উদাসী রাজকুমার – ১.১১

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সারারাত নিদ্রাহীন ভাবে কাটালেন মহারানি তলতাদেবী। তাঁর হাত ও পা শিকল দিয়ে বাঁধা। এই অবস্থায় ঘুম আসার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। একটু নড়াচড়া করলেই শিকলের ঝনঝন শব্দ হচ্ছে। তাঁর দু’চোখে জ্বলছে ক্রোধের আগুন। 

ভয় কাকে বলে তা তলতাদেবী জানেনই না। তিনি হতাশাতেও ভেঙে পড়েননি। তিনি মনে-মনে জানেন, যে-কোনও উপায়ে এখান থেকে উদ্ধার পেতেই হবে। তারপর চম্পকের ওপর চরম প্রতিশোধ নেবেন। 

শুধু তাঁর চিন্তা হচ্ছে দুই ছেলের জন্য। 

রাজকুমার দৃঢ় এবং তীক্ষ্ণ সারাদিন মাকে দেখেনি। রাত্তিরে খাওয়ার আগে- তারা মায়ের সঙ্গে গল্প করে। আজ তারা নিশ্চয়ই মাকে খুঁজেছে। রাজপ্রাসাদের মধ্যে ওদের বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই অবশ্য। তবু মাকে না দেখে ওরা তো কখনও পুরো একটা দিন থাকেনি! 

মহারাজ মহাচূড়ামণি কখন ঘুম থেকে জাগবেন তার ঠিক নেই। জেগে উঠে তিনি যখন শুনবেন মন্ত্রী জীবক কারাগারের মধ্যেই নিহত হয়েছেন, তখন তিনি দারুণ রেগে উঠবেন তো বটেই, রাগের চোটে অন্য কাকে যে কী শাস্তি দেবেন, তার ঠিক নেই। 

মহারানি যে গোপনে চম্পকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, সে-কথা রাজপুরোহিত ছাড়া আর কেউ জানে না। 

রাজপুরোহিত ছম্ভী অবশ্যই যথাসময়ে খবরটি জানাবেন মহারাজকে। সব বুঝিয়ে বলবেন! কিন্তু মহারানি সকালে বেরিয়েও সন্ধের পর রাজধানীতে ফিরতে পারলেন না, এর কী ব্যাখ্যা দেবেন ছম্ভী? 

চম্পক বিদ্রোহ করেছে, একথা শুনলেই মহারাজ জ্বলে উঠবেন। সৈন্য নিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে বেরিয়ে পড়বেন বিদ্রোহ দমন করতে। ঝড়ের মুখে তৃণখণ্ডের মতন মহাচূড়ামণির সামনে চম্পকের বাহিনী এক নিমেষে উড়ে যাবে। আজ দুপুরের মধ্যেই মহারানি মুক্ত হবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এবার চম্পক তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেও তাকে আর ক্ষমা করা হবে না। রাজপথে, প্রজাদের সামনে চম্পক মৃত্যু বরণ করবে। 

কিন্তু চম্পক গূঢ় হেসে কাল বলেছিল, সে এমন কৌশল করেছে যে, মহাচূড়ামণি তাকে আক্রমণ করতে সাহস পাবেন না। কী সেই কৌশল? মহারাজ কোনও বাধাই গ্রাহ্য করবেন না। এমনকী মহারাজ কাছাকাছি এসে পৌঁছলে চম্পক যদি মহারানির গলায় তলোয়ার ঠেকিয়ে তাঁকে খুন করে ফেলার ভয় দেখায়, তা হলে কি মহারাজ থমকে যাবেন? 

না, না, দেশের জন্য মহারানির জীবনও তুচ্ছ। দেশকে রক্ষা করার জন্য মহারানি এখনই নিজের প্রাণদান করতে রাজি আছেন। 

মহারাজের কাছে কোনওক্রমে যদি একটা বার্তা পাঠানো যেত! 

কাল সারাদিন এবং সারারাত মহারানি তলতাদেবী কোনও খাদ্যদ্রব্য মুখে দেওয়া তো দূরের কথা, এক বিন্দু জলও পান করেননি। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না! 

নিজের অজান্তেই তিনি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, “জল! জল!” 

অমনি একজন প্রহরী তাঁবুর দরজার কাছে উঁকি মারল। তার হাতে একটা জলের পাত্র। মহারানি কখন জল চাইবেন, সেজন্য যেন সে তৈরি হয়েই ছিল। 

লোকটি ভেতরে এসে জলের পাত্রটি নামিয়ে রাখল মহারানির সামনে।

তলতাদেবী লোকটির চোখের দিকে চোখ রেখে বললেন, “মূর্খ, আমার হাত বাঁধা। জল খাব কী করে? হাতের শিকল খুলে দাও!” 

প্রহরীটি পাহাড়ি জাতের লোক। রাজধানীর ভাষা সে ভাল বোঝে না। সে মাথা নাড়ল দু’ দিকে। 

তলতাদেবী বললেন, “তা হলে ওই জল নিয়ে যাও!” 

প্রহরীটি এবার নিজে জলের পাত্রটি ধরে নিয়ে এল তলতাদেবীর মুখের দিকে। 

তলতাদেবী মাথা সরিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত চোখে বললেন, “খবরদার! জানো না,এ রাজ্যের মহারানি অন্য কারও হাতে জল পান করেন না!” 

সেই কণ্ঠস্বর শুনে যে-কোনও মানুষই ভয় পাবে। প্রহরীটির হাত কেঁপে উঠল। সে জলের পাত্রটি নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল তাঁবু থেকে। 

একটু পরেই সে ডেকে আনল আর একজনকে। এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটিকে তলতাদেবী চেনেন। এর নাম ভাটু, এ চম্পকের সর্বক্ষণের সহচর। চম্পকের সঙ্গে এই ভাটুকে কয়েকবার দেখেছেন তলতাদেবী। 

তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে ভাটু বলল, “আপনি জল পান করবেন না, মহারানি?”

তলতাদেবী বললেন, “তুই জানিস না, রাজা-রানিরা কখনও অন্যের হাত থেকে জল খান না!” 

ভাটু বলল, “এতক্ষণ জল না খেয়ে রয়েছেন। আপনার শরীর খারাপ হবে।”

তলতাদেবী বললেন, “জলের পাত্রটা নিয়ে যা এখান থেকে। আমার জল চাই না!” 

ভাটু বলল, “আপনি মুখ ফুটে একবার জল চেয়েছেন। তবু আপনাকে জল না খাওয়ালে আমাদের নতুন রাজা রাগ করবেন।” 

তলতাদেবী ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, “নতুন রাজা? বিশ্বাসঘাতক হবে রাজা! তোদের চম্পক রাজা হলে, তুই বুঝি সেনাপতি হবি?” 

ভাটু অন্য প্রহরীটিকে বলল, “এই, ওঁর হাতের শিকল খুলে দাও, আমি পাহারা দিচ্ছি!” 

ভাটু তার কোমর থেকে তলোয়ার খুলে নিয়ে দাঁড়াল। পাহাড়ি প্রহরীটি নিজের অস্ত্রটা মাটিতে নামিয়ে রেখে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর মহারানির হাতের শিকলের বন্ধন মুক্ত করে দিল। 

তলতাদেবী বললেন, “পায়ের শিকলও খুলে দাও? আমার পায়ে ঝিঝি ধরে গেছে। আমি উঠে দাঁড়াব।” 

পাহাড়ি সৈনিকটি ঘাড় ঘুরিয়ে ভাটুর দিকে তাকাল। 

ভাটু বলল, “ঠিক আছে, পায়ের বাঁধনটাও খুলে দাও। আমি তো আছি এখানেই। উনি পালাবেন কোথায়!” 

পাহাড়ি প্রহরীটি পায়ের শিকলও খুলে দিল। 

তলতাদেবী পিতলের তৈরি ভারী জলের পাত্রটি তুলে নিলেন দু’ হাতে। মুখের কাছে এনে ঢকঢক করে জল পান করতে লাগলেন। দু’জন পুরুষ এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল তাঁর সেই জল খাওয়া। 

একটুখানি জল পান করেই তলতাদেবী সেই ভারী পাত্রটা হঠাৎ ছুঁড়ে মারলেন পাহাড়ি প্রহরীটির মাথা লক্ষ্য করে। সে লোকটি আঁক করে একটা শব্দ করেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। 

চোখের নিমেষে তার তলোয়ারটি তুলে নিয়ে তলতাদেবী উঠে দাঁড়ালেন!

ভাটু তাঁবুর মধ্যে ঢুকে এল। নিষ্ঠুরভাবে হেসে বলল, “এই ভাবে কি পালাতে পারবেন, রানিমা? আপনি আমার শক্তি জানেন না! কেন মিছিমিছি ঝঞ্ঝাট করছেন, আপনার অস্ত্রটা ফেলে দিন।” 

তলতাদেবীও হাসলেন। এই ভাটু স্ত্রীলোক বলে তাঁকে অবজ্ঞা করছে। এ লোকটা জানে না যে, এক সময় তিনি সমস্ত রকম অস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন। 

তিনি তলোয়ারটা তুলে বললেন, “বিশ্বাসঘাতকতা করে সেনাপতি হবার লোভ হয়েছে, তাই না? দেখি তোর যোগ্যতা আছে কি না!” 

তলতাদেবীর তলোয়ারের এক আঘাত প্রতিরোধ করেই ভাটু চমকে উঠল। একজন নারীর এতখানি জোর! 

মাত্র একটুক্ষণ লড়াই করেই ভাটুর হাত থেকে অস্ত্র ছিটকে পড়ল। সে সেটা আবার কুড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতেই তলতাদেবী পা দিয়ে চেপে ধরলেন। তারপর ভাটুর ঘাড়ে তলোয়ারের ডগাটা ঠেকিয়ে বললেন, “এবার শেষ করে দিই?” 

ভাটু হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “আমাকে দয়া করুন, এবারের মতন ক্ষমা করুন!” 

তলতাদেবী বললেন, “কাপুরুষরা বিপদে পড়লেই ক্ষমা চায়। তোর মতন পাপীদের মৃত্যুদণ্ডই উচিত শাস্তি। কিন্তু আমি নিজের হাতে এক্ষুনি তোকে মারতে চাই না। তুই টু শব্দটি করবি না। গা থেকে জামাটা খুলে ফ্যাল। আমি যা বলছি শুনবি। একটু এদিক-ওদিক করলেই তোর গলার নলি কেটে দেব!” ভাটু নিজের জামাটা খুলে ফেলতেই তলতাদেবী তাকে আবার বললেন তার হাত দুটো মাথার ওপর তুলতে। 

তারপর সেই হাত দুটোতে তিনি শক্ত করে শিকল বাঁধলেন। ভাটুর জামাটার খানিকটা অংশ ভরে দিলেন তার মুখের মধ্যে। পা দুটিও বাঁধলেন। 

তারপর সরে এসে বললেন, “এবার দ্যাখ, শিকল বাঁধা অবস্থায় থাকতে কেমন লাগে! তুই চ্যাঁচাতেও পারবি না!” 

পাহাড়ি সৈন্যটি এখনও অজ্ঞান হয়ে আছে। 

তলোয়ারটা হাতে নিয়ে তলতাদেবী খুব সাবধানে উঁকি মারলেন তাঁবুর বাইরে। 

কাছাকাছি আর কোনও মানুষজন নেই। চম্পকের বোধহয় ঘুম ভাঙেনি। কিন্তু ভোরের আলো ফুটে গেছে। পেছনের জঙ্গলে ডাকাডাকি করছে অনেক পাখি। 

তাঁবুর বাইরে পা দিয়ে তলতাদেবী বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন একবার। আঃ, কী আরাম! স্বাধীনতার স্বাদ এত সুন্দর! জীবনে এই প্রথম তিনি এক রাত্রি বন্দিনী ছিলেন। তাতেই এত কষ্ট! 

সামনের দিকে অনেক প্রহরী থাকবেই। পেছনে জঙ্গলের দিকে প্রহরীরা আছে কি না কে জানে! তলতাদেবী খুব সন্তর্পণে পেছন দিকেই যেতে শুরু করলেন। সূর্যের আলো দেখে বুঝলেন, এটাই পূর্ব দিক। তাঁকে যে-কোনও উপায়ে পৌঁছতেই হবে রাজধানীতে। 

সকল অধ্যায়

১. উদাসী রাজকুমার – ১.১
২. উদাসী রাজকুমার – ১.২
৩. উদাসী রাজকুমার – ১.৩
৪. উদাসী রাজকুমার – ১.৪
৫. উদাসী রাজকুমার – ১.৫
৬. উদাসী রাজকুমার – ১.৬
৭. উদাসী রাজকুমার – ১.৭
৮. উদাসী রাজকুমার – ১.৮
৯. উদাসী রাজকুমার – ১.৯
১০. উদাসী রাজকুমার – ১.১০
১১. উদাসী রাজকুমার – ১.১১
১২. উদাসী রাজকুমার – ১.১২
১৩. উদাসী রাজকুমার – ১.১৩
১৪. উদাসী রাজকুমার – ১.১৪
১৫. উদাসী রাজকুমার – ১.১৫
১৬. উদাসী রাজকুমার – ১.১৬
১৭. উদাসী রাজকুমার – ১.১৭
১৮. উদাসী রাজকুমার – ১.১৮
১৯. উদাসী রাজকুমার – ২.১
২০. উদাসী রাজকুমার – ২.২
২১. উদাসী রাজকুমার – ২.৩
২২. উদাসী রাজকুমার – ২.৪
২৩. উদাসী রাজকুমার – ২.৫
২৪. উদাসী রাজকুমার – ২.৬
২৫. উদাসী রাজকুমার – ২.৭
২৬. উদাসী রাজকুমার – ২.৮
২৭. উদাসী রাজকুমার – ২.৯
২৮. উদাসী রাজকুমার – ২.১০
২৯. উদাসী রাজকুমার – ২.১১
৩০. উদাসী রাজকুমার – ২.১২
৩১. উদাসী রাজকুমার – ২.১৩
৩২. উদাসী রাজকুমার – ২.১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন