য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪১

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২৬ অক্টোবর। জাহাজের একটা দিন বর্ণনা করা যাক।

সকালে ডেক ধুয়ে গেছে, এখনো ভিজে রয়েছে। দুই ধারে ডেকচেয়ার বিশৃঙ্খল ভাবে পরস্পরের উপর রাশীকৃত। খালিপায়ে রাত-কাপড়-পরা পুরুষগণ কেউ বা বন্ধু-সঙ্গে কেউ একলা মধ্যপথ দিয়ে হুহু করে বেড়াচ্ছে। ক্রমে যখন আটটা বাজল এবং একটি-একটি করে মেয়ে উপরে উঠতে লাগল তখন একে একে এই বিরলবেশ পুরুষদের অন্তর্ধান।

স্নানের ঘরের সম্মুখে বিষম ভিড়। তিনটি মাত্র স্নাগার; আমরা অনেকগুলি দ্বারস্থ। তোয়ালে এবং স্পঞ্জ হাতে দ্বারমোচনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। দশ মিনিটের অধিক স্নানের ঘর অধিকার করবার নিয়ম নেই।

স্নান এবং বেশভূষা সমাপনের পর উপরে গিয়ে দেখা যায় ডেকের উপর পদচারণশীল প্রভাতবায়ুসেবী অনেকগুলি স্ত্রীপুরুষের সমাগম হয়েছে। ঘন ঘন টুপি উদ্‌ঘাটন করে মহিলাদের এবং শিরঃকম্পে পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে শুভপ্রভাত অভিবাদন করে গ্রীষ্মের তারতম্য সম্বন্ধে পরস্পরের মত ব্যক্ত করা গেল।

ন-টার ঘণ্টা বাজল। ব্রেক্‌ফাস্ট প্রস্তুত। বুভুক্ষু নরনারীগণ সেপান-পথ দিয়ে নিম্নকক্ষে ভোজনবিবরে প্রবেশ করলে। ডেকের উপরে আর জনপ্রাণী অবশিষ্ট নেই, কেবল সারি সারি শূন্য চৌকি ঊর্ধ্বমুখে প্রভুদের জন্য প্রতীক্ষমান।

ভোজনশালা প্রকাণ্ড ঘর। মাঝে দুই সার লম্বা টেবিল; এবং তার দুই পার্শ্বে খণ্ড খণ্ড ছোটো ছোটো টেবিল। আমরা দক্ষিণ পার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র টেবিল অধিকার করে সাতটি প্রাণী দিনের মধ্যে তিন বার ক্ষুধা নিবৃত্ত করে থাকি। মাংস রুটি ফলমূল মিষ্টান্ন মদিরায় এবং হাস্যকৌতুক গল্পগুজবে এই অনতি-উচ্চ সুপ্রশস্ত ঘর কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আহারের পর উপরে গিয়ে যে যার নিজ নিজ চৌকি অন্বেষণ এবং সেটা যথাস্থানে স্থাপনে ব্যস্ত। চৌকি খুঁজে পাওয়া দায়। ডেক ধোবার সময় কারা চৌকি কোথায় ফেলেছে তার ঠিক নেই।

তার পরে যেখানে একটু কোণ, যেখানে একটু বাতাস, যেখানে একটু রোদের তেজ কম, যেখানে যার অভ্যাস সেইখানে ঠেলেঠুলে টেনেটুনে পাশ কাটিয়ে পথ করে আপনার চৌকিটি রাখতে পারলে সমস্ত দিনের মতো নিশ্চিন্ত।

দেখা যায় কোনো চৌকিহারা ম্লানমুখী রমণী কাতরভাবে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করছে, কিংবা কোনো বিপদগ্রস্ত অবলা এই চৌকি-অরণ্যের মধ্যে থেকে নিজেরটি বিশ্লিষ্ট করে নিয়ে অভিপ্রেত স্থানে স্থাপন করতে পারছে না– তখন পুরুষগণ নারীসহায়ব্রতে চৌকি-উদ্ধারকার্যে নিযুক্ত হয়ে সুশিষ্ট ও সুমিষ্ট ধন্যবাদ অর্জন করে থাকে।

তার পর যে যার চৌকি অধিকার করে বসে যাওয়া যায়। ধূমসেবিগণ, হয় ধূম-সেবনকক্ষে নয় ডেকের পশ্চাদ্ভাগে সমবেত হয়ে পরিতৃপ্তমনে ধূমপান করছে। মেয়েরা অর্ধনিলীন অবস্থায় কেউ বা নভেল পড়ছে, কেউ বা সেলাই করছে, মাঝে মাঝে দুই-একজন যুবক ক্ষণেকের জন্যে পাশে বসে মধুকরের মতো কানের কাছে গুন গুন করে আবার চলে যাচ্ছে।

আহার কিঞ্চিৎ পরিপাক হবামাত্র একদলের মধ্যে ক্বয়েট্‌স খেলা আরম্ভ হল। দুই বালতি পরস্পর হতে হাত দশেক দূরে স্থাপিত হল। দুই জড়ি স্ত্রীপুরুষ বিরোধী পক্ষ অবলম্বন করে পালাক্রমে স্ব স্ব স্থান থেকে কলসীর বিড়ের মতো কতকগুলো রজ্জুচক্র বিপরীত বালতির মধ্যে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগল। যে পক্ষ সর্বাগ্রে একুশ করতে পারবে তারই জিত। মেয়ে-খেলোয়াড়েরা কখনো জয়োচ্ছ্বাসে কখনো নৈরাশ্যে ঊর্ধ্বকণ্ঠে চীৎকার করে উঠছে। কেউ বা দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ বা গণনা করছে, কেউ বা খেলায় যোগ দিচ্ছে কেউ বা আপন আপন পড়ায় কিংবা গল্পে নিবিষ্ট।

একটার সময় আবার ঘণ্টা। আবার আহার। আহারান্তে উপর ফিরে এসে দুই স্তর খাদ্যের ভারে এবং মধ্যাহ্নের উত্তাপে আলস্য অত্যন্ত ঘনীভূত হয়ে আসে। সমুদ্র প্রশান্ত, আকাশ সুনীল মেঘমুক্ত, অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে। কেদারায় হেলান দিয়ে নীরবে নভেল পড়তে পড়তে অধিকাংশ আনীল নয়ন নিদ্রাবিষ্ট। কেবল দুই-একজন দাবা, ব্যাক্‌গ্যামন কিংবা ড্রাফ্‌ট খেলছে এবং দুই-একজন অশ্রান্ত অধ্যবসায়ী যুবক সমস্ত দিনই ক্বয়েট্‌স খেলায় নিযুক্ত। কোনো রমণী কোলের উপর কাগজ কলম নিয়ে একাগ্রমনে চিঠি লিখছে এবং কোনো শিল্পকুশলা কৌতুকপ্রিয়া যুবতী নিদ্রিত সহযাত্রীর ছবি আঁকতে চেষ্টা করছে।

ক্রমে রৌদ্রের প্রখরতা হ্রাস হয়ে এল। তাপক্লিষ্ট ক্লান্তকায়গণ নিচে নেমে গিয়ে রুটিমাখনমিষ্টান্ন সহযোগে চা-রস পানে শরীরের জড়তা পরিহার করে পুনর্বার ডেকে উপস্থিত। পুনর্বার যুগলমূর্তির সোৎসাহ পদচারণা এবং মৃদুমন্দ হাস্যালাপ আরম্ভ হল। কেবল দু-চার জন পাঠিকা উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদ থেকে কিছুতেই আপনাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না, দিবাবসানের ম্লান ক্ষীণালোকে একাগ্রনিবিষ্ট দৃষ্টিতে নায়ক-নায়িকার পরিণাম অনুসরণ করছে।

দক্ষিণ আকাশে তপ্ত স্বর্ণবর্ণের প্রলেপ, তরল অগ্নির মতো জলরাশির মধ্যে সূর্য অস্তমিত, এবং বামে সূর্যাস্তের কিছু পূর্ব হতেই চন্দ্রোদয়ের সূচনা। জাহাজ থেকে পূর্বদিগন্ত পর্যন্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিকঝিক করছে।

জাহাজের ডেকের উপরে এবং কক্ষে কক্ষে বিদ্যুদ্দীপ জ্বলে উঠল। ছটার সময় বাজল ডিনারের প্রথম ঘণ্টা। বেশ-পরিবর্তন উপলক্ষে সকলে স্ব স্ব কক্ষে প্রবেশ করলে। আধ ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় ঘণ্টা। ভোজনগৃহে প্রবেশ করা গেল। সারি সারি নরনারী বসে গেছে। কারো বা কালো কাপড়, কারো রঙিন কাপড়, কারো বা শুভ্র বক্ষ অর্ধ-অনাবৃত। মাথার উপরে শ্রেণীবদ্ধ বিদ্যুৎ-আলোক। গুনগুন আলাপের সঙ্গে কাঁটাচামচের টুংটাং ঠুংঠাং শব্দ মুখরিত, এবং বিচিত্র খাদ্যের পর্যায় পরিচারকদের হাতে হাতে নিঃশব্দ স্রোতের মতো যাতায়াত করছে।

আহারের পর ডেকে গিয়ে শীতল বায়ু সেবন। কোথাও বা যুবকযুবতী অন্ধকার কোণের মধ্যে চৌকি টেনে নিয়ে গিয়ে গুনগুন করছে, কোথাও বা দু-জনে জাহাজের বারান্দা ধরে ঝুঁকে পড়ে রহস্যালাপে নিমগ্ন, কোনো কোনো জুড়ি গল্প করতে করতে ডেকের আলোক ও অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দ্রুতপদে একবার দেখা দিচ্ছে একবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, কোথাও বা পাঁচ-সাতজন স্ত্রীপুরুষ এবং জাহাজের কর্মচারী জটলা করে উচ্চহাস্যে প্রমোদকল্লোল উচ্ছ্বসিত করে তুলছে। অলস পুরুষেরা কেউ বা বসে কেউ বা দাঁড়িয়ে কেউ বা অর্ধশয়ান অবস্থায় চুরুট টানছে, কেউ বা স্মোকিং সেলুনে কেউ বা নিচে খাবার ঘরে হুইস্কি সোডা পাশে রেখে চারজনে দল বেঁধে বাজি রেখে তাস খেলছে। ওদিকে সংগীতশালায় সংগীতপ্রিয় দু-চারজনের সমাবেশ গানবাজনা এবং মাঝে মাঝে করতালি শোনা যাচ্ছে।

ক্রমে সাড়ে দশটা বাজে, মেয়েরা নেবে যায়, ডেকের উপরে আলো হঠাৎ যায় নিবে, ডেক নিঃশব্দ নির্জন অন্ধকার হয়ে আসে। চারিদিকে নিশীথের নিস্তব্ধতা, চন্দ্রালোক এবং অনন্ত সমুদ্রের অশ্রান্ত কলধ্বনি।

সকল অধ্যায়

১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০১
২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০২
৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৩
৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৪
৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৫
৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৬
৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৭
৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৮
৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৯
১০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১০
১১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১১
১২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১২
১৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৩
১৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৪
১৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৫
১৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৬
১৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৭
১৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৮
১৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৯
২০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২০
২১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২১
২২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২২
২৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৩
২৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৪
২৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৫
২৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৬
২৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৭
২৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৮
২৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৯
৩০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩০
৩১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩১
৩২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩২
৩৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৩
৩৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৪
৩৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৫
৩৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৬
৩৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৭
৩৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৮
৩৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৯
৪০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪০
৪১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪১
৪২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪২
৪৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৩
৪৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৪
৪৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৫
৪৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৬
৪৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন