ভাঙাপুকুর রহস্য – ২

রাত গভীর। গ্রামের উপর তখন অন্ধকার নেমে এসেছে নিঃশব্দে। কোথাও দূরে শেয়ালের ডাক, আবার কোথাও ছেঁড়াখোঁড়া কুকুরের ঘেউ ঘেউ। তবু বাড়ির ভেতর সব কিছু যেন স্থির, নিশ্চল।

পরিমল ঘোষ ঘুমিয়ে ছিলেন ঘরের এক কোণে রাখা চৌকিতে। জানালার ফাঁক গলে চাঁদের আলো তার গালে পড়ছিল, আর কাঁথা গায়ে দিয়ে শরীরটা হালকা করে জড়ানো। এমন সময়—

ঠক… ঠক…
মৃদু এক আওয়াজ।

একবার… তারপর আরেকবার।

পরিমলবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলেও প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলেন না—এটা স্বপ্ন, না বাস্তব? কুয়াশার মতো ঘুমের আবরণটা তখনও পুরোপুরি কেটে যায়নি। আবার শব্দটা এল—

খটাস!

এইবার তিনি উঠে বসলেন। মুখে বিরক্তির রেখা, চোখে রাগ।

ঘুম ভাঙতেই চারপাশটা কেমন অচেনা লাগছিল পরিমল বাবুর। অন্ধকার ঘর, জানালার বাইরে ছায়ার নড়াচড়া—সব কিছু যেন স্বপ্নের রেশ টেনে নিয়ে এসেছে বাস্তবে। কিছুক্ষণের জন্য তিনি বুঝতেই পারছিলেন না, তিনি এখনও ঘুমের জগতে আছেন, নাকি ভয়টা সত্যিই কাছেই হাঁটছে।

“কে রে এই মাঝরাতে…!”— গলা নামিয়ে নিজেই ফুঁসলেন।

চোখদুটো আধখোলা, ঘুমের ঘোর তখনও পুরো কাটেনি। কিন্তু কানে ঠিকঠাক পৌঁছেছিল শব্দটা—কোনো কিছুর সরসরে নড়াচড়া, একটানা নয়, থেমে থেমে।
খট… খটাস…

পরিমলবাবু বিছানার পাশের লাঠিটা হাতে নিলেন। পায়ের শব্দ না তুলেই এগিয়ে গেলেন বারান্দার দিকে। তার ভেতরের গর্জে ওঠা চেহারাটা চাপা ছিল, কিন্তু চোখে ছিল কড়ামেজাজের ঝিলিক।

দরজাটা ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিতেই আবার সেই শব্দ—এইবার আর সন্দেহ নেই, বাড়ির ভেতরে কেউ ঢুকেছে।

“কে রে…?”—দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করলেন তিনি।

বারান্দা পেরিয়ে উঠোনের দিকে পা বাড়ালেন। জোছনায় ছায়া পড়ে আছে — গাছের? না, মানুষের?

হঠাৎ এক ঝটকায় একটা দেহ ছায়ার মত দৌড়ে উঠল উঠোনের এক কোণ থেকে।

“চোর!”

পরিমলবাবু লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গেলেন পেছন পেছন।

টাপ টাপ টাপ — পায়ের শব্দ ছুটছে, মাটির কাঁদা গলে উঠছে। তিনি লাঠি তুলে ছোঁ মারলেন, কিন্তু লক্ষ্য তখনও কিছুটা দূরে।

চোরটা বেড়ার কাছে পৌঁছে এক লাফে ওপারে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই অন্ধকার তাকে গিলে ফেলল।

একটানা হাঁপাতে হাঁপাতে পরিমলবাবু থমকে দাঁড়ালেন। কাঁধের ওপর লাঠিটা নামিয়ে বারান্দার দিকে তাকালেন।

শুধু নিঃসঙ্গ একটা রাত, আর মাটিতে রয়ে গেল পায়ের ছাপ—ভেজা, দাগ কাটা, যেন কিছু রেখে গেল চোরটা… শুধুই ভয় নয়, বরং কোনও অদৃশ্য সংকেত।

গ্রামে সকাল হতে দেরি লাগে না। রোদের আলো উঠোনে পড়ে থাকলেও, ঘরের ভেতর তখনও রাতের গাঢ় ছায়া লেগে।

সেই সময়েই হরিহরবাবু আর অবিনাশ চলে এলেন পরিমলবাবুর বাড়িতে।

“কি ব্যাপার পরিমল?”— সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন হেডস্যার।

পরিমলবাবু চায়ের কাপটা নামিয়ে বললেন, “রাত তিনটে কি সাড়ে তিনটে হবে, ঘুমের ঘোরে একটা শব্দে উঠে পড়ি। জানালার পাশে ছায়া দেখতে পাই, তারপর একটা লোক বেড়া টপকে পালাল। আমি লাঠি নিয়ে ছুটেছিলাম, কিন্তু ধরতে পারিনি।”

“চুরি হয়েছে কিছু?”— অবিনাশ জিজ্ঞেস করল।

“তা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু বারান্দার একপাশে একটা ছেঁড়া চটি পড়ে ছিল।”

হরিহরবাবু মুখ গম্ভীর করে বললেন, “এটা নিছক চুরি, না আরও কিছু, বলা যাচ্ছে না।”

অবিনাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “চলুন থানায় যাওয়া যাক। পুলিশকে জানানো দরকার। একের পর এক ঘটনার পর চুপ করে থাকা ঠিক হবে না।”

পরিমলবাবু একটু দ্বিধা করলেও শেষমেশ রাজি হলেন।

তিনজনে একসঙ্গে হাজির হলেন থানায়। দারোগা অনুপমবাবু তখন অফিসঘরের এক কোণে বসে, চশমা নামিয়ে কপাল চুলকে কিছু কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন।

“আরে, হরিহরবাবু! পরিমলবাবু! কি ব্যাপার?”— গলা তুললেন তিনি।

ঘটনা খুলে বলতেই অনুপমবাবু একগাল হাঁসি দিলেন।
“ঠিক আছে, একটা জেনারেল ডায়েরি নেব। আমাদের লোকজন পাঠাব, পেট্রোলিং একটু বাড়ানো হবে। বেশি ভাবার কিছু নেই।”

হরিহরবাবু সামান্য ইতস্তত করে, গলা একটু নিচু করে বললেন,
“আসলে, অনুপমবাবু… এই ধরনের ঘটনার পর গ্রামের মানুষজন একটু… অস্থির হয়ে উঠেছে। আপনি তো জানেন, আমাদের জায়গাটা সাধারণত খুব শান্ত। তাই একটু বেশি গুরুত্ব দিলে ভালো হয়।”

অনুপমবাবু কিছু না বলেই চোখ নামিয়ে কাগজপত্রে নজর ফেরালেন।

এই পর্যায়ে অবিনাশ সামনে এগিয়ে এল, তারপর জিজ্ঞেস করল,
“স্যার, আপনার কাছে একটা প্রশ্ন… এই নিরিবিলি গ্রামে এত কান্ড ঘটছে কেন?”

দারোগা অনুপমবাবু চশমাটা আবার চোখে চাপিয়ে ধীরে বললেন,
“দেখুন বাবু, নিঃশব্দ জায়গা মানেই নিরাপদ এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। শান্ত নদীর তলায়ও কিন্তু গর্ত থাকে। আমরা তো আমাদের মতো চেষ্টা করছি।”

তারপর একটু মাথা চুলকে সংযোজন করলেন,
“একজন নতুন ডি.এস.পি বদলি হয়ে আসছেন। কেসগুলো তাঁর অধীনেই যাবে। তার আগে বেশি নড়াচড়া করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।”

অবিনাশ জিজ্ঞেস করল, “কবে আসবেন আপনার এই ডিএসপি?”

অনুপমবাবু চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললেন,

“কবে আসবেন, সেটাও আমাদের ঠিক জানা নেই।”

একটু বিরক্ত সুরে, যেন নিজের অক্ষমতা ঢাকার ভঙ্গিতে যোগ করলেন,
“ওঁরা বড় অফিসার। ওদের কথা কি আমি বলতে পারি?”
একটু হেসে আবার বললেন,
“ডব্লিউ বিসিএস পাস করে এখনকার ছেলেরা ভাবে দুনিয়াটাই কিনে নিয়েছে! দেখবেন, এখনই হয়তো কোথাও  গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

তারপর কাগজের একটা কোণ ভাঁজ করতে করতে গলা নিচু করলেন,
“ডিউটি জয়েন করেছেন কিনা, সেটাও কেউ বলতে পারছে না। উপর মহলেরও সেই বিষয়ে কোনো খেয়াল নেই।”

এই সব কথা শুনে অবিনাশ কিছু বলল না। শুধু বুঝে ফেলল—এই থানায় সক্রিয়তা নয়, বরং অপেক্ষা ও অসহায়তা যেন কাজের নিয়ম হয়ে গেছে।

***

হরিহরবাবু তখন অফিসঘরে একা বসে। জানালার বাইরে তালপাতার নড়াচড়া, হালকা হাওয়া, আর সকালের রোদ জানালার কাঁচে ধুলো ছাপ ফেলে রেখেছে।
তিনি তখন হাতে একটা প্লাস্টিকের চুলকানোর হাত নিয়ে নিজের পিঠে পৌঁছাতে চেষ্টা করছেন।
নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন,
“নিজের হাতে চুলকানোর মজাটাই আলাদা, এইসব প্লাস্টিকের খেলনা দিয়ে কি আর মন ভরে…”

ঠিক তখন দরজার কাছে কণ্ঠস্বর—
“স্যার?”

তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিচিত মুখ—নুপুর, রিমার দিদি, যে হন্যে হয়ে তাঁর বোনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মুখে ক্লান্তির রেখা, কাঁধে ঝুলে থাকা ধুলো জমা ব্যাগ, চোখ লাল।
কিন্তু দৃষ্টিতে ছিল দৃঢ়তা।

“আরে নুপুর!”— চমকে উঠলেন হরিহরবাবু।
“তুমি আবার? ভেতরে এসো মা…”

নুপুর ধীরে ঘরে ঢুকে বসল, চেয়ারের বাঁ হাতা আঁকড়ে ধরে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর নিচু গলায় বলল,
“তিনদিন হয়ে গেল, স্যার। এখনো কেউ কিছু জানে না। আপনি অন্তত কিছু শুনেছেন?”

হরিহরবাবু চুপ করে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর ক্লান্ত স্বরে বললেন,
“আমি জানি না, মা। আমি সত্যিই জানি না। রিমা এমন মেয়ে ছিল, যার সম্পর্কে কখনও কেউ একটাও অভিযোগ করেনি… আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।”

“কিন্তু এখন তো বিশ্বাস না করলেই চলবে না, স্যার,”—নুপুর বলল, গলার স্বর কিছুটা কাঁপছে, “ও কোথায়, কেমন আছে… কেউ জানে না, কেউ বলছে না। আর আমি শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছি… একটা নাম, একটা চিহ্ন পাওয়ার আশায়।”

এই সময়েই দরজার দিক থেকে পায়ের শব্দ।

“স্যার, আপনি ডাকছিলেন?” — অবিনাশ।

অবিনাশ ঘরে ঢুকছে, হাতে কিছু নোট।

“এই তো, এসো অবিনাশ,”—হরিহরবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তোমার কালকের রিপোর্টটা ভালো হয়েছে। ওই সপ্তম শ্রেণির ক্লাসটা একদম ঠিকভাবে ধরেছো।”

অবিনাশ একটু হেসে বলল, “শিশুদের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক তৈরি করা একটু কঠিন, তবে ওদের কল্পনা খুব তীক্ষ্ণ।”

“তাই তো চাই। শুধু বই মুখস্থ করলেই হবে না, অনুভব করতে হবে ইতিহাস—মাটির গন্ধ থেকে উঠে আসা সময়,”—হরিহরবাবুর চোখে তখন শিক্ষকসুলভ উজ্জ্বলতা।

দুজনের কথাবার্তায় নুপুর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়।
তার মুখে একটুখানি ধুলো, চোখে হালকা ছায়া।

“আমি চলি স্যার,”—নমস্কার করে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।

কেউ তাকে থামায় না।

দরজা বন্ধ হতেই হরিহরবাবু খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন ফাঁকা জায়গাটার দিকে।

তারপর অবিনাশের দিকে ফিরে বললেন,
“নুপুর… ও রিমার দিদি। শহরে কলেজে পড়াশোনা করছিল। কিন্তু যেদিন থেকে রিমা নিখোঁজ হয়েছে, সেই দিন থেকে এ গ্রামেই পড়ে আছে। কখনও দু’দিনের জন্য শহরে যায়, আবার ফিরে আসে। ঠিক যেন—এই গাছপালা, এই মাঠের মধ্যেই কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

অবিনাশ চুপ করে থাকল। সে কিছু বলল না, শুধু এক অদ্ভুত কৌতূহল, এক অজানা দায় নিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল।

স্কুলের পেছনের দিকে একটা পুরনো অশ্বত্থ গাছ। তার ছায়ায় একটা পাথরের বসার জায়গা, রোদ আর নীরবতার মাঝখানে একাকী বসে আছে নুপুর। তার চোখ মাটিতে, হাত দুটো হাঁটুর ওপর ভাঁজ করা।

অবিনাশ একটু দ্বিধা নিয়ে ধীরে এগিয়ে গেল। জুতোয় ধুলো জমেছে, তবু পা ফেলছে আলতো শব্দে।

“আপনি একা বসে আছেন?”

নুপুর চমকে তাকায় না। কেবল মাথা নেড়ে বলে,
“হ্যাঁ।”

“আমি অবিনাশ… স্কুলে নতুন এসেছি। ইতিহাস পড়াই।”

নুপুর মুখ তুলে তাকাল। চোখে ক্লান্তি, তবু বিনয়ের রেখা।

“জানি। আপনাকে হেডস্যারের ঘরে দেখেছিলাম।”

দুজনেই চুপচাপ। বাতাসে কেবল পাতার শব্দ। তারপর অবিনাশ বলল,
“আপনি… যদি চান, আমি শুনতে পারি। কোনো উপকার হয়তো করতে পারব না, তবু… শুনে রাখতে পারি।”

এইবার নুপুর তাকায়—একেবারে চোখে চোখ রেখে। যেন যাচাই করছে, এই মানুষটিকে সত্যিই বিশ্বাস করা যায় কি না।

অবিনাশ ধীরে এগিয়ে এসে গাছতলায় নুপুরের পাশে বসে। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বাতাসে গাছের পাতার মৃদু নড়াচড়া, দূরে কয়েকটা ছাত্রছাত্রীর হাসির আওয়াজ—তবু এই জায়গাটায় যেন সময়ও থেমে গেছে।

অবিনাশ আস্তে বলল,
“শুনলাম আপনি শহরে পড়াশোনা করেন?”

নুপুর হালকা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আমি ইকোনোমিক্স পড়ি।”

অবিনাশ একটু থেমে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি আপনি কেমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে এভাবে গ্রামে পড়ে থাকাটা কি ঠিক হচ্ছে? সিস্টেমের ওপর একটু আস্থা রাখুন… কখনো কখনো সময়ই নিজের উত্তর দেয়।”

নুপুর এবার চোখ নামিয়ে ফেলল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি যদি নিশ্চিত হতে পারতাম—যে আমার বোনকে আর ফিরে পাবো না, তাহলে চোখের জল ফেলে নিজের জগতে ফিরে যেতে পারতাম।
কিন্তু আমি তো জানিই না… ও বেঁচে আছে না মারা গেছে।
যদি কেউ আমাকে এতটুকু আশা দিত, যে তাকে ফিরে পাবো, তাহলে আমি হাজারবার অপেক্ষা করতাম।”

অবিনাশ এবার গলার সুরে দৃঢ়তা এনে বলল,
“দেখুন, এখানে আসার পর থেকেই আমি আপনার বোনের ব্যাপারে শুনছি।
এমনকি এটাও জেনেছি—এর আগে আরও কয়েকজন মেয়ে অপহৃত হয়েছে।
শুধু রিমার কথা শুনলে হয়তো ভাবতাম এটা ব্যতিক্রম, কিন্তু যখন দেখছি এরকম ঘটনা একটার পর একটা ঘটছে, তখন স্পষ্ট বোঝা যায়—এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না।
আমি অনেক জায়গায় পড়েছি—হিউম্যান ট্রাফিকিং চক্র গ্রামের বাচ্চাদের টার্গেট করে।
আমার মনে হয়, এখানেও সেই রকম কোনও গ্যাং আছে… যারা মেয়েদের ধরে কোথাও পাচার করে দিচ্ছে।
সঠিকভাবে তদন্ত হলে… আমার বিশ্বাস, কিছু একটা ঠিক ধরা পড়বে।”

নুপুর শান্ত স্বরে বলল,
“আপনি জানেন, এর আগেও স্পেশাল ব্রাঞ্চ এখানে এসেছিল।
তারা নিজেরা বলেছে—একটা সংঘবদ্ধ চক্রের সন্দেহে তদন্ত চালাচ্ছে।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত… কিছুই খুঁজে পায়নি।”

অবিনাশ খানিকটা বিস্মিত গলায় বলল,
“আপনি এত কিছু জানলেন কীভাবে?”

নুপুর এবার অবিনাশের দিকে সরাসরি তাকাল। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু গলায় ভরসা।

“আমি মাঝেমধ্যে কলকাতায় যাই। কখনো স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিই,
কখনো সাংবাদিকদের দপ্তরে গিয়ে বলি—এই খবরটা প্রচার করতে।
কিন্তু তারা বলেই—‘একটা ছোট গ্রামের খবর, পাঠকরা কতটা আগ্রহ পাবে?’
তাই আমি আবার ফিরে আসি এই গ্রামে, আবার খুঁজি… নিজেই।”

শেষ কথাটা বলেই নুপুর চুপ করে গেল।

পাশে বসে থাকা অবিনাশ কিছু বলল না।
কেবল গাছের পাতার শব্দের ফাঁকে যেন তার মনে হচ্ছিল,
এই মেয়েটা শুধু একজন বোন নয়—একে একা ফেলে রাখা মানে, পুরো অন্ধকারটাকেই অস্বীকার করা।

একটা সময় নীরবতা ছুঁয়ে গেল তাদের দুজনের মাঝখানে। গাছের পাতায় হাওয়ার ঝিরঝির, দূরে স্কুলের ঘণ্টা বাজছে ধীরে ধীরে।

নুপুর ধীরে ব্যাগের চেইন খুলল। ভেতর থেকে একটা পুরনো খাতা বের করল। পাতাগুলো একটু হলুদ হয়ে গেছে, মলাটে ছেঁড়া দাগ, কোণার কাছে ভাঁজ।

“এটা রিমার খাতা,”—নুপুর বলল, “স্কুল ব্যাগে এটা পড়ে ছিল। ওর জিনিসের মধ্যে খুব বেশি কিছু পাইনি। কিন্তু এটা… এটা কেন জানি না, আলাদা লাগে আমার।”

অবিনাশ হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিল।

মলাটের পেছনদিকটা খোলা।

সেখানে রিমা নিজের মতো করে কিছু লিখেছে, এঁকেছে—যেমন ছোটরা করে।

একটা কোণে একটা বড় রঙিন গোলাকৃতি—হয়তো সূর্য, নয়তো কোনো চিন্তাজগৎ।

পাশে একটা বিড়ালের মুখ, বড় চোখ আর হালকা হাসি।

কোথাও একটা পাঁচটা আঙুলের ছাপের মতো কিছু আঁকা, কালো জেলপেন দিয়ে টানা।

আর মাঝখানে ছোট ছোট অক্ষরে এলোমেলো কিছু শব্দ—যেমন:
“রিমা আজকে খেলেনি”, “মা বকা দেয়”, “আমি পালিয়ে যাব”, “স্যার সব বোঝে না” —
এইসব টুকরো বাক্য।

কিন্তু নিচের দিকে একটা জায়গায় হঠাৎ…

একটা অদ্ভুত লেখা।

“তিনি বললেন আজ থেকে আমি সাবজেক্ট ফাইভ ই। হি হি, কি মজা।”

নুপুর অবিনাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আপনি কি বলতে পারেন এর মানে কী হতে পারে? আমি তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কে ‘তিনি’? আর এই ‘সাবজেক্ট ফাইভ ই’ কথাটা… এটা কি ওর কোনো বানানো খেলা?”

অবিনাশ কিছুক্ষণ কিছু বলল না।

তার চোখ খাতার সেই বাক্যটায় স্থির হয়ে আছে। মুখ থমথমে।

সে খাতার পাতাটা আবার উল্টে নেয়। এরপর আঙুল দিয়ে সেই জায়গাটায় আলতো ছুঁয়ে দেখে।

খেলার ছলে লেখা কিছু শব্দ হয়তো শিশুমনে কোনো এক অদ্ভুত জগৎ খুলে দেয়,
কিন্তু “তিনি”, “Subject”, এমনকি “5E” — এই শব্দগুলো যেন বেশি পরিণত, বেশি নির্দিষ্ট।

একটা পাঁচ বছর বয়সী মেয়ের খাতায় এইরকম কিছু… শুধু হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

অবিনাশের দৃষ্টি গভীর হয়ে এল। ঠোঁটের কোণে হালকা টান, যেন ভেতরে কোথাও কিছু কাজ করছে।

তার চোখ এক জায়গায় গেঁথে গেল—
“সাবজেক্ট ফাইভ ই”।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন