সুজিত রায়
অগ্নিবলয় কলকাতা তবুও মানবিক
‘…হিন্দুদের মধ্যে কিছুটা আত্মবিশ্বাস তখন ফিরে এসেছে। তারা এবার প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো।… হিন্দুরা সংগঠিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে জাগছে একাত্মবোধ। কিন্তু ঐ উচ্ছৃঙ্খল মুসলমান দুর্বৃত্তদের সঙ্গে লড়াই করা কি সম্ভব? তবুও কোথাও কোথাও জ্বলে উঠল প্রতিরোধের আগুন। প্রতিহিংসার বীভৎস চেহারা। ১৬ তারিখ মধ্যরাতে শহরটি এক জ্বলন্ত অগ্নিবলয়ে পরিণত হল।…’
—১৯৪৬ কলকাতা হত্যা এবং নোয়াখালি গণহত্যা: দীনেশ চন্দ্ৰ সিনহা, অশোক দাশগুপ্ত ও আশিস চৌধুরী।
ভাষান্তর : পৃথ্বীরাজ সেন। প্রকাশক: হিমাংশু মাইতি, কলকাতা ২০২২, পৃ. ১৩৬
.
“This is not a riot. It needs a word found in mediaval history, a fury. Yet, “fury” sounds spontaneous, and there must have been some deliberation and organisation to set this fury on its way.’
ref. The Statesman, editorial. Source: Communal Riots in Bengal 1905-1947 by Suranjan Das. pub. Oxford India Paperbacks 2022. pg 177
.

যত্রতত্র মৃতদেহ। মধ্য কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছেই।
গোপাল ‘বিপ্লবতীর্থ’ মলঙ্গা লেনে তাঁর বাড়ির সামনে আগুন লাগানোর জন্য মুসলমানদের জড়ো করে রাখা কাঠকুটো, বাঁশ আর গাছের ডাল দু-হাতে দ্রুত সরিয়ে দিয়ে যখন বাড়িতে ঢুকলেন, মনে হল গোটা বাড়ির লোক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কারণ, গোপাল বরাবরই ডাকাবুকো। আর, মানুষের বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো গোপালের চিরকালের অভ্যাস। অতএব, বাড়ির লোকজনদের দরজা বন্ধ করে ভেতরে থাকার নির্দেশ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, মুসলমান দাঙ্গাবাজরা পালিয়েছে। কাটা দেহটা থেকে তখনও অনর্গল রক্তপাত হয়ে চলেছে।
গোপাল একবার ঘৃণার চোখে তাকালেন কাটা দেহটার দিকে। তারপর হাতে একটা লাঠি নিয়ে চললেন পাশের বাড়িতে যেখানে অনেকগুলো মুসলমান যুবক ‘মেস’ বানিয়ে থাকে। সংখ্যায় অনেক— প্রায় চারশো। এরা সব চাঁদনি চকের বিভিন্ন দোকানপাটের কর্মচারী। তা ছাড়া, সলভেশন আর্মি (Salvation Army)-র কিছু কর্মীও ওই বাড়িতেই থাকত। তারাও মুসলমান। এ পাড়ায় থাকলে ওদের বিপদ বাড়তে পারে। তাই তিনি একাই তাদের বিপদের কথা বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলেন চাঁদনি চকে, যেখানে মুসলমানরা আত্মরক্ষার্থে একত্রিত হয়ে রয়েছে। গোপাল পাড়ার দু-চারজন হিন্দু ছেলেকে ডেকে বলে দিলেন—
—ওদের গায়ে যেন হাত না পড়ে। ওদের চাঁদনি চকে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে আসিস। বউবাজার থানাকেও খবর দিয়ে দিস।
সেদিন দিনভর গোপাল পথেই রইলেন। সঙ্গে দু-চারটে হিন্দু যুবক। সবার হাতেই অস্ত্র। কারণ, আত্মরক্ষার্থে এবং বিপদগ্রস্তকে রক্ষা করতে হলে অস্ত্র প্রয়োজন। আর তা ছাড়া, মুসলমানরা এবার যেভাবে হিন্দু নিধনে পথে নেমেছে, তা সহজে থামবে না, যদি-না প্রতিরোধ করা যায়।
সন্ধ্যার অন্ধকার গড়াতেই গোপাল জাতীয় বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন। আগে খবরাখবর নিলেন, অন্যরা কোথায় কোথায় গণ্ডগোলের খবর পেয়েছে। কত হিন্দু মারা গেছে, কতজন হাসপাতালে, কত অন্যভাবে আক্রান্ত, কোনো মহিলা ধর্ষিতা হয়েছে কি না— সঠিক সংখ্যা না পেলেও যা শুনলেন, তা মারাত্মক। আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। গোপাল কড়া নির্দেশ জারি করলেন —
—সবাই মন দিয়ে শোন। এদের আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। বাংলাকে পাকিস্তান হতে দেব না কিছুতেই। আমাদের প্রতিরোধে নামতে হবে। হামলাকারীদের পালটা মার দিলেই ওরা পিছু হঠবে। তার জন্য দরকার আমাদের লোকবল, অস্ত্রবল। আর দরকার কৌশল।
কিন্তু, কীভাবে?
গোপাল বললেন—
—আজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম নয়। আমাদের হিন্দু মহল্লায় মহল্লায় যেতে হবে। প্রতিটা বাড়ি থেকে যুবক, তরুণ কর্মীদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচার করতে হবে— সবাই প্রস্তুত থাকুন হাতে অস্ত্র নিয়ে। হামলাকারীদের ভয়ে গুটিয়ে গেলে চলবে না। মা, বোনদের মা কালীর মতো ভয়ংকরী হতে হবে। পুরুষদের হতে হবে পরশুরাম। হামলা করলেই সামনে যাকে পাবে, তাকে বলি দিতে হবে মা কালীকে স্মরণ করে। মনে রাখতে হবে, ঈশ্বর আমাদের ওদের আল্লার চেয়ে বেশি শক্তিমান কারণ ওরা মনে পাপ নিয়ে আল্লার ভজনা করে। সেই আল্লার শক্তি হিন্দু সনাতনী শক্তির ঈশ্বরের চেয়ে বেশি হতে পারে না।
গোপাল সবাইকে নির্দেশ দিলেন—
—সবাই বাড়ি থেকে যে যা অস্ত্র পাও— দা, কুড়ুল, বর্শা, বঁটি, টাঙি, নিদেনপক্ষে লাঠি, লোহার রড যা আছে। আমার কাছে কিছু অস্ত্র আছে। সেগুলো যেখানে যা দেবার, আমি দেব। বাকি অস্ত্র আমিও সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু, অপেক্ষায় থাকলে হবে না। সময় নেই সময় নষ্ট করার। চলো, সবাই মিলে পথে নামি।
.
সেদিনই রাতে শুরু হল অভিযান। হিন্দু পাড়ায় পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে চলল প্রচার অনেকটা গেরিলা বাহিনীর মতো। সর্বত্র তো গোপালের যাওয়া সম্ভব ছিল না। প্রতিনিধিদের পাঠাল উত্তর ও মধ্য কলকাতার বিভিন্ন পাড়ায়। গোপাল পাঁঠাকে চেনে না, এমন খুব কম মানুষই তখন উত্তর ও মধ্য কলকাতায়। গোপাল প্রতিনিধিদের বলে দিলেন, কোথায় কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
খবর এল পার্ক সার্কাস কড়েয়ায় ব্যান্ডপার্টি বাজিয়ে পথে নেমেছে মুসলমান লুঠেরারা। হিন্দু দোকানগুলো ভাঙচুর করে লুঠ করছে। গোপাল পৌঁছে গেলেন দলবল নিয়ে। প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করলেন— এসব বন্ধ করো। ক্ষতি হবে দু-পক্ষেরই। কিন্তু, তখন কে শুনবে গোপালের উপদেশ! আক্রমণকারীরা রক্তখেকো ভ্যাম্পায়ারের মতোই ভয়ংকর তখন। অগত্যা পালটা আক্রমণে নামতেই হল। এক এক তরোয়ালের কোপে কাটে এক একজনকে আর গোপাল চিৎকার করে ওঠেন— জয় মা কালী!
হিন্দুবাহিনীও তখন উত্তেজনায় ফুটছে। গোপাল যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ তাদের মদত দিলেন। কিন্তু, যখন মুসলমানদের দলটি আক্রমণ সামলাতে না পেরে পিছু হঠল, গোপাল বললেন—
—চল। ফিরে চল। আসল কাজ হবে কাল। কিন্তু মনে রাখবি সকলে, আমাদের কাজ হবে আক্রমণ করা নয়, আক্রমণ প্রতিহত করা। আগামীকাল সকাল থেকে আমরা মুসলমান মহল্লায় যাব। দরকারে রাজাবাজারেও। ছোটো ছোটো গ্রুপে। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করব যে, হিন্দুরা জেগে আছে। অকারণে অশান্তি কোরো না। অশান্তি করলে ছেড়ে দেব না। কিন্তু, কেউ কোনো মহিলার গায়ে হাত দেবে না। সে-মহিলা যদি সশস্ত্র থাকে, তাহলে তাকে নিরস্ত্র করবে, ব্যস। ওইটুকুই। মা, বোনের সম্মান বজায় রাখতে হবে। আমরা মা কালীর সন্তান।
পরদিন সকালে জাতীয় বাহিনীর সামনে গোপাল হাজির হলেন তন্ত্রসাধকের বেশে। ঘন লাল অঙ্গবস্ত্র তাঁর শরীর জুড়ে। মাথার ওপর শক্ত করে বাঁধা ঝুঁটি। হাতে তলোয়ার। কোমরে গোঁজা পিস্তল। মার্কিন সেনার কাছ থেকে সংগ্রহ করা। দু-চারটে পিস্তল দুঃসাহসী দু-চারজন সঙ্গীকেও দিলেন। তারপর বেরিয়ে পড়লেন।
—চল, আমরা বড়োবাজার, চিৎপুর যাব। টাকাপয়সা তুলতে হবে মাড়োয়ারিদের কাছ থেকে। নাহলে, অস্ত্র কিনব কীভাবে?
গোপালকে দেখেই মাড়োয়ারিরা হাতজোড় করে দাঁড়াল। গোপাল বললেন—
–আমরা লুঠেরা নই, সেটা আপনারা জানেন। আমাদের কিছু টাকাপয়সা দরকার। অস্ত্র কেনার জন্য। নাহলে পালটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব না।
মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা অকাতরে টাকা তুলে দিলেন গোপালের হাতে। গোপাল নিশ্চিন্ত। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গোপালের বিভিন্ন ডেরায় জমা পড়ে গেল, পিস্তল, বোমা, ছুরি, ভোজালি, তরোয়াল, লাঠি, রড, কোনো কিছুই বাদ নেই। কলকাতার যুবকরা তো এলই শয়ে শয়ে। হাওড়া, হুগলির যুবকরাও বাদ গেল না।
গোপালের নির্দেশে প্রায় সহস্র সশস্ত্র যুবক ছড়িয়ে পড়ল দাঙ্গাক্রান্ত অঞ্চলে। গোপালের নিজের হাতে গড়া শক্তপোক্ত ব্যায়াম করা পেটাই চেহারার যুবকদের নির্দেশে এক-একটা দল গেল এক-একদিকে। কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও গুপ্ত আক্রমণ। কোনো কিছু বোঝার আগেই শেষ। গোপালের নির্দেশ, হিন্দুর এক তো মুসলমানের দশ।
কলকাতা শহরের আকাশে-বাতাস তখন হিন্দু মা, হিন্দু স্ত্রী, হিন্দু বোনেদের কান্নায় মথিত। পথের ধুলো হয়ে উঠেছে রক্তে রঙিন। আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে দোকানের পর দোকান। বাড়ির পর বাড়ি। চোখের সামনে এই মারণমুখী আক্রমণ দেখে হিন্দু যুবকরা ভুলে গেল গোপালের নির্দেশ— ‘শুধু হামলাকারীদের মারবে। সকলকে নয়।’ আক্রমণ চলল সর্বাত্মক। রাজাবাজার, বড়োবাজার, কড়েয়া, পার্ক সার্কাস, পার্ক স্ট্রিট, মল্লিক বাজার ইত্যাদি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে মুসলমান বস্তিগুলোতে আগুন লাগাল হিন্দু যুবকরা। আগুন থেকে বাঁচতে বেরিয়ে এলেই আত্মাহুতি দিল ধারালো তরোয়ালের কোপে। সব আক্রমণগুলোই ছিল আচম্বিত। কচুকাটা বলতে যা বোঝায়, সেটাই শুরু করে দিল হিন্দু যুবকরা শহর জুড়ে। পালটা আক্রমণে যখন দাঙ্গাকারীরা আসত সম্মুখসমরে, তখনও হিন্দু যুবকদের রোখার ক্ষমতা ছিল না দাঙ্গাবাজদের।
গোটা শহর জুড়ে তাণ্ডব। রাস্তায় ছড়ানো-ছেটানো মৃতদেহর সংখ্যা বাড়ছে। তাল মিলিয়ে বাড়ছে আগুনের শিখা। কোথাও পুলিশ নেই। সেনা নেই। গোটা শহরে প্রশাসন আছে বলেই মনে হচ্ছিল না। অতএব, রোখবার কেউ নেই। আছে শুধু উত্তেজনা আর প্ররোচনার ঢেউ। খবর আসছে, দ্বিতীয় দিনে দাঙ্গা তুমুল চেহারা নিয়েছে মেটিয়াবুরুজে, দক্ষিণ কলকাতায়। খবর আসছে, পলায়নপর হিন্দু পরিবাররা নদীপথে নৌকায় নিরাপদ স্থানে যাবার পথে তাদের জলে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাদের সলিলসমাধি হয়েছে গঙ্গায়। যারা সাঁতরে নৌকায় ওঠার চেষ্টা করেছে মরিয়া হয়ে, তাদের মাথায় আঘাত করা হয়েছে বইঠা দিয়ে। কী অমানুষিক আক্রমণ!
গোপালের কাছে খবর আসছে— আক্রমণ থামছে না। গঙ্গাপারের মুসলমানরা হিন্দুদের কোতল করছে আর গঙ্গায় ছুড়ে ফেলছে। গঙ্গায় তখন লাশের মিছিল। লাশ ঠোকরাচ্ছে গাংচিল, শকুনের দল! বায়সদের কালো ডানায় গঙ্গাবক্ষে আঁধার নেমেছে।
দিনভর আঘাত, পালটা আঘাতের খবরে তোলপাড় গোটা কলকাতা। তারই মধ্যে রটছে গুজব— মহিলাদের ধর্ষণ করার পর রাজাবাজারে কসাইয়ের দোকানে তাদের নগ্ন মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মৃতদেহগুলিকে দৃষ্টিকটু করে তুলতে মহিলাদের স্তন কেটে নেওয়া হয়েছে কোথাও কোথাও। গুজব রটেছে— দুধের শিশুদের শূন্যে ছুড়ে দিয়ে তারপর তীক্ষ্ণ বর্ণায় বিঁধে ফেলা হয়েছে। যত গুজব রটে, তত প্রতি-আক্রমণ বাড়ে। যত প্রতি-আক্রমণের খবর ছড়ায়, তত হিন্দু আক্রমণকারীদের সংখ্যা বাড়ে। মাড়োয়ারিরা যেচে যেচে গোপালের হাতে টাকা দিয়ে যায়— ‘আরও অস্ত্র কিনুন। আমরা টাকা দেব। লঙ্গরখানা খুলুন হিন্দুদের জন্য। আমরা টাকা দেব। কিন্তু, যারা দাঙ্গা শুরু করেছিল তাদের ছাড়বেন না।’ প্রচুর মাড়োয়ারি যুবকও পথে নামতে দ্বিধা করেনি। বহু মাড়োয়ারি পরিবারের সকলে মিলে আক্রমণকারীদের ঠেকিয়েছে— এমন খবরও এসেছে বড়োবাজার থেকে। গোপাল নিজেও বুঝতে পারছেন, প্রতি-আক্রমণের যে ঢেউ আছড়ে পড়েছে, তাকে সহজে রোখা যাবে না। অনেক সময় নিজেকেও রুখতে পারছেন না তিনি। ১৭ অগাস্ট সকালেই বউবাজারে সোনার দোকান লুঠ করতে এসেছিল কয়েক জন মুসলমান যুবক। খবর পেয়ে গোপাল ছুটে যেতেই ওকে ভোজালি নিয়ে আক্রমণ করে যুবকরা। ঝকমকিয়ে ওঠে গোপালের হাতের তরোয়াল। এক কোপে একজনের দেহ দু-টুকরো করতেই বাকিরা ভাগলবা!
দিন যত গড়ায় ততই কানে আসে, হিন্দু নয়, বাড়ছে মুসলমান মৃতদেহর সংখ্যা, আহতর সংখ্যা। মুসলমান নেতৃত্বও তটস্থ। তারা ভেবেছিল এক, হল আর এক।
বেলেঘাটায় বিশাল মুসলমান বস্তি মিয়াঁবাগান থেকে সুরাবর্দির উসকানিতে বিশাল সংখ্যক দাঙ্গাবাজ ‘কায়েদ-ই-আজম জিন্দাবাদ’, ‘মারকে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আওয়াজ তুলে হিন্দু নিধনে পথে নামার উদ্যোগ নেয়। এলাকায় গোপালের সুপরিচিত দুই মস্তান যুগলচন্দ্র ঘোষ আর রতন ঘোষকে পথে নামার নির্দেশ দেন কংগ্রেস নেতা সুরেশচন্দ্র মজুমদার। যুগলকে নিজের গাড়িটা দিয়ে বলেন, “এটা নিয়ে যাও কারখানা মালিকদের কাছে। টাকা তোলো। হিন্দু যুবকদের হাতে টাকা দাও। খুন করাও মুসলমানদের। যুগল সেটাই করে। ব্যবসায়ী আর কারখানা মালিকদের থেকে হাজার, হাজার টাকা তুলে হিন্দু যুবকদের ডেকে বলে— একটাকে খতম করলেই হাতে হাতে দশ টাকা। একটাকে আহত করলেই কড়কড়ে পাঁচ টাকা নগদ। সে-আমলে দশ টাকা মানে হাতে চাঁদ পাওয়া। এক অর্থে ‘সুপারি’ পাওয়ার মতোই হিন্দু যুবকরা সেদিন স্নান করেছিল মুসলমানের রক্তে।
.
কলকাতায় যে গোপাল পাঁঠা এবং তার বাহিনী তাণ্ডব চালাচ্ছে, খবরটা পৌঁছেছিল রাম চ্যাটার্জির কাছেও। হুগলির রাম চ্যাটার্জির নামে তখন হুগলি জেলায় গাছের পাতারাও কাঁপে। বামফ্রন্ট আমলে এই রাম চ্যাটার্জিই মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি দল তৈরি করে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে।
রাম ঠিক করে নিলেন গোপালকে সাহায্য করতে হবে। কোথা থেকে জোগাড় করলেন ব্রিটিশ সেনার একটা ইউনিফর্ম আর সেনাবাহিনীর একটা পতাকা। একটা জিপগাড়ি জোগাড় করে দু-হাতে পিস্তল বাগিয়ে রওনা দিলেন কলকাতায়। শ্যামবাজার পেরিয়ে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট ধরে কিছুটা এগিয়েই দেখলেন, বেশ কিছু মুসলমান ছেলে জড়ো হয়েছে হিন্দু পাড়ায়। জিপ থামালেন রাম চ্যাটার্জি। সেনাবাহিনীর পতাকা লাগানো জিপ। তার ওপর সেনাপোশাকে রাম। চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেল আক্রমণকারীরা। রাম চ্যাটার্জি বাক্যালাপ না করেই দু-হাতে চালিয়ে দিলেন পিস্তল। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়ল চার যুবক। বাকিরা? আক্রমণ তো দূরের কথা— কে কোনদিকে যে ছুটল!
রাম চ্যাটার্জি মুচকি হাসলেন। জিপ ছুটল বউবাজারের দিকে যেখানে গোপাল রয়েছেন।
১৭ অগাস্ট বিকেল থেকে গোপাল আর রাম যৌথ নেতৃত্ব দেন হিন্দু যুবকদের। গোপালকে সাহায্য করেন কংগ্রেসের বলিষ্ঠ ও বলবান নেতা বিজয় সিং নাহার, দেবেন দে, ইন্দুভূষণ বিদ। সম্মিলিত পরিকল্পনায় লুঠ হয় শোভাবাজারের মুসলমান বস্তিতে জমা করা বিশাল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র। আমহার্স্ট স্ট্রিটে অঙ্কের বিখ্যাত শিক্ষক যাদব চক্রবর্তীর বাড়িতে মুসলমান আক্রমণ হলে গোপালের বাহিনীই তা রুখে দেয় কয়েক জনকে লাশে পরিণত করে।

স্বামীহারা স্ত্রীর বুকফাটা কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল কলকাতার বাতাস
.
১৭ অগাস্ট সকাল থেকে হোসেইন সুরাবর্দি বসে ছিলেন লালবাজার কন্ট্রোল রুমের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় আর নজর রাখছিলেন জল গড়াচ্ছে কোনদিকে। ১৬ অগাস্টের হিন্দু নিধনের জন্য তাঁর রচিত স্ক্রিপ্ট ব্যাপক সাফল্য পাওয়ায় ভেবেছিলেন, ১৭ অগাস্টের বিকেলের মধ্যেই তিনি বাংলা দখল করে নিয়ে কায়েদ-ই-আজম মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু, যখন দেখলেন, খেলছে হিন্দুরাই গোটা শহর কাঁপিয়ে, তখন নির্দেশ পাঠালেন মুসলিম সামাজিক সংগঠন ARDS-কে যে, গোপালকে শান্তি বৈঠকে ডেকে কেটে ফেল। নাহলে কলকাতা মুসলিম শূন্য হয়ে যাবে।
ARDS গোপালকে আমন্ত্রণ জানাল শান্তি বৈঠকে। গোপাল বুঝেছিলেন — এটা একটা ছক। দু-পকেটে দুটো লোডেড পিস্তল ভরে হাজির হলেন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের শান্তি বৈঠকে। তাঁকে সংগঠনের মুসলিম নেতৃত্বের তরফে বলা হল— একচেটিয়া মুসলিম হত্যা চলছে। এসব বন্ধ করো।
গোপাল হেসেছিলেন। দু-পকেটে পিস্তলের সঠিক অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে বলেছিলেন— বোতলবন্দি জিন যদি একবার মুক্তি পায় তাকে কি আর চটজলদি বোতলবন্দি করা যায়! সে তার দায়িত্ব শেষ করেই ফিরবে। আপনাদের উচিত ছিল হিন্দু-হত্যার আগে কথাগুলো ভেবে নেওয়া।
একথা শোনার পরেই মুসলমান নেতাদের মুখ থেকে শান্তির হাওয়া উধাও। সবাইকার চোখ তখন জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুনে। গোপাল আড়চোখে দেখে নিলেন, ধীরে ধীরে বৈঠকে উপস্থিত মুসলমানরা তাঁকে গোল করে ঘিরে ফেলার উদ্যোগ করছে। এবার আছড়ে পড়বে ধারালো অস্ত্র। গোপাল তাঁর আরাধ্যা কালী মাকে স্মরণ করে চকিতে দু-পকেট থেকে দু-হাতে পিস্তল নিয়ে ফায়ার করলেন। পিস্তলের নল থেকে বর্ষিত বুলেট ক-জনের প্রাণ নিল, তা দেখার সময় ছিল না গোপালের। সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে গোপাল পর পর দুটো বাড়ি পার হয়ে তৃতীয় বাড়ির পাঁচিল টপকে মিশে গেলেন সংকীর্ণ গলিপথে। যদিও গোপাল পরে বলেছিলেন, ‘আমি শূন্যে গুলি চালিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। ওখানে দাঁড়িয়ে পিস্তল চালালে অনেকে মরত সেদিন।’
দাঙ্গার প্রথম দিনে যত ঘটনা ঘটেছে তার অনেক খবরই জানা গিয়েছিল পরদিন ১৭ অগাস্ট। গোপালের কাছে নানা মুখে খবর হাতে এসে পৌঁছোচ্ছিল আর ততই উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন গোপাল। দাঙ্গা শেষ হবার অনেক পরে গোপাল মুখার্জি সম্পর্কে যখন হিন্দুরা জয়জয়কার করে নেমেছিল, তখন গোপাল বারে বারে সাংবাদিকদের কাছে এবং রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কবুল করেছেন— প্রতিটা ঘটনাই ছিল যথেষ্ট উত্তেজক। তবে, জানতাম সব সত্য সত্য নয়। এরকম উত্তেজক পরিস্থিতিতে নানা গুজবও রটে। আমার ছেলেদের পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া ছিল, হামলাকারী ছাড়া অন্য কারো গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। মেয়েদের সম্মান রক্ষা করতে হবে— মুসলমান মহিলা হলেও। কিন্তু, সবক্ষেত্রে সে-নির্দেশ পালিত হয়নি সেটা গোপালও স্বীকার করেছেন। আসলে, খবরগুলো ছিল মাথা গরম করে দেওয়ার মতো। যেমন, শোনা গিয়েছিল বউবাজারে সাহেবদের কোয়ার্টারের সামনে রক্তের হোলিখেলা খেলেছিল দাঙ্গাবাজরা। রাজাবাজারে ভিক্টোরিয়া কলেজে হিন্দু মহিলাদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার হয়েছে। হিন্দু নারীদের বলাৎকার করে স্তন কেটে নেওয়া হয়েছে। জননাঙ্গ ধারালো ছুরির ফলায় ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে। মায়ের কোল থেকে শিশুদের টেনে আছড়ে মারা হয়েছে। এসব কোনোটাই সত্যি নয়। পরে সবই গুজব বলে প্রমাণিত হয়েছিল।
মেটিয়াবুরুজে পান্না চ্যাটার্জির বাড়ির সমস্ত পুরুষ সদস্যকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। বিস্ময়করভাবে ওই পরিবারের একজন মহিলা সদস্যকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার, মুসলিম রাজনীতিবিদ যওশর আলি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নেননি বলে তাঁর বাড়িতেও হামলা চালিয়েছিল মুসলিম লিগের ন্যাশনাল ভলান্টিয়াররা।
বিশিষ্ট অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপক ড. নারায়ণ চক্রবর্তী স্বস্তিকা পত্রিকার 2023 পুজোবার্ষিকী সংখ্যায় ‘ইতিহাসে উপেক্ষিত নায়ক’ শীর্ষক প্রবন্ধে এসব ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘গোপাল প্রথম দিন অর্থাৎ ১৬ অগাস্টে সেভাবে প্রতিরোধ গড়েননি। ১৭ তারিখ থেকে তাঁরা ময়দানে নামেন। যদিও ১৬ তারিখ থেকে গোপালের কাছে অত্যাচার ও হিন্দু নিধনের খবর আসছিল, কয়েকটি বিশেষ ঘটনা তাঁকে দ্রুত প্রতি- আক্রমণে যেতে প্ররোচিত করে।’ এমনকী বিজয় সিং নাহার, ইন্দুভূষণ বিদ ও দেবেন দে গোপালকে সশস্ত্র প্রতিরোধে রাস্তায় নামতে অনুরোধ করেছিলেন। গোপাল তাতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বলেছিলেন দলের ছেলেদের—
“তোমরা মনে রাখবে একটি হিন্দু প্রাণের বদলা নিতে দশটি লিগ জেহাদির প্রাণ নেওয়া চাই। সেইসঙ্গে মনে রাখবে, সাধারণ খেটে খাওয়া মুসলমান মানুষ যখন আশ্রয় চাইবে, তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেওয়া তোমাদের কর্তব্য। তেমনি মনে রাখবে সুরাবর্দির কুকুরগুলোকে যেমন কোনোরকম দয়া দেখানো যাবে না, তেমনি কোনো মুসলমান রমণীর গায়ে যেন হাত না পড়ে।… ওরা ওদের ধর্মস্থানে জানোয়ারের শিক্ষা পেলেও আমরা আমাদের ধর্মের মনুষ্যত্বের শিক্ষা ভুলব না।’ (সূত্র: ইতিহাসে উপেক্ষিত নায়ক : ড. নারায়ণ চক্রবর্তী, স্বস্তিকা পুজো সংখ্যা 2023, পৃষ্ঠা ৯৭)।
দু-দিন ধরে যখন কলকাতা ভাসছে হিন্দু-মুসলিমের রক্তে, তখন ১৭ অগাস্ট সন্ধ্যায় গোপালের জাতীয় বাহিনীর কয়েকটি যুবক তাঁর সঙ্গে বউবাজারে দেখা করল। বলল— ‘দাদা পারমিশন দাও, ওই কুত্তা সুরাবর্দিটাকেই খতম করে দিই। লিগের সব ফোঁস একেবারেই শেষ হয়ে যাবে।’ চমকে উঠেছিলেন ডাকাবুকো গোপালও। বলে কী ছেলেরা!
—কী বলছিস ভেবে বলছিস তো?
—হ্যাঁ দাদা, ভেবেই বলছি। ওটাকে নিকেশ করতেই হবে। এত হিন্দুর রক্তের শোধ একবারে তুলে নেব।
গোপাল তাকালেন। দেখলেন, যুবকদের চোখে প্রতিশোধের আগুন।
—দেখো দাদা, সাধারণ খেটে খাওয়া মুসলমানগুলোর কী দোষ? ওদের খেপিয়ে তুলেছে ওই সুরাবর্দি আর ইমাম, মোয়াজ্জেম, মৌলভিরা। মসজিদে, মাদ্রাসায় ওদের জড়ো করে হিন্দু নিধনে উসকানি দিয়েছে। মগজ ধোলাই করেছে। আসল অপরাধী তো মহাত্মা গান্ধীর ওই পা-চাটা কুত্তাটা। ওটাকে খুন করলেই দাঙ্গা খতম।

মৃত্যুভয়ে ভীত শাহীদ হোসেইন সুরাবর্দি
গোপাল বললেন,
—ব্যাপারটা সহজ নয়। ও প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটিশ পুলিশ ওকে গার্ড দেয়। ওর সঙ্গে থাকে লিগের ন্যাশনাল ভলান্টিয়াররা। তারাও সবাই সশস্ত্র থাকে।
–থাকতে দাও, দাদা। আমাদের শুধু পিস্তল আর গ্রেনেড দাও। দেখো, আমরা কী করি।
গোপালের মনটা খুঁতখুঁত করছে। তরতাজা যুবকগুলো প্রাণে বাঁচবে তো! ওরাই তো এইসময় ভরসা। অথচ, প্রস্তাবটা মন্দ নয়। দাঙ্গা যেভাবে ছড়াচ্ছে, তাতে কতদিনে তা থামবে কেউ জানে না। লিগের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে সুরাবর্দি। লোকটাকে নিকেশ করতে পারলে মুসলমানরা পিছু হঠবে, এটা সত্যি। আর তা ছাড়া, হিন্দুরা তো খুনি নয়। তারাই-বা কতদিন দাঙ্গা রুখতে কত মুসলমানের প্রাণ নেবে!
অতএব, রাজি হয়ে গেলেন গোপাল। তিন যুবকের হাতে তুলে দিলেন পিস্তল আর গ্রেনেড। দু-চারটে বোমাও। তারপর এক ব্যবসায়ীর একটা জিপগাড়ি জোগাড় করলেন। বলে দিলেন,
—নজর রাখতে হবে সুরাবর্দি কখন বাড়ি থেকে বেরোবে। গান্ধীজি কলকাতায় আসবেন শোনা যাচ্ছে। ওই পা-চাটা কুত্তাটা রোজ বেলেঘাটায় গিয়ে গান্ধীর পা ধরে বসে থাকবে। ওখানে যাওয়ার পথে যা করার করতে হবে।
তাই হল। দাঙ্গার ভয়াবহতা ততদিনে কমে এসেছে। টুকটাক বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলছে এদিক-ওদিক। দু-একদিন সুরাবর্দির বাড়ির ওপর নজর রাখল যুবকরা। ক-টায় বেরোন, কখন ফেরেন। তারপর একদিন সুরাবর্দির গাড়ির পিছু নিল। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আর একটা গাড়িতে যাচ্ছিলেন শাকরেদদের নিয়ে গোপাল পাঁঠা। উদ্দেশ্য, ছেলেগুলো বিফল হলে নিজেই যা করার করবেন।
কিন্তু, বিধি বাম!
শিয়ালদায় বেলেঘাটাগামী ব্রিজের ওপর শিবতলা স্ট্রিট, ট্যাংরাগামী রাস্তা আর বেলেঘাটা মেইন রোডের সংযোগস্থলে আচমকা সামনের গাড়িটার চাকা স্কিড করে আছড়ে পড়ল ব্রিজ থেকে একেবারে অনেক নীচে রেললাইনে। তিন যুবকের দেহই গেঁথে যায় রেললাইনের পাশে লোহার বর্ণামুখী গার্ডওয়ালের ওপর। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তিনজনের।
গোপাল সেদিন চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু, সেদিনই শপথ নিয়েছিলেন— যদি ভবিষ্যতে প্রয়োজন পড়ে, সুরাবর্দিকে নিজের হাতে খুন করে জেলে যাবেন। তার অবশ্য প্রয়োজন পড়েনি। কারণ, সুরাবর্দির মুখোশ খুলে গিয়েছিল। তাই তাঁর ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছোবলে আর বিষ ছিল না সুরাবর্দির। তাই শেষপর্যন্ত তাঁকে খুন করার পরিকল্পনা ত্যাগ করেছিলেন গোপাল। কিন্তু, আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল কলকাতার হিন্দু সমাজের যে, হাজার হাজার হিন্দুর রক্তে হাত রাঙিয়েও খুনি, ধর্ষক, শয়তান সুরাবর্দি বেঁচে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পাকিস্তানে। চরমতম অবজ্ঞার মধ্যে জীবন কাটলেও খুন হতে হয়নি তাকে।
সুরাবর্দির নির্দেশে ‘হিন্দু এথনিক ক্লিনজিং’ প্রক্রিয়া যখন গোপাল তথা হিন্দু বাহিনীর প্রতি-আক্রমণে বিধ্বস্ত তখন প্রমাদ গুনলেন সুরাবর্দি। হিন্দুরা একটা ভয়ংকর আক্রমণ নামাবে— এ ধারণাই ছিল না তাঁর। সারাক্ষণই কানে আসছে— মুসলমান নারী, পুরুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে গোটা শহর জুড়ে। এরকম হলে তো বাংলা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মুসলমান। কাদের নিয়ে যাবেন পাকিস্তানে!
যে সুরাবর্দি গত দু-দিন ধরে লালবাজারে বসে গোস্ত-বিরিয়ানি খেয়ে হিন্দু নিধন যজ্ঞ উপভোগ করছিলেন সেই তিনিই এবার ফ্রেডারিক জন বারোজকে ফোন করলেন। বাংলার গভর্নর ফোন তুলতেই ভয়ার্ত কণ্ঠে সুরাবর্দি বলে উঠলেন— সাহেব, এসব কী হচ্ছে কলকাতায়? মুসলমানদের তো শেষ করে দিল হিন্দু গুন্ডার দল! এমনভাবে বললেন সুরাবর্দি যেন মুসলমানরা সব মক্কা, মদিনার নাম স্মরণ করে এতকাল মসজিদে বসে হিন্দুদের মঙ্গল কামনা করছিল।
বারোজ মুচকি হাসলেন। কারণ, একটু আগেই তাঁর কাছে খবর এসেছে, মিয়াবাগান বস্তিতে একজন সেনা জওয়ানকে খুন করে গুম করে রেখেছে মুসলমানরা। বললেন,
—আপনি বললে সেনা নামিয়ে দেব, সুরাবর্দি সাহেব। আপনিই এতদিন আমার হাত বেঁধে রেখেছিলেন। কিন্তু, সেনা নামলে হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানও রেহাই পাবে না— এটা কিন্তু আপনাকে চোখের সামনে দেখতে হবে।
সুরাবর্দি উপায়হীন। অন্তত গোপালের চেয়ে তো সেনাবাহিনীর আক্রমণ কম হবে। ১৮ অগাস্ট ততক্ষণে গোপালের ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর যুবকরা মুসলিম লিগের ছাত্র সংগঠন মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের সবুজ টুপি পরা বাহিনীকে কচুকাটা করে দিয়েছে এন্টালি, বেলেঘাটায়। দুপুরে কারফিউ জারি হল। উপদ্রুত এলাকায় সেনা নামল। নামল সশস্ত্র পুলিশ। বেলেঘাটায় রুট মার্চের সময় দেখা গেল একজন জওয়ান মিসিং। এলাকার ত্রাণকর্তা যুগল ঘোষ পরে জানিয়েছিলেন, গোপন বার্তার ভিত্তিতে স্থানীয় মুসলমান বস্তিতে ঢোকে সেনাকর্মীরা। পুরুষরা ততক্ষণে হাওয়া। মুসলিম মহিলারা বাধা দিল। কিছুতেই সেনাবাহিনীদের ঢুকতে দেবে না বস্তিতে। সেনাবাহিনী গায়ের জোরেই ঢুকল। চিরুনিতল্লাশি করে খুঁজে পেল সেই নিখোঁজ জওয়ানের দেহ। তাকে ভোজালির কোপে খুন করা হয়েছে। এরপর ক্ষুব্ধ সেনা বাধাদানকারী মহিলাদের তাড়া করল। কেউ কেউ পালাল রাজাবাজারের দিকে। কেউ কেউ হোঁচট খেয়ে মিলিটারি বুটের তলায় পিষে মারা গেল। ১৯ অগাস্টেও শহরে ছিল সেনা টহল। তারই মধ্যে ছোটো ছোটো দলে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে গেছে গোপালের বাহিনী। নিঃশব্দে মুসলমান পরিবারে ঢুকে পরিবারসুদ্ধ সকলকে কুপিয়ে বেরিয়ে এসে হাত ধুয়ে ফেলেছে। সেনাবাহিনী বুঝতেই পারেনি।
সুরাবর্দি তখন আতঙ্কিত। আবার ফোন বারোজ সাহেবকে।
—আর তো পারা যাচ্ছে না। ওই গোপাল পাঁঠাটাকে জবাই করে দিন না। নাহলে তো বাংলা থেকে মুসলমান জাতটাই উবে যাবে, সাহেব।
—আপনি বললে ‘শুট অ্যাট সাইট’-এর অর্ডার দিচ্ছি।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই করুন। জলদি। গোপাল খতম হলেই হিন্দুরা খতম।
শেষপর্যন্ত জারি হল আদেশ— শুট অ্যাট গোপাল অ্যাট দ্য ফার্স্ট সাইট। কিন্তু, গোপাল গোপালই। তিনি রইলেন কলকাতা জুড়েই। ছায়ার মতো। মুসলমান খুনখারাবি থামল না। গোপালকেও খুঁজে পেল না পুলিশ। কারণ, পুলিশের বড়ো অংশই ছিল হিন্দু বাঙালি। তারাই আড়াল করে রাখল হিন্দুর পরিত্রাতাকে।
২০ অগাস্ট ১৯৪৬।
তখন দাঙ্গা কিছুটা স্তিমিত। কিন্তু, আতঙ্কের রেশ তখনও ছড়িয়ে শহরে। এমতাবস্থায় The Statesman লিখল— (The riot was) a political demonstration of Muslim League.
চোখের সামনে সেটাই দেখেছে সবাই। ২০ অগাস্টেও দেখছে— শহর জুড়ে শকুনের ডানায় আবদ্ধ হচ্ছে সূর্যালোক। তারই মধ্যে অলক্ষ থেকে কোথাও বর্ষিত হচ্ছিল মনুষ্যত্বের আশীর্বাদ।
গোপাল ও তাঁর বাহিনী মুসলমান আক্রমণকারীদের হত্যা করেছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু বহু মুসলমানকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েওছে। দাঙ্গার প্রথম দিনেই তিনি তাঁর পাশের বাড়ির মুসলমান শ্রমিকদের জাতীয় বাহিনীর ছেলেদের তত্ত্বাবধানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় থানায় যাতে তাদের ওপর আক্রমণ না হয়। তারপরেও বহু নিরপরাধ পরিবারকে গোপাল আশ্রয় দিয়েছেন নিরাপদ স্থানে। শুধু গোপালই নয়, কলকাতার বহু হিন্দু পরিবার এগিয়ে এসেছিল মুসলমানদের পরিত্রাতা হিসেবে। যেমন, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে হায়দার আলির পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন প্রতিবেশী হিন্দুরা।
গোলাম ওস্তাগর লেনে ৩০টি মুসলিম পরিবারকে বাঁচিয়েছিলেন স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। বউবাজারে থাকতেন বিশিষ্ট চিত্রাভিনেত্রী সন্ধ্যারানি। স্থানীয় এক প্রতিবেশী মুসলমান পরিবারকে সন্ধ্যারানি আশ্রয় দিয়েছিলেন। তা জানতে পেরে কয়েক জন হিন্দু যুবক সন্ধ্যারানিকে হুমকি দেন, তাদের ছেড়ে না দিলে তিনিও আক্রান্ত হবেন। সন্ধ্যারানি মাথা নত করেননি। তিনি ওই হিন্দু যুবকদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাঁকে না মেরে তারা মুসলিম পরিবারটির কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তারপরেও হিন্দু দাঙ্গাবাজদের নিরস্ত করতে না পেরে তিনি বলেন— তোমরা বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। আমি ওদের বার করে দিচ্ছি। যা করার আমার চোখের আড়ালে করো। এখানে কিছু করতে দেব না। একথায় আশ্বস্ত হয়ে তারা বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। সেই সুযোগে সন্ধ্যারানির স্বামী অলোক চট্টোপাধ্যায় পিছনের দরজা দিয়ে মুসলমানদের বার করে দিয়ে বলেন, তারা যেন হসপিটাল রোড দিয়ে দৌড়ে আশ্রয় নেয় মুসলমান পাড়ায়। তারা সেটাই করে। হিন্দু দাঙ্গাবাজরা ধাওয়া করেও তাদের ধরতে পারেনি।
এরকম টুকরো টুকরো নানা মনুষ্যত্বের কাহিনি সেদিনও দাঙ্গার কলুষিত রূপের আড়ালে এক উজ্জ্বল দিনের ছবি এঁকেছিল। যেমন, ভবানীপুরে এক ব্রাহ্মণ একটি মুসলমান ছেলেকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। হিন্দু দাঙ্গাবাজরা ওই ব্রাহ্মণকে খুন করার চেষ্টা করলে তিনি পইতে ছুঁয়ে চিৎকার করেছিলেন— তোমরা এখুনি না পালালে আমি কিন্তু ব্রহ্মশাপ দেব। তোমরা কেউ বাঁচবে না। ভয় পেয়ে পালিয়েছিল যুবকরা।
শ্যামবাজারে হিন্দু মহাসভার নেতা দেবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে কয়েক জন মুসলমানকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে মুসলমানদের বাঁচিয়েছিলেন বিখ্যাত কমিউনিস্ট আইনজীবী স্নেহাংশু আচার্য, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, কবি বিষ্ণু দে, গুপ্ত প্রেসের মালিক অজয় বসু, সেসময় কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব চিন্মোহন মহলানবিশ, মণি সান্যাল। শিখ বাসিন্দা গুরুদয়াল সিং হিন্দু যুবকদের সঙ্গে নিয়ে গড়চা বস্তির প্রায় ২০০ মুসলমানকে বাঁচিয়েছিলেন দাঙ্গার আগুন থেকে। উল্টোডাঙায় এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক মুসলমান মহিলা।
কমিউনিস্ট নেতা ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, আবদুল মোমিন, মনসুর হবিবুল্লাহ্, সমর সেন আক্রান্তদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেরাই আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।
উলটো ঘটনারও অভাব ছিল না। অমানুষিক বর্বরতার নজির যেমন মুসলমানরা সৃষ্টি করেছিল শহর জুড়ে, তখনই কোথাও কোথাও কিছু কিছু মুসলমান ব্যক্তি বা পরিবার পরিত্রাতা হিসেবে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আক্রান্ত হিন্দুদের পাশেও।
মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাসকারী প্রতিবেশী হিন্দুদের পাশে রক্ষাকর্তা হিসেবে চরম মানবিক নজির রেখেছিলেন স্থানীয় মুসলমান পরিবারগুলিই। যেমন, লিনটন স্ট্রিটে বেশ কিছু হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল স্থানীয় মুসলমান দাঙ্গাবাজরা। পার্ক সার্কাসে আমির আলি অ্যাভিনিউতে কংগ্রেস নেতা জে সি গুপ্তর বাড়ি আক্রমণ করে মুসলিম যুবকরা। বাধা দেন স্থানীয় মুসলিমরাই। এন্টালিতে মুসলিম লিগ কাউন্সিলর মহম্মদ ইউসুফ নিজে উদ্যোগ নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৯৩ বছরের দিদি বর্ণকুমারী দেবীর। বেনিয়াপুকুরেও ৪৩টি হিন্দু পরিবারকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন প্রতিবেশী মুসলমানরাই। পার্ক সার্কাসে কমিউনিস্ট নেতা ডা. গনি এলাকার কয়েকটি ধোপা পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মির্জাপুরে টাওয়ার লজের বোর্ডিং হাউস আক্রান্ত হলে আক্রমণকারীদের উদ্যত শাবলের আঘাতের মুখেও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সালেহ্ আহমেদ।

১৭ অগাস্ট ১৯৪৬। শহর কলকাতার ব্যস্ততম এলাকা এসপ্ল্যানেড। ছবি সৌজন্য : ‘লাইফ’ পত্রিকা’
বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু এবং মুসলমান— দুই সম্প্রদায়ের মানুষই যৌথভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরোধিতা করেছিলেন তার নজিরও রয়েছে অনেক। দুই সম্প্রদায়ের যুবকরাই সম্মিলিতভাবে নিজেদের এলাকায় রাতপাহারা দিতেন। প্রত্যেকে থাকতেন সশস্ত্র যাতে আক্রমণ হলে যৌথভাবেই তা রোখা যায়। কংগ্রেস নেতা বিজয় সিং নাহার দাঙ্গা চলাকালীনই স্থানীয় মসজিদের ইমামকে সঙ্গে নিয়ে শান্তি মিছিল বার করেছিলেন। আবার, কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায়ের বাড়ি আক্রমণ হলে তা ঠেকিয়েছিলেন মুসলিম লিগ নেতা সামসুদ্দিন আহমেদ। কমিউনিস্ট পার্টি, আরএসপি, ডেমোক্র্যাটিক ভ্যানগার্ড এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতৃবৃন্দ ১৭ অগাস্ট ‘ভ্রাতৃহত্যা অবিলম্বে বন্ধ করার আবেদন’ জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন, নেতাজির মেজদা শরৎচন্দ্র বসু, সুরেন্দ্র ঘোষ, আবদুল হালিম, শাহিদ সুরাবর্দি, ভূপেশ গুপ্ত, ভবানী সেন, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার প্রমুখ বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এমনকী নারকেলডাঙায় তৎকালীন রেল শ্রমিক নেতা জ্যোতি বসু রেল শ্রমিকদের নিয়ে শান্তির আহ্বান জানিয়ে মিছিলের আয়োজন করেছিলেন। দক্ষিণ কলকাতায় দাঙ্গায় আটকে পড়া মুসলমান শ্রমিকদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল হিন্দু শ্রমিকরাই। শিয়ালদা ভিক্টোরিয়া কলেজের লেডিজ হোস্টেলে স্থানীয় মুসলমান গুন্ডারা বদ উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণ করলে রাজাবাজারের ট্রাম শ্রমিক রেজ্জাক, দোরবি, ইসাক প্রমুখ কলেজের গেট আটকে দাঁড়ান। পরে সেনাবাহিনীর সাহায্যে মেয়েদের উদ্ধার করে নিরাপদ এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। বেলগাছিয়ায় মুসলমান বস্তির ওপর আক্রমণকেও যৌথভাবে ঠেকিয়েছিল ট্রাম শ্রমিকরাই।
কমিউনিস্টদের মুখপত্র স্বাধীনতা পত্রিকা, বাটা মজদুর ইউনিয়ন, এআইটিইউসি, কমিউনিস্ট যুব সংগঠন ইত্যাদির পক্ষ থেকে শান্তির স্বপক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা নেওয়া হয়েছিল। শান্তি মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন বহু মসজিদের ইমামরাও
এ প্রসঙ্গে একটা তথ্য প্রকাশ করা জরুরি। এখন বহু হিন্দু সংগঠন ও সংগঠিত নেতা বলে থাকেন, কোনো মুসলিম লিগ নেতা দাঙ্গার নিন্দা করেননি। এই তথ্য সম্পূর্ণভাবে ঠিক নয়। একথা ঠিক, কোনো লিগ নেতাই দাঙ্গার প্রবল ক্ষতিকে আটকাতে পারেননি বা মানুষের প্রাণরক্ষা করতে পারেননি কারণ স্বয়ং সুরাবর্দির মদতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিনটি হিন্দু হত্যার দিনে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু, দাঙ্গা শুরুর পরদিনই ১৭ অগাস্ট লিগ প্রধান মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ বলেছিলেন: ‘I unreservedly condemn the acts of violence and deeply sympathise with those who have suffered.’ জিন্নাহ্র এই বিবৃতি ১৮ অগাস্ট অমৃতবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত হয়েছিল। এই বিবৃতি ‘কেবলমাত্র প্রহসন’ বলে হিন্দু নেতারা তীব্র সমালোচনা করলেও, বিস্ময়কর ব্যাপার জওহরলাল নেহরুসহ কোনো কংগ্রেস নেতাই দিল্লি থেকে সেদিন মুখে রা কাড়েননি। এমনকী মহাত্মা গান্ধীও মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন