ভাঙাপুকুর রহস্য – ৩

ঘণ্টা পড়তেই পরিমল ঘোষ নিজের খাতা বন্ধ করলেন।
ছাত্রছাত্রীদের বিদায় জানিয়ে ক্লাসঘর থেকে বেরোতে বেরোতে তার মুখটা একটু যেন ভারী।
মুখে অভ্যস্ত হাসিটা থাকলেও চোখের ভেতর ছায়া — যেন অন্য কিছু ভাবছিলেন।

চোখে চশমা তুলে কপালে ঘাম মুছলেন। ঘাড়টা ডানদিকে হেলিয়ে একটু খটখট শব্দে কাঁধ নাড়লেন।
“এই বয়সে হাড়-জোড়ও ক্লান্ত হয়ে যায়,”—নিজের মনেই হেসে ফেললেন।

হাতের নিচে একখানা খাতা আর কলম নিয়ে ধীরে ধীরে স্কুলের অফিস ঘরের দিকে এগোলেন।

ঠিক তখনই হেডস্যার হরিহরবাবু বারান্দা ধরে হাঁটছিলেন।
দুজনের চোখাচোখি হতেই পরিমলবাবু বললেন,
“গুড মর্নিং স্যার!”
হাসি মিলিয়ে মৃদু নমস্কার।

হেডস্যারও হাসলেন, “গুড মর্নিং পরিমল। ক্লাস কেমন হল?”

পরিমলবাবু একটু হালকা মুখে বললেন,
“ক্লাস তো খারাপ না, তবে আজ একটা জিনিস পড়ালাম — ‘মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন’ — বুঝলেন, ব্যাপারটা এমন যে যদি সোজা করে বলি, তো বাচ্চারা বোর হয়ে যায়… আর জটিল করে বললে তো কথাই নেই, ক্লাসে দু-চারজন নিদ্রাভঙ্গ করেই ফেলে।”

হেডস্যার হেসে বললেন,
“তা হলে তুমি কী ভাবছো?”

পরিমলবাবু একটু উত্তেজিত স্বরে বললেন,
“ভাবছিলাম একটা ছোটখাটো চার্ট বানিয়ে ফেলি নিজেই—রঙিন কাগজে ধমনী-শিরা আঁকা থাকবে, ওর নাম থাকবে, আর কিউ-কার্ডের মতো ছোট ছোট কুইজ…
আরেকটা ভাবনা হল, এই বিষয়টা একটা গল্পের মধ্যে রেখে বলি।
যেমন, ‘রক্ত কেমন করে সারা দেহ ঘুরে বেড়ায় — একদিন রক্তকণিকার অভিযান!’
কি বলেন?”

হেডস্যার হেসে মাথা নেড়ে বললেন,
“তুমি তো আগেও এমন ভাবনা এনেছিলে, খুব ভালো লাগছে শুনে।
ছাত্রছাত্রীরাও যেন ভয় না পায় বইয়ের পাতায় — সেটাই বড় কথা।”

দুজনেই ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে মূল বিল্ডিংয়ের পাশের ফুটপাথ ধরে চলছিলেন।

ঠিক সেই সময় পাশের গেটের ধারে একটা ভাঙা বেঞ্চির পাশে বসে থাকা এক লোককে দেখে দুজনেই থমকে দাঁড়ালেন।

এক অদ্ভুত চেহারা।
চুলগুলো জট পাকানো, যেন অনেকদিন জল বা চিরুনি ছুঁয়েও দেখেনি।
দাঁড়ি মুখে এমনভাবে গজিয়েছে, যেন গাছের শেকড় গলার চারপাশ ঘিরে ধরেছে।
গায়ে ছেঁড়া ময়লা হাফ প্যান্ট, তার ওপর একটা মলিন হলুদ রঙের শার্ট — একপাশে বোতাম নেই, আরেকপাশ ছেঁড়া।

লোকটা মাটি থেকে কিছু কুড়োচ্ছে, কখনো নিজের গাল টিপছে, কখনো তাকিয়ে হাসছে অকারণে।

হেডস্যার একটু বিরক্ত মুখে বললেন,
“উফ! এটা যে আবার কোথা থেকে জুটল!”

পরিমলবাবু অবাক হয়ে বললেন,
“কে উনি? আগে তো দেখিনি।”

হেডস্যার গলা নামিয়ে বললেন,
“এই পাগলটা মাস দুয়েক আগে এখানে এসে জুটেছে।
কোথা থেকে এসেছে, কেউ জানে না।
দিনের বেলা স্কুলের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে।
রোজ দশ টাকা বেরিয়ে যায় আমার — একে না দিয়ে পারা যায়?”

পরিমলবাবুর চোখ একটু মিইয়ে গেল।
লোকটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
“এরা যেমন অদৃশ্য হয়ে আসে, তেমনি কোনোদিন হারিয়েও যায়…
কিন্তু কোথা থেকে আসে, কেন আসে — কেউ জানে না।”

পাগলটিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন হেডস্যার ও পরিমলবাবু।
ঠিক সেই সময় পাশের রাস্তা ধরে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল নুপুর।

চোখেমুখে ক্লান্তি, কিন্তু ভেতরে একটা জেদ যেন স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে।
সকালবেলার হালকা রোদে তার মুখটা ম্লান লাগলেও দৃষ্টিতে ছিল অদ্ভুত দৃঢ়তা।

হেডস্যার নুপুরকে দেখে মনে মনে একটু বিরক্ত হলেন।
‘আবার এল… একটানা ঘুরে ঘুরে একটা প্রশ্ন নিয়েই যেন সব জাগতিক নিয়ম ভেঙে দিয়েছে মেয়ে।’
তবু মুখে ফুটিয়ে তুললেন একপ্রকার সৌম্যতা।
হালকা হাসি এনে বললেন,

“আরে নুপুর! তুমি আবার এসেছো? এসো মা, এসো। চলো আমার কেবিনে গিয়ে বসো। আমি একটু পরে আসছি।”

নুপুর সোজাসুজি বলল,
“না স্যার, আসলে আমি অবিনাশ স্যারকে খুঁজছিলাম। উনি বলেছিলেন আজ থানায় যাবেন, দারোগাবাবুর সাথে কিছু কথা বলবেন। তাই এসেছি।”

হেডস্যার একটু কপালে ভাঁজ ফেললেন।
“অবিনাশ? থানায়? কেন, এসবের মধ্যে আবার সে পড়ল কেন?”
শব্দটা মুখে আনেননি ঠিক, কিন্তু ভাবটা স্পষ্ট ছিল চেহারায়।

ঠিক তখনই বারান্দার দিক থেকে অবিনাশ এসে পড়ল।

সাদা পাঞ্জাবি-পাজামার ওপর কাঁধে রাখা খাতা, চোখে সেই শান্ত দৃঢ়তা।
দু’জন শিক্ষক ও নুপুরকে একসাথে দেখে সে হাসিমুখে বলল,
“গুড মর্নিং স্যার, গুড মর্নিং পরিমলবাবু, গুড মর্নিং নুপুর।”

হেডস্যার তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন, কিন্তু মুখে সেই আগাগোড়া সংযত ভঙ্গি।
“অবিনাশ, শুনলাম তুমি নাকি নুপুরের সাথে থানায় যাচ্ছ?”

অবিনাশ বিনয়ের সুরে বলল,
“হ্যাঁ স্যার। উনি চেয়েছিলেন আমি একটু সঙ্গে থাকি। তাই বলেছিলাম ওঁকে নিয়ে যাব।”

হেডস্যার এবার একটু সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
“কিন্তু তোমার তো ক্লাস আছে আজ, না?”

অবিনাশ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“স্যার, আমার ক্লাসটা হয়ে গেছে। এখন এক ঘণ্টার মতো অফ টাইম।
এই সময়টার মধ্যেই থানায় গিয়ে কাজটা সেরে চলে আসব।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ক্লাসে কোনো সমস্যা হবে না।”

হেডস্যার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।

তারপর ধীরে বললেন,
“ঠিক আছে। যাও। কিন্তু সাবধানে থেকো।”

অবিনাশ মাথা নোয়াল।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নুপুরের মুখে তখন একটা কৃতজ্ঞতার ছায়া —
একটা সাথী পেয়েছে সে, অন্তত কথা বলার মতো একজন।

ভাঙ্গাপুকুর থানার দালানে ঢোকার মুখেই একটা ময়লা বেঞ্চ।
পাশে একটা ভাঙা বোর্ডে ঝোলানো — “সাধারণ ডায়েরি – সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা”।
পর্দা সরিয়ে নুপুর ও অবিনাশ ভেতরে ঢুকল।

দারোগা অনুপমবাবু কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে, পেট বের করা ফতুয়া পরে চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন।
চোখে ঝিমঝিম ভাব, টেবিলের এক কোণে মোবাইলে হালকা গেম চালু।

দুজনে ঢুকতেই মাথা তুললেন।
“আহা… আবার?” — বললেও গলায় বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই।

নুপুর এগিয়ে এসে বলল,
“স্যার, রিমার ব্যাপারে কিছু জানতে এসেছিলাম। তিন সপ্তাহ হয়ে গেল — কিছুই জানি না আমরা।”

অনুপমবাবু হালকা গলায় বললেন,
“আর জানেন কি, এই কেসে তো সেরকম কিছু লিডও নেই।
তদন্ত করতে গেলে কিছু না কিছু দিক লাগে…
সেইটুকু তো আমরা পাইনি এখনো।”

নুপুরের গলার সুর এবার খানিক কেঁপে উঠল,
“কিন্তু স্যার, কিছু তো করুন! এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কী করে চলবে?”

অনুপমবাবু এবার চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন, চোখে একটু বিরক্তি।
“আপনারা তো বোঝেন না মা, এই থানায় কত রকম কেস চলে একসাথে।
তবে বিশ্বাস রাখুন — আমরা বসে নেই।”

এই সময় অবিনাশ একটু এগিয়ে এসে বলল,
“স্যার, রিমার খাতাটা আমি দেখেছি। ওর শেষ পাতায় কিছু অদ্ভুত লেখা ছিল।
চাইলে সেটা আপনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টের কাছে পাঠাতে পারেন।
শুনেছি অনেক কিছু বিশ্লেষণ করা যায় এখন…”

এই কথায় অনুপমবাবুর চোখ কুঁচকে উঠল।

তিনি মোবাইলটা টেবিলে ফেলে একরকম শব্দ করে উঠলেন,
“আঃ! আপনারা এখন সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ দেখে এসে আমাদের পুলিশিং শেখাবেন?”

তার কণ্ঠে হালকা ব্যঙ্গ।

“ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফরেনসিক, সাইকোলজিক্যাল প্রোফাইলিং — এগুলো শুনেছেন কোথায়?
দেখুন মশাই, পুলিশের কাজ কীভাবে হয় সে নিয়ে আপনাদের কোনও আইডিয়া নেই।
আমরা আমাদের মতো করে, ভেতরে ভেতরে যা করার করছি।
আপনারা যদি এতই জানেন — তাহলে নিজেরাই তদন্ত করে ফেলুন।”

এক মুহূর্ত নীরবতা।

অবিনাশ মুখ থামিয়ে ফেলল।

দারোগাবাবু এবার চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে গম্ভীর সুরে বললেন,
“এবার দয়া করে উঠুন। আমার সামনে অনেক ফাইল পড়ে আছে।
যত তাড়াতাড়ি পারি কিছু করব — কিন্তু এরকম প্রশ্ন করে আমাদের পেশাদারিত্বে সন্দেহ তোলা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।”

নুপুর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, চোখ দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে।
কিন্তু সে আর কোনও কথা বলেনি।

অবিনাশ তাকিয়ে রইল ফাঁকা দেওয়ালের দিকে —
সেখানে এক পুরনো পোস্টার ঝুলছে:
“আপনার পুলিশ — আপনার পাশে”

থানার দরজার নিচ দিয়ে ছায়া গড়িয়ে পড়ছিল রাস্তায়।
অবিনাশ বাইক স্টার্ট করল। নুপুর চুপচাপ পিছনে বসল, মুখে অসন্তোষের এক চাপা রেখা। থানার ভিতরের কথোপকথন যেন তার ভেতরটা পোড়াচ্ছিল।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

রাস্তায় গাছের ছায়া সরে আসছে এক পাশে, বাতাসে পাতা উড়ছে।
অবিনাশ মুখ ঘুরিয়ে হালকা গলায় বলল,
“আপনি ঠিক আছেন তো?”

নুপুর সামান্য থেমে বলল,
“হ্যাঁ, তেমন কিছু না। এসব কথাবার্তা শুনে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।”

অবিনাশ বলল,
“তারপরও, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনাকে ঠান্ডা মাথায় যেভাবে অপমান করল… সেটা মেনে নেওয়ার মতো না।”

নুপুর হালকা হাসল, “মেনে নেওয়া ছাড়া আর কী বা উপায় আছে? অনেক দিন ধরেই এসব দেখে আসছি। কেউ শোনে না, কেউ দেখে না।”

তারপর দুজনে আবার চুপ। বাইক চলছিল গ্রামের ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে।

হঠাৎ, এক মুহূর্ত!

সামনের বাঁক ঘুরতেই  পাগলটা ছুটে এসে সোজা বাইকের সামনে দাঁড়াল!
সেই পাগলটা — এলোমেলো চুল, দাড়ি জট পাকানো, ছেঁড়া হলুদ জামা, এক চোখে ভয়াবহ ফাঁকা দৃষ্টি।

“সাবধান!”
অবিনাশ জোরে ব্রেক চাপল।

চাকা কাঁপতে কাঁপতে ঘষে গেল কাঁচা রাস্তায়, আর নুপুর ছিটকে পড়তে পড়তে কেবল সামলে নিল নিজেকে।
বাইকের ভারসাম্য সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল না, কিন্তু চাকা ঘুরতে ঘুরতে থেমে গেল।
বাইকের হেডলাইটটা একটু নিচে মুখ করে ঝিমিয়ে পড়ল।

অবিনাশ কাঁপা গলায় বলল,
“এটা আবার কোথা থেকে এল!”

নুপুর তখন ধুলোমাখা জামা সামলে দাঁড়াচ্ছে।
পাগলটা তখন রাস্তার ধারে এক চিলতে ঘাসে বসে মাটি কুড়োচ্ছে, যেন কিছু ঘটেইনি।

অবিনাশ আবার বাইক স্টার্ট করতে গেল, কিন্তু ইঞ্জিন একবার ঘড়ঘড় করে উঠেই থেমে গেল।

চুপচাপ… গায়ের পেছনে গাছেদের ছায়া আর দূরে একটা চিলের ডাক।

ঠিক তখনই অবিনাশের চোখ গেল — রাস্তার একপাশে একটা ছোট পরিত্যক্ত বিল্ডিং
জং ধরা টিনের ছাউনি, কাঠের দরজায় রঙ উঠে গেছে, জানালার কাঁচ ভাঙা।

সে নুপুরকে বলল,
“এই বিল্ডিংটা কি… এখানে আগে কিছু হত?”

নুপুর তাকিয়ে বলল,
“না… মানে, ছোটবেলা থেকে দেখছি এটা এভাবেই পড়ে আছে। শুনেছি পুরোনো ত্রাণ কেন্দ্র ছিল একসময়, পরে কেউ আর ব্যবহার করেনি। এখানে কেউ থাকে না।”

অবিনাশ কিছুক্ষণ স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকল বিল্ডিংটার দিকে।

তারপর ধীরে বলল,
“কিন্তু একটা কথা বলুন তো—এখানে আশেপাশে তো প্রচুর গাছপালা, ঝোপঝাড়…
কিন্তু এই বাড়িটার সামনের মাটি পুরো পরিষ্কার।
পাতা নেই, ধুলোও জমে নেই — যেন কেউ নিয়ম করে ঝাড় দিয়ে রাখে।”

নুপুর কিছু বলল না। অবিনাশ তখন হেঁটে এগোতে শুরু করল।
নুপুরও কৌতূহলে পিছনে এল।

দরজাটা সামান্য ঠেলতেই একটা কঁকিয়ে ওঠা শব্দে খুলে গেল।

ভেতরে একটা ঘন, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ।
চোখ একটু অভ্যস্ত হতে সময় লাগল।

তারপর…

এক কোণে পড়ে আছে চার-পাঁচটি বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ।
পচে গেছে চামড়া, অনেক জায়গা হাড় বেরিয়ে এসেছে।
গায়ের জামাকাপড় ছিঁড়ে লেপ্টে আছে শরীরে।
কোনো মুখই চেনার মতো নেই, শুধুই ছায়া আর গন্ধ।

নুপুর হঠাৎ দম বন্ধ করে চিৎকার করে উঠল —
“না… না… এটা… এটা তো রিমার জামা!
এই জামাটা আমি নিজে কিনে দিয়েছিলাম! এটা তো… রিমা… তাহলে এটা কি…?”

কথাগুলো গলার কাছে জমে গেল।

তার মুখে তখন আর কোনো শব্দ নেই। শুধু কান্না নয়, আতঙ্ক নয় — ধ্বংস হয়ে যাওয়ার এক গভীর স্তব্ধতা।

অবিনাশ দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল হয়ে।

আর বাইরের পাগলটা দূর থেকে তাকিয়ে হাসছে।
হয়তো হাওয়ায় আবার একটা চিল ডাকল।

ছোট্ট সেই পরিত্যক্ত ঘরটার সামনে তখন ভিড় জমেছে।
পুলিশের গাড়ির সাইরেন থেমে গেছে, মাটিতে পড়েছে বহুজনের পায়ের ছাপ।
চারপাশে কৌতূহলী মানুষের গুঞ্জন, আতঙ্ক আর কৌতূহলের মাঝামাঝি এক অস্বস্তিকর নিঃশব্দতা।

নুপুর একটা খালি বেঞ্চে বসে কাঁপছে।

কান্নাটা এখন আর নিয়ন্ত্রণে নেই।
চোখ, গলা, মুখ — সব কিছুর রেখায় ছড়িয়ে গেছে ব্যথা আর বিপন্নতা।
সে মুখে বলছে না কিছু, শুধু নিজেকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদছে।
তার চোখের সামনে তখনো ঘুরে ঘুরে আসছে সেই জামা — রিমার জামা।

পরিমলবাবু তার একটু পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, মুখ থমথমে।

হেডস্যার ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এলেন, মাথা নিচু, কপালে গভীর ভাঁজ।
তার দৃষ্টি গেল পচে যাওয়া সেই লাশগুলোর দিকে, আবার পড়ল নুপুরের কাঁধে।

হঠাৎ নিঃশব্দে বললেন,
“পরিমল, এগুলো তো… এগুলো তো আমাদের স্কুলের শিশুরা!
ওরা যে ক্লাস ফাইভে পড়তো… আমারই চোখের সামনে বড় হচ্ছিল…”

পরিমলবাবু হালকা গলায় বললেন,
“কেউ কল্পনা করতে পারবে না হরিহরবাবু, এমনটা আমাদের এই ভাঙাপুকুরে হবে।
এতদিন যেটা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছি… সেই গুজবটাই সত্যি হয়ে গেল আজ।”

দারোগা অনুপমবাবু তখন লাশগুলো দেখেও যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
গায়ে হালকা ধুলো পড়েছে, তিনি তা ঝাড়ছেন।

মুখে এক ধরনের গা-ছাড়া ভাব।

অবিনাশ এগিয়ে এসে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“স্যার, এখনো কি আপনি চুপ করে বসে থাকবেন?
এটা কি আপনার কাছে গুজবের মতোই লাগছে?”

দারোগা অনুপমবাবু হালকা ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
“মশাই, আপনি তো এমন করে বলছেন যেন আমি ঘরে বসে হুঁকো টানছি।
তদন্ত করতে গেলে সময় লাগে, সবকিছু একদিনে হয় না।
আর আপনাদের মতো লোকজন সিনেমা আর সিরিজ দেখে এসে ভাবেন আমরা শুধু ঘুমিয়ে থাকি।”

অবিনাশ গলার সুরে চাপ দিয়ে বলল,
“আর একটুও দেরি করলে চলবে না।
বডিগুলোকে এক্ষুনি ফরেনসিক টিমের কাছে পাঠান।
তদন্ত এখনই শুরু করা দরকার — এক মুহূর্তের দেরিও চলবে না!”

অনুপমবাবু এবার চোখ পাকিয়ে বললেন,
“দেখুন, আপনি তো এখন এমনভাবে বলছেন, যেন আপনি আমার সিনিয়র!
আমারও অফিস আছে, নিয়ম আছে।
বডিগুলো মর্গে পাঠাচ্ছি।
নতুন ডিএসপি সাহেব যেদিন আসবেন, সেদিনই অফিশিয়ালি তদন্ত শুরু হবে।”

এক মুহূর্তের নীরবতা।

হেডস্যার, পরিমলবাবু, এমনকি আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই কনস্টেবল পর্যন্ত তাকিয়ে রইল অবিনাশের দিকে।

অবিনাশ সোজা দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলল—
“আমিই এখানকার নতুন ডিএসপি।”

এক মুহূর্ত যেন সময় দাঁড়িয়ে গেল।

নুপুর চোখ তুলে তাকাল, হেডস্যারের মুখ থমকে গেল, পরিমলবাবুর ঠোঁটে হালকা চমক।

দারোগা অনুপমবাবু এক পা পিছিয়ে এসে ঠোঁট চেপে ধরলেন, মুখটা স্পষ্টত থমকে আছে।

অবিনাশ এবার কেবল বলল,
“আপনি এবার তদন্ত শুরু করুন।”

তার গলায় কোনও নাটকীয়তা নেই —
শুধু আদেশের সেই নিরব, অথচ ভয়ংকর দৃঢ়তা।

বাতাসে একটা বদলে যাওয়া ভার জমে রইল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন