উদাসী রাজকুমার – ১.২

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রানি তলতাদেবী ঘোড়ায় চড়া শিখেছিলেন খুব ছোটবেলা থেকেই। তিনি তীর-ধনুক, তলোয়ার, বর্শা প্রভৃতি অস্ত্র চালনাও শিখেছেন। তাঁর বিয়ের আগে, তাঁর পিতার রাজ্যে তিনি পোশাক পরতেন ছেলেদের মতন। রাজবাড়ির অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে তিনি একজন গুরুর কাছে সব রকম শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তার কারণ, তলতাদেবীর পিতা ভল্লদেবের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। রাজা-রানির ছিল ওই একটি মাত্র কন্যা। সুতরাং ভল্লদেব ঠিক করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর মেয়েই সিংহাসনে বসবে। 

পনেরো বছর বয়েস পর্যন্ত তলতাদেবী জানতেন যে ভবিষ্যতে তাঁকেই পিতার রাজ্য চালাতে হবে। তিনি সেই কাজের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলছিলেন। কিন্তু এই সময় হঠাৎ তাঁর একটি ভাই জন্মাল। অমনি বদলে গেল সব কিছু। রাজা-রানির কাছ থেকে তলতাদেবী যতখানি আদর পেতেন, তার অনেকখানিই চলে গেল নতুন শিশুটির দিকে। শুধু তাই নয়, রাজা আদেশ দিলেন, তলতাদেবীকে ছেলেদের পোশাক ছেড়ে মেয়েদের পোশাক পরতে হবে, তিনি আর রাজপুরীর বাইরে যেতে পারবেন না। সব দেশেই কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্রসন্তানের কদর বেশি। রাজ্য চালাবার সব রকম যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন তলতাদেবী, তবু একটি পুত্রসন্তান জন্মানোমাত্রই ঘোষণা করে দেওয়া হল যে, সে-ই হবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। 

সেই সময় খুব দুঃখ আর অভিমান হয়েছিল তলতাদেবীর। তাঁকে তাঁর ছোটভাইয়ের কাছেও যেতে দেওয়া হত না। রাজা ভল্লদেবের সন্দেহ হয়েছিল তলতাদেবী হয়তো ছোট ভাইটিকে মেরে ফেলে আবার সিংহাসন দাবি করবেন। তাই তিনি খুব তাড়াতাড়ি রাজকন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। ছোট ভাইটি জন্মাবার ছ’ মাসের মধ্যে তলতাদেবীর বিয়ে হয়ে গেল অহিচ্ছত্রপুরের রাজা মহাচূড়ামণির সঙ্গে। 

তলতাদেবীর সেই ছোট ভাইটিও কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজত্ব করতে পারেনি। কুমার যশস্করের যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়েস, তখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। জন্ম থেকেই যশস্কর বেশ দুর্বল আর রুণ। অত্যধিক আদর-যত্নে রেখে তাকে আরও দুর্বল করে তোলা হচ্ছিল। পাঁচ বছর বয়েসে পৌঁছে একদিন সে রাজপ্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল হঠাৎ। তাতে গুরুতর চোট লাগল তার মাথায়। রাজবৈদ্যরা হাজার চেষ্টা করেও সেই শিশুটিকে বাঁচাতে পারল না। তিনদিন পরেই সেই হতভাগ্য রাজকুমার প্রাণ হারাল। 

সেই শোকে রাজা ভল্লদেবও আর বেশিদিন বাঁচলেন না। চার মাসের মধ্যে তিনিও ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন। তখন সেই রাজ্যে দেখা দিল দারুণ বিশৃঙ্খলা। মন্ত্রী, সেনাপতি সিংহাসন দখল করার জন্য লড়াই শুরু করলেন। সেইসব সংবাদ তলতাদেবীর কানে আসায় তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন। তাঁর প্ররোচনায় তাঁর স্বামী মহাচূড়ামণি আক্রমণ করলেন শ্বশুরের রাজ্য। সেখানকার অরাজকতার সুযোগ নিয়ে মহাচূড়ামণি অল্পদিনেই যুদ্ধে জয়ী হলেন। সেই রাজ্যটি জুড়ে গেল উত্তর পাঞ্চাল রাজ্যের সঙ্গে। তলতাদেবী তাঁর পিতৃরাজ্য ফিরে পেলেন বটে, কিন্তু সিংহাসনে বসার অধিকার তাঁর স্বামীর। 

রানি হয়ে এসে তলতাদেবী কিন্তু শুধু রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে আবদ্ধ থাকেননি। রাজধানী অহিচ্ছত্রপুরের সর্বত্র তিনি রথে চড়ে ঘোরেন, প্রজাদের খোঁজ-খবর নেন। ঘোড়ায় চড়ার অভ্যেসটিও তিনি রেখে ছিলেন। কখনও কখনও তিনি রথের বদলে ঘোড়া ছুটিয়েও দূর-দূর জায়গায় যান। রাজার সঙ্গে শিকার করতে গিয়ে তিনি নিজেও তীর ছোঁড়েন। একবার রাজার সঙ্গে বাজি রেখে তিনি রাজার আগেই নিজের তীরে একটি বন্য শূকর বধ করেছিলেন। 

রাজধানী অহিচ্ছত্রপুরের দিকে যখন ভয়ঙ্কর দাবানল ধেয়ে আসছে, তখন সেই দাবানল নেভাবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে রানি তলতাদেবী একটি সাদা রঙের ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। সঙ্গে নিলেন বাছাইকরা দশজন অত্যন্ত সাহসী সৈনিক। দাবানলের গতি যে কখনও রোধ করা যায়, তা কেউ এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। গ্রীষ্মকালে অরণ্যের শুকনো গাছে-গাছে ঘর্ষণ লেগে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরোয়। সেই স্ফুলিঙ্গ থেকে নীচের লতাপাতায় আগুন ধরে যায়। তারপর সেই আগুন বাড়তে থাকে। ক্রমশ সেই আগুন বড়-বড় গাছপালাকেও গ্রাস করে। তারপর বাতাসের গতি যেদিকে থাকে, সেদিকেই সেই বিশাল আগুন ধেয়ে চলে। আগেরবার এই দাবানল বহু গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে, রাজধানীটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, আরও অনেক দূর পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গানদীর কিনারে থেমেছিল শেষ পর্যন্ত। 

রানির এরকম একটা অসম্ভব প্রস্তাব শুনেও বাধা দিলেন না বটে রাজা, কিন্তু রানিকে একা ছেড়ে দিতেও সাহস পেলেন না। বিরাট বিপদের আশঙ্কায় তাঁর ঘুম একেবারে ছুটে গেছে। তিনিও মন্ত্রী ও অমাত্যদের নিয়ে চললেন রানির সঙ্গে। শুধু সেনাপতি চম্পককে সঙ্গে নিলেন না, চম্পক তো আর সেনাপতি নেই, সে এখন থেকে পাদুকাবহনকারী ভৃত্য। 

সাদা শাড়ি পরা রানি তলতাদেবী সাদা ঘোড়ায় চেপে সকলের আগে ছুটছেন ঝড়ের বেগে। 

রাজধানীর পশ্চিম দিকে মাত্র সাতটি গ্রাম, তারপরেই অরণ্য। তারপর হিমালয়। এদিকে আছে একটি মাত্র ছোট নদী। তা এই পাহাড়ি নদীতে বর্ষাকালে প্রবল জলস্রোত থাকে বটে, কিন্তু শীত-গ্রীষ্মে শুকিয়ে একেবারে খটখটে। কোথাও জলের একটু রেখাও নেই। প্রত্যেক গ্রামেই একটা-দুটো পুকুর আছে বটে, কিন্তু সেগুলোও এখন প্রায় শুষ্ক। জলের চেয়ে কাদাই বেশি। লোকেরা তৃষ্ণা নিবারণ করে কুয়োর জল থেকে। কিন্তু কলসি দিয়ে সেই কুয়োর জল তুলে দাবানল ঠেকাবার চেষ্টা করাও হাস্যকর। কেউ সে চেষ্টা করতে গেলে নিজেও পুড়ে মরে। 

লোকের ধারণা, মাঝে-মাঝে অগ্নিদেবতার খিদে অত্যন্ত বেড়ে যায়। জঙ্গলের গাছপালা খেয়েও তাঁর খিদে মেটে না। গ্রাম-নগর, মানুষজনও তিনি খেতে চান। সেই প্রচণ্ড ক্ষুধার সময় অগ্নিকে রোধ করার সাধ্য মানুষের নেই। আকাশের দেবতাদের মধ্যে অগ্নির ক্ষমতার কোনও সীমা নেই। সেইজন্য সব মানুষই অগ্নির পূজা করে। বড়-বড় রাজারা যজ্ঞ করার সময় অগ্নি দেবতাকে কতরকম অর্ঘ্য দেন। তবু অগ্নি সন্তুষ্ট হন না। প্রতি বছরই কিছু-কিছু গ্রাম ও অনেক মানুষ অগ্নির গর্ভে যায়। আর দাবানল এলে তো কথাই নেই। তখন রাজধানীও রক্ষা করা যায় না। 

আকাশের দেবতাদের নিজেদের মধ্যেও রেষারেষি আছে। অগ্নির প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন ইন্দ্র। তিনিই মেঘ ও বৃষ্টির দেবতা। একমাত্র বৃষ্টিপাতের সময়ই অগ্নি জব্দ হন। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রের অনেক কাজ, তিনি সব সময় ব্যস্ত, এই গ্রীষ্মকালে তিনি পৃথিবীতে বৃষ্টি দিতে ভুলে যান। সেইজন্য গ্রীষ্মকালেই বেশি-বেশি দেখা যায় অগ্নির দাপট। 

রানি তলতাদেবী ঘোড়া ছুটিয়ে এসে পৌঁছলেন রাজ্যের শেষ প্রান্তে, অট্টাগ্রামে। সেই গ্রাম ততক্ষণে দাউদাউ করে জ্বলছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই পালিয়েছে প্রাণভয়ে, কয়েকজন শুধু জিনিসপত্র বাঁচাবার লোভে জ্বলন্ত বাড়ির মধ্যেও ঢুকতে গিয়েছিল, তারা প্রাণ হারিয়েছে। 

অট্টাগ্রামের পর যবের খেত। তারপর আবার একটি গ্রাম। সেই গ্রামের নাম ভুরুঙ্গা, সেখানকার মানুষজনের মধ্যে একদল চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে, আর একদল মাটিতে হাঁটু গেড়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে বলছে, “হে ইন্দ্ৰ, রক্ষা করো! রক্ষা করো! বৃষ্টি দাও!” 

অট্টাগ্রাম থেকে যারা চলে এসেছে, তারা বলছে, “এখন আর প্রার্থনা করে কোনও লাভ হবে না! পালাও পালাও! আমরাও ইন্দ্র দেবতাকে অনেক ডেকেছি, জঙ্গলে যখন প্রথম আগুন লাগে, তখন থেকে ডাকছি। কিন্তু ইন্দ্র দেবতা এখন আকাশে নেই, পালাও! নইলে সবাইকে মরতে হবে।” 

তবু ভুরুঙ্গা গ্রামের মানুষ পালাতে চাইছে না। তাদের খেতে এখন ফসল পেকেছে, সব নষ্ট হয়ে যাবে। বাড়ি-ঘরও ধ্বংস হবে। এরপর পালিয়ে গিয়েও তারা খাবে কী? সাধ করে বানানো বাড়ি, নিজের হাতে লাগানো গাছপালা ফেলে দিয়ে কেউ চলে যেতে পারে? 

রানি তলতাদেবী এবং রাজা মহাচূড়ামণিকে দলবল সমেত আসতে দেখে প্রজারা যেন খানিকটা ভরসা পেল। এর আগেরবারের মহাবিপদের সময় রাজারা এদিকে মোটেই আসেননি। রাজপরিবার আগেই পলায়ন করেছিলেন রাজধানী ছেড়ে। 

এবারে আগুনের এমন বিধ্বংসী লীলা দেখেও রাজা-রানি এবং মন্ত্রীরা এখানে এসেছেন দেখে প্রজারা মনে করল, নিশ্চয়ই তা হলে গ্রাম রক্ষা করার কোনও উপায় হবে। 

সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে বলতে লাগল, “মহারাজ, বাঁচান, বাঁচান!”

সেই আর্ত বিলাপ শুনে রাজা মহাচূড়ামণি আরও অসহায় বোধ করলেন। প্রজাদের তিনি কী বলে সান্ত্বনা দেবেন? 

তিনি তলতাদেবীকে প্রশ্ন করলেন, “রানি, তুমি কী করে এই জলপ্রপাতের মতন দাবানলকে আটকাবে? এ যেন স্বয়ং মহাকাল! এর হাত থেকে কোনওক্রমেই নিস্তার নেই।” 

রানি দূরের আগুনের দিকে চেয়ে চুপ করে রইলেন। অট্টাগ্রাম পুড়ছে, সেই আগুনের আভা এসে পড়েছে তাঁর মুখে। 

রাজপুরোহিত ছম্ভী রাজার মুখের দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, তাতেই বোঝা গেল রানির ওপর তাঁর কোনও ভরসা নেই। রানির কথায় বিশ্বাস করে এখানে আসাটাই খুব ভুল হয়েছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট। এতক্ষণে রাজধানী থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র সব সরিয়ে ফেলা যেত! 

স্বয়ং রাজা তাঁর প্রজাদের কোনওই সান্ত্বনা দিতে পারছেন না দেখে রাজপুরোহিত ছম্ভী নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। 

তিনি দু’হাত তুলে প্রজাদের বললেন, “তোমরা ইন্দ্রের বন্দনা করো! আকুলভাবে তাঁকে ডাকো। দেবতার দয়া ছাড়া উদ্ধার পাবার আর কোনও উপায় নেই। তোমাদের গ্রাম্য ভাষায় প্রার্থনা করলে হবে না, আমি সংস্কৃত মন্ত্ৰ উচ্চারণ করছি, তোমরা আমার সঙ্গে-সঙ্গে বলো!” 

রাজা মহাচূড়ামণি নিজেও হাত জোড় করে পুরোহিতের পাশে দাঁড়ালেন। 

রানি তলতাদেবী ঘোড়া ছুটিয়ে একবার গেলেন যবের খেত পেরিয়ে অট্টাগ্রামের কাছাকাছি। সে গ্রামের প্রায় সবটাই এর মধ্যে ভস্মীভূত হয়েছে, এখন সামনের খেজুর গাছ ও অন্যান্য বড় গাছের একটি বাগান পোড়াচ্ছে। তলতাদেবী আগুনের বেগ ও বাতাসের গতি পর্যবেক্ষণ করলেন একটুক্ষণ। তারপর দ্রুত ফিরে এলেন ভুরুঙ্গা গ্রামে। 

ঘোড়া থেকে নেমে তিনি পুরোহিত ছম্ভীকে বললেন, “ইন্দ্র দেবতার কাছে প্রার্থনা করার অবশ্য প্রয়োজন আছে। ইন্দ্রের দয়া ছাড়া বৃষ্টি হবে না। কিন্তু আপনি অনুগ্রহ করে প্রজাদের নিয়ে এই গ্রামটি ছেড়ে একটু দূরে চলে যান। সকলকে আগে বলুন, যার-যার ঘরবাড়ি থেকে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি সরিয়ে নিতে।” 

প্রার্থনার মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটায় একটু বিরক্ত হলেন ছম্ভী। তিনি এদিককার আকাশে মেঘ দেখেছেন। যদি দৈবাৎ ইন্দ্র-বন্দনার সময় বৃষ্টি নামে তা হলে প্রজারা তাঁর নামে জয়ধ্বনি দেবে। 

তিনি বললেন, “মহারানি, প্রজাদের এই গ্রাম তো ছাড়তেই হবে। তার আগে পূজা-প্রার্থনা সেরে নেওয়া যাক দ্রুত। আমার আর বেশি সময় লাগবে না।” 

রানি তলতাদেবী বললেন, “আপনার দ্রুত প্রার্থনা সারার দরকার নেই। অনেকক্ষণ ধরেই প্রার্থনা করাবেন সকলকে দিয়ে। আমি শুধু অনুরোধ করছি, আপনি সকলকে নিয়ে এই গ্রাম ছেড়ে পরের প্রান্তরটিতে গিয়ে বসুন। এই গ্রামটি আমার এক্ষুনি খালি অবস্থায় চাই।” 

ছম্ভী রাজার দিকে তাকাতেই রাজা বললেন, “মহারানি যেমন বলছেন, সেই মতন ব্যবস্থা করুন!” 

মন্ত্রী দারুক উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলেন, “প্রজারা অবিলম্বে এই গ্রাম পরিত্যাগ করো, রাজার আদেশ! রাজার আদেশ!” 

তৎক্ষণাৎ একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। লোকেরা যে-যা পারল, স্বর্ণালঙ্কার ও টাকাপয়সার পুঁটুলি হাতে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল গ্রাম থেকে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কেউ রইল না। 

এবারে সেই জনশূন্য গ্রামের এক প্রান্তে এসে রানি তাঁর মশালধারী সৈন্যদের বললেন, “তোমরা প্রত্যেক ঘরে-ঘরে আগুন ধরিয়ে দাও। একটিও যেন বাদ না থাকে।” 

রাজা মহা বিস্ময়ে বললেন, “সে কী? আমরা নিজেরাই গ্রামে আগুন লাগাব? কেন?” 

রানি বললেন, “মহারাজ, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়। শত্রুকে জয় করতে হয় অন্য শত্রুর সাহায্য নিয়ে। সেরকম বড় আগুনের সঙ্গে লড়তে হয় ছোট আগুন দিয়ে।” 

রাজা আবার বললেন, “কিছুই বুঝতে পারলুম না। আগুনের সঙ্গে আগুন দিয়ে লড়াই হবে কী করে?” 

ছম্ভী বললেন, “এই আগুন যখন দাবানলের সঙ্গে যুক্ত হবে, তখন তো আগুনের আরও শক্তি বৃদ্ধি হবে।” 

রানি তলতাদেবী উতলা হয়ে বললেন, “আপনাদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের আর সময় নেই। আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন।“

তারপর তিনিই একজন সৈন্যের হাত থেকে মশাল তুলে নিয়ে প্রথম একটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। 

তখন অন্য সৈন্যরাও হাত লাগাল। তারা দৌড়ে দৌড়ে প্রতিটি বাড়িতে মশাল গুঁজে দিতে লাগল। এই গ্রামের সব বাড়িই কাঠ ও খড় দিয়ে তৈরি, আগুন ধরতে দেরি হল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্ত গ্রামটি একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হল। 

রানি তলতাদেবী সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “এবার যবের খেতটাও পুড়িয়ে ছাই করে দাও!” 

সৈন্যরা পরস্পরের দিকে গোল-গোল চোখ করে তাকাল। তারাও প্রায় সকলেই কৃষক পরিবারের সন্তান। মাঠের ফসলকে তারা পবিত্র জ্ঞান করে। শত্রু রাজ্য আক্রমণ করে তারা অনেক ঘর-বাড়িতে আগুন জ্বালে, অনেক মানুষ মারে, কিন্তু কখনও ফসল ধ্বংস করে না। 

অট্টাগ্রাম ও ভুরুঙ্গাগ্রামের মাঝখানে বিস্তীর্ণ যবের খেত। ফসল সবে পেকেছে, পাকা ফসলের সোনালি রঙে সেই প্রান্তরটি ছেয়ে আছে। একটুক্ষণের মধ্যেই দাবানল এসে সেই ফসল খেয়ে নেবে ঠিকই, কিন্তু সৈন্যরা নিজ হাতে সেখানে আগুন ধরাতে যাবে কেন? 

সৈন্যদের দ্বিধা দেখে রানি তলতাদেবী আবার নিজেই মশাল নিয়ে নেমে গেলেন সেই যবের খেতে। তখন সৈন্যরাও বাধ্য হয়ে রানিকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। 

পাকা ফসলে আগুনের ছোঁয়া লাগতেই চচ্চড় শব্দে জ্বলতে লাগল। তারপর এক অদ্ভুত দৃশ্য হল। এদিকে ভুরুঙ্গাগ্রাম জ্বলছে মানুষের হাতের আগুনে। দূরে অট্টাগ্রাম দাউ-দাউ করে পড়ে শেষ হচ্ছে দাবানলে। মাঝখানে যবের খেতের আগুন যেন ঠিক একটা সরল রেখায় এগিয়ে যাচ্ছে দাবানলের দিকে। যবের খেতের আগুন যেন একসারি সৈন্য আর দূরের দাবানল যেন হামলাকারী দৈত্য-দানব! 

রানি তলতাদেবী একটা উঁচু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছেন, তাঁর পাশে রয়েছেন রাজা এবং মন্ত্রী। 

অন্যরা এখনও রানির এই কাণ্ডটির মর্ম কিছুই বুঝতে পারছেন না। রাজপুরোহিত প্রজাদের নিয়ে গ্রাম ছাড়িয়ে খানিকটা দূরের এক প্রান্তরে ইন্দ্রের বন্দনা করতে বসেছেন। 

হঠাৎ এই সময় এক রমণী কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল, “রানিমা, আমার স্বামীকে বাঁচান! আমার স্বামীর জীবন রক্ষা করুন।” 

রানি তলতাদেবী ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে তোমার স্বামীর?”

রমণীটি রানির পা জড়িয়ে ধরে বলল, “সে কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে আসবে না। সে আগুনে পুড়ে মরবে!” 

মন্ত্রী জীবক জিজ্ঞেস করলেন, “সে বাড়ি ছেড়ে আসতে চায় না? কী এমন মূল্যবান জিনিস আছে তোমার বাড়িতে?” 

রমণীটি চোখের জলে রানির পা ভিজিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল, “কিছুই না। আছে শুধু কয়েকখানা পাথর। আমি কত বোঝালাম, তবু কিছুতেই সে সেই পাথরগুলো ছেড়ে আসবে না।” 

মন্ত্রী জীবক বললেন, “পাগল! ঠিক আছে, তুমি ওঠো। আমি সৈন্যদের বলছি, জোর করে তাকে ধরে নিয়ে আসবে। তুমি যাও, বাড়িটা চিনিয়ে দাও!” 

রমণীটি এবার অশ্রুমাখা মুখখানি তুলে বলল, “তাতে কোনও লাভ হবে না। আমার প্রতিবেশীরা তাকে জোর করে সরাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার হাতে একটা ধারালো কুঠার আছে। সে বলছে, কেউ তাকে ধরতে গেলেই সে নিজের গলায় কোপ মারবে। পাথরগুলো ছেড়ে সে কিছুতেই যাবে না।” 

রানি তলতাদেবী বললেন, “বড় বিচিত্র মানুষ তো! সোনাদানা নয়, কয়েকখানা পাথরের জন্য সে পুড়ে মরতে চায়!” 

রমণীটি বলল, “মহারানি, একমাত্র আপনিই দয়া করতে পারেন। আপনি আমার স্বামীর জীবন দান করুন।” 

রানি অবাক হয়ে বললেন, “আমি কী করে দয়া করব? তুমিই তো বললে, কেউ ধরতে গেলে সে কুঠার দিয়ে আত্মঘাতী হবে?” 

রমণীটি আস্তে-আস্তে বলল, “সে বলেছে, একমাত্র মহারানি নিজে এসে বললে সে গৃহত্যাগ করতে পারে।” 

এ-কথা শোনামাত্র রাজা ক্রোধে চক্ষু রক্তবর্ণ করে তলোয়ারে হাত দিলেন। মহারানির নাম উচ্চারণ করতে পারে এমন বেয়াদপকে তিনি এই মুহূর্তে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চান। তিনি একজন সৈনিককে সেরকম আদেশ দিতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই তলতাদেবী বললেন, “লোকটি সম্পর্কে আমার কৌতূহল হচ্ছে। একবার দেখে আসতে ক্ষতি কী?” 

রানি তরতর করে নেমে এলেন টিলা থেকে। সঙ্গে এল চারজন সৈনিক। রমণীটি রানিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তার বাড়ি বেশি দূর নয়। তার কাঠের বাড়িটি অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভেঙে-ভেঙে পড়ছে। সামনের ছোট বাগানটিতে বিরাট একখানা পাথরের চাঁই-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন বলিষ্ঠকায় মানুষ, তার সারা মুখে দাড়ি, মাথায় বাবরি চুল। একটা কুঠার দিয়ে সে একমনে পাথরটি কেটে চলেছে। 

রানি তলতাদেবী কাছে এসে দেখলেন, সেখানে আরও অনেকগুলি খণ্ড পাথর পড়ে আছে। সেগুলি ঠিক পাথর নয়, পাথরের মূর্তি। যে বড় চাঁইটি ওই লোকটি কাটছে, তাতেও ফুটে উঠেছে একটি মুখের আদল। 

রানি তলতাদেবী ধমকের সুরে বললেন, “ওহে, তুমি রাজার আদেশ শোনোনি যে, সবাইকেই এ-গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে? কেন বিলম্ব করছ?” 

লোকটি তলতাদেবীকে দেখে মুখ ফিরিয়ে একগাল হাসল। তারপর কুঠারটি ফেলে হাত জোড় করে বলল, “দণ্ডবৎ হই, মহারানি! অধীনের নাম জয়পাল। আমি পাথর কেটে মূর্তি বানাই। বহু পরিশ্রম করে এই মূর্তিগুলি বানিয়েছি। আমি চলে গেলে এগুলো আগুনের শিখায় বিকৃত হয়ে যাবে। তাও না হয় হোক। কিন্তু এই যে মূর্তিটি আমি শুরু করেছি, এটা সম্পূর্ণ না করে যাই কী করে?” 

রানি বললেন, “তুমি তো ভারী মূর্খ দেখছি! তোমার জীবনের চেয়েও এই পাথরগুলির দাম বেশি?” 

জয়পাল বলল, “দামের প্রশ্ন নেই। আমি এসব মূর্তি বিক্রয় করি না! কিন্তু একজন শিল্পী যদি কোনও কাজ শুরু করে শেষ করতে না পারে, তা হলে তার বেঁচে থেকে লাভ কী?” 

রানি বললেন, “এখন কথা বলবার সময় নেই। তুমি আমাকে আসতে বলেছিলে কেন?” 

জয়পাল আবার হেসে বলল, “আমার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। মহারানি, এই বড় পাথরটি দেখে চিনতে পারেন? একটু দেখুন তো ভাল করে!” 

রানি এবার লক্ষ করলেন, সেই বড় পাথরের চাঁইটিতে ফুটে উঠেছে তাঁরই মুখের রেখা। অসমাপ্ত হলেও চেনা যায়। 

জয়পাল বলল, “কিছুদিন আগে রাজধানীর পথে আপনাকে দেখেছিলাম। তারপর এই মূর্তিটি গড়ে আপনাকে উপহার দেব ভেবেছিলাম। এর মধ্যেই এসে পড়ল আগুন। এই মূর্তি সম্পূর্ণ করে আপনাকে দেখাতে না পারলে আমার জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যেত।” 

রানি তলতাদেবী অধীর হয়ে বললেন, “তোমাকে আমার রাজপ্রাসাদে স্থান দেব। সেখানে তুমি যত ইচ্ছে মূর্তি গড়তে পারবে। এবার চলো!” 

সৈন্যদের তিনি আদেশ দিলেন ছোট-ছোট মূর্তিগুলি সঙ্গে নিয়ে নিতে। তারপর প্রায় ছুটেই আবার উঠে এলেন টিলার ওপরে। 

রাজা মহাচূড়ামণি চোখ বড়-বড় করে বললেন, “মহারানি, দ্যাখো, দ্যাখো, কী অদ্ভুত ব্যাপার! এ যে অলৌকিক কাণ্ড!” 

যবের খেতের সব ফসল এর মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। নিভে গেছে সেই আগুন, এখন সেখান থেকে শুধু ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ওদিকের দাবানল অট্টাগ্রামটিকে গ্রাস করে, কাছাকাছি সব বাগান ভস্ম করে দিয়ে বিনষ্ট যবের খেতের সামনে এসে থমকে গেছে। দাবানলের তেজও যেন খানিকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে।” 

রানি তলতাদেবীর মুখে ফুটে উঠল জয়ের আনন্দ আর তৃপ্তির হাসি। তিনি আস্তে আস্তে বললেন, “এর মধ্যে অলৌকিক কিছুই নেই।” 

রাজা মহাচূড়ামণি জিজ্ঞেস করলেন, “অলৌকিক কিছু নেই? তোমার আগুন দেখে দাবানল ভয় পেল নাকি? দাবানল কেন থেমে গেল? আর তো এগিয়ে আসছে না!” 

তলতাদেবী বললেন, “মহারাজ, দাবানলের মধ্যে যে অগ্নি দেবতা থাকেন, তিনি ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা, মানুষ-পশু এই সবই খেয়ে ফেলেন বটে, কিন্তু তিনি ছাই খান না! আগুন তার উচ্ছিষ্টকে ঘৃণা করে। ছাইগাদার ওপর দিয়ে কখনও আগুন যায় না!” 

রাজা বললেন, “তা হলে এই যব খেতের ছাই আর ভুরুঙ্গাগ্রামের ছাই পার হয়ে দাবানল আর রাজধানীর দিকে যাবে না?” 

রানি বললেন, “না। এবারের মতন দাবানল শুধু একটা গ্রাম খেয়েই নিভে যাবে।” 

সকল অধ্যায়

১. উদাসী রাজকুমার – ১.১
২. উদাসী রাজকুমার – ১.২
৩. উদাসী রাজকুমার – ১.৩
৪. উদাসী রাজকুমার – ১.৪
৫. উদাসী রাজকুমার – ১.৫
৬. উদাসী রাজকুমার – ১.৬
৭. উদাসী রাজকুমার – ১.৭
৮. উদাসী রাজকুমার – ১.৮
৯. উদাসী রাজকুমার – ১.৯
১০. উদাসী রাজকুমার – ১.১০
১১. উদাসী রাজকুমার – ১.১১
১২. উদাসী রাজকুমার – ১.১২
১৩. উদাসী রাজকুমার – ১.১৩
১৪. উদাসী রাজকুমার – ১.১৪
১৫. উদাসী রাজকুমার – ১.১৫
১৬. উদাসী রাজকুমার – ১.১৬
১৭. উদাসী রাজকুমার – ১.১৭
১৮. উদাসী রাজকুমার – ১.১৮
১৯. উদাসী রাজকুমার – ২.১
২০. উদাসী রাজকুমার – ২.২
২১. উদাসী রাজকুমার – ২.৩
২২. উদাসী রাজকুমার – ২.৪
২৩. উদাসী রাজকুমার – ২.৫
২৪. উদাসী রাজকুমার – ২.৬
২৫. উদাসী রাজকুমার – ২.৭
২৬. উদাসী রাজকুমার – ২.৮
২৭. উদাসী রাজকুমার – ২.৯
২৮. উদাসী রাজকুমার – ২.১০
২৯. উদাসী রাজকুমার – ২.১১
৩০. উদাসী রাজকুমার – ২.১২
৩১. উদাসী রাজকুমার – ২.১৩
৩২. উদাসী রাজকুমার – ২.১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন