. ৫৪. স্কুল-টুলেও বক্তৃতা
৫৫. ৫৫. সারা রাত ঘরের কাছে জলের ঢেউ
৫৬. ৫৬. এক-একটা দিন আসে
৫৭. ৫৭. চয়ন যখন পড়ায়
৫৮. ৫৮. ঘটনাটা ঘটল সন্ধেবেলায়
৫৯. ৫৯. বাড়ির প্ল্যান পাল্টাতে হল
৬০. ৬০. নদীর ধারে বাস করতে
৬১. ৬১. পড়াতে পড়াতে সব মনে পড়ে যাচ্ছে
৬২. ৬২. একটা নদী কত কী করতে পারে
৬৩. ৬৩. এরা মাটি ভাগ করতে চায়
৬৪. ৬৪. নিরঞ্জনবাবুর কাছে বসে থাকলে
৬৫. ৬৫. জ্যোৎস্না রাতে ছাদের রেলিং-এর ধারে
৬৬. ৬৬. একটা গুণ্ডার দল
৬৭. ৬৭. হেমাঙ্গর দাড়ি ক্ৰমে বেড়ে যাচ্ছে
৬৮. ৬৮. নিজেকে মুক্ত রাখা কি সোজা কথা
৬৯. ৬৯. চারুশীলা যে কেন তাকে এয়ারপোর্টে ধরে এনেছে
৭০. ৭০. টাকা আসছে
৭১. ৭১. অপর্ণার ইদানীংকালের জীবনে
৭২. ৭২. রশ্মি চলে যাওয়ার দিন
৭৩. ৭৩. শ্যামলীকে শাসিয়ে গেল
৭৪. ৭৪. যারা টিউশনি করে
৭৫. ৭৫. পনেরো দিন জ্বরে পড়েছিল বীণা
৭৬. ৭৬. পার্কের মধ্যে ঘাপটি মেরে
৭৭. ৭৭. ডারলিং আৰ্থ বইটা
৭৮. ৭৮. স্ট্রোক জিনিসটা কি
৭৯. ৭৯. দাদার সঙ্গে সম্পর্কটা
৮০. ৮০. চিঠিটা এল দুপুরে
৮১. ৮১. আপার মা আর বাবা
৮২. ৮২. দাড়ি আর গোঁফের কতগুলো অসুবিধের দিক
৮৩. ৮৩. বামাচরণকে প্রথমটায় চিনতেই পারেনি বিষ্ণুপদ
৮৪. ৮৪. লিফটে একাই ছিল চয়ন
৮৫. ৮৫. বীণা এত অবাক হল
৮৬. ৮৬. গ্যারেজের ওপর একখানা ঘর
৮৭. ৮৭. আর কী বাকি রাখলেন
৮৮. ৮৮. টাকা জিনিসটার যে কী মহিমা
৮৯. ৮৯. তার ভিজিটিং কার্ড নেই
৯০. ৯০. বুকের মধ্যে যেন একটা শাঁখ বেজে ওঠে
৯১. ৯১. আপাতত একতলা
৯২. ৯২. একটা মধ্যযুগীয় শাসনতন্ত্র
৯৩. ৯৩. পুত্রকন্যা শব্দগুলির অর্থ
৯৪. ৯৪. হেমন্তের স্নিগ্ধ বিকেল
৯৫. ৯৫. পালপাড়ায় গিয়ে একদিন
৯৬. ৯৬. মণীশের বাক্যহীন চেয়ে-থাকাটা
৯৭. ৯৭. পৃথিবীর রূপের জগৎ
৯৮. ৯৮. বিনীতভাবে নমস্কার
৯৯. ৯৯. একটু ফাঁকা লাগছিল চয়নের
১০০. ১০০. এত আনন্দ হল বাড়িতে
১০১. ১০১. কত সামান্য হলেই চলে যায়
১০২. ১০২. কাকা তাকে ডাকল না
১০৩. ১০৩. রবিবারের এক সকালে
১০৪. ১০৪. ছোট ফিয়াট গাড়ির মধ্যে
১০৫. ১০৫. চারদিকে সুখ
১০৬. ১০৬. মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় অরণ্যে
১০৭. ১০৭. মাসে মাসে পাঁচশো করে টাকা
১০৮. ১০৮. চারদিকে কত গাছ
১০৯. ১০৯. বডন স্ট্রিটের বাড়িতে
১১০. ১১০. বাংলাদেশে যাওয়ার আগে
১১১. ১১১. শোকের এমন প্রকাশ
১১২. ১১২. এইভাবেই দান উল্টে যায় পৃথিবীর
১১৩. ১১৩. মণীশের শরীর খারাপ হয়েছিল
১১৪. ১১৪. রাওয়াত নামে এক বন্ধু
১১৫. ১১৫. বিষ্ণুপদর শ্রাদ্ধাদি মিটে যাওয়ার এক মাস পর
১১৬. ১১৬. শীতের শুরুতেই দাদা-বউদি বেড়াতে গেল
১১৭. ১১৭. নিমাইয়ের পাঠানো টাকা
১১৮. ১১৮. একবিংশ শতকে কেমন হবে নর-নারীর সম্পর্ক
১১৯. ১১৯. ক্রাচে ভর দিয়ে
১২০. ১২০. একাকার হয়ে যাই

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন