ভাঙাপুকুর রহস্য – ৫

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের সেই প্রথম ক্লাসটা পরিমলের আজও মনে আছে।
বাকি ছাত্রছাত্রীরা হইচই করছিল, প্রফেসর একটা খেলনা সাপ ছুঁড়ে দিলেন হঠাৎ, আর একটা মেয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠে পেছনের বেঞ্চে লাফিয়ে গিয়েছিল।

তখন সবাই হাসছিল —
কিন্তু পরিমল হাসেনি।
সে কেবল তাকিয়ে ছিল মেয়েটির চোখের পুতলির দিকে, মুখের খিঁচুনি, ঠোঁটের কাপুনির দিকে।
তার মনে হয়েছিল — ভয়ের এই মুহূর্তটা… অসম্ভব সুন্দর।

সেদিন বাড়ি ফিরে সে প্রথমবার নিজের ডায়েরিতে লিখেছিল—

“Subject A: Right eye dilation: 0.5 cm | Upper lip curl | Scream: ~3.2 sec
Fear = সুন্দর।”

এরপর থেকে ভয় তাকে আর পিছু ছাড়েনি।
সে প্রতিদিন কাউকে না কাউকে ভয় দেখানোর ছুতো খুঁজে বের করত।

প্রথমে হোস্টেলে রুমমেটকে, পরে বন্ধুদের।
কেউ তার খাবারে লবণ বেশি পড়িয়ে দিয়েছিল — সে রাত্তিরে তার রুমে একটা ছোট রেকর্ডার লাগিয়ে ভয়ানক আওয়াজ ছেড়ে দিয়েছিল।
একটা ছেলের গার্লফ্রেন্ডের ছবি সে ম্যানিপুলেট করে পাঠিয়ে দিয়েছিল অন্য ছেলের ফোনে।
সে ব্ল্যাকমেল করত, শুধু একটা মুখ দেখার জন্য — সেই মুহূর্তটা যখন মানুষ মুখ দিয়ে ভয়ের শেষ অভিব্যক্তিটা ছুঁড়ে দেয়।

সে ওই মুহূর্তগুলো নোট করে রাখত, আঁকত, তুলনা করত —
ভয়ের চেহারাগুলো যেন তার গ্যালারি।

একদিন সে তার প্রফেসর সোমেন্দ্র দাশের কাছে গেল।
একটা টিউটোরিয়াল ক্লাসের পরে জিজ্ঞেস করল:

– “স্যার, ভয় কি সত্যিই কেবল survival mechanism?
নাকি এটা control এর একটা gateway?”

প্রফেসর একটু চমকে উঠেছিলেন।
“তুই এই প্রশ্ন করছিস কেন?”
পরিমল একটু হেসে বলেছিল,
“ভয়ের সময় মানুষের চোখ ঠিক কীভাবে নড়ে সেটা আমি খেয়াল করি…
অনেকেই ভাবে, আমি কৌতূহলী।
আসলে আমি শুধু জানতে চাই – মানুষ কীভাবে ভেঙে পড়ে।”

সেদিন মৃণাল স্যারের চোখে একটা অনুজ্ঞার ছায়া ছিল।
তিনি বলেছিলেন,
“সাইকোলজি জানার চেয়ে ভয়ংকর কিছু নেই, যদি তুমি সেটা অনুভব না করে, ব্যবহার করতে চাও।”

সেই রাতেই পরিমল তার খাতায় লিখেছিল:

“Fear isn’t just a response. It’s a lever.
If you know which muscle twitches first,
you know where to press hardest.”

এরপর তার পরীক্ষা শুরু হয়েছিল —
নাটমন্দিরে এক ছেলেকে তার ভয়সুত্রে টেনে এনেছিল,
একটা বাচ্চাকে অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছিল কেবল বুঝতে,
সে কতক্ষণ কাঁদবে।

কেউ টের পায়নি।

স্নাতক শেষ করার আগেই তার খাতায় লেখা ছিল —
Subject 1A to 8C পর্যন্ত
প্রতিটা “সাবজেক্ট” ছিল মানুষ — যার ভয় সে অনুভব করেছিল, মেপেছিল, এবং কখনও কখনও… চিরতরে নীরব করে দিয়েছিল।

***

ঘরটা নিঃশব্দ।
নুপুর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ঠান্ডা ধাতব চেয়ারে বসে আছে। মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখে অবিশ্বাস আর অবসাদের ছায়া।

কিন্তু সেই সব অনুভব থেকে বহু দূরে দাঁড়িয়ে আছে পরিমল ঘোষ—
এক হাতে পুরোনো চামড়ার বাঁধাই ডায়েরি, অন্য হাতে কালো রঙের ফাউন্টেন পেন।

সে একটু ঝুঁকে এসে নুপুরের মুখের একপাশে তাকাল, তারপর ডায়েরিতে লিখল—

Subject 6F – প্রথম পর্যায়ের ভয় প্রতিক্রিয়া:
Pupillary dilation: দ্রুত
Respiratory rate: 21/sec
Jaw tightening: স্থায়ী
চোয়ালে ক্লান্তি আসছে না। শক্ত মন। চমৎকার।

তারপর সে ঘরের কোণ থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করল।
ভেতরে ছিল কাচের বয়ামে রাখা অদ্ভুত সব পোকামাকড় — বাদামী লোমে মোড়া, ছোট চোখ, সরু পা — যেন জ্যান্ত দুঃস্বপ্ন।

নুপুর তাকিয়ে ছিল।
সে চিৎকার করতে চেয়েছিল, কিন্তু ভয় সেই মুহূর্তে গলায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

পরিমল একটাকে বেছে নিল —
একটা পিঁপড়ের মতো পোকা, কিন্তু হালকা নীলচে রঙের, আর অতিরিক্ত পা।
সে সেটাকে আলতো করে নুপুরের গলা বরাবর ছেড়ে দিল।

নুপুর চিৎকার করল না।
কিন্তু তার শ্বাস দ্রুত হয়ে উঠল, চোখ বুজে নিল সে — ঠোঁটের কাঁপন থামাতে পারল না।

পরিমল আবার লিখল—

Test 1 – Crawling insect on neck
Vocal outburst: No
Eye clenching: Yes
Skin flush: Partial
Tremor: Left shoulder 1.2 sec
Fear with suppression — ব্যতিক্রমী প্রতিক্রিয়া।

এরপর সে একটা ছোট চিরুনির মতো যন্ত্র আনল —
যার এক পাশে ছিল ছোট্ট একটা স্ট্রব লাইট।
নুপুরের চোখের সামনে হঠাৎ সেই আলো অন-অফ হতে লাগল প্রতি সেকেন্ডে পাঁচবার করে।

নুপুরের মাথা ঝিমিয়ে পড়ল, ঘাড় বেঁকে গেল পাশের দিকে।

Test 2 – Strobing light sensory aggression
Pupillary disorientation: Confirmed
Weak nausea reflex observed
Mental strain line appearing in forehead
দ্রুত ভাঙছে না – ব্যতিক্রমধর্মী subject।

এরপর ঘরের পাশে রাখা স্পিকারে চালু করল একটা ভয়ঙ্কর বিকৃত অডিও রেকর্ডিং —
মৃত বাচ্চাদের কান্না আর দূরের ট্রেনের শব্দের সঙ্গে মিশে থাকা এক নারীর ফিসফাস—
“তোর পালাবার পথ নেই…”

নুপুর গলার রগ কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল —
“থামাও এটা! থামাও… প্লিজ!”

পরিমল সেই চিৎকার শোনার সময় তার চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির রেখা ফুটে উঠল।
সে ধীরে ডায়েরির পাতায় লিখল—

Test 3 – Auditory phobia projection
Vocal explosion: Yes
Pulse spiked – 132/min
Mental resistance dropping
চমৎকার। Subject ready for deep psychological intervention.
নুপুর এখন প্রকৃত পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত।

তারপর সে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এল।
নুপুর তখন নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না — না সে ঠিক কাঁদছে, না একেবারে নিঃশব্দ।

পরিমল তার কানে একদম কাছে গিয়ে বলল—
“তোমার ভয় এখন আমার নিয়ন্ত্রণে। তুমি এখন আমার তৈরি গল্পের চরিত্র —
আর গল্পটা শেষ হবে, তখনই, যখন আমি বলব।”

নুপুর ধীরে ধীরে মাথা তোলে।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত — তবু চোখে একরকম দৃঢ়তা।
তাকে পরীক্ষা করা হচ্ছিল, অথচ এখন সে প্রশ্ন করতে চায়। সে ভাবতে চায় — পরিমল ঘোষ কেন এমন করছে?

“স্যার…” তার গলা কাঁপে, কিন্তু ভাঙে না।
“আপনি কেন এসব করছেন?
কি লাভ হবে এগুলো করে?
অর্থের জন্য? পয়সার জন্য?”

পরিমল একটু হাসে, ঠোঁটের কোণে একটা অদ্ভুত বক্রতা।
তার ডায়েরিটা বন্ধ করে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে—

“নুপুর, মনুষ্যজাতির মধ্যে তুমি একটা তুচ্ছ উদাহরণ।
তুমি ভাবছো টাকা… টাকা…
এটাই সব কিছু?”

সে ঘর থেকে ধীরে উঠে একটা ধুলো জমা আলমারি থেকে একটা পুরনো খাম বের করে দেখায়।

“হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অফার এসেছিল।
প্রফেসরশিপ — বেতনের অংকটা শুনলে তুমি নিজের গ্রাম বেচে দিতে চাইবে।
আমি চাইলে আজও সেই আমেরিকার বড়সড় ল্যাবে বসে দামি কোট পরে চকচকে আলোতে গবেষণা করতে পারতাম।
কিন্তু না… আমি এসেছি এখানে। এই দেশে। এই মাটিতে।
টাকায় কিছু আসে যায় না।”

নুপুর কপালে জমে থাকা ঘাম গড়িয়ে পড়তে দেখে, চোখ না সরিয়েই বলে—
“তাহলে আপনি কী চান?
কেন করছেন এই ভয়ানক কাজগুলো?”

পরিমল এবার চোখে আগুন টেনে আনে, মুখের চামড়া টানটান হয়।
“তুমি ভাবছো আমি কী করছি সেটা তোমার মাথায় ঢুকবে?
আমি একজন গবেষক — নিউটনের মতো, আইনস্টাইনের মতো!
তাদের থিওরি, আমার বাস্তব।
তারা গণনা করেছিল পদার্থ, আমি পরিমাপ করছি ভয়।
এই মস্তিষ্ক, এই স্নায়ু, এই হৃদপিন্ড — সব আমার গবেষণার বিষয়।”

নুপুর এবার চিৎকার করে ওঠে,
“তাই বলে আপনি মানুষ খুন করবেন?!
ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে পরীক্ষা করবেন?!”

পরিমল দাঁত চেপে উত্তর দেয় —
“বাজে কথা বলো না।
আমি কাউকে খুন করিনি, আমি কাউকে মেরেও ফেলিনি।
আমি শুধু ভয় দেখিয়েছি।
শুধু পর্যবেক্ষণ করেছি, টুকলি করেছি, বিশ্লেষণ করেছি।
যদি কারও হার্ট ফেইল করে যায় — সেটা কি আমার দোষ?
বড় কাজ করতে গেলে collateral damage মেনে নিতে হয়।
তুমি সেটা বুঝবে না। কারণ তুমি subject — researcher নও।”

নুপুরের চোখ দুটো এবার কাঁপছে, কিন্তু ভয়ে নয় — রাগে।
সে কিছু বলার জন্য ঠোঁট খুলে, কিন্তু পরিমল তখনই ডায়েরির নতুন পাতায় লিখতে ব্যস্ত।

Subject 6F – Cognitive Retort Level: HIGH
Emotion: Anger surpassing Fear.
Possibly unstable.
Excellent.

ঘরটা নিঃশব্দ।
ডায়েরির শেষ লাইনটা লিখে রেখে পরিমল ঘোষ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।

তার চোখে কোনো আবেগ নেই, মুখে কেবল একরাশ নিরুত্তাপ ক্লান্তি।
বাঁ হাত দিয়ে সে আলমারির ওপর থেকে ধুলোর মধ্যে চাপা পড়ে থাকা একটি ছোট ধারালো অস্ত্র তুলে নিল —
ছুরি নয়, যেন এক অদ্ভুত নকশার মেডিক্যাল যন্ত্র — যা কেবল গবেষণাগারেই থাকে, অস্ত্রোপচারের ঘরে।

নুপুর তাকিয়ে রইল — চোখে বিস্ময় আর ভয়ের মিশ্র প্রতিফলন।

পরিমল এগিয়ে এল ধীরে ধাপে ধাপে। তার কণ্ঠ যেন জমে ওঠা বরফ:

“তুমি তো খুব সাহসী, নুপুর।
তুমি তো জানতে চেয়েছিলে — আমি কেন করি, কী পাই…
এখন বলো, তোমার শেষ ইচ্ছেটা কী?”

নুপুর জবাব দিল, শান্ত গলায়:
“আপনি তো বলেছিলেন… আপনি খুন করেন না।”

পরিমলের চোখে যেন এক মুহূর্তের ঝলক —
তারপর কণ্ঠটা নিঃস্ব, ভারী হয়ে উঠল:

“তুমি অনেক কিছু জেনে গেছো।
তোমাকে জীবন্ত রেখে দিলে…
তুমি ভবিষ্যতে আমার গবেষণায় ডিস্টার্ব করতে পারো।
তোমাকে আজ ঘুম পাড়াতেই হবে।”

সে হাতটা উঁচু করল — সেই ধারালো যন্ত্রটাকে আলোয় চকচক করতে দেখা গেল।

নুপুর চিৎকার করল না।
তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে প্রস্তুত। হয়তো রক্ত নয়, কিন্তু সত্যকে নিয়ে মরার জন্য।

ঠিক তখনই…

ধাঁই!

একটা বিস্ফোরণ।

পরিমল ঘোষ ছিটকে পড়ে গেল পেছনে — ডান কাঁধে গুলি লেগে ছিটকে গেল যন্ত্রটা।

তারপর ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল অবিনাশ —
হাতের বন্দুক এখনো ধোঁয়া ছাড়ছে।
তার পেছনে দারোগা অনুপম, দুই পুলিশ কনস্টেবল।

কিন্তু যেটা সবচেয়ে অদ্ভুত —
অবিনাশের ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই পাগল লোকটি।

তার মুখে এখন আর একফোঁটা উন্মাদনা নেই।
চুল দাড়িতে ধুলোর আস্তরণ, ছেঁড়া পোশাক — কিন্তু দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাস, চোখে আগুন।

তার বাঁ হাতে বন্দুক, চোখে অচঞ্চল স্থিরতা।
যেন সেই মানুষটা আর “পাগল” নয় — যেন সব সময়েই সে জানত সে কী করছে।

পরিমল ঘোষ রক্তাক্ত, মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে।
তবু চোখে সেই পুরনো দম্ভ।

অবিনাশ তার দিকে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে থেকে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল।

তার কণ্ঠ শান্ত। কঠিন।

তিনি বললেন—
“অফিসার বিশ্বাস, অ্যারেস্ট হিম।”

“পাগল” লোকটি — যার চেহারায় আর কোনও পাগলামির ছাপ নেই —
হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে স্যালুট জানাল।
তার চোখে নির্দয় স্থিরতা।

কয়েক সেকেন্ড পরে দু’জন কনস্টেবল এগিয়ে এল,
আর পরিমল ঘোষকে তুলে নিয়ে যেতে লাগল —
অবিনাশ ছুটে গেল চেয়ারের দিকে।
নুপুর নিস্তেজ, চোখ বন্ধ, মুখটা ফ্যাকাসে।
সে তাড়াতাড়ি এক এক করে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল।

শেষ বাঁধনটা খুলতেই নুপুর শরীরটা ঢলে পড়ল…
সোজা অবিনাশের কোলের উপর।

এক মুহূর্ত…
অবিনাশ স্থির হয়ে রইল।
তার দু’হাতে নুপুরের শরীর, বুকের উপর নিঃশ্বাসের ভার।
সে তাকিয়ে রইল মেয়েটির মুখের দিকে—

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন