উদাসী রাজকুমার – ১.১৪

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট এই গ্রামটির ওপর হঠাৎ যেন আছড়ে পড়ল ঝড়। প্রায় পঞ্চাশজন পাহাড়ি সৈন্য ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ঘিরে ধরল গ্রামটিকে। এই সৈন্যদের প্রত্যেকের হাতে ধারাল বর্শা, সেগুলোর ফলায় চকচক করছে রোদ। এই সৈন্যরা অতি নিষ্ঠুর প্রকৃতির। অস্ত্রের ভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা তারা বিশেষ বোঝে না। 

অর্ধেক সৈন্য ঘিরে রাখল গ্রামটিকে, যাতে একজনও পালাতে না পারে। আর অন্যরা ঘোড়া থেকে নেমে এক-একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। হুঙ্কার দিয়ে জানাল, “ভেতরে যারা আছো, সবাই বেরিয়ে এসো।” 

সৈন্যদের সেই উগ্রমূর্তি দেখে কেউ আর ভয়ে বেরোতেই চায় না! 

একজন সৈন্য একটা মশাল জ্বালল! তারপর সেই দাউদাউ করে জ্বলা মশাল উঁচু করে তুলে ধরে বলল, “এক্ষুনি যদি সবাই বেরিয়ে না আসো, তা হলে আগুন লাগাব সব ঘরে!” 

সারা গ্রামে একটা কান্নার রোল পড়ে গেল। 

গ্রামের বৃদ্ধ সর্দারের ঘরে রয়েছেন মহারানি তলতাদেবী, ওঝা এবং আরও কয়েকজন রয়েছে সেখানে। বাইরে থেকে একজন ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, সর্বনাশ হয়েছে। রাজার সৈন্যরা গ্রামের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে বলছে! 

ওঝা দরজার কাছ থেকে উঁকি মেরে দেখল সৈন্যদের। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কেন, ওরা আমাদের গ্রামে আগুন লাগাতে এসেছে কেন? আমরা কী দোষ করেছি?” 

যে-লোকটি খবর দিতে এসেছিল, সে বলল, “ওরা বলছে, ওদের তাঁবু থেকে একজন বন্দী পালিয়ে এসেছে। তাকে এক্ষুনি ফিরিয়ে দিতে হবে!” 

ওঝা বলল, “আমরা তো কোনও বন্দীকে এখানে আটকে রাখিনি। কী রে, এই গ্রামে কি কোনও বন্দী লুকিয়ে আছে?” 

সেই লোকটি বলল, “না!” 

তখন মহারানি তলতাদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমিই সেই বন্দী! ওরা আমাকেই খুঁজতে এসেছে!” 

ওঝা অবিশ্বাসের সুরে বলল, “আপনি? বন-দেবী রাজার সৈন্যদের হাতে বন্দী ছিলেন? তা কী করে সম্ভব? বন-দেবীকে কি কোনও মানুষ জোর করে আটকে রাখতে পারে?” 

তলতাদেবী বললেন, “তোমরা বিশ্বাস করোনি। আমি বন-দেবী নই। আমি এ রাজ্যের মহারানি!”

ওঝা দু’দিকে মাথা নেড়ে বলতে লাগল, “কিছুই বুঝতে পারছি না। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আপনি বন-দেবী নন, এ-রাজ্যের মহারানি? তা হলে রাজার সৈন্যরা আপনাকে বন্দী করবে কেন? মহারানিকে বন্দী করার সাধ্য কি কারও থাকতে পারে? আমরা শুনেছি, আমাদের মহারানির যেমন বুদ্ধি, তেমন সাহস।” 

তলতাদেবী বললেন, “ওরা রাজার সৈন্য নয়। ওরা বিদ্রোহী। সব কথা বুঝিয়ে বলার সময় নেই। এখন আমাকে পেলে ওরা আর ছাড়বে না। তোমাদের এখান থেকে পেছন দিক দিয়ে গোপনে বেরিয়ে যাবার কোনও পথ আছে?” 

ওঝা আর অন্য লোকেরা সবাই সবার মুখের দিকে তাকাল।

একজন বলল, “যদি পেছনের পাহাড়ের দিকে পৌঁছে দেওয়া যায়…”

অন্য একজন বলল, “কিন্তু সৈন্যরা যে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছে! তাদের চোখ এড়িয়ে যাওয়া যাবে কী করে?” 

তলতাদেবী বললেন, “আমাকে পথটা দেখিয়ে দাও, আমি কোনওক্রমে যাবার চেষ্টা করব। আমি এখানে থাকলে সৈন্যরা তোমাদের ওপর অত্যাচার করবে!” 

বৃদ্ধ সর্দার চোখে দেখতে পায় না বটে কিন্তু কানে সব শুনতে পায়। সে হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে বলল, “মহারানি! মহারানি! আমাদের দেশের মহারানি?” 

ওঝা বলল, “সর্দার, বিদ্রোহী সৈন্যরা মহারানিকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে!” সেই বৃদ্ধ অদ্ভুত তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “ওরে, তোরা কি পুরুষ? তোদের গায়ে রক্ত নেই? আমাদের মহারানি এসেছেন গ্রামে, আমাদের সামনে থেকে সৈন্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যাবে? তোরা আটকাতে পারবি না?” 

ওঝা বলল, “সৈন্যদের সঙ্গে আমরা লড়াই করব কী করে? আমাদের কাছে যে সেরকম অস্ত্র নেই!” 

বৃদ্ধ সর্দার বললেন, “লড়াই করতে না পারিস, মরতে তো পারিস? আমাদের প্রাণ থাকতে আমরা কিছুতেই মহারানিকে সৈন্যদের হাতে তুলে দেব না!” 

একজন গ্রামের লোক উত্তেজিতভাবে চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যাঁ, আমরা লড়ব! জান দেব তবু মান দেব না! আমাদের জ্যান্ত রেখে কেউ মহারানিকে ধরে নিয়ে যেতে পারবে না!” 

আরও অনেকে একসঙ্গে বলে উঠল, “হ্যাঁ, আমরা লড়ব! আমরা লড়ব!”

মহারানি তলতাদেবী হাত তুলে বললেন, “না!” 

সবাই চুপ করে গেল। 

.

তলতাদেবী সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। এরা সবাই নিরীহ, গ্রামবাসী। দুর্ধর্ষ পাহাড়ি সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে এরা কচু-কাটা হবে। শুধু শুধু এরা প্রাণ দেবে, তাতেও তলতাদেবী আত্মরক্ষা করতে পারবেন না। 

তিনি বললেন, “তোমরা যে আমাকে বাঁচাবার জন্য প্রাণ দিতে চেয়েছ, তাতেই আমি ধন্য হয়েছি। কিন্তু লড়াই করার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি একা সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলব!” 

বৃদ্ধ সর্দার কেঁদে-কেঁদে বলল, “মা, তোমার কোনও বিপদ হলে আমরা তা সইতে পারব না! আমাদের প্রাণ অতি তুচ্ছ, তোমার সম্মান আমরা নষ্ট হতে দেব না কিছুতেই।” 

তলতাদেবীরও চোখে জল এসে গেল। 

তিনি কান্না মুছে বললেন, “কোনও সৈন্য আমার গায়ে হাত দেবার সাহস পাবে না! আমি রাজধানীতে যদি পৌঁছতে পারি, তা হলে মহারাজকে সঙ্গে নিয়ে আবার একদিন এই গ্রামে ফিরে আসব।” 

তলোয়ারটা তুলে তিনি বেরিয়ে এলেন কুটিরের বাইরে। 

খানিকটা দূরের একটা কুটির থেকে সৈন্যরা ভেতর থেকে নারী ও শিশুদের জোর করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে বাইরে। একজন সৈন্য মশাল উঁচিয়ে হিংস্র কণ্ঠে বলছে, “কোথায় তাকে লুকিয়ে রেখেছিস, বল, বল! নইলে এক্ষুনি আগুন ধরিয়ে দেব!” 

মহারানি তলতাদেবী দৌড়ে গেলেন সেদিকে। 

সৈন্যদের কাছে গিয়ে বললেন, “থামো, থামো! আর অত্যাচার করবার দরকার নেই!” 

সৈন্যরা তলতাদেবীকেই খুঁজতে এসেছে, কিন্তু চোখের সামনে হঠাৎ তাঁকে দেখে এমনই অবাক হয়ে গেল যে, কথাই বলতে পারল না কয়েক মুহূর্ত! – 

তারপর একজন বলল, “এই তো সেই বন্দিনী! পালিয়ে এসেছে। ওরে, ধর! ধর!” 

তলতাদেবী কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “খবরদার, আমাকে কেউ স্পর্শ করবে না! আমি ধরা দিচ্ছি, তোমরা গ্রামের লোকেদের ছেড়ে দাও।” 

একজন সৈন্য এগিয়ে এসে বলল, “আমরা আপনার হাত বাঁধব।” 

তলতাদেবী বললেন, “আর একটুও এগোবে না! আমার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করলে আমি নিজের হাতে নিজের গলা কেটে ফেলব! তোমরা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারবে না! তোমাদের নেতা চম্পক কোথায়? তাকে ডাকো!” 

তখন কয়েকজন সৈন্য তলতাদেবীকে ঘিরে রইল। তিনি তলোয়ারটা নিজের গলার কাছে ঠেকিয়ে রাখলেন। কয়েকজন সৈন্য গেল চম্পককে ডেকে আনতে। 

একটু পরেই চম্পক এসে হাজির হল ঘোড়া ছুটিয়ে। 

সৈন্যদের বৃত্তটার কাছে এসে ঘোড়া থেকে নেমে সে ঠাট্টার সুরে বলল, “পালাতে পারলে না তা হলে? ধরা পড়ে গেলে শেষ পর্যন্ত!” 

তলতাদেবী এবার তলোয়ারটা ফেলে দিয়ে বললেন, “আমি স্বেচ্ছায় ধরা দিচ্ছি। নিরীহ গ্রামবাসীদের কোনও দোষ নেই, ওদের শাস্তি দিও না!” 

চম্পক বলল, “তলোয়ারটা ফেললে কেন? তুলে নাও। তুমি যে মহারানি? তুমি মহারানি হয়েই রাজধানীতে ফিরে যাবে।” 

সকল অধ্যায়

১. উদাসী রাজকুমার – ১.১
২. উদাসী রাজকুমার – ১.২
৩. উদাসী রাজকুমার – ১.৩
৪. উদাসী রাজকুমার – ১.৪
৫. উদাসী রাজকুমার – ১.৫
৬. উদাসী রাজকুমার – ১.৬
৭. উদাসী রাজকুমার – ১.৭
৮. উদাসী রাজকুমার – ১.৮
৯. উদাসী রাজকুমার – ১.৯
১০. উদাসী রাজকুমার – ১.১০
১১. উদাসী রাজকুমার – ১.১১
১২. উদাসী রাজকুমার – ১.১২
১৩. উদাসী রাজকুমার – ১.১৩
১৪. উদাসী রাজকুমার – ১.১৪
১৫. উদাসী রাজকুমার – ১.১৫
১৬. উদাসী রাজকুমার – ১.১৬
১৭. উদাসী রাজকুমার – ১.১৭
১৮. উদাসী রাজকুমার – ১.১৮
১৯. উদাসী রাজকুমার – ২.১
২০. উদাসী রাজকুমার – ২.২
২১. উদাসী রাজকুমার – ২.৩
২২. উদাসী রাজকুমার – ২.৪
২৩. উদাসী রাজকুমার – ২.৫
২৪. উদাসী রাজকুমার – ২.৬
২৫. উদাসী রাজকুমার – ২.৭
২৬. উদাসী রাজকুমার – ২.৮
২৭. উদাসী রাজকুমার – ২.৯
২৮. উদাসী রাজকুমার – ২.১০
২৯. উদাসী রাজকুমার – ২.১১
৩০. উদাসী রাজকুমার – ২.১২
৩১. উদাসী রাজকুমার – ২.১৩
৩২. উদাসী রাজকুমার – ২.১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন