য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩২

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৪ অক্টোবর। জিব্রাল্টার পৌঁছনো গেল। মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে।

আজ ডিনার-টেবিলে একটা মোটা আঙুল এবং ফুলো গোঁফওআলা প্রকাণ্ড জোয়ান গোরা তার সুন্দরী পার্শ্ববর্তিনীর সঙ্গে ভারতবর্ষীয় পাখাওআলার গল্প করছিল। সুন্দরী কিঞ্চিৎ নালিশের নাকিস্বরে বললেন– পাখাওআলারা রাত্রে পাখা টানতে টানতে ঘুমোয়। জোয়ান লোকটা বললে, তার একমাত্র প্রতিবিধান লাথি কিংবা লাঠি। পাখা-আন্দোলন সম্বন্ধে এইভাবে আন্দোলন চলতে লাগল। আমার বুকে হঠাৎ যেন একটা তপ্ত শূল বিঁধল। এইভাবে যারা স্ত্রীপুরুষে কথোপকথন করে তারা যে অকাতরে একসময় একটা দিশি দুর্বল মানব-বিড়ম্বনাকে ভবপারে লাথিয়ে ফেলে দেবে তার আর বিচিত্র কী? আমিও তো সেই অপমানিত জাতের লোক, আমি কোন্‌ লজ্জায় কোন্‌ সুখে এদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাই এবং একত্রে দন্তোন্মীলন করি। শরীরের সমস্ত রাগ কণ্ঠ পর্যন্ত এল কিন্তু একটা কথাও বহু চেষ্টাতে সে-জায়গায় এসে পৌঁছল না। বিশেষত ওদের ওই ইংরেজি ভাষাটা বড়োই বিজাতীয়– মনটা একটু বিচলিত হয়ে গেলেই ও-ভাষাটা মনের মতো কায়দা করে উঠতে পারি নে। তখন মাথার চতুর্দিক হতে রাজ্যের বাংলা কথা চাক-নাড়া মৌমাছির মত মুখদ্বারে ভিড় করে ছুটে আসে। ভাবলুম এত উতলা হয়ে উঠলে চলবে না, একটু ঠাণ্ডা হয়ে দুটো-চারটে ব্যাকরণশুদ্ধ ইংরেজি কথা মাথার মধ্যে গুছিয়ে নিই। ঝগড়া করতে গেলে নিদেন ভাষাটা ভালো হওয়া চাই।

তখন মনে মনে নিম্নলিখিত মতো ভাবটা ইংরেজিতে রচনা করতে লাগলুম :

কথাটা ঠিক বটে মশায়, পাখাওআলা মাঝে মাঝে রাত্রে ঢুললে অত্যন্ত অসুবিধা হয়। দেহধারণ করলেই এমন কতকগুলো সহ্য করতে হয় এবং সেই জন্যই খ্রীস্ট্রীয় সহিষ্ণুতার প্রয়োজন ঘটে। এবং এইরূপ সময়েই ভদ্রাভদ্রের পরিচয় পাওয়া যায়।

যে লোক তোমার আঘাতের প্রতিশোধ নিতে একেবারেই অক্ষম, খপ করে তার উপরে লাথি তোলা চূড়ান্ত কাপুরুষতা; অভদ্রতার চেয়ে বেশি।

আমরা জাতটা যে তোমাদের চেয়ে দুবর্ল সেটা একটা প্রাকৃতিক সত্য– সেই আমাদের অস্বীকার করবার জো নেই। তোমাদের গায়ের জোর বড্ডো বেশি– তোমরা ভারি পালোয়ান।

কিন্তু সেইটেই কি এত গর্বের বিষয়ে যে, মনুষ্যত্বকে তার নিচে আসন দেওয়া হবে?

তোমরা বলবে-কেন, আমাদের আর কি কোনো শ্রেষ্ঠতা নেই?

থাকতেও পারে। তবে, যখন একজন অস্থিজর্জর অর্ধ-উপবাসী দরিদ্রের রিক্ত উদরের উপরে লাথি বসিয়ে দাও এবং তৎসম্বন্ধে রমণীদের সঙ্গে কৌতুকালাপ কর এবং সুকুমারীগণও তাতে বিশেষ বেদনা অনুভব করেন না, তখন কিছুতেই তোমাদের শ্রেষ্ঠ বলে ঠাহর করা যায় না।

বেচারার অপরাধ কী দেখা যাক। ভোরের বেলা অর্ধাশনে বেরিয়েছে, সমস্ত দিন খেটেছে। হতভাগ্য আর দুটো পয়সা বেশি উপার্জন করবার আশায় রাত্রের বিশ্রামটা তোমাকে দু-চার আনায় বিক্রি করেছে। নিতান্ত গরিব বলেই তার এই ব্যবসায়, বড়োসাহেবকে ঠকাবার জন্যে সে ষড়যন্ত্র করে নি।

এই ব্যক্তি রাত্রে পাখা টানতে টানতে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে– এ দোষটা তার আছে বলতেই হবে।

কিন্তু আমার বোধ হয় এটা মানবজাতির একটা আদিম পাপের ফল। যন্ত্রের মতো বসে বসে পাখা টানতে গেলেই আদমের সন্তানের চোখে ঘুম আসবেই। সাহেব নিজে একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

এক ভৃত্যের দ্বারা কাজ না পেলে দ্বিতীয় ভৃত্য রাখা যেতে পারে, কিন্তু যে কাপুরুষ তাকে লাথি মারে সে নিজেকে অপমান করে, কারণ তখনই তার একটি প্রতিলাথি প্রাপ্য হয়– সেটা প্রয়োগ করবার লোক কেউ হাতের কাছে উপস্থিত নেই, এইটুকুমাত্র প্রভেদ।

তোমরা অবসর পেলেই আমাদের বলে থাক যে, তোমাদের মধ্যে যখন বাল্যবিবাহ প্রভৃতি সামাজিক কুপ্রথা প্রচলিত তখন তোমরা রাজ্যতন্ত্রের মধ্যে কোনো স্বাধীন অধিকার প্রাপ্তির যোগ্য নও।

কিন্তু তার চেয়ে এ-কথা সত্য যে, যে-জাত নিরাপদ দেখে দুর্বলের কাছে “তেরিয়া’– অর্থাৎ তোমরা যাকে বলো “বুলি’– আর কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই– অপ্রিয় অশিষ্ট ব্যবহার যাদের স্বভাবত আসে, কেবল স্বার্থের স্থলে যারা নম্রভাব ধারণ করে, তারা, কোনো বিদেশী রাজ্যশাসনের যোগ্য নয়।

অবশ্য যোগ্যতা দু-রকমের আছে–ধর্মত এবং কার্যত। এমন কতকগুলি স্থল আছে যেখানে শুদ্ধমাত্র কৃতকারিতাই যোগ্যতার প্রমাণ নয়। গায়ের জোরে থাকলে অএনক কাজই বলপূর্বক চালিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু বিশেষ বিশেষ কাজে বিশেষ বিশেষ উপযোগী নৈতিক গুণের দ্বারাই সে কার্যবহনের প্রকৃত অধিকার পাওয়া যায়।

কিন্তু ধর্মের শাসন সদ্য সদ্য দেখা যায় না বলে যে, ধর্মের রাজ্য অরাজক তা বলা যায় না। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিষ্ঠুরতা এবং প্রতিদিনের ঔদ্ধত্য প্রতিদিন সঞ্চিত হচ্ছে, এক সময় এরা তোমারেদই মাথায় ভেঙে পড়বে।

যদি বা আমরা সকল অপমানই নীরবে অথবা কথঞ্চিৎ কলরব সহকার সহ্য করে যাই, প্রতিকারের কোনো ক্ষমতাই যদি আমাদের না থাকে, তবু তোমাদের মঙ্গল হবে না।

কারণ, অপ্রতিহত ক্ষমতার দম্ভ জাতীয় চরিত্রের মূল আক্রমণ করে। যে স্বাধীনতাপ্রিয়তার ভিত্তির উপর তোমাদের জাতীয় গৌরব প্রতিষ্ঠিত, তলে তলে সেই স্বাধীনতাপ্রিয়তার বিশুদ্ধতা নষ্ট করে। সেই জন্য ইংলণ্ডবাসী ইংরেজের কাছে শোনা যায় ভারতবর্ষীয় ইংরেজ একটা জাতই স্বতন্ত্র। কেবলমাত্র বিকৃত যকৃৎই তার একমাত্র কারণ নয়, যকৃতের চেয়ে মানুষের আরো উচ্চতার অন্তরিন্দ্রিয় আছে, সেটাও নষ্ট হয়ে যায়।

কিন্তু আমার এ বিভীষিকায় কেউ ডরাবে না। যার দ্বারে অর্গল নেই সে-ই অগত্যা চোরকে সাধুভাবে ধর্মোপদেশ দিতে বসে; যেন চোরের পরকালের হিতের জন্যই তার রাত্রে ঘুম হয় না।

লাথির পরিবর্তে লাথি দিলেই ফলটা অতি শীঘ্র পাওয়া যায়। এই পুরাতন সত্যটি আমাদের জানা আছে, কিন্তু বিধাতা আমাদের সমস্ত শরীরমনের মধ্যে কেবল রসনার অগ্রভাগটুকুতে বলসঞ্চার করেছেন। সুতরাং হে জোয়ান, কিঞ্চিত নীতি-কথা শোনো।

শোনা যায় ভারতবর্ষীয়ের পিলে যন্ত্রটাই কিছু খারাপ হয়ে আছে, এই জন্য তারা পেটের উপরে ইংরেজ প্রভুর নিতান্ত “পেটার্নাল ট্রীট্‌মেন্ট’-টুকুরও ভর সইতে পারে না। কিন্তু ইংরেজের পিলে কী রকম অবস্থায় আছে এ-পর্যন্ত কার্যত তার কোনো পরীক্ষাই হয় নি।

কিন্তু সে নিয়ে কথা হচ্ছে না; পিলে ফেটে যে আমাদের অপঘাতমৃত্যু হয় সেটা আমাদের ললাটের লিখন। কিন্তু তার পরেই সমস্ত ব্যাপারটা তোমরা যে-রকম তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাও, তাতেই আমাদের সমস্ত জাতিকে অপমান করা হয়। তাতেই একরকম করে বলা হয় যে, আমাদের তোমরা মানুষ জ্ঞান কর না। আমাদের দুটো-চারটে মানুষ যে খামকা তোমাদের চরণতলে বিলুপ্ত হয়ে যায় সে আমাদের পিলের দোষ। পিলে যদি ঠিক থাকত তা হলে লাথিও খেতে, বেঁচেও থাকতে এবং পুনশ্চ দ্বিতীয়বার খাবার অবসর পেতে।

যা’হক ভদ্রনাম ধারণ করে অসহায়কে অপমান করতে যার সংকোচ বোধ হয় না, তাকে এত কথা বলাই বাহুল্য; বিশেষ যে ব্যক্তি অপমান সহ্য করে দুর্বল হলেও তাকে যখন অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা না করে থাকা যায় না।

কিন্তু একটা কথা আমি ভালো বুঝতে পারি নে, ইংলণ্ডে তো তোমাদের এত বিশ্বহিতৈষিণী মেয়ে আছেন, তাঁরা সভাসমিতি করে নিতান্ত অসম্পর্কীয় কিংবা দূরসম্পর্কীয় মানবজাতির প্রতিও দূর থেকে দয়া প্রকাশ করেন। এই হতভাগ্য দেশে সেই ইংরেজের ঘর থেকে কি যথেষ্ট পরিমাণে মেয়ে আসেন না যাঁরা উক্ত বাহুল্য করুণরসের কিয়দংশ উপস্থিত ক্ষেত্রে ব্যয় করে মনোভার কিঞ্চিৎ লাঘব করে যেতে পারেন। বরঞ্চ পুরুষমানুষে দয়ার দৃষ্টান্ত দেখেছি। কিন্তু তোমাদের মেয়েরা এখানে কেবল নাচগান করেন, সুযোগমতে বিবাহ করেন এবং কথোপথনকালে সুচারু নাসিকার সুকুমার অগ্রভাগটুকু কুঞ্চিত করে আমাদের স্বজাতীয়ের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। জানি না, কী অভিপ্রায়ে বিধাতা আমাদের ভারতবাসীকে তোমাদের ললনাদের স্নায়ুতন্ত্রের ঠিক উপযোগী করে সৃজন করেন নি।

যাই হ’ক, স্বগত উক্তি যত ভালোই হ’ক স্টেজ ছাড়া আর কোথাও শ্রোতাদের কর্ণগোচর হয় না। তা ছাড়া যে কথাগুলো আক্ষেপবশত মনের মধ্যে উদয় হয়েছিল সেগুলো যে এই গোঁফওআলা পালোয়ানের বিশেষ কিছু হৃদয়ঙ্গম হত এমন আমার বোধ হয় না। এদিকে, বুদ্ধি যখন বেড়ে উঠল চোর তখন পালিয়েছে– তারা পূর্বপ্রসঙ্গ ছেড়ে অন্য কথায় গিয়ে পড়েছে। মনের খেদে কেবল নিজেকেই ধিক্‌কার দিতে লাগলুম।

সকল অধ্যায়

১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০১
২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০২
৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৩
৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৪
৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৫
৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৬
৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৭
৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৮
৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৯
১০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১০
১১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১১
১২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১২
১৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৩
১৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৪
১৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৫
১৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৬
১৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৭
১৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৮
১৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৯
২০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২০
২১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২১
২২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২২
২৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৩
২৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৪
২৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৫
২৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৬
২৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৭
২৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৮
২৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৯
৩০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩০
৩১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩১
৩২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩২
৩৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৩
৩৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৪
৩৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৫
৩৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৬
৩৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৭
৩৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৮
৩৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৯
৪০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪০
৪১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪১
৪২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪২
৪৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৩
৪৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৪
৪৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৫
৪৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৬
৪৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন