সুজিত রায়
গণতন্ত্র চুলোয় বিভাজনের ইস্তেহার
পাকিস্তানের অর্থ হল সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।… পাকিস্তানের প্রতিটি সৈন্যকে পাকিস্তান তৈরি করার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে। তাঁদের যথেষ্ট রক্ত ঝরাতে হবে।…
—মুসলিম লিগ, ১৯৪৬
কংগ্রেস এমন এক ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখে, যে ভারতবর্ষ কোনোরকম শৃঙ্খল দ্বারা আবদ্ধ হবে না এবং যে ভারতবর্ষে গণতন্ত্র বিরাজ করবে। প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
—ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, ১৯৪৬
হিন্দুরা ভারতবর্ষের বুকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় রূপে বিদ্যমান। হিন্দুস্তান হল এইসব হিন্দুদের মাতৃভূমি। হিন্দুরা এই অঞ্চলটিকে স্বর্গের তুল্য বলেই মনে করে থাকেন। হিন্দুদের দেখতে হবে যে কোনোভাবেই যেন তাদের পরম আরাধ্য এই মাতৃভূমি ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয়।
—বাংলা প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা, ১৯৪৬
.
Communalism essentially amounts to organising an exclusive religious group on the basis of hostility to one or more of the others at the social level. The implied hostility becomes sharper when two or more groups have to live together and share common economic, political and other scarce resources.
—H Mukhia in Communalism: A Study in Historical Perspective. vol. 1, No. 1, 1972 of Social Scientist.
.
১৯৪৫ সালের ১৫ অগাস্ট।
বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করে দিয়ে জাপান মিত্রশক্তির কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করল।
আর সেইসঙ্গেই শেষ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
একদিকে জাপানের সাহায্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্রর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের ‘ভারতের মুক্তিযুদ্ধ’-র পতন ঘটল। পরিকল্পিত চক্রান্তে বিমান দুর্ঘটনায় ফরমোজা দ্বীপের তাইহোকু বিমানবন্দরে মৃত্যু হল নেতাজির। [সূত্র : নেতাজী খুন হয়েছিলেন: সুজিত রায়, দে পাবলিকেশনস, কলকাতা 2022 ] অন্যদিকে, গ্রেট ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হল লেবার পার্টি কনজারভেটিভ পার্টিকে পরাস্ত করে। নির্বাচিত নতুন সরকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৪৬ সালে ভারতে হবে সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ব্রিটিশ সরকার।
সাজো সাজো রব উঠল ভারতবর্ষে। তিন প্রধান রাজনৈতিক শক্তি— কংগ্রেস, মুসলিম লিগ এবং হিন্দু মহাসভার নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল জোরকদমে। তিনটি রাজনৈতিক শক্তিই নিজেদের নির্বাচনি ইস্তেহার প্রকাশ করল। তাতে দেখা গেল, কংগ্রেস যখন একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ ভারতীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ডাক দিচ্ছে, হিন্দু মহাসভা যখন হিন্দু, মুসলমান সকলের জন্য এক আইন প্রয়োগের দাবি তুলে হিন্দু জনসমাজকে একত্রিত করার ডাক দিচ্ছে, তখন মুসলিম লিগ ডাক দিচ্ছে মুসলিম ভূমি পাকিস্তান গঠনের দাবিতে মুসলিমদের একত্রিত করতে।
এই অধ্যায়ে এই তিনটি ইস্তেহারই সেই ১৯৪৬-এ যে ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল, তা হুবহু তুলে ধরা হল কারণ, ১৯৪৬-এর ভয়াবহ কলকাতা দাঙ্গার পিছনে এই ইস্তেহারগুলির ভূমিকা নির্ধারিত করে দিয়েছিল— আগামী দিনে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তার ভৌগোলিক স্থিতি, তার সংস্কৃতি এবং ইতিহাস কোন ধারায় প্রবাহিত হতে চলেছে।
কায়েদ-ই-আজ্ম মি. মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ সর্বভারতীয় মুসলিম লিগের পক্ষ থেকে এই ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। তাঁর দল আগামী নির্বাচনে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক বিধানসভাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এই নির্বাচনকে ভারতীয় মুসলিমদের জন্য গণভোট হিসাবে গণ্য করা হয়। এই নির্বাচনের মূল বিষয় হবে, ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের নীতি নির্ধারণ। তাঁরা যাতে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, প্রয়োজন তাই একটি গণভোটের আয়োজন। বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লিগের কার্যনির্বাহী কমিটি ১৯৪৫ সালে ১ অগাস্ট তারিখে অনুষ্ঠিত একটি সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। মেজর অ্যাটলির শ্রমিক সরকার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার কথা ঘোষণা করেছে।
বর্তমানকালে ব্যালট পেপারের মাধ্যমেই আমরা সাধারণ মানুষেরা আমাদের মনোভাব ব্যক্ত করতে পারি। এইভাবেই সাধারণ মানুষ সুচারু এবং সুসম্পন্নভাবে তাঁদের মতামত জ্ঞাপন করতে পারেন। মুসলিম লিগ তাই এই নির্বাচনকে স্বাগত জানাচ্ছে। মুসলিম লিগ হল ভারতবর্ষে বসবাসকারী সমস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধি। মুসলিম লিগ তাই ভারতে একটি সাধারণ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। মুসলিম লিগ আগে থেকেই ঘোষণা করে যে, এই সাধারণ নির্বাচন তাদের কাছে একটি গণভোটের আকার নেবে। ভারতে অনুষ্ঠিত এই সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লিগ পাকিস্তানের স্বপক্ষে জনমতকে আরও সুদৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে পারবে। শুধু তাই নয়, ভারতের সর্বত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে একই আওয়াজ ওঠে, সেদিকে নজর দেবে।
শেষপর্যন্ত মহামান্য ব্রিটিশ সরকার এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ঘোষণা করে। আগামী শীতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
মুসলিম লিগ তাদের নির্বাচনি ঘোষণায় বলে, “আমরা এই যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আবেদন করেছি। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের যারা শত্রু তাদের মুখোশ খুলে যাবে। পাকিস্তানের জন্য আমরা সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করতে পারব।’
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগ এই ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই রাজনৈতিক সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুসারে এই সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হবে। যাতে এই যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করতে পারি সেজন্য এখন থেকেই আমাদের সর্বপ্রকার প্রস্তুতি চালাতে হবে। আমাদের হাতে যেসব উৎসগুলি আছে সবগুলিকে কার্যকরী করতে হবে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগ অবিভক্ত বঙ্গদেশে বসবাসকারী ৩ কোটি ৫০ লক্ষ মুসলমানের একমাত্র প্রতিনিধি স্বরূপ রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইতিমধ্যেই এই সংগঠন ১০ লক্ষ সদস্য সংগ্রহ করতে পেরেছে। এটি একটি গণতান্ত্রিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতপার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, এইসব সংগঠনের সঙ্গে যেসব কর্মী, সদস্য এবং সমর্থক আছেন, তাঁদের মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে।
সমস্ত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমি সকলের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, তাঁরা যেন আপাতত এইসব মতপার্থক্যগুলিকে ঠান্ডাঘরে নিক্ষেপ করেন। মনে রাখতে হবে, আমাদের সকলের একটিমাত্র দাবি আছে, সেই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই লড়াই-এর পথ থেকে সরে আসব না। আমরা কখনো ক্ষমতার জন্য লড়াই করব না, ব্যক্তিগত আবেগ বা অনুভূতিকে বড়ো করে দেখব না। এখন আমরা ইতিহাসের এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে পদস্খলন হল আত্মহত্যার সমান। আগামী সাধারণ নির্বাচনে যে ফলাফল ঘোষিত হবে, তা হবে সুদূরপ্রসারী। আর, ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ধারণ করবে এই সাধারণ নির্বাচন। মুসলিম লিগের প্রতিটি সদস্যকে এই কথা মনে রাখতে হবে।
এটি হল আমাদের জন্য এমন এক যুদ্ধ যেখানে আমরা সমস্ত বিভেদ, বিতর্ক ভুলে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়াই করব। আমাদের মধ্যে আদর্শগত অথবা ব্যক্তিগত মতপার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু, এখন আমাদের সকলকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। এই কাজে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে আমরা আমাদের মধ্যেকার সমস্ত বিবাদকে ভুলে যাব। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের কার্যনির্বাহী সমিতির ১৯৪৫ সালের ২৭ অগাস্ট তারিখে অনুষ্ঠিত এই সভায় স্থির হয়েছিল যে, আমরা সাময়িকভাবে বরখাস্ত প্রতিটি ইউনিয়ন, সাবডিভিশন, জেলা এবং প্রাদেশিক সভার পুনর্গঠনের আবেদন করব। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের তরফ থেকে সব বঙ্গীয় প্রাদেশিক সভায় সদস্যদের আমি পুনরায় তলব করছি। একথা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন নেই যে, পাকিস্তানের এই নির্বাচনে যত বেশি সংখ্যক আসনে আমরা জয়লাভ করব, আমাদের দাবি আরও সোচ্চারভাবে উচ্চারিত হতে পারবে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে যে সংসদীয় সমিতি তৈরি হবে সেদিকে আমরা আমাদের আনুপাতিক হার বৃদ্ধি করতে পারব। আমি তাই বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য-সদস্যাদের কাছে আবেদন করছি— তাঁরা যেন আপাতত ব্যক্তিগত সমস্ত বিবাদ-বিসম্বাদ দূরে সরিয়ে রাখেন। তাঁরা যেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
‘পাকিস্তান’-এর অর্থ হল সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। আমাদের দেশে এখনও এমন কিছু বোকা, মূর্খ, স্বপ্নসন্ধানী, কষ্টকল্পনার ওপর নির্ভরশীল মানুষ আছেন, আছেন এমন কিছু দ্বি-চারী মানুষ যাঁরা চিন্তা করেন যে, পাকিস্তান সৃষ্টি অতি সহজেই হবে। এর জন্য কোনো আত্মবলিদানের প্রয়োজন নেই। একটা কথা পরিষ্কারভাবে মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তানের প্রতিটি সৈন্যকে পাকিস্তান তৈরি করার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে। তাঁদের যথেষ্ট রক্ত ঝরাতে হবে। তা নাহলে এই স্বপ্ন কখনোই সফল হবে না।
আমাদের কবি এবং সাহিত্যিক; শিল্পী এবং হস্তশিল্পী, যুবক এবং ছাত্র, ভূস্বামী এবং কৃষক পরিবার, উলেমা থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত— সকলেই নিশ্চয়ই ভারতবর্ষের মুসলিম জনসমাজের বিখ্যাত মানুষদের সম্পর্কে অবহিত। এখন এইসব বিশিষ্ট মানুষেরা তাঁদের সমস্ত মতপার্থক্যকে ভুলে গেছেন। তাঁরা অতীত নিয়ে কোনো রোমন্থন করছেন না। তাঁরা আগামী শীতের ওই যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য এক হয়েছেন। যে করেই হোক, পরিষদের ওই সাধারণ নির্বাচনে আমাদের জিততেই হবে।
কংগ্রেস ইতিমধ্যে নিজেকে লিগের সঙ্গে এক অনভিপ্রেত সংঘর্ষে জড়িয়ে ফেলেছে। এই সংঘর্ষের কোনো দরকার ছিল না। আসুন, আমরা সাহসের সঙ্গে ওই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করি। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যের মাধ্যমে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছেন এবং তিনি আরও একটি কথা বলেছেন, তা হল— আমরা দরকার হলে কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হতে পারব। সেই বিষয়ে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি হয়তো তাদের সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করবে। এর জন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু, ভারতবর্ষে বসবাসকারী মুসলমানরা কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের মতো এত বোকা নয়, তাই তাঁরা এই প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবেন না। একমাত্র আল্লাই বোধ হয় তাঁদের এতখানি শক্তিশালী করে তুলেছেন।
পাকিস্তান সূত্রটি অত্যন্ত সরল, এর মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। ইতিমধ্যে আমরা ভারতবর্ষের রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়েছি। পাকিস্তান সৃষ্টির মূলে আছে সত্যিকারের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য এবং সকলের প্রতি সমব্যবহার। এই বিষয়টি হল রাজতন্ত্রের বিরোধী এবং এর মাধ্যমে আমরা সকল প্রকার অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে পারব। আর, এই বিষয়টি কংগ্রেসের ‘অখণ্ড-ভারততত্ত্ব’র বিরোধিতা করে।
স্বাধীন ভারত কখনোই এক ও একক রাষ্ট্র হিসাবে পরিগণিত হবে না। স্বাধীন ভারত কখনোই একটি রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। অখণ্ড ভারত ছিল মৌর্যদের শাসনের সময় এবং মুঘলদের শাসনের সময়। এখন গ্রেট ব্রিটেনের শাসনাধীন ভারত অখণ্ড অবস্থানে আছে। স্বাধীন ভারত কখনোই এমন অবস্থানে থাকবে না। ঈশ্বর এই বিশাল উপমহাদেশটিকে সৃষ্টি করেছেন যাতে এখানে বসবাসকারী প্রতিটি জাতিসত্তা নিজ নিজ স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে। এই বিষয়ে আরও আলাপ-আলোচনা করা দরকার। আসলে, কংগ্রেস বোম্বেতে অবস্থিত পুঁজিপতিদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে চায়। তাই বোধ হয় তারা ভারতবর্ষকে বিভাজিত করতে চায় না। অখণ্ড ভারতের মাধ্যমে কংগ্রেস দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে শোষণ করতে চায়। কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মুসলিমরা রুখে দাঁড়াবে। কংগ্রেস ভারতবর্ষের বুকে এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন করতে চাইছে। কংগ্রেস কয়েক জন ব্যক্তিসত্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পাকিস্তান হল স্বাধীনতার প্রতীক। মুসলিম-হিন্দু নির্বিশেষে সকলে সেখানে স্বাধীনসত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
আমরা সমস্ত মুসলমান সম্প্রদায়কে লিগের সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এই সেনাবাহিনীর সাহায্যে আমরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি কংগ্রেসকে যেকথা বলে সতর্ক করতে চাইছি তা হল, তারা যেন আর বেঠিক পদক্ষেপ না ফেলে। দিল্লি এবং লন্ডনে যে সমস্ত উদাসীন সাম্রাজ্যবাদীরা বসে আছেন, তাঁদের কানেও এই খবর আমরা পৌঁছে দিতে চাই। আমরা কখনোই এই কথাটি ভুলব না যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবনতি ও অবলুপ্তির সঙ্গেসঙ্গে ভারতবর্ষের বুকে ‘পাকিস্তান’ নামে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হবে। আমরা পাকিস্তানের দাবিকে সার্থক করব আমাদের নিজস্ব মানুষদের চোখের জল আর বুকের রক্তের দ্বারা। আমরা কখনোই ব্রিটিশের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করব না। আমাদের এই দাবির মূলে আছে সাম্য, সকলের প্রতি সম-অধিকার এবং সমতা। আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে, স্বাধীনতা এবং দেশপ্রেম হল একে অন্যের বিপরীত। আমরা কখনোই কোনো মানুষের ওপর অত্যাচার করব না। আল্লাহ্-র আশীর্বাদে এখন আমরা জয়ের অবস্থানে পৌঁছে গেছি। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি তাহলে অদূর ভবিষ্যতে জয় করায়ত্ত হবে। তাই একতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং স্বাধীনতার জন্য স্বপ্ন হল এই যুদ্ধে আমাদের পরম পাথেয়। মনে রাখবেন, এইভাবেই আমরা সকলে সমবেতভাবে স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছি।
আমাদের জনগণের মধ্যে অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। কিন্তু, আমি যখন বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করছিলাম তখন দেখেছিলাম যে, তাঁরা এইসব বিবাদ ভুলে গেছেন। বাংলার মানুষ কায়মনোবাক্যে পাকিস্তানের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। যদি নেতারা কোনো ভুল না করেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কোনো ভুল করবেন না। তবে, মাঝেমধ্যে নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে অনভিপ্রেত মতানৈক্যের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে তা সাধারণ মানুষকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করছে। তাই আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, আমরা আপাতত ব্যক্তিগত স্বার্থকে বড়ো করে দেখব না। আমাদের স্বপ্ন শেষ হবে পৃথক পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে। ১৯৩৫ সালে প্রবর্তিত ‘ভারত শাসন আইন’- এ যেকথা বলা হয়েছে, তারই বাস্তবায়ন হবে পাকিস্তান এই রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে। আমাদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ যদি তাঁর নিজস্ব সত্তাকে বেশি করে প্রতিভাত করতে চান তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আমরা জেহাদ ঘোষণা করব। ভবিষ্যতে মন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিশিষ্ট মানুষদের বাংলার মুসলমান মানুষ কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্যায় হল আগামী শীতকালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন। যে মুহূর্তে সমস্ত ভোটদাতা পাকিস্তানের স্বপক্ষে ভোট দেবেন, তখনই আমরা এই গণভোটে জয়ের পর্যায়ে পৌঁছে যাব। কংগ্রেস ইতিমধ্যে নিজেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বলে যে দাবি করেছে, সেই মিথ্যা দাবিও নস্যাৎ হয়ে যাবে। আমাদের সকলের লক্ষ্য হল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। আমরা চাইছি ব্রিটিশ যেন অবিলম্বে ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এই হস্তান্তরকরণের প্রথম এবং প্রধান একমাত্র প্রক্রিয়া হল, পাকিস্তান নামের একটি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি। আমরা যে লড়াইতে অংশগ্রহণ করতে চলেছি, সেটি হল স্বাধীনতা এবং সাম্যের লড়াই। আমরা বিশ্বাস করি এবং আশা রাখি যে, যিনি মনে-প্রাণে স্বাধীন পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেন তিনি আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে আমাদের সাহায্য করবেন।
আমরা কংগ্রেসের দাবির বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছি। আমরা কখনো ভাবিনি যে, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এমন এক লড়াইয়ের ডাক দিতে হবে। শুধু তাই নয়, হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধেও আমরা লড়াই করব। আমরা ভারতবাসীর সঙ্গে কোনো বিদ্বেষমূলক সম্পর্ক চাই না। তাই আমাদের লড়াই হল সম্পূর্ণ আত্মরক্ষার লড়াই, আমরা কংগ্রেসকে প্রতিপক্ষ হিসাবে চাইনি, কিন্তু কংগ্রেসই তাদের আগ্রাসী মনোভাব দিয়ে আমাদের লড়াইতে এনেছে।
তাই মনে কোনো দ্বিধা রাখবেন না, আমাদের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখুন। শেষপর্যন্ত আমরাই জয়যুক্ত হব। আল্লাহ্ আমাদের সহায় হবেন। এখন একটাই স্লোগান, তা হল, আমরা অবিলম্বে যুদ্ধযাত্রা করি।
গত ষাট বছর ধরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার জন্য সর্বান্তঃকরণে প্রয়াসী হয়েছে।
এই সুদীর্ঘ ষাট বছর ধরে আমরা ভারতীয় জনতার যে ইতিহাস রচনা করেছি সেখানে প্রতিমুহূর্তে আছে স্বাধীনতার স্বপ্ন, প্রতিটি মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চেয়েছেন। মুষ্টিমেয় কয়েক জন স্বাধীনতাকামী মানুষকে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখন আমরা সারা ভারতের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছি। এই বিশাল দেশের সর্বত্র আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে গেছে। আমরা সমস্ত ভারতবাসীর সার্বিক মুক্তি কামনা করছি। কংগ্রেসের এই আন্দোলন বড়ো বড়ো শহর থেকে প্রান্তিক গ্রামে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আর ভারতবর্ষের অগণিত জনতার অংশগ্রহণে আজ কংগ্রেস ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। দেশের জনগণের সক্রিয় সহযোগিতায় কংগ্রেস এমন একটি শক্তিশালী সংগঠন তৈরি করেছে যা স্বাধীন ভারতের স্বপ্নকে সফল করতে পারে। স্বাধীন ভারতের অধিবাসীরা কংগ্রেসের শাসনে সুখে- শান্তিতে দিন কাটাতে পারবে। চিন্তন এবং কার্যক্ষেত্রে তাঁরা পাবেন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং স্বাধিকার। ভারতের জনগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা বহন করবেন। আমরা নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমাদের নিয়োগ করেছি। কংগ্রেস এখনও ভারতের স্বাধীনতাকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষের বুকে অসংখ্য মানুষ এবং গ্রামীণ মহিলারা কংগ্রেসের পতাকাতলে একত্রিত হয়েছেন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়। তাঁরা সকলে আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের অবদানের কথা আমরা কখনো ভুলতে পারব না। আমরা প্রতিমুহূর্তে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি, শুধু তাই নয়, মানুষের দুঃখে সহানুভূতি জানিয়েছি। এইভাবেই সর্বস্তরের সমস্ত মানুষ আমাদের সমর্থক হয়ে উঠেছেন। আমরা মানুষের সহযোগিতার ভারতের সর্বত্র স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক গণবিপ্লবের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করতে পেরেছি। এজন্য সকল ভারতবাসীকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
কংগ্রেস মূলত দুটি বিষয়ের ওপর তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে— সমগ্র ভারতবাসীর সার্বিক উন্নয়ন এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ধারাবাহিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামে কংগ্রেস নানাধরনের বাধাবিপত্তির সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। ব্রিটিশ শাসকদের জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছে। সেই সাম্রাজ্যবাদীরা সশস্ত্র সৈনিকের মাধ্যমে এই সংগ্রাম দমন করার চেষ্টা করেছেন। কংগ্রেস কিন্তু সদাসর্বদা অহিংস নীতিকে সমর্থন করেছে। এইভাবে কংগ্রেস তার গণআন্দোলনকে আরও ব্যাপক এবং সর্বাত্মক করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়ত এই সংগঠন থেকে আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছে। গত তিন বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা অনায়াসে বলতে পারি যে, এখন সর্বত্র অশান্তি বিদ্যমান। তারই মাঝে ব্যাপক জনজাগরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও কংগ্রেস কর্মীদের ওপর অত্যাচার এবং নির্মমতা ক্রমবর্ধমান। তা সত্ত্বেও কংগ্রেস আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছে। আরও বেশি মানুষ কংগ্রেসের মতাদর্শে অসীম আস্থা রাখছেন। এইভাবেই ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে দিয়ে এই সংগঠন ঈন্সিত লক্ষ্যপথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে।
কংগ্রেস সমগ্র ভারতবাসীর সম-অধিকার এবং সম-সুযোগসুবিধায় বিশ্বাসী। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই যেন একইরকমভাবে জীবনযাপন করতে পারে। কংগ্রেস ভারতে বসবাসকারী সমস্ত সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং ভারতে যাঁরা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাস করেন, তাঁদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। শুধু তাই নয়, কংগ্রেস এই সমস্ত মানুষের কাছে স্বাধীনতার শুভবার্তা পৌঁছে দেবে। পৌঁছে দেবে সহিষ্ণুতার কথা। কংগ্রেস চিরদিনই সমগ্র ভারতবাসীকে এক অখণ্ড সত্তারূপে দেখে এসেছে। কংগ্রেস চায় প্রতিটি ভারতীয় যেন স্বাজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা যেন নিজ নিজ ইচ্ছা পালনে পারঙ্গম হন এবং তাঁদের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত কৃৎ- কুশলতা বিদ্যমান তা সাফল্য লাভ করে। কংগ্রেস ভারতবর্ষের সমস্ত অঞ্চলের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য রক্ষার্থে কৃতসংকল্প। শুধু তাই নয়, কংগ্রেস ভারতবর্ষের কোনো একটি অঞ্চলকে অবহেলিত রাখতে চায় না। কংগ্রেস বিশ্বাস করে ভারত এক সামগ্রিক সত্তা, যদিও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জীবনযাপন এবং সংস্কৃতি প্রতীয়মান হয়। এইভাবে ভারত একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই কংগ্রেসের উদ্দেশ্য হল, ভারতের প্রতিটি অঞ্চলকে এক ঐক্যে ঐক্যবদ্ধ করা। কংগ্রেস প্রতিটি ভাষাভাষীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে। প্রত্যেকটি আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করে। কংগ্রেস সেইসমস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। যাঁরা বংশপরম্পরায় সামাজিক অন্যায়- অবিচার এবং অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তাঁরা যেন সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারেন এবং জীবনের সমস্ত দিকগুলিকে উদ্ভাসিত করতে পারেন, কংগ্রেস সেটাই কামনা করে।
কংগ্রেস এমন এক ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখে, যে ভারতবর্ষ কোনোরকম শৃঙ্খল দ্বারা আবদ্ধ হবে না এবং যে ভারতবর্ষে গণতন্ত্র বিরাজ করবে। প্রতিটি মানুষের
মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। প্রতিটি মানুষের অধিকারগুলি যেন পরিস্ফুট হয় সেইদিকে এই দল নজর দেবে। ভারতের প্রস্তাবিত সংবিধানে এই ব্যাপারে লৌহকবচ থাকা দরকার। যে সংবিধান আমরা প্রস্তুত করতে চলেছি, সেই সংবিধান এমন এক ভারতবর্ষের স্বপ্নকে সফল করবে, যে ভারতবর্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় হবে এবং তার মধ্যে থাকবে বিভিন্ন আঞ্চলিক কেন্দ্র। ভারতের একাধিক আইন পরিষদ গঠিত হবে এবং সেই আইন পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের মাধ্যমে।
ইতিমধ্যে ১৫০ বছর কেটে গেছে, বিদেশি শাসকরা কখনোই অগ্রসর হননি। ভারতবর্ষের সার্বিক উন্নয়নে সবরকম বাধা সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা ভারতবর্ষে নানা ধরনের অনভিপ্রেত সমস্যার জন্ম দিয়েছেন। এই সমস্যাগুলির তাৎক্ষণিক সমাধান হওয়া দরকার। এইসব বিদেশি শাসকবর্গ দ্বারা ভারতবর্ষ এবং সেখানকার অধিবাসীরা তীব্র শোষণের শিকার হয়েছে। এইসময়ে মানুষকে নানাধরনের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। ভারতবাসী হতাশার অতল দুর্বিপাকে নিমজ্জিত হয়েছে। ক্ষুধার আগুন জ্বলে উঠেছে পেটের মধ্যে। মানুষ কোথাও গিয়ে আশার বাণী শুনতে পায়নি। এই দেশটি যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দিক থেকে নিঃস্ব এবং দেউলিয়া হয়ে গেছে তা নয়, মানুষকে বারে বারে অত্যাচারিত হতে হয়েছে, মানবাত্মার কান্না শোনা গেছে এবং এর পাশাপাশি যদি আমরা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের কথা ভাবি, সেখানেও পরিলক্ষিত হয়েছে শুধুই অবক্ষয়। এত বছর ধরে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, এখনও যুদ্ধের পরিস্থিতি একেবারে নির্মূল হয়নি, এই সময় ভারতবাসীকে অনিচ্ছাকৃতভাবে নানা দুঃখ-জ্বালা-যন্ত্রণার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে, শাসকদের কিছু কিছু অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত মানুষের কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ ভারতবাসীর দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে মোটেই অবহিত নন। তাঁরা কখনোই ভারতবাসীর সেই দুঃখ-কষ্টের প্রশমন করার চেষ্টা করেননি। ভারতের বুকে যে প্রশাসনিক পদ্ধতি চালু আছে, তা একেবারে নিঃস্ব-রিক্ত করে দিয়েছে ভারতবর্ষকে। দেশের নানা স্থানে দেখা দিয়েছে সরকারপ্রসূত দুর্ভিক্ষ। শুধু তা-ই নয়, জনগণের এক বিরাট অংশের হাতে উপযুক্ত অর্থ না থাকাতে তাঁরা নিদারুণ দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। এই সকল ব্যাপারগুলির আশু সমাধান করা দরকার। তা না হলে, আমরা কখনোই একটি সুউন্নত ভারতের স্বপ্নকে সফল করতে পারব না। তবে, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব ছাড়া এই সমস্যাগুলির সমাধান কোনোমতেই সম্ভব নয়। তাই আমরা চাইছি, ভারতবর্ষ যেন রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্বাধীনতাও অর্জন করে।
বর্তমানকালে ভারতের যে সমস্যা সবথেকে বেশি প্রতীয়মান হয়েছে, তা হল দারিদ্র্যের সমস্যা। জনগণের জীবনযাত্রার মান কোনোভাবেই উন্নত হচ্ছে না। জনগণের কথা কোনো সরকার চিন্তা করছেন না। কংগ্রেস এই ব্যাপারে বিশেষ নজর দেবে। কংগ্রেস এই কারণে নানাপ্রকার উদ্যোগ নিতে চলেছে। কংগ্রেস চায় প্রতিটি ভারতবাসী যেন নিজেকে ঠিকমতো স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে। আর, এক্ষেত্রে কংগ্রেসের অবদান যেন সমাজের একেবারে নীচুতলায় বসবাসকারী মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। কংগ্রেস প্রতিটি ভারতবাসীর সার্বিক এবং সর্বাত্মক উন্নয়নের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেইজন্য কংগ্রেস বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চলেছে। কংগ্রেস ভারতবর্ষের শিল্প এবং কৃষি, সামাজিক পরিষেবা এবং জনগণের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলিকে নানাভাবে উজ্জীবিত করতে সচেষ্ট। এই বিষয়গুলির আধুনিকীকরণ দরকার। শুধু তাই নয়, দেখতে হবে যে, সর্বক্ষেত্রে যেন এক নতুন উদ্দীপনার জন্ম হয়। তা না হলে, ভারতের মোট সম্পদের পরিমাণ কখনোই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে না। আত্মবিকাশ এবং আত্ম-উন্নয়নের ক্ষেত্রটি প্রসারিত করতে হবে। আমরা যেন অন্যের ওপর নির্ভরতা না রেখে নিজেদের উন্নতিসাধন করতে পারি। তবে, এইসব কাজ করতে গেলে আমরা প্রাথমিকভাবে যে বিষয়গুলির ওপর নজর দেব এবং যেগুলিকে আমাদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে মনে করব, তা হল জনগণের সার্বিক উন্নতি। মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মান আকাশচুম্বী করতে হবে। বর্তমানে দেশের সর্বত্র কর্মহীনতার অভিশাপ বিদ্যমান। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন অবস্থায় জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। এই সমস্যার আশু সমাধান দরকার। মানুষ যেন মানুষের মতো বেঁচে থাকতে পারে। মানুষের মধ্যে যেন মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটে যায়, কংগ্রেস সেদিকেও নজর দেবে। এই বিষয়গুলিকে বাস্তবায়িত করতে হলে নানাধরনের প্রকল্প প্রণয়ন করা দরকার। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ের মধ্যে একটি সুচারু বন্ধন রাখতে হবে। দেখতে হবে দেশের বেশিরভাগ সম্পদ যেন মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বন্দি না থেকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করে থাকি যে, ক্ষমতা যেন আজ কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। দেশের কয়েকটি বিশেষ পরিবার বা কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী সমস্ত ক্ষমতা ভোগ করছে, যা কখনোই হওয়া উচিত নয়। সমস্ত মানুষের হাতে যদি ক্ষমতা পৌঁছে না যায়, তাহলে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন হবে কেমন করে? আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ খনিজ সম্পদ বিদ্যমান, এখানে নানা ধরনের পরিবহণ পরিষেবা আছে, এ ছাড়া আমরা বিভিন্ন বস্তু উৎপাদন করে থাকি, সেই বস্তুগুলির গণবণ্টন ব্যবস্থাও করতে হবে। দেখতে হবে শিল্পসঞ্জাত সুযোগ-সুবিধাগুলি যেন সকলের হাতে পৌঁছে যায়। জাতীয় কার্যাবলির প্রতিটি ইতিবাচক দিক যেন সকলে বুঝতে পারেন। এইভাবেই আমরা এমন এক স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখব যে ভারতবর্ষ সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
কংগ্রেস পৃথিবীর সকল স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। যতদিন পর্যন্ত এই রাষ্ট্রসংঘের স্বপ্ন সফল না হচ্ছে, ততদিন কংগ্রেস সমস্ত দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক হবে মধুর। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে যেসব দেশগুলি অবস্থিত, সেখানকার জনগণের সঙ্গেও কংগ্রেস সখ্যের সম্পর্ক স্থাপন করবে। দূর প্রাচ্য অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়াতে ভারত তার শুভেচ্ছার বাণী পৌঁছে দেবে। হাজার হাজার বছর ধরে এইসব অঞ্চলগুলির সঙ্গে ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। আমরা কখনোই এইসব অঞ্চলগুলিকে উপেক্ষা করতে পারি না। এই অঞ্চলগুলির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে। আমরা যেন আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারি এবং ভবিষ্যতে আমরা যেন ব্যাবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও আধুনিক হয়ে উঠতে পারি। সেজন্য এইসব অঞ্চলগুলির সঙ্গে আরও সুদৃঢ় বন্ধন রাখা দরকার। ভারতবর্ষ তার স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অহিংস পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছে। ভারতবর্ষ বিশ্বব্যাপী শান্তি কামনা করে এবং ভারতবর্ষ প্রার্থনা করে পৃথিবীর সমস্ত দেশ যেন পারস্পরিক সমঝোতা এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নত হয়। ভারতবর্ষ পৃথিবীর সর্বত্র নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে। আমাদের দেশ বিশ্বাস করে যে, স্বাধীনতা জীবনের একমাত্র স্বপ্ন হওয়া উচিত। স্বাধীনতার ভিত্তিতেই আমরা বিভিন্ন সত্তাকে পরিস্ফুট করতে পারি। বিশ্বের বুক থেকে ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ যেন চিরতরে দূরীভূত হয়, পৃথিবীব্যাপী স্থাপিত হয় এমন এক মহাসংঘ যা সকলের উন্নতিসাধন করতে পারবে।
১৯৪২ সালের ৮ অগাস্ট তারিখে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কর্মসমিতি একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। তারপর থেকে ভারতবর্ষে নানা ঘটনা ঘটে গেছে। কংগ্রেস কর্তৃক উত্থাপিত বিভিন্ন দাবি এবং ঘোষণাকে নানাভাবে ব্যাহত করা হয়েছে। সেই প্রকল্পনাকে কংগ্রেস যেকথা বলেছিল, আজও সেই কথা বলছে। কংগ্রেস চাইছে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন।
সাধারণ গণপরিষদ হল এমন একটি সংগঠন যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকবে না। সেই কমিটিতে উপদেষ্টামণ্ডলী থাকবে, যাদের উপদেশ মেনে চলা হবে। আমাদের জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ এখন রুদ্ধ কারান্তরালে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। হয়তো কেউ কেউ ইতিমধ্যে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন, কিন্তু তাঁরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এইভাবে আমরা নানা অসুবিধার মধ্যে দিয়ে চলেছি। ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় সাধারণ সভা আহ্বান করা যাচ্ছে না। এই বিষয়গুলি আমাদের কাছে খুবই দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কংগ্রেস তাই চিন্তা করেছে যে, সে এই নির্বাচনে যোগদান করবে। আর, এই নির্বাচনের যে ফলাফল ঘোষিত হবে তার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য সাধিত হবে। কংগ্রেস বিশ্বাস করে এইভাবেই আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নকে সফল করতে পারব। আমরা চাই ভোটাররা স্বাধীন ও অবাধভাবে ভোট দিয়ে এই বিষয়টি সম্পর্কে তাঁদের মতামত প্রকাশ করুন। বিশেষ করে ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁরা কী চিন্তাভাবনা করছেন সেটি কংগ্রেসের জানা দরকার। তাই এই নির্বাচনকে আমরা ছোটো ছোটো বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে রাখব। আমরা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কথা চিন্তা করব না, আমরা কোনো ধরনের কুসংস্কারের কাছে মাথা নত করব না। একটি কথাই মনে রাখতে হবে, তা হল— স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব। যে দেশে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, সেই পবিত্র মাতৃভূমি যেন বিদেশি শাসকের হাত থেকে মুক্ত হতে পারে, এটাই হল এই মুহূর্তে কংগ্রেসের একমাত্র আহ্বান। আর এই আহ্বান আমরা পাঠাচ্ছি ভারতের সমস্ত জনগণের কাছে।
কংগ্রেস তাই সমস্ত ভোটারের কাছে আবেদন করছে যে, আপনারা জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য এগিয়ে আসুন। আপনারা কংগ্রেস প্রার্থীদের সমর্থন করুন। এই আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস যেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারে সেজন্য সাহায্য করুন। আমরা এখন ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা বুঝতে পারছি না। এর আগে বার বার ভারতীয় জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। এখনও আমরা সমস্ত মানুষের কাছে জীবনের ন্যূনতম চাহিদাগুলি পৌঁছে দিতে পারিনি। এখনও নানাধরনের সামাজিক অবিচার আমাদের মনকে দুঃখকাতর করে তোলে। এখন সময় এসেছে, এখন আমাদের সকলকে আবার পূর্ণমাত্রায় সজাগ হয়ে উঠতে হবে। আমরা শুধুমাত্র নির্বাচন সম্পর্কে চিন্তা করব না, আমরা নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতির কথাও ভাবব। মনে রাখতে হবে, এই নির্বাচন হল আরও বৃহৎ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এক পদক্ষেপ। আসুন, আমরা সকলে সংঘবদ্ধ হই। আমরা স্বাধীনতার স্বপ্নকে সফল করি। আমরা চাই স্বাধীন ভারত যেন বিশ্বজগৎ সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। আমাদের মধ্যে সাহস আছে, আছে আত্মবিশ্বাস, আমরা সকলে একত্রিত হলে এই স্বপ্ন একদিন সফল হবেই, এই ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই!
ভারতের আইনসভার নির্বাচন আসন্নপ্রায়। এখন জনগণকে দুটি বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে— ভারতের জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।
এক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভার প্রস্তাব এবং উপস্থাপনা একেবারে পরিষ্কার। হিন্দু মহাসভা দেশবাসীর কাছে এই কথা বার বার ঘোষণা করেছে যে, এই সংগঠন হিন্দু এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে একই আইনব্যবস্থা প্রণয়ন করতে আগ্রহী। ভারতের কোনো অংশে যদি কোনো একটি সম্প্রদায় সংখ্যালঘু অবস্থায় থাকে, তাহলেও এই ব্যাপারে কোনো ব্যতিক্রম হবে না। ভারতবর্ষের আঞ্চলিক রাজ্যসমূহের ভৌগোলিক পরিসীমা নির্ধারণে কোনো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসৃত হয়নি। বিপরীতক্রমে বলা যেতে পারে যে, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি স্বীয় স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই সীমারেখাকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যাতে এই দেশের মানুষকে নানাধরনের অনভিপ্রেত বা আত্মঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে এই বিষয়টির ওপর দৃষ্টিপাত করা দরকার। বর্তমানে ভারতবর্ষে যে ভৌগোলিক সীমারেখা বিদ্যমান, তার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি অনতিবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। আমরা এই কারণে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে এই ভৌগোলিক পরিসীমা নির্ধারণ করতে আগ্রহী।
আদর্শগত দিক থেকে এবং বাস্তবতার দিক থেকে এই রাজ্যগুলি ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হোক। যতক্ষণ পর্যন্ত এই পদ্ধতি পুরোপুরি অনুসৃত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশকে অবক্ষয়ের অন্ধকারে রাখতে বাধ্য হব। আমরা প্রশাসনিক জটিলতাকে কমাতে পারব না। আর, এর ফলে আমাদের দেশে বসবাসকারী সমস্ত মানুষ একইরকম সুযোগসুবিধা পাবেন না। আমাদের দেশের শান্তি বিঘ্নিত হবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসবে নানা অনভিপ্রেত ঘটনা।
বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখেছি যে, শাসকগোষ্ঠী নানাধরনের প্রলোভন দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করতে চাইছেন। তাঁরা এমন কিছু প্ৰকল্পনা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন যা অবাস্তব এবং কাল্পনিক। আমি আশা করি যে, জনগণ এই ধরনের অবাস্তব প্রতিশ্রুতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবেন। তাঁরা কখনোই এভাবে আর প্রতারিত বা প্রবঞ্চিত হবেন না। বাস্তবিকপক্ষে, এই জাতীয় সাম্প্রদায়িক এবং স্বার্থান্বেষী মানুষের উদ্দেশ্য হল ওই ঔপনিবেশিক শক্তির হাত শক্ত করা। তাঁরা স্বশাসনের মাধ্যমে এই মহান দেশকে খণ্ডবিখণ্ড করতে চাইছেন। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য হল দেশব্যাপী অস্থির অবস্থা সৃষ্টি করা। ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় কখনো তাঁদের পিতৃভূমিকে এইভাবে খণ্ডিত হতে দেবেন না। আর, এভাবেই তাঁরা ভারতের অখণ্ডতা রক্ষার্থে সর্বস্ব এবং সব কিছু নিয়োগ করবেন। আমাদের উচিত সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ক্ষুদ্র বৃত্ত থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা। যাঁরা ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের যড়যন্ত্রে উদ্যোগী হয়েছেন, তাঁরা এই দেশটিকে অকারণে এবং অযৌক্তিকভাবে খণ্ডিত করতে চাইছেন। আমার মতে, তাঁরা হলেন জাতীয়তার পরিপন্থী। এমনকী যদি আমরা আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার দৃষ্টিতে তাঁদের এই কার্যধারা বিশ্লেষণ করি তাহলেও তাঁদের স্বপক্ষে কোনো কিছু নিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
ইতিমধ্যে যে সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তার ফলে আমাদের দেশে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরিতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত এই সাম্প্রদায়িক বিচারব্যবস্থা থেকে ভারত বিমুক্ত না হচ্ছে, ততদিন আমরা একটি স্বাধীন সংঘবদ্ধ রাষ্ট্রের স্বপ্ন সফল করতে পারব না। আমাদের উচিত অবিলম্বে যুগ্ম নির্বাচক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা। নাহলে, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারবে না। আমাদের মনের ভিতর যেসব স্বাধীন চিন্তার উদ্রেক হয় এবং আমরা যেসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবনা অনুসরণ করে থাকি, সেগুলিকে যদি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিফলিত করতে হয়, তাহলে এই পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বিষয়টিকে বাদ দিতে হবে। আমরা একটি সর্বাত্মক গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থা চালু করতে না পারলে এবং সম্মিলিত নির্বাচকমণ্ডলীর সাহায্য না পেলে কখনো এই বিষয়টিতে সফল হব না। তাই আমাদের দাবি, অবিলম্বে ভারতবর্ষে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন চালু করা হোক। এখন যাঁরা ভিন্ন ধর্মীয় আত্ম-অধিকারের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন, তাঁদের এই কু-উদ্দেশ্য যেন সফল না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। সেইজন্য আমরা সম্পূর্ণ নতুন পরিপ্রেক্ষিতের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী।
এখনও পর্যন্ত ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি যুক্তিতর্কর ওপর চেপে বসে আছে। আমাদের দেশে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার প্রভাব রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয়ের থেকেও প্রভাবশালী। এই পরিস্থিতির মধ্যে কোনো সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তন অথবা অর্থনৈতিক বিষয়গুলির উত্থাপন সম্ভব নয়। আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, এই অবস্থায় থেকে কি একটি অবাধ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব?
ভারতবর্ষে কখনোই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ দেখা যায় না। দীর্ঘকাল ধরে ভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করে এসেছেন। ভারতবর্ষ সদাসর্বদা স্বাধীনতা এবং সহিষ্ণুতার জন্য বিখ্যাত। অন্য ধর্মের প্রতি আমরা যথেষ্ট শ্রদ্ধা এবং সখ্য প্রদর্শন করে এসেছি। ভারতবর্ষে কখনোই ধর্ম জনগণের মতামতকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
আজ যদি ভারতের ৩৫ কোটি জনতা একসঙ্গে তাঁদের দাবিকে উত্থাপন করেন, তাঁরা যদি তাঁদের ধার্মিক অনুষঙ্গগুলি ভুলে যান, তাহলে বিশ্বের কোনো দেশ, যতই শক্তিশালী হোক না, ভারতের এই দাবিকে অবজ্ঞা করতে পারবে না। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ যেমন, রাশিয়া এবং চীন হল এক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাদের কাছ থেকে এই বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট শিক্ষালাভ করা উচিত।
একটা ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, ১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু, যদি অন্যান্য প্রদেশ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য সরবরাহ না হত তাহলে মৃতের সংখ্যা আরও বেড়ে যেত। বঙ্গদেশে মুসলমানরা অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল স্থানে অবস্থান করছেন। তাই তাঁদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। এইজন্যই হয়তো তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হয়েছেন। মুসলিম লিগ এই বিষয়টিকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলা খেলতে চাইছে, যা কখনোই কাম্য নয়। মুসলিম লিগ চাইছে ভারতের বুকে একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন করতে। এটি দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলার ওই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ থেকে তাঁরা যদি শিক্ষাগ্রহণ না করেন, তাহলে সেটা হবে তাঁদের পক্ষে দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক।
ভারতের বুকে একাধিক সম্প্রদায় বিদ্যমান, যদি এখন আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক অনৈক্য দেখা দেয়, তাহলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ ভারতবর্ষকে আক্রমণ করতে লালায়িত হবে। ভারতের ইতিহাসে এমন ঘটনা বার বার পরিলক্ষিত হয়েছে। যখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি দেখে যে, দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অশান্তি বিদ্যমান এবং দেশের মানুষের মধ্যে সংহতি নেই, দেশের মানুষ সমবেতভাবে বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে না, তখন শত্রুরাষ্ট্র সীমান্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভারতবর্ষকে এইসব স্বার্থান্বেষী মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। ভারতের বুকে এমন এক বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে যাতে ভারতবর্ষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। এভাবেই ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে।
হিন্দুরা ভারতবর্ষের বুকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় রূপে বিদ্যমান। হিন্দুস্থান হল এইসব হিন্দুদের মাতৃভূমি। হিন্দুরা এই অঞ্চলটিকে স্বর্গের তুল্য বলেই মনে করে থাকেন। হিন্দুদের দেখতে হবে যে, কোনোভাবেই যেন তাঁদের পরম আরাধ্য এই মাতৃভূমি ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয়। হিন্দুরা এই মহান দেশের সার্বিক ঐক্য এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে শহিদ হতে বিন্দুমাত্র অস্বীকৃত হবেন না। হিন্দুদের কাছে ভারতবর্ষ শুধু তাঁদের মাতৃভূমি নয়, এটি হল এক পবিত্র দেবভূমি। হিন্দুরা কখনোই তাঁদের মাতৃভূমিকে খণ্ডবিখণ্ড হতে দেখতে পারবেন না। তাঁদের লক্ষ্য পরিষ্কার, তাঁদের কর্তব্যকে আমরা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি। এক সংঘবদ্ধ ভারত সর্বাত্মক স্বাধীনতা লাভ করবে। এই ধর্মযুদ্ধে হিন্দু মহাসভা কখনোই হিন্দু সম্প্রদায়ের সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হবে না বলেই আমাদের স্থির বিশ্বাস।
‘বন্দেমাতরম্’
শ্রীহরিদাস হালদার
সচিব, সংসদীয় কমিটি
বাংলা প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা
তিনটি ইস্তেহারই স্পষ্ট করে দিয়েছিল, কোন দল আগামীদিনে ঠিক কোন পথে হাঁটতে চাইছিল।
কংগ্রেস চাইছিল, একটি মজবুত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে, যে রাষ্ট্র সকল স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠা করবে। ধর্ম নয়, গণতান্ত্রিক অধিকারই হবে ভারতের প্রতি জাতির প্রথম এবং আত্মিক অধিকার। কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল আত্মবিকাশ এবং আত্ম-উন্নয়নের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করা। স্বনির্ভর একটি জাতিশক্তি গঠন করবে। আর, সেটা সম্ভব যদি মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মান আকাশচুম্বী হয়। কর্মহীনতা দূরীকরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, পিছিয়ে পড়া মানুষের উজ্জীবন, কৃষি ও শিল্পের আধুনিকীকরণ এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সমগ্র ভারতীয় সমাজকে একীভূতকরণের মাধ্যমে এমন একটি স্বাধীন সত্তার দেশ গঠন যেখানে কোনো পরিবার নয়, ভারতের প্রতিটি পরিবারই যেন সশক্তিকরণের লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে।
হিন্দু মহাসভার নজর ছিল জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনতায়। এবং মহাসভা চেয়েছিল, সেই লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে গোটা দেশে আগে দরকার একই আইন সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া। এক দেশ, এক বিধান। শুধু তাই নয়, হিন্দু মহাসভা চেয়েছিল, ভারতবর্ষের আঞ্চলিক রাজ্যগুলির ভৌগোলিক পরিসীমা নতুন করে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে নির্ধারিত হোক যাতে কোনো মানুষই আত্মঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে না পড়ে। রাজ্যগুলি পুনর্গঠিত হোক ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে। হিন্দু মহাসভা স্পষ্টতই ঘোষণা করেছিল, স্বশাসনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত শক্ত না করে প্রয়োজন দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করা। সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসা এবং বৈরিতার বাতাবরণ থেকে দূরে থাকা।
কিন্তু, মুসলিম লিগের ইস্তেহার প্রমাণ করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই— নির্বাচনি ফলাফলের মাধ্যমে সমগ্র মুসলমান সমাজকে একত্রিত করে ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্র গঠন করা। মুসলিম লিগ প্রধান মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ স্পষ্টতই বলেছিলেন— ১৯৪৬-এর নির্বাচন ছিল পাকিস্তান গঠনের ব্যাপারে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের দাবি গণভোটের রূপে প্রতিস্থাপন করা। এবং, সেটা তখনই সম্ভব যখন সমগ্র মুসলমান সমাজ, সমগ্র হিন্দু সমাজের তীব্র বিরোধিতা করবে।
ফল যা হবার, তা-ই হয়েছিল।
সংখ্যালঘু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের মস্তিষ্ক সুস্থ চিন্তাভাবনা এবং সুস্থ সংস্কৃতির বিপরীত পথেই হেঁটেছিল। তা ছিল ইসলামিক সত্তার ধারক ও বাহক হয়ে একটি ইসলামিক দেশ গঠন করা। ফলাফলে দেখা গেল— ভোটের অধিকারী ৮৬.৮ শতাংশ মুসলমানই দেশ বিভাজনের সপক্ষে রায় দিয়েছিলেন। এর প্রমাণ, জাতীয় আইন পরিষদের অন্তর্গত প্রতিটি মুসলিম নির্বাচনি ক্ষেত্রে মুসলিম লিগই জয়ী হয়েছিল। অবিভক্ত বঙ্গদেশে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১২৩ আসনের ১১৫টি আসনে জয়ী হয়েছিল লিগ। এবং, অবশ্যম্ভাবীভাবেই অবিভক্ত বাংলার নতুন মন্ত্রিসভার প্রধান হয়েছিলেন সুরাবর্দি— হোসেইন সুরাবর্দি যিনি একটি লক্ষ্যেই স্থির ছিলেন— হিন্দুর বিনাশসাধন। হিন্দু নামক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিসর্জন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সবকটি ইস্তেহার সংগৃহীত ‘১৯৪৬ কলকাতা হত্যা এবং নোয়াখালি গণহত্যা’ থেকে। প্রকাশক : হিমাংশু মাইতি। ভাষান্তর : পৃথ্বীরাজ সেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন