উদাসী রাজকুমার – ১.১৩

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

জঙ্গলের ভেতরকার গ্রামবাসীদের বিভিন্ন দল রাত্তিরবেলা বেরিয়েছিল শিকার খুঁজতে। তাদের মধ্যে একটি দল সাক্ষাৎ পেয়েছিল মহারানি তলতাদেবীর। 

আর-একটি দলও ফিরছিল এই সময়ে। এই দলের মধ্যে রয়েছে গ্রামের ওঝা। এই ওঝাটি গ্রামের লোকদের রোগ-ভোগ হলে চিকিৎসা করে, ওদের নিজস্ব দেবতার পুজো করার ভারও তার ওপরে। তার সারা গায়ে উল্কি আঁকা, তার গলায় হলদে বাঘের দাঁত দিয়ে গাঁথা একটা মালা। তার মাথার চুল ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া, চোখ দুটো জবাফুলের মতন লাল। তার পরনে একটা ভাল্লুকের চামড়া। 

ওই ওঝাকে গ্রামের মানুষ যেমন ভক্তি করে, তেমন ভয়ও পায়। 

এই ওঝাদের দলটি আজ শিকার করেছে একটা শুয়োর আর দুটো খয়েরি রঙের খরগোশ। তারা আনন্দ করতে করতে ফিরছে, এমন সময় এক জায়গায় শুনতে পেল মানুষের গলার আওয়াজ। 

প্রথমে আড়াল থেকে লুকিয়ে তারা উঁকি মারল। তারপর মংরু আর হিংকাকে দেখল, এরা তাদেরই গ্রামের লোক। তখনও তারা মহারানি তলতাদেবীকে দেখতে পায়নি। সবাই মিলে একসঙ্গে ফেরা যাবে, এই ভেবে তারা ঝোপঝাড় ভেদ করে যেই কাছে চলে এল, অমনি তাদের চোখ গেল তলতাদেবীর দিকে। 

ওদের তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবাক হল ওঝা।

প্রথমে সে চেঁচিয়ে বলল, “কে? কে? ইনি কে?” 

তারপর বলল, “মা, আপনি সত্যি এলেন? সত্যি এলেন?” 

সেই ওঝা দড়াম করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। পাগলের মতন মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলতে লাগল, “মা, মা, মা! আজ কী ভাল দিন! আজ কী ভাল দিন!” 

মংরু আর হিংকা ধরতে যাচ্ছিল মহারানিকে, তারা ওঝার এই ব্যবহার দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। 

মহারানি তলতাদেবী ভাবলেন, এই ভাল্লুকের চামড়া পরা লোকটি নিশ্চয়ই তাকে চিনতে পেরেছে। যাক, তা হলে এবার নিশ্চিন্ত! এখন তাড়াতাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে। 

মাথা ঠুকতে-ঠুকতে ওঝা একবার মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “ওরে, সত্যি‍ই কি দেবী এসেছেন? নাকি আমি চোখে ভুল দেখছি! ওরে মংরু, ওরে হিংকা, তোরাও দেখতে পাচ্ছিস?” 

মংরু বলল, “হ্যাঁ গো, আমরাও একজনকে দেখছি। কিন্তু আমরা তো চিনি! না? ইনি কে?” 

ওঝা বলল, “তোরা চিনিস না! হায় রে পাপীর দল! ইনি তো সাক্ষাৎ বন-দেবী! আমি একদিন স্বপ্ন দেখেছিলাম, এই বনের মধ্যে সকালবেলা একদিন’ বন-দেবী আমাদের দেখা দেবেন। তাঁর হাতে থাকবে তলোয়ার। তাঁর দেখা পেলে আমাদের সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে! ওরে, আজ যা শিকার করেছিস, সব বন-দেবীর পায়ে পুজো দে!” 

অন্যরা ওঝার কথা শুনে সঙ্গে-সঙ্গে বিশ্বাস করে ফেলল। শুয়োর, খরগোশ, হরিণ সব এনে রাখল মহারানি তলতাদেবীর পায়ের কাছে। 

মহরানি আবার চিন্তায় পড়লেন। এ যে নতুন ঝামেলা। এই গ্রামবাসীরা তাঁকে কোনও ঠাকুর-দেবতা বলে ভেবেছে। এখন তো এরা সহজে ছাড়তে চাইবে না। 

মহারানির কাছে এসে ওঝা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে বলল, “মা, আমরা এই জঙ্গলের মানুষ। এতকাল এই জঙ্গলে শান্তিতে থেকেছি। এখানে শিকার করি, জঙ্গলের ফলমূল খাই। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে সৈন্যরা এখানে এসে তাঁবু ফেলেছে। তারা আমাদের ওপর অত্যাচার করে। আমাদের জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। মা, এই সৈন্যদের হাত থেকে আমাদের বাঁচান।”

তলতাদেবী ভাবলেন যে এখন আর নিজেকে মহারানি বলে পরিচয় দিয়ে কোনও লাভ নেই। এরা তাঁকে বন-দেবী বলে ধরে নিয়েছে, সেটাই চলুক। 

তিনি হাত তুলে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “এই সৈন্যরা দু’-একদিনের মধ্যেই চলে যাবে। তোমাদের ওপর আর কেউ অত্যাচার করবে না!” 

অনেকে একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলে উঠল, “জয় মা বন-দেবী। জয় মা বন-দেবী!” 

মংরু বলল, “এই, অত জোরে চিৎকার করিসনি। সৈন্যরা শুনতে পাবে। সৈন্যরা আমাদের কথা টের পেয়ে যাবে।” 

ওঝা তাকে ধমক দিয়ে বলল, “দূর বোকা! এখন স্বয়ং বন-দেবী আমাদের সঙ্গে রয়েছেন, এখন সৈন্যরা আমাদের কী করবে? সৈন্যরা এলে বন-দেবী তাদের কচুকাটা করবেন ওই তলোয়ারে!”

তলতাদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আসল ব্যাপারটা এদের বোঝাবার কোনও উপায় নেই। এখন চম্পকের সৈন্যরা এসে পড়লে মহা বিপদ! এর মধ্যে কি তাঁর খোঁজ পড়েনি? চম্পক জেগে উঠলেই তাঁর খোঁজ করবে। তলতাদেবী : ওঝাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের গ্রামে ঘোড়া আছে?” 

হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে ওঝা বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল, “ঘোড়া? হ্যাঁ, আমাদের গ্রামে দুটি ঘোড়া আছে। ঘোড়া দিয়ে কী হবে দেবী?” 

তলতাদেবী বললেন, “চলো, তোমাদের গ্রামে চলো!” 

ওঝা চোখ বড়-বড় করে বলল, “আমাদের গ্রামে যাবেন আপনি? সত্যি যাবেন? আমাদের কি এত সৌভাগ্য হবে?” 

তলতাদেবী বললেন, “হ্যাঁ, আমি তোমাদের গ্রামটা একবার দেখব।”

ওঝা আর অন্য গ্রামবাসীরা গোল হয়ে ঘিরে রইল তলতাদেবীকে। তারপর তারা এগিয়ে চলল গভীর জঙ্গলের দিকে। 

ওঝা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তলতাদেবীর দিকে। তার ধারণা বন-দেবী হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাবেন। 

চম্পকের সৈন্যদের তাঁবুগুলো থেকে যত দূরে সরে থাকা যায় ততই ভাল। তলতাদেবী দ্রুত পায়ে হেঁটে সেই লোকগুলির সঙ্গে চলে এলেন তাদের গ্রামে। 

জঙ্গলের মধ্যে, একটা ছোট পাহাড়ের গায়ে এই গ্রাম। সমস্ত বাড়িই গাছের ডাল-পালা আর পাতা দিয়ে তৈরি। কয়েকটা গোরু-ছাগল চরছে এদিক-ওদিকে। একটা ভারী সুন্দর, চকচকে ঝকঝকে ঝরনা বয়ে যাচ্ছে সেই গ্রামের মাঝখান দিয়ে। কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে মহানন্দে স্নান করছে সেই ঝরনায় নেমে। 

মহারানিকে দেখার জন্য গ্রামের মেয়ে-পুরুষ-বুড়োরা ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে এল। এরকম ফরসা, দামি সাজ-পোশাক পরা কোনও মহিলাকে তারা কেউ কখনও দেখেনি। 

ওঝা জয় বন-দেবী বলে ধ্বনি দিতেই সবাই গলা মেলাল। কয়েকজন প্রণাম জানাল মাটিতে শুয়ে পড়ে। 

ওঝা বলল, “ওরে আমাদের কী সৌভাগ্য, স্বয়ং বন-দেবী এসেছেন আমাদের গ্রামে। আজ এখানে বন-দেবীর পুজো হবে। আমাদের সব বিপদ কেটে যাবে।” 

মহারানি তলতাদেবী দেখলেন, একটু দূরে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা আছে দুটো ঘোড়া। বেশ তেজী চেহারা। দুটোই খয়েরি রঙের, একটার গায়ে একটু সাদা ছিট-ছিট। তলতাদেবী সব সময় সাদা ঘোড়া পছন্দ করেন। তিনি এগিয়ে গিয়ে সাদা ছিট-ছিট ঘোড়ার গায়ে আদরের চাপড় মারলেন। 

তলতাদেবীর সঙ্গে-সঙ্গে একদল মেয়ে-বুড়োও চলে এল সেই গাছতলায়। গ্রামের অন্য মেয়েরা তাঁর দিকে হাঁ করে দেখছে, কেউ কোনও কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। 

মহারানি ওঝাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, “তোমাদের গ্রামের যাতে কোনও বিপদ না হয়, তা আমি অবশ্যই দেখব। এখন একটা কাজের কথা শোনো। এখান থেকে রাজধানীতে যাবার যে রাস্তা, সেই রাস্তা তুমি চেনো?” 

ওঝা বলল, “দেবী, আমরা তো কখনও রাজধানীতে যাইনি। তবে এই জঙ্গলের উত্তর দিকে গেলে একটা পাকা সড়ক আছে। সেই সড়ক ধরে গেলে রাজধানীতে পৌঁছনো যায় শুনেছি।” 

মহারানি বললেন, “আমাকে এক্ষুনি একবার রাজধানীতে যেতে হবে। তোমাদের গ্রাম থেকে একটা ঘোড়া আমাকে ধার দাও।” 

ওঝা বেশ হকচকিয়ে গেল। তার ধারণা, বন-দেবী যখন-তখন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন। এই সব দেব-দেবীরা যাওয়া-আসা করেন আকাশ-পথে। এঁদের আবার ঘোড়া লাগে নাকি? 

মহারানি আবার বললেন, “তোমাদের একটা ঘোড়া আমাকে ধার দাও! আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে!” 

ওঝা তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়ে বলল, “ধারের কথা কী বলছেন, দেবী! এই গ্রামের যা-কিছু আছে, তা সবই আপনার, আমি স্বপ্নে দেখেছি, একদিন বন-দেবী এসে আমাদের সব দুঃখ দূর করে দেবেন। আমার সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু দেবী, আপনি এক্ষুনি যাবেন কেন? আপনার পুজো দিয়ে আমরা ধন্য হব!” 

মহারানি বললেন, “এখন তার সময় নেই। আমি তোমাদের এমনিই আশীর্বাদ করছি।” 

ওঝা বলল, “দেবী, অন্তত একটু দয়া করুন। আমাদের গ্রামের সর্দার খুব বৃদ্ধ আর অসুস্থ। আমি চিকিৎসা করে তাকে সারাতে পারিনি। সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। সে কি আপনার দর্শন পাবে না?” 

মহারানি অস্থির ভাবে বললেন, “পরে আবার আমি আসব। আমাকে এক্ষুনি চলে যেতে হবে!”

ওঝা বলল, “বেশি সময় লাগবে না। ওই তো কাছেই ঝরনার ধারে। একবার দয়া করে চলুন।” 

আরও পাঁচ-ছ’ জন লোক ওই একই কথা বলতে লাগল। দু’-তিনটি বাচ্চা টানাটানি করতে লাগল মহারানির হাত ধরে। 

মহারানিকে রাজি হতেই হল। তিনি জোরে জোরে হাঁটতে লাগলেন, একটা বড় দল চলল তাঁর সঙ্গে। 

একটা কুটিরের সামনে এসে ওঝা বলল, “আসুন দেবী, এইখানে।” 

ঘরের ভেতরটা এই সকালবেলাতেও অনেকটা অন্ধকার। একটা খাটিয়ার ওপর শুয়ে আছে এক বৃদ্ধ। মাথায় সাদা ধপধপে চুল। শরীরের সব হাড়-পাঁজরা বেরিয়ে গেছে। নিশ্বাস ফেলছে জোরে-জোরে। 

এত লোকের পায়ের আওয়াজ শুনে বৃদ্ধ বলল, “কে? কে?” 

ওঝা বলল, “সর্দার, দ্যাখো, কে এসেছেন! আমাদের জীবন ধন্য হয়ে গেল। বন-দেবী আমাদের দেখা দিয়েছেন?” 

বৃদ্ধ চেষ্টা করেও চোখ মেলতে পারল না। একটা দুর্বল হাত তুলে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে এসেছে বললি? কোন দেবী?” 

ওঝা বলল, “বন-দেবী! স্বয়ং বন-দেবী। আর কোনও চিন্তা নেই, উনি ছুঁয়ে দিলেই তুমি সেরে উঠবে।” 

বৃদ্ধ হাত দিয়ে বন-দেবীকে খোঁজার চেষ্টা করল। মহারানি তার সেই হাতখানি চেপে ধরলেন। 

বৃদ্ধ এখনও চোখ খুলতে পারছে না। কিন্তু তার দু’ চোখের কোণ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। সে বলল, “আঃ কী সুন্দর গন্ধ! বন-দেবী! সত্যিই বন-দেবী এসেছেন আমাদের মতন এই অভাগাদের গ্রামে?” 

মহারানি কম্পিত গলায় বললেন, “না, সর্দার। আমি বন-দেবী নই। আমি এ রাজ্যের মহারানি, মহারাজ মহাচূড়ামণির পত্নী। আমি প্রার্থনা করব, যাতে তোমার রোগের কষ্ট দূর হয়ে যায়। তুমি ঠিক আবার সেরে উঠবে!” 

এই সময় বাইরে তুমুল একটা হই-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। শোনা গেল খটাখট খটাখট অনেক ঘোড়ার পায়ের শব্দ। 

সকল অধ্যায়

১. উদাসী রাজকুমার – ১.১
২. উদাসী রাজকুমার – ১.২
৩. উদাসী রাজকুমার – ১.৩
৪. উদাসী রাজকুমার – ১.৪
৫. উদাসী রাজকুমার – ১.৫
৬. উদাসী রাজকুমার – ১.৬
৭. উদাসী রাজকুমার – ১.৭
৮. উদাসী রাজকুমার – ১.৮
৯. উদাসী রাজকুমার – ১.৯
১০. উদাসী রাজকুমার – ১.১০
১১. উদাসী রাজকুমার – ১.১১
১২. উদাসী রাজকুমার – ১.১২
১৩. উদাসী রাজকুমার – ১.১৩
১৪. উদাসী রাজকুমার – ১.১৪
১৫. উদাসী রাজকুমার – ১.১৫
১৬. উদাসী রাজকুমার – ১.১৬
১৭. উদাসী রাজকুমার – ১.১৭
১৮. উদাসী রাজকুমার – ১.১৮
১৯. উদাসী রাজকুমার – ২.১
২০. উদাসী রাজকুমার – ২.২
২১. উদাসী রাজকুমার – ২.৩
২২. উদাসী রাজকুমার – ২.৪
২৩. উদাসী রাজকুমার – ২.৫
২৪. উদাসী রাজকুমার – ২.৬
২৫. উদাসী রাজকুমার – ২.৭
২৬. উদাসী রাজকুমার – ২.৮
২৭. উদাসী রাজকুমার – ২.৯
২৮. উদাসী রাজকুমার – ২.১০
২৯. উদাসী রাজকুমার – ২.১১
৩০. উদাসী রাজকুমার – ২.১২
৩১. উদাসী রাজকুমার – ২.১৩
৩২. উদাসী রাজকুমার – ২.১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন