সাতসকালেই রক্তপাত আগুনের ফুলকি

সুজিত রায়

‘হিন্দু ভারত নাকি মুসলিম ভারত’ : সাতসকালেই রক্তপাত আগুনের ফুলকি

…‘হিন্দু-ভারত’ ও ‘মুসলিম-ভারত’ করে যদি আমরা চিৎকার করতে থাকি— শ্মশানের শৃগালের চিৎকার শুনে যেমন পথিক দূরে সরে যায়, আমাদের সেই বিকট চিৎকার শুনে বিশ্ববাসী, ভারতের দিগন্তপ্রসারিত শ্মশান থেকে দূরে সরে যাবে; আর আমরা নরমাংস- লোলুপ রসনা সঞ্চালন করতে করতে রোষষায়িত দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে চাইতে থাকব; এবং একবার সুযোগ পেলে কি করে শত্রু নিপাত করতে পারি, তার ব্যর্থ গবেষণায় এই অমূল্য জীবন ব্যয় করব; আর, আমাদের উদ্‌ভ্রান্ত মস্তিষ্কপ্রসূত টিকির সঙ্গে বিদ্যুতের এবং দাড়ির সঙ্গে পৌরুষের সম্বন্ধ বিষয়ক উৎকট মতবাদগুলি কর্মক্লান্ত জগৎবাসীর অবসর বিনোদন করবে।

সূত্র: বাঙালি মুসলমান: এস ওয়াজেদ আলি, দীপালি পত্রিকা, ভাদ্র ১৩৪৭

.

Men, women and children were butchered before the eyes of their near and dear ones… (accompanied by) devilish dancing….. (by) those responsible for those diabolical acts. Such devilish dancing was probably a conscious on unconscious initiation of a particular rite of violence expressing the crowd’s feelings of hatred and vengeance.’ -Source: Hindustan Standard, 20th Aug. 1946

সেদিনের বীভৎস উন্মত্ততা কলকাতার খোলা রাজপথে

সেদিনের বীভৎস উন্মত্ততা কলকাতার খোলা রাজপথে

কথা ছিল মিছিল শুরু হবে দুপুর থেকে। কারণ, ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ডাক দেবেন মুসলিম লিগ নেতারা দুপুর তিনটের পর মনুমেন্ট ময়দান থেকে।

কিন্তু, নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণবিহীন উত্তেজিত মুসলিম যুবকদের রক্তে তখন উন্মাদনা। লিগের প্রচার করা হিন্দু বিনাশের লিফলেট ঢুকে গেছে অশান্ত মস্তিষ্কে। হাতে হাতে পৌঁছে গেছে ছুরি, ছোরা, ভোজালি, তরোয়াল, পিস্তল, পাইপগান, বোমা, লোহার রড, বাঁশের লাঠি। চকচক করছে তাদের লোভের চোখ— লুটের মাল ঘরে তোলার লোভ, কাফের মহিলাকে যৌন নিষ্পেষণে উল্লসিত হবার লোভ।

সকাল ৬টা থেকে শুরু ঝামেলা। রাজাবাজারের পাকিস্তান-এর সমর্থক বাহিনীর প্রথম আক্রমণ মানিকতলায়। তারপর একের পর এক ছুরিকাহত হচ্ছেন হিন্দুরা। অস্ত্রের জোগান আসছে স্থানীয় মসজিদ থেকে। একদল যখন লুঠ চালাচ্ছে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে, অন্য দল তখন গুঁড়ো করছে আমহার্স্ট স্ট্রিট মোড়ের শীতলা মন্দির। কেশব সেন স্ট্রিটের মুসলমান কাঠ ব্যবসায়ী নূর মহম্মদ ছুরি খেলেন রাজাবাজারের মুসলমানের হাতে

সেই শুরু…।

তারপর অবিরাম আক্রমণের ঢেউ। কখনো উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে তো কখনো মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে। কখনো চিৎপুরে, বড়োবাজারে তো কখনো পার্ক সার্কাসে, বালিগঞ্জে।

দুপুর বারোটা বাজতে-না-বাজতেই কলকাতা শহরের দখল নিল দাঙ্গাবাজ বাহিনী। প্রত্যেকের হাতে লাঠি নয়তো ধারালো অস্ত্র। সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। অলিগলি থেকে রাজপথ পিঁপড়ের সারির মতো একটা একটা করে মানুষের সারি বেরিয়ে আসছে আর মিশে যাচ্ছে শহরের রাজপথের মিছিলগুলির সঙ্গে। হিংস্র অ্যানাকোন্ডার মতো সরীসৃপসম সেই মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। শহরের দোতলা, তিনতলা বাড়ির জানলায় আধখোলা পাল্লার আড়ালে ভীত, সন্ত্রস্ত মুখ— মেয়েদের, শিশুদের। এবার কি তাহলে শুরু হবে ঘরে ঘরে আক্রমণ?

হ্যাঁ, সেই নির্দেশই দিলেন লিগ নেতারা মনুমেন্ট ময়দান থেকে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলিম ইনস্টিটিউটে জড়ো হওয়া সংখ্যালঘুদের মূল মিছিল ছুটছিল নেতাদের মঞ্চের দিকে। যে মঞ্চ আলো করে বসে আছেন ডাইরেক্ট অ্যাকশন-এর প্রধান পুরোহিত হোসেইন শাহিদ সুরাবর্দি, লিগ নেতা আবদুল হাশিম, লিগ সভাপতি নাজিমুদ্দিন আর তাবড় মুসলিম নেতা আবদুর মনসুর। আর, কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু।

সলতে পাকানোর কাজটা করেছিলেন সুরাবর্দিই যিনি চোরকে বলেন চুরি করো, গৃহস্থকে বলেন চোরকে ধরো। একজন আপাদমস্তক সুযোগসন্ধানী, ক্ষমতালোভী ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সংকীর্ণ রাজনীতির মুখ সেই সুরাবর্দিই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস কেন তা ব্যাখ্যা করলেন হাজার হাজার মুসলমান জনতার সামনে। বললেন— প্রাথমিক লক্ষ্য অবশ্যই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন; কিন্তু, পাশাপাশি লক্ষ্য মুসলমানদের আত্মমর্যাদার পুনরুদ্ধার। সেকাজে যে বাধা দেবে, তাকে শাস্তি পেতে হবে। ভয়ংকর শাস্তি। তোমরা যাও, শাস্তি দাও তাদের যারা এতকাল মুসলমানকে ক্ষমতা দেয়নি, সম্মান দেয়নি, ভালোবাসা দেয়নি। এখন সময় এসেছে। পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া আছে। তারা পথে নামবে না। সেনাবাহিনীকে ডাকাই হবে না। অতএব, যে যা পারো করে নাও।

লাগাতার মুসলিম উসকানি

উত্তেজিত জনতার মধ্যে মনে হল নতুন ঢেউ জন্ম নিল। উদ্‌বেল সেই ঢেউকে চরম উচ্চতায় পৌঁছে দিলেন আবুল হাশিম। আর, আবুল হাশিমের সেই চরম উষ্ণ বক্তৃতাটিকেই আগুনের ফুলকি দিয়ে সাজালেন নাজিমুদ্দিন। কোনো রাখঢাক না রেখেই ঘোষণা করলেন— ১৬ অগাস্টের লড়াই হল হিন্দু এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চরমতম লড়াই। এ লড়াই মুসলমানের সশস্ত্র ক্ষোভ, সমস্ত অপমান, সমস্ত হীনম্মন্যতার প্রতিশোধ নেওয়ার লড়াই।

উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে মনুমেন্ট ময়দান। সেই ফুটন্ত পরিবেশে ঘি ঢাললেন আবদুল মনসুর আহমেদ। তিনিই প্রথম অর্ধসত্য তথ্য প্রচার করলেন। বললেন— বেহালা, কালীঘাট, মেটিয়াবুরুজ, মানিকতলা অঞ্চলে হিন্দুরা মুসলমানদের কচুকাটা করছে। উত্তেজনা চরমে পৌঁছে দিয়ে কয়েক জন আহত মুসলমানকে স্টেজে তোলা হল। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠল এসপ্ল্যানেড চত্বর।

কোনো কিছুই বিস্ময়কর নয়। আচম্বিত নয়। কারণ, হিন্দুদের বিরুদ্ধে উসকানির কাজটা চলছিল লাগাতার। লাগাতার রমজান মাসের আহ্বান দিচ্ছিলেন মুসলিম লিগের নেতারা, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জেমরা, মৌলানারা— ‘কাফেরদের নিশ্চিহ্ন করে দাও।’ বলা হচ্ছিল— ‘ইসলামের ভাই— আপনারা রমজান মাসের ঐতিহ্যের কথা কখনো বিস্মৃত হবেন না। পবিত্র কোরানের পাতায় এই মাসটির কথা বার বার বলা হয়েছে। উন্মাত মহম্মদ এই সময় মহান পয়গম্বর হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই মাসেই কাফেরদের হত্যা করা হয়… এ মাসেই আমরা কাফেরদের হাত থেকে আমাদের পবিত্র ভূখণ্ডকে অধিকার করতে পেরেছি।… এই মহান মাসেই মহান ইসলাম ধর্মের জয়পতাকা উড্ডীন হয়।… ঈশ্বরের অসীম অনুগ্রহে সর্বভারতীয় মুসলিম লিগ এই মাসটিকেই বেছে নিয়েছে পাকিস্তান সৃষ্টির মাস হিসাবে।… মক্কা এই মাসেই জয় করা হয় এবং বদরের যুদ্ধও জয় হয়। পাকিস্তান আমাদের স্বপ্ন, ১৬ অগাস্ট তারিখে আমরা সর্বভারতীয় হরতাল পালন করব। এটি হল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন। এদিনই সর্বভারতীয় সংঘর্ষ শুরু হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এই সংঘর্ষ থামবে না।… প্রত্যেক নারী, পুরুষ, শিশু এবং বৃদ্ধ, প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক নিজের জীবনদানের জন্য মনে-প্রাণে প্রস্তুত থাকবেন। পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য তাঁদের এই বলিদানকে আমরা সর্বদা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব। আসুন, আপনারা সংঘবদ্ধ হয়ে উঠুন, প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অংশ নিন। আমরা সিরাজদ্দৌল্লা, সৈয়দ আহমেদ বারলাভি, টিপু সুলতানের কথা জানি।… তাঁরা হিন্দু অথবা ব্রিটিশের ক্রীতদাস হয়ে বেঁচে থাকাকে ঘৃণা সহকারে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই আমরা এমনতরো রাষ্ট্রের জন্ম দেব যেখানে ইসলাম হবে সর্বোত্তম পন্থা। আমরা কিছুতেই ব্রিটিশ আধিপত্য স্বীকার করব না। ব্রাহ্মণ এবং বেনিয়াদলকে পরাস্ত করতেই হবে।

[সূত্র : মুসলিম লিগের প্রচারিত প্রচারপত্র। Ref. ১৯৪৬ কলকাতা হত্যা এবং নোয়াখালি গণহত্যা: দীনেশ চন্দ্র সিনহা, অশোক দাশগুপ্ত, আশিস চৌধুরী, ভাষান্তর : পৃথ্বীরাজ সেন, প্রকাশক : হিমাংশু মাইতি, কলকাতা 2022]

প্রচারে উর্দু আরবি সংবাদপত্র

বিভিন্ন উর্দু এবং আরবি সাম্প্রদায়িক পত্রপত্রিকা যেমন আসরে জাদিদ, মর্নিং স্টার ইত্যাদিতে ক্রমাগত প্রচার করা হচ্ছিল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন মুসলমান মিছিল থেকে কী ধরনের স্লোগান দেওয়া হবে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা কীভাবে প্রশিক্ষণ নেবে ইত্যাদি।

কতকগুলি স্লোগান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল—

১। পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক

২। মারকে লেঙ্গে পাকিস্তান

৩। কাফের লোগোঁকো মার ডালো

বলা হচ্ছিল— ১৬ অগাস্ট বেলা তিনটের মধ্যে মনুমেন্টের পাদদেশে সমাবেশকে এমন বিশাল করে তুলতে হবে যাতে অমুসলিমরা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন।

আসরে জাদিদ পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে বার বার জেহাদের প্রচার চলছিল। কলকাতার মেয়র এস এস উসমান স্বাক্ষরিত একটি পুস্তিকায় আহ্বান করা হয়েছিল— আমরা কাফের অর্থাৎ হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করি। আমরা ইসলামের মহান সাম্রাজ্য স্থাপন করি।

মুসলিম লিগ প্রচারিত একটি পুস্তিকায় লেখা হয়েছিল— “হে কাফেররা, তোমাদের ভবিষ্যৎ একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাবে। এমন এক সংঘর্ষ দেখা দেবে, যার আঁচ থেকে তোমরা বাঁচতে পারবে না। আমরা আমাদের শক্তিমত্তা প্রকাশ করব।

আওয়াজ উঠছিল ময়দানের সভামঞ্চের মাইক থেকে— কোয়ামি জঙ্গ কা টেবল বাজ আয়া— এবার জাতীয় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে।

বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমান যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল— সশস্ত্র আক্রমণের জন্য তরোয়াল চালানো, ভোজালি চালানো, টাঙির কোপ কীভাবে দিতে হয়, কীভাবে ছুরি চালাতে হয় গলায়। মুসলিম লিগের পুস্তিকায় লেখা হচ্ছিল ভয়ংকর সব হুমকি। ‘ভারতে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে, আমাদের সকলের হাতে তীক্ষ্ণ তরবারি থাকবে, আমরা আগামীকাল অর্থাৎ ১৬ অগাস্ট তারিখে এমন আতঙ্কের সৃষ্টি করব যাতে কেউ ঘুমোতে পারবেন না।’ প্রচার করা হচ্ছিল— মিছিলের গর্জন এতই তীব্র হবে যে মূক মানুষের মুখেও ভাষা ফুটবে, অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পাবে। বধিরও শুনতে পাবে নবরাষ্ট্রের জন্মের জন্য দাবির জোরদার আওয়াজ। আহ্বান জানানো হচ্ছিল পাড়ায় পাড়ায়, মুসলিম মহল্লায় মহল্লায়— ‘যারা শান্ত স্বভাবের মানুষ, তাঁরাও আসুন। যাঁরা স্বর্গে পৌঁছোতে চান, তাঁরা আসুন। যারা চোর, গুন্ডা, যাদের মধ্যে অসীম শক্তি লুকিয়ে আছে, তারাও স্বাগত। স্বর্গের প্রবেশদ্বার খোলা হয়েছে। আসুন, আমরা হাজারে হাজারে সেখানে প্রবেশ করি। আমরা আমাদের বিজয়ের জন্য আনন্দ প্রকাশ করি। জয় পাকিস্তান, জয় মুসলমান, শান্তি প্রদেশ।’

গত একমাস ধরে মুসলিম বস্তিতে বস্তিতে গড়ে তোলা হয়েছিল অস্ত্রাগার। ১৬ অগাস্ট সেইসব অস্ত্র উঠে এল সংখ্যালঘু কিশোর থেকে প্রৌঢ়দের হাতে হাতে। মসজিদে মসজিদে জমায়েত। সেখান থেকে ময়দান। যেন প্রতিটি দাঙ্গাবাজের পদক্ষেপে গেঁথে তোলা হচ্ছে পাকিস্তানের ভিত। সেই ভিত গাঁথা হবে হিন্দুর রক্তে। কাফেরের রক্তে।

১৯৪৬-এর দাঙ্গা নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। সাধারণ গৃহস্থ থেকে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ থেকে পুলিশ অফিসার, লেখক থেকে কবি – বহু মানুষ তাঁদের চোখে সেদিনের দেখা তাণ্ডবের বিবরণ লিখে গেছেন। আমরা সেগুলোর কিছু কিছু নমুনা এখানে হাজির করব। সেইসব নমুনাগুলিই প্রমাণ করবে কলকাতা দাঙ্গার সূত্রপাত করেছিল মুসলমানরাই মূলত মুসলিম লিগের কট্টর পাক-ই-স্তানবাদী নেতৃত্বের উসকানিতেই। বহু গবেষণাগ্রন্থতেও ছড়িয়ে আছে সেই সত্য।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. সুরঞ্জন দাস তাঁর সুবিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থ Communal Riots in Bengal 1905-1947-এ লিখেছেন :

Long Before the Direct Action resolution had been framed the Bengal Muslim League leader Abul Hashim had threatened, ‘Where justice and equity failed, shinning steel would decide the issue.’

এর অর্থ বহুদিন ধরেই মুসলমানরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হিন্দু হত্যার, যাতে ভারতবর্ষকেই পাকিস্তান করে তোলা যায়। সেটা যখন সম্ভব হল না, তখন হিন্দু নিধন শুরু হল ভারত বিভাজনের মাধ্যমে পাকিস্তান তৈরির চাপ সৃষ্টি করতে।

ড. দাস তাঁর গ্রন্থে ১৫ অগাস্ট রাত এবং ১০৬ অগাস্টের সকালের বিবরণ দিচ্ছেন বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করে:

The night before the Direct Action Day was filled with slogans damning the Congress and Hindus and Muslim processionists going to the rally on 16 August were armed with Lathis and other Lethal weapons as if they were going into a great battle with savage force against the Hindus. পরের বিবরণ: The processionists shouted such provocative slogans as Larke Lenge Pakistan and their battle cry seemed to be, to quote a contemporary comment, ‘Let teach them (Hindus) the meaning of Pakistan. K. S. Roy, the Congress Leader in the Bengal assembly, remarked that the way processionists shouted the slogans and acted in union showed they were ‘obeying orders’.

সেই সময়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও লিখিত তথ্য থেকে জানা যায়, মুসলমানদের মারমুখী মিছিলকে কেন্দ্র করে ছোটোখাটো মারদাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কোথাও কোথাও হিন্দুরাও পালটা আক্রমণ করছিলেন আত্মরক্ষার তাগিদে, বিভিন্ন উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে ছোড়া ইট, পাটকেলেও কিছু মুসলমান মিছিলকারী আহত হয়েছিলেন। কিন্তু, তখনও পর্যন্ত গণ্ডগোল দাঙ্গায় পরিণত হয়নি। কিন্তু, মনুমেন্ট ময়দানে মুসলিম লিগ নেতারা এমনভাবে গুজব এবং মিথ্যা রটনায় মেতে উঠেছিলেন যে, ময়দানের জমায়েত মনে করে নিল, গোটা কলকাতা জুড়েই মিছিলে মিছিলে আক্রমণ করছেন হিন্দুরা। গবেষক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন তাঁর ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা’য়: ‘জনতাকে উত্তেজিত করার জন্যই ছড়ানো হচ্ছিল এইসব গুজব, এমন মনে করার কারণ আছে। প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল, কারণ এর পরেই লিগ নেতারা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গা লেগে গেছে বলে প্রচার করে সভা বন্ধ করে দিয়ে জনতাকে ফিরে যেতে বলেন। সভা ভেঙে যায় আর তারপরেই ব্যাপকভাবে শুরু হয় দোকানপাট লুট, পথচারীদের ওপর আক্রমণ। দাঙ্গা মারাত্মক রূপ নিতে শুরু করে ওই সময়।’

১৬ অগাস্ট বিকেল তিনটে থেকে সাতটার মধ্যে তোলপাড় হয়ে যায় কলকাতা শহর। পাড়ায় পাড়ায় জটলা, উত্তেজনা, দোকানে দোকানে ঝাঁপ ফেলার তৎপরতা, বড়োবাজার, কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে অবিরাম লুঠপাট, ভাঙচুর। বড়ো বড়ো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স থেকে ছোটোখাটো পান-বিড়ি, চা-বিস্কুটের দোকানও রেহাই পায়নি।

দাঙ্গাবাজদের ঠেকাতে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বৈঠক করলেন গোপাল মুখার্জীসহ অন্যান্য বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিকদের সঙ্গে। ছবি সৌজন্য : স্বস্তিকা পূজা সংখ্যা ১৪৩০

দাঙ্গাবাজদের ঠেকাতে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বৈঠক করলেন গোপাল মুখার্জীসহ অন্যান্য বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিকদের সঙ্গে। ছবি সৌজন্য : স্বস্তিকা পূজা সংখ্যা ১৪৩০

হিন্দুরা জেগে রইল চারদিন

বহু মানুষ দাঙ্গার প্রথম চারদিন— ১৬ অগাস্ট থেকে ১৯ অগাস্ট দু-চোখের পাতা এক করতে পারেননি। মুসলিম লিগ নেতারা যেমন বলেছিলেন— হিন্দুদের ঘুমোতে দেবেন না, অবস্থাটা প্রকৃতপক্ষে তেমনই হয়েছিল। বাড়িঘর, পরিবার, প্রতিবেশীদের রক্ষার তাগিদে অনিদ্রাই সম্বল ছিল চাররাত। তাঁদের লিখে যাওয়া বা বলে যাওয়া কিছু বিবরণ এখানে তুলে ধরছি।

কংগ্রেস নেতা বিজয় সিং নাহার থাকতেন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে। লিখছেন :

…কলকাতার ময়দানে সভা হল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী এইচ এস সুরাবর্দী গরম গরম বক্তৃতা দিলেন।… জনসভা শেষ হবার পর লুটপাট, দাঙ্গা-হাঙ্গামা আরম্ভ হল। ১৬ অগাস্ট বিকেলে বাড়ির একতলায় বসে আছি। হঠাৎ খবর এল ওয়েলিংটন স্কোয়ারের আশেপাশে ঝামেলা শুরু হয়েছে। আমি একাই বেরিয়ে পড়লাম। দেখি কি ব্যাপার! ওয়েলিংটনের মোড়ে দোকানপাট ভাঙা হচ্ছে। বাধা দিলাম। চারদিকে মুসলমান। ওদেরকে ধমকে দিলাম। কি হচ্ছে, কেন ভাঙচুর করছ? এদিকে হঠাৎ দেখলাম, একটা লোক আমারই ওপর তরোয়াল তুলেছে কোপ মারতে। ভাগ্যক্রমে আর একজন সেই লোকটাকে হাত দিয়ে আটকে দিল। বোধহয় আমাকে চিনতে পেরেছে। সব দেখে বুঝলাম, একা বাধা দিয়ে লাভ নেই। বাড়ি ফিরে এলাম।

বাড়িতে মধুসূদন রায় ছিল। আমরা দুজনে লাঠি নিয়ে বেরোলাম। পাড়ার সব দরজা-জানলা বন্ধ। দাঙ্গাবাজরা ওয়েলিংটন পেরিয়ে ইন্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটে ঢুকেছিল। খবর পেলাম কুমার সিং হল ওদের লক্ষ্যস্থল। কারণ এই জায়গাটা কংগ্রেসের বড়ো ঘাঁটি।… রাস্তা ফাঁকা, কোনো বাধা নেই। আমি এবং মধু মাত্র দুজন। লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে আমরা রাস্তায় নেমে পড়লাম।… দাঙ্গাকারীদের মোকাবিলা করে তাদের দূরে ঠেলে দিতে লাগলাম।… আমরা মারমুখী হয়ে এগোতেই আক্রমণকারীরা পিছু হঠতে লাগল। দাঙ্গাকারীদের হাতে ছোরা অনেক ছিল।… হঠাৎ দেখি আমি একা। কি করে বাঁচবো সেই চিন্তা। এদিকে আমার বাড়ির ছেলেরা কাগজ আর নেকড়া পাকিয়ে রেখেছিল। কেরোসিন তেলে ভালো করে ডুবিয়ে মোমবাতির আগুন জ্বালিয়ে সেই বল একটা বাড়ির বারান্দা থেকে ছোঁড়া হচ্ছিল। সেই আগুন দেখে মিছিলের অনেক লোক ভয় পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা, ভাগ্যক্রমে একটা জিপ দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঝট করে জিপটার আড়ালে দাঁড়ালাম। সে যাত্রা ভগবানের দয়ায় বেঁচে গেলাম।

রাতে বাড়ি আর দোকান ভাঙচুর আবার শুরু হয়েছে। দাঙ্গা পুরোদমে চলছে।… রাত তিনটের সময় বিরাট হল্লা।… শুনলাম কাছেই সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে তালতলা লেনের এক বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। দোতলায় আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। ভেতরে মহিলারা আটকে পড়েছেন। কান্না ও চিৎকার শোনা যাচ্ছে।… গিয়ে দেখি ভীষণ অবস্থা। বাড়ির ওপরতলা থেকে মেয়েরা ছেলেরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। নিচে দাঙ্গাবাজরা আরও আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য।… আমি একটা কৌশল করলাম। বিপ্লবী

নেতা অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে খুব জোরে বাঘের ডাক দিতে শিখেছিলাম।… গোলমালের মধ্যে বাঘের ডাক দিলাম খুব জোরে। ওই অদ্ভুত আওয়াজে উপস্থিত অনেকে হতচকিত হয়ে থমকে গেল। সেই ফাঁকে আমি নিমেষের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমি বহু বছর এই অঞ্চলের কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ছিলাম। আমাকে সামনাসামনি দেখে অনেকেই গুটিসুটি সরে পড়ল। ইতিমধ্যে ফায়ার ব্রিগ্রেড এসে গেল। মুসলমানরা দমকলকে রোখার চেষ্টা করেছিল। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। ওদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করা হল।

[সূত্র: যা দেখেছি যা করেছি— বিজয় সিং নাহার, পৃষ্ঠা ৮১-৮৬]

সাংবাদিকরা যা দেখেছেন

কলকাতা দাঙ্গার সময়ে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নানা উত্থান-পতনের তিনি সাক্ষী। ১৬ অগাস্ট ১৯৪৬ এবং পরবর্তী তিন দিনের কালান্তক মুসলিম-হিন্দুর দাঙ্গার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন:

১৯৪৬ সালের অগাস্ট মাসের এক সন্ধ্যায় আমি রাজা দীনেন্দ্ৰ স্ট্রিটের সঞ্জীববাবুদের একতলায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী (আসলে মুখ্যমন্ত্রী) সুরাওয়ার্দির কণ্ঠস্বর বা বক্তৃতা শোনা গেল রেডিয়োতে। কিন্তু বক্তৃতাটি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ও রক্তপাতের হুমকিতে ভরতি ছিল। আসলে তখন মুসলিম লিগের পক্ষ থেকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে Direct Action-এর ডাক দেওয়া হয়েছিল। ফলে রক্তপাত ও হাঙ্গামার সূত্রপাত হল।… সারা শহরব্যাপী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেল আর শাসক ইংরেজ বেশ মজা দেখতে লাগল।… অগাস্ট মাসের সেই দিনগুলিতে আমি ছিলাম রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে— উলটাডিঙি অঞ্চলে। খালের ওধারে ছিল উলটাডিঙির মুসলমানদের ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকা। যেখান থেকে সন্ধ্যার অন্ধকার হতেই আল্লা হো আকবর ধ্বনিত হত। আর ওপার থেকে তার জবাবে ধ্বনিত হত বন্দে মাতরম। দিনের বেলায়ও লোক যাতায়াত খুব সামান্য ছিল এবং দৈনন্দিন জীবনধারণের প্রয়োজনে যদি কোনো হিন্দু মুসলমান এলাকায় কিংবা যদি কোনো মুসলমান হিন্দু এলাকায় গিয়ে পড়ত, তাহলে তার রক্ষা ছিল না। অথচ দাঙ্গা শুরু হওয়ার আগে হিন্দু ও মুসলমান হাটে বাজারে ফুটপাতে পাশাপাশি দোকান চালিয়েছে। বিকিকিনি করেছে। কিন্তু আজ তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে গেল— খুনের নেশায় যেন মত্ত হয়ে গেল। যে মুসলিম ফলওয়ালার বা মাংসওয়ালার কাছ থেকে হিন্দুরা দিনের পর দিন ফল কিনেছে বা মাংস কিনেছে কিংবা যে মুসলমান হিন্দু দোকানদারদের কাছ থেকে গামছা বা লুঙ্গি কিনেছে অথবা বাজারে শাকসবজি বা মাছ কিনেছে, আজ তারাই পরস্পরের গলা কাটতে লাগল। ভয়াবহ বর্বর ও অমানুষিক দৃশ্য। সন্ধ্যার পরে তো বটেই, দিনের বেলায় প্রকাশ্য সূর্যালোকে মানুষ মানুষকে অনায়াসে খুন করল। অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গরিবেরা মারা পড়ল… কত যে রিকশওয়ালা মারা পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। দাঙ্গা থেমে যাওয়ার অনেকদিন পর কোনো কোনো খালে বা ব্রিজের কাছে কিংবা পরিত্যক্ত রিকশার মধ্যে মৃতদেহ পাওয়া যেত।

[সূত্র: যখন সম্পাদক ছিলাম: বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৮১-৮৬]

আজীবন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক কল্যাণ দত্ত তাঁর স্মৃতিকথা আমার কমিউনিস্ট জীবন-এ হাতড়ে বেড়িয়েছেন সেইসব ভয়াবহ দাঙ্গার দিনগুলোকে।

এরপরেই এল কলকাতার সর্ববৃহৎ ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, ১৬ অগাস্ট।… ১৭ অগাস্ট বিকেলে কলকাতার অবস্থা দেখার জন্য বেরোলাম। ট্রাম-বাস বন্ধ। বেলগাছিয়া থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত দাঙ্গার কোনো চিহ্ন নেই। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট ধরে এগোতে ইতস্তত কিছু কিছু পোড়া দোকানঘর আর মৃতদেহ চোখে পড়ল। হাতিবাগান বাজারের বড়ো ফটকের সামনে যে দৃশ্য দেখলাম, তা কোনোদিন ভুলব না।

দেখলাম যে বেশ কিছু লুঙ্গি পরা লোককে গাদা করে একের ওপরে আরেকজনকে চাপিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। পরে শুনেছি যে, বাজারের সব কটি গেট বন্ধ করে মুসলমানদের আক্রমণ করা হয়। খাঁচায় পড়া ইঁদুরের মতো তারা ছোটাছুটি করতে থাকে। তখন তাদের লাঠি, রড ও ইট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।

বিশিষ্ট সাংবাদিক শংকর ঘোষ তখন থাকতেন বিবেকানন্দ রোড ও কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মোড়ে একটি মেসে। রাজ্য-রাজনীতি, দিল্লির রাজনীতি, দাঙ্গা এবং দেশভাগ ও স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর তিন খণ্ডে প্রকাশিত অসামান্য রচনা ‘হস্তান্তর’ (আনন্দ পাবলিশার্স)-এ তিনি স্বচক্ষে দেখা দাঙ্গার খণ্ডচিত্র এঁকেছেন নিপুণ সাবলীলতায়।

মেসে আমার ঘরটি ছিল তেতলায়…। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালে তো কথাই নেই, ঘরে বসেও বিবেকানন্দ রোড ও কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের বেশ খানিকটা অংশ দেখা যায়, দাঙ্গার প্রথম দুদিন এই বারান্দাই ছিল আমার অবজার্ভেশন টাওয়ার।… ওই এলাকায় প্রথম ঘটনাটি ঘটে বেলা দশটা নাগাদ। বিবেকানন্দ রোড ধরে একজন দুধঅলা সাইকেলে দুধের পাত্র ঝুলিয়ে পিছনে একটি দশ-বারো বছরের ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যখন কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট দিয়ে মানিকতলার দিকে যাচ্ছেন তখন ওই বিক্ষিপ্ত জটলা থেকে কয়েকজন বেরিয়ে এসে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলেন। সাইকেল আরোহী প্রতিবাদ করতেই তাঁকে মারধর আরম্ভ হল। ওপর থেকে দেখলাম হঠাৎ একটি ছোরা রোদে ঝলসে উঠল। সাইকেল আরোহী কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের ট্রাম লাইনের ওপর লুটিয়ে পড়লেন। ছোরা হাতে একজন আস্ফালন করতে করতে সরে পড়লেন। ছোটো ছেলেটি কাঁদতে আরম্ভ করায় তাকে কয়েকটা চড়-চাপড় মেরে পালাতে বলা হল, সে ওখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেল। প্রাণে বেঁচেছিল কিনা জানিনা।… দুধঅলা রাস্তায় পড়ে রইলেন। তিনি জীবিত কি মৃত, তা দেখতে কেউ এগিয়ে এল না।… রেডক্রশের ফ্ল্যাগ উড়িয়ে একটি প্রাইভেট গাড়ি চলে গেল, দাঁড়াল না। কয়েক মিনিট পরে পুলিশের একটি গাড়ি এল, সে গাড়িও দাঁড়াল না।… তারও খানিকক্ষণ পরে পুলিশের কাছে বা অন্য কোনো সূত্রে খবর পেয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে সেই একভাবে পড়ে থাকা দেহটি সরিয়ে নিয়ে গেল। (হস্তান্তর, পৃষ্ঠা ৮৭-৮৮)

১৭ অগাস্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে সাংবাদিক শংকর ঘোষ যা লিখে গেছেন তা শুনলেও আতঙ্ক হয়—

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিনটা বদলে যেতে আরম্ভ করল। কলকাতায় আগের দিন কী ঘটেছে, তা জানার জন্য সকলেই ব্যগ্র কিন্তু যথাসময়ে সে দিন কাগজ পৌঁছল না। বড়ো কাগজগুলি কোনোরকমে চার পাতার কাগজ বার করেছিল কিন্তু সে কাগজও বিলির ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। ওই ১৬ আগস্টই কলকাতা শহর হিন্দু ও মুসলমান এলাকায় ভাগ হয়ে গিয়েছিল, এক সম্প্রদায়ের হকারের অন্য সম্প্রদায়ের এলাকায় গিয়ে কাগজ বিলি তো সম্ভবই ছিল না, অন্য সম্প্রদায়ের এলাকা অতিক্রম করে নিজের সম্প্রদায়ের এলাকায় কাগজ বিলিরও উপায় ছিল না। ফলে বেশ কয়েকদিন কলকাতার বড়ো ছোটো সব কাগজই তার নিজ নিজ এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। বাগবাজার থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার ও হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড মধ্য কলকাতায় ও স্টেটসম্যান সাহেবপাড়ায় ও দক্ষিণ কলকাতায়। বিলি করার অসুবিধার জন্য বড়ো কাগজগুলি সীমিত সংখ্যক কাগজ ছাপত অথচ সারা শহরে কী হচ্ছে বা ভিন্ন পাড়ায় কী হচ্ছে তা জানার ব্যাপক আগ্রহের জন্য খবরের কাগজের চাহিদা খুব বেড়ে গিয়েছিল। চাহিদা ও সরবরাহের এই অসামঞ্জস্যের সুযোগ কয়েকটি অল্প পরিচিত ছোটো কাগজ পুরো নিয়েছিল। খবরের সত্যাসত্য যাচাইয়ের কোনো উপায় না থাকায় গুজবই তখন সংবাদ বলে প্রচারিত হত।… উত্তেজনা বাড়াত।

যেমন গুজবের বান ডেকেছিল রাজাবাজারকে ঘিরে। সেখানে নাকি কসাইয়ের দোকানে দোকানে ধর্ষিতা ও মৃতা যুবতীদের নগ্নদেহ কাটা গোরুর মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘এমন দৃশ্য এই প্রথম দেখলুম।’ ঝোলানো দেহগুলির কোনো কোনোটার স্তনগুলো কেটে নেওয়া হয়েছে। সে আবার এক বিসদৃশ দৃশ্য। কিছু পুরুষের দেহ নাকি ছুড়ে ফেলা হয়েছিল ট্রামলাইনের তারে। তবে, যাঁরা নগ্ন নারীদেহ দেখতে রাজাবাজার গিয়েছিলেন, তাঁরা ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘দুর দুর! যত্ত ভাঁওতা!

রেলওয়ে শ্রমিকদের মুখে শুনলাম, চারিদিকে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে, বাড়িঘর পুড়ছে, লুঠতরাজ চলছে। কোনোরকমে শিয়ালদহ স্টেশনে চলে এলাম আমরা তারপর পায়ে হেঁটে লোয়ার সার্কুলার রোড দিয়ে এগোচ্ছি। দেখলাম রাস্তার দুপাশে মৃতদেহ পড়ে আছে। ফুটপাতে আক্রমণকারীরা ঘোরাফেরা করছে। চারিদিকে আগুন জ্বলছে। আমরা ফুটপাত দিয়ে না গিয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছি।

এ অভিজ্ঞতা কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর, যিনি সেই সময় ছিলেন রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের বড়ো মাপের নেতা, রাজ্য বিধান পরিষদে জয়ী সদস্য। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩০ বছরের টানা মুখ্যমন্ত্রী। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘নারকেলডাঙা শ্রমিক লাইনে ১৫ অগাস্ট থেকেই ছিলেন পার্টির নির্দেশে। রেল কলোনিতে বসে বসেই দেখেছেন, ১৬ অগাস্ট সকাল থেকেই মাঝে মাঝেই রাস্তা দিয়ে চলেছে মিছিল। মিছিলে মুসলিম লিগের পতাকা ছয়লাপ। লিখেছেন, ‘সেই সময়কার হিসেব অনুযায়ী ১৯৪৬ সালের অগাস্ট দাঙ্গায় কলকাতায় মৃতের সংখ্যা ২০ হাজারের কম হবে না, বেশিও হতে পারে।’

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ লিখছেন:

ভারতের ইতিহাসে ১৬ অগাস্ট ছিল একটি কালা দিন, অভূতপূর্ব গণহিংসা মহান কলকাতা শহরকে সেদিন রক্তপাত, হত্যা ও সন্ত্রাসে নিমজ্জিত করেছিল। শয়ে শয়ে ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিলেন, হাজার হাজার ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন এবং কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছিল। মুসলিম লিগ বেশ কয়েকটি মিছিল বার করেছিল এবং এই মিছিল থেকে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ আরম্ভ হয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই সারা শহর দুই সম্প্রদায়ের গুণ্ডাদের হাতে চলে যায়।

আরএসপি নেতা যতীন চক্রবর্তী যুক্তফ্রন্ট আমলে ‘হরতালদা’ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন কারণ তিনি হরতালের ডাক দিলে রাস্তায় সাইকেল নিয়েও কেউ বেরোত না। নিজের স্মৃতিকথায় তিনি লিখছেন:

আমাদের কমিউন তখন হ্যারিসন রোডে, মহেন্দ্র দত্তর ছাতার দোকানের ওপরে। মাখন পাল, প্রতুল চৌধুরি, সুখময় চক্রবর্তী, মণি চক্রবর্তীরা তখন থাকতেন কমিউনে। বাজার-টাজার তো কদিন ধরেই বন্ধ, খবর এল কয়েকদিন ঘরে কমিউনে কোনো খাবার নেই। আমরা চাল, ডাল, চিঁড়ে, গুড় জোগাড় করে দিয়ে এলাম সেখানে। রাস্তায় বেরোনো তখন এক নারকীয় অভিজ্ঞতা। পার্ক সার্কাস দিয়ে যেতাম, দেখতাম, চতুর্দিকে মৃতদেহের ছড়াছড়ি। মৃতদেহ পড়ে থাকছে, সরানোর লোক নেই। বৃষ্টির জলে ফুলে, পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চতুর্দিকে। মুখ ঘুরিয়ে, নাকে রুমাল চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছে লোকে। সৎকার দূরে থাক, মৃতদেহ সরানোর ব্যবস্থাও নেই তখন আমহার্স্ট স্ট্রিট আর মির্জাপুর স্ট্রিটের পশ্চিম দিকটা হিন্দু এলাকা, পূরবী সিনেমা পর্যন্ত নো ম্যান’স ল্যান্ড। তারপর দপ্তরিপাড়া ছাড়িয়ে সার্কুলার রোড পর্যন্ত মুসলিম এলাকা। নিজের চোখে দেখেছি, দপ্তরিপাড়া থেকে এক একটা করে হিন্দুর মাথা কেটে বর্ণায় গেঁথে উঁচু করে তুলে দেখাচ্ছে। আর তারপরেই হিন্দু পাড়া থেকে মুসলমানের মাথা কেটে বর্ণায় গেঁথে উঁচু করে দেখানো হচ্ছে। একের পর এক। মানুষের প্রাণের, মনুষ্যত্বের কোনো মূল্য নেই তখন। পাঁঠা গোপাল, জগা বোস, এরাই সব তখন হিরো।

পুলিশ বাহিনী

কলকাতা পুলিশের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ আধিকারিক পুলিশ কাহিনী প্রসিদ্ধ লেখক পঞ্চানন ঘোষালের বর্ণনায় :

…লিগ নেতারা সভাস্থলে উত্তেজনা সঞ্চার করে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘যাও, আপনা আপনা মহল্লা বাঁচাও। হিন্দুলোগ শুরু কর দিয়া।’ গুণ্ডাদের পারিবারিক প্রীতি অল্প, বরং লুটপাটের দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি। ইঙ্গিত ও নির্দেশ পেয়ে তারা পথের দুধারে দোকানগুলো লুট করে আগুন ধরিয়ে এগিয়ে চলল। রাতের অন্ধকারে মহাদাঙ্গা ওরাই শুরু করে দিল। কমলালয় প্রভৃতি বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলি লুটের পর চৌরঙ্গীর বন্দুকের দোকানগুলির দুয়ার ভাঙার খটখট শব্দ আর লুটেরাদের সহর্ষ উল্লাসধ্বনি। ভয়ার্ত নরনারী থানায় ফোন করলে তাদেরকে লালবাজার কন্ট্রোলরুমে যোগাযোগ করতে বলা হয়। কলিকাতা নিধন- যজ্ঞে যে বর্বরতা হয়েছিল, তা দিল্লিতে নাদিরশাহী হত্যাকাণ্ডকেও লজ্জা দেয়। সুপরিকল্পিতভাবে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হল। এ অবস্থায় নিয়মশৃঙ্খলার অজুহাতে আমরা তিনজন কিন্তু নীরব থাকতে পারিনি।

আমি, হীরেন্দ্রনাথ সরকার ও সত্যেন্দ্র মুখার্জি… ঠিক করলাম কর্তৃপক্ষের আদেশ না থাকলেও ইউনিফর্ম ও সার্ভিস ওয়েপন নিয়ে রাউন্ড ডিউটি করব। কিছু বাস যোগাড় করে আমরা কাজে নেমে পড়লাম। এরপর দিনরাত হিন্দু এলাকা হতে মুসলিমদের এবং মুসলিমদের এলাকা হতে হিন্দুদের উদ্ধার করে স্থানান্তরিত করেছিলাম।

পথেঘাটে তখন উভয় সম্প্রদায়ের সংখ্যাহীন মৃতদেহ। কাউকে অস্ত্রাঘাতে কাউকে ঠেঙিয়ে মারা হয়েছে। পথ এমন অবরুদ্ধ যে গাড়ি থেকে নেমে মৃতদেহগুলি দুপাশে সরিয়ে তবে এগোনো যায়।… চাঁদনি মার্কেটের ঘাঁটি হতে মুসলিম গুণ্ডারা অতর্কিতে বার হয়ে পথচারী হিন্দুদের ছুরিকাঘাত করে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পথচারীগণ ছুরিকাঘাত সত্ত্বেও যারা জীবিত তাদের হাসপাতালে বহন করছে। প্রতি ঘটনার পর ত্বরিৎ-গতিতে ঘাঁটিতে ফিরে আততায়ীরা চিৎকার করে উঠছিল : ‘লঢ়ি তগদীর লঢ়ি তগদীর’। তবে ওরা ভুল করে বেশি বাঙালি মুসলমানদেরই ছুরিকাঘাত করছিল। বেশভূষায় বাঙালি মুসলমান নাকি হিন্দু চেনার ক্ষমতা ওদের ছিল না।

এর ঠিক উলটোদিকের গলির পার্শ্ববর্তী খাটালটি দেহাতীদের একটা ঘাঁটি। কর্পোরেশন স্ট্রিট হতে একজনকে ধরে সেখানে পুরে তারা চীৎকার করছিল— ‘বজরঙবলী কি জয়! ‘ খানিকক্ষণ পর ধপাধপ শব্দের পর নীরবতা। তারপর একটি করে মৃতদেহ ধর্মতলা স্ট্রিটে ফেলে দিয়ে তারা স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছিল।… সুবোধ সাহা নামে এক ব্যক্তি ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একজন তার পেটে ছুরি মেরে পিছিয়ে দাঁড়াল। ভদ্রলোকের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে পড়ে। তিনি দুহাতে নাড়িভুঁড়ি সামলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর আততায়ী তাই দেখে পুনরায় ছুরি তুললে আমি গুলি ছুঁড়লাম।… কজন কিশোরের একটি দল ইটের ঘায়ে পড়ে যাওয়া এক প্রৌঢ় ব্যক্তিকে খেঁটে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে জ্ঞানহারা করে ফেলল। ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল, ‘আরে নড়ছে রে নড়ছে।’ তাই শুনে লুঙ্গি ও লাল গেঞ্জি পরা ও কানে বিড়ি গোঁজা এক যুবক এগিয়ে এসে ছুরি বসিয়ে তাকে একেবারে নীরব করে দেয়। কিন্তু লরী হতে নেমে ছুটে ওদের কাউকে ধরতে পারিনি।

অন্যত্র এক জায়গায় দেখি, সমগ্র পরিবারকে ম্যানহোলের মধ্যে পুরে উপরে কর্তাব্যক্তিকে দাঁড় করিয়ে তার গলায় ঢাকনি পরিয়ে গুণ্ডারা নাচছে আর তার গলা একটু একটু করে কাটছে। এক্ষেত্রেও আমি গুলি করে ওদেরকে উদ্ধার করেছিলাম। ওরা বাড়ি ফিরে যাবার পর ওঁদের এক বয়স্কা কন্যাকে ভোগদখলের ইচ্ছায় দুদলে কাড়াকাড়ি করছিল। ঠিক সময়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে আমি রক্ষা করতে পেরেছিলাম।

টেরিটি বাজারের এক মসজিদে হিন্দুদের আশ্রয় দেওয়া হলে কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। কিছু চীনা এসে ওদের উদ্ধার করতে অপারগ হওয়ায় আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। মেঝের ওপর নিহতদের এমন পুরু রক্ত যে আমাদের জুতোর কিছু অংশ তাতে ডুবে যায়।…

১৩৬৪ সালে প্রকাশিত পঞ্চানন ঘোষালের পুলিশ কাহিনী-তে ১৯৪৬-এর দাঙ্গার এরকম বহু ভয়াবহ কাহিনি তাঁর স্মৃতি থেকে রোমন্থিত হয়েছে। প্রতিটি ঘটনাই দাঙ্গার ইতিহাসে অনন্য সংযোজন।

কলকাতা পুলিশ বাহিনীর তৎকালীন আর এক পুলিশ অফিসার সুধাংশু কুমার মজুমদারও কলকাতা দাঙ্গা ১৯৪৬-এর গা শিউরে ওঠা নারকীয় ঘটনাবলি লিখে গিয়েছেন তাঁর স্মৃতি যখন কথা বলে গ্রন্থে। স্বপ্রকাশিত গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালে। পরে ২০২০ সালে গবেষক ও লেখক সৌম্য বসু তাঁর সম্পাদিত এবং খড়ি প্রকাশনী প্রকাশিত দাঙ্গা থেকে দেশভাগ হিন্দু বাঙালির প্রতিক্রিয়া গ্রন্থে শ্রীমজুমদারের বিবৃতি সংকলিত করেন সবিস্তারে। আমি কিছু নির্দিষ্ট অংশ চয়ন করে এই গ্রন্থে সংযোজিত করছি। উল্লেখ্য, ‘৪৬-এর দাঙ্গা চলাকালীন শ্রীমজুমদার এন্টালি থানায় দ্বিতীয় অফিসার পদের দায়িত্বে ছিলেন।

…মুচিপাড়া থানার ওসি সিরাজুল হক বউবাজার স্ট্রিটে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে ডাক্তার বগলা বাবুর চেম্বারে যাইতেছিলেন তখন তাকে গুলি করিয়া হত্যা ও জখম করে। এবং নানা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা আরম্ভ করে। একদিন সকালে একদল পাঠান সশস্ত্র পুলিশ কিছু গোরুকে কাটার উদ্দেশ্যে Entally Slaughter House-এর দিকে escort করিয়া লইয়া যাইতেছিল, তখন এন্টালি এলাকার রাস্তার দুই পার্শ্বের হিন্দুদের বাড়িতে এলোপাথারি ১০২ রাউন্ড গুলি চালায়, তাহাতে অনেক হিন্দু জখম হয়।…

রাজপথে পচতে থাকা মৃতদেহগুলির ঠাঁই হল কর্পোরেশনের জঞ্জাল ফেলার গাড়িতে। ছবি সৌজন্য : ‘লাইফ’ পত্রিকা

রাজপথে পচতে থাকা মৃতদেহগুলির ঠাঁই হল কর্পোরেশনের জঞ্জাল ফেলার গাড়িতে। ছবি সৌজন্য : ‘লাইফ’ পত্রিকা

সংবাদপত্রের ভূমিকা: নিন্দিত মুসলিম লিগ

১৬ অগাস্ট থেকে টানা প্রায় একসপ্তাহ কলকাতা শহরের স্বাভাবিক নাগরিক জীবনের সম্পূর্ণ ছন্দপতন ঘটেছিল। আমরা আগেই সাংবাদিক শংকর ঘোষের লেখায় পড়েছি, সংবাদপত্র প্রকাশিত হলেও দাঙ্গার দিনগুলিতে সংবাদপত্র পাড়ায় পাড়ায় বিলিবণ্টন করা শহরের অধিকাংশ অঞ্চলেই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তার কারণ মুসলমান পাড়ায় হিন্দুরা ঢুকতে পারছিল না, হিন্দু পাড়ায় মুসলমানরা ঢুকতে পারছিল না। এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে বড়ো সংবাদপত্রগুলি প্রকাশিত হত অত্যন্ত কম সংখ্যায়। সেই কম সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলিতে দাঙ্গার ছবি ফুটে উঠেছিল কীভাবে তার কিছু নমুনা আমরা এখানে সংযোজন করব।

যেমন The Statesman পত্রিকায় ১৮ অগাস্টের সংখ্যায় প্রকাশিত দাঙ্গা সম্পর্কিত রিপোর্টে বলা হয়েছিল— ১৬ ও ১৭ অগাস্টে শহরে দুই সম্প্রদায়ের মোট ২৭০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, আহতের সংখ্যা ছিল ১৬০০। শুক্রবার ১৬ অগাস্ট মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাকে সাড়া দিয়ে দাঙ্গায় অংশ নিয়েছিল মুসলমান দাঙ্গাবাজরা। অসংখ্য মানুষকে ছুরিকাহত করা হয়েছিল, লুঠতরাজ হয়েছিল ব্যাপক। হিন্দু সম্পত্তির বিপুল ক্ষতিসাধন করেছিল মুসলিম দাঙ্গাকারীরা। দু-দিন শহরে আইনের শাসন বলে কিছু ছিল না। বদলে দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণ জারি ছিল। ১৭ তারিখ রাত ৯টায় সরকার কারফিউ জারি করে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত। সেদিন থেকেই কার্যত রাস্তাঘাটে পুলিশ পেট্রোল চোখে পড়ে। পুলিশ কোথাও কোথাও গুলি করে, টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটায়। গোটা শহর জুড়ে ছোটো, বড়ো প্রায় ৯০০ অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বহু জায়গায় আগুন নেভাতে দমকল বাহিনীকে বাধা দেওয়া হয়েছিল দাঙ্গাকারীদের তরফে। আগুনে ভস্মীভূত হয় উত্তর কলকাতার একটি সংবাদপত্র অফিস এবং বেশ কিছু বস্তি। সশস্ত্র আক্রমণ হয় দ্য স্টেটসম্যান-এর অফিসেও। আশেপাশের বেশ কিছু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, দাঙ্গা চলাকালীন দ্য স্টেটসম্যান, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড এবং অমৃতবাজার পত্রিকা চরম অসুবিধার মধ্যেও দাঙ্গার দিনগুলোতে একদিনও কাগজের প্রকাশনা বন্ধ করেনি। এই জনপ্রিয় সংবাদপত্রেই ২২ অগাস্ট দাবি করা হয়েছিল, The riotings appalling results- the slaughter or wounding of anything upto 15,000 people… রিপোর্টে একথাও প্রকাশ করা হয়েছিল— দাঙ্গার প্রথম দিনেই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক এক কোটি টাকা।

১৮ অগাস্টই Calcutta Ordeal নামে একটি সম্পাদকীয়তে The Statesman মন্তব্য করেছিল:

From early on Friday there was violence in the streets, which increased rapidly in the early afternoon as processions made their way to the big demonstrations on the maidan. Ruffians in the crowd armed with Lathis knocked pedestrians and bystanders about, bands of ruffians ran about the city in lorries… and smashed up property.

The Statesman পত্রিকার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল— দাঙ্গার সূত্রপাত করেছিল মুসলমানরাই। আক্রান্ত হয়েছিল বাঙালি এবং অবাঙালি হিন্দুরা। ওই সম্পাদকীয়তেই লেখা হয়েছিল:

The full story of what happened can not be told yet. …Direct Action day has given the city two days of horror. Violence was feared, though not on so unrestrained a scale, when the Government decided on action that was certain to produce inflammatory language and communal clashes in the streets. There was however some assurance from those arranging the demonstration that it would be peaceful and orderly, though when a holiday was announced and explained as a precaution against clashes in the streets that might lead to larger disturbances it was obvious that Ministers themselves were dubious. That being so, it was incumbent on them to take precautions against a breakdown of civic order.

২০ অগাস্টে The Statesman পত্রিকার সম্পাদকীয়র ভাষা ছিল আরও তীক্ষ্ণ যেটির প্রতিটি শব্দে ঝরে পড়েছিল মুসলিম লিগের দাঙ্গাবাজদের প্রতি ঘৃণার পাহাড় :

This is not a riot. It needs a world found in mediaeval history, a fury. Yet ‘fury’ sounds spontaneous to set this fury on its way. The horde who ran about battering and killing with 8 ft lathis may have found them lying about or brought them out of their own pockets, but that is hard to believe we have already commented on the bands who found it easy to petrol and vehicles when no others were permitted on the streets. It is not a mere supposition that men were imported into Calcutta to help making an impression.

মন্তব্য করা হয়েছিল— এই ঘটনার পর মুসলিম লিগের প্রতি ঘৃণা আর অভিযোগ ছুড়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার থাকল না। বিভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দাদের কাছে মুসলিম লিগ ধারাবাহিকভাবে ভয় ও ঘৃণার পাত্র হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

দাঙ্গার দিনগুলোতে হিংসা কতখানি অমানবিক পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার পরিচয় দিয়েছিল অমৃতবাজার পত্রিকা-র ৩০ অগাস্টের একটি রিপোর্ট—

কসাইখানার যূপকাষ্ঠের সামনে শিকারকে হাঁটু ভাঁজ করে বসিয়ে দেওয়া হল। বারংবার সে তার প্রাণভিক্ষা চাইল। দয়া ভিক্ষা করল। কিন্তু কসাইদের কাছে অনেক বেশি সহজলভ্য ছিল লোকটির অপমানে ঝুঁকে পড়া নির্দোষ মাথাটা। ধারালো অস্ত্রের এক কোপে সেই মাথাটা ছিন্ন হয়ে গেল। ধরে আনা হল আর একজনকে। তার এক পায়ের গোড়ালিতে বাঁধা গোরুর দড়ি। সেটা শক্ত করে ধরে রেখেছে এক দাঙ্গাবাজ। অন্যরা ক্রমাগত তার পিঠের ওপর আছড়ে ফেলছে তাদের হাতের লাঠি। একটু পরেই দড়িটা আলগা করে দেওয়া হল। মুক্তি পেয়েছে ভেবে সে দৌড় লাগাতেই ফের টান পড়ল দড়িতে। লোকটা আছড়ে পড়ল মাটিতে। তারপর… এক আঘাতেই ছিন্ন হয়ে গেল তার মাথা।

মুসলিম লিগের প্রতি তীব্র ধিক্কার ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছিল Hindustan Standard পত্রিকায়। ১৬ অগাস্টের সম্পাদকীয়তে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল :

…nationalist Bengal be they Hindu or Muslim are opposed on principle to the mandate of the League. With them the issue is vital one. They cannot and will not participate in a demonstration the object of which is the repudiation of all their cherished political principles. Millions of such Nationalists all over Bengal claims protection from the government against coercion to which they are likely to be subjected by the overzealous followers of the League…

এই রচনার প্রথম অধ্যায়টি আমরা শুরু করেছিলাম আমেরিকার বিখ্যাত লাইফ (Life) পত্রিকার বিশ্বখ্যাত ফোটোগ্রাফার শ্রীমতী মার্গারেট ব্যুরকে হোয়াইট ওরফে ম্যাগীর কলকাতার রাজপথে ‘৪৬-এর দাঙ্গার শিকারদের রাজপথ-শয্যার ছবি তোলার দৃশ্য দিয়ে। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে প্রকাশিত লাইফ পত্রিকার তাঁর তোলা সেইসব ভয়ংকর দৃশ্যের ছবির সঙ্গে লেখা হয়েছিল :

In the streets of Calcutta for four days last month Hindus and Muslims clashed in savage rioting. The riot subsided, leaving the sun-leaked streets littered with dead and dying. For a while the streets were quiet.

Then the vultures came down. In India they are not unaccustomed to the taste of human flesh, for the Parsis leave their corpses unburied on ceremonial towers where carrion birds may eat them. Attracted by sight rather than by smell, the vultures swooped down into the death-filled streets of Calcutta. Clacking their curved beaks, beating their enormous, wings to keep balance, the birds tore at the dead.

লাইফ পত্রিকার পাতার পর পাতা জোড়া অনবদ্য অথচ আতঙ্ক ধরানো ছবির পাশাপাশি লেখা হয়েছিল—

মার্গারেট সেদিন কলকাতার আপার চিৎপুর রোডে পা রেখেছিলেন, যে রাস্তার ওপর ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছিল। সেখানে তিনি ছবি তুলেছিলেন সেইসব উৎকট ও অসহ্য দৃশ্যের যেখানে হিন্দু ও মুসলিম মৃতদেহগুলি পড়ে আছে পাশাপাশি। চরমতম গ্রীষ্মের তীব্র গরমে সেগুলির সৎকার হচ্ছে রাজপথেই ওরা (শকুনিরা) উড়ে বেড়াচ্ছে মাথার ওপর অনতিউচ্চতায় আর মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে আশেপাশের বাড়ির ছাদে, কার্নিশে। ওদের অনেকেই তখনও ক্ষুধার্ত। সৎকারের জন্য মৃতদেহ বহনকারীরা হেঁটে যাচ্ছে রক্তস্নাত সেই পথ ধরে খালি পায়ে শকুনের দলকে তাড়াতে তাড়াতে।

পত্রিকায় দাবি করা হয়েছিল— ‘৪৬-এর দাঙ্গায় কলকাতায় মৃত্যু হয়েছিল ৭০০০ মানুষের। আহতর সংখ্যা ছিল ২০০০০। আর মন্তব্য করা হয়েছিল— ‘All this was a symbolic segment of the current struggle between Hindus and Muslims over the future of the government of the independent India that is now approaching its birth.’ Modern Review পত্রিকা এই দাঙ্গার বিস্তারিত ভয়ার্ত চিত্র তুলে ধরেছিল ‘৪৬-এর সেপ্টেম্বর সংখ্যায়।

‘Fiery speeches were delivered inciting the listeners to a frenzy and a Jehad (holy war) was declared on the (Hindu) infidels. The vast gathering split into large mobs uttering frenzied hands and brandishing their weapons. These then streamed into the main thoroughfares breaking open Hindu shops and murderously assaulting the poor unfortunate Hindus they could find. The arrangements were perfect for the programme of loot, arson, rape and murder and trunk-loads of goondas armed with dangerous weapons and incediary materials were rapidly sent to the more distinct parts to reinforce the local hooligans. Soon the city was ablaze from North to South and from East to West. The telephone wires were jammed with frontic appeals for police-aid from Hindus of all sections of the city, but these appeals were disregarded into toto…’

বিরল ন্যায়বাদী এবং সাহসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা Modern Review সেযুগে অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি পত্রিকা হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই পত্রিকায় লেখা হয়েছিল—

The situation soon became precarious for the Hindus all over Calcutta. The entire city was at the tender mercies of tens of thousands of gangsters who had been imported to reinforce them. Further they seemed immune from the action of Law, for the police had so far been mostly lookers-on.

লালবাজারে বিরিয়ানি হাতে সুরাবর্দি

ইতিহাসে আর কখনো কি এমনটা দেখা গেছে যে, একটা শহরের একটি সম্প্রদায়ের মানুষকে মারছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে আর এক সম্প্রদায়ের মানুষ, কিন্তু সেই শহরেই পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বসে সেই রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী সকাল থেকে বিফ বিরিয়ানি গলাধঃকরণ করতে করতে পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘ফোন আসতে দিন। কাফেরদের গলা চিরে যাক। আপনারা কেউ রাস্তায় নামবেন না।’ না, সেনাবাহিনীকেও নির্দেশ দেননি, দাঙ্গা রুখুন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না হিন্দুরা মার খেতে খেতে রক্তঝরা শরীরে পথে নেমেছে পালটা মার দিতে। না, মানবিক ইতিহাসে এ ঘটনা নাদির শা বর্গি আক্রমণ আর মোঘল সম্রাটদের কেউ কেউ রেখে গেছেন ঠিকই। কিন্তু, সে ছিল রাজতন্ত্রের দিন। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় বিশেষ করে ইংরেজ প্রশাসকদের মতো তাবড় প্রশাসকদের আমলে এমন ইতিহাস খুঁজে পেতে হন্যে হতে হবে।

কলকাতার ‘৪৬-এর দাঙ্গার ওপর অত্যন্ত সঠিকভাবেই The Statesman একটা সিলমোহর এঁটে দিয়েছিল— ‘The Great Calcutta Killing। ‘ আর সেই কিলিং-এর মাস্টারমাইন্ডই শুধু নয়, সম্পূর্ণ পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন হোসেইন সুরাবর্দি, সেকথা লেখা হয়েছে সেই সময়ের পত্রপত্রিকার ছত্রে ছত্রে। এমনকী সমস্ত গবেষকের গবেষণাপত্রেও।

ময়দানের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে এই সুরাবর্দিই সমবেত মুসলমান জনগণকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “তোমাদের ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হল। যা করার করে নাও।’ আর, তার আগে থেকেই নেতাদের বক্তৃতা, হাজারো লিফলেট, পুস্তিকা, প্রচারপত্রর মাধ্যমে প্রায় একমাস ধরে শহরের মুসলমানদের উসকানি দেওয়া হয়েছে, কাফেরদের অস্তিত্বই বিনষ্ট করে দেওয়ার জন্য। অতএব, মুসলমানরা তৈরিই ছিল। তাই ১৬ অগাস্ট সকাল থেকেই হিন্দু নিধন শুরু হয়ে গিয়েছিল। অথচ, গোটা শহরে একটাও পুলিশের গাড়ি, লরি ভরতি পুলিশ ফোর্স কিংবা আপৎকালীন পরিষেবার কোনো চিহ্নই দেখা যায়নি। আক্রমণের তীব্রতা বাড়ে দুপুর তিনটের পর যখন সভা থেকে সমবেত সশস্ত্র মুসলিম বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়— ‘এবার তোমরা ফিরে যাও।’

ফিরেছিলেন মুসলমানরা। কিন্তু শহরে হিন্দুদের দোকান, হাট-বাজার, হিন্দু বাড়িতে খুন, ধর্ষণ, লুঠতরাজ এবং শেষপর্যন্ত আগুনের লেলিহান অগ্নিশিখায় সব ধ্বংস করতে করতে। প্রতিটি মুসলিম হাঙ্গামাকারীর হাতে ছিল হ্যারিকেন বোঝাই কেরোসিন তেল, পেট্রোল। এইসব জ্বালানি তাদের কিনতে হয়নি। মহানুভব প্রশাসক সুরাবর্দির অনবদ্য ইসলামিক বদান্যতায় মুসলিম মহল্লায় মহল্লায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল কুপন; যে কুপন দেখালেই বিনামূল্যে মিলছিল কেরোসিন আর পেট্রোল শহরের পেট্রোল পাম্পগুলি থেকে। হাজার হাজার লিটার জ্বালানির দাম দিয়ে রেখেছিল সরকার।

শুধু তাই নয়, প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন সরকারিভাবে ছুটির দিন ঘোষণা করায় আক্রমণের তীব্রতা তুঙ্গে উঠেছিল। কারণ, ছুটির দিনে হিন্দুরা যখন হালকা মেজাজে দিন কাটাচ্ছে, তখন ছুটির মেজাজে মুসলমানরা নেমে পড়েছিল ভোজালি, ছুরি, তরোয়াল, মশাল হাতে হিন্দু নিধনে। এই ছুটি ঘোষণা করাটাও ছিল সুরাবর্দির মস্তিষ্কপ্রসূত।

হিন্দু নিধন, হিন্দু গৃহবধূ ও যুবতী ধর্ষণ, হিন্দু শিশুদের আছড়ে অথবা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে তারপর তীক্ষ্ণ বর্ণায় গিঁথে ফেলার মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ড যখন চূড়ান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, তখন গভর্নর লর্ড ওয়াভেল সুরাবর্দিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, এবার দাঙ্গা যাতে না ছড়ায় তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী নামাতে হবে। বিখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক নিকোলাস মানসার্য (Nicholas Mansergh) সম্পাদিত Constitutional Relations between Britain and India: The Transfer of Power 1942-47 গ্রন্থে আর্চিবল্ড ওয়াভেলের উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়াভেল বলেছিলেন: ‘The atmosphere was admittedly explosive and we realised and I impressed it on my CM and his colleagues – that they were playing with fire. কিন্তু, তারপরেও সুরাবর্দি লালবাজার কন্ট্রোল রুমে বসে ‘মজা’ উপভোগ করেছেন। পুলিশ কমিশনার ডি আর হার্ডউইকের হাত-পাও বেঁধে রেখেছিলেন সুরাবর্দি নিজেই কন্ট্রোল রুমের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। অধ্যাপক সুরঞ্জন দাসের Communal Riots in Bengal 1905-1947 শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে (পৃষ্ঠা 177-179) লেখা হয়েছে, ১৬ অগাস্টের আগেই মুসলিম লিগ নেতা নাজিমুদ্দিন সদর্পে বলেছিলেন, “There are 150 different ways to cause trouble particularly as the Muslim League is not restricted to non-violence.’ আর, মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দি স্বয়ং কী বলেছিলেন? দাঙ্গা শুরুর ঠিক একসপ্তাহ আগে সুরাবর্দি দিল্লিতে বসে নিউ ইয়র্কের ইনস্টিটিউট অফ কারেন্ট ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স (Institute of Current World Affairs)-এর সাংবাদিক ফিলিপস ট্যালবট (Phillips Talbot)-কে বলেছিলেন: ‘It would be hard to prevent any disturbance in Calcutta on the Direct Action Day.’ গবেষণাপত্রেই লেখা হয়েছে— সরকারি তত্ত্বাবধানেই যে দাঙ্গা পরিচালিত হয়েছিল, তার অন্যতম প্রমাণ ছিল বাংলা সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের একটি রিপোর্ট। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মিছিলকারীদের একটা অংশকে কলকাতা কর্পোরেশনের গাড়ি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। হাঙ্গামা হতে পারে জেনে শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স মজুত রাখা হয়েছিল। এমনকী সুরাবর্দির নিজের গাড়িতেও মিছিলকারীদের জন্য খাবার, ছোরাছুরি এমনকী পেট্রোল ও কেরোসিনও বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ময়দানের সভায়। বাংলা সরকারের একটি গোপন নোটে বলা হয়েছিল : … the police did not interfere when crime was being committed in their presence.’ [Source: Home (Pol. ) Top Secret File No. 390/46]

প্রথম আক্রমণটা যে মুসলমানরাই করেছিল তা তৎকালীন সময়ের ইতিহাস ও গবেষণাপত্রের প্রায় সবক-টাতেই সেকথা লেখা হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর সচিব শ্রীনির্মলকুমার বসু তাঁর My Days with Gandhi বইতে লিখেছেন: ‘The offensive began from the side of Muslim mobs; but within a few hours the Hindus … also struck back.’ সেই প্রতি-আক্রমণের ঘটনার কিছু তথ্য আগেই বলা হয়েছে। আবারও সবিস্তার বলা হবে প্রতি-আক্রমণের কথা। কিন্তু, দায়ী যে ছিল মুসলিমরাই এবং মুসলিম লিগ এবং স্বয়ং সুরাবর্দির মদতে তা লিখে গেছেন Resurgence of Tribal Savagery in Calcutta গ্রন্থের লেখক সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মানসাঘও বলে গেছেন— ১৬ অগাস্ট সকাল থেকে মুসলমানরাই ছিল আক্রমণাত্মক মেজাজে [সূত্র : The Transfer of Power vol. VIII Page 240, 295-96]

মুসলিম গ্রন্থকারের নব কথামালা

যদিও পরবর্তীকালে মুসলমান গ্রন্থকাররা পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত কিছু গ্রন্থে ঠিক উলটো কথাই লিখেছেন এবং লেখকরা স্বভাবসিদ্ধভাবেই অপরাধী হোসেইন শাহিদ সুরাবর্দির সমর্থনেই পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনই একটি গ্রন্থ ড. মুহম্মদ আবদুর রহিমের বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস। প্রকাশক : আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা। এই বইতে দাবি করা হয়েছে, ‘৪৬-এর দাঙ্গায় মুসলমানরাই দাঙ্গার সূত্রপাত করেছিল যা একেবারেই ভুল তথ্য। তার চেয়ে নির্ভেজাল অসত্য তথ্য লেখা হয়েছে ঢাকার বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার প্রকাশিত বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থে। লেখক : আব্বাস আলি খান। ২০১১-র জুনে সপ্তম প্রকাশ। এই গ্রন্থে আগাগোড়া বাংলা ইতিহাসে ‘হিন্দুদের চরম মুসলিম বিদ্বেষ’কেই তুলে ধরা হয়েছে। গ্রন্থের ৩৯৫ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে :

হিন্দু মুসলিম মিলন তো দূরের কথা, হিন্দুদের চরম মুসলিম- বিদ্বেষের কারণে ১৯২০ সাল থেকে সাত আট বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সারা দেশ জর্জরিত হয়। ১৯২৩ সালে ১১টি, ১৯২৪ সালে ১৮টি, ১৯২৫ সালে ১৬টি, ১৯২৬ সালে ৩৫টি এবং ১৯২৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩১টি বিরাট দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। ফোর্টনাইটলি রিভিউতে (Fortnightly Review) তে জনৈক ইংরাজ লেখেন, হিন্দু ও মুসলমানের মিলন পৃথিবীর আরও অনেক অসম্ভব জিনিসের মতো একটা অসম্ভব ব্যাপার। এশিয়াটিক রিভিউ পত্রিকায় জনৈক প্যাট্রিক ফ্যাগান লেখেন, পরাধীন ভারতের মুসলমানদের দুটি পথ খোলা আছে— হয় হিন্দু জাতিতে লীন হয়ে যাওয়া, না হয় দৈহিক শক্তিবলে ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েম করা। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ : সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদুদ-২৮৬)

‘ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা কোনো বছরই বন্ধ থাকেনি। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতে এসব দাঙ্গা সংগঠিত হয়। একথা সত্য যে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় এসব দাঙ্গার উদ্যোক্তা এবং তারাই মূলতঃ দায়ী।’

গোটা বিশ্বের প্রায় সমস্ত ইতিহাস গ্রন্থ এবং গবেষণাগ্রন্থে যখন লেখা হয়েছে, দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছিলেন মুসলিম লিগ নেতারাই এবং তাতেই প্রভাবিত হয়ে মুসলমানরাই প্রথম আক্রমণ করেছিল, তখন বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের পূর্ববঙ্গীয় লেখক আব্বাস আলি খান একমাত্র ছত্রে ছত্রে অবিশ্বাস্য ‘সত্যকাহিনি’ রচনা করেছেন। এই গ্রন্থে তাঁর লেখা দাঙ্গার বিবরণ পুরোটাই এখানে তুলে ধরছি। পড়লেই পাঠকরা বুঝতে পারবেন— ইতিহাসকে বিকৃত করার এক বিকৃত মানসিকতা থেকেই এই ইতিহাস লেখক এক নব ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন—

১৬ অগাস্টের কদিন পূর্ব থেকেই এ মিথ্যা গুজব ছড়াল যে মুসলিম লিগ নেতা তথা কলকাতার মুসলমানগণ হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালাবে এবং তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করবে। এ গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল যেন হিন্দুগণ কলকাতার শতকরা প্রায় পঁচিশ ভাগ মুসলমান নির্মূল করার জন্য তৈরি হয়।

আমি ক্ষেত্র গ্রন্থকার। সে সময়ে সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত থাকলেও পাকিস্তান আন্দোলন মনে প্রাণে সমর্থন করতাম। মুসলিম লিগ মহলের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলতাম। ১৬ই অগাস্ট মুসলমানদের পক্ষ থেকে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানো হবে এরূপ কোনো পরিকল্পনার বিন্দুবিসর্গও কানে আসেনি। আমি তখন ফ্যামিলিসহ কলকাতায় থাকতাম, বাসায় আমার সাথে আমার স্ত্রী ও চার বছরের কন্যা মাত্র। গোলযোগের কোনো আশঙ্কা থাকলে তাদেরকে একাকী ফেলে ১৬ অগাস্টে মুসলিম লিগের জনসভায় নিশ্চিন্ত মনে কিছুতেই যেতে পারতাম না।

গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় আমার মতো অনেকেই যোগদান করেন। আমরা জনসভায় উপস্থিত হয়ে দেখলাম রাজা গজনফর আলি খান ইংরেজিতে বক্তৃতা করছেন।

মুসলিম লিগ কর্মীদের হাতে কোনো অস্ত্র তো দূরের কথা, কোনো লাঠিসোঁটাও দেখতে পাইনি। তবে পাকিস্তান লাভের আশায় সকলকে হর্ষোৎফুল্ল ও উজ্জীবিত দেখতে পেয়েছিলাম।

রাজা সাহেবের পর সোহরাওয়ার্দী সাহেব মঞ্চে ওঠার পর মুসলিম লিগ মিছিলের এবং জনসভায় আগমনকারীদের উপর হিন্দুদের সশস্ত্র আক্রমণের সংবাদ আসতে থাকল। অতঃপর আক্রান্ত মুসলমানদের অনেকেই রক্তমাখা জামাকাপড় নিয়ে সভায় হাজির হয়ে হিন্দুদের সশস্ত্র হামলার বিবরণ দিতে লাগল। শ্রোতাদের হর্ষ বিষাদে পরিণত হল। ভয়ানক উত্তেজনা, ভীতি ও আশঙ্কা বাড়তে থাকল। কলকাতায় শতকরা বিশ থেকে পঁচিশ ভাগ মুসলমান। প্রায় সকলেই দরিদ্র। তাদের শতকরা প্রায় পাঁচ ভাগ বহিরাগত। বিভিন্ন স্থানে চাকরি করে।

জনসভায় যোগদানকারীগণ কিভাবে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাবে, তাদের অরক্ষিত পরিবারের অবস্থাই বা কি— এমন একটা আশঙ্কা সকলের চোখেমুখে দৃশ্যমান হয়ে উঠল। প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারলেন। তাঁর বক্তৃতার কোনো কথাই আমার মনে নেই। তবে জনতাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ‘হাম সব দেখ লেংগে’— বলে সকলকে শৃঙ্খলার সাথে ঘরে ফিরে যেতে বললেন। আমরা কোনোরকমে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে বাসায় ফিরলাম। কলকাতার মুসলিম পল্লি পার্কসার্কাসে থাকতাম বলে বেঁচে গিয়েছি, নতুবা হিন্দুদের আক্রমণের শিকার অবশ্যই হতে হত।

এ লোমহর্ষক ঘটনা সম্পর্কে তৎকালীন কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান (Statesman) পত্রিকার সম্পাদক Ian Stephens বলেন— ‘স্বভাবতঃ প্রথম দিনের মারামারিতে এবং নিশ্চিতরূপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে মুসলমানদের জানমালের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়।

( Ian Stephens, Pakistan, London, Erhest Bena 1963, p 106: Choudhury Mahammed Ali – The Emergence of Pakistan, p 76).

এসব ঘটনার দ্বারা একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে ১৬ অগাস্ট হিন্দুদের উপর আক্রমণ করার কোনো পরিকল্পনা মুসলিম লিগের ছিল না। বরঞ্চ লিগের ডাইরেক্ট অ্যাকশনকে নিজেদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য কংগ্রেস মুসলিম নিধনের নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরি করে। তবে এর সুফল হয়েছে মুসলমানদের জন্যে। পাকিস্তান সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়েছে— যার সম্ভাবনা কিছুটা ক্ষীণ হয়েছিল কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবের পর। জিন্নাহ খোলাখুলি ও অকপটে কলকাতার নৃশংস ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন এবং নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

…১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্টে অনুষ্ঠিত নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা ছিল তুলনাবিহীন। কলকাতার মুসলমানদের নির্মূল করার এক সুচিন্তিত পরিকল্পনার অধীনে এ হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছিল। (পৃষ্ঠা ৪৬৮-৪৬৯)।

বর্তমান গ্রন্থটি রচনাকালে নানাবিধ সূত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে এই গ্রন্থটি আমার নজরে আসে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল— বইটির অগ্রভাগে ‘গ্রন্থকারের কথা’য় গ্রন্থকার নিজেই দাবি করেছেন— ‘ইতিহাসের কোথাও কণামাত্র কল্পনা, স্বকপোলকল্পিত অথবা অতিরঞ্জিত উক্তি করিনি। অনেকের কাছে তিক্ত হতে পারে, কিন্তু আগাগোড়া সত্য ঘটনাই লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।’

যেকোনো ইতিহাসে প্রমাণসাপেক্ষ তথ্য ছাড়া সে-ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না। এক্ষেত্রে লেখক আব্বাস আলি খান হিন্দু আক্রমণের তীব্রতায় কলকাতা শহরের কোথায় কত মুসলিম আক্রান্ত হয়েছিলেন, অন্তত কয়েক জনের পরিচয়, মৃত মুসলিমের সরকারি তথ্য, হাসপাতালে ভরতি মুসলিমদের সংখ্যা কিছুই পেশ করেননি। তার চেয়েও জরুরি বিষয়, ইতিহাসকাররা মুসলিম লিগ ও ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত যেসব পুস্তিকা বা প্রচারপত্রের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলিতে ঠিক কী লেখা হয়েছে তা পাতার পর পাতা লেখা হয়েছে, সেগুলির প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন গ্রন্থকার। কোনো ইতিহাসকার বা গবেষকের সরাসরি বিরোধিতাতেও তিনি যাননি।

পুলিশ যখন লুঠেরা

মুসলিম ইতিহাসকারদের এই ইতিহাস কলকাতা দাঙ্গার ইতিহাসে ঠিক যতটাই কলঙ্কিত, তেমনই কলঙ্কিত সুরাবর্দির মদতপুষ্ট কিছু পুলিশের ভূমিকা, মূলত যারা পাকিস্তানপন্থী। যেমন তৎকালীন পুলিশ অফিসার, সুধাংশুকুমার মজুমদার তাঁর স্মৃতিকথা— স্মৃতি যখন কথা বলে-তে তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (হেডকোয়ার্টার) শ্রীদোহার এক চরম কুকীর্তির কথা ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, তালতলা থানা এলাকায় বেশ কয়েকটি সোনা-রুপার দোকান লুঠ করেছিল মুসলিম দাঙ্গাবাজরা। লুণ্ঠিত ওই দোকানগুলির সামনে একটি বিরাট লোহার সিন্দুক পড়ে ছিল যা সম্ভবত লুঠেরারা নিয়ে যেতে পারেননি। শ্রীদোহার নির্দেশে কয়েক জন পুলিশ কর্মচারী ওই সিন্দুকটি বয়ে নিয়ে যান লাউডন স্ট্রিটে শ্রীদোহার বাসভবনে। বহনকারী এক সহকারী সাবইনস্পেকটর রমেন চ্যাটার্জি শ্রীমজুমদারকে জানিয়েছিলেন, সিন্দুকটি ভরা ছিল সোনা ও রুপার গয়নায়। পরে জানা গিয়েছিল, মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত ওই ডেপুটি কমিশনার দোহা সাহেব একবালপুর এলাকায় একটি প্রাসাদোপম বাসভবন তৈরি করেছিলেন। দেশবিভাগের পর সেই বাড়িটি এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীকে মোটা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

শ্রীমজুমদারের আত্মস্মৃতিতে কুকর্ম ফাঁস হয়েছে আরও এক পুলিশ অফিসারের। কলকাতার দাঙ্গার সেইসব ভয়ংকর দিনগুলিতে তিনি ছিলেন মানিকতলা থানার ওসি। আর ঘটনা হল এটাই যে, ১৬ অগাস্ট দাঙ্গার প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল মানিকতলাতেই। শুধু দোকান লুঠপাট নয়, মুসলিম দাঙ্গাবাজদের আক্রমণে একজন ছুরিকাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন।

ওই কট্টরপন্থী মুসলিম ওসি-র মদতেই মানিকতলা, বেলেঘাটা ও চিৎপুর থানার মুসলমানদের আক্রমণ চরম আকার নিয়েছিল। ওই ওসি-র সবচেয়ে বড়ো কুকীর্তি ছিল কলকাতা শহরের অন্যতম দর্শনীয় বাগমারি ভিলা লুঠে উসকানি দেওয়া। যশোহরের জমিদারবাড়ি কলকাতার বাগমারি ভিলার বাসিন্দাদের হত্যা ও আহত করে যথেচ্ছভাবে দামি আসবাবপত্র, শৌখিন সামগ্রী ও ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করে মুসলিম দাঙ্গাবাজরা। লুঠের মালের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, দু-দিন ধরে তা সরাতে হয়েছিল। পুলিশের ওই দাঙ্গাবাজ ওসি নিজে হাত মিলিয়েছিলেন ওই লুঠ ও হত্যায় এবং সবচেয়ে বড়ো দাঁওটিও লুটেছিলেন তিনিই। সোনার গয়নাভরতি একটি টিনের তোরঙ্গ অন্য কাউকে ছুঁতে দেননি। ওই তোরঙ্গ এবং লুঠের প্রচুর মালপত্র নিয়ে তিনি প্রথমে জমা করেন তাঁর কলকাতার কোয়ার্টারে। পরে সব পাঠিয়ে দেন চট্টগ্রামে তাঁর দেশের বাড়িতে। এই কুখ্যাত ওসি-র নাম ছিল ফজলুল করিম চৌধুরি। কট্টর লিগপন্থী। তাঁর ভাই ছিলেন পূর্ববঙ্গের মুসলিম লিগপ্রধান। বাগমারি ভিলায় লুঠতরাজের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিলেন যশোহরের জমিদার পরিবার।

এই ফজলুল করিম চৌধুরিই লালবাজারের হাবিব গুন্ডা, মুরারিপুকুর ও বাগমারির কিছু লিগপন্থী নেতা ও গুন্ডার সঙ্গে পরিকল্পনা করেছিলেন, মানিকতলা থানার কাছেই অবস্থিত নারীকল্যাণ আশ্রম আক্রমণ করা ও হিন্দু নারীদের অপহরণ করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার। সুধাংশু মজুমদার খবরটি আগেভাগে পেয়ে যাওয়ায় তিনি নিজে ৫০০ সশস্ত্র মুসলিম নারীলাঞ্ছনাকারীদের লক্ষ করে গুলি চালান। তার ফলে ৫/৬ জন দাঙ্গাবাজ আহত হয়। এজন্য কলকাতা পুলিশের মুসলমান দাঙ্গাবাজদের সমর্থক পুলিশ বাহিনীর কাছে শ্রীমজুমদার ছিলেন চিহ্নিত শত্রু।

শ্রীমজুমদারের মতোই কলকাতা পুলিশ বাহিনীর বেশ কিছু হিন্দু অফিসার নিজেদের দায়িত্বে সুরাবর্দির নির্দেশ অমান্য করে সেদিন পথে নেমেছিলেন বলে বহু জায়গায় হামলাকারীদের রোখা গিয়েছিল। উদ্ধার হয়েছিল বহু নারী ও শিশু। নিশ্চিত ধর্ষণ এবং মৃত্যু থেকে বেঁচেছিলেন যুবতীরা, নাবালিকারা। প্রাণ বেঁচেছিল বহু হিন্দু পরিবারের। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিলেন— কে ডি গাঙ্গুলি, অমিয় গুপ্ত, হিমাংশু গুপ্ত, দীনেশ চন্দ্র, নীহার বর্দ্ধন, মনমোহন বিশ্বাস, অনিল ঘোষ, রঞ্জিত রায় চৌধুরি, জ্ঞানাকুল চক্রবর্তী, অজয় দে প্রমুখ। এইসব জুনিয়ার অফিসাররা ডেপুটি কমিশনার হীরেন সরকার, অবনী গুপ্ত, রায়বাহাদুর সত্যেন মুখার্জী প্রমুখর পরামর্শে শ্যামপুকুর, জোড়াসাঁকো, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জসহ নানা এলাকায় মুসলিম আক্রমণের পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিয়েছিলেন। শ্রীমজুমদার লিখেছেন :

এসব সাহসী অফিসারদের সেই সাহসিকতার কথা এবং বীরত্বপূর্ণ কাজের কথা কোনোদিন ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় নাই। অন্যথায় কিছু কিছু হিন্দু অফিসার যাহারা মুসলমান লিগের সহযোগিতা করিয়াছিল এবং হিন্দুকে রক্ষা করার পরিপন্থী ছিল, দেশবিভাগের পর তাহারাই Govt-এর প্রিয়ভাজন হইয়াছিল এবং তাহাদের পদের উন্নতি হইয়াছিল।

পুলিশি সতর্কতা প্রশাসনিক উদাসীনতা

তৎকালীন ফাইল সূত্রে লালবাজার থেকে জানা যাচ্ছে, পুলিশের একাংশ ১৫ অগাস্ট থেকেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, ১৬ অগাস্ট গণ্ডগোল হবে। যেমন, এন্টালি থানার এসআইডি মল্লিক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার এ এম গুপ্তাকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন: মুসলমান অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একাধিক সশস্ত্র শোভাযাত্রা বের হবার সম্ভাবনা আছে। আগামীকাল তাই আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। এই শোভাযাত্রাগুলি মনুমেন্টের দিকে এগিয়ে যাবে যেখানে এক জনসভা আহ্বান করা হয়েছে। আমাদের আশঙ্কা এবং অনুমান যে ওইদিন কলকাতার শান্তি বিঘ্নিত হবে।

একইভাবে বেলেঘাটা পুলিশ স্টেশনের এসআই সাকরুল হোসেন থানার অফিসার ইনচার্জকে রিপোর্ট করেছিলেন: ‘১৬ অগাস্ট তারিখে শহর জুড়ে নানা ধরনের অশান্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে। মুসলিম লিগ সমর্থকেরা সেদিন হিন্দুদের দোকানগুলিকে বন্ধ রাখার জন্য জোর করবে। শুধু তাই নয়, যাতে শ্রমিকরা এই বিক্ষোভে যোগ দেয় সেই ব্যাপারেও জোর করা হবে তাই আগামীকালের হরতালের পরিপ্রেক্ষিতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু- মুসলমান সংঘর্ষ এবং শান্তি বিঘ্নের আশঙ্কা করছি।’

মানিকতলা থানার ইনচার্জকেও সাবইনস্পেকটর কবীর চৌধুরী জানিয়েছিলেন, ‘আগামীকাল ১৬ অগাস্ট তারিখে শহরের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে।’

চিৎপুর থানার সাবইনস্পেকটর অবনীচন্দ্র রায়েরও রিপোর্ট ছিল : “যদি ১৬ অগাস্ট ১৯৪৬ তারিখে হিন্দুরা তাঁদের দোকান খোলা রাখেন তাহলে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা আছে।’

[সূত্র: ১৯৪৬, কলকাতা হত্যা এবং নোয়াখালি গণহত্যা: দীনেশচন্দ্র সিনহা, অশোক দাশগুপ্ত ও আশিস চৌধুরি, ভাষান্তর: পৃথ্বীরাজ সেন, প্রকাশক: হিমাংশু মাইতি, কলকাতা 2022/

কিন্তু ইতিহাস বলছে, থানায় থানায় এরকম সংবাদ পুলিশের তরফেই জানানো হলেও, পুলিশ পথে নামেনি দাঙ্গা প্রশমনে। কারণ একটাই— সুরাবর্দি চাননি। আমরা আগেও তথ্য পেশ করেছি, সুরাবর্দি একদিকে যেমন পুলিশকে পথে নামাননি, তেমনি গোটা শহরে হিন্দুদের পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থাও এই ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক চরিত্রটিই করেছিলেন। ১৫ অগাস্ট থেকে ১৮ অগাস্টের মধ্যে কম দামে পেট্রোল কেনার জন্য তাঁরই সই করা কুপন বিলি করা হয়েছিল মুসলমান গুন্ডাদের মধ্যে। মুসলমান মালিকদের লরিগুলিকে দাঙ্গাবাজরা যাতে ব্যবহার করতে পারেন, সে- ব্যবস্থাও তিনিই করেছিলেন। [সূত্র: Husseyn Saheed Suhrawardy : A Biography; Shaista Ikramullah, Karachi, 1991, pg 53]

সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এই মুসলিম দাঙ্গাবাজরা কলকাতা পুলিশের হিন্দু অফিসারদেরও রেহাই দেয়নি। আক্রান্ত হয়েছিল তৎকালীন কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনারের বাড়ি ২১ নম্বর নারকেলডাঙা মেন রোডে। ২০০০-এর বেশি উন্মত্ত মুসলিম ঘিরে রাখে উত্তর কলকাতার ডেপুটি কমিশনার এস এন মুখার্জির বাড়িকে।

হেস্টিংস থানার এসআই নুরুল হুদা ভূঁইয়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, তিনি দেখেছেন, তিনটি বাসে করে মুসলমান জনতা এসেছে ৭নং বেলেঘাটা রোডের একটি মসজিদের পাশের মুসলিম পল্লি থেকে। পরেশনাথ মন্দিরের কাছে হিন্দু বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূর অস্ত, ১৮ অগাস্ট রাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৮ মুসলমান দাগী দুর্বৃত্তকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন সুরাবর্দি। এরা শহরে ঢুকেছিল BLL152 নম্বর লরিতে চেপে। গুন্ডাদের নাম ছিল মহম্মদ ইউনুস, আলি হোসেন, সঈদ গীরজান, মহম্মদ রউফ, কাদির, মাজিদ খান, সাইদ মহম্মদ ইসাক। এদেরই হাতে হাজার হাজার টাকা দিয়ে হিন্দুরা নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন কোথাও কোথাও।

.

যখন এরকম হাজারো সংবাদ শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে আর হিন্দুদের ক্ষোভ যত তীব্র হচ্ছে, ততই মেজাজ হারাচ্ছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার ডি আর হার্ডউইক। তিনি স্বীকার করেছিলেন— পচা মৃতদেহর গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার পর কন্ট্রোল রুমে খবর পৌঁছেছিল। সুরাবর্দি ৩-৪ দিন ধরে কন্ট্রোল রুমে বসে ছিলেন। তিনি সমস্ত দিন এবং রাত জেগে কাজ করেন। খাদ্য গ্রহণ করেননি। তাঁকে নিদ্রামগ্ন অবস্থায় দেখা যায়নি।

যখনই কমিশনারের ওপর চাপ বাড়ল তখন আর তিনি মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না। প্রকাশ্যেই বলে বসলেন— ‘আমি কী করতে পারি? স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বসে একটার পর একটা চিরকুট পাঠিয়ে পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করছেন।’

ফলত, কমিশনার সাহেব যখন হিন্দু-মুসলমানের প্রাণরক্ষার আবেদনে ক্লান্ত, তখন কিছুটা বাধ্য হয়েই উত্তর দিয়েছেন এক এক দলকে এক একরকম। কাউকে বলছেন, ‘মা কালীকে স্মরণ করুন। তিনিই আপনাদের রক্ষা করবেন।’ কাউকে বলেছেন, ‘আপনাদের নিরাপত্তা দেবে কংগ্রেস।’ কাউকে বলেছেন, ‘এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অনুমতি নেই। আমি অপারগ।’ অথবা, কাউকে বলেছেন, ‘আমি কিছুই করতে পারব না। নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করুন।’

অতএব, লিওনার্ড মোসলেকে The Last Days of the British Raj শীর্ষক গ্রন্থে লিখতেই হল :

The Calcutta Police were finding job of putting down the riots an almost insuperable one. There was the psychological difficulty at first (when the acts of murder were being mostly committed by Muslims) that the killers and violators were of their own religion, for most of the Calcutta Police were Muslims. But by afternoon, the bellows of artificial fury had done the work and the Hindus and Sikhs came out on the streets too, red hot for revenge and reprisal . They came out not to meet the Muslim goondas in head- on-clashes, nor even to protect their own people and put down the rioting. That is not the way Calcutta mobs work. While the Muslim gangs went on hunting isolated Hindus and looting Hindu shops, Hindus and Sikhs went on a hunt for helpless Muslims. It was always the old men, the children and the women that they were after. The women lost their breasts. The old men had their legs snapped. The children had their hands or arms cut off … ( pg 30 )

ঠিক যেমনটি মুসলমানরা করেছিল ১৬ অগাস্টের ভোরে। নিঃশব্দে। বর্ণনাটা লিওনার্দ মোসলেরই—

‘হুগলি নদী পার হয়ে এসেছিল ওরা কলকাতায়। শয়ে শয়ে মুসলমান গুণ্ডার দল। তাদের হাতে ছিল লাঠি, ছুরি, কাচের বোতল, গাড়ির ভাঙা চোরা টুকরো, লোহার রড। ওরা দরজার সামনে অথবা গলির মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। লক্ষ রাখছিল, কোনো দোকান খোলে কিনা। এলাকায় সব দোকানই হিন্দুদের। যেই দোকানদার দোকানের দরজার চাবি খুলল, সঙ্গে সঙ্গে পড়ল লাঠির ঘা, ছোরার আঘাত। দোকানদার তখন হয় মৃত অথবা সংজ্ঞাহীন। লুট হয়ে গেল দোকানের সব রসদ।’ (pg 29)

মোসলে লিখছেন—

It began quietly at first and scarcely anyone realized what terrible things were happening. একজন ব্রিটিশ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন কর্মস্থলে। হঠাৎ দেখলেন, একজন ঝাড়ুদার দৌড়ে আসছে। তার পিছনে মারমুখী জনতা। তাকে ছুঁয়ে ফেলল ওই দলবদ্ধ জনতা। পায়ের গোড়ায় মারল লাঠিটা এতটাই জোরে যে লোকটার পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ার শব্দটাও শুনতে পেলেন ওই ব্রিটিশ নাগরিক। লোকটা যেই আছড়ে পড়ল মাটিতে, একজন ঝুঁকে পড়ল তার ওপর, তারপর নিঃশব্দে একটা ধারালো ছুরি দিয়ে চিরে দিল কণ্ঠনালি। কেটে নিল দুটো কান। (pg 29)

মোসলে লিখছেন—

শুরুতে ছিল কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। রাস্তায় একজন মহিলাকে ধরা হল, নোংরা ইঙ্গিত করা হল। তারপর এক হাত থেকে অন্য হাতে লোফালুফি শুরু হল। সেই মহিলা আর্তচিৎকার করে উঠলেন, গুণ্ডাবাহিনী তাঁর মাথায় মারল লাঠি। মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। There were spots to be had with legless and armless cripples, of whom there are plenty in Calcutta… There were small girls and old men who were frog marched to a place where a cow- one of Calcutta’s wandering sacred cows, had been caught and they were forced to hold the knife that cut its throat; a terrible act of sacrilege for a Hindu. (pg 29)

দুপুরের পর থেকে হিংসা ছড়াল উন্মত্ত অগ্নিশিখার মাধ্যমে। প্রথম দিকটা ছিল কিছু গুন্ডার দাপাদাপি। বাকিরা ছিল দর্শক। কিন্তু, দাঙ্গার নেশাটা বড়ো ছোঁয়াচে, তাই ওই দর্শকরাই ঝাঁপিয়ে পড়ল হত্যা, ধর্ষণ, লুঠপাটের বিবেকহীন নির্লজ্জতায়। শহরের সব প্রান্ত ভরে গেল আর্ত চিৎকারে, যন্ত্রণার শীৎকারে, নরকের গভীর থেকে উঠে আসা ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে।

অচেনা শহর

শহরের ব্রিটিশ নাগরিকরা আশ্রয় নিয়েছিল চৌরঙ্গি স্কোয়ারের নিরাপত্তার চাদরে মোড়া গ্র্যান্ড হোটেলে। কারণ, জিন্নাহ্-র প্রত্যক্ষ সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ বিরোধিতা। বিকেলের দিকে হোটেলের জানলা দিয়ে ব্রিটিশ নারী-পুরুষ-শিশুরা প্রত্যক্ষ করলেন সেইসব ভয়াবহ ঘটনা— একজন শিখ যুবক একটি মুসলমানকে খুন করে, তার দেহটি টুকরো টুকরো করে ফেলছে পেশাদার কসাইয়ের মতো। Kim Christen নামে এক মহিলা পরে মন্তব্য করেছিলেন, “I have a stomach made strong by experiences of a war hospital, but war was never like this… There had been a mob killing two hundred yards south of the Medical College and bodies lay about in the roads amid the wreckage of burning cars… bleeding, shattered, wounded while open carts were piled with those who had not survived the journey back.’

রেড ক্রশের সৌজন্যে আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ধারালো অস্ত্রগুলোকে কিছু মানুষ একজায়গায় জড়ো করছিল। সব হাসপাতালে ঝুলেছিল Full লেখা বোর্ড। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। ডাক্তার এবং নার্সরা দিন রাতের হিসাবের বাইরে গিয়ে একের পর এক অপারেশন করছেন। অ্যাম্বুলেন্সগুলো অবিরাম দৌড়োচ্ছে আহতদের তুলে আনতে।

মোসলের সেই মর্মান্তিক দৃশ্যের লিখিত বিবরণ :

At the end of forty eight hours an air of death and desolation hung over Calcutta. It was muggily hot and raining hot and raining slightly. The smoke from fires hung heavy on the air. Only an occasional cycle (usually ridden by an Englishman) or a military jeep, canopied in wire netting, rushed by. The city had come to a standstill. No more trains were coming into Howrah or Sealdah from the country. The sewers overflowed; and in the foetid gutters the bodies of dead men and women and dead cows lay side by side, being picked over by the vultures. (page 32)

৪৮ ঘণ্টা কেটে গেল যখন, তখন মৃত্যু এবং হতাশা ছাড়া শহর কলকাতার মুঠোয় আর কিছুই নেই। প্যাঁচপেচে গরম। আর, ভাদুরে বৃষ্টি। মাঝে মাঝে এবং হালকা। আগুন থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাতাসকে ভারী করে তুলেছে। কখনো-সখনো এক-আধটা সাইকেল আর মিলিটারি জিপ ছুটে যাচ্ছে রাজপথে মাথায় রজ্জুর জাল চাপিয়ে। শহরটা হঠাৎই যেন ভাষা হারিয়েছে। বাইরের রাজ্য থেকে কোনো ট্রেন হাওড়া বা শিয়ালদায় ঢুকছে না। নর্দমাগুলো উপচে উঠেছে নোংরা জল আর ময়লা জঞ্জালে। পূতিগন্ধময় নর্দমাগুলির কোথাও কোথাও আটকে আছে মরা দেহ— পুরুষের, নারীর, গোরুরও পাশাপাশি। আর, সেইসব মৃতদেহর আস্বাদের অপেক্ষায় ভিড় শকুনদের।

.

এ কলকাতা আমাদের চেনা নয়।

এ কলকাতাকে আমরা জানতাম না।

কলকাতাবাসী এই কলকাতাকে দেখল, জানল সেই প্রথম।

১৯৪৬-এর দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর দিনগুলোয়।

শুধু চিনল না—

চেনালও তাদের, যারা কলকাতাবাসীকে চিনিয়েছিল দাঙ্গার কলকাতাকে।

সে আর এক পর্ব।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন