য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৭

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৬ অক্টোবর। এখনো আমাদের প্রবাসের সময় উত্তীর্ণ হয় নি, কিন্তু আমি আর এখানে পেরে উঠছি নে। বলতে লজ্জা বোধ হয়,আমার এখনো ভালো লাগছে না। সেটা গর্বের বিষয় নয়, লজ্জার বিষয়–সেটা আমার স্বভাবের ত্রুটি।

যখন কৈফিয়ত সন্ধান করি তখন মনে হয় যে, য়ুরোপের যে ভাবটা আমাদের মনে জাজ্বল্যমান হয়ে উঠেছে, সেটা সেখানকার সাহিত্য ইতিহাস পড়ে। সেটা হচ্ছে আইডিয়াল য়ুরোপ। অন্তরের মধ্যে প্রবেশ না করলে সেটা প্রত্যক্ষ করবার জো নেই। তিন মাস, ছ-মাস কিংবা ছ-বৎসর এখান থেকে আমরা য়ুরোপীয় সভ্যতার কেবল হাত-পা নাড়া দেখতে পাই মাত্র। বড়ো বড়ো বাড়ি, বড়ো বাড়ি কারখানা, নানা আমাদের জায়গা; লোক চলছে ফিরছে, যাচ্ছে আসছে, খুব একটা সমরোহ। সে যতই বিচিত্র, যতই আশ্চর্য হ’ক না কেন, তাতে দর্শককে শ্রান্তি দেয়; কেবলমাত্র বিস্ময়ের উত্তেজনা চিত্তকে পরিপূর্ণ করতে পারে না বরং তাতে মনকে সর্বদা বিক্ষিপ্ত করতে থাকে।

অবশেষে এই কথা মনে আসে–আচ্ছা ভালো রে বাপু, আমি মেনে নিচ্ছি তুমি মস্ত শহর, মস্ত দেশ, তোমার ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্যের সীমা নেই। অধিক প্রমাণের আবশ্যকতা নেই। এখন আমি বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি। সেখানে আমি সকলকে চিনি, সকলকে বুঝি; সেখানে সমস্ত বাহ্যাবরণ ভেদ করে মনুষ্যত্বের আস্বাদ সহজে পাই। সহজে উপভোগ করতে পারি, সহজে চিন্তা করতে পারি, সহজে ভালোবাসতে পারি। যেখানে আসল মানুষটি আছে সেখানে যদি অবাধে যেতে পরতুম, তা হলে বিদেশেও আপনার স্বজাতীয়কে দেখে এ-স্থানকে আর প্রবাস বলে মনে হত না। কিন্তু এখানে এসে দেখি কেবল ইংরেজ, কেবল বিদেশী, তাদের চালচলন ধরনধারন যা কিছু নূতন সেইটেই কেবল ক্রমিক চক্ষে পড়ে, যা চিরকেলে পুরাতন সেটা ঢাকা পড়ে থাকে; সেই জন্যে এদের সঙ্গে কেবল পরিচয় হতে থাকে কিন্তু প্রণয় হয় না।

এইখানে কথামালার একটা গল্প মনে পড়ছে।

একটা চতুর শৃগাল একদিন এক সুবিজ্ঞ বককে আহারে নিমন্ত্রণ করেছিল। বক সভায় গিয়ে দেখে বড়ো বড়ো থালা সুমিষ্ট লেহ্য পদার্থে পরিপূর্ণ। প্রথম শিষ্ট-সম্ভাষণের পর শৃগাল বললে, “ভাই, এস আরম্ভ করে দেওয়া যাক।” বলেই তৎক্ষণাৎ অবলীলাক্রমে লেহন করতে প্রবৃত্ত হল। বক তার দীর্ঘ চঞ্চু নিয়ে থালার মধ্যে যতই ঠোকর মারে মুখে কিছুই তুলতে পারে না। অবশেষে চেষ্টায় নিবৃত্ত হয়ে স্বাভাবিক অটল গাম্ভীর্যে সরোবরকূলে ধ্যানে নিমগ্ন হল। শৃগাল বোধ করি মাঝে মাঝে কটাক্ষপাত করে বলছিল, “ভাই, খাচ্ছ না যে। এ কেবল তোমাকে মিথ্যা কষ্ট দেওয়াই হল। তোমার যোগ্য আয়োজন হয় নি।” বক বোধ করি মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছিল, “আহা সে কী কথা। রন্ধন অতি পরিপাটি হয়েছে। কিন্তু শরীর গতিকে আজ আমার ক্ষুধা বোধ হচ্ছে না।” পরদিন বকের নিমন্ত্রণে শৃগাল গিয়ে দেখেন, লম্বা ভাঁড়ের মধ্যে বিবিধ উপাদেয় সামগ্রী সাজানো রয়েছে। দেখে লোভ হয় কিন্তু তার মধ্যে শৃগালের মুখ প্রবেশ করে না। বক অনতিবিলম্বে লম্বচঞ্চু চালনা করে ভোজনে প্রবৃত্ত হল। শৃগাল বাহিরের থেকে পাত্রলেহন এবং দুটো-একটা উৎক্ষিপ্ত খাদ্যখণ্ডের স্বাদগ্রহণ করে নিতান্ত ক্ষুধাতুরভাবে বাড়ি ফিরে গেল।

জাতীয় ভোজে বিদেশীর অবস্থা সেইরকম। খাদ্যটা উভয়ের পক্ষে সমান উপাদেয় কিন্তু পাত্রটা তফাৎ। ইংরেজ যদি শৃগাল হয় তবে তার সুবিস্তৃত শুভ্র রজতথালের উপর উদ্‌ঘাটিত পায়সান্ন কেবল চক্ষে দর্শন করেই আমাদের ক্ষুধিতভাবে চলে আসতে হয়, আর আমরা যদি তপস্বী বক হই, তবে আমাদের সুগভীর পাথরের পাত্রটার মধ্যে কী আছে শৃগাল তা ভালো করে চক্ষেও দেখতে পায় না– দূর থেকে ঈষৎ ঘ্রাণ নিয়েই তাকে ফিরতে হয়।

প্রত্যেক জাতির অতীত ইতিহাস এবং বাহ্যিক আচারব্যবহারে তার নিজের পক্ষে সুবিধা, কিন্তু অন্য জাতির পক্ষে বাধা। এই জন্য ইংরেজসমাজ যদিও বাহ্যত সাধারণসমক্ষে উদ্‌ঘাটিত কিন্তু আমরা চক্ষুর অগ্রভাটুকুতে তার দুই-চার ফোঁটার স্বাদ পাই মাত্র, ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারি নে। সর্বজাতীয় ভোজ কেবল সাহিত্য-ক্ষেত্রেই সম্ভব। সেখানে যার লম্বা চঞ্চু সে-ও বঞ্চিত হয় না, যার লোলজিহ্বা সে-ও পরিতৃপ্ত হয়।

কারণটা সাধারণত হৃদয়গ্রাহী হ’ক বা না হ’ক এখানকার লোকের সঙ্গে হৌ-ডু-য়ু-ডু বলে, হাঁ করে রাস্তায় ঘাটে পর্যটন করে, থিয়েটার দেখে, দোকান ঘুরে, কলকারখানার তথ্য নির্ণয় করে–এমন কি, সুন্দর মুখ দেখে আমার শ্রান্তি বোধ হয়েছে।

এতএব স্থির করেছি এখন বাড়ি ফিরব।

সকল অধ্যায়

১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০১
২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০২
৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৩
৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৪
৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৫
৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৬
৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৭
৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৮
৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ০৯
১০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১০
১১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১১
১২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১২
১৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৩
১৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৪
১৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৫
১৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৬
১৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৭
১৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৮
১৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ১৯
২০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২০
২১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২১
২২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২২
২৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৩
২৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৪
২৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৫
২৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৬
২৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৭
২৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৮
২৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ২৯
৩০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩০
৩১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩১
৩২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩২
৩৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৩
৩৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৪
৩৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৫
৩৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৬
৩৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৭
৩৮. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৮
৩৯. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৩৯
৪০. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪০
৪১. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪১
৪২. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪২
৪৩. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৩
৪৪. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৪
৪৫. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৫
৪৬. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৬
৪৭. য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি – ৪৭

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন