য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১২

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৭ সেপে্‌ম্বর। আজ সকালে ব্রিন্দিসি পৌঁছনো গেল। মেলগাড়ি প্রস্তুত ছিল, আমরা গাড়িতে উঠলুম।

গাড়ি যখন ছাড়ল তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। আহার করে এসে একটি কোণে জানলার কাছে বসা গেল।

প্রথমে, দুই ধারে কেবল আঙুরের খেত। তার পরে জলপাইয়ের বাগান। জলপাইয়ের গাছগুলো নিতান্ত বাঁকাচোরা, গ্রন্থি ও ফাটলবিশিষ্ট, বলি-অঙ্কিত, বেঁটেখাটো রকমের; পাতাগুলো ঊর্ধ্বমুখ; প্রকৃতির হাতের কাজে যেমন একটি সহজ অনায়াসের ভাব দেখা যায়, এই গাছগুলোয় তার বিপরীত। এরা নিতান্ত লক্ষ্মীছাড়া, কায়ক্লেশে অষ্টাবক্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; এক-একটা এমন বেঁকে ঝুঁকে পড়েছে যে পাথর উঁচু করে তাদের ঠেকো দিয়ে রাখতে হয়েছে।

বামে চষা মাঠ; সাদা সাদা ভাঙা ভাঙা পাথরের টুকরো চষা মাটির মধ্যে মধ্যে উৎক্ষিপ্ত। দক্ষিণে সমুদ্র। সমুদ্রের একেবারে ধারেই এক-একটি ছোটো ছোটো শহর দেখা দিচ্ছে। চার্চচূড়া-মুকুটি সাদা ধবধবে নগরীটি একটি পরিপাটি তন্বী নাগরীর মতো কোলের কাছে সমুদ্র-দর্পণ রেখে নিজের মুখ দেখে হাসছে। নগর পেরিয়ে আবার মাঠ। ভুট্টার খেত, আঙুরের খেত, ফলের খেত, জলপাইয়ের বন; খেতগুলি খণ্ড প্রস্তরের বেড়া দেওয়া। মাঝে মাঝে এক-একটি বাঁধা কূপ। দূরে দূরে দুটো-একটা সঙ্গিহীন ছোটো সাদা বাড়ি।

সূর্যাস্তের সময় হয়ে এল। আমি কোলের উপর এক থোলো আঙুর নিয়ে বসে বসে এক-আধটা করে মুখে দিচ্ছি। এমন মিষ্ট টসটসে সুগন্ধ আঙুর ইতিপূর্বে কখনো খাই নি। মাথায় রঙিন রুমাল বাঁধা ওই ইতালীয়া যুবতীকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, ইতালিয়ানীরা এখানকার আঙুরের গুচ্ছের মতো, অমনি একটি বৃন্তভরা অজস্র সুডোল সৌন্দর্য, যৌবনরসে অমনি উৎপূর্ণ,– এবং ওই আঙুরেরই মতো তাদের মুখের রং– অতি বেশি সাদা নয়।

এখন একটা উচ্চ সমুদ্রতটের উপর দিয়ে চলেছি। আমাদের ঠিক নিচেই ডান দিকে সমুদ্র। ভাঙাচোরা জমি ঢালু জলের মধ্যে প্রবেশ করেছে। গোটা চার-পাঁচ পাল-মোড়া নৌকো ডাঙার উপর তোলা। নিচেকার পথ দিয়ে গাধার উপর চড়ে লোক চলেছে। সমুদ্রতীরে কতকগুলো গোরু চরছে– কী খাচ্ছে ওরাই জানে; মাঝে মাঝে কেবল কতকগুলো শুকনো খড়কের মতো আছে মাত্র।

রাত্রে আমরা গাড়ির ভোজনশালায় ডিনারে বসেছি, এমন সময়ে গাড়ি একটা স্টেশনে এসে দাঁড়াল। একদল নরনারী প্ল্যাটফর্মে ভিড় করে বিশেষ কৌতূহলের সঙ্গে আমাদের ভোজ দেখতে লাগল। তারই মধ্যে গ্যাসের আলোকে দুটি-একটি সুন্দর মেয়ের মুখ দেখা যাচ্ছিল, তাতে করে ভোজনপাত্র থেকে আমাদের চিত্তকে অনেকটা পরিমাণে বিক্ষিপ্ত করছিল। ট্রেন ছাড়বার সময়ে আমাদের সহযাত্রিগণ তাদের প্রতি অনেক টুপি রুমাল আন্দেলন, অনেক চুম্বন-সংকেত প্রেরণ, তারস্বরে অনেক উল্লাসধ্বনি প্রয়োগ করলে; তারাও গ্রীবা-আন্দোলনে আমাদের প্রত্যভিবাদন করতে লাগল।

সকল অধ্যায়

১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০১
২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০২
৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৩
৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৪
৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৫
৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৬
৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৭
৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৮
৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৯
১০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১০
১১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১১
১২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১২
১৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৩
১৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৪
১৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৫
১৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৬
১৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৭
১৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৮
১৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৯
২০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২০
২১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২১
২২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২২
২৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৩
২৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৪
২৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৫
২৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৬
২৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৭
২৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৮
২৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৯
৩০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩০
৩১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩১
৩২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩২
৩৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৩
৩৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৪
৩৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৫
৩৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৬
৩৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৭
৩৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৮
৩৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৯
৪০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪০
৪১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪১
৪২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪২
৪৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৩
৪৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৪
৪৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৫
৪৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৬
৪৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন